দ্যুতি মুখোপাধ্যায়

“পড়াশোনা তুলনাকমূলক সাহিত্যে, কর্মসূত্রে সাংবাদিক। আরামকেদারা বিপ্লবীও। কথায় কথায় রাজা-উজির মারার অভ্যেস অতএব মজ্জাগত, নিবাস যদিও রাজারহাট। দীর্ঘদিন নাচ শিখেছি, পেশাদার হওয়ার ক্ষুদ্র ইচ্ছা থাকলেও আমল দেওয়া যায়নি নানা কারণে, যার মধ্যে আলস্যটাই প্রধান। অগত্যা নাচ বিষয়ক তর্কে রাজা-উজির মেরে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করে থাকি।” – দ্যুতি

যে কোনও লেখার সামনে গিয়ে খুব অসহায় ভাবে দাঁড়াই আমি। শব্দেরা বরাবরই আমায় বিপদে ফেলতে পছন্দ করে, এবং দীর্ঘদিনের ব্যবহার অভ্যাসে একটা ধারণাই আমার দৃঢ়বদ্ধমূল হয়েছে – ভাষার কাজ যত না প্রকাশ করা তার চেয়ে অনেক বেশি হল আড়াল করা। কাজেই এই আড়ালে উন্মুখ ভাষাকে মাধ্যম করে যখন আমি লিখতে বসি আরেকরকম ভাষারই কথা, তখন কাজটা একটু জটিল হয়ে পড়ে বইকি।
এ ভাষা নাচের। মানে নাচটাই তো ভাষা, তার মধ্যে শরীর ভঙ্গির ভেদ বিচার করে, এক একটা ধরণ নির্ণয় করে আমরা তার নানা রকম নাম দিয়েছি। বাক ও লেখ্য, মানে যাদের আমরা সাধারণত ভাষা বলে বুঝে থাকি, তাদের সঙ্গে নাচের একটা মূলগত তফাত আছে। ভাষার প্রকাশিতব্য সীমাবদ্ধ। আমরা মুখে ধ্বনি তৈরি করি, সে ধ্বনিকে এক একটা সংকেতে চিহ্নিত করি, পরস্পরের মধ্যে সেই সংকেতের গ্রহণযোগ্যতা স্বীকার করি, তার পর গিয়ে তৈরি হয় অর্থ। আর সেই অর্থের গুণেই ধ্বনি শব্দ হয়ে ওঠে। লেখার ক্ষেত্রেও কালির আঁচড়ে কয়েকটা সংকেতকে এভাবে চিহ্নিত করে নিতে হয় আমাদের। কিন্তু এই সব সংকেত বা শব্দ অর্থনিরপেক্ষ ভাবে বক্তা বা রচয়িতার উপস্থিতির দ্যোতক হয়ে উঠতে পারে কি?
নাচ কিন্তু পারে। এক্ষেত্রে আমি মুদ্রার মাধ্যমে কোনও একটি ভাব প্রকাশের কথা বলছি না। সেটাও ওই মুখের বা লেখার ভাষারই সামিল, নর্তক ও দর্শকের মধ্যে একটা বোঝাপড়া দাবি করে তা। কিন্তু না, নাচের মূল ভাষাটি হল উপস্থিতির। যে নর্তক শরীরকে আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে তার মাধ্যমে ছন্দ ও ভঙ্গিকে ধরে রাখার একটা বিমূর্ত প্রক্রিয়া, যা পূর্বনির্দিষ্ট বোঝাপড়া ছাড়াই পৌঁছে দিতে পারে অর্থ, দ্যোতনা।
ধান ভানতে এত শিবের গীত একটিই উদ্দেশ্যে। যে বিষয়টি নিয়ে আমি এখানে আলোচনার একটা চেষ্টা চালাচ্ছি তা ভারতীয় নাচের একটি বিশেষ ধারা। এবং এমন একটি ধারা যার পত্তন একজন তথাকথিত ভাষাশিল্পীর হাতে। কাজেই ভাষা-সম্পর্কিত সামান্য পিন্ডি চটকানো তার আগ দিয়ে জরুরি হয়ে পড়ে।

রবীন্দ্রনৃত্য নামক নাচের ধারাটি এখন প্রায় মৃত। মানে মৃত তো ঠিক বলা যাবে না। এই তো সেদিন অফিসের বসন্তোৎসবে গিয়ে দেখি সেই পরিচিত দৃশ্য। দুই সাংবাদিক সহকর্মী শাড়ি পরে বাটিকের স্যাশ ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছেন, সবাই রবীন্দ্রভাবে গদগদ। ছোটবেলা থেকে এই দৃশ্য কয়েক হাজার বার দেখেছি। আমার নিজের নৃত্যশিক্ষার হাতেখড়িও এই ধারাতেই কি না। তা সেই দীর্ঘ পরিচয়ের সূত্রেই ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ পরিভাষাটি এবং তার অর্থ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও উপলব্ধি জমা হয়েছিল। এ লেখা সেটাকেই একটা পরিসরে বাঁধার (অক্ষম) প্রয়াস।
শান্তিনিকেতনে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে নাচ-গান শিক্ষাকে আবশ্যিক জায়গা দেওয়ার অনেক আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথ নাচ নিয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন, ইউরোপে সামাজিক নৃত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল, এবং সার্বিক ভাবে এই ‘দেহের চলমান শিল্প’টির সম্ভাবনা নিয়েই তিনি আগ্রহী ছিলেন। সে সময় বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষেই নাচ বিষয়টার কৌলীন্য ছিল না। প্রাকৃত জনের বিনোদন এবং অপ্রাকৃত জনের প্রাকৃত আমোদের সামগ্রী হিসেবেই তার পরিচিতি ছিল বেশি। তিরিশের দশকে যে পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের হাত ধরে আমাদের ধ্রুপদী নাচগুলি ‘ধ্রুপদী’ ও শাস্ত্রীয় তকমা পাবে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠবে, তা তখনও যবনিকার ওপারে। অশাস্ত্রীয় আধুনিক নৃত্যের পুরোধাপুরুষ উদয় শঙ্কর তখনও বিদেশে। এমন একটি সন্ধিক্ষণে বিশের দশকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একটু একটু করে শুরু করছেন ছাত্রছাত্রীদের নাচের পাঠ দেওয়া। মণিপুর থেকে, রাজস্থান থেকে গুরুদেব ডেকে নিয়ে আসছেন সে সব এলাকার নৃত্যশিল্পীদের, আর তাঁদের কাছ থেকে শেখা নাচ দিয়ে পড়ুয়া-শিক্ষকরা মিলে গড়ে তুলছেন বিশ্বভারতীর নানা উৎসবের নাচ, রবীন্দ্রনাথ রচিত গানের সঙ্গে নাচ। গুরুশিষ্য পরম্পরার থেকে এ নাচের শিক্ষা ও সম্ভাবনা দুইই আলাদা।
কেমন সে নাচ? চিত্রশিল্পের ভাষায় তাকে কোলাজের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে হয়তো। নানা রঙের, নানা ধরনের, লেখা, আঁকা কাগজ কেটে কেটে একসাথে এনে নতুন একটি ছবি তৈরি, যেখানে সেই উপাদানগুলি স্বতন্ত্র স্বাক্ষর বজায় রেখেও হয়ে উঠছে সম্পূর্ণ অন্য কোনও অর্থবাহী। তেমনই রবীন্দ্রনাথ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিচ্ছেন নানা ধারার নৃত্যে, আর সেগুলি থেকে ভঙ্গিসমূহ নিয়ে গানের আশ্রয়ে গড়ে তুলছেন আলাদা একটি নাচ। ওই বিশিষ্ট নৃত্যধারাগুলির কৌলীন্য ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে তাতে। কিন্তু তৈরি হচ্ছে নতুন অর্থ, যার ভিতরে ওই বিশেষ নাচের (সে মার্গীয় নৃত্য হোক বা লোকনৃত্য) ‘রসিক’ দর্শকের সঙ্গে পূর্বপরিকল্পিত বোঝাপড়াটি নেই। দর্শক চকিত হচ্ছেন, নড়ে বসছেন, যখন মণিপুরনৃপদুহিতা চিত্রাঙ্গদার পদছন্দে মণিপুরির লীলায়িত গতিভঙ্গিমায় এসে মিশছে কথাকলি বা ভরতনাট্যমের দার্ঢ্য।
বলাই বাহুল্য, এত নড়াচড়া, চমকিত হওয়া অনেকেরই পছন্দ হয়নি। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িকে যদি ভয় থেকে থাকে নাচের মতো কৌলীন্যহীন একটি বিষয়কে পাঠ্যক্রমে স্থান দেওয়ায় ভদ্রসমাজের প্রতিক্রিয়ার (সে সময়কার সংবাদপত্রে শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্যশিক্ষার খবর প্রকাশিত হয়েছিল মৃদঙ্গের তালে তালে ব্যায়াম অভ্যাস হিসেবে), পরবর্তী কালে একই রকম নাক সিঁটকেছেন ধ্রুপদী নৃত্যের বিশুদ্ধতাবাদীরা। রবীন্দ্রনাথের জীবতকালে, পরে, এমনকি এখনও পর্যন্ত এই নৃত্যধারা নিয়ে ধ্রুপদী নৃত্যবিদদের মধ্যে চলতি মত, কবিগুরু লেখনীর রসরাজ বটে, তবে স্বীকার করতেই হবে যে নাচ ব্যাপারটা তিনি বিশেষ বোঝেন না! সমালোচনার ধরন থেকেই স্পষ্ট, রবীন্দ্রনাথ যেটা করছিলেন তা ‘ভারতীয় নৃত্যে’র ধারণাটির মূলেই আঘাত করেছিল। নিজে অধিক না বলে শান্তিদেব ঘোষের শরণাপন্ন হওয়াই এ বার বুদ্ধিমানের কাজ, “শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের আগ্রহে যে নৃত্যধারার উদ্ভব হয়েছিল তাকে বলব ভারতীয় আধুনিক নাচ বা মডার্ন ডান্স। ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যগুলি যেমন গাননির্ভর, গুরুদেবের নৃত্য আন্দোলনের মূল ভিত্তিও হল তাই। ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য, লোকনৃত্য এবং বিদেশি নৃত্যকে গুরুদেবের গানের সঙ্গে নৃত্যভঙ্গিতে অভিনয়ের প্রয়োজনে সাজিয়ে নিতে হয়েছে। অর্থাৎ নানা প্রকৃতির নাচের মিশ্রণে এর উদ্ভব, এবং প্রয়োজনমত দেহের সাধারণ অঙ্গভঙ্গিকে স্থান দিতে হয়েছে”।
রবীন্দ্রনৃত্যের বিরুদ্ধ সমালোচনার যে ধরন তা ভারতের আধুনিক নৃত্যশিল্পীদের কাছে ভীষণ পরিচিত। এই তিরে বিদ্ধ হয়েছেন উদয় শঙ্কর, পরবর্তীকালে মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার, রঞ্জাবতী সরকাররা। রঞ্জাবতী তাঁর লেখালিখিতে বারবার স্পষ্ট করতে চেয়েছেন ধ্রুপদী নৃত্যের থেকে তাঁর নাচ কোথায় আলাদা, কিন্তু কেন তা আদ্যন্ত ভারতীয়ই। তাঁর যুক্তিজাল অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথের নাচকে ধরার চেষ্টা করা যাক। প্রতিটি ধ্রুপদী নৃত্যধারারই তো নিজস্ব একটা সামাজিক-রাজনৈতিক-আদর্শগত ইতিহাস আছে। ধ্রুপদী নাচিয়ের শরীরও তৈরি হয় সেভাবেই। উদাহরণ হিসেবে মণিপুরিকে ধরা যাক। প্রাচীন মৈতৈ সমাজ মাতৃতান্ত্রিকতার ঐতিহ্য বহন করত, সে সমাজে মহিলা পুরোহিত শ্রেণি মাইবিদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাঁদের বিশিষ্ট নাচের ধরনে সে মর্যাদার পরিচয় মেলে। সে নাচ বলিষ্ঠ, তার চলন মুক্ত। সাড়ম্বর মুদ্রা ব্যবহার নেই, কিন্তু দেহের চলন আটকায় না কোথাও। ষোড়শ শতকের পর থেকে সে সমাজে ঢুকছে উত্তর ভারতীয় হিন্দুধর্ম। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে আসা রাস নাচে পোশাকের বিশিষ্টতায় মেয়েদের চলন হয়ে আসছে বদ্ধ, চোখ হচ্ছে নিচু, গতি অবরুদ্ধ। এ ভাবেই প্রতিটি ধ্রুপদী নাচিয়ের শরীরই বহন করে তার নৃত্যধারার বিশেষ আদর্শের ছাঁচ।
রবীন্দ্রনাথ এই ছাঁচটাকেই ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। তিনি ধ্রুপদী নৃত্যধারাগুলি থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন ভঙ্গিসমষ্টিকে তুলে এনে তাদের ঢালাই করলেন নিজস্ব বক্তব্যের ছাঁচে। সৃষ্টি করলেন এমন নাচ যেখানে সেই ভঙ্গিসমূহ পাশাপাশি আসতে পারে কোনও আদর্শগত নিয়ম না মেনেই। চিত্রাঙ্গদাকে ধরতে গিয়ে চরিত্রের নিয়মেই অতএব খর্ব হবে বিশুদ্ধতা। তার দেহ মনের টানাপোড়েন শুধু ললিত মণিপুরি বা শুধু ঋজু ভরতনাট্যমে ধরা সম্ভব নয়। নিজের নিজের জগত থেকে বেরিয়ে এই দুই নাচের ভঙ্গিরা পরস্পরের হাত ধরল বলেই তো সৃষ্টি হলেন তিনি যিনি বলতে পারেন ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী’। তাতে মণিপুরি-ভরতনাট্যম দুই নাচেরই নিজস্ব রসজগত ভেঙ্গে খানখান হবে, ও তৈরি হবেন তৃতীয় এক দর্শক, যিনি এসেছেন চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের রসগ্রহণে, মণিপুরি বা ভরতনাট্যমের নয়।
এ বার প্রশ্ন ওঠে, এই যে এত বড় একটা বিপ্লবের ইঙ্গিত দিলেন রবীন্দ্রনাথ, ভারতীয় নাচের ধারণার একেবারে মূলেই আঘাত হানলেন, তাহলে তাঁর সঙ্গে ‘আধুনিক’ নৃত্য বিষয়টাকে জোড়া হয় না কেন? উত্তরটা রবীন্দ্রনাথের কাছে পাওয়ার উপায় নেই, বরং বলতে পারবেন তাঁর সৃষ্টির স্বঘোষিত অভিভাবকরা।
আমি ছোটবেলা থেকে যে প্রতিষ্ঠানে নাচ শিখেছি সেটির পত্তন রবীন্দ্রনাথের এক ছাত্রের হাতে। উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের নৃত্য-গীত ভাবনার ঐতিহ্য বহন। সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রনৃত্য শেখানো হয় রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ‘বিশুদ্ধ’ পদ্ধতি মেনে (অচলায়তন মনে পড়ছে কি?)। এই নৃত্যশিক্ষা পদ্ধতি কী রকম? আমাদের দুটি ধ্রুপদী নৃত্য শেখানো হত, ভরতনাট্যম ও মণিপুরি। ওই প্রতিষ্ঠানে আমার ৯ বছরের শিক্ষাজীবনে কোনও ধ্রুপদী নৃত্য পরিবেশনায় আমি অংশ নিইনি। অংশ নিয়েছি বর্ষামঙ্গলে, নবীনবরণে, নৃত্যনাট্য পরিবেশনায়। ধ্রুপদী নৃত্যের মত সাড়ম্বর পোশাক নয়, কিন্তু আমাদেরও বাঁধা থাকত ইউনিফর্ম।. সাধারণ কুঁচি দিয়ে পরা শাড়ি, কাঁধে ও কোমরে উত্তরীয় (বাটিকের হলেই ভাল), টানা টানা চোখ, বাধ্যতামূলক রুপোলি গহনা। একটু বড় হয়ে আমরা যখন একক নাচের সুযোগ পেয়েছি, তখন আমাদের উতসাহ দেওয়া হয়েছে এই দুই নাচের ভঙ্গিভাণ্ডার থেকে ধার করে নিজস্ব নাচ গড়ে তুলতে। ইচ্ছেমতো বেছে নিতে বলা হয়েছে নদীর চলন, ঝড়ের গতি, হৃদয়বেদনার মুদ্রা। এত তো স্বাধীনতা। তা হলেও একটু বড় হওয়ার পর থেকেই, মানে নাচ ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবার মতো বড় হওয়ার পর থেকেই সংশয় কেন চেপে বসল?
সংশয় বহুবিধ। প্রথমত, এই স্বাধীনতারও একটা সীমা ছিল। পরম্পরা রক্ষকদের মত ছিল, রবীন্দ্রনাথের নাচ মণিপুরি আশ্রয়ী। কাজেই চলন কাঠামো হতে হবে অনুরূপ। ব্যক্তিগত ভাবে মণিপুরি নৃত্যধারা পছন্দ করার কারণে এই সীমাবদ্ধতায় তখন অবশ্য আমার অসুবিধা হয়নি (বা হয়তো এই আদর্শগত শিক্ষা থেকেই মণিপুরি নিয়ে অতিরিক্ত ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল, কে জানে!)। দ্বিতীয় সংশয়টা অনেক গভীর, ও সার্বজনীন। আমাদের নাচের পরীক্ষাগুলি দিতে হত ধ্রুপদী নৃত্যধারাতে। বাইরে থেকে সেই নৃত্যধারার এক এক জন গুরু এসে পরীক্ষা নিতেন। আমাদের অধিকাংশ নৃত্যশিক্ষিকাও ছিলেন মূলত ধ্রুপদী নৃত্যধারাতেই শিক্ষিত। এই জগতটা আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রায়ই নাক সিঁটকাত। ‘তোমাদের টেকনিক বড্ড ভুলভাল’, কতবার শুনেছি। আর আমরাও তো অবাক হয়ে দেখতাম, ভরতনাট্যম দিদিমণির পিঠ কেমন যেন বেশি সোজা থাকে সব সময়েই, মুদ্রাগুলো আরও কত কাটা কাটা। আমার হাত-পা এলিয়ে যায়, অভিযোগ তাঁর। আবার মণিপুরি দিদিমণির মতে, আমি নাকি বড্ডই কাঠ কাঠ, হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে নাচি। লাও ঠ্যালা!
এই ঠ্যালা সামলাতে যারা মোটামুটি নাচ নিয়ে সিরিয়াস তারা ডিপ্লোমা পাওয়া মাত্রই গিয়ে নাম লেখাতো কোনও বিশুদ্ধ ধ্রুপদী নৃত্য প্রতিষ্ঠানে, শাস্ত্রীয় ছকে বেঁধে নিত জীবন। বাকিদের ক্ষেত্রে বিবাহ বাজারের সিভিতে একটি অতিরিক্ত গুণ যোগ করা ছাড়া রবীন্দ্রনৃত্য আর কোনও কাজে লেগেছে বলে আমি দেখিনি।
মুশকিলটা হল, রবীন্দ্র সংস্কৃতির যাঁরা ধ্বজাধারী, তাঁরাও বোধহয় এই নৃত্যধারাটির জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু চাননি। রবীন্দ্রনৃত্য মানে এইই। সেই কবে বিশ শতকের শুরুতে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ও তাঁর সহযোগীরা যে যে নাচ থেকে উপাদান আহরণ করে সেগুলি যে যে ভাবে মিশিয়ে গানের সঙ্গতে একটা নতুন প্রকাশমাধ্যম তৈরি করেছিলেন, সেই কাঠামোটিকেই ছাঁচে খোদাই করে বছরের পর বছর ছাপ্পা মেরে যাওয়া। সময়ের নিয়মে যেমন তা তরলীকৃত হয়েছে, তেমনই অন্য দিকে তার অর্থ সম্ভাবনারও বিস্তার, পরিবর্ধন, পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু নাচে নতুন রক্ত ঢোকেনি, আর সেটা করা হয়েছে সচেতনভাবেই। শান্তিদেব ঘোষ তাঁর বহুবিধ সমস্যা-সংস্কার সত্ত্বেও একটা জিনিস ঠিকই ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনৃত্যকে কোনও তথাকথিত school of dance বলাটা ভুল হবে, সেটা বরং একটা নতুন ভাবনার, ভাবধারার দ্যোতক। পরবর্তীকালের রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা কিন্তু ঠিক এই ভুলটাই করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তো নাচকে সামাজিক জীবনের অঙ্গ করে তুলতেও চেয়েছিলেন। সেখান থেকেই আসছে নৃত্যকে শরীরের স্বাভাবিক সহজাত ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার চিন্তা। সেখান থেকেই বসন্তোৎসবের প্রভাতফেরীতে অনায়াস জায়গা করে নিচ্ছে পশ্চিম ভারতের গোষ্ঠীনৃত্য ডান্ডিয়া। এই সব সামাজিক নৃত্যের সুখস্মৃতি পাঠভবনের পড়ুয়ারা সারাজীবন বহন করবেন, তা তাঁদের ব্যক্তিগত পাওয়া। নাচ নামক শিল্পমাধ্যমটির তাতে লাভের লাভ কিছু হয়নি।
অথচ হওয়ার তো কথা ছিল। রবীন্দ্রনৃত্যের ধারণার মূলেই আছে স্বাধীন চলনের শিক্ষা। সমসাময়িক দিয়ে নাচের আঙ্গিক ও উপাদান নির্ধারণ করার শিক্ষা। তা সেই ছকভাঙ্গার নাচকে যখন ছকে ঢালাই করা হল সেখানে ফাঁকির ভাগটাই বসল গেঁড়ে। এই অসুখটা দেখেছি আমার ঐ প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে। একটা নতুন নাচ তৈরির সময় কখনই বিশেষ খাটতে দেখিনি তাঁদের। ‘গত ফাংশনে এই গানটায় কী হয়েছিল মনে নেই? ব্যস, ওটাই করে দে’। স্টেজে মেরে দেওয়ার আত্মবিশ্বাস আমার সম্ভবত তৈরি হয়েছে এখান থেকেই। এই ৮ ঘণ্টার শিফটে অফিস ঠেলা নিতান্ত স্থূলকায় আমাকেও যদি কোনও একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে বলা হয় এক্ষুনি নাচ, আমি ঠিক নেচে দেব। এবং হাততালিও পাব। আমার দর্শক, রবীন্দ্রনৃত্যের দর্শক তো ওই হাত ঘুরুঘুরু সহজ ললিত ছকটার বাইরে আমার থেকে কিছু প্রত্যাশাই করেন না।
এ বার আমার সেই শিক্ষাগুরুদের নৃত্যপ্রতিভা নিয়ে আমি সংশয় প্রকাশ করছি না। তাঁরা আমার থেকে অনেক বেশি করে নাচের মধ্যে আছেন। তাঁদের নিজেদের নাচের স্কুল আছে, ধ্রুপদী নাচের স্কুল। সেখানে তাঁরা প্রশ্নাতীত ভাবে একনিষ্ঠ। কিন্তু আমাদের সেই প্রতিষ্ঠানে তাঁরা প্রায় কোনও শ্রমই ব্যয় করতেন না। ‘ও তো সহজ নাচ’। সমস্যা এটাই। রবীন্দ্রনৃত্য নাচ নয়, ‘আসল’ নাচ হল ধ্রুপদীই। এই ছেলেখেলা সিন্ড্রোম থেকে যদি খোদ শিল্পীরাই না বেরোতে পারেন তাহলে সে নৃত্যধারাকে বাঁচিয়ে রাখে কার সাধ্যি। হয়েছেও তাই। অফিসের বসন্তোৎসবে বা পাড়ার ফাংশনে সহকর্মী বা কাকু-কাকিমার স্নেহবর্ধন ছাড়া এই মুহূর্তে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে রবীন্দ্রনৃত্যের আর কোনও ভূমিকা নেই। ভাসানের নাচ এর থেকে অনেক বেশি নৃত্যগন্ধী একটা বিষয়।
অথচ যদি এই পথ পরিক্রমাটাই অন্য রকম হত? কী হতে পারত তার একটা উদাহরণ আমরা পেয়েছি মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার ও তাঁর হাতে গড়া ডান্সার্স গিল্ডের এক সময়ের পরীক্ষা-নিরিক্ষায়। মঞ্জুশ্রীর পেশাদার মঞ্চে নৃত্য পরিবেশনা শুরু রবীন্দ্রনাথের গান, নৃত্যনাট্যের হাত ধরে। কিন্তু এককালে গণনাট্য সঙ্ঘে যুক্ত, বিশ্বভারতীর অন্যতম চক্ষুশূল গায়ক দেবব্রত বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ মঞ্জুশ্রীর নৃত্যধারণা তাঁর আদর্শগত অবস্থান থেকেই রবীন্দ্র-প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপরীতে হেঁটেছে। রবীন্দ্রনাথকে মঞ্জুশ্রী দেখেছেন তাঁর ধ্রুপদী ছক ভেঙ্গে দেওয়ার বৈপ্লবিক সম্ভাবনা থেকে। বিশ্বভারতীর মতো রবীন্দ্রসৃষ্ট ফর্মটিকে অন্ধ অনুসরণ না করে তার আদর্শটিকে মঞ্জুশ্রী গ্রহণ করলেন। ‘তোমারি মাটির কন্যা’, ‘তাসের দেশ’-এর মতো রবীন্দ্র-আশ্রয়ী সৃষ্টির পাশাপাশি সমান তালে মঞ্জুশ্রী ও পরবর্তীকালে তাঁর কন্যা ভারতীয় আধুনিক নৃত্যের দিকপাল শিল্পী রঞ্জাবতী রচনা করে গিয়েছেন ‘অরণ্য অমৃতা’, ‘গঙ্গোত্রী’র মতো স্বাধীন পরিবেশনা। রবীন্দ্রনাথের থেকে ধ্রুপদী আশ্রয়ী হয়েও ধ্রুপদী ছক না মানার যে ধারাটি তাঁরা নিয়েছিলেন, এর সবকটিতেই কিন্তু তার প্রয়োগ ঘটেছে।
আর তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা গভীর চিন্তা-ভাবনা করেছেন এই নৃত্যধারার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা কী হতে পারে তা নিয়ে।  বিশেষত রঞ্জাবতী তাঁর নাচ সংক্রান্ত লেখালিখিতে একাধিক বার এই পদ্ধতিগত প্রশ্নটি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। মঞ্জুশ্রী-রঞ্জাবতী নৃত্যজীবনের দীর্ঘ অংশ ধরে ভেবেছেন, ধ্রুপদী পরম্পরার বাইরে গিয়ে কী ভাবে একজন নাচিয়ের শরীরকে নাচের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা যায়।
এই ভাবনাটার প্রয়োজন ছিল। আধুনিক নৃত্যধারণার মূল কথাই হল নিয়ম নির্ভরের বিপ্রতীপে ভাবনা নির্ভর নাচ। রঞ্জাবতী যেমন লিখছেন তাঁর লক্ষ্যের কথা, শরীরকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যে আমি কতটা পারব ভেবে নাচব না, আমি কী নাচব ভেবে নিয়ে শরীরকে সেই মতো পারাব। এখন, যে কোনও নাচিয়ের কাছেই এই সমস্যাটা খুব স্পষ্ট। শারীরিক সক্ষমতা ও প্রকাশের ইচ্ছার মধ্যে টানাপোড়েন এক অনন্ত, ঘটমান প্রক্রিয়া। আর এর বাস্তব অসুবিধাগুলি মারাত্মক। শারীরিক আঘাত, পঙ্গুত্ব থেকে মানসিক অস্থিরতা – সবটাই চলে আসতে পারে। ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী এই টানাপোড়েনের বাইরে নন মোটেই। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে সুবিধা (যদি সুবিধা বলা যায়) একটাই। প্রতিটি ধ্রুপদী নৃত্যের প্রকাশভঙ্গীর সম্ভাবনা সীমাবদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ যে নৃত্য আদর্শের সন্ধান দিয়েছিলেন, তার ভঙ্গি-সম্ভাবনা অসীম। মঞ্জুশ্রী এই অসীমত্বের বিপদগুলি বুঝেছিলেন বলেই প্রশিক্ষণের উপর এত জোর দিয়েছেন। তাঁদের নবনৃত্য তৈরিই হয়েছে নাচিয়ের শরীরের ভারসাম্য নষ্ট না করে তার সক্ষমতা চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য থেকে (এর গুণবিচারে যাওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই, বিস্তারিত ধারণা পেতে ঐশিকা চক্রবর্তী সম্পাদিত Ranjabati: A Dancer and Her World বইটি পড়ে দেখা যেতে পারে)। রবীন্দ্রনাথের মত তাঁদের ধারাও ধ্রুপদী নৃত্যকে রাখছে হাতের কাছে,  তার থেকে আহরণ করছে প্রাণবস্তু। কিন্তু রবীন্দ্রনৃত্যের মত সেই আহরণের মাপকাঠি ‘শান্তিনিকেতনে কি হইয়াছিল’ থাকছে না। মাপকাঠি হচ্ছে নাচকে, নাচিয়ের শরীরকে স্বতন্ত্র মাধ্যম করে তোলার প্রয়োজনটুকু।
লেখার একদম প্রথমে যে বিষয়টা তুলেছিলাম,সেই উপস্থিতির প্রশ্নে এবার ফেরত যাব। রবীন্দ্রনাথের নাচ হয়ে উঠেছিল তাঁর কথাশিল্প প্রকাশেরই একটি মাধ্যম, ধ্রুপদী ছক ভেঙ্গেছিল প্রকাশিতব্যের অভিনবত্বের তাগিদে। মঞ্জুশ্রী-রঞ্জাবতীরা সেই ছকভাঙ্গার ধারণাটিকেই আর একটু বিস্তৃত করে দিয়ে তার প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন নাচিয়ের উপস্থিতিকে প্রকাশের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, আমি যখন নাচছি তখন আমার বিদ্যেবুদ্ধি, আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি – মোট কথা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছকে আমার অবস্থানটা দিয়েই বেছে নিচ্ছি আমার হস্তমুদ্রা,আমার গতি, আমার চোখের চলন, আমার ওঠাবসার পরিমাপ। আর সেটা আমি নিচ্ছি ধ্রুপদী নৃত্যধারার যুগসঞ্চিত ভাণ্ডার থেকেও।
এবার পাঠক বলবেন এটাও কি একটা আদর্শ পরিস্থিতিই হয়ে গেল না, ঠিক যেটার ফাঁদে পড়ার দায়ে আমি অভিযুক্ত করেছি আমার পুরনো প্রতিষ্ঠানটিকে? একদমই তাই। সেই কারণেই হয়তো ১৯৯৯ সালে রঞ্জাবতীর আত্মহত্যা ও ঠিক পরের বছর রোগভোগে ভগ্নহৃদয় মঞ্জুশ্রীর মৃত্যু থমকে দিতে পারে নবনৃত্য আন্দোলনকেও। ডান্সার্স গিল্ড এখনও আছে। ছোটবেলায় সেখানকার ছাত্রী এক দিদির সঙ্গে সঙ্গে লেপ্টে থেকে খানিক সুযোগ হয়েছিল নবনৃত্য চেখে দেখার। তখন বেশ নতুন জগতের স্বাদ পেয়েছিলাম। কিন্তু বছর কয়েক আগে তাদের অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে হতাশ হয়েছি। মঞ্জুশ্রীর নাচ আমি দেখিনি, রঞ্জাবতীর ‘অরণ্য অমৃতা’ দেখেছি দূরদর্শনে। সেটা ১৯৮৯ সালের নৃত্যনির্মিতি। ২০১০-১১য় ডান্সার্স গিল্ড তার চেয়ে খুব বেশি এগোয়নি। পোশাক ভাবনা থেকে শুরু করে সমবেত নৃত্যের formation, ৮০-৯০-এর দশকেই পড়ে আছে। সে নাচের ভাবনার খোরাক দেওয়া, দর্শককে নাড়া দেওয়া তো দূর, নিদেন পক্ষে চমকে দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও যেন নেই।
এটাই হয়েছে বারবার, সম্ভবত এটাই হওয়ার। পরীক্ষা-নিরিক্ষায় ভাঁটা পড়লেই প্রতিষ্ঠান অচলায়তন হয়ে জাঁকিয়ে বসবে। রবীন্দ্রনাথ তো আর তাঁর প্রবর্তিত নাচকে রবীন্দ্রনৃত্য বলেননি, তাঁকে যাঁরা ঠাকুর বানিয়েছেন তাঁরাই পরিভাষাতেও বেঁধেছেন। কিন্তু মঞ্জুশ্রী-রঞ্জাবতীরা তো চেষ্টা করেছিলেন নৃত্যরত শরীরের সম্ভাবনাগুলিকেই খুলে দেওয়ার, এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার যা নাচিয়েকে নিজের প্রকাশ নিজেই তৈরি করার সুযোগ করে দেবে। রঞ্জাবতীর নিজের ভাষায় এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করা যেখানে “The body of the dancer always has its own presence and being, regardless of the form explored.” তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানও কিন্তু ভুলে গেছে সে কথা। আসলে প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে হয়তো এটাই হবে। মাস মাইনে দিয়ে বছর বছর ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়মে বেঁধে নাচ শেখাতে হলে হয়তো ভাবধারা নিয়ে চিন্তার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। রঞ্জাবতীর আত্মহত্যার পিছনেও এমন একটা টানাপোড়েনের দিকেই ইঙ্গিত করেন গবেষকরা। মায়ের দুরারোগ্য ব্যাধি রঞ্জাবতীকে বাধ্য করেছিল ডান্সার্স গিল্ড পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে। কিন্তু ৩৬ বছর বয়সে নিজের সবচেয়ে সৃজনশীল সময়টিতে প্রতিষ্ঠান চালানোর গুরুদায়িত্ব বহন করতে সম্ভবত যথেষ্ট প্রস্তুত ছিলেন না রঞ্জাবতী।
প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরেই কি তবে খুঁজতে হবে পথ? এ ক্ষেত্রেও রাস্তা দেখিয়েছেন সেই বৃদ্ধই। শান্তিনিকেতনে কর্মশালা পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময় ধরে এক এক জন গুরুর কাছে নাচ শিখেছেন ছাত্রছাত্রীরা। পরবর্তীকালে পাঠ্যক্রমের চাপে বন্ধ হয়েছে এই নতুন নতুন জানাশোনার আসর, নাচের সজীবতাও গেছে। সমসাময়িক নাচের জন্য সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের চেয়ে অনেক বেশি উপযোগী কর্মশালা ও artist collaboration পদ্ধতিই। সারা বিশ্ব জুড়েই এ ধরনের পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশ বাড়ছে। এ পোড়া বঙ্গদেশে অবশ্য পথিকৃতকে পুজো করা হয়, তাঁর ভাবনা নিয়ে ভাবার লোক বিশেষ নেই। ফলে বছর বছর খারাপ থেকে খারাপতর ‘সমসাময়িক’ নৃত্য পরিবেশনা হয়েই যাবে। এবং ধ্রুপদী নৃত্যধারাগুলি নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও স্বাতন্ত্রের মধ্যে তফাত করতে না পেরে ‘সমসাময়িক’ হয়ে ওঠার চেষ্টায় সেই তালিকা বৃদ্ধি করবে। উদাহরণ দিই? এই সেদিন দেখলাম কত্থক নৃত্যশিল্পী অসীমবন্ধু ঘোষ ও মণিপুরি নৃত্যশিল্পী বিম্বাবতী দেবী যৌথ প্রযোজনা করছেন ‘আঁধার ঘরের রাজা’, রবীন্দ্রনাথের শাপমোচনের অনুসরণে। জমকালো মঞ্চ, চোখধাঁধানো আলো, সুচারু পোশাক ভাবনা সব ঠিক আছে। নাচটাই তো মিশ খেল না। রাজা চরিত্রে অসীমবন্ধু ও সুদর্শনা চরিত্রে বিম্বাবতী নিজের নিজের ধারায় নেচে গেলেন। অনেকটা সেই কেন্দ্রীয় সরকারি অনুষ্ঠানগুলোয় সব ধরনের নাচ একসঙ্গে স্টেজে গুঁজে দেওয়ার ধ্রুপদী ফিউশনের মতো। আর একবার বিশুদ্ধ ভরতনাট্যমে চিত্রাঙ্গদা অভিনয় দেখতে গিয়েছিলাম। আধ ঘণ্টা পর পালিয়ে বেঁচেছি।
তা হলে খাড়াইল কী? কিছুই না বলতে গেলে। নাচের মূল ভাষা যে উপস্থিতিরই, সেই ধারণা ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যে নেই। আর বিশ্বায়িত বিশ্বে ভারতীয়-অভারতীয় তর্কটাও অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যায়িত। সমসাময়িক নৃত্য আলাদা হয়ে যায় নাচিয়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করেই। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যভাবনায় এ স্বীকৃতির সম্ভাবনা ছিল। তাঁর প্রতিষ্ঠান তা দেয়নি। তবে একটা জিনিস দিয়েছে। সংশয়। রবীন্দ্রনৃত্য ও নবনৃত্য এই দুই ধারার সঙ্গেই খুচরো খুচরো পরিচয় আমার মধ্যে এই সংশয়কে পুরে দিয়েছিল বিরাট ভাবে। অনেক সুযোগ হারিয়ে এবং আলস্যের মাশুল দিয়ে দিয়ে আজ বুঝতে পারি, এই সংশয়কে ধারণ করতে পারা বা না পারাই একজন সমসাময়িক নৃত্যশিল্পীকে ভাঙ্গে-গড়ে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি যতই অপর্যাপ্ত হোক না কেন, নিহিত আদর্শটিকে তো কোথাও না কোথাও ধারণ করেই আছে। বিশুদ্ধ রবীন্দ্রনৃত্য ঘরানার শিল্পী পূর্ণিমা ঘোষের অসামান্য প্রাণবন্ত নাচ এখনও চোখে ভাসে আমার। সেই ছাপ্পা মারার কারখানাতেই তিনিও তো ছিলেন।
রবীন্দ্রনৃত্য থেকে প্রাপ্তি বোধহয় এই সংশয়টুকুই। ভাবতে ভাল লাগবে, আমার সঙ্গে যাঁরা পাশ দিয়ে বেরিয়ে নাচকেই ধ্যানজ্ঞান করেছিলেন, সেই প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর ভিতরে এই সংশয় জন্মেছে। তাঁরা যদি কোন ধারায় নাচছি তা নিয়ে না ভেবে নাচছি এটাই ভাবার শিক্ষাটুকু গ্রহণ করতে পারেন রবীন্দ্রনাথের থেকে, তাহলে হয়তো আশার কথা আছে এখনও।
তথ্য ঋণ স্বীকারঃ
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য, শান্তিদেব ঘোষ
Ranjabati: A Dancer and Her World, Ed. Aishika Chakraborty

4 thoughts on “রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক নাচ সম্পর্কে কিছু অদরকারি কথা

  1. এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। আমিও তুলনামুলক সাহিত্যের ছাত্রী। মনিপুরী নাচ শিখেছি এবং এখন করে চলেছি। লেখাটা খুব খুব ভাল লাগল পড়ে।
    শুধু একটাই প্রশ্ন- আমার যতটুকু জানা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনিপুরী আর কথকলি, এই দুই নৃত্য ধারাকেই তার পাঠ্যক্রমে রেখেছিলেন। ভরতনাট্যমের প্রতি তার আগ্রহ বিশেষ ছিল না। কবির বৃদ্ধ অবস্থায় একবার শান্তিনেকেতনে, নৃত্যশিল্পী রুক্মিনি দেবি আরুন্ডাল ওনার সামনে নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন, তখন ওই নৃত্য ধারার প্রতি তার ভাললাগা তৈরি হয়েছিল। জানিনা এই তথ্য ঠিক কিনা, তবে এখনও বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনে কথকলি নৃত্যটি শেখানো হয়।
    আর একটি বিষয়- এখন West Bengal Dance Group Federation রবীন্দ্র নৃত্যে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। শুনে তোমার ভালো লাগবে।
    আরো এরকম জোরালো লেখার আশায় থাকব। ভালো থেকো।

    1. অনেক ধন্যবাদ অন্তরা। আমরা লেখককে আপনার কথা জানিয়েছি। দ্যুতির এই লেখাটি পরিবর্ধিত রূপে আমাদের বইমেলা ২০১৬ (প্রিন্ট) সংখ্যাতেও বেরিয়েছে। আপনি পড়তে চাইলে আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।

  2. নিজের বেশিরভাগ পুরোনো লেখা পড়লেই আমার এখন কান্না পায়, এটা পড়লেও পায় কিঞ্চিৎ। তাই ব্যাপারটা আপনাকে নাড়া দিতে পেরেছে জেনে স্বস্তি পেলাম। আপনি ঠিকই বলেছেন, ভরতনাট্যম শান্তিনিকেতনের পাঠ্যক্রমে ছিল না। কিন্তু আমি শান্তিনিকেতনে শিখিনি, শিখেছি সুরঙ্গমায়। সেখানে ভরতনাট্যম ও মণিপুরী এই দুটিই শেখানো হত। এই লেখায় ভরতনাট্যমের উল্লেখ মূলত এসেছে দেখবেন আমার নিজের অভিজ্ঞতার সূত্রে, অথবা উদাহরণ হিসেবে। আর পারলে ছাপা সংখ্যাটির সংস্করণটা পড়ে ফেলুন। সেটা পড়লে আমার আরেকটু কম কান্না পায়। 🙂

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.