সৌমিত্র কর
(এই লেখাটির আরেকটি সংস্করণ বেরিয়েছে বঙ্গদর্শনে।)

সৌমিত্র কর একজন চিত্রশিল্পী। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ১৯৯০ সালের ব্যাচের এই শিল্পী বাংলার পুতুল ও লোকজ শিল্পের এক অন্যতম প্রধান গবেষক ও সংগ্রাহক। দেশে-বিদেশে তাঁর ছবি নানা প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি ফ্রেম আর্টিস্ট গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার সাঁতরাগাছিতে তাঁর বসবাস।

শরতের কোন এক দুপুর গাঁয়ের বাড়ির উঠানে দুর্গা মূর্তি গড়ার কাজ চলছে, মাটির কাজ প্রায় শেষের দিকে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মজিলপুরের বোস পাড়া। এ অঞ্চলের এক বাড়িতে জন্ম পাঁচুবাবুর। টালির চাল, দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁ হাতে ছোট্ট দালান, দেওয়াল লম্বা লম্বা কাঠের তাকে পরপর পুতুলের ছাঁচ সাজানো। দালানের একধারে কাঁচা মাটির কিছু পুতুল রাখা। বেশ কিছু পোড়ানো পুতুল ঝুড়িতে। সামনের উঠোনে কাঠের পাটায় কিছু পুতুল শুকোতে দেওয়া। মাটির খুরির বেশ কটাতে আধশুকনো রঙ রাখা। লাল, নীল, হলুদ। এমনই এক বাড়ির বাসিন্দা, পাঁচুগোপাল দাস। আমাদের পাঁচুবাবু। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই সহজ সরল আন্তরিক যেন নিজেই নিজের মধ্যে বিভোর। তিনি মাটির মানুষ, মাটির গন্ধ তাঁর সারা শরীরে, পুতুল গড়েন মাটি দিয়েই। আপাদমস্তক শিল্পী। আমার তাঁকে বাবু ডাকি। প্রশ্ন করি, বাবু মা দুর্গা গড়েন তো এখনও? পাঁচুবাবু কী ভাবছিলেন জানি না। কিছুক্ষণ চুপচাপ। জানো, এ বয়েসে সে ভাবে ঠাকুর করা হয়ে ওঠে না। শরীর দেয় না, যা করার শম্ভুই করে এখন। ঠাকুরের চোখ ওই দেয়।

শম্ভু পাঁচুবাবুর ছোট ছেলে শম্ভুনাথ দাস।
বাবু বলে চলেন, পুতুল ও ঠাকুর গড়ার শুরু আমার কাকার হাত ধরে। আমার কাকা মন্মথ দাস যাঁর পুতুল তোমার কাছে আছে। তিনি অসাধারণ কাজে করতেন। আমাদের যে পুতুল দেখছো তার অধিকাংশ ছাঁচ তাঁর হাতে তৈরি। এত পাতলা মাটির চাদরের ছাঁচ প্রায় দেখতেই পাবে না। আমার যখন বয়স তেইশ বা চব্বিশ হবে, তখন আমার শেখার শুরু, তার আগে গড়িনি কখনও। কাকা গড়তেন, তা দেখেই শেখা, হাতে ধরে শেখাননি কখনও। কাকা প্রায় একশ পাঁচটা পুতুলের ছাঁচ করেছিলেন।

বাবু আপনাদের আদিনিবাস কোথায় ছিল? আসলে আমরা যশোরের লোক। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য মোঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হন। তার মুন্সি চন্দ্রকেতু দত্ত স্বপরিবারে মজিলপুরে পালিয়ে আসেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষ যশোর ছেড়ে চলে আসেন। সে সময় আমার পূর্বপুরুষরা মজিলপুরে এসে বাসা গড়েন। আদিকালে এখানে ছিল গঙ্গা, পরবর্তী কালে যা মজে গিয়ে জনবসতি গড়ে ওঠে। নাম হয় মজিলপুর আর পশ্চিমদিকে জয়নগর। শোনা যায় দেবী জয়চন্ডীর নামে জয়নগরের নামকরণ হয়েছে।

স্বনামধন্য শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন মজিলপুরের মানুষ। তাঁর পরিবারের আদিপুরুষ মজিলপুরের শ্রীকৃষ্ণ উদ্‌গাতা। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে জয়নগর গ্রামে বসবাস স্থাপন করেন। শ্রীকৃষ্ণ উদ্‌গাতা যশোরের চন্দ্রকেতু দত্তের বাড়ির কুলপুরোহিত ছিলেন। মানসিংহ যখন যশোর আক্রমণ করেন তখন দত্ত পরিবারের সঙ্গে তিনিও মজিলপুরে চলে আসেন।
দাস পরিবারের আদিপুরুষ কালীচরণ দাসের দুই ছেলে রাম ও জানকী কলকাতার কুমোরটুলিতে প্রতিমার ডাকের সাজের কাজ শুরু করেন। এরও পরে শশী ও হরনাথ দাস মজিলপুরের বাড়িতে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু করেন।

আপনার কাকা মন্মথবাবু তা হলে পুতুল গড়তে শুরু করেন। একশ-র উপর যত ছাঁচ ছিল তাঁর, সব ছাঁচ থেকে এখন তো আপনারা পুতুল করেন না। কী কী ছাঁচ ছিল তাতে?
অনেক কিছু যেমন নারায়ণ, শিব, মাতাল শিব, কালী, নন্দী ভৃঙ্গী, কালীয়-দমন, রাধাকৃষ্ণ, সরস্বতী, কৃষ্ণকালী, বরাহ অবতার, জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা, গণেশ, জগদ্ধাত্রী, গণেশ জননী, যশোদা।
এ ছাড়া বেনে, বেনেবৌ, বাবু-বিবি, পিয়ন, মুন্সি, মেম, গোয়ালা বউ, সেপাই, বুড়োবুড়ি, মাতাল, সিংহ, বেড়াল, ঘোড়া, গরু, হাতি, বুলবুলি টিয়া থেকে কাকাতুয়ার মত পশুপাখি। অনেক ছাঁচ নষ্ট হয়ে গেছে দীর্ঘদিন না ব্যবহারের ফলে। নোনা ধরে গেছে বেশ অনেকগুলোয়। কাকার গড়া জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পায় ১৯৮৬ সালে। অবশ্য তার আগে কাকা মারা গিয়েছিলেন। সে পুরস্কার আমিই গ্রহণ করি। ইতিমধ্যে চা এসে হাজির। চা নিয়ে প্রশ্ন করলাম আমাদের বাংলায় তো নানা পদ্ধতির পুতুল গড়া হয় ধরুন, শিলেট, হিংলি বা মুখোশ পুতুল।

আপনাদের পুতুল গড়ার পদ্ধতিটা একটু বলুন না শুনি।
আমাদের পুতুলের ভেতরটা ফাঁপা। যার কাঠামো দু’ভাগে তৈরি করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই যা করে। দেবদেবী ও প্রতিমা হয় কাঁচামাটির। পুজো হয় তো, তাই পোড়ানো হয় না। শুকিয়ে রঙ করা হয়। পুতুল অবশ্য ভালভাবে পোড়ানো হয়। রঙ করার পরে লাগানো হয় রজন ও গর্জন তেল গরম করে তার প্রলেপ, চকচকে করার জন্য।
পুতুলের গঠন পদ্ধতি, পোড়ানো, চোখ আঁকার প্রকার ভেদ বা রঙের ব্যবহার সম্পর্কে বলতে বলতে পাঁচুবাবু একাত্ব হয়ে যান। জানো ভাই, শিল্পীর জীবন, কত লোক কত কী বলে তা নিয়ে ভাবলে চলবে না। মন হবে নির্লোভ, নরম প্রকৃতির।

আপনাদের আঁকা চোখ?
আমাদের আঁকা চোখ কলকাতা থেকে কিছুটা আলাদা। মূলত নিমপাতা, বাঁশপাতা বা পটলচেরা চোখ এরকম বাংলার চিরাচরিত প্রথা মেনে চলে আসছে। হরনাথ দাস আমার সেজঠাকুরদা আমাদের মতো করে চোখ আঁকতে শুরু করেন। অসাধারণ চোখ আকতেন তিনি। আমাদের গড়নে কালীঘাট পটের ছোঁয়া ছিল। অনেকেই অবাক হতেন কালীঘাট পটের সঙ্গে এত মিল দেখে।

হাতদুটি কোলের ওপর আদুল গা, পরনে ধুতি। আনমনা বাংলার পুতুলের এ ধারা চলমান রাখতে গড়ে চলেছেন পুতুল অনেক কষ্টে সৃষ্টির আনন্দে ও ঘরানার প্রতি বিশ্বাস রেখে।
আপনাদের পুতুলতো আছেই, আপনি বাংলার লৌকিক দেবদেবী সবগুলোই করেছেন শুনেছি। বাংলার লৌকিক দেবদেবী যা প্রায় শহরের মানুষরা দেখতেই পান না। আসলে শহর অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীর সে ভাবে পুজোর প্রচলন নেই। আমি বেশ কিছু গড়েছি। দক্ষিণরায়, বনবিবি, নারায়ণী আটেশ্বর, পঞ্চানন্দ, বড় খাঁ গাজি, বসন্ত রায়, পীর গোরাচাঁদ, ঝোলা বিবি, শীতলা, কালুরায় আরও অনেক আছে।
লৌকিক দেবদেবী গড়েন কেন?
আসলে লৌকিক দেবতারা গ্রাম অঞ্চলে পুজো পান। আমাদের এসব অঞ্চলের জন্য গড়তেই হয়। একটা ভাললাগা কাজ করে মনে হয়। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, বাংলার লৌকিক দেবদেবী নিয়ে বই লিখেছিলেন। আমায় বার বার বলতেন যেন লৌকিক দেবদেবী গড়া বন্ধ না করি। আসলে জানো তো গড়ার লোকও কম।

এখনকার আর্টের ঠাকুর কেমন লাগে। দেখে কষ্ট পাই, দেবদেবীর প্রকৃত রূপবর্ণনা, রঙ। এটা তো একটা চর্চা দীর্ঘকালের। প্রাণ প্রাণ। প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বল তো, দেবীকে মাতৃরূপ দিতে হবে না।
পাঁচুবাবু ও পুতুলের সংগ্রহ আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশুতোষ সংগ্রহশালায়, গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহশালায়, বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিউজিয়ামে বা বারুইপুর সংগ্রহশালায়। এছাড়াও অনেকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে। উত্তরপ্রদেশে টনকপুরে গিয়েছে দশমহাবিদ্যার দশটি কালীর রূপ, লৌকিক দেবদেবী ও পুতুল পাড়ি দিয়েছে লন্ডন শহরেও।
পুতুল বা দেবদেবীর আকর্ষণে তার কাছে এসেছেন কত মানুষ। বিশিষ্ট চিত্রকর ধীরেন ব্রক্ষ্ম, গণেশ হালুই, ভাস্কর নিরঞ্জন প্রধান, লোকশিল্প বিশেষজ্ঞ তারাপদ সাঁতরা। সকলের নাম মনে রাখতে পারেন না এখন।

বাবু, জীবনের অনেকটাই তো কাটিয়ে দিলেন কাজও করেছেন দীর্ঘদিন। আগামী দিনে কী ভাবছেন?
হ্যাঁ, প্রায় আশি হতে চলল। পাঁচুবাবুর মুখে সরল ছেলেমানুষি হাসি। এ আর এমন কী? চোখের চাওনি ছাড়া বেশ সুস্থ আছি। সেঞ্চুরি করতে চাই। অনেক কাজ বাকি আছে যে। কিছু নতুন ভাবনাও আছে মনে। লৌকিক দেবদেবী প্লেট রিলিফে ছড়াতে চাই সাধারণ মানুষের মধ্যে, অন্যভাবে। দায়িত্ব একটা থেকে যায়। আসা করি শম্ভু এগিয়ে নিয়ে যাবে পারিবারিক ঘরানা।
দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য সরকারের জন্য তথ্যচিত্র করেছেন আপনার ওপর। আপনার জীবনের দীর্ঘ কাজের ওপর। তা অনেক তো গড়লেন এ জীবনে, পারিবারিক সৃষ্টি বাড়ি জুড়ে ছড়ানো। তা আপনার প্রিয় পুতুল কোনটা? গাছের ফাঁক দিয়ে চিলতে রোদ এসে পড়েছে দাওয়ার ওপর। নীল আকাশে সাদা মেঘের গায়ে পড়ন্ত সূর্যের আলো। শরতের আকাশে পুজোর আগাম সংবাদ। পাঁচুবাবু তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। বললেন গণেশ জননী।

3 thoughts on “জয়নগরের ছাঁচের পুতুল (The Jaynagar Dolls Cast In Mold)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.