তৃণা নিলীনা বন্দ্যোপাধ্যায়

(১)

পূর্বকথন : মণিপুরের ঔপনিবেশিক অতীত ও বর্তমান

হেইসনাম কানহাইলাল “পেবেত” নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ করেন ১৯৭৫ সালে ইম্ফল শহরে। ভারতে তখন জরুরী অবস্থা চলছে। মণিপুরের রাজনীতিতেও এই সময় টালমাটাল অবস্থা। ইম্ফল শহরে এবং তার আশেপাশের গ্রামীণ এলাকাগুলিতে ভারতীয় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে জনরোষ বেড়েই চলেছে। বহু ছোটখাটো জনসংগঠন এই সময়ে গড়ে উঠতে শুরু করেছে যারা মেইতেই গোষ্ঠীর সত্ত্বা ও অস্তিত্বের লড়াই বিষয়ে মুখর হয়ে উঠছে। এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলিরই পথ অনুসরণ করে পরবর্তীকালে, অর্থাৎ ১৯৮০ এবং ৯০-এর দশকে, এক সার্বিকভাবে জোরালো রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে যার অনেকগুলি দাবীর মধ্যে একটি ছিল ভারতের আধিপত্য ও শাসন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। ৭০-এর দশক থেকেই, এই বেড়ে উঠতে থাকা সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলি সাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে থাকে এবং মণিপুরী মানুষজনকে মনে করিয়ে দেয় ১৯৪৭-এর ‘স্বাধীনতা’ পরবর্তীকালে ভারতীয় রাষ্ট্রের আগ্রাসনের ইতিহাস। এই ইতিহাস বিষয়ে আমরা কিছু পরে বিশদে কথা বলব।

অবশ্যই, ১৯৪৯-এর রাজনৈতিক অধিগ্রহণই মূল ভূখণ্ডের এই অঞ্চলের ওপর প্রথম আগ্রাসনের নিদর্শন নয়। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সভ্যতার মণিপুরের ওপর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস আরও অনেক পুরনো ও সুদূরপ্রসারী। তারই প্রেক্ষিতে আমাদের বুঝতে হবে ৬০ ও ৭০ দশকের এই মেইতেই সাংস্কৃতিক পুনরুত্থানকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রাজা চরাই রংবা-র শাসনকালে (১৬৯৭ খৃ-১৭০৬ খৃ) আসাম ও বঙ্গের সাথে যোগাযোগের ফলে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব মণিপুরে বাড়তে থাকে। তবে এই প্রভাববৃদ্ধি জনগণের নিজেদের মধ্য থেকে উৎসারিত কোনও স্বাভাবিক বা স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘটে না। বরং এটি সংগঠিত হয় মণিপুরের তৎকালীন রাজাদের খেয়ালখুশি মাফিক, কিছুটা জোর করে আর খানিক শাস্তির ভয় দেখিয়ে। ১৭০৯ সালে গরিব নিওাজ রাজা হওয়ার পর, বিভিন্ন মণিপুরি ঐতিহাসিকদের মতে[1], বৈষ্ণব ধর্ম একরকম জোর করেই মণিপুরী জনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। হিন্দু ধর্ম হয়ে ওঠে মণিপুর রাজ্যের সরকারী ধর্ম অথবা ‘স্টেট রিলিজিয়ন’। এর আগে, রাজা চরাই রংবা শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবে পৈতে ধারণ করেছিলেন। জনতার ওপর তিনি তাঁর নিজের বিশ্বাস চাপিয়ে দেননি, না মেইতেইদের নিজস্ব ধর্মকে কোনভাবে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। গরিব নিওাজ কিন্তু ব্যক্তিগত ধর্মাচার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেন না। এই অঞ্চলের পরম্পরাগত ধর্মকে (যাকে আজ “সানামাহি” ধর্ম বলা হয়) সরিয়ে রেখে জনতাকে বাধ্য করলেন হিন্দু ধর্ম মেনে নিতে। এতে মণিপুরের রাজবংশের ও শাসনব্যবস্থার প্রত্যক্ষ মদতদারি ছিল। উপরন্তু, যারা এই আচার-অনুষ্ঠান মেনে চলতে অস্বীকার করেন বা সানামাহির রীতিনীতিগুলি চালিয়ে যেতে থাকেন তাদের জন্য বরাদ্দ হয় কঠোর শাস্তি।

এই রাজকীয় ধার্মিক আস্ফালনের এবং অত্যাচারের ফল হয় নানাবিধ। সানামাহির ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের (“মাইবা”) তরফ থেকে গরিব নিওাজের বিরুদ্ধে একধরনের বিদ্রোহ গড়ে ওঠে, কিন্তু তা বেশীদিন টেঁকে না। অন্যদিকে সানামাহি ধর্মের আচার-আচরণকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে ফেলা অসম্ভব প্রমাণিত হয়। বরং যেটা ঘটে সেটা হল দৈনন্দিন আচার-আচরণে সানামাহি ও বৈষ্ণব ধর্মের এক ধরনের অদ্ভুত সংমিশ্রণ। এক ধর্মীয় পরতের ওপর চাপে আরেক পরত; তবে পূর্বের পরতটি সম্পূর্ণ মুছে যায় না। তৈরি হয় একধরনের ‘পালিম্পসেস্ট’[2]। যেমন পরম্পরাগত ‘লাই হারাওবা’ উৎসবের মধ্যে আমরা আজও দেখতে পাই বৈষ্ণব ধর্মাচারের কিছু ছায়া। আবার মণিপুরের ‘রাসলীলা’ উৎসব সারা ভারতের রাসলীলার থেকে বহুলাংশে আলাদা — সাজপোশাক, মণ্ডপসজ্জা এবং বিশেষত নৃত্যগীতের মধ্যে দেখা যায় ‘লাই হারাওবা’র নাচের বা ‘থাংতা’[3]-র চলনের ছাপ।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের মেইতেই সমাজ সম্পর্কে যে সমস্ত গবেষণার কাজ আজ পাওয়া যায় তার মধ্যে বেশিরভাগই সেইসময়কার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের কর্মচারীদের লেখা। যদি বলা যায় যে নৃতত্ত্ববিদ্যা অথবা মানচিত্র অঙ্কনবিদ্যার মত কিছু পাঠ্যবিষয়ের উদ্ভব ওতপ্রোতভাবে ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত তাহলে নতুন কিছু বলা হবে না। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা নিজের প্রয়োজনেই কিছু ‘ডিসিপ্লিন’-এর জন্ম দেয় যা পরবর্তীকালে মেট্রোপলিটান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সম্মানের জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়। বিষয়টি জটিল হলেও দুর্বোধ্য নয়। মোদ্দা কথা হল, যাকে শাসন করতে হবে তাকে ওতপ্রোতভাবে জেনে ওঠা প্রয়োজন, আর সাথে সাথেই প্রয়োজন সভ্যতার কিছু ইউরোপীয় মাপকাঠিকে কায়েমী করে তোলা। ভারতের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মচারীরা উনিশ শতক থেকেই নিজেদের শখের নৃতাত্ত্বিক ভাবতে শুরু করেন। কেউ কেউ আবার সময়কালে লন্ডনের “রয়াল অ্যান্থ্রোপোলোজিকাল ইন্সটিটিউট”-এর সদস্যও হয়ে ওঠেন। ঔপনিবেশিক সরকারের চাকরি করার সাথে সাথেই তারা ছাপতে থাকেন ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে লেখা সর্বপ্রথম নৃতাত্ত্বিক কেতাবগুলি। নানা সমস্যাবহুলতা, নিহিত বা ব্যক্ত জাতিবিদ্বেষ ও পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এই বইগুলি তাদের সময়ের দলিল, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জরুরী তথ্যের আকরও বটে।

মণিপুরের সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিষয়ক ইংরাজি ভাষায় ছাপা এরকম গোড়ার দিকের একটি নৃতাত্ত্বিক দলিল টি সি হডসনের লেখা দ্য মেইথেইস[4]। বইটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯০৮ খৃষ্টাব্দে; আর হডসন ছিলেন উনিশ শতকের শেষের দিকে মণিপুরে ব্রিটিশ সরকারের পলিটিকাল এজেন্ট। মেইতেইদের ধর্ম বিষয়ে কিছু কৌতূহল উদ্দীপক মন্তব্য করেন হডসন এই বইয়ে যা পরবর্তীকালে আরও জটিল রূপ ধারণ করে ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার[5] ও মণিপুরী ধর্মের ঐতিহাসিক সরোজ নলিনী পারাট[6]-এর গবেষণায়। হডসন জানাচ্ছেন যে হিন্দুধর্মকে মেইতেই জনতার মধ্যে গ্রাহ্য করে তুলতে গরিব নিওাজ ও তার পরবর্তী রাজারা নির্বাসন থেকে মৃত্যুদণ্ড সমস্ত শাস্তিই নির্বিচারে প্রয়োগ করেন[7]। মানুষ মূলত আতঙ্কপরবশ হয়ে মেনে নেয় এই নতুন ব্যবস্থা। মাইবা ও মাইবিদের বিদ্রোহ হালে পানি পায় না। হিন্দুধর্মের সাথে সাথে যে সবথেকে ক্ষতিকারক বিদেশী বস্তু মণিপুরী সমাজে প্রবেশ করে কায়েমী হয়ে ওঠে তা হল জাতিব্যবস্থা। একদল মানুষ নিজেদের ‘ব্রাহ্মণ’ বলে দাবী করে হয়ে ওঠেন রাজপরিবারের প্রীতি ও সম্মানভাজন, এবং এই নতুন অর্জিত ক্ষমতার ব্যবহার তাঁরা করতে থাকেন সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন বিষয়ে নিদান দিয়ে, শাস্তি প্রদান করে, ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ইচ্ছেমত জরিমানা ধার্য করে। যদিও কোন কোন ঐতিহাসিক মত এবং এই মেইতেই ব্রাহ্মণ বংশগুলির পারিবারিক দস্তাবেজ অনুযায়ী এমন দাবীরও খোঁজ পাওয়া যায় যে এই ব্রাহ্মণরা ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রথম মণিপুরে এসে পৌঁছন পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়, অতএব তাঁরা সত্যই পুরনো বাসিন্দা, একথা অনস্বীকার্য যে মেইতেই সমাজে তাঁদের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতাবৃদ্ধি এবং সানামাহি ধর্মের রাজনৈতিক দমনের শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর পর থেকে। 

এই জাতিবিভক্ত নতুন সমাজের আরেকটি বৈশিষ্ট হল কয়েকটি বিশেষ মেইতেই জনগোষ্ঠীর সমাজ-বহির্ভূত বা জাতিবিচ্যুত হয়ে ওঠা। হডসনের মতে, যে সমস্ত জনগোষ্ঠী হিন্দুধর্মের – এবং বিশেষ করে বৈষ্ণবধর্মের – নিয়মকানুন মেনে নিতে অস্বীকার করেন (যেমন মদ্যপান বা মদ বানানোর কাজ বর্জন করা, মাংস না খাওয়া ইত্যাদি) সেই সমস্ত গোষ্ঠীই ধীরে ধীরে সমাজ বহিষ্কৃত হয়ে ওঠেন। এদের নাম মেইতেই ভাষায় হয় “লই”। হডসনের পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে উনবিংশ শতকের শেষাশেষি মণিপুর উপত্যকাকে ঘিরে থাকা পাহাড়গুলির লাগোয়া এই সমস্ত “লই” জাতির গ্রামগুলিতেই চলে নানা নিষিদ্ধ জীবিকার অভ্যাস — যেমন ভাত জারিয়ে “ইয়ু” বা আঞ্চলিক মদের উৎপাদন, যা এইসব প্রান্তিক গ্রামগুলি থেকে সারা মণিপুরে সরবরাহ হতে থাকে। যে সমস্ত জীবিকা ‘সভ্য’ এবং বৈষ্ণব ধর্মান্তরিত মেইতেই সমাজ ত্যাগ করে সেসবই চালিয়ে যায় এই ‘লই’রা। ‘অসভ্যতা’র মূল্যস্বরূপ বাড়তে থাকে তাদের অর্থনৈতিক শোষণ। এই ‘লই’রাই চালিয়ে যায় সানামাহি ধর্মের প্রাচীন জীব বলির প্রথা যা ‘লাই হারাওবা’ বা অন্যান্য উৎসবে প্রাক-হিন্দু সময়ে অনুষ্ঠিত হত, এবং বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবের ফলে যা মেইতেই মূলস্রোত থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চাকপা গোষ্ঠীর লাই হারাওবার কথা যেখানে প্রাক-হিন্দু বলিপ্রদানের আচারগুলি আজও আগের মতই অনুষ্ঠিত হয়। সরোজ পারাটের মতে চাকপা এবং ময়রাং লাই হারাওবাগুলিতে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাক-মেইতেই কিছু আচার অনুষ্ঠানও বর্তমান কাল অবধি টিকে রয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালের প্রমিতকরণের ধারা এইসব অনন্য বৈশিষ্টগুলিকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দিচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় দাঁড়িয়ে, এ কথা বললে খুব ভুল হবে না যে মূলস্রোতের ধার্মিক মেইতেই আজও বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাঁরা বেশীরভাগই আজও রসকলি কাটেন ও মাংস ছোঁন না, যদিও মাছ খাওয়াকে মেইতেইরা বৈষ্ণবধর্মের পরিপন্থী বলে গণ্য করেন না। বাংলা থেকে আমদানি হওয়া এই বৈষ্ণব সভ্যতার আগ্রাসী প্রভাব ধর্ম, সংস্কৃতি আর সমাজের পরিসর পেরিয়ে পৌঁছে যায় ভাষার জগতে। বিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে মেইতেই ভাষা লেখা ও ছাপা হতে থাকে বাংলা হরফে; প্রজন্মর পর প্রজন্ম ইস্কুলে শুধু বাংলা স্ক্রিপ্ট শেখে। মেইতেই লিপি বিলুপ্তপ্রায় হয়। ১৯৭০-৮০র দশকে জোরালো হয়ে ওঠা এই মেইতেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলির মূল দাবীর মধ্যে একটি ছিল মেইতেই হরফ শিক্ষার নতুন করে চলন এবং বাংলা হরফের নিঃশর্ত প্রত্যাখ্যান। ভাষা ও ধর্মের রাজনীতি এখানে দৃশ্যতই একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত এবং এই ঐতিহাসিক জটিলতার আরও কিছু স্তর এই প্রবন্ধে পরে আলোচিত হবে।

মণিপুরী মানুষদের প্রাক-হিন্দু যুগের ধর্ম ছিল একধরনের ‘আনিমিস্ট’ ধর্ম। বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করতেন পূর্বপুরুষ ও প্রকৃতির আরাধনায়। এই ধর্মবিশ্বাসকে পরবর্তীকালে নৃতত্ত্ববিদরা নাম দিয়েছেন ‘সানামাহি’, এই ধর্মের একজন মূল দেবতার নাম অনুসরণ করে। সানামাহি ধর্মের একটি মূল বৈশিষ্ট ছিল সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে নিহিত জীবনে বিশ্বাস। এই ধর্মের ‘লাই’ নামক দেবদেবীরা মনুষ্যরূপী সত্ত্বা হিসেবে কম আর ‘স্পিরিট’ হিসেবে কল্পিত হতেন বেশি। মূর্তিপূজার কোন চল একেবারেই ছিল না। এই ‘লাই’দের উদ্দেশ্যে উদযাপিত সবচেয়ে জরুরী উৎসব আজও ‘লাই হারাওবা’। মেইতেই ভাষা থেকে বাংলায় সরাসরি তর্জমা করলে এই নামের মানে দাঁড়ায়– ‘দেবতাদের প্রীতিসাধন’ অথবা আরও সহজ ভাষায় ‘লাইদের আনন্দ দেওয়ার উৎসব’। এই উৎসব প্রতি বছর বসন্তকালে অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাস নাগাদ অনুষ্ঠিত হয়। অনেক নৃতাত্ত্বিক একথাও লিখেছেন যে এটি একটি ‘ফার্টিলিটি ফেস্টিভাল’ — প্রকৃতির ঐশ্বর্য, জমির উর্বরতা ও একটি কৃষিধর্মী সভ্যতার উন্নতির জন্য প্রার্থনা করতে তিনদিন ব্যাপী এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। পুরুষ ও নারী, আকাশ ও মাটির মিলনে জীবজগতের যে উর্বরতা তা প্রতি বছর নতুন করে উদযাপিত হয় দুই লাই-এর সঙ্গমের কাহিনীর মধ্যে দিয়ে। তবে এই মহাজাগতিক যৌন মিলনের কাহিনী শুধু বলে শোনানো হয় না — নাচ, গান ও অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত হয় সমস্ত ভক্তজন সমক্ষে।

লাই হারাওবা

নাচ-গান ও কাহিনীর মূল স্রোতটি টেনে নিয়ে যান এমন কিছু মহিলা যাঁরা আজও সানামাহি ধর্মের প্রধান পুরোহিত। এদের বলা হয় ‘মাইবি’। লাই হারাওবায় মাইবিদের ভুমিকা বিষয়ে বিস্তারিত কাজ করেছেন নৃতাত্ত্বিক মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার (যাকে আমরা অনেকেই হয়ত মূলত নৃত্যশিল্পী বলে জানি)[8] আর তার পরবর্তীকালে মেইতেই বুদ্ধিজীবী সরোজ নলিনী পারাট।[9] লাই হারাওবার বিবিধ বৈশিষ্টের মধ্যে একটি হল যে এই উৎসবে সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানের মূলে রয়েছে ‘পারফর্মেন্স’। ‘লাই’দের জল থেকে জাগিয়ে তোলা থেকে শুরু করে, ‘হিরি’ বা সুতোর সাহায্যে তাদের আসনে স্থাপিত করা এবং তারপর তাদের মিলনের আর জন্মের মুহূর্ত বর্ণিত করা সমস্ত কিছুই হয় নাচ ও গানের মাধ্যমে। এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল যে এই বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা উৎসবের পরম্পরার মূল ভিত্তি হল একটি অলিখিত কথ্য সংস্কৃতির ধারা, যাকে আফ্রিকান সাহিত্যিক গুগি ওয়া থিওংগো-র ভাষায় বলা চলে ‘ওরেচার’[10]। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার একটি বড় দিক হল তার ‘শাস্ত্রের’ জোর, জ্ঞানের আকর হিসেবে ‘টেক্সট’-এর সম্মান দাবী করা, এবং যুগপৎ, ভাষা হিসেবে সংস্কৃতের প্রাচীন মহিমা। তাই হিন্দুধর্মের সাথে মেইতেই সভ্যতার ঐতিহাসিক সংঘাত, একটি ‘টেক্সচুয়াল’ বা লিখিত ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতির সঙ্গে একটি মূলত ‘ওরাল’ বা বাচিক সংস্কৃতির সংঘাতও বটে। যদিও মেইতেই ভাষায় স্ক্রিপ্ট বা লিপি প্রাক-হিন্দু সময় থেকে বিদ্যমান, এই সভ্যতার সবথেকে জরুরী আচারগুলি, বলা যেতে পারে এর সংস্কৃতির মূলকেন্দ্রগুলি লিপি-নির্ভর নয়। লাই হারাওবার ‘ওরাল টেক্সট’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে[11] সরোজ এবং জন পারাট বলেছেন যে লাই হারাওবার সময় উচ্চারিত শব্দবন্ধ বলতে আমাদের কাছে যা আছে তা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে মৌখিকভাবে, স্মৃতির ওপর নির্ভর করে। পারাট জানাচ্ছেন যে মাইবা, মাইবি (লাই হারাওবার পুরোহিতরা) আর পেনাখংবাদের (যারা ‘পেনা’[12] নামক মেইতেইদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রটি বংশগতভাবে বাজান) দায়িত্ব ছিল এই শব্দগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা; তাঁরাই পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে নিতেন লাই হারাওবার ভাষা, সঙ্গীত, নৃত্য ও আচার-অনুষ্ঠানের রীতিগুলি। এক্ষেত্রে সবথেকে জরুরী কথা হল যে মন্ত্র, বা গানের শব্দবন্ধ, যাই বলা হোক না কেন, তার লাই হারাওবার ‘পারফর্মেন্স’ ব্যতিরেকে কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। পারাটের মতে নানা অঞ্চলে অনুষ্ঠিত লাই হারাওবার ক্ষেত্রে এই শব্দবন্ধের নানা ব্যতিক্রম বা ভিন্ন পাঠ পাওয়া যায়। এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেখানে ভাষা সত্যিই প্রাচীন সেখানে মাইবিরাও অনেকসময়ে এই মন্ত্রগুলির সঠিক অর্থ জানেন না। ‘মেইতেই মায়েক’ বা প্রাচীন মেইতেই স্ক্রিপ্ট (যা প্রায় ১০০০ বছর পুরনো) নিয়ে পণ্ডিতরা যে কাজ করেছেন তাতে লাই হারাওবার পাঠকে ইংরাজিতে তর্জমা করতে সুবিধা হয়েছে বটে, কিন্তু এ কথা সরোজ পারাট বার বার জোরের সাথে বলছেন যে এই প্রাক-হিন্দু মেইতেই ‘টেক্সট’গুলি নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ বাচিক ও পারফর্মেন্স-নির্ভর ঐতিহ্যই লাই-হারাওবাকে মেইতেই সভ্যতার মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে। এবং এর ফলেই লাই হারাওবার এতো চিত্তাকর্ষক বৈচিত্র্য। সম্ভবত লাই হারাওবা মেইতেই লিপির থেকেও প্রাচীন, এবং এর শিকড় রয়েছে লিখিত ভাষা উদ্ভবের আগেকার কোন সম্পূর্ণ বাচিক সংস্কৃতির মধ্যে। পারাট লিখছেন –“লাই হারাওবার পাঠ একটি মৌখিক পরম্পরা, পুঁথিগত ঐতিহ্য নয়। একে যারা বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁরা লিপিকার নন বরং মাইবা, মাইবি ও পেনাখংবাদের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির সদস্য।“[13]

ঐতিহাসিক পিয়ের নরা[14] লিখেছিলেন যে যেখানে জীবন্ত স্মৃতি বা ‘লিভিং মেমরি’ বিলুপ্তপ্রায় সেখানে মনে রাখার তাগিদটা একধরনের কর্তব্যবোধে পরিণত হয়। একে নরা ‘ড্যুটি মেমরি’ বলেছেন। এই ক্ষেত্রে অনেক সময়েই রাষ্ট্রের নিদানে নাগরিকবৃন্দ বাধ্য হন কিছু বিশেষ দিনক্ষণ, ঘটনা বা স্থানকে মনে রাখতে; বিশেষ করে ‘দেশপ্রেমিক’ নাগরিকের জন্য এমন যৌথ স্মৃতিচারণ একধরনের কর্তব্যে পরিণত করা হয়। (রাষ্ট্রের দাবীতে এই বাধ্যতামূলক স্মৃতি উদযাপন সম্বন্ধে বেনেডিক্ট আন্ডেরসনও আধুনিক জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি বিষয়ে লেখা তার বিখ্যাত বই ‘ইমাজিন্ড কমিউনিটিস’[15]-এ লিখেছেন।) যে সমস্ত জায়গায় ‘ড্যুটি মেমরি’ বা বাধ্যতামূলক স্মৃতিচারণা চলে সেই সমস্ত জায়গাকে নরা ‘সাইটস অফ মেমরি’ বলেছেন। তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘স্মৃতির নির্মাণভূমি’। অবশ্যই এর একটি ইচ্ছাকৃত বা কৃত্রিম চরিত্র রয়েছে। কিছু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রয়েছে। নরার মতে এই ধরনের স্মৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রয়েছে জিয়ন্ত বা ‘লিভিং মেমরি’, যা কোন একটি কৌম বা গোষ্ঠীর মধ্যে আপনি বেঁচে থাকে, বদলে যায়, নতুন করে গজায় বা পরিবর্তিত চেহারা নেয়। যতদিন এই কৌম গোষ্ঠী জীবন্ত থাকে ততদিন তাদের কৌমস্মৃতিও বেঁচে থাকে তাদের গল্পকথা, গান, রূপকথা, নাচ, নাটকের মধ্যে দিয়ে। নরার মতে আধুনিক পৃথিবিতে এইসমস্ত জীবন্ত মেমরির আকর ক্রমেই কমে আসছে আর তাই আমরা অভূতপূর্বভাবে নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠছি অহরহ স্মৃতি সংরক্ষণের চিন্তায়। নরার মতে এই দুয়ের মধ্যে একটি কালানুক্রমিক সম্পর্ক আছে। যেখানে ‘লিভিং মেমরি’র শেষ সেখানেই ‘সাইটস অফ মেমরি’র শুরু। নরা লিখছেন রাষ্ট্রপুষ্ট ও রাষ্ট্র সংরক্ষিত ‘সাইটস অফ মেমরি’গুলি ক্রমাগত সংগঠিতভাবে মহাফেজখানা তৈরির কাজ চলে, এবং জীবন্ত স্মৃতির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে তা পূরণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে। ‘লিভিং মেমরি’ সম্পর্কে নরার সবথেকে জরুরী বক্তব্যগুলির মধ্যে একটি হল যে, জীবন্ত স্মৃতি সেই যা আমাদের ভুলে যাওয়ার অনুমতি দেয়, সরকারি সংরক্ষণশালাগুলি যা দিতে অক্ষম। তাই একটি জীবন্ত সংস্কৃতি যেখানে আছে সেখানে অনেক কিছুই দৈনন্দিন পালটে যায়; মানুষ ভুলে যায় অনেক কথাই, আবার করে বানায়, বা নতুন স্মৃতি সঞ্চারিত করে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে — সংরক্ষণের কোন সচেতন চেষ্টা না করেই। তাই মানুষ একই রূপকথা নানা রকম করে বলে, ইচ্ছেমত পালটে দেয়, আবার নতুন করে পুরনো গল্পকথা মনে করে। এর কোনটাতেই কোন শাস্তি ধার্য হয় না; স্মৃতি আর গল্পকথায় ভর করে একটি সংস্কৃতি বেশ বেঁচে থাকে।

নরার তত্ত্বকে গ্রহণ করেই তার থেকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান লাতিন আমেরিকান পারফর্মেন্স স্টাডিজ-এর অধ্যাপক ডায়ানা টেলর। টেলর মেনে নিতে রাজি হন না যে ‘লিভিং মেমরি’ আর ‘সাইটস অফ মেমরি’র মধ্যে কালানুক্রমিক কোন সম্পর্ক আছে। দ্য আরকাইভ অ্যান্ড দ্য রেপেরটোয়ার: পারফর্মিং কালচারাল মেমরি ইন দ্য আমেরিকাস[16] নামে তাঁর বিখ্যাত বইয়ে তিনি বলেন যে এই দুই আলাদা ধরনের স্মৃতির কথা বলে নরা অবশ্যই ঠিক করেছেন, তবে এই দুইয়ের মধ্যে কোন ‘আগে-পরে’র সম্পর্ক নেই। টেলরের মতে জীবন্ত স্মৃতির আস্তানাগুলির অদৃশ্য হয়ে ওঠার সাথে বিশ্বব্যাপী উপনিবেশিক শক্তিগুলোর বহুদিন ধরে গভীর যোগ। এই আগ্রাসী শক্তিগুলির ক্ষমতাবিস্তারের ফলেই ‘লিভিং মেমরি’কে ধীরে ধীরে গ্রাস করা হয়েছে আর বেড়ে উঠেছে কর্তব্য স্মৃতি নির্মাণের আখড়া। তবে এ কোন সুদূর অতীতের কথা নয়। এ সমস্ত প্রক্রিয়া আজও চলছে। জীবন্ত স্মৃতি যেখানে বিদ্যমান সেই সমস্ত কৌম গোষ্ঠীও আমাদেরই আধুনিক পৃথিবীর অংশবিশেষ; আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়াগুলি তাদের সমস্ত জ্ঞানের ভাণ্ডারকে জ্ঞান বলে অস্বীকার করে কেননা তা লিখিত জ্ঞান নয়। কারণ তাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভিত্তি কোন পুস্তকসংগ্রহ নয়। ডায়ানা আরও বলছেন, ‘লিভিং মেমরি’কে অস্বীকার করে অদৃশ্য করে তোলাই আজকের উপনিবেশিক শক্তিগুলির একমাত্র পদ্ধতি নয়। ‘লিভিং মেমরি’র বিলুপ্তি ঘোষণা করার মধ্যেই রয়েছে অন্য এক ধরনের খেলা। এই সংস্কৃতিগুলি যে সুদূর অতীতের ও বিলুপ্তপ্রায় এ কথা বারবার উচ্চারণ করার মানে হল এদের সমসাময়িকতাকে অস্বীকার করা। এরা যে প্রাক-আধুনিক এমন একটা ভাণ করা। যেখানে সত্যিটা হচ্ছে যে শুধুমাত্র লিপি এবং পাঠ নির্ভর সভ্যতাগুলিকে আমরা আধুনিক বলে মেনে নিই, তবে আজও পৃথিবীর বহু মানুষ এই সভ্যতার সংজ্ঞা থেকে বাদ যাবে। তাই ‘লিভিং মেমরি’ আর তার ‘সরকারি সংরক্ষণ’এর জায়গাগুলির মধ্যে সম্পর্ক আধুনিক ও প্রাক-আধুনিকের নয়, বরং ক্ষমতা এবং আগ্রাসনের। আধুনিকতার যে সংজ্ঞা বর্তমান উপনিবেশিক শক্তিগুলি পুরো দুনিয়ার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তার মূলে রয়েছে এই সমস্ত বাচিক সংস্কৃতিগুলোর (অর্থাৎ যাদের সভ্যতা বা জীবনচর্চা অক্ষর, পুস্তক ও মহাফেজখানা নির্ভর নয় তাদের) আধুনিকতা এবং সমসাময়িকতা অস্বীকার করার প্রচেষ্টা। অর্থাৎ, আজও যে পৃথিবীর বহু মানুষ ‘নন-টেক্সটুয়াল’ (পাঠ-নির্ভর নয় এমন) একটি পৃথিবীতে বাঁচেন তা জোর করে ভুলিয়ে দেওয়া। আর যদি তাঁদের অস্তিত্ব একেবারে অস্বীকার করে ওঠা না যায় তাহলে এমন একটি ধারণা তৈরি করে দেওয়া যে তাঁরা কোন প্রাক-আধুনিক যুগের ফসল, নেহাতই দুর্ঘটনাবশত আজও বেঁচে আছেন বা কোন বিশেষ দুর্ঘটনাবশত এখনও সঠিক অর্থে আধুনিক হয়ে উঠতে পারেননি। তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইতিহাস, আধুনিকতা ও প্রগতির পরিধির মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা চলতে থাকে। এই প্রক্রিয়ারই আরেক নাম বোধহয় ‘উন্নয়ন’। টেলরের মতে এই সমস্ত গোষ্ঠীগুলির মধ্যে যে সংস্কৃতি, ইতিহাসবোধ আর জ্ঞানের ভাণ্ডার রয়েছে তা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে লিপি বা মহাফেজখানায় রক্ষিত দস্তাবেজের দ্বারা সংরক্ষিত হয় না। বরং তা হস্তান্তরিত হয় কিছু বাচিক ঐতিহ্য এবং বিশেষ করে ‘পারফর্মেন্স’-এর মধ্য দিয়ে।

নানা পারফর্মেন্সের ঐতিহ্যের যে সম্মিলিত আকর এমন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে বেঁচে থাকে তা ‘লিভিং মেমরি’ তো বটেই, উপরন্তু, টেলরের বয়ানে, তা একধরনের শরীরী ‘রেপের্টোয়ার’ও বটে। এই ‘রেপেরটোয়ার’-এর অস্তিত্ব জীবিত মানুষের শরীরী স্মৃতিগুলির মধ্যে এবং তা পারফর্মেন্সের নিয়মিত অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। একে একধরনের ‘এমবডিড ট্রান্সমিশন’ বা শরীরী সঞ্চারণের প্রক্রিয়াও বলা চলে। কারণ এই ‘রেপেরটোয়ার’কে বাঁচিয়ে রাখে একটি জীবন্ত সংস্কৃতি যা বারংবার ‘পারফর্মড’ বা উপস্থাপিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকে। উপনিবেশিক শক্তিগুলির চিরকালীন ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা হল এই জীবন্ত শরীরী অভ্যাস ও পারফর্মেন্সের আকরগুলিকে মহাফেজখানার দস্তাবেজে পরিণত করা, যাতে তার ওপর ক্ষমতাসীন কারো দখলদারী থাকে। এ ক্ষেত্রে টেলরের আবেদন যে আমরা প্রথাগতভাবে ভাবতে অভ্যস্থ যে ‘পারফর্মেন্স’ এমন একটি বস্তু যাকে আমরা ভাষাভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জেনে উঠতে পারি। অর্থাৎ ‘পারফর্মেন্স’কে কোন না কোন ভাবে লিখিত ভাষায় রূপান্তরিত না করে উঠলে তাকে ঠিক জ্ঞান বলা যায় না। টেলর আমাদের ভাবতে বলছেন যে পারফরমেন্স নিজেই এক ধরনের জ্ঞান, যা ভাষাভিত্তিক জ্ঞানের থেকে স্বতন্ত্র এবং ভাষার পরিধির বাইরে সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত হয়। এই তত্ত্বের সাথে কোথাও গুগির ‘ওরেচার’ সম্পর্কে ভাবনার যোগ অবশ্যই আছে, বিশেষত দুটি মূল ভাবনায়। এক, উগান্ডার ভাষাতাত্ত্বিক পিও জিরিমু-র ‘ওরেচার’ নিয়ে ভাবনার কথা বলতে গিয়ে[17] গুগি বলছেন যে আমাদের কল্পনা করতে হবে এমন একটি বাচিক সংস্কৃতির এবং শৈল্পিক মানদণ্ডের কথা যা কোন ভাবেই অক্ষরনির্ভর ও পুস্তকভিত্তিক সভ্যতার থেকে কোন স্বীকৃতি চায় না। দুই, এই একই প্রবন্ধে, গুগি জোর গলায় বলছেন যে ‘ওরেচার’-এর সব থেকে জরুরী বৈশিষ্ট হল ‘পারফর্মেন্স’, যেখানে যিনি উপস্থাপনা করছেন ও যিনি দেখছেন দুজনেরই যৌথ অবদানে কিছু শরীরী প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে একটি গোষ্ঠীসত্ত্বার বারংবার নির্মাণ ও টিঁকে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে।

এই সমস্ত কথা মাথায় রেখে আমরা যদি আমাদের মণিপুর বিষয়ে আলোচনায় ফিরে যাই আমরা বুঝতে পারবো যে মণিপুরী সংস্কৃতি বিষয়ে আমরা এখন অবধি যা যা জেনেছি তাতে এ কথা স্পষ্ট যে একধরনের ‘পারফর্মেন্স রেপের্টোয়ার’ এই সভ্যতার কেন্দ্রে রয়েছে, যার মাধ্যমে শুধু মণিপুরী ধর্ম নয়, মণিপুরী লোকগাথা, বাচিক সাহিত্য, মহাজাগতিক জ্ঞান, জীবনদর্শন এমনকি ইতিহাসবোধ সংরক্ষিত ও সঞ্চারিত। এর মধ্যে ভীষণভাবে জরুরী ‘লাই হারাওবা’ উৎসবটি (যার প্রভাব আমরা কানহাইলালের কাজের ওপরও দেখতে পাবো), কিন্তু লাই হারাওবাই এই বাচিক ও পারফর্মেন্স সংস্কৃতির সবটুকু নয়। এর আরও জরুরী উপাদান রয়েছে যেগুলির বিষয়ে আমরা কিছু পরে আলোচনা করব। ব্রাহ্মণ্যবাদের যে ধর্মীয় ও ভাষাগত দমনের কথা আমরা একটু আগে করছিলাম, তা ছাড়াও ভারতের মূল ভূখণ্ডের মণিপুরের সভ্যতার ওপর আরও অনেক আগ্রাসন বহু দশক ধরে কার্যকরী। তারই কিছু সুদূরপ্রসারী ফল আমরা দেখতে পাই ৬০ বা ৭০ দশকের রাজনৈতিক মুহূর্তগুলিতে। অর্থনৈতিক পরিসরের দিকেই তাকিয়ে দেখা যাক। নৃতাত্ত্বিক মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের মতে মাড়ওয়ারি এবং অন্যান্য উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ীরা প্রথম মণিপুরে এসে পৌঁছন সেখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম হবার পরে। মণিপুরের আভ্যন্তরীণ কৃষি-সম্পর্কিত যে দৈনন্দিন ব্যবসা তা আগের মতই অনেকটাই মেইতেই মহিলাদের হাতে থেকে যায়। কিন্তু আমদানিরপ্তানির ক্ষেত্র এবং বড় ব্যবসার পরিসরের রাশ অনেকটাই চলে যায় এইসব মূল ভূখণ্ডের মানুষজনের হাতে। এরা যখন মণিপুরে এসে পৌঁছন এঁদের হাতে থাকে অনেক বড় পুঁজি এবং শহুরে বাজারগুলির বড় দোকানগুলো প্রায় সমস্তই এদের হাতে চলে যায়। রপ্তানি হয়ে আসা কারখানাজাত ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের বণ্টনের নিয়ন্ত্রণ আজও বেশিরভাগই এদের হাতে। মণিপুরের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা ও অর্থনীতির জন্য এই প্রক্রিয়া যে খুব ভালো প্রভাব ফেলেছে এমন কথা বলা যায় না। বহু দশক ধরে চলতে থাকা এই অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত মণিপুরে ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় ‘নুপি লান’ অথবা ‘মহিলাদের যুদ্ধ’। প্রথম ‘নুপি লান’ ঘটেছিল ১৯০৪ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের মেইতেই পুরুষদের ওপর শাস্তি স্বরূপ চাপিয়ে দেওয়া ‘লালুপ’ অথবা বেগার খাটনির বিরুদ্ধে। মেইতেই মহিলাদের সমবেত প্রতিবাদের ফলস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার এই শাস্তি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের একেবারে শেষের দিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর দোরগোড়ায়, ১৯৩৯ সালে, মণিপুরে চালের প্রভূত অভাব দেখা দেয়। এর কয়েক বছর পরেই যেমনটা বাংলায় ঘটতে চলেছে। বাংলার মতই এ কোন স্বাভাবিক দুর্ভিক্ষ ছিল না, বরং কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছিল যথেচ্ছ চাল রপ্তানি করে এবং গুদামে চাল জমিয়ে রেখে, যাতে করে আঞ্চলিক মানুষজনকে চাল অস্বাভাবিক বেশী দামে কিনতে হচ্ছিল। এই অত্যধিক রপ্তানি বন্ধ করতে সরকার কিছুই করে উঠতে না পারায়, মেইতেই মহিলারা (বিশেষত যারা ইম্ফলের মূল বাজারগুলিতে ব্যবসায়ী বা দোকানদার ছিলেন) এক বহুদিনব্যাপী যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলেন যা অবশেষে এই মুনাফাখোরদের আটকাতে সক্ষম হন। ঐতিহাসিক জন পারাটের বই ‘দ্য ওয়ুন্ডেড ল্যান্ড’[18]-এ ও তাঁর অন্যান্য লেখায় এই দ্বিতীয় নুপি লান-এর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই সমস্ত বিবরণে ও মণিপুরের মহিলাদের নিজস্ব গল্পকথা থেকে আমরা জানতে পারি যে চালের রপ্তানি আটকাতে ইম্ফলের মূল বাজারে মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীদের ট্রাকের সামনে রাস্তায় শুয়ে পড়েন দলে দলে মহিলা। সরকার সমস্যার সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। তবে মূল ভূখণ্ডের মানুষের দ্বারা অর্থনৈতিক শোষণ ও মণিপুরের বৃহৎ ব্যবসাগুলির নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া এখানেই বন্ধ হয়ে যায় না।

১৯৪৭-এর পরে দু বছর মণিপুর একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। একটি স্বাধীন বিধানসভা এবং নিজস্ব সংবিধানও এই সময়ে মণিপুরে কার্যকরী থাকে। কিন্তু অবিলম্বেই বোঝা যায় যে মণিপুরের মহারাজা ছাড়া আর কারো কর্তৃত্ব স্বাধীন ভারতের সরকার মেনে নিতে রাজি নয়, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিকার পর্যন্ত নয়। ১৯৪৯ সালে মহারাজা বোধচন্দ্রকে শিলঙে ডেকে পাঠান সর্দার প্যাটেল এবং রাজাকে তার নিজেরই বাড়িতে গৃহবন্দী করে রেখে সই করতে বাধ্য করা হয় এক ‘মেরজার’-এর দলিলে যাকে অনেক ঐতিহাসিক অধিগ্রহণের দস্তাবেজও বলতে পারেন। এই সমস্ত ঘটনাবলী জন পারাটের বইতে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। এই রাজনৈতিক আত্মসাৎ সুষ্ঠুভাবে ঘটে যাওয়ার পর এই দলিলের নানা অনুবিধি রাজা এবং মণিপুরের মানুষজনকে না জানিয়েই পালটে ফেলা হয়। ভারতীয় সেনার একটি বড়সড় বাহিনি এখানে নিযুক্ত হয়, রাস্তায় ঘাটে বাজারে মোতায়েন হয় আর্মি। অবশ্যই কোন সম্ভাব্য বিদ্রোহ এড়াতে। জন পারাটের মতে বিধিসম্মত হস্তান্তরণের অনুষ্ঠানটি ঘটে ১৫ই অক্টোবর, ১৯৪৯ সালে ইম্ফলের বিখ্যাত রাজকীয় পোলো ক্রীড়াঙ্গনে। মেজর-জেনেরাল রাওাল সিং মণিপুরের চিফ কমিশনার নিযুক্ত হন এবং অবিলম্বেই সমস্ত মন্ত্রীসভা ও বিধানসভাকে অবৈধ ঘোষণা করে তার সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন। এর কিছুদিন আগেই ঐতিহাসিক কাংলা দুর্গে ভারতীয় আর্মির একটি ব্যাটেলিয়ন নিযুক্ত হয়েছে; আসাম রাইফেলস সেখানে তখনই বিদ্যমান। (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এই কাংলা অবশেষে সেনাবাহিনীমুক্ত হয় ২০০৬ সালে, থাংজাম মনোরমা-র মৃত্যুর কয়েক মাস পরে। এই দীর্ঘ সময় ধরে মণিপুরের সাধারণ নাগরিকের কাংলায় প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে থাকে; মনে রাখতে হবে, সানামাহি ধর্ম অনুযায়ী কাংলা মেইতেই জনগণের কাছে পুণ্যভূমিও বটে।) এরপর যা ঘটে তার ফল মণিপুরের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রমাণিত হয়। মূল ভূখণ্ডের মানুষজনের মণিপুরে অভিবাসনের ওপর কোন সরকারি বা আইনি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। মূল ব্যবসা-বাণিজ্যগুলি আরও বেশী করে চলে যেতে থাকে তাদের হাতে। উপরন্তু প্রায় সমস্ত সরকারি ও প্রশাসনিক চাকরী পেতে থাকেন মণিপুরের বাইরে থেকে আসা ভারতীয়রা যদিও সেইসব চাকরীর জন্য যোগ্য মণিপুরীদের কোন অভাব সেই সময়েও ছিল না। এইসব চাকরীগুলিতে মণিপুরিদের নিজেদের জন্য কোন সংরক্ষণ না থাকায়, মণিপুরী নাগরিকদের মধ্যে বেকারত্ব ক্রমবর্ধিত হারে বাড়তে থাকে। ফলত নানা সমস্যা দেখা দেয় — অল্পবয়েসিদের মধ্যে মাদকাসক্তি, অতিরিক্ত মদ্যপান, হতাশাজনিত হিংসার ঘটনা, গুন্ডা সংস্কৃতি এবং অবশ্যই সরকারের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা ক্ষোভ। এই ক্ষোভই পরবর্তীকালে, ৬০ ও ৭০ এর দশকে, একটি সচেতন রাজনৈতিক আকার ধারণ করে। প্রথমে ৬০এর দশকে মেইতেই সত্ত্বা ও সংস্কৃতি রক্ষার্থে কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এদের অনুসরণ করে ৭০-এর দশকে কিছু পূর্ণ বিকশিত রাজনৈতিক গোষ্ঠী জন্ম নেয়, যার মধ্যে অনেকগুলিকেই বিপ্লবী সংগঠন বলা চলে। তাদের মতাদর্শের অনেকটাই হল মেইতেই জাতীয়তাবাদ এবং ভারতের ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মণিপুরের সম্পূর্ণ মুক্তি — ‘স্বতন্ত্র মণিপুর’, যার জন্য প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রাম করতেও প্রস্তুত ছিলেন এদের অনেকে। এই অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে ভারতীয় সরকারের উদ্বেগও সত্তরের দশক ধরে উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। অবশেষে, কিছুটা প্রত্যাশিত ভাবে, ভারত সরকার তার পুরনো পদ্ধতি অবলম্বন করে। ১৯৮০ সালে, অবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ পেতে স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র একটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনের আধুনিক সংস্করণের শরণাপন্ন হয়। মণিপুরে আরোপ করে আর্মড ফোরসেস স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট (১৯৫৮) বা ‘আফস্পা’, যার বহু নিদানগুলির একটি হল ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে কেউ শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে যে কাউকে মেরে ফেলতে পারবে এবং এই খুনের জন্য তাকে কোন শাস্তি পেতে হবে না। এমনকি তার বিরুদ্ধে নালিশও করা যাবে না। কারণ, যেখানে আফস্পা লাগু সেটি একটি ‘উপদ্রুত’ এলাকা এবং সেখানে সঙ্কটকালীন আইন আরোপ করা জরুরী। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী যে আইনের হওয়ার কথা ছিল বিপদকালীন একটি অস্থায়ী সমাধান, তা মণিপুর ও কাশ্মীরের মত রাজ্যগুলির জন্য হয়ে ওঠে দশকের পর দশক ব্যাপী দৈনন্দিন সত্য, প্রতিনিয়ত অবদমন ও অপমানের কায়েমি ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আটপৌরে চেহারা।

(২)

তামনা লাই’, ‘পেবেত’ এবং সত্তরের মণিপুরে রাজনৈতিক গল্পকথা

কানহাইলালের কাজের বিষয়ে যারা ওয়াকিবহাল নন, তাদের জন্য তাঁর জীবন সম্পর্কে দু-একটি কথা বলে শুরু করা ভালো। কানহাইলালের জন্ম ১৯৪১ সালে মণিপুরের ইম্ফল শহরে। কানহাইলালের জন্মের তিন মাস পরেই তাঁর মা মারা যান এবং তার কিছু পরেই তাঁর বাবা আবার বিয়ে করে সংসার পাতেন। কানহাইলাল তাঁর বাবার বড় ভাই এবং তাঁর স্ত্রীর কাছে মানুষ হন। কানহাইলাল এবং সাবিত্রীর সাক্ষাৎকারগুলিতে এ কথা অনেক সময় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ছোটবেলা কানহাইলাল ছিলেন মুখচোরা এবং লাজুক। সমবয়েসি অন্য ছেলেমেয়ের সাথে খেলা না করে কানহাইলাল ভালোবাসতেন প্রকৃতির মধ্যে একা একা সময় কাটাতে। স্কুল পেরিয়েই তিনি এলাহাবাদে চলে যান কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করতে। এই সময়ে, কোন একটি গরমের ছুটিতে তিনি ইম্ফলে ফিরে এসে ঠিক করেন যে তাঁর সহপাঠী বন্ধুদের সাথে একজোট হয়ে একটি নাটক মঞ্চস্থ করবেন। এই তার থিয়েটারের সাথে প্রথম পরিচয় আর এই নাটকের মহড়া চলাকালীনই তাঁর প্রথম সাবিত্রী হেইসনামের সাথে আলাপ হয়। সাবিত্রী তখন ইম্ফলের ব্যবসায়ী প্রসেনিয়াম থিয়েটারের প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী। যে নাটকটি কানহাইলালের নির্দেশনায় এই সময় উপস্থাপিত সেটি একটি ব্যঙ্গাত্মক সামাজিক নাটক। নাম ছিল ‘লায়েং আহানবা’ তর্জমা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘প্রথম চিকিৎসা’। নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার কিছু পরেই সাবিত্রী এবং কানহাইলাল পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন।

কানহাইলালের আর কৃষিবিদ্যা পড়া হয়না, বিবাহের কিছু পরেই তিনি দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় ভর্তির জন্য আবেদন করেন। ১৯৬৩ সালে, কানহাইলাল এনএসডি-তে ভর্তি হন। এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় মণিপুরী ছাত্র। প্রচুর উৎসাহ নিয়ে দিল্লীতে পৌঁছলেও, কানহাইলাল অবিলম্বে বুঝতে পারেন যে এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনার অভিজ্ঞতা তাঁর পক্ষে খুব সুখের হবে না। কানহাইলাল হিন্দি একেবারেই বলতে বা বুঝতে পারতেন না, আর তাঁর ইংরাজির ওপর দখলও তাঁর নিজের ভাষায় ‘একটি সাধারণ কেরানির মতো ছিল’।[19] পরবর্তী জীবনে এই অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে তিনি বলছেন যে তিনি ইংরাজি ভাষায় কাজ চালানোর মতই শিক্ষা পেয়েছিলেন আর হিন্দি ভাষার প্রয়োজন তাঁর এর আগে কখনো হয়নি। তবে এনএসডি পৌঁছে তিনি বুঝতে পারলেন যে ইংরাজির থেকেও বেশী প্রয়োজন তাঁর হিন্দি ভাষা জানা। হিন্দি ছাড়া না তাঁর পক্ষে সম্ভব ক্লাসরুমে কি ঘটে চলেছে তা বুঝে ওঠা, না সহপাঠীদের সাথে কোন কথোপকথন চালানো না (সবথেকে জরুরী যে বিষয়টা) কোন নাটকে অভিনয় বা নির্দেশনা করা। কেননা এই সব ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের শুধু উৎসাহিত নয়, অনেক সময় বাধ্য করেন, ‘রাষ্ট্র’ভাষায় কথা আদান-প্রদান করতে। এই অপারগতা থেকে যে একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও অপমানবোধ কানহাইলালের মধ্যে তৈরি হয় তা তাঁর মধ্যে গভীরভাবে দাগ কাটে। রুস্তম ভারুচা কানহাইলাল সম্পর্কে লেখা তার বইয়ে আমাদের জানান যে ১৯৬৮-এর কোন সময় কানহাইলাল অনুমতি ছাড়া এনএসডি থেকে ছুটি নেন, এর ফলস্বরূপ তাঁকে শাস্তিমূলকভাবে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বার করে দেওয়া হয়[20]। জীবনের শেষের দিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারগুলিতেও কানহাইলাল বারংবার বলেছেন যে এনএসডি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরবর্তী কয়েক মাস তাঁর জীবনের সবথেকে কঠিন সময়গুলির একটি। এই আপাত ব্যর্থতার অপমান কানহাইলালের কাঁধে এতটাই চেপে বসে যে তিনি বহুমাস লজ্জায় বাড়ি ফিরতে পারেন না। সাবিত্রী এই সময়ে গর্ভবতী। তাঁর বয়ানে এইসময় পরিবারের মধ্যেও কানহাইলালের ব্যর্থতা ও ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ নিয়ে ক্ষোভ এবং হতাশাবোধ গড়ে উঠেছে। এই ‘ব্যক্তিগত’ ব্যর্থতার যে একটি রাজনৈতিক মাত্রা আছে তা বোধহয় কানহাইলালের নিজের কাছেও তখন পরিষ্কার নয়। এর কয়েক মাস পরে ১৯৬৯ সালের মে মাসে,কানহাইলালের বন্ধুরা অবশেষে সক্ষম হন তাঁকে ইম্ফলে ফিরিয়ে নিয়ে এসে আবার থিয়েটার করার জন্য রাজী করাতে। ১৯৬৯-এর জুলাই মাসে কানহাইলাল তাঁর নিজস্ব থিয়েটার গ্রুপ ‘কলাক্ষেত্র মণিপুর’ শুরু করেন। কানহাইলালের জীবনের এই সময়কালে এটি সবথেকে লক্ষণীয় একটি বিষয়। মণিপুরের নিজস্ব সংস্কৃতির যে বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে তিনি ভারতের রাজধানীতে দৈনন্দিন বহিরাগত হয়ে উঠছিলেন, যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের, ভাষার, লোকগাথার, উৎসব ও অভিনয়ের এই কেন্দ্রীয় নাট্যশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে প্রায় কোন মূল্য ছিল না, মণিপুরে ফিরে এসে কাজ করতে গিয়ে ঠিক সেই সমস্ত পরম্পরার মধ্যে একনিষ্ঠভাবে অনুপ্রেরণা খুঁজতে শুরু করলেন কানহাইলাল। পরবর্তী জীবনে তাঁর লেখায় এবং সাক্ষাৎকারে তিনি বারবার বলছেন যে এই সময়ে তিনি প্রথম ‘আধুনিক’ এবং শহুরে ভারতীয় সভ্যতার দিকে না তাকিয়ে, নতুন করে ঘুরে তাকালেন মেইতেই সংস্কৃতির দিকে। শিখতে শুরু করলেন ‘শুমাং লীলা’ (সোজা তর্জমা “উঠোনের নাটক”, যাকে ভারতীয় নাট্য ঐতিহাসিকরা অনেক সময়ে তাঁদের লেখায় ‘মণিপুরের যাত্রা’ও বলেছেন), লাই হারাওবা, থাং তা এবং ‘ওয়ারিলিবা’-র (‘কাহিনী পাঠ’, এই ফর্মটি বিষয়ে পরে আরও বিস্তারিত বলা হচ্ছে) মতো মেইতেই শৈলীগুলির উপস্থাপনা থেকে।

সাবিত্রী ও কানহাইলাল

অনেকেই (বিশেষ করে ভারতীয় সমালোচকরা) বলে থাকেন যে সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে কানহাইলালের ওপর সবথেকে জরুরী প্রভাব পড়ে বাদল সরকারের কাজের। এ কথা একাংশে সত্যি, এবং কানহাইলাল নিজের লেখাপত্রে এ কথা নানা জায়গায় স্বীকারও করেছেন। ১৯৭২ সালে মণিপুর স্টেট একাডেমির আয়োজিত একটি নাট্য উৎসবে বাদল সরকার তাঁর প্রযোজনা নিয়ে যান। সাকুল্যে তাঁর চারটি নাটক এই উৎসবে অভিনীত হয়, যার মধ্যে একটি ছিল ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’। কানহাইলাল এতটাই প্রভাবিত হন যে ১৯৭৩-র গোড়ার দিকে তিনি কোলকাতা পৌঁছে যান এবং বেশ কয়েক সপ্তাহ বাদল সরকারের সাথে থেকে তাঁর কাজ পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর অভিনেতাদের সঙ্গে অনুশীলন পদ্ধতিগুলি শেখার চেষ্টা করেন। পরে তিনি এ কথাও উপলব্ধি করেন যে এর মধ্যে অনেকগুলি পদ্ধতিই সেই সময়কার স্বনামধন্য পোলিশ নির্দেশক জার্সি গ্রতস্কির-র কাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ১৯৭৩ সালেই সরকার আবার ইম্ফলে আসেন। এবার প্রযোজিত হয় তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘স্পার্টাকাস”, আঞ্চলিক অভিনেতা, নির্দেশক ও নাট্যকর্মীদের সাথে কিছু কর্মশালার মধ্যে দিয়ে। কানহাইলাল এইবার সরকারের সহকারী নির্দেশক হিসেবে কাজ করেন। নাটকটি উপস্থাপিত হয় মণিপুরের বেশীরভাগ পারম্পরিক না ‘শুমাং লীলা’-র মতো খোলা উঠোন বা মণ্ডপে (‘শুমাং’ অর্থে ‘উঠোন’)। ১৯৭২-৭৩-এর মাসগুলিতে বাদল সরকারের কাজের মধ্যে একধরনের নতুন অনুপ্রেরণা খুঁজে পাওয়া সত্ত্বেও, কানহাইলাল কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারেন তাঁর নিজের কাজ এবং মণিপুরের প্রেক্ষাপটে সরকারের সমস্ত পদ্ধতিই যে লাগসই এমনটা নয়। রুস্তম ভারুচা তার বইয়ে এই অসামঞ্জস্যের কারণগুলো কিছুটা বিশ্লেষণ করেছেন এবং কানহাইলালও তাঁর জীবনের শেষের দিকে এসে এই বিষয়ে কিছু কথা লিখেছেন। প্রধান সমস্যা এই ক্ষেত্রে বোধহয় এটাই ছিল যে বাদল সরকারের নাট্যশিক্ষণপদ্ধতিগুলির মধ্যে বেশিরভাগটাই ছিল শহুরে এবং মধ্যবিত্ত অভিনেতাদের জন্য নির্মিত। যাদের মধ্যে কোন শরীর চর্চার সংস্কৃতি নেই, এবং শহুরে মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রতা’ ও শালীনতার চাপে যাদের মধ্যে শরীরী অভিব্যক্তি নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা অস্বস্তি, তাদের জড়তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে কার্যকরী ছিল এই সমস্ত অনুশীলন প্রক্রিয়া। কিন্তু কানহাইলালের সামনে কলাক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ছিলেন একেবারেই অন্য ধাঁচের কিছু অভিনেতা। শরীরের নানা স্থিতির বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল কম, বা একেবারেই অন্য ধাঁচের। এরা বেশিরভাগই মণিপুরের গ্রামীণ ও মূলত কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতির ফসল। কানহাইলাল অচিরেই বুঝতে পারলেন যে এই অভিনেতা-অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করার পদ্ধতি হতে হবে একবারে অন্যরকমের। কোন শহুরে মধ্যবিত্ত কেতাবি শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব এদের ওপর যত না জোরালো, তার থেকে অনেক বেশী জোরালো মেইতেই লোকসংস্কৃতি, আঞ্চলিক গল্পগাথা, মিথ, রূপকথা, গান, যৌথনৃত্য এবং রাসলীলা, লাই হারাওবার মতো ধর্মীয় উৎসবের প্রভাব। এঁরা যে গল্প শুনে, যে নাটক দেখে বড় হয়েছেন, তা ভারতের মূল ভূখণ্ডের যে কোন শহরের তরুণদের থেকে আলাদা। উপরন্তু গ্রামে বা ‘লেইকাই’তে (পাড়া) নিয়মিত যৌথ উৎসবে নাচগানে অংশগ্রহণের ফলে শরীরী পারফর্মেন্সে যে স্বাচ্ছন্দ্যে তারা অভ্যস্ত তা কোলকাতার শহুরে অভিনেতাদের মধ্যে বিরল। তাই, এই অভিনেতাদের ট্রেনিং যে বাদল সরকারের দলের অভিনেতাদের শিক্ষাপ্রণালীর থেকে আলাদা হতে বাধ্য, এ কথা বুঝে উঠতে তরুণ কানহাইলালের বেশীদিন সময় লাগেনি। তা সত্ত্বেও, অনেক নাট্যসমালোচকই কোন বিশ্লেষণ ছাড়াই আজও বাদল সরকারকে কানহাইলালের ‘মেন্টর’ বলতে অভ্যস্ত। সাংস্কৃতিক ঔপনিবেশিকতার ছায়া যে এই মূল্যায়নেও একেবারে অনুপস্থিত এ কথা হলফ করে বলতে পারি না।

১৯৭২ সালে, কানহাইলাল তাঁর কর্মজীবনেরপ্রথম জরুরী প্রযোজনা – “তামনা লাই” (“অতৃপ্ত আত্মা”) মঞ্চস্থ করেন। একটি পুরনো মেইতেই লোককথার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে নাটকের কাহিনী। জীবনের নানা সময়ে বিভিন্ন মেইতেই লোককথাকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার যে কাজ কানহাইলাল করে গেছেন তার শুরু এইখানেই। ১৯৬০-৭০-এর দশকে মণিপুরের সবথেকে কঠিন সমস্যাগুলির মধ্যে একটি ছিল বেকারত্ব এ কথা আমরা প্রবন্ধের পূর্ববর্তী অংশে জেনেছি। এই বেকার-সমস্যা থেকে যে গুন্ডা সংস্কৃতি সমসাময়িক মণিপুরী সমাজে জন্ম নিয়েছিল তাকে দর্শকের সামনে তুলে ধরে “তামনা লাই” নাটক। লোকের মুখে মুখে ফেরা এই জনপ্রিয় লোককথাটিকে কানহাইলাল মণিপুরের সাম্প্রতিক সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটি রূপকধর্মী ভাষ্যে পরিণত করেন। এরপর থেকে, নিজের পারিপার্শ্বিক সাংস্কৃতিক আকরগুলি খুঁড়ে নাটকের উপাদান খুঁজে আনাটাই এক প্রকার কানহাইলালের হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রযোজনা বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কানহাইলাল লিখেছেন, “তামনা লাই” মণিপুরী দর্শকের অনুভুতিগুলির শেকড়ে গিয়ে আঘাত করতে পেরেছিল। এই নাটকে যে প্রয়োগকৌশল আমরা ব্যবহার করেছিলাম তা আমরা শিখেছিলাম আমাদের মৌখিকভাবে সঞ্চারিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলির থেকে। এগুলো আমাদের পক্ষে বুঝে ওঠা সহজ হয়েছিল কারণ আমাদের শেকড় আমাদের পারম্পরিক সাংস্কৃতিক জীবনের মধ্যে আগে থেকেই গভীরভাবে প্রোথিত ছিল।”[21] এই নাটকে অভিনয়ের ভাষা অদ্ভুতভাবে খুঁজে পান সাবিত্রী হেইসনাম। একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি এই ‘তামনা লাই’এর জন্য প্রস্তুতিপর্বের কথা বিস্তারিত বলেছেন। শেষ দৃশ্যে মা-হারা বিধবা মায়ের চরিত্রে হাহাকার করে কেঁদে ওঠার কথা সাবিত্রীর। মহড়া চলাকালীন নির্দেশক কানহাইলালের কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না কান্নার ধরন। সাবিত্রী অভিনেত্রী হিসেবে বড় হয়ে উঠেছেন নানা ধারার নাটকে অভিনয় করে। শিশুবয়েসে শ্রী চৈতন্যের জীবন বিষয়ে অভিনীত জনপ্রিয় গৌরলীলা, এবং পরবর্তীকালে রোম্যান্টিক মেলোড্রামাধর্মী পেশাদারী নাটকে তার ট্রেনিং। ‘তামনা লাই’-এর রিহার্সালে কানহাইলাল সাবিত্রীকে বলেন যে তিনি বাস্তবানুগ সামাজিক নাটকের বা মেলোড্রামার যে অভিনয়ের ধরন তা মঞ্চে দেখতে চান না। সাবিত্রীকে খুঁজে বের করতে হবে অন্য কিছু। তারপর একদিন মাঝরাতে সাবিত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন কানহাইলাল। তাঁরা শুনতে পান কিছু দূরেই কাবুই উপজাতির গ্রামে কোন এক উৎসবে তাদেরই ভাষায় স্তবগান চলছে, আর তারই সঙ্গে শোনেন রাতের অন্ধকারে একটি কুকুর চীৎকার করছে। কানহাইলালের পরামর্শ অনুযায়ী এরপর বহুদিন ধরে সাবিত্রী চেষ্টা করেন এই দুটি শব্দকে মিলিয়ে ‘তামনা লাই’এ তাঁর কান্নার ধরনটি তৈরি করতে; শুধুমাত্র বাস্তবানুগ না হয়ে এই কান্না হয়ে ওঠে আরও কিছু বেশী — আনুষ্ঠানিক স্তবগান এবং একটি জন্তুর আর্তনাদের মধ্যেকার কিছু। অতি অবশ্যই শহুরে মধ্যবিত্ত পরিমিতির ধারণার বাইরের এক শরীরী অভিব্যক্তি।

এভাবেই, এই পর্বে, কানহাইলাল, সাবিত্রী এবং কলাক্ষেত্রের অন্যান্য অভিনেতারা মণিপুরের নানা সাংস্কৃতিক চর্চার পরম্পরা থেকে শিখতে শুরু করেন, কিছুটা আকস্মিকভাবে, কিছুটা নিয়মবদ্ধভাবে। এই সময়কার গুরুদের কথা বলতে গিয়ে কানহাইলাল নাম নেন ইয়ামশাং মাইবি, গুরু আচোউবিসেনা আর পণ্ডিত কুলচন্দ্রর যারা সকলেই লাই হারাওবা-র পারফর্মেন্স শৈলীগুলির বিশেষজ্ঞ। অন্যদিকে তিনি বলেন গুরু ইবতম্বি সিং আর গুরু গৌরকিশোর শর্মার কথা যারা থাংতায় পারদর্শী। এঁদের সকলের কাছেই শেখেন কলাক্ষেত্রের অভিনেতারা। পরবর্তী কানহাইলাল লিখছেন যে এই গুরুদের ভাষায় অভিনেতা ও পারফর্মারদের জন্য এমন অনেক রূপকধর্মী নির্দেশ থাকত যাকে ঠিক ইংরাজি কেতাবি নাট্যশিক্ষার ভাষায় তর্জমা করে ওঠা যায় না, তবে যার ঠিকঠিক শরীরী মাপগুলো বুঝে উঠতে পারলে অভিনেতারা মূল্যাতীতভাবে লাভবান হবেন, যেমন “শরীরটাকে মাটিতে পুঁতে দাও”, “জলে চাঁদের মত ভাসিয়ে দাও”, “ধড়টাকে ঢেউ বানিয়ে ফেল” কিংবা “নিজের আত্মাটা ঘরের এই জায়গাটায় রাখো[22]

অভিনেতাদের শরীর সঞ্চালনের শিক্ষাপদ্ধতি ছাড়াও, নাট্যকার হিসেবে নাটক লেখার উপাদান খুঁজতে কানহাইলাল ফিরে যাচ্ছিলেন মেইতেই ‘ওরেচার’-এর উৎসগুলিতে। মেইতেই সংস্কৃতির মধ্যে কথকতার দুধরনের পরম্পরা বহু শতাব্দী ধরে জনপ্রিয় ছিল — তার মধ্যে একটিকে বলা হয় ‘ওয়ারি-লিবা’ এবং অন্যটিকে ‘ফুঙ্গা ওয়ারি’। ‘ওয়ারি-লিবা’র ঐতিহ্যে পেশাদারী কথকেরা বছরের কিছু বিশেষ সময়ে তাঁদের কাহিনীগুলি দর্শকবৃন্দের সামনে পেশ করেন। কথকতার সাথে সাথে নানা ধরনের স্তবগান, সঙ্গীতের ব্যবহার ও পেনা-র সঙ্গত এ সমস্ত ক্ষেত্রে প্রচলিত। ওয়ারি-লিবা বেশিরভাগ সময়েই আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রাম বা লেইকাই-এর স্তরে উপস্থাপিত হয় এবং যারা গল্প বলেন তাঁদের সাধারণত বিধিগতভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত হতে হয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় হডসনের বইয়ে আমরা ওয়ারি-লিবার উল্লেখ পাই এবং জানতে পারি যে সেই সময়ে ওয়ারি-লিবার কথকেরা বেশিরভাগই ভ্রাম্যমাণ গায়ক ছিলেন।[23] তাঁদের কাহিনীগুলি ছিল নানা সানামাহি ধর্মীয় পুরাকথার বিভিন্ন সংস্করণ — যেমন খাম্বা আর থইবির প্রেমের গল্প, বা নুমিত কাপ্পার (সূর্য) রোমাঞ্চকর বিজয়ের বর্ণনা। বর্তমানে মণিপুরে ওয়ারি-লিবা শিল্পীদের গিল্ড বা সমবায় সঙ্ঘ তৈরি হয়েছে, তারা সরকার এবং নানা রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সহায়তা পেয়ে থাকেন। বছরে একবার অন্তত আনুষ্ঠানিক ভাবে ইম্ফল শহরে রাজ্য স্তরের ওয়ারি-লিবা উৎসব সংগঠিত হয়, যেখানে নানা আমলা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব উপস্থিত থাকেন। মূল যে বিষয়টির ওপর এ ক্ষেত্রে আমি জোর দিতে চাইছি তা হল মেইতেই সমাজে লোকগাথা, আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক স্তরে গল্প বলার ঐতিহ্য, এবং ‘পারফর্মেন্স’-এর মধ্যে দৃশ্যতেই এক গভীর ঐতিহাসিক যোগ রয়েছে।

ওয়ারি-লিবা ছাড়াও, আনুষ্ঠানিক পরিসরের একেবারেই বাইরে রয়েছে ‘ফুঙ্গা ওয়ারি’র ঐতিহ্য, যার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া একটি গল্প ‘পেবেত’ নাটকের উৎস। ‘ফুঙ্গা-ওয়ারি’র সোজা তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘আগুনের চারপাশে বসে বলা গল্প’। যদি ওয়ারি-লিবা কে ভাবা যায় একটি ‘পাব্লিক পারফর্মেন্স’-এর শৈলী হিসেবে, তবে ফুঙ্গা-ওয়ারি-র ধরনটা অনেক বেশী ব্যক্তিগত, পরিবার ও গার্হ্যস্তের সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ। চরম শীতের রাতগুলিতে যখন গ্রাম বা লেইকাইগুলিতে আর কিছুই করার থাকে না, তখন প্রতিটি বাড়ির উঠোনে জ্বালানো আগুনের চারপাশে পরিবারের শিশুদের নিয়ে বসেন দাদু-ঠাকুমারা। এই সমস্ত শীতের রাতে যে সমস্ত গল্প এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখে শোনে পরিবারের ছোটরা তাকেই বলে ফুঙ্গা-ওয়ারি। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম সবথেকে বড়দের থেকে সবথেকে ছোটদের স্মৃতিতে সঞ্চারিত হয় এই কাহিনীগুলি, এবং এইভাবেই চলতে থাকে ফুঙ্গা-ওয়ারির পারিবারিক কথকতার ঐতিহ্য। বেশিরভাগ সময়েই এই গল্পগুলির লেজুড় হিসেবে থাকে কোন একটি সামাজিক বা নৈতিক শিক্ষা। রূপকের মাধ্যমে ছোটদের কাছে রাখা হয় কোন একটি সামাজিক সমস্যা বা অন্যায়ের কাহিনী, আর গল্পের ছলেই কোথাও বলে দেওয়া হয় সমাধানের সুত্র। সাধারণত গল্পের শেষটা সবারই মোটামুটি জানা থাকে, তবে সে কারণে বারংবার একই গল্প শোনবার ইচ্ছায় কোন ভাঁটা পড়ে না।

মণিপুরের রাজনৈতিক পটভূমিকায় ফুঙ্গা-ওয়ারির মত একটি অনাড়ম্বর এবং অন্তরঙ্গ কথনশৈলীর কি বিশেষ তাৎপর্য থাকতে পারে ? এই বিষয়ে ভাবতে গিয়ে প্রথমেই যে কথা মনে রাখা প্রয়োজন তা হল ৭০-এর দশক থেকেই যেমন মণিপুরে বৈপ্লবিক শক্তিগুলি জোরালো হয়ে উঠছিল তেমনই রাজনৈতিক অভিব্যক্তির গণতান্ত্রিক পরিসর ক্রমাগত কমে আসতে শুরু করেছিল। ভারত রাষ্ট্রের গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে ভীতি বাড়ছিল; মূল ভূখণ্ডে জরুরী অবস্থা শেষ হয়ে যাওয়ার তিন বছরের মধ্যে মণিপুরে লাগু হয় আফস্পা। চেহারা পালটে যায় শুধুমাত্র ইম্ফল শহরের নয়, আশেপাশের উপত্যকাব্যাপী সমস্ত গ্রামগঞ্জের আর পাহাড়ি উপজাতিগুলির গ্রামগুলির তো বটেই। সন্ধ্যে নামার পর রোজ নেমে আসে ঘোষিত বা অঘোষিত কার্ফ্যু; রাস্তায়-ঘাটে আর্মি ছাড়া আর কোন মানুষজন দেখা যায় না। রাতের অন্ধকারে সন্ত্রাসবাদের সন্দেহে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদের, তাদের বেশীরভাগ সময়েই আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। নিজেদেরই গ্রাম, শহরের অলিগলি, বাজার-মণ্ডপ অচেনা হয়ে ওঠে মণিপুরী মানুষজনের কাছে। সন্ধ্যের পরে বাজার দোকান সমস্ত বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, লোডশেডিং-এর অন্ধকার নিয়মিত নেমে আসে — সমস্ত সন্ধ্যাকালীন জমায়েত, উৎসব (এমনকি লাই হারাওবা), নাটক, রাসলীলা, পারফর্মেন্স স্থগিত হয়। এই সময়েই শুরু হয় মেইরাপাইবি আন্দোলন — মশাল হাতে মণিপুরী বয়স্থা মহিলারা সন্ধ্যার পর বেরিয়ে আসেন পাড়ায় পাড়ায়; আর্মির সাথে সাথেই, আর্মির নির্দেশ অমান্য করে, টহল দেন রাস্তায় রাস্তায়। অত্যাচার-অন্যায়ের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেন। তবে বেশীরভাগ সাধারণ মানুষই সূর্য ডোবার পরে কোন এক অজানা অপরাধে নিজেরই গৃহে বন্দী হয়ে সময় কাটান। রাষ্ট্রীয় অবদমন যেখানে প্রকাশ্য অভিব্যক্তি নিষিদ্ধ করে তোলে, তখন ফুঙ্গা ওয়ারির মতো অন্তরঙ্গ গল্পকথন ও যৌথ স্মৃতিচারণ হয়ে ওঠে এক অন্যধরনের রাজনৈতিক হাতিয়ায়। শীতের রাতে ফিসফিস করে বলা এই গল্পগুলির মধ্যে যেমন ধরা থাকে কৌমের অলিখিত ইতিহাস, তেমনই থাকে এক প্রজন্মের অন্য প্রজন্মের প্রতি উপদেশ, আশ্বাসপ্রদান, সাবধানবাণী এবং কখনো কখনো রাজনৈতিক কৌশলের বিধ্বংসী বীজ।

এরকমই একটি জনপ্রিয় ফুঙ্গা-ওয়ারি গল্পকে ১৯৭৫ সালে মণিপুরের সমসাময়িক রাজনৈতিক দলিল হিসেবে পেশ করলেন কানহাইলাল “পেবেত” নাটকে। যখন নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় তখন ভারতে জরুরী অবস্থা চলছে এবং তা মণিপুরের এবং অন্যান্য উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলির ওপরেও তখন এই ব্যবস্থা লাগু। আপাতদৃষ্টিতে, একটি ছোট্ট পাখির পরিবারের ওপরে একটি লোভী এবং আগ্রাসী বেড়ালের অত্যাচারের গল্পের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে আপত্তিজনক কিছুই নেই। শুনে মনে হয় যেন শিশুদের মনোরঞ্জনের কাহিনী একটি। কিন্তু, এই বহু পুরনো মেইতেই গল্পকথায় যে নৈতিক শিক্ষার পরিসর গোড়াতেই ছিল তাকে বাড়িয়ে তুলে কানহাইলাল নির্মাণ করলেন একটি জোরালো এবং আধুনিক রাজনৈতিক ভাষ্য। মেইতেই ভাষায় ‘পেবেত’ হল চড়াইয়ের থেকেও ছোট একটি পাখির নাম। অনেকেই বলেন যে পেবেত পাখি নাকি মণিপুরে বহু দশক ধরে দেখা যায়নি। এমনও বলা হয় যেএই পাখি আজ লুপ্ত। এর থেকেই কিছুটা বোঝা সম্ভব যে পেবেত পাখির লোককথা মেইতেই সমাজে ঠিক কতটা পুরনো। লোক মুখে ফেরা এই প্রাচীন গল্পটি নিয়ে কানহাইলাল তার নাটকে তেমন জটিল কিছুই করেন না। আপাতদৃষ্টিতে একটি সরল কাহিনী সরলভাবেই বর্ণিত হয়। কোন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক প্রবচন বা ব্যাখ্যা গল্পের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়না। কিন্তু ‘পারফর্মেন্স’-এর যে ভাষা তিনি ‘পেবেত’-এ তৈরি করেন তাতে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রা প্রদান করে মেইতেই ‘ওরেচার’এর এই নিদর্শনটির মঞ্চায়ন। মেইতেই জাতীয়তাবাদের মূলে যে অবমাননাবোধ ও রাজনৈতিক সম্মানের দাবীতার সাথে মিলিত হয়ে বেজে ওঠে ‘পেবেত’ নাটকের সুর। এই নাটকের মূল অর্থ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সাবিত্রী হেইসনাম সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাতকারে বলেছেন,

মানে খুব সহজ। একটি বড় গোষ্ঠী একটি ছোট গোষ্ঠীকে দাবিয়ে রাখছে। যে ক্ষমতাবান সে দুর্বলের অবমাননা করছে। বেড়ালটি এই ক্ষমতাবানের প্রতীক। পেবেত ছোট। ভাষাভিত্তিক অবদমন আমাদের সমাজের একটি প্রতিদিনের সত্য। […] মণিপুরি ভাষাকে রাষ্ট্রের অষ্টম শেড্যুলের অন্তর্গত করার জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল তাতে আমিও অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমাদের নিজেদের লিপি, অক্ষরমালা ছিল — মেইতেই মায়েক। তাও আমরা স্কুলে শুধু বাংলা স্ক্রিপ্টই শিখতাম। এর একটা ইতিহাস আছে। আমরা নিজেদের ভাষা, নিজেদের লিখনি ফিরে পেতে চাইছিলাম। শিখতে চাইছিলাম। এটাও একটা বড় বদল ঘটেছিল। অবদমন তো আমাদের জীবনের প্রতিটি পরিসরে ছিল।[24]

এই ভাষাভিত্তিক অবদমনেরই একটি বিশেষ রূপই হয়ত কানহাইলাল দেখেছিলেন দিল্লীর জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ে; এবং এই অবমাননারই একটি ভয়ঙ্কর রূপ উঠে আসে আমাদের সামনে ‘পেবেত’ নাটকে।

পেবেত নাতকে সাবিত্রী ও অন্য অভিনেতারা

কী ছিল ‘পেবেত’ নাটকের গল্প? এই বিশেষ ফুঙ্গা-ওয়ারি গল্পটিতে, আমরা দেখি একটি পেবেত পরিবার — একজন মা এবং তার পাঁচ সন্তান। নাটকটির শুরুতে আমরা দেখি এই মাকে তার পাঁচ সন্তানের জন্ম দিতে। দেখি তাঁর গর্ভযন্ত্রণার ছবি আর তারপর দেখি ভ্রূণ আকারে গুটিয়ে থাকা পাঁচটি পাখির সন্তানকে। তারা যেন নতুন প্রাণ, ডিমের খোলার মধ্যে জড়সড় হয়ে রয়েছে — এখনও জন্মায়নি। পেবেত মায়ের উত্তাপ ও ভালোবাসা পেয়ে, তারা একটু একটু ডিম ফেটে বেরোয়, অল্প অল্প চরে ফিরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে। যে দর্শকেরা মণিপুরিদের লাই হারাওবা উৎসবের জরুরী অংশগুলিরসঙ্গে পরিচিত, তারা অবিলম্বে বুঝতে পারবেন যে নাটকের এই গোড়ার অংশটুকু লাই হারাওবার “লাইবু” অনুষ্ঠানটির থেকে অনুপ্রাণিত। লাইবু অনুষ্ঠানটি লাই হারাওবার সবথেকে জরুরী আচারগুলির মধ্যে একটি এবং এটি উপস্থাপিত হয় উৎসবের দ্বিতীয় দিনে। লাই হারাওবার অন্যান্য বড় নৃত্যানুষ্ঠানগুলির মতই এ ক্ষেত্রেও প্রধান নৃত্যশিল্পী বা উপস্থাপিকা হন একজন ‘মাইবি’ বা সানামাহি ধর্মের মহিলা পুরোহিত। লাইবু আচারটির মধ্যে দিয়ে প্রধান মাইবি নৃত্যের মাধ্যমে বর্ণনা করেন ‘লাই’ অথবা দেবতাদের জন্মের প্রক্রিয়া। লাইবু নাচের চক্রের মধ্যে সবথেকে জরুরী হয় ‘হাকচাং সাবা’ অংশের নাচটুকু, যেখানে মাইবি নানা প্রতীকী হস্তমুদ্রার মধ্যে দিয়ে দর্শকদের দেখান কিভাবে দেবতার শরীর ভ্রূণ অবস্থা থেকে একটু একটু করে গড়ে উঠছে — তৈরি হচ্ছে চোখ, নাক, হাত, আঙ্গুল, উরু, যোনি, গোড়ালি, পায়ের পাতা। মাইবির এই নাচ ছাড়া লাই হারাওবার ধার্মিক প্রক্রিয়া সমাধা হওয়া একেবারে অসম্ভব। লাইবু চক্রের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় সরোজ পারাটের ১৯৯৭-এ ছাপা মেইতেই ধর্ম বিষয়ক বইয়ে, এবং তারও অনেক আগে ১৯৮৪ সালে লেখা নৃত্যশিল্পী-নৃতাত্বিক মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের বইয়ে। (যাঁরা মঞ্জুশ্রীর নৃত্য বিষয়ে গবেষণারত তাঁরা অবশ্যই তাঁর নাচের ওপর লাই হারাওবার প্রভাব বিষয়ে ভেবে দেখতে আগ্রহী হবেন)। আমাদের পক্ষে এখানে যেটা লক্ষনীয় তা হল লাই-এর শরীরের প্রতিটি অংশের হয়ে ওঠার জন্য মাইবি-নৃত্যশিল্পীরা ব্যবহার করেন একটি করে আলাদা হস্তমুদ্রা এবং এর প্রত্যেকটিরই একটি করে প্রতীকী মানে আছে। সাম্প্রতিক বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে সাবিত্রী বলেছেন যে নিজের অভিনয়শৈলী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি যেশুধু মাইবিদের পারফরমেন্স পদ্ধতিগুলির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত তাই নয়, মাইবিদের কাছে সরাসরি নৃত্যশিক্ষাও কলাক্ষেত্র-এর গোড়ার দিকে ট্রেনিং-এর অংশ ছিল। এই হাকচাং সাবার নৃত্যাচারের মধ্যেকার শরীরী বিন্যাস ও মুদ্রা আরও বিস্তারিত ভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৮৪-এ ‘মেময়রস অফ আফ্রিকা’ তে, যার কিছু প্রভাব কলাক্ষেত্রের সবথেকে সুপ্রসিদ্ধ প্রযোজনা ‘দ্রৌপদী’র (২০০০) মধ্যেও দেখা যায়। তবে লাই হারাওবার বিশেষ কিছু উপাদানের সর্বপ্রথম প্রয়োগ আমরা লক্ষ্য করি, আমার মতে, ‘পেবেত’ নাটকে, যদিও এ বিষয়ে কানহাইলালের কোন সরাসরি বক্তব্য কোন সাক্ষাৎকারে বা লেখায় পাওয়া যায়না। এতদ্‌সত্বেও, প্রশ্ন থেকেই যায় যে একটি সমাজের কোনও একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যখন এত গভীরভাবে প্রভাবশালী, তখন আধুনিক শিল্প সৃষ্টিগুলির মধ্যে কোনটি সেই ঐতিহ্যের সচেতন ‘ব্যবহার’ এবং কোনটি আরও অন্তরঙ্গ জটিলরূপে শুধুমাত্র একটি সাংস্কৃতিক আবহাওয়ার অংশীদার হয়ে উঠেছে, এ কথা সঠিকভাবে বুঝে ওঠা কঠিন।

এগিয়ে যাওয়া যাক ‘পেবেত’ নাটকের গল্প নিয়ে। পাখির বাচ্চাগুলি বড় হয়ে ওঠার পরে ঘটনাস্থলে এসে হাজির হয় একটি বেড়াল। বেড়ালের হাবভাব ব্যবহারে গোড়া থেকেই বোঝা যেতে থাকে যে পেবেত শিশুগুলিকে আত্মসাৎ করে তাদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে চায়। সে একে একে এই বাচ্চাগুলিকে নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে ফুসলে নিয়ে যেতে থাকে। তাদের বলতে বাধ্য করের তার নিজের ভাষা, নকল করতে বাধ্য করে তার আচারব্যবহার। নানা ভাবে অপমানিত করে তাদের, তাদের নাকাল করে আনন্দ পায়। এইসবের মধ্যে সবথেকে নিষ্ঠুর কাজ এই বেড়াল যেটি করে তা হল সে এই বাচ্চাদের যে বুঝিয়ে রাজি করে ফেলতে পারে তাদের নিজের মায়েরই অবমাননা করতে। বাচ্চারা একে একে হাতে পাথর তুলে নিয়ে মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিতে থাকে, ক্ষতবিক্ষত করে তোলে তাকে। রুস্তম ভারুচা লিখেছেন যে এই গল্পটি ফুঙ্গা-ওয়ারি ঐতিহ্যের মধ্যে এমনই জনপ্রিয় একটি গল্প যে বেশীরভাগ মেইতেইরা শুধুমাত্র এই গল্পের মূল ঘটনাগুলি মনে রেখেছেন এমনটা নয়, তারা মনে রাখতে পারেন কাহিনীর বিশেষ-বিশেষ সংলাপগুলিকেও।[25] কানহাইলাল যখন ‘পেবেত’-এর টেক্সট বা পাঠ তৈরি করেন তখন পাখিদের আপাত অর্থহীন ডাকগুলি-র শব্দ (যা দিয়ে নাটকে একধরনের সঙ্গীতও তৈরি হয়) ছাড়া, বাকি প্রায় সমস্ত সংলাপই তিনি এই মৌখিকভাবে চলে আসা লোকগাথার সংলাপগুলি থেকে সরাসরি গ্রহণ করেছিলেন। ‘ওরাল টেক্সট’ থেকে ‘পারফর্মেন্স’-এ রূপান্তরিত করতে গিয়ে বড় বদল বলতে হয় দুটি জিনিস – এক, বেড়ালটিকে কানহাইলাল চেহারা দেন এক হিন্দু বৈষ্ণব পুরোহিতের। সে মঞ্চে প্রবেশ করে কপালে রসকলি কেটে, মালা জপ করতে করতে, গেরুয়া চাদর জড়িয়ে। দেখলেই বোঝা যায় সে অতি ধার্মিক বেড়াল। দুই, বেড়ালটি সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত। সে মাঝে মাঝে মেইতেই ভাষায় দু একটা সংলাপ বলে উঠলেও, তার প্রধান কাজ হয় পাখির বাচ্চাগুলিকে সংস্কৃত আওড়াতে বাধ্য করা। তারা একটি লাইনই বলতে শেখে, ‘জননী জন্মভুমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’ যার অর্থ ‘জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের তুলনায় শ্রেয়”। বলা হয়, রামায়ণের কোন একটি সংস্করণে রাম স্বয়ং এ কথা বলেছিলেন। এই অচেনা ভাষার অজানা বাক্যটি পণ্ডিতের আগ্রাসী শিক্ষার স্বীকার হয়ে তারা আওড়াতে শেখে, এবং এই শব্দগুলি উচ্চারণ করতে করতে তারা নিজেদের মাকে পাথর ছুঁড়ে মারে। আহত করে। সংস্কৃতজ্ঞানী বেড়াল তাদের বাধ্য করে নিজের পশ্চাদ্দেশ লেহন করতে; পাখিরা তখন স্বাধীনতার স্বাদ এতটাই ভুলেছে যে তারা সেই কাজও আনন্দের সঙ্গে করে ফেলে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, ইম্ফল শহরের রাজনৈতিক আবহাওয়ার প্রেক্ষিতে যখন এই নাটক প্রথম মঞ্চস্থ হয় তখন না মণিপুরী না ভারতীয় পক্ষের দর্শকের কোন সন্দেহ থাকে নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে। মেইতেই জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের অন্তরের কথাগুলিকে মঞ্চপরিসরে তুলে ধরে এই নাটক। বেড়ালের কর্তৃত্বাধীন পাখিগুলির কাছে সংস্কৃত শব্দগুলি হয়ে ওঠে অস্ত্রের মতন যা দিয়ে তারা নিজের মা-কে আঘাত করতে পারে। তাদের সংস্কৃত ভাষায় মা ও মাতৃভূমির গুণগান করতে করতে নিজের মা-কে ক্ষতবিক্ষত করার মধ্যে যে গভীর রাজনৈতিক হতাশাবোধ, ঐতিহাসিক অবমাননা ও সম্মানের লড়াই প্রকট হয়ে ওঠে তা কোন মেইতেই মানুষের পক্ষেই সেই সময়ে না চিনে উঠতে পারা সম্ভব ছিল না। ফলস্বরূপ, খবর ছড়িয়ে যায় যে এই নাটক ‘হিন্দু বিরোধী’ এবং তার থেকেও জরুরীভাবে, ‘ভারত-বিরোধী’। এমার্জেন্সির সময়। কানহাইলালকে ডেকে পাঠানো হয় ইম্ফলের একটি পুলিশ থানায়। অফিসার দেখতে চান স্ক্রিপ্ট। কানহাইলাল অফিসারের সামনে ছেঁড়া পাতায় পেন্সিল দিয়ে লেখেন একটিমাত্র লাইন – সেটি সংস্কৃত, আপাতদৃষ্টিতে খোদ ‘রামায়ণ’ থেকে গৃহীত। বাকি যে কটা অর্থবহ সংলাপ তা সমস্তই জনপ্রিয় লোকগাথা থেকে গৃহিত। অফিসার ঠিক বুঝতে পারেন না এর মধ্যে কোন সংলাপটি সেন্সর করবেন। নিষিদ্ধ করবেন মেইতেই সমস্ত মানুষের মুখস্থ একটি লোকগল্প না রামায়ণের ‘পবিত্র’ সংস্কৃত শ্লোক? দুটোই তার কাছে অসম্ভব এবং আজগুবি মনে হয়। তিনি কানহাইলালকে যেতে দেন। সেন্সর না হয়েই জরুরী অবস্থার বছরগুলিতে ইম্ফল শহরে রমরমিয়ে চলতে থাকে ‘পেবেত’-এর শো। সেই সময়ের বিপ্লবী রাজনৈতিক দলগুলির সক্রিয় কর্মীরা অনেকেই এই নাটকটির দ্বারা অনুপ্রাণিত বোধ করেন এমন কথা রুস্তম ভারুচার গবেষণায় পাওয়া যায়।

তার থেকেও জরুরী বিষয় বোধহয় এই যে প্রথম মঞ্চায়নের প্রায় ৪৫ বছর এবং স্বয়ং কানহাইলালের প্রয়াণের পরেও ‘পেবেত’ সফলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। এর একটা বড় কারণ বোধহয় এই যে ‘দ্রৌপদী’ বা ‘ডাকঘর’ নাটকের ক্ষেত্রে যা সম্ভব হয় না, তা ‘পেবেত’-এর ক্ষেত্রে হয়। এই এত দশক ধরে ‘পেবেত’ বিভিন্ন ধরনের স্থানে উপস্থাপিত হয়েছে। এর জন্য প্রসেনিয়াম থিয়েটারের স্পেস জরুরী নয়। এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কানহাইলাল আমাকে একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যে এমনটা নয় যে তাঁর প্রসেনিয়াম বিষয়ে কোন রকমের অনীহা বা আপত্তি আছে। অনেক নাটকের ক্ষেত্রেই তার মনে হয়েছে যে প্রসেনিয়াম এর পরিসরটা জরুরী — যেমন ‘দ্রৌপদী’। কিন্ত এমন অনেক অন্য নাটক আছে — যেমন ‘পেবেত’ বা ‘মেম্যরস অফ আফ্রিকা’ — যেগুলি তিনি মেইতেই পারম্পরিক নাট্য প্রদর্শনের জায়গাগুলিতে অভিনয় করতে বেশী সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ‘মেময়রস’ বেশীরভাগ সময়েই আমি প্রসেনিয়ামের বাইয়ে কোন খোলা জায়গা, বাগান, মণ্ডপ বা উঠোনে অভিনীত হতে আমি দেখেছি। অভিনয় বা নাচের জন্য নির্মিত এরকম মণ্ডপ ইম্ফলের সব জায়গায় পাওয়া যায়। ‘পেবেত’-এর ক্ষেত্রে প্রসেনিয়ামে অভিনয় যেমন কখনই অসুবিধেজনক ছিল না, তেমনই একই স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে এ নাটক আমি অভিনীত হতে দেখেছি গাছতলায়, খোলা উঠোনে বা ঘরের ভেতরে। মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে এই আকারগত নমনীয়তা ‘পেবেত’ নাটকের অনেকগুলি জোরের মধ্যে একটি এবং এর সাথে এই নাটকের দীর্ঘ অভিনয়ের ইতিহাসের একটা যোগ অবশ্যই আছে। তবে শুধু ফর্মের প্রশ্নে আটকে থাকলে এ ক্ষেত্রে ভুল মূল্যায়ন করা হবে। ‘পেবেত’ যেমন মণিপুরের রাজনৈতিক অবদমনের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ ধরতে পেরেছিল, একই সাথে পেরেছিল এমন একটি অভিনয়ের ভাষা তৈরি করতে যা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাত্রা করতে পারে তার মূল প্রতিপাদ্যর কিছুমাত্র না হারিয়ে ফেলে। যেহেতু এই নাটকে কোন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ভাষ্য বা কথিত বিশ্লেষণ নেই, এবং সমস্ত নাটকীয় দ্বন্দ্বও সঙ্কটের মুহূর্ত মূলত অভিনেতাদের শরীরের রেখায় আঁকা হয়ে থাকে, আক্ষরিকভাবে ভাষা বুঝতে না পারাটা এই নাটকের ক্ষেত্রে কোন সমস্যাই নয়। ‘পেবেত’ তার নিজের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য একটুও না হারিয়ে, পেরে ওঠে তার কেন্দ্রীয় সমস্যাকে বিভিন্ন অঞ্চল ও সংস্কৃতির মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। ঔপনিবেশিক শিক্ষার আগ্রাসনের চিত্র দেখতে পাই আমরা, দেখি ধর্মীয় ও ভাষাভিত্তিক অবমাননার চরিত্র। অবদমিত মানুষের ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে সম্মান ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের নানা স্তর উপস্থাপিত হয় আমাদের সামনে। সবথেকে জরুরী এ ক্ষেত্রে বোধহয় এইটা বুঝে ওঠা যে, উৎকৃষ্ট সংস্কৃতির উপযাজক হয়ে আসে যে ঔপনিবেশিক শক্তি তার হাতে অনেক সময়েই থাকে ভাষাভিত্তিক আগ্রাসনের হাতিয়ার — অক্ষরমালা, প্রাচীন লিখনি, পুস্তকাগার, শাস্ত্র ও মহাফেজখানার দলিল-দস্তাবেজ। তার বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে থাকে আপাত নির্বল পাখির ‘অর্থহীন’ ডাক — একটি বাচিক, স্মৃতিনির্ভর সংস্কৃতির মিথ, লোকগাথা ও পারফর্মেন্সের আকর। কেমন হয় এই লড়াইগুলি? শরীরী হিংসার পরিসর পেরিয়ে কোন মানসিক আগ্রাসনের দিকে এগিয়ে যায় এই কর্তৃত্বস্থাপন? এমনই কিছু প্রশ্ন এবং প্রশ্ন উদ্রেককারী দৃশ্যমালা আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় ‘পেবেত’ নাটক। এতগুলো দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরেও, এই প্রশ্নগুলির প্রভাব তো কমেইনি, বরং রাজনৈতিক ভাবে আরও গুরুতর হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের দোরগোড়ায় এসে তাঁর ‘দ্য স্টোরিটেলার’ নামে প্রবন্ধে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন লিখেছিলেন যে ‘তথ্যের’ আগ্রাসনের মুখে পড়ে আধুনিক সমাজের গল্প বলার ক্ষমতা শেষ হয়ে আসছে; আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলিকে যৌথ পরিসরে ভাগ করে নিতে ভুলে যাচ্ছি। গল্প শোনার আকর্ষণ শুধুমাত্র শেষটুকু জেনে ফেলা নয়; সেটা আধুনিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে পড়ে। বরং একই গল্প, চেনা গল্প, বারংবার একসাথে শুনে একই শিক্ষা যৌথভাবে বারংবার পাওয়ার মধ্যে যে মজা আছে তাই কথকতা করা ও শোনার আনন্দ। এই কৌম স্তরে যৌথ স্মৃতিচারণার পরিসরে উঠে আসতে পারে এমন সব সত্য যা রাষ্ট্রচালিত মহাফেজখানার তথ্যভাণ্ডারে জায়গা পায়নি। মানুষেরস্মৃতি দাঁড়িয়ে উঠতে পারে সরকারী ইতিহাসের বিরুদ্ধে। তাই আফস্পা-চালিত রাজ্যে, ফুঙ্গা ওয়ারিও একটি পারফর্মেন্সের পরিসর তো বটেই। তাকে আরও গভীরভাবে রাজনৈতিক করে তোলে হেইসনাম কানহাইলালের কথকতা। ‘পেবেত’ নাটক শাস্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করায় পাখির ডাককে।

উল্লেখপঞ্জী


[1] সরোজ নলিনী পারাট, দ্য রিলিজয়ন অফ মণিপুর – বিলিফস, রিচুয়ালস অ্যান্ড হিস্টরিকাল ডেভেলপমেন্ট, (গৌহাটি আর দিল্লী: স্পেকট্রাম পাবলিশার্স, ১৯৮০), পৃ ১৪৫-১৪৬।

[2] ইংরাজিতে এই শব্দের অর্থ দাঁড়ায় এমন কোন ফলক যার ওপর বারে বারে আগের লেখা মুছে দিয়ে আবার লেখা হয়েছে, এবং আগের লেখার অংশবিশেষ বর্তমান লেখাকে ছাপিয়ে অন্তত কোথাও কোথাও দৃশ্যমান রয়েছে।

[3] পারম্পরিক মণিপুরী “মার্শাল আর্ট” বা সামরিক কলা।

[4] টি সি হডসন, দ্য মেইথেইস, (নিউ দিল্লী: লো প্রাইস পাব্লিকেশান্স, ২০০৭)।

[5] মঞ্জুশ্রী চাকী-সরকার, ফেমিনিসম ইন এ ট্র্যাডিশনাল সোসাইটি: উইমেন অফ মণিপুর (নিউ দিল্লী: শক্তি বুকস, ১৯৮৪)।

[6] সরোজ নলিনী পারাট, দ্য রিলিজয়ন অফ মণিপুর – বিলিফস, রিচুয়ালস অ্যান্ড হিস্টরিকাল ডেভেলপমেন্ট, (গৌহাটি আর দিল্লী: স্পেকট্রাম পাবিলশারস, ১৯৮০)।

[7] হডসন, দ্য মেইথেইস, পৃষ্ঠা ৯৫।

[8] চাকী-সরকার ছিলেন ‘ডান্সারস গিল্ড’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্দেশক, এবং ‘নবনৃত্য’-এর ধারণার জন্মদাত্রী।

[9] সাম্প্রতিক গবেষকদের মধ্যে রোজিও উশাম এবং দেবাঞ্জলি বিশ্বাস ‘লাই হারাওবা’ নিয়ে কাজ করেছেন কিন্তু তাঁদের গবেষণা এখনও বই হিসেবে প্রকাশিত হয়নি।

[10] গুগি ওয়া থিওংগো, “নোটস টুওারডস এ পারফরমেন্স থিওরি অফ অরেচার”, পারফরমেন্স রিসার্চ ১২ (৩), (নিউ ইয়র্ক: টেলর এন্ড ফ্রান্সিস, ২০০৭), পৃষ্ঠা ৪-৭।

[11] সরোজ নলিনী পারাট আর জন পারাট, দ্য প্লিসিং অফ দ্য গডস – মেইতেই লাই হারাওবা, (ইম্ফল: জৈন বুক শপ, ২০১৮ [পুনর্মুদ্রণ]), পৃষ্ঠা ১৯।

[12] পেনা যন্ত্রের দড়ির অংশটিকে পুরুষ এবং বাকি যন্ত্রটিকে নারী বলে মনে করা হয়, এবং এই দুই অংশের মিলনে সঙ্গীতের জন্ম এমন কথা মেইতেই মানুষজন বিশ্বাস করেন। এই কারণেই, পেনা ছাড়া লাই হারাওবা সংগঠিত হওয়া অসম্ভব।

[13] সরোজ ও জন পারাট, দ্য প্লিসিং অফ দ্য গডস, পৃষ্ঠা ২০।

[14] পিয়ের নরা, “বিটুইন মেমরি এন্ড হিস্টরি: লে লিউ দ্য মেময়র”, রেপ্রেসেন্টেশন্স, নম্বর ২৬, স্পেশাল ইশ্যু: মেমরি এন্ড কাউন্টার-মেমরি , (স্প্রিং, ১৯৮৯), পৃষ্ঠা ৭-২৪।

[15] বেনেডিক্ট অ্যান্ডরসন, ইমাজিন্ড কমিউনিটিস: রিফ্লেকশান্স অন দ্য অরিজিন এন্ড স্প্রেড অফ ন্যাশনালিস্ম, (লন্ডন এন্ড নিউ ইয়র্ক: ভারসো, ১৯৮৩)।

[16] ডায়ানা টেলর, দ্য আরকাইভ অ্যান্ড দ্য রেপেরটোয়ার: পারফর্মিং কালচারাল মেমরি ইন দ্য আমেরিকাস, (ডুরহাম আর লন্ডন: ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৩)।

[17] গুগি ওয়া থিওংগো, “নোটস টুওারডস এ পারফরমেন্স থিওরি অফ অরেচার”, পারফরমেন্স রিসার্চ ১২ (৩), (নিউ ইয়র্ক: টেলর এন্ড ফ্রান্সিস, ২০০৭), পৃষ্ঠা ৪।

[18] জন পারাট, উন্ডেড ল্যান্ড: পলিটিক্স অ্যান্ড আইডেন্টিটি ইন মডার্ন মণিপুর (নিউ দিল্লী: মিত্তল, ২০০৫)।

[19] হেইসনাম কানহাইলাল, দ্য থিয়েটার অফ দ্য আরথ: এসেস এন্ড ইন্টারভিউস, (কোলকাতা: সিগাল বুক্স, ২০১৬), পৃষ্ঠা ১০।

[20] রুস্তম ভারুচা,  দ্য থিয়েটার অফ কানহাইলাল: পেবেত এন্ড মেময়রস অফ আফ্রিকা, (কোলকাতা: সিগাল বুক্স, ১৯৯২), পৃষ্ঠা ২২।

[21] হেইসনাম কানহাইলাল, দ্য থিয়েটার অফ দ্য আরথ: এসেস এন্ড ইন্টারভিউস, (কোলকাতা: সিগাল বুক্স, ২০১৬), পৃষ্ঠা ৩৬।

[22] হেইসনাম কানহাইলাল, দ্য থিয়েটার অফ দ্য আরথ: এসেস এন্ড ইন্টারভিউস , পৃষ্ঠা ১৩।

[23] হডসন, দ্য মেইথেইস, পৃষ্ঠা ১১৭।

[24] তৃণা নিলীনা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্টারভিউ উইথ সাবিত্রী হেইসনাম  (কোলকাতা: প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট আর সংহিতা, ২০১৮), পৃষ্ঠা ২৩।

[25] রুস্তম ভারুচা, দ্য থিয়েটার অফ কানহাইলাল, পৃষ্ঠা ৩৩।

তৃণা নিলীনা বন্দ্যোপাধ্যায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেজ-এ অধ্যাপক, অভিনেতা ও লেখক, কলকাতা পীপলস ফিল্ম ফেস্টিভাল ও প্রতিরোধের সিনেমা পত্রিকার সাথে যুক্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.