এলিশিবা কুই

এলিশিবা কই??

গন্ধবরুণ ও গঙ্গারামপুরের দই 

১.
বাড়ির মালিক ডায়াবেটিক।  কম বয়সে আয়কর কনসালট্যান্ট। বম্বে-দিল্লী ঘুরে প্রচুর আয় করে শেষে কলকাতায় এসে চারতলা বাড়ি হাঁকিয়েছে; ভাড়া দিয়ে দিব্যি চলছে তার। গলায় সোনার চেন, থুতনির তলা দিয়ে ঘোড়ার নাকে গলানো দড়ির মতন দাড়ি দু’দিকে কানের গোড়া অবধি উঠেছে – হালকা মেরুন রং। ভাদুড়ী বাড়ি ছেড়েছে – প্রেমিকার সাথে সহবাস করবে। আসলে সহবাস কিনা জানা নেই অথবা ‘সহবাস’ শব্দটা বড় একপেশে হয়ত; আর যাই হোক কেমন যেন ‘যৌনমিলন’ ব্যাপারটা আগাগোড়া দাবিদাওয়া নিয়ে বিচরণ করে। অন্য আরেকটা ধারণার মত ‘শব্দের, অক্ষরের ধারণা’ তার স্বাদ কিকরে যেন বায়াসড  হয়ে যায় কত সহজে! বাজারে চা-এর দোকানে – মধ্যাহ্নের আহার শেষে পাড়ার মা-মাসীরা ‘সহবাস’ শব্দটা  ফিসফিসিয়ে বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। চার বছরকালে এরকম আবদার কেউ করেনি। পালবাজারের মেসে ঘরের আলো বন্ধ করে  রাফিন আর শ্রেয়া  ঢুকত, মেসমালিক গভীর ঘুমে তখন। ফলতঃ তাদের একসাথে থাকার ব্যাপারটা কখনই আলাদা করে বলার প্রয়োজন হয়নি। বললেও তার পরিণতি জানাই  ছিল। গোটা  শহর রে-রে করে উঠত; একে মোসলমান ছোঁড়া তায় প্রেমিকা নিয়ে মেসযাপন! ঘড়িগুলো ছবির  মত দশটা-দশ বেজে থেমে রয়েছে যেন। সন্দীপদার বলা গল্পটা মনে পড়ে .. “মৌসুমী ভৌমিক অনেককাল  বাড়ি ভাড়া খুঁজে পায়নি!”

সুভাষ পাঠাগারে যেসব বই ‘প্রাঃ’ ট্যাগ মারা, সেসব ইস্যু করা যেতনা। ছোট্ট লাইব্রেরি – গ্রামীণ ; জল-বিজলি নেই; বাঘাযতীন মোড় – রানিকুঠি রুটে সন্ধ্যেবেলা হৈ-হৈ-রৈ-রৈ তুলে যে ঢ্যামনা হাঁদা-মোটা ভলভো বাসটা লালকা মাঠের পাশে রাত্তিরের ঘুম সারতে আসে সেই সাইজের একটা বাস অবধি পৌঁছতে পারবেনা নতুনপাড়া-গজেন্দ্রপুর চৌরঙ্গী সরু  রাস্তায়। ফলতঃ সুভাষ পাঠাগারের বই কম। গরমের ছুটির দিনগুলোয় প্রাপ্তবয়স্ক ট্যাগ দেওয়া বইগুলো অমোঘ আকর্ষণের বস্তু হয়ে উঠত খুব সহজেই। একদিন নতুন বইয়ের খাপ থেকে ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’ ঝেঁপে চোখখারাপ-বুড়ো-কেরানীকে দিয়ে ইস্যু করলাম। কলকাতায়  ভাড়াবাড়ি  খুঁজে খুঁজে বারবার নাকচ হওয়া মুসলিম যুবক – অবিবাহিতা যুগলদের দেখলেই সেই গল্পটা মনে পরে বারবার। বাড়ির মালিক প্রথম ঘন্টা ‘না’ বললে ও তার যথার্থতা প্রমাণে প্রচুর গল্প শোনাল; শেষে আটহাজারের ঘর দশহাজারে রফা হল; শর্ত একটাই – ভাদুড়ীর সঙ্গিনীকে শাঁখা-সিঁদুর পরে থাকতে হবে।
একটা ইন্ডা‌কশন কুকার – কতক থালা, ছুরি, মশলার কৌটো আর দুটো ঘর নিয়ে ভাদুড়ী ঘর সাজালে।
২.
ভোরবেলা এদিককার রাস্তাগুলো সুন্দর।  যে-ক’বছর দমদম – সিঁথির মোড় – নাগেরবাজারে থেকেছি তার থেকে বেশ আলাদা।  চৈত্র মাস পড়ে গেল। গলির মোড়ে আমগাছে গুচ্ছ আমের ফলন। হলুদ রঙের ট্যাক্সি হুস-হুস করে ছোটে; সবক’টা এম-টু’য়ের মত ব্যস্ত। সাম্বা বলে এম-টু সবচেয়ে কেতার বাস গোটা কলকাতায়। দেখতে লঝ্ঝরে অথচ চাল বড় খেয়ালী তার। কারো পরোয়া করেনা; কেউ এগিয়ে এসে হাত দেখালে থামবে তো না-ই বরং পারলে উড়িয়ে চলবে। আমার চেনা কেউ এম-টু-তে উঠেছে কখনো শুনিনি। এমনকি দেখেছি মাত্র একবার। কেপিসি টিবি হসপিটালের সামনে জ্যামে আটক। গরমকাল, ভাঙ্গা রং ওঠা বাস; চালকের মুখটাও সেরকম, যেন সমস্ত ভীড় ভেঙ্গে, লোকজন রেখে, খানাখন্দ-ছালওঠা পীচরাস্তা টপকে-টপকে তার পালানোর তাড়া  ক্রমশ তীব্রতর। হিচককের মুভিতে নায়কেরা যেভাবে পেছনে ফেলে চুল পাট  করে আঁচড়ায় সেরকম চুল তার। গাড়ির বনেট কাঁপছে – যেন ফুঁসছে।
পাঁউরুটিওয়ালা তিনচাকার গাড়িতে প্যাডেল মারতে মারতে রাস্তার মাঝ বরাবর চলে দুলকি চালে। দূরে কোথাও সকালের মাদার ডেয়ারী’র গাড়ি দুধের ডিব্বা নামায়। শুনশান রাস্তায় হঠাৎ জনস্রোত নামে কলকল স্বরে; যাদবপুর – ঢাকুরিয়া  স্টেশনরোড ভরাট করে।  মেয়ো রোডে যেরকম মিছিল হল সেবার সেপ্টেম্বরে, সেরম দু’ধার ঠেসে রাস্তার। ক্যানিং – লক্ষীকান্তপুর – ডায়মন্ড থেকে কলকাতার কাজের মাসি – মুটেমজুর -রিক্সাওয়ালার দল; হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ –  মুখে হাসি। রোজ লোকালট্রেন ভরাট হয়ে এসে ঘুম ভাঙ্গায় পাড়ায় পাড়ায় প্রত্যেক গৃহস্থের। রাস্তায় রাস্তায় প্যাঁ-পুঁ -প্যাঁ-পুঁ রিক্সা নামে। ততক্ষণে পিটাই পরোটার দোকান ঘুঘনি-ডিমসেদ্ধ – ভাজা লঙ্কা নিয়ে রেডি। দু’একটা ছোকরা সুন্দর চিকন টায়ারের সাইকেল চালিয়ে সাঁ করে চলে যায়। ‘ট্যুর ডে-ফ্রান্সের’ সাইকেলের মত মেদহীন ব্যাপার একটা! সীট থেকে পাছা উঠিয়ে এদিক-ওদিক এদিক-ওদিক চট্-পট্ প্যাডেল হাঁকাতে থাকে। কঁচুয়া-বোয়ালমারির সড়কের কথা মনে আসে খুব। সাড়ে ন’টা বাজলেই মন্ডলঘাট – নন্দনপুর -কুম্বারী থেকে দলে দলে ছাত্র স্কুলে যেতে থাকে। হেঁটে , কতক সাইকেলে চড়ে, হাফ প্যাডেল  – ফুল প্যাডেল; তিনফুটের লম্বা ছেলে চব্বিশ ইঞ্চি ঢ্যাঙ্গা বি-এস -এ সাইকেল ; কারো হিরো – কারো এটলাস, কারো চাকায় প্লাস্টিকের স্টিকার – কারো হ্যান্ডেলের দু’ধারে ঝলমলে রাংতা ঝোলানো; কারোবা লঝঝড়ে।  আর হতো রেস সাইকেলের। চেনা অচেনা যেই হোক;  একজন যদি আরেকজনকে কাটালো তো আড়চোখে তাকিয়ে পীঠ নিচু করে ষাঁড়ের মত উঁচিয়ে সেও প্যাডেলে ছুট লাগালো। গজেন্দ্রপুর চৌরঙ্গী মোড়ে দুটো রাস্তা মিলেছে।  একটা মন্ডলঘাট আরদূরে জলপাইগুড়ি, আরেকটা তিস্তার পাড় ছুঁয়ে এসে হলদিবাড়ি রওয়ানা দিয়েছে। ফাইভ-সিক্সের ছেলেরা অথবা বেঁটে যারা উঁচু সাইকেল চালাতো তাদের ছিল ঢিমে তাল; আর যারা নতুন, হাফ-প্যাডেল গোত্রের তাদের কুছ-পরোয়া নেই  ভাব ; কোনমতে টেনেটুনে গন্তব্যে পৌছুলেই হল ; মাঝে জোরামে কেউ জিরিয়ে  নিত। রবিচাষ মরশুমে কাদাহীন প্রধানসড়কে খানিক ভীড় থাকে ; টমেটো-লাউ-লঙ্কার ভ্যান। এদের স্বভাব কয়লার ওয়াগনের মত – মাল পৌছুলেই হলো কোনো একবেলায় ! সাইকেলের আরোহী বেশিরভাগের ডেডলাইন এগারোটার লোকাল ট্রেন।  এগারোটায় হলদিবাড়ির সব স্কুলের প্রেয়ার। টাউন পৌছুলে রাস্তা জ্যাম তাই ওটা ফিনিশিং এন্ড। ওই অবধি পৌছে সাদা জামা ঘেমে যে যার মত ক্লাসে যেত আর যারা রেসে জিতত – বেশ ভারিক্কি চালে বেল বাজাতে বাজাতে গর্বভরা মুখে ভীড় ভাঙতো।
কলিং বেলের শব্দ; বাড়ির মালিক দরজা খুলে দেয় ঘুমচোখে। হাঁটু অবধি কাপড় পরা, কানে রুপোর রিং-অলা মহিলা রোজ আসেন ক্যানিং থেকে। বাসনমাজা  – কাপড়কাচা – রান্না সব করে দেয় তার বাড়ির। কন্ন জেঠি ছিল পাশের বাড়িতে গাঁয়ে। এরকম হাঁটু অবধি কাপড় ছাড়া কখনো দেখিনি; উঁচু দাঁত – খুব সুপুরি খেত। স্বামীর নাম ফেদেরি – একটা আস্ত কুঁড়ে – ভালো নাম ভূপেন্দ্রনাথ। তার সাইকেলের অনেক গল্প আছে। গাঁয়ের লোকে বলে তার সাইকেলে ধুলো পড়েনা – মাছি বসলে পিছলে যায়। কন্ন জ্যাঠাইমা’র নামের উৎপত্তিও কেউ জানেনা। কর্ণ নাকি কন্যে কে জানে! ভোররাতে উঠে স্নান সেরে নতুন কাপড় পড়ে  মুখে পান-সুপুরি গুঁজে কাশিয়াবাড়ির ফার্স্ট লোকাল ধরে শিলিগুড়ি যায় – ঘরকন্নার কাজ করতে। ফেদেরি সারাদিন সাইকেল মোছে।  নেড়ি কুকুরকে খাবার দেয়, বিকেলে হাটে যায়, পকেটে রেশমি রুমাল। সাইকেল স্ট্যান্ড করে ওঠালে, স্ট্যান্ডের গায়ে  মাটি-কাদা মোছে তাই দিয়ে। সন্ধ্যে নাগাদ তার বাড়ি যাত্রার রিহার্সাল হয়।  দ্বিতীয় বৌয়ের সংসারে অনেক ছেলেপুলে। অত লোকের খাবার নেই  তাদের  শ্বশুরবাড়িতে। বাড়ি পাঠিয়েছে তাই। পিঠে পরব – চৈত্র সংক্রান্তি – গাঁয়ে মেলা হলে তারা আসে। যাত্রার দলের এক মহিলার সাথে ফেদেরির বড় সখ্যতা। তাকে দিনে দেখা যায়না। রাত্তিরে এসে ভোরে চলে যায়। সন্ধ্যেবেলা ফেদেরির অট্টহাসি শোনা যেতো। ‘প্যাচকেটার সংসার’ নামে এক গ্রাম্য পালা – একটাই পালা হয়  রোজবছর। ফেদেরি ছিল প্যাচকেটা চরিত্র,  সেই যাত্রায়; তার রক্ষিতার মত কিছু চরিত্র গোটা গ্রামে অদৃশ্য হয়ে ঘুড়ে বেড়ায়, যাদের নিয়ে কানাকানি-ফিশফিশ করে কথা হয়।  কেউ সামনে কিছু বলেনা, রেখেঢেকে রাখে। তাদের আনাগোনা রাত্তিরে-সড়কে-বেনামে! রাত হলে পাড়াটা কেমন রহস্যে ভরে যায়।  মাইনর স্কুলে পড়ার দিনে , বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত টিউশন শেষে।  প্রায়সই ক্ষিতীশের সোঁতা পেরিয়ে এক মহিলার সাথে দেখা হতো – মুখ গামছা দিয়ে ঢাকা। সাইকেলের ঘন্টা শুনে রাস্তার একধারে চেপে দাঁড়িয়ে থাকতো মাথা নামিয়ে – আরোহীর চলে যাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনত। কারো কোনো প্রশ্ন থাকতনা তার প্রতি। অনেক পরে জেনেছি গোবিন্দর মাসি সে।  গোবিন্দর বাবা বাড়ি এলে সে রাত্তিরে তাদের বাড়ি যায় রাত কাটাতে।
বেলা নেমে আসে। পানিসাপটির গাছে প্যাঁচা ডাক দেয়। বাঁশবাগানের ওপারটা অন্ধকার হয়ে আছে – জোনাকীর দল এসে খেলা করে। চানখানাটারির বাগান হয়ে ধূলোর রাস্তা ধরে কেউ দুধ আনে গোয়ালাপাড়া থেকে; অন্ধকারে ভয় পেলে শীস দেয় সুরহীন – ডালের মেহেন্দির গান গায়। গৃহস্থ বাড়িতে জাঁতায় ডাল পেষাইয়ের ঘড় -ঘড়ড়। খোলানে কেউ ধান সেদ্ধ করে – কোলে বসিয়ে এক শিশুকে দুধ খাওয়ায় পা-ছড়িয়ে, আরেকজনকে পাশে বসিয়ে  ধারাপাত শেখায়। বগরিবাড়ির ধানভাঙ্গা কলের মৃদু শব্দ  ভাসে দূরে। আমাদের একান্নবর্তী পাকশালে তেলে ফোড়নের আওয়াজ – ভাত ফোটার উদ্বে‌লতা। রান্নার তদারকি করতে করতে মা কবেই ভুলে গেছে নিজের কথা। গত পঁচিশ বছরে কেরানীর চাকরিটা বাবার হাতব্যাগটার মত অর্বাচীন মনে হয়। মা আর কারো প্রেমে পড়েনি – হয়তো বাবাও নয়।  সাধ করে কতকাল কাউকে রঙিন খামের চিঠি দেয়নি – কারো চিঠির অপেক্ষা করেছে কি তাও জানা নেই। কালোজিরে দিয়ে কি করে আলুর তরকারী – বোয়াল মাছ দিয়ে কি করে রসা বানায় – পোলাও বানাতে কত পুরনো ঘি দিতে হয় এইসব ভাবতে ভাবতে কতকাল চলে গেছে তার।
পুকুরধারে টি -টি -টি  করে হাঁসেদের ঘরে ফেরার ডাক দিতে থাকে কেউ ।
গরমকালে এক বিহারী বুড়ো মাথায় এলুমিনিয়ামের সসপ্যানের ভেতর দইয়ের ছোট ছোট হাঁড়ি ভরে ফেরি করে। হাঁক দেয় ,  “.. দহি…. গঙ্গারামপুরকা দহি… ” । কখনো তিন চারটের বেশি হাঁড়ি দেখিনি ওতে; যে সসপ্যানে ফেরি করে, সেটার আকারটাই শুধু অনেক বড় – দেখতে যেন অনেক ভাঁড়ার তার; লোকে ভাবে বিক্কিরিও হয়ত তাই। সকাল হোক আর বিকেল সেই তিন চারটে হাঁড়িই থাকে।  সে বলে তার দইয়ের খুব চাহিদা তাই আর এই কটা বাকি; শেষবেলায় কোনো ক্রেতা পেলে দু’পয়সা কমেই নাহয় বেচবে! তার দই আমি কাউকে কিনতে দেখিনি আজ অবধি।
৩.
কালো মেয়ে – যেমন নলপুকুরের দীঘল জলে অস্ফূট স্নিগ্ধ সন্ধ্যে নামে। বুবু বলেছে সুকান্ত সেতুর ওপরটা মেঘ করে এলে মন কেমন করেনা তার। কিছু এসএমএস বাসের সিটে হারিয়েছে; সন্ধ্যে জুড়ে ভরা ড্রাফটবক্স সহ মোবাইলটা কবে যে কোথায় পড়ে গেল! বৃষ্টিভেজা ছাতার জল – নখের কোনায় কাদা সব শুকিয়ে। অটোর সারি – ভীড় খুব – আমি নাইনটিজ থেকে অপেক্ষা করে আছি; নাহ্‌, চাটুজ্যের একটা  লাইনও মনে পড়েনা।  মেসের বাথরুমে সেই গন্ধটা আবিষ্কারের ক্ষণে জানলাম সেটা কন্ডিশনার ছিল, তোমার চুলের গন্ধ নয় বিন্দুমাত্র। বাবুঘাট-শিয়ালদা-এসপ্ল্যানেডের মিনিবাসে ঘামের গন্ধ ঘোরে – কেরানীর জামার গন্ধ, পুরোনো হিসেবের পাতা – রোববারের গন্ধ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। খানিক চা-খাব। সকালে ঝুঙ্কু আসবে বলছে; হয়্ত ঘুম থেকে উঠতেই…..। অপূর্ব বলল দুপুর নাগাদ ঘুরে যাবে। সেও নিরুদ্দেশ। অপেক্ষা করে করে কেমন ঘোর লাগে। এক মহালয়ার রাতে টর্চ জ্বেলে বসে ছিলাম শিউলি ফোটা দেখব বলে। ব্যাটারী শেষ হলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। বড়জেঠিমা নবান্নের দিন বারবার রাস্তায়  আনমনে দেখে । মেজদিদির বিয়ে মানেনি বলে সে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। তার সবকটা চিঠি বর্ষাকালের ডোবায় ফেলে দিয়েছিলুম – আর শ্রাবণে কলমির ফুল হয়ে ফুটবে। জেঠিমার সাধ করে বেড়াতে যাওয়া হয়নি জামাইবাড়ি। নবান্নে এখন তার নামে চাল-কলা মেখে পুকুরপাড়ে রেখে আসে। পেছনে ফিরে তাকাতে নেই তখন। জমিয়ে রাখলে ভারী হয়ে যায়, প্রিয়তম বস্তুগুলো তাই হয়তো ছেড়ে ছেড়ে যাওয়ার। সত্যি আর মিথ্যের মাঝখানে।  মামাবাড়ির বাগানে স্ট্রবেরির পাতার মত ঝোপে লালরঙ্গা গন্ধবরুন ফল হয়। নর , নর’র  ভাই মিলে সকাল সকাল তাই খুঁজে খেত। আমিও খুঁজেছি অনেকবার। তার স্বাদ ভারী মিঠে তাই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অনেককাল  আগের কথা ; মনেই পড়েনা গন্ধবরুণ ফল একটাও খুঁজে পেয়েছি কি না !
ভাদুড়ি’র সংসার – বাড়ির মালিক – কন্নজ্যাঠাইমা যেদিন আরেক পুরুষের সাথে ঘর বাঁধল অথবা গোবিন্দর রক্ষিতা মাসি, আর একটাও প্রেমে না-পড়া  আমার মা, ওদিকে মেজদিদি – প্রত্যেকেই এই গন্ধবরুণের ফল খুঁজে চলেছে হয়তো।  খুঁজতে খুঁজতে একদিন ভুলেই গেল আসলে পেল কি পেলনা, অথবা মানুষের ভুলে যাওয়ার মত পাওয়া না-পাওয়াগুলো সত্যি আর মিথ্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এইখানে সব নাকচ করা যায়। যা খুশি মেনে ভুলিয়ে রাখা যায় বিহারী ফেরিওয়ালার দইয়ের ফেরির মতন। এতে ভেতরে কি রইলো কি রইলনা – সব সত্যি সব মিথ্যে !
খুব গরম পড়লে ভাঁটিফুলের গন্ধ নাকে লেগেই হারিয়ে যায় ঘুঘুমারির দহলায়। ঘূর্নি ওঠে অর্থহীন হাওয়ায়। একটা খোলা রাস্তায় তাস পরে থাকে; কেউ লক্ষ্য না রেখে মাড়িয়ে চলে যায়। এইবার রোদটা নেমে এলো। সাইকেলে বেরোব। রিজেন্ট এস্টেটর ছায়াভরা এভিন্যুটা আমাদের গজেন্দ্রপুর চৌরঙ্গির রাস্তা হবে – ঠিক স্কুল ফেরত্ যেন; তারপর ইব্রাহিমপুর রোড ধরে গলি পেরিয়ে শক্তিগড় মাঠ। গলির ধারে একটা পুরোনো পুকুর – কচুরিপানা; পাশে বাঁশবাগান ; নতুনপাড়ার কোনো ডোবা যে ওটা। পুকুরধারে কারো বাচ্চা দাঁড়িয়ে – সবে হাঁটতে শিখেছে – মায়াভরা মুখ – ছাগলছানা তারাই যেন। তারপর আনন্দপল্লী এলে রাস্তাটা আমের বোলের গন্ধে ভরে – নন্দনপুরের আমবাগান; যেন দূরে শিশুর দল ধুলো ওড়াতে ওড়াতে খেলা শেষে ঘরে ফিরছে। ওধারে দেয়ালে কেউ কাপড় গোটায় ছাদে – কিছু কুকুর লেজ নাড়ে তেলেভাজার দোকানের সামনে। মোড় ঘুরতেই বড় সড়ক আসবে। আর কিছু না ভেবেই জ্যামে আটকানো এস. সি. মল্লিক রোডের সব গাড়ির সাথে আমিও সাইকেলে বসে দাঁড়িয়ে থাকব নিস্তব্ধ ; ঠিক লিফটে ওঠার মূহুর্তে এক-লিফট ভর্তি লোকেরা মৃতদেহের মত নিথর নির্বাক হয়ে যায় যেরকম। গাড়িগুলো থেকে ধোঁয়া বেড়াবে। হর্নের শব্দ। ইঞ্জিনের ঘর্ঘর আওয়াজ। কেউ ফস্ করে সিগেরেট ধরিয়ে, কাঁচ নামিয়ে গাড়ির জানালায় মাথা রেখে দূরদৃষ্টিতে আন্দাজ করছে জ্যাম আর কতদূর।  সিগন্যালটা নাহয় সেদিন নষ্ট হল আর আমি অপেক্ষা করেই থাকব। পায়ের তলার মাটি সর্ষেক্ষেত হোক।  মেরুনরঙ্গা বাছুরটা আবার ছুটে পালাবে। যে কিশোরীর মুখে রসুনের গন্ধ তার চোখের মত গভীর হাওয়ায় গন্ধবরুণ ফলের সুবাস সাদার্ন এভিন্যু – গড়িয়াহাট – রাসবিহারী জুড়ে জ্যামে আটক গাড়ির ভেতরে। মেজদিদির একটা চিঠিও হারালে কষ্ট হবেনা – কারো সময় হবে অফুরান অপেক্ষা করার – কারো বেগুনীর বেসন বানাতে বানাতে প্রেমপত্র আসবে গৃহস্থে – কেরানীর ঘামে ঘামে বিহ্বলতা জন্মাবে জমিয়ে না রাখার। আবার রেস হবে গজেন্দ্রপুর চৌরঙ্গী মোড়ে  – দুটো পরস্পর সমান্তরাল মালগাড়ি সত্যি আর মিথ্যের মাঝখান দিয়ে চলতে চলতে বৃষ্টি হবে মহানগর জুড়ে – আমার গাঁয়ে – সর্ষেক্ষেতে – মেজদিদির উঠোন জুড়ে – একটা শিশু হামাগুড়ি দেবে – খেলবে কাদায় – হাতে গন্ধবরুণের ফল।

*

ওল্ড স্কুল কফিহাউস 

কোচবিহার। বড়সড়ক – তুঁতের বাগান ; দহ বিঘার পর বিঘা। কচুরিপানার দহলা ধরে অনেকটা পথ গেলে পর গোঁসানীমারি। একদিন কারো পুকুর খুঁড়তে গিয়ে অনেক পুরাতন দেয়াল আবিষ্কার হল – কিছু মূর্তি , আরও নানান কিছু পাওয়া গেলো; হয়ত অনেক শতাব্দী আগের কিংবা তারচেয়েও পুরনো , বিস্মৃত। হরপ্পার নগরে ঘোরা হয় নাই; সূর্যমন্দির অথবা সুমাত্রার বাদলবনে হাজার বছরের রহস্য নিয়ে দণ্ডায়মান স্থাপত্যও কখনও দেখিনি। এইখানে গোঁসানীমারির দেয়ালে অদ্ভুত ছবি দেখে কতবার কল্পনা করেছি সেইসব শিল্পীদের কথা – কত শতাব্দী আগে সেইসব অখ্যাত বনবাদাড়ের দেশে অতীন্দ্রিয় বিস্ময়ে যারা ওই মূর্তি , পাথরে খোদাই করা ছবি বানিয়েছিল , নলরাজার গড় বানিয়েছিল; কে জানে কোন নেশার তাড়নায়!
জ্যৈষ্ঠদিন; নন্দনপুরের দহলায় ঘাস নেই; পাটক্ষেত জুড়ে দুপুররোদে গরম ভ্যাপসা হাওয়া; হাঁটুজলা সরু সোঁতার ধারে যে কচি সপের ডগা হয়েছে, চরে বেড়ানো গরুর দল সেইসব গিলছে আর গরুর নাকে ঘাম জমে উঠছে বিন্দু বিন্দু। টোসীবুড়ীর পিঠে, কপালেও ঘাম জমে সেরকম; ভোলারহাটের বড়বাগান ধারে কাদায় যে মোষগুলো গা-ডুবিয়ে থাকে, তাদের চামড়ার মত টোসীবুড়ীর পিঠের রঙ। জ্যৈষ্ঠরোদে ফতফত করে সোনামুগডাল ফাটে ক্ষেতে। একটু বেলা পরে এলে খেজুরের শুকনো পাতা তিরতির করে কাঁপে; দূরে কালো মেঘেরা ভিড় বাড়ায় দিগন্তে আর টোসীবুড়ী ধামা ভরায়, সোনামুগডাল ছেঁড়ে; গান গায় সুর করে, যেন গোটা শামিলার বসত – শতবর্ষ প্রাচীন বিধ্বস্ত কোনও গলা; সুখের গান না দুখের বোঝা দুষ্কর; তাকে কখনও জিজ্ঞেস করাও হয়নি! পৃথিবীতে প্রথম ভাঁটিফুল দেখে, হেমন্তের রাত্রিশেষে পূর্বাকাশে ফিকে রঙ দেখে যে অবাক হয়েছে; তাম্র প্রস্তর যুগের আগে, কোনও প্রাচীন তুষার যুগের শুরুতে যারা অবাক আগ্রহে পাহাড়ের গায়ে, শিলালিপি জুড়ে নিজেদের অস্ফূট বিস্ময় স্বাক্ষর করে গেছে, টোসীবুড়ীর গলায় মানব ইতিহাসের সেইসব শিল্পীর ছায়া। কত অর্বাচীন, কত সরল, কত গভীর, আদরমাখা। আমাদের অহংকারের মিনারভরা শতাব্দীতে কখনও তার কাছে ছুটে গিয়ে প্রশ্ন করার খুব ইচ্ছে কি করে তার গলায় এত সজীবতা, কিকরে এত শতাব্দীর শোক নিয়ে আছে, কিকরে এত সহজাত!
বনবন করে পাখা ঘুরছে মাথার ওপর। নিজেকে সত্যি বেকার মনে হওয়ার কোনও জায়গা পাওয়া গেলে সেটা গ্রীষ্মছুটির খোলা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিগুলো। জনা তিনেক পাঠক; পঞ্চাশোর্ধ এক কেরানী এন্ট্রি খাতার সামনে ঝিমোচ্ছে আরেক কর্মী ডেস্কটপে তাস খেলায় মশগুল। বাইরেটা অন্ধকার করে আসে। হালকা মেঘের ডাক; ভরদুপুরবেলা রোদ কমে এলো। এখান থেকে আকাশ দেখা যায়না, বাইরে গাছের পাতা দেখা যায়না। শুধু ফ্যানের শব্দ; কালো কালো বই। সবকটা প্রতিষ্ঠান কি এরকমই নির্বাসনের ডেরা তবে! পঞ্চাশোর্ধ কেরানীর শ্যাম্পু করা চুল হাওয়ায় উড়ছে সুড়সুড় – ঘুম ঢুলুঢুলু চোখ – ঝিমোনো মাথা  – হলদিবাড়ির মাড়োয়ারি আড়তদার যেন। সেবার একাত্তরে মেলার মাঠে মেলা নেই সেবার, শরণার্থীর ভিড়; হা-ভাত; চুরি-চালাকি; বঙ্গদেশের সরল লোকজন পঞ্চাশের দুর্দিনের পর আবার জোচ্চুরির সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় হয়ে। পিসিরা অনেক পরে এদেশে এসেছে। একাত্তরের বিধবা, চার ছেলে সাথে। এপারে বন্ধক দেওয়া গহনার বাক্স তাকে ফেরত্ দেয়নি মাড়োয়ারি আড়তদার; বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছে। দেওরদের একান্নবর্তী সংসারে এর লাঞ্ছনা বহুদিন শুনতে হয়েছে তাকে। আগাছার মত পাঁচটে প্রাণী কাউনের ভাত, সজিকচুর সব্জিতে এতকাল বাঁচতে পারে সেই অদ্ভুত ঘটনা তাদেরও অবাক করে দিত। তাদের পাকশালে সূর্য উঠত সকালবেলা, আবার ডুবে যেত খড়খড়ির ফুটোয় দিনের পর দিন – ঋতু – বচ্ছর গুজরান হত; সেই খড়খড়ির ফাঁকেই গন্ধবরুণের জঙ্গলে দরগাবল্লীর জোনাকি মিটমিট করত সন্ধ্যেয়। রাঁধুনিদের আহ্লাদ-সখ-বর্ষ বিকেলে কোনও অচিন প্রাপ্তির কামনা সব ব্যাঞ্জনের স্বাদে মিশে গৃহস্থের রসনা তৃপ্তিতে হারিয়ে গেছে! পিসিদের রান্নাঘরে উনুন স্তিমিত হতনা; মাঝরাতে পাক শেষ হতে না হতেই আবার ভোরবেলা জলখাবারের জোগান দিতে হত। কোনো বাউণ্ডুলে কপালে তিলক পরে ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে কতকাল পথ ফিরেছে দফাদারপাড়ার রাস্তায়; অষ্টপ্রহর আয়োজন হলে মহল্লার তরুন বোষ্টম মাতাল হয়েছে – কারো জন্য উতরোল হয়ে গলায় টান দিত যেন; রাত গভীর হলে সদ্য ফোটা আলুথালু ভাঁটফুলের গন্ধভরা মাদার ঝোপে কতবছর অপেক্ষা করেছিল সেই বাউণ্ডুলে। পিসি পাকশাল ছাড়ল না, সংসারের আটপৌরে উঠোনের চৌহদ্দি ফেলে একবারও পথে পা বাড়ালো না। শ্রাবণমাসে আকাশ কালো করে, যেন ডিম্বাকৃতি একটা কালো চাদর ঢাকা পৃথিবীটা ওই দূরে শেষ হয়ে যায়; বরষায় ভেতর-গেরস্থের কাজ কম; বাড়ির বউয়েরা কেউ জাঁতায় ডাল পেষে – কেউ নারকেলপাতা ছেঁচে ঝাঁটার কাঠি বানায় – কেউ থেঁতু দিয়ে দড়ি পাঁকায় উটকন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। ঘূর্ণির পর ঘূর্ণি পাঁক একত্র হয়ে দড়ি তৈরি হয়; যার কোনও শেষ নেই – শুরুও নেই; গত শতাব্দী তার আগের শতাব্দীর হাজার বছর আগে থেকে সিন্ধুনদের তীরে, সুদূর দাক্ষিণাত্যে – মালাবার উপকুলে – বঙ্গদেশে বিধবারা এভাবেই অর্থহীন দড়ি পাকানোর কাজ করে আসছে। সে কাজ যদি দায়িত্ব না হয় তবে কিছুই করার নেই আর বলে বৃথা দিনপাত, নাকি শুধু নির্জীব যান্ত্রিকতা – কে জানে? দায়িত্বের যে মালিকানা নেই পিসি জানত নিশ্চয়!
স্ট্রান্ডরোডের দু’একটা গলি খুঁজলেই ‘ওল্ড স্কুল কফিহাউস’।  সন্ধ্যে থেকে ভোররাত অবধি খোলা থাকে। দশপয়সায় সাউথ ইন্ডিয়ান ব্ল্যাক কফি আর সুড়সুড়িভাজা পাওয়া যায়। আশির দশকের কলকাতা; সিগারেটের ধোঁয়াভর্তি এই ওল্ড স্কুল কফি হাউসে হলুদ আলোর ভেতরটা বড় চমৎকার। সব ভাঙাগড়া; একটা যুগের স্বপ্নেরা পুরনো শরীরে আবার নতুন করে গা-ঝাড়া দেয়া ভিড়; শরণার্থীর কলোনি, র‍্যাশন দোকানে হাহাকার – এক একটা মহল্লা যেন এক একটা ময়মনসিংহ, যশোর, রংপুর নিয়ে নিয়ে গোটা সাতচল্লিশের পূর্ববঙ্গ একাত্তরের সাথে মিলে মিশে একাকার! যাবতীয় শহুরে জালিয়াতি – ঘুষখোর কেরানী , আমলা – অবার্চীন ট্রেডইউনিয়ন নেতা – চকচকে জহরকোটের মন্ত্রী – লোকাল ট্রেনের বাস্তুহীন হকার – প্রত্যেকে ঘুমোতে গেলে ‘ওল্ডস্কুল কফিহাউস’ গমগম করে ওঠে। ভাঙাগড়ার আলোআঁধারি শহরটায় যেন আরেকটা পৃথিবী; চুপ থাকার – গল্প করার; ফিসফিস করে। সিগারেট মুখে দিলে সেকেন্ডহ্যান্ড পলিএস্টার সার্ট পরা অচিন যুবক কেমন আত্মীয়তায় কাছে এসে লাইটার জ্বালিয়ে দেয়! এখানে কেউ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত অথবা বাইরনের সাহিত্য নিয়ে মাথা চুলোচুলি করে না; দেশে কোন বস্তুর দাম কত বাড়ল, কে কোন দলে যোগ দিল কারা ভাল ফুটবল খেলে কিংবা শরণার্থীর ভবিষ্যতের দায়িত্ব কার ইত্যাদি নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামায় না। ওল্ড স্কুলে সবকটা লোক যেন তার অতীতটা নিয়ে সজীব হতে চায়; হাউসের মালিক থেকে বেয়ারা , কাস্টমার অবধি প্রত্যেকে হয় মদে টইটুম্বুর নাহলে প্রবাসে গৃহকাতর, গোটা শহরে গল্প করার সঙ্গহীন  অথবা সারাদিন খাটাখাটনির পর একটু বাঁধন ছাড়তে আসে; বাঁচার ফুরসৎ খুঁজতে আসে! অবোধ্য বিদেশি ভাষা ও কৌতুকের ভঙ্গিমার এতরকম সংগ্রহ আর কোথায় আছে গোটা প্রাচ্যে আমার জানা নেই। সিকান্দার আলী তাসখন্দের লোক; কলকাতায় সুদের ব্যাবসা তার; ট্রিংকার্সে প্রায়ই পাত্তা পাওয়া যায়  দিব্যি। মদ খেতে নয়, পাওনাদারের হিসেব-নিকেশ করতে আসে। বিগত দশকে তার সবচেয়ে ছ্যাঁচোড় কাস্টমারদের মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। বিলবয়ের চাকরিতে পঁয়ত্রিশ টাকার ধার মেটাতে তা প্রায় একদশক সময় লেগেছিল! একটা সময় পর সে আর টাকা চাইতে আসত না, আসত গল্প করতে শুধুই; ঘণ্টার পর ঘণ্টা অর্থহীন বসে থাকতো শূন্য চোখে যেন তার মাথার ভেতরটা দেখা যাবে এক্ষুনি। গোটা শহরে ধার চাওয়া লোকেরা বাদে তার সাথে  যে গল্প করার কেউ নেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। এক একদিন সে আফগানি বেদানার গল্প করত, তাসখন্দে গমক্ষেতের ধারে তার ছোটবেলার গল্প করত। এডেন বন্দরের কথা সিকান্দারের মুখেই প্রথম শোনা; সেখানকার পানশালা গুলো – ধূ-ধূ মরুভুমির বন্দর দেশে সরাইখানা এক-একটা যেন এই ওল্ড স্কুলের সহোদর, বৈচিত্রে আর অহরহ ভিড়ভাট্টায়। একটা করে নতুন জাহাজ আসত সুদূর কলম্বো, সাইপ্রাস আরও দূর ন্যুইয়র্ক, টোকিওর মালবাহী কার্গো জাহাজ; আরও নতুন লোক, নতুন গল্প, নতুন ক্রেতা-বিক্রেতা; নিত্য এত নতুনত্বে এডেন ছিল উচ্ছল, প্রাণবন্ত, চল্লিশ ডিগ্রী গরম আর অন্ধকার, অভাব- অনটনের শৃঙ্খল ছিঁড়তে জনতা উন্মাদ হয়ে ছুটছে যেন একটা মশলামুড়ির ঠোঙ্গায়; সব মিশে একাকার! কে মরল, কে বাঁচল, দীর্ঘ সফরে দুদিনের বিশ্রামে কে কার বন্ধু হল, শত্রু হল, কে কাকে মনে রাখল, কোনকিছুর ইয়ত্তা নেই! সেই এক চিত্র এই ওল্ডস্কুলে। যে মিস্ত্রি লোহাপট্টিতে কাজ করে, সে কবে ছাপরার চাঁদনী রাতে কোন যুবতীকে চুমু দিয়েছিল ভাঙা মেলা শেষে; কার ঘরে দুমকার সেরা ছাতু পাওয়া যায়, আফগানে কত জমকালো আঙ্গুরচাষ হয় অথবা নানকিং-এ চালের দারু পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ – এইসব গল্প করে চীনা বুড়ো, যুবক, উরাল পর্বতের চামড়ার পাইকার, চার্চে সঙ্গীত শিক্ষিকা, দানিশ বয়স্কা অথবা সুদূর মঙ্গোলিয়ার কার্পেট ব্যাবসায়ী। সক্কলে এসে ভিড় করে এখানে; ভাঙা হিন্দি আর বাংলায়, অ
নাহারক্লিষ্ট, অনাচার, অভাব আর লাঞ্ছনা থেকে মুক্তিকামী মহানগরের ঘুমন্ত জনতা জাগার অনেক আগেই এরা ঘরে ফেরে, পরদিনের কাজের যোগাড়যন্ত্র সাজায়! অতঃপর আরেকটা দিন গত হয়। গ্রীষ্মকালে ভিড় কম; সেইরকম এক রাত্তিরে দেখা বুড়ো দানিয়েলের সাথে। আর্মেনিয়ান ভদ্রলোক, সুন্দর পেলব দাঁড়ি- গোঁফ – সাদা রঙের। গোটা শরীরজুড়ে তার বাঁশপাতা গন্ধের খুশবু।  কথায় কথায় সিগারেট অফার করল সাথে কফি আর সুড়সুড়িভাজা। সেদিন গল্প হল প্রচুর; গল্পের বিষয়বস্তু বেশীরভাগ ভিনদেশের। নতুন ওয়াইন কেমন বদলে গেছে, শহরটা দিনদিন কেমন নিস্তেজ – গল্প যত অগ্রসর হয়, কবেকার পুরাতন কলকাতার জৌলুস দানিয়েলের ফ্যাকাশে বিবর্ণ শরীরে জীবন্ত হয়ে ওঠে তার চকচক করা চোখে ; শুধুই অতীত নিয়ে লোকেরা কেমন করে বেঁচে থাকে তা দানিয়েলকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই । এইতো আমার মত ছাপোষা বিলবয় অবধি সাদার্নে একটা নিজের বাড়ির স্বপ্ন দেখে, কিছু টাকা জমিয়ে নিজের একটা রেস্তরাঁর স্বপ্ন দেখে! ভুলটা ভাঙল আরেকদিন। সেদিন দানিয়েলের মুখ থমথমে, চলনে একটা ইতস্তত ভাব, হাত কম্পমান। ওল্ড স্কুলে ঢুকেই কেমন আমায় খুঁজে সামনে বসল; কানের কাছে এসে বলতে লাগল তার নরওয়েজিয়ান এক বন্ধু আসছে আজ! দানিয়েলের মুখে তীব্র অ্যালকোহলের গন্ধ। আমি বললাম বেশ। বুড়ো জানালো ক্রিশ্চিয়ানস্যান্ড থেকে আসছে তার বন্ধু। নরওয়ের কোনও এক শহর। ক্রিশ্চিয়ানস্যান্ডের সুন্দর কাঠের বাড়ীগুলো যে পাড়ায় সেখানে বসে তারা কত সময় কাটিয়েছে আর্লি ফিফটিজে একসাথে; সেই বন্ধুর মাছ ধরার জাহাজে গোটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উপকূল চষে বেড়াত সেইসব দিনে। হগ , স্তাভাঙ্গার আর  আলেসুন্দের খাঁড়িতে উত্তরমেরুর অদ্ভুত রাত্তিরে মেরুজ্যোতিময় আকাশ দেখে ঘুমোতে  যাওয়া হয়নি  কতকাল তারপর। বরফের মত হিমশীতল জলে হেরিঙ্গের ঝাঁক জালে ধরে সেইসব চালান করা হত বারগেন বন্দরে। সমুদ্র উত্তাল হলে অথবা খুব শীতের মরশুমে কিছুদিন অপেক্ষা করা হত আলেসুন্দ অথবা বারগেনে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সিগাল ঘুম ভাঙ্গাত তার; আবার সন্ধ্যেয় দিকচক্রবালে বন্দরের হলুদ আলো যখন উত্তরের সংক্ষিপ্ত রাত্তির আয়োজন করত মাছের গন্ধভরা অন্ধকার জাহাজের ছায়ায়, দানিয়েল তখন কাঁদত – কোনও কিছুর জন্যে নয়, কোনও কিছু হারিয়েও নয়। পৃথিবীর অন্তরতম নিস্তব্ধতায় কেমন এক শোক প্রোথিত আছে যেন, যাকে ছোঁয়া যায়না; মন দিয়ে যুঝতে গেলে পুড়ে যেতে হয়! তারপর আবার মরশুম শুরু হয়, কখনও তারা হেরিঙ্গের ঝাঁক তাড়া করতে করতে গ্লাস্কো, ডাবলিন অবধি পৌছয়। কাস্টমসে ভেরিফাই করিয়ে ডাবলিন ঘোরা যায়। গ্রীষ্মে আইরিশ বরফগলা স্ট্রিমলেটগুলো তখন যেন ট্রাউটের জঙ্গল। টোপ ফেললে টপাটপ ওঠে। সেখানকার ট্রাউট সবচেয়ে সুস্বাদু! এবছর সে আবার পাড়ি দেবে সেইসব জায়গায় ক্রিস্তোফার এলেই; আবার মাছের খোঁজে বেরোবে অসলো থেকে ভ্যারাঙ্গার দ্বীপ অবধি – উত্তর সাগরের সবচেয়ে পুরুষ্ট হেরিং আর ম্যাকারেলের খোঁজে; প্রত্যেক খাঁড়ি খুঁজে খুঁজে শেষে আলেসুন্দে বিশ্রাম নেবে, গ্রীষ্মে ভ্যারাঙ্গারে বুনো বার্চের ঝোপে বসে রেডফক্স শিকার করে তার ছাল দিয়ে টুপি বানাবে আগামী শীতের অপেক্ষায়! কলকাতা ভালো লাগছেনা বিন্দুমাত্র। আচমকা সে তার হলুদ দাঁতের মাড়ি বের করে উচ্ছল মুখে বলল চাইলে আমিও আসতে পারি তাদের সাথে! আমি সুযোগসন্ধানী চোখে বুদ্ধিজীবির মত মুখ করে তার দিকে চাইলাম – হ্যাঁ বা না কিছুই না বলে। ভাবলাম বেকার, মধ্যবিত্ত’ও নই, মাস গেলে ছ’টাকায় বিলবয়ের চাকরিতে পশুর মত বাঁচতে হয়; মাছের ব্যবসা  মন্দ হবেনা – স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সমুদ্রযাপন! অজানা লোভ আর দানিয়েলের গল্প ধাপ্পাবাজি কিনা সেটা পরখ করতে বসে রইলাম ক্রিস্তোফারের অপেক্ষায়।
ক্রিস্তোফার আসেনি সেদিন। তারপর দানিয়েলের সাথেও সাক্ষাৎ হয়নি আর। বেশ ক’মাস গেলো। কলকাতায় শীত; একদিন আবার ঢুঁ-দিলাম ওল্ড স্কুলে। এক বেয়ারাকে কাছে ডেকে বুড়ো দানিয়েলের খবর জিজ্ঞেস করায় সে হাসল প্রথমে; অতঃপর যা শুনলাম মন ভেঙ্গে গেলো। উত্তর কলকাতার সরু রোগা গলি, শরণার্থীর ভিড় আর বিলবয়ের ছ’টাকার চাকরিতে গত কমাসে ডাবলিনের বিকেল, দূর নরওয়ে উপকূলে সমুদ্রবন্দর, মিটমিট করা আলোয় ঢেউয়ের শব্দ আর  মেরুজ্যোতির আকাশ দিয়ে যে ইমারত বানালাম সেটা বেয়ারার এক হাসিতেই ভেঙ্গে গেলো। দানিয়েল একটা মাতাল; তার বাপ, তারও বাপ এই কলকাতায় জন্মেছে; নরওয়েতে তার এক বন্ধু ছিল বটে তবে সেও নিখোঁজ। রোজ রাতে মদ গিলে এসব গল্প কতবার সে কতজনকে বলেছে তার ইয়ত্তা নেই। দানিয়েল আদৌ কখনও ইউরোপ এমনকি কলকাতার বাইরে গেছে কিনা সে নিয়েই ঢের সন্দেহ আছে। ব্যাটা ধড়িবাজ আরমান। এসব কথা ভাবলে দানিয়েলের প্রতি মায়া হত কখনও কখনও আবার রাগও। আমরা পালাতে ভালবাসি, আবার পালানোর ধারণাকে ভালবাসি; একটা সত্যি গল্প দিয়ে – একটা মিথ্যে গল্প দিয়ে পালাই। যে পথ দিয়ে গোঁসানীমারির শিল্পীরা পালিয়েছে, যে পথ দিয়ে টোসীবুড়ি পালাতে চেয়েছে; পিসি , আমার বিধবা পিসি যে গল্পে পালাত অথবা লাইব্রেরি থেকে ভ্যারাঙ্গার, যেভাবে আমি পালিয়েছি, বুড়ো দানিয়েল পালিয়েছে আরেকটা সত্যি-মিথ্যের গল্পে, আরেকটা মিথ্যে বিলবয়ের গল্পে, সেইরকম গোটা পৃথিবীর প্রত্যেকে যেন পালাতে চাইছে – ক্রমশ তীব্রতরভাবে পালাতে চাইছে! পলাতকী গল্পের শেষটা কারো জানা নেই, সেবিষয়ে আগ্রহীও নয় কেউ। পালানোটাই মুখ্য! মিথ্যে পালানো আর সত্যি পালানোর মাঝখানে আমি, দানিয়েল, পিসি, বিলবয় – প্রত্যেকে বড় নিষ্ঠুর ।
এরকম আরেকটা গল্প মনে আসে খুব। গ্রীষ্মের ছুটিতে রোজবছর চয়ন আসে – সেই ছোট্টটি। মাইনর স্কুলে পড়ে। বাড়ির বাগানে আম লিচু খাওয়ার লোক চাই যে। ভাগ্নেরা সেখানে সেরা অপশান। জেঠু গিয়ে নিয়ে আসে ফি বছর। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে কেউ জেদ করে কবে কি আদায় করেছে মনে পড়েনা। বায়না করে কেঁদে লুটোপুটি করলেও যে জেদের খেলনা – জামা – মার্বেলের টাকা মেলা অসম্ভব সেটা ষষ্ঠীদাদা – অম্বরীশদা – আমি ভালই জানি, এমনকি দশবছরের জয়ন্তও ব্যাপারটা বোঝে। ফলত ওপথে যে ফেইলিওর অবশ্যম্ভাবী সেবিষয়ে প্রত্যেকেই রীতিমতো গবেষণা করে নিশ্চিত। চয়ন মামাবাড়ি এসে স্বভাবতই বায়না ধরে এবং সেসব যে কি স্মুথলি মঞ্জুর হয়ে যায় ও মঞ্জুরিনামায় আমাদের প্রত্যক্ষ সমর্থন ইত্যাদি ঘটনা আমাদেরও অবাক করে মাঝে মাঝে । একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে কান্না শুরু করল, সে তক্ষুনি বাড়ি যাবে এবং তাকে রেখে আসতে হবেই হবে! হঠাৎ কান্নায় গোটা বাড়ি জেগে উঠল মাঝরাতে। ছেলে কিছুতেই মানার পাত্র নয়। বড়জেঠিমা তখন মোক্ষম অস্ত্র যোগাড় করল। আমাদের ছোটবেলায় যে মলম প্রত্যেকের প্রচুর বিদ্রোহ নিউট্রালাইজ করেছে সেইটি প্রয়োগ হল। জেঠিমা বলল – যাবি তো যাবি কিন্তু কাল যে ওইবাড়ির হাটে মেলা! কলের গাড়ি , আলো জ্বলা পুতুল কে কিনবে বাড়ি গেলে? ‘ওই বাড়ি’র অস্তিত্ব কোনও কালেই কোথাও বিদ্যমান নেই। ভোটের আগের প্রতিশ্রুতির মত ওটা একটা ধেড়ি ফানুস মাত্র! অতঃপর চয়ন বাড়ির কথা বেমালুম ভুলে ঘুমোতে গেলো খেলনার প্রাচুর্য আর প্রতিশ্রুতির তাসের ঘরে!

*

ছবি: সৌম্যজিৎ

3 thoughts on “দুটি গল্প

  1. নুতন ধারায় স্নাত গল্প, ভালো লাগলো, গঙ্গারামপুরের কাছেই আমার বাড়ী, আসলে গঙ্গারামপুরের কাছেই নয়াবাজার ,(গঞ্জ) নয়াবাজারের দৈ বিখ্যাত…..
    পরে যোগাযোগ সমৃদ্ধ হবো।
    অভিনন্দন জানাই……
    গোবিন্দ তালুকদার
    বুনিয়াদপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর
    gobindatalukdar9@gmail. com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.