মিত্রাভ ব্যানার্জি‌

মস্তিষ্ক কোষে কাহিনীটির অভ্যুদয় বেশ কিছু বছর আগে শাহবাগের গতিপ্রাপ্তি বা সেহবাগের অবসর ঘোষণা উভয়ই তখন দূরঅস্ত। মুক্তিমনাদের গলার নলী তখনো অক্ষত তখন আমার উত্তরভারত বা দাক্ষিণাত্য নিয়ে অস্বস্তি তুঙ্গে এমতবস্থায় আমার কতিপয় বাংলাদেশী বাঙালী সহকর্মীদের মধ্যে জনৈক হতভাগ্য আমার আত্মীয়তা এবং বিচার প্রত্যাখ্যান করেন ধর্মীয় সংস্কারে ভাষার বন্ধনে ধর্মের দংশনদাগপ্রকট হলো ব্যস! শালা আইউবের দালাল টিক্কা খানের কুত্তা মিটে গেল
এই ঘটনার কিছুদিন পরে স্রেফ ভাষার, শুধুমাত্র সংস্কৃতির অধিকারে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুম্বনের অবশিষ্ট উম্মীদ হাওয়ায় হারিয়ে যায় যখন আমার পাঁজরের তটে বসবাসকারী সমবয়ষ্ক সমভাষী কিছু মানুষ আমার ঢাকা, আমার মুজিব, আমার চট্টগ্রামের নামে থুতু ফেললে। বললে বেশ্যার জাত। তখনো (এইখানে হাসতে হতো জনাব) তখনও কিন্তু মুক্তিমনাদের অন্ত্রে তপ্ত শলাকা ঢোকানোর দেরী আছে।
এই পরিচ্ছেদ লেখার দিন ফরিদাবাদে ১১ বছর আর ছয় মাসের দুটি শিশু দলিত হওয়ার অপরাধে দগ্ধ। গুরু গ্রন্থসাহিবের পৃষ্ঠা কর্তণের সুবাদে পঞ্জাবে প্যারামিলিটারি নেমে পড়েছে। জম্মু তে গোহত্যার গুজবে খুন – দাঙ্গা – কারফিউ। যারা খুন করল, আগুন দিল, তারা সবাই সমদেশীয়, সম কৃষ্টিজ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমভাষী।
আজকেই ভ্লাদিমির,  আসাদ বিরোধী বিপ্লবীদের বোমা মেরে ছত্রভঙ্গ করে দয়াময় ভিন্নভাষী আসাদের হাতে হাত গুঁজে সহাস্য ছবি ছেপেছেন। ভারত জাপান আমেরিকা (ফিসফিসিয়ে বলুন চীন বিরোধি) নৌমহড়ায় মত্ত। আর সেই সময়েই চীনের ইশকুলে ইশকুলে আফিম যুদ্ধে চিং সাম্রাজ্যের পতনে ব্রিটেনের কালোহাতের ইশতেহার আর ব্রিটেন জোড়া চীনের মানবিকতা লঙ্ঘনের তোপ দাগার দুরত্ত্ব অতিক্রম করে দুই দেশের মহামহিমদের প্রেমালিঙ্গন। এই ঐক্য বা ভিন্নতা আর তার থেকে জন্মানো এই ক্রোধ, ঘৃণা কিসের ভিত্তিতে? ধর্ম নয়, সংস্কৃতি নয় বন্ধু। ভিত জানবেন বরং আরো, আরো অন্তরে নিহিত উচ্চাকাঙ্খার।   
এই কাহিনী ম্যান্ডারীনের ঢালের নিচে লুকোন ভীরু ছদ্ম-কম্যুনিজমের পটভূমিকায় হতে পারত। রুশকি-ইউক্রেনীয়ান সামঞ্জস্যের বুকে পা রেখে এদিকে ক্রিমিয়া, দানেতস্ক দখল, অন্যদিকে ওদেসায় বাড়িভর্তি রুশ সৈন্যকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে মারার উল্লাসের পটভুমিকায় বা ফরাসি ছুঁড়ে ফেলে ফার্সি বর্মের আড়ালে শিয়া আগ্রাসনের।
এক্ষণে আমার শহর ক্লেদ, মৃত্যু, ক্ষুধা, ধর্ষন, প্রতারণা ভুলে শারদ উৎসবের আলোয় আলোয় অন্ধ। 
দৃষ্টি মুবারক !” – মিত্রাভ



এখন সুসময়, এখন পৃথিবী নিস্পন্দন, আজ ঢেউ ফিরে গেছে।

সকাল বেলা আর পাঁচটা খবরের মাঝে একটা খবর ইমনের কানে বাজল। ‘সদ্যোজাত শিশুরা বড়দের থেকে বেশী ঘ্রাণশক্তি সম্পন্ন বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই ইন্দ্রিয়ের প্রখরতা আগেও ছিলো নাকি বিগত বহু বছরের বংশানুক্রমিক অন্ধত্ত্বের ফলে ইদানিং দেখা দিচ্ছে সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সুনিশ্চিত নন। এই বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য মেহেদিকে পাওয়া যায়নি’। বাঁ হাতে টেবিলে রাখা টাইমস্পীকে হাত ছোঁয়াতে জোনাথন হারকার বলল ‘আটটা ছাব্বিশ’। জোনাথন ইমনের প্রিয় কোন চরিত্র না। ছোটবেলা একবার মাত্র সে ড্রাকুলা শুনেছিলো। জোনাথনের কন্ঠটি স্টোরে ফ্রি। এটা যে জোনাথনেরই কন্ঠ সেটাও স্টোরে বলা না থাকলে সে মনে করতে পারত না। আটটা ছাব্বিশ। এই বার চায়ের আশা করাই যায়। জিনি এতক্ষণে উঠে পড়েছে নিশ্চই। ইমন জিনিকে ডাকবে, না ডাকবেনা সেই দোনামনার মাঝেই প্রক্সি ট্রে র আওয়াজ পাওয়া গেল। চা আসছে। ট্রেটা কদিন ধরে ভোগাচ্ছে। রান্না ঘর থেকে চালু হয় ঠিক, কিন্তু কখনোই সঠিক জায়গায় থামতে চায় না। কখনো চৌকো বোতামে শোবার ঘরের বদলে বসার ঘরে হাজির হয়, কখনো গোল বোতামে বসার ঘরের বদলে গ্যারাজের দরজায় গিয়ে ঠোক্কর খায়। আজকেও সেন্টার টেবিলে যেখানে ট্রের স্টপ সেন্সর লাগানো আছে তার চেয়ে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে ট্রেটা থামল। ইমন হাত বাড়িয়ে চা বা চায়ের ট্রে কোনোটিরই হদিস পেল না। চায়ের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু চা অধরা। অগত্যা ইমন অসহায় হাঁক পাড়ল
জিনি!
পাওনি?
কাছেই আছে কোথাও, বাজাও একবার।

ট্রের আইডি বাটন জিনির রিস্ট ব্যান্ডে। যদিও অধিকাংশ সময়ে ইমনের প্রয়োজনেই ট্রেটা ব্যবহার হয়। জিনি ডিসিপ্লিন্স-এ স্কুলে সেরা ছাত্রী ছিলো। কোনোদিনই তার কোন জিনিস খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি। প্রক্সি ট্রে, প্রক্সি চেয়ার ইত্যাদির ব্যবহার জিনি এড়িয়ে যেতে পেরেছে অবহেলায় (সেই জন্যই অধিকাংশ জিনিসের আইডি বাটন জিনির হাতে। ইমনের জিম্মায় থাকলে আইডি বাটনের আইডি বাটন বানাতে হতো)।
ফ্ল্যাট থেকে তিন নম্বর বোতাম। ইমন জানে। চাপ দিতেই কোঁ কোঁ করে শব্দ করতে শুরু করল ট্রে। এটাও ফ্রি টোন। কিন্তু ভালো টিউনের পেছনে খরচা করার থেকে ট্রেটা সারালে উপকার বেশি। ইমন ট্রেটাকে ছুঁতেই বিচ্ছিরি আওয়াজটা থামল। কিন্তু ইমনের বিরক্তিটা গেলনা পুরোপুরি। কারণ ট্রেটা দাঁড়িয়েছে উলটো হয়ে, মানে কাপের হাতল এখন ইমনের বাঁদিকে। এই ধরনের ত্রুটি এখনকার পৃথিবীতে প্রায় ক্ষমাহীন। জিনি ঘরে ঢুকল। ইমন শব্দ পেয়ে ট্রেতে আঙ্গুলের গাঁট দিয়ে শব্দ করল দুবার। খানিকক্ষণ পরে জিনি বলল ‘ওমা উলটো!’ ইমন মনে মনে খুশি হয়। আশা করা যায় জিনি এবার নতুন ট্রে কেনার ছাড়পত্র দেবে। এবারে ফ্লোটিং কিনবে ইমন। এফ পি সেভেনে বিজ্ঞাপনে বলছে দুদিন চার্জ থাকে। শস্তা স্লাইডিং গুলোর চাকায় বিচ্ছিরি শব্দ হয় কদিন পর থেকেই।
‘তৈরি হবেনা’? জিনি প্রশ্ন করে, ইমন উত্তরস্বরূপ চায়ে চুমুক দেয় সশব্দে।
‘তোমাদের আওয়ার সেভিং এর কি হলো’?
ইমন জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল একটা।
এটা আশু পরিবর্তনে মেহেদির নবতম সংযোজন। বারো ঘন্টায় দিন। মানে এতদিন মানুষ যাকে একঘন্টা বলে জানত সেরকম দু ঘন্টাকে এবার থেকে এক ঘন্টা বলে ধরা হবে। অঙ্ক কষে দেখা গেছে তাতে নাকি উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে মানুষের। অ্যাসেম্বলিতে ইমন মৃদু প্রতিবাদ করেছিলো। বলেছিলো আগে খোদ সংযুক্ত বাংলা দেশেই দন্ড প্রহর লহমার হিসেব চালু ছিলো, সেই অর্থে এই পরিবর্তনে নতুনত্ত্ব তেমন কিছু নেই। কিন্তু সেক্রেটারি কর্ণপাত করেননি। এটাও মেহেদির বহু সিদ্ধান্তের মত আউটার অ্যাসেম্বলিকে জানানো হয়েছিলো মাত্র। জনমত নেওয়াটা লোক দেখানো। ইমনের ধারনা ইনার অ্যাসেম্বলিতেও মেহেদির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমত তেমন পাত্তা পায়না।
‘অর্থাৎ এখন আমাদের চারটে তের তাইতো’? জিনির পরিহাসের ইমন উত্তর দেয়না। বিরক্ত গলায় বলে
‘শিরিন ফোন করেছিলো?’
‘কাল তো আর করেনি। অবশ্য পরশু অনীক বলল প্রেগন্যান্সির এই স্টেজে চিপ কাজ করেনা, মায়ের সাথে বেবিকেও সেন্স করতে শুরু করে। তাছাড়া যতই বলুক রেডিয়েশান ফ্রি, এই অবস্থায় ফোন টোন ব্যবহার না করাই ভালো। অনীক কে একবার ফোন করলে হয়না?’
ইমনের মনে আছে একটা সময় ছিলো, যখন চিপের নম্বর হতো। যার চিপ যে খুশি ব্যবহার করতে পারত। যে কোনো চিপ থেকে যাকে খুশি ফোন করা যেত। তবে তখনো পৃথিবীর বহু মানুষ দৃষ্টিশীল ছিল। নম্বরের অর্থ ছিলো। ইমন এখনো মনে করতে পারে হাতের আঙ্গুল গুলো ছুঁইয়ে মা তাকে পাঁচ গুনতে শিখিয়ে ছিলো। বুড়ো, তর্জনী, মধ্যমা, অনামিকা, কনিষ্ঠা এই সবকটা মিলিয়ে হোতো পাঁচ। বাঁ হাত আর ডান হাত মিলিয়ে হত দুই, টেবিলের পায়া গুলো সবকটা ছুঁলে হতো চার। ইমন জানে। শিরিন অনীকরা জানেনা। এখন নম্বর শুধু দূরত্ত্ব তাপমাত্রা আর সময়। চায়ের সময়, তৈরী হবার সময়, মেহেদির আকাশকুসুম বক্তিমো শোনার সময়, খাওয়ার সময়, শোবার সময়। এখন শিশু জন্মানোর সাথে সাথে তাকে জি চিপ দেওয়া হয়। ফোনে লাগিয়ে নিলে তবেই ফোনে কথা বলা যাবে। সেই ফোনেই ফোন করা যাবে যারা জি চিপে রেজিস্টার্ড। ফোনে নাম বললেই ফোন। এদ্দিন পর্যন্ত যাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ আছে একমাত্র তাদেরকেই জি চিপে রেজিস্টার করানো যেত। কিন্তু এর ফলে বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এমনকি শারীরিক সম্পর্ক না হওয়া পর্যন্ত প্রেমিক বা প্রেমিকাকেও ফোন করা অসম্ভব ছিলো। ভয়েস ইমেল ছাড়া উপায় ছিলোনা। কয়েক বছর আগে কমন অ্যাসেম্বলিতে ইমন এই প্রসঙ্গ তোলে। সেক্রেটারি প্রথম এবং শেষ বার তার সাথে একমত হন। তার আউটার অ্যাসেম্বলি তে পদন্নোতি হয়। মেহেদি স্বয়ং অফিসিয়াল ভয়েস ইমেলে তাকে অভিবাদন জানান। কিন্তু এই জি চিপের বাকি সহস্র প্রতিবাদের উত্তরে মেহেদি মৌন থেকেছেন। আগে শুধু ফোনে, ব্যাঙ্কে, আর চাকরিক্ষেত্রে জি চিপ রেজিস্টার করাতে হতো। এখন প্রক্সি গাড়ি কিনতে গেলে, সেই গাড়িতে নতুন গন্তব্য রেজিস্টার করাতে গেলে, বাড়ি কিনতে, হাসপাতালে, স্কুলে, স্কাই ট্রেনের মান্থলি করাতে সর্বত্র, সর্বত্র জি চিপ। সবার প্রতিটি গতিবিধি এখন মেহেদির আর তার সম্মানীয় ইনার অ্যাসেম্বলির নখদর্পণে। আপত্তি জানাতে সেক্রেটারি তাকে দশ বছর আগের আর এখনকার অপরাধমূলক, নাশকতামূলক কাজের পরিসংখ্যান বর্ণনা করেন। বর্তমানে সংখ্যাটা প্রায় সত্তর ভাগেরও কম। কিন্তু চৌপহর এই আনুবীক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকাকে সাধারণ মানুষ খুব সহজে মেনে নেয়নি। কয়েকটা দল প্রতিবাদে খুব সরব হয়েছিলো। তাদের মধ্যে অ্যান্টিশভেনিস্ট বলে একটা দল সবথেকে সফল হয়। তাদের সমর্থকরা, সংখ্যাটা খুব একটা কম নয়, টানা তিন দিন কাজে যায়নি, ই-স্টোর বন্ধ রেখেছিলো, অপারেটর নেই বলে স্কাই ট্রেন বন্ধ ছিলো তিনদিন। কিন্তু মেহেদিকে টলানো যায়নি। সেই সমর্থকেরা তিনদিন পরে তাদের নিরীহ ইনবক্সে টারমিনেশান ভয়েস ইমেল আবিস্কার করে। এরপরে আন্দোলন খালি রেডিওতে আর ই-লিফলেটেই সীমাবদ্ধ আছে। অনীক আবার এই দলের বিরাট সমর্থক। বিপদে আপদে না পড়ে আবার। ইমনের চিন্তা বাড়ছে আজকাল।
কি ভাবছ অত? জিনি অনেক্ষণ উত্তর না পেয়ে প্রশ্ন করে।
তুমি গুনতে জানতে?
অ্যাঁ? জিনি একটু অবাক হয়। হঠাৎ?
এমনি জিজ্ঞেস করছি —
জানতাম মানে, জানি তো। এক ঘন্টা মানে কতক্ষন, পঁচিশ ডিগ্রী মানে কেমন গরম, দশ বছর মানে…
নানা মানে, চব্বিশ মানে কটা কলম, সাত মানে কটা কাপ…ছাড়ো…এমনি হঠাৎ মনে হলো।
জিনি শ্বাস ফেলে, জিনি চিরকালই দৃষ্টিহীন। জিনি শুনেছে তার মা খুব ছোটবেলায় দেখতে পেত। জিনির বাবা কোনদিনই পাননি। ইমনের স্পর্শে জোনাথন বললেন আটটা ছাপ্পান্ন। জিনি চায়ে চুমুক দিল। বলল
‘আচ্ছা তখন পৃথিবী ভারি অন্যরকম ছিলো তাইনা’? বহু মানুষ বহু মানুষকে এই প্রশ্ন অসংখ্যবার করেছে। ‘জোনাথন কফিনের ঢাকনা খুলতেই দেখতে পেল কাউন্ট শুয়ে, সে যেন কালকের তরুণ, তার গাল গোলাপী, ঠোঁট রক্তে রাঙ্গানো লাল’ জিনির স্মৃতিশক্তি অসাধারন, ইমন লক্ষ্য করেছে তার সময়েরও যারা জন্মত দৃষ্টিহীন তাদের সকলের স্মৃতিশক্তিই তার চেয়ে বেশী। শিরিনের বয়সীদের দের তো তুলনাই নেই। ‘এই উপন্যাসগুলো রিরাইট করা উচিত। ধর গাল ব্যাকেলাইটের মত মসৃণ, ঠোঁট নতুন কেকের মত নরম, অস্তিত্ত্বহীন অনুভূতি জিইয়ে রেখে লাভ কি। আর লাল বা গোলাপি মানে চোখের রেটিনার এক অংশের স্নায়ুর উত্তেজনা, তার মানেই কি সত্যি সে গাল তরুণের মত মসৃণ? সেই সময়ে লেখকদের বর্ণনাগুলো কেমন ওপর ওপর না’?
রিরাইট-এর প্রসঙ্গ টা কি অ্যাসেম্বলিতে তোলা যায়? হলে মন্দ হয়না। বহু ছেলে মেয়ে, ভাষাবিদের চাকরি হবে। সত্যিই তো, সূর্যাস্তের আকাশে রঙের খেলা। এ বাক্যের মানে কি? সেই সূর্যাস্ত শীতল না উষ্ণ, হাওয়া কোন দিকে, বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ আছে না নেই…রঙের খেলা কিছুই বোঝাচ্ছেনা। একটিমাত্র ইন্দ্রিয়র ওপর নির্ভরশীল বর্ণনা কেবল।
‘যাই তৈরী হই। ‘
‘তোমার রূপোলি বর্ম অঙ্গে চাপিয়ে যুদ্ধজয়ে যাও বীর…’ আবার পরিহাস। ইমন সামান্য বিরক্ত হয়
‘শোনো তবু এই অ্যাসেম্বলি আছে বলেই ব্যাটার খামখেয়ালিপনায় লাগাম আছে। নইলে এদ্দিনে হিটলারি রাজত্ত্ব চালু হয়ে যেত।’
‘হ্যাঁ তোমাদের বাহুতে জড়ানো থাকত রক্তিম স্বস্তিকা…আচ্ছা রাগ কোরোনা…সত্যি বল রক্ত একটা রঙ হলো…কি ডিসগাসটিং, না’? ইমন ছকোনা বোতাম টিপে প্রক্সি চেয়ার বাথরুমের দিকে নিয়ে চলে। জিনির হাসির উত্তর দেয়না।

প্রক্সি গাড়ির ভিতরটা গরম হয়ে ছিলো, ইমন প্রায় চিৎকার করে বলল বাইশ। গরম সে মোটে সহ্য করতে পারেনা। ভেতরটা একটু ঠান্ডা হতে বলল রাজভবন। গাড়ির স্পীকার থেকে আওয়াজ এল মোটামুটি আধ ঘন্টা। ইমন বলল আলি আকবর, ট্র্যাক ওয়ান, আওয়াজ ষোলো। ক্ষীণ আওয়াজে আলাপ শুরু হলো। সামান্য ঝাঁকুনি তে ইমন বুঝতে পারল গাড়ি চলতে শুরু করেছে। রিরাইট-এর ব্যাপারটা তার মনে ধরেছে। আর দু’বছরের মাথায় ইমনকে অবসর নিতে হবে। তার আগে ইনার কাউন্সিলে প্রমোশন পেলে মন্দ হয়না। ইনার কাউন্সিল তাদের বক্তব্য সোজা মেহেদির সামনে পেশ করে, সেক্রেটারির সামনে না। অবসরের সময়ে মেহেদি সদস্যদের কোন একটা ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করেন বলে শোনা যায়। অধিকাংশ সদস্যই নাকি কয়েক ঘন্টার জন্য দৃষ্টিশক্তি ফেরত চান। তবে এ সবই শোনা কথা। ইমন ইনার কাউন্সিলের কয়েকজন সদস্য কে চেনে বটে কিন্তু অবসর প্রাপ্ত কাউকে চেনেনা। ফলে এই গুজবের সত্যতা যাচাই করার অবকাশ হয়নি কখনো। গাড়ির আওয়াজে আলি আকবরের ওস্তাদি শোনাই যাচ্ছিলনা তেমন, ইমন বলল আওয়াজ কুড়ি। সামান্য আওয়াজ বাড়ল। গেল পাঁচ বছরে পৃথিবীতে কোন যন্ত্রসঙ্গীত রেকর্ড হয়নি। কন্ঠসঙ্গীত, বড়োজোর পুরোন ট্র্যাকের ওপরে ইম্পোজ করে গান হয়েছে। মানুষ যন্ত্রসংগীতে উৎসাহ হারাচ্ছে। একদল মনোবিদেরা বলছেন একেবারে না দেখে যন্ত্রসঙ্গীত শেখা শক্ত বলে। আরেকদল বলছেন মানুষ শব্দের উৎসের সাথে রিলেট করতে পারছেনা বলে। তবে অধিকাংশের মত যন্ত্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা যখন সবচেয়ে বেশী অর্থাৎ কুড়ি শতকে তখন পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ দৃষ্টিশীল ছিলো। যন্ত্রসঙ্গীতের সুরের থেকে নাকি বাজাবার ভঙ্গী মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলো বেশি। তাই আজকের পৃথিবীতে যন্ত্রসঙ্গীত অচল। আজকের পৃথিবী। জিনির প্রশ্নটা ইমনের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সত্যি কেমন ছিল তখন সব? ইমন ইতিহাসবিদ। বর্তমানে ঐতিহাসিকরা পৃথিবীর ইতিহাসকে দুভাগে ভাগ করেছেন। প্রি ডিসিজ, আর পোস্ট ডিসিজ। অসুখপূর্ব আর অসুখোত্তর। পোস্ট ডিসিজ ইতিহাস নিয়েই ইমনের মূলত পড়াশোনা। সে ইতিহাস মানুষের বাধা অতিক্রম করার ইতিহাস। দুহাজার সাতাত্তর সালের গোড়ার দিকে (ইমন সঠিক তারিখ টা বার করার চেষ্টা করেছিলো,পারেনি) প্রথম অসুখের আবির্ভাব। দিক নির্ণায়ক শলাকা যেদিকে তার ডান দিকে ভিয়েতনাম বলে কোন এক দেশে প্রথম এই অসুখ নথিভুক্ত হয়। অ্যাকিউট মায়োপিক সিন্ড্রোম। অ্যাম্পসি। প্রায় একশো বছর আগে এই সংযুক্ত বাঙলা দেশেই এরকম আরেকটি চোখের অসুখ মহামারির আকার ধারণ করেছিলো কিন্তু সেই কঞ্জাঙ্কটিভাইটিস এর মতো অ্যাম্পসির কোন প্রতিষেধক মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। আর কঞ্জাঙ্কটিভাইটিস-এ দৃষ্টি হারানোর বা মৃত্যুর কোন সম্ভাবনা ছিলোনা। কিন্তু অ্যাম্পসি প্রথম নথিভুক্ত হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীর আশি ভাগ মানুষ তাদের দৃষ্টি শক্তি হারায়। রেটিনার ইনফেকশানে প্রথম দিকে অসুস্থ প্রায় সব মানুষই মারা পড়ে। দুহাজার সাতাত্তর অর্থাৎ পৃথিবীতে ইসলামের উত্থানের সময়েই। ধর্মযাজকরা একে কয়ামত বলে প্রচার করতে থাকেন। পৃথিবীর লোকসংখ্যা মাত্র একাশি হাজারে দাঁড়ালে মেহেদির উত্থান। মেহেদি অ্যাম্পসির প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে না পারলেও এই রোগের ফলে মানুষের মৃত্যু প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অনেকে তাঁকে বিজ্ঞানী মনে করলেও মেহেদি প্রথম থেকেই ধর্মযাজক, ইমামের ভুমিকা পালন করে আসছেন। গোটা পৃথিবীর জীবিত মানুষদের মেহেদি লড়াই করতে শিখিয়েছেন। আজ পৃথিবীর মানুষের সংখ্যা সাত লক্ষ। শিশু বয়েস থেকে স্কুলে নিয়মানুবর্তিতা শেখানো হয়। ফলে মানুষ দৈনন্দিন জীবনে এখন দৃষ্টির প্রয়োজন অতিক্রম করেছে। আগে মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ দৃষ্টি নির্ভর ছিলো – হাঁটা, বসা, কথা বলা, আনন্দ, দুঃখ, ভালোবাসা, শোক, সময
় কাটানো সব। এখন মানুষ আরো অনুভূতি প্রবণ। এখন আর কেউ কিছু হারিয়ে ফেলেনা, কোনো শিশু শহরে হারিয়ে যায়না। আগে মানুষ রঙিন পোষাকে, শরীরের উদ্বৃত্ত চুলে, বাসস্থানের রঙে কোমরের আকৃতিতে বহু সময় ও অর্থ অপচয় করেছে। সংযুক্ত বাঙলা দেশে এখন মানুষ পোষাক ব্যবহার করে মাত্র দুমাস। দেহের উদ্বৃত্ত চুল স্নানের সময়ে রেডিয়েশান চেম্বারে ঝরিয়ে নেয়। ইমন এই ইতিহাস নিয়ে থিসিস করেছিলো। মানবসভ্যতা অ্যাম্পসির ফলে একশো বছর পিছিয়ে যাওয়ার বদলে সহস্র বছর অগ্রসর হয়েছে।
রাজভবন…শেষ সিগনাল…চার মিনিট
গাড়ির কন্ঠস্বরে ইমনের ভাবনা বাধা পায়। আজকে অ্যাসেম্বলির সেমিনার বিকেল বেলা। ততক্ষণ ইমন নিজের কাজ করতে পারে। নিজের গবেষণার কাজ। বিগত প্রায় দু বছর ধরে ইমন পোস্ট ডিসিজ ইতিহাসের ঘটনাবলীর একটা সময়পঞ্জি বানাতে ব্যস্ত। কাজটা খুব সহজ নয়। কিন্তু সব থেকে শক্ত কাজ ইমন দেখেছে প্রথম দুবছরের ইতিহাস বার করা। তখন সর্বনাশা মহামারীর জন্যই হোক, বা মানুষের তখনকার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ইন্দ্রিয় হারানোর জন্যই হোক প্রথম দুবছরের প্রায় কোন ইতিহাস নথিভুক্ত নেই। সারা পৃথিবীতেই। যেটুকু যা আছে সেগুলো নন ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা। যার মর্মোদ্ধার এখনকার পৃথিবীতে প্রায় অসম্ভব। আর কিছু নথি মেইন ফ্রেমে আছে যা ইমনের আওতার বাইরে। সেই নথি পর্যন্ত পৌঁছতে সরাসরি মেহেদির অনুমোদন প্রয়োজন। অনেকবার সেক্রেটারির কাছে আবেদন করেও সেই অনুমোদন ইমন আদায় করতে পারেনি। সাতাত্তর আর আটাত্তর। ইমনের অস্বস্তি হয়। তার অহঙ্কারে আঘাত লাগে। নিজের অতীতের সব রহস্য উদ্ঘাটিত না হওয়ায় অসহায় মনে হয় নিজেকে। এই দু’বছরের ইতিহাস নিয়ে তার নিজস্ব একটা থিয়োরি আছে কিন্তু প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত সেই থিয়োরি কাউকে, এমনকি জিনিকেও বলতে তার সাহস হয়নি।
গাড়ি থামে। দরজা দিয়ে নামতেই বাঁ দিকে বিপ শব্দ শুনতে পেল ইমন। তার প্রক্সি চেয়ার তার জন্য অপেক্ষা রত। অধিকাংশ সদস্যই তাদের চেম্বার পর্যন্ত হেঁটে যেতে পছন্দ করে। কিন্তু তারা ইমনের চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট। অ্যাম্পসি তাদের জীবনের শ্বাসপ্রশ্বাসের মতোই একটি অঙ্গ। ইমন এখনো এই অসুখের সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি। ইমন বাকি বহু মানুষের মতো গোপনে আজও বিশ্বাস করে তার দৃষ্টিহীনতা তার দূর্ভাগ্য। আরেকটি ইন্দ্রিয় কার্যকর হলে তার জীবন অনেক সুন্দর হতো।
ইমন নিজের চেম্বারে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজে ডুবে গেল। সাতাত্তর আর আটাত্তর এই দুবছরের ইতিহাসের অনুপস্থিতি মানব সভ্যতার এক অপূরনীয় ক্ষতি। মেহেদির অতীত নিয়ে প্রায় কিছুই জানা যায়নি এখন অবধি। যতদূর জানা যায় মেহেদির উত্থানের আগে সংযুক্ত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে অত্যন্ত দরিদ্র একটি দেশ ছিলো। রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রায় অরাজকতার পর্যায়ে পৌঁছয়। এই সময়ে ইসলামের উত্থান। উত্থান না বলে জাগরণ বলা ভালো। কারন এর আগে ইসলাম প্রসার পেয়েছে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। সালাউদ্দিন, মহম্মদ আলি এমনকি বাহান্ন সালে বাবা ইরানির উত্থান সবই ভয়াবহ রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু পঁচাত্তর সাল নাগাদ মানুষ বাকি ধর্মগুলি প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করে। ইতিহাসে এই প্রথম ইসলাম জয়ী হওয়ার বদলে জনপ্রিয় হলো। মেহেদি নিজেকে খালিফ ঘোষণা করলেন। কেউ প্রতিবাদ করল না। সেই থেকে মেহেদি অ্যাম্পসির সাথে লড়াইয়ের সাথে সাথে ইসলামের কূপমণ্ডু‌কতা দূর করার কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছেন। এখন মানুষের ভাবাবেগ, যুক্তি, বিচারক্ষমতা অনেকাংশেই কোরানের দায়ভার মুক্ত। কিন্তু এই বিপ্লবের শুরুর দুটি বছরে কি ঘটল? মানুষ ইসলাম বেছে নিলো কেন? দৃষ্টিহীনতার সাথে দৃষ্টি নির্ভর একটা জাতি মাত্র দু বছরে কেমন করে খাপ খাইয়ে নিল? ইমন নথির পর নথি শুনতে থাকে। কোথাও সাতাত্তর আর আটাত্তরের উল্লেখ মাত্র নেই। অন্ধত্ত্ব মানুষকে ক্ষণিকের জন্য বর্তমানকে ভুলে থাকতে সাহায্য করছিল বোধহয়।

অ্যাসেম্বলির ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই ইমন প্রক্সি চেয়ারের বড় স্ফীত বোতামটায় চাপ দিলো। চেয়ার দ্রুত তাকে অ্যাসেম্বলি কক্ষে ফাঁকা সুরক্ষিত যায়গায় অধিষ্ঠান করাল। ইমন সামনে হাত বাড়িয়ে একবার মাইকটা স্পর্শ্ব করে নিলে। আজকে সমস্ত পৃথিবীর চলাচল, পরিবহণ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রক্সিমিটি সুইচের দ্বারা। একটি তর্জনীর মাপের জিনিস, যার কাছাকাছি কোন বস্তু এসে পড়লে সেটি অ্যাকটিভেটেড হয় আর তার মাদারবোর্ডে সেই বস্তুটির অবস্থান আর নিকটবর্তী বস্তুটির ধরণ মানে গাড়ি, চেয়ার বা ট্রের ক্ষেত্রে সেগুলোর কোড বৈদ্যুতিক সংকেতে প্রেরণ করে। মাদারবোর্ড তার মধ্যে আগে থেকে সঞ্চিত তথ্যের ভিত্তিতে বেতার তরঙ্গে বা ওয়াই ফাইতে সেই বস্তুটির ইঞ্জিন বন্ধ করে বা বস্তুটিকে নিজ গতিতে চলে যেতে দেয়। ইমন একবার রেডিওতে শুনেছিলো কেবল কোলকাতায় ব্যবহৃত প্রক্সিমিটি সুইচের সংখ্যা প্রায় দু বিলিয়ন। নতুন সুইচগুলি ইনফ্রা তরঙ্গে কাজ করে, পুরনোগুলি চৌম্বক ক্ষেত্রে। প্রতিদিন প্রায় আট হাজার প্রক্সিমিটি সুইচ খারাপ হচ্ছে। যার প্রতিটা মাত্র পনের মিনিটের মধ্যে সারাই বা পরিবর্তন করা হয়। দেশের সেরা ইঞ্জিনিয়াররা এই কাজে নিযুক্ত আছেন। প্রক্সি সুইচের উৎপাদন করে রাষ্ট্র, অলাভজনক ভাবে। করের টাকায়। ঠিক যেভাবে রাস্তা নির্মাণ হয় বা জল পরিশোধন করা হয়। এই প্রক্সি সুইচের ব্যবহারও শোনা যায় মেহেদির মস্তিষ্কপ্রসূত। তিনি ইমাম, চিকিৎসক, পদার্থবিদ না ধাপ্পাবাজ এই নিয়ে নানা স্তরে জল্পনা চালু আছে।
‘নমস্কার সদস্যবৃন্দ’ সেক্রেটারির বকবকানি চালু হলো। অধিকাংশ ভাগই মেহেদির গুণগান আর সংযুক্ত বাঙলা দেশের উন্নতির বর্ণনা। এর পরে সকল সদস্যের কাছ থেকে দেশের উন্নতির জন্য কিছু পরামর্শ চাওয়া হবে। নব্বই ভাগ মতামত তৎক্ষণাৎ নাকচ হয়ে যাবে। বাকি দশ ভাগ নাকচ করবেন মেহেদি স্বয়ং। চেনা ছক। ইমন ভাবছিলো পুরনো উপন্যাসের নবীকরণ আদৌ এই অ্যাসেম্বলিতে পেশ করার উপযুক্ত কোন পরামর্শ কিনা। পাশে প্রক্সি চেয়ার থামার শব্দ পেয়ে ইমন মাথা তুলল। জাভেদ। প্রতিটি সেমিনারেই তার দেরি হয়। উপযুক্ত অজুহাত অবশ্য সে সবসময়েই দিতে পেরেছে। ‘প্রক্সি চেয়ারটা গোলমাল করছিল জাঁহাপনা’ জাভেদ ফিসফিসিয়ে বলে। গলায় কৌতুক। অর্থাৎ তার আজকের অজুহাত তৈরি। ইমনের মাথায় দুরাগত সাইরেনের মত কিছু ভাবনা আত্মপ্রকাশ করে, যে ভাবনা গুলো ইমন এতদিন ভাবতে সাহস পায়নি। যা সত্যি হলেও সে সত্যি মিথ্যার চেয়ে বেশী অবিশ্বাস্য হবে। প্রক্সিমিটি চেয়ার। প্রক্সিমিটি সুইচ। প্রক্সিমিটি অর্থে নৈকট্য। প্রতিটি সুইচের জন্য ধার্য, স্থির, অপরিবর্তনশীল দূরত্ব। ঠিক যে দূরত্বে নির্দিষ্ট বস্তুটি এলে তবেই সুইচটি কাজ করতে শুরু করবে। ইমনের অবসর নিতে আর মাত্র দুবছর। অ্যাসেম্বলির সদস্যস্বরূপ তার অফুরান পেনশন, সুযোগ সুবিধে পাওয়ার কথা। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তার মেয়ে শিরিন মা হতে চলেছে। এই সুসময়ে ইমন মাইকে হাত চাপা না দিয়েই (এখনকার পৃথিবীর নিয়মানুগ মানুষ আর ভুল করেনা, অর্থাৎ ইচ্ছে করেই মাইকে হাত চাপা না দিয়েই) জাভেদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল
‘দৃষ্টিহীনের দুনিয়ায় প্রক্সি সুইচের স্থির দূরত্ব কি ভাবে মাপা হয় বলতে পারেন ভাই জাভেদ’?
জাভেদ উত্তর দেয়না। সেক্রেটারি ভয়ানক বিরক্ত গলায় বলেন, ‘ভাই ইমন, দয়া করে আপনার বক্তব্য পেশ করার সুযোগ আসার আগে পর্যন্ত কথোপকথন থেকে বিরত থাকলে বাধিত হব’।
ইমন ক্ষমা চাওয়ার বদলে বেশ জোর গলায় বলে ‘রাখুন আপনার কথোপকথন আর বক্তব্যের সুযোগ, আমি মেহেদির সাথে কথা বলতে চাই। আজই। এখনই।’
গোটা অ্যাসেম্বলি তে একটা মৃদু গুঞ্জন ছড়িয়ে যায়। সেক্রেটারি বলেন ‘সদস্যবৃন্দ, ভাই সকল দয়া করে শান্ত হোন। ভাই ইমন এর পরথেকে এই ধরনের ঔদ্ধ্‌ত্ব আমরা…’
ইমন সামনের টেবিলে একটা চাপড় মেরে বলে ‘আমি জানি সাতাত্তরে কি ঘটেছিলো।’ আশপাশের সদস্যদের শ্বাসের শব্দ ছাড়া গোটা অ্যাসেম্বলি কক্ষে আর কোন শব্দ শোনা যায়না। ‘এইবার? এইবার কথা বলতে পারা যাবে’?

সহসা ঝাঁকুনিতে ইমন বুঝতে পারল তার প্রক্সি চেয়ারটি চলতে শুরু করেছে। তার নির্দেশ ছাড়াই। খানিক্ষণ পরে চেয়ার থামলে ইমন দু কাধে দুটি হাতের স্পর্শ অনুভব করল। দুটোই বাঁ হাত। অর্থাৎ দুজন মানুষ। ইমন সোজা হয়ে চেয়ারে বসেছিলো হাতদুটো ভাঁজ করে কোলের ওপর রাখা। এরপরে ইমন সতর্ক হওয়ার আগেই কারা তার কবজি চেপে ধরল। তার দুহাত দ্রুত তারা বেঁধে ফেলল চেয়ারের হাতলের সাথে। তার মাথায় নাকের ওপরে কি একটা বসিয়ে দিলো সযত্নে। ইমন বুঝতে পারছিলো, বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে খুব একটা উপকার হবেনা। হঠাত যন্ত্রণা। ইমনের মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যায় যেন। চোখে মনে হয় কে তপ্ত শলাকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইমন চিৎকার করে। বাঁধনমুক্ত করার চেষ্টা করে নিজেকে। খানিকক্ষণ পরে যন্ত্রণা স্তিমিত হয়। ইমন ঘামে ভিজে গেছে ততক্ষণে।
‘চোখ খুলুন ইমন’ – ভরাট কণ্ঠস্বর। ইমন তার চোখের পাতা বন্ধ রাখতেই অভ্যস্ত। ধীরে ধীরে অব্যবহারে স্ফীত কুঞ্চিত চোখের পাতা খোলে ইমন। সহসা তার মস্তিষ্কে যেন বিষ্ফোরণ হয়। এতবছরের অকর্মণ্য একটি ইন্দ্রিয় লক্ষ লক্ষ সংকেত পাঠাতে থাকে মস্তিষ্কে। ইমন দেখতে পায়। ইমনের গা গুলিয়ে ওঠে। মস্তিষ্কের ওপর অত চাপ একবারে সহ্য করা শক্ত। ইমন চোখ বন্ধ করে। ফিরে যায় চেনা অন্ধকারে। এবার চোখ খোলে আগের চেয়েও আস্তে আস্তে। ইমনের দূরত্বের আন্দাজ থাকলে বুঝতে পারত ঘরটি ছোট। পায়ে হেঁটে গেলে তিন কি চার কদমের বেশি হবেনা। ডানদিকে দরজা। বাঁ দিকে দেওয়ালে দুটি ছিদ্র। ইমন অনুমান করে ওগুলো জানলা। ওখান দিয়ে সূর্য রশ্মি এসে প্রতিফলিত হচ্ছে সব বস্তুতে। এই প্রতিফলন তার চোখ সংগ্রহ করে প্রেরণ করছে মস্তিষ্কে। ইমনের সামনে কয়েক জন মানুষ দাঁড়িয়ে। একজন মানুষ ঠিক তার মুখোমুখি হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় এমন দূরত্বে বসে। সেই মানুষটি বলে ‘আমি মেহেদি ইমন, দৃষ্টি মুবারক।’
ইমন ঠিকভাবে দৃষ্টিশীল হলে বুঝতে পারত মেহেদি বয়েসে বৃদ্ধ। মুখের গড়ন লম্বাটে, মুখে লম্বা সাদা দাড়ি। দেহ শীর্ণ। চোখ! ইমনের নবলব্ধ দৃষ্টি তার স্মৃতিতে চিরকালের জন্যে ওই চোখ দুটি প্রোথিত করে দিল। মেহেদির মুখে বয়েসের ছাপ স্পষ্ট। সাতাত্তর সালে মেহেদির কুড়ি বাইশ বছর বয়েস হলেও এখন তার বয়েস আশির বেশী হওয়া উচিত। মেহেদি খুব ঢিলে ঢালা একটা পোষাক পরে আছেন। বাকি সকলের পোষাক প্রায় গায়ের সাথে চাপা। এখন জৈষ্ঠ মাস। তাই ইমন নগ্ন। পোষাকের ব্যবহার এই ঋতুতে অপ্রয়োজনীয়। সামনের দুজন মানুষ এগিয়ে এসে ইমনের বাঁধন খুলে দেয়। ইমন এতক্ষণে লক্ষ্য করে তার মাথায় নাকের ওপর একটা যন্ত্র লাগানো। চোখের সামনের অংশটি চৌকো। সেই অংশের বাইরে তাকালে সব অন্ধকার। এই যন্ত্রটিও নিশ্চই মেহেদির আবিষ্কার। ইমনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহেদি হঠাত বললেন ‘আসুন’। মেহেদি ইমনের হাত ধরে তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করে। ইমনের হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিলো। সামনের বস্তু গুলোর থেকে কত দূর দিয়ে যাওয়া উচিত তার জ্ঞান ইমনের সদ্য কার্যকর চোখদুটির নেই। ইমন চোখ বন্ধ করে। বলে ‘আমার প্রক্সি স্টাফ…’ মেহেদি মৃদু হাসেন। বলে ‘চেষ্টা করুন। পারবেন।’ ইমন চোখ খোলে মেহেদি তার কনুই ধরে থাকেন। ঘর থেকে বেরিয়ে তারা একটা করিডোরে পৌছলে মেহেদি বলেন
‘আমরা অনেক দিন ধরে আপনাকে লক্ষ্য করছি ইমন। আমরা জানতাম আপনি পারবেন।’
ইমনের পাশ দিয়ে নগ্ন মানুষেরা প্রক্সি স্টাফ, প্রক্সি চেয়ারের ভরসায় তাদের পার হয়ে যায়। ইমনও নিশ্চই দিনের পর দিন এভাবে না জেনে মেহেদির পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। ইমন বলল
‘আমার কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে।’
মেহেদি ওপরে নিচে মাথা নাড়েন, বলেন
‘মনে রাখবেন উত্তর দিতে আমি দায়বদ্ধ নই।’
‘অন্ধত্ব কেন?’ ইমনের কন্ঠে ক্ষোভ ছিলো
মানুষ অন্ধই ছিলো ইমন। অ্যাম্পসি তাকে দৃষ্টিহীন করেছে কেবল। আপনি নিজেও জানেন আজকের দৃষ্টিহীন মানুষ আগের চক্ষুষ্মান মানুষদের থেকে কত এগিয়ে। আমরা আজ কত বেশি সংযত দেখুন। বিজ্ঞানে আমাদের উন্নতির সীমা নেই…
তবু আমরা আপনাদের মত কিছু দৃষ্টিশীল মানুষের অধীনে…
সেটা সাময়িক ইমন। এখনও আমরা সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীনতার জন্য প্রস্তুত নই। তবে আর খুব বেশি দেরি নেই। আগামি দশ বছর পরে স্কুলে ডিসিপ্লিন শেখানো অর্থহীন হবে। আপনিই নিজেকেই দেখুন। আপনি জন্মত অন্ধ নন। অথচ আপনি বিগত তিরিশ বছর ধরে আপনার ফোনটি ডান কবজিতে বেঁধে রাখেন। কথা বলার সময়ে বার করে নেন। কথা বলা শেষ হলে ফোন যথাস্থানে ফেরত যায়। আমি ফোন ব্যবহার করিনা। কিন্তু আমার পরিচিত দৃষ্টিশীল মানুষেরা তিরিশ বছর নয় মাত্র তিরিশ মিনিট আগে ফোন টি কোথায় রেখেছে মনে করতে পারেনা।
মেহেদি ইমন কে নিয়ে একটা এলিভেটরে প্রবেশ করলেন। ইমন এর আগে বহুবার এলিভেটর ব্যবহার করেছে। আজ দেখল বস্তুটি আলোকিত। এলিভেটরের ছাদটি উজ্বল। এটা কৃত্তিম আলো। ইমন জানে। ইমনের চোখে কষ্ট হচ্ছিলো।
ইমন চোখ বন্ধ করে বলল ‘এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলোনা, দেড়শো বছর আগে ফ্যাসিজমও মানুষকে সংযত করেছিলো, একরকম ভাবে দেখতে গেলে নিয়মানুগও করেছিলো। অন্ধত্ব কেন?’
‘অন্ধত্ত্ব কেন?’ মেহেদি উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন। ‘আমরা কোন পৃথিবীতে বাস করছিলাম ইমন? যেখানে মানুষ মানুষকে বিচার করত তার গায়ের রঙ দিয়ে, দাঁতের গড়ন দিয়ে, তার ব্যবহারের পোষাকের রঙ দিয়ে। আজকের পৃথিবীতে সুন্দর কুৎসিতে পার্থক্য নেই। ফর্সা কালোয় পার্থক্য নেই, লম্বা খর্বে পার্থক্য নেই। আজকে মানুষ বিচার হয় তার মেধা দিয়ে, তার কর্মক্ষমতা দিয়ে। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে মানুষ শুধু সৌন্দর্যের জন্য কত সময় অর্থ শক্তি অপচয় করেছে। আজ আমাদের বাসস্থান ঠিক সেভাবে বানানো হয় যেভাবে আমাদের প্রয়োজন। প্রকোষ্ঠহীন। ফলে অনেক বেশি মজবুত। আধিক্য আজকে অর্থহীন তাই আমাদের সমাজে ঈর্ষা নেই। নগ্নতা আজকে অর্থহীন, তাই আমাদের সমাজে ধর্ষণ নেই। আজকে পোষাকের প্রয়োজনীয়তা নেই। আমরা আবার ইডেন উদ্যানে ফিরে যেতে পেরেছি। আমরা লজ্জা কে জয় করেছি ইমন। আমি জানতাম এই অন্ধত্বের ফলে সেই অসম্ভব আমরা সম্ভব করতে পারব।
আপনি জানতেন! অর্থাৎ এই অন্ধত্ব…
একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে এলিভেটর থামল। মেহেদি স্বয়ংক্রিয় দরজা খোলার জন্য অপেক্ষা করতে করতে যেন আনমনে বলেন
হ্যাঁ ইমন, অর্থাৎ এই অন্ধত্ব মনুষ্য সৃষ্ট। অ্যাম্পসির ভাইরাস আমি নিজে হাতে গবেষণাগারে তৈরি করেছি।

এলিভেটরের দরজা খুললে ইমন খানিকটা ফাঁকা জায়গা দেখতে পেল। অ্যাসেম্বলি হলের ছাদে দাঁড়িয়ে তারা। সূর্য এখন মধ্য গগনে। ইমনের চোখের কষ্টটা বাড়ছে। মেহেদি আবার তার কনুই ধরে ইমনকে হাঁটতে সাহায্য করেন। ছাদের প্রান্তে নিয়ে যান। ডান হাত তুলে সামনে দেখিয়ে বলেন
‘দেখুন ইমন, এইই আমাদের সংযুক্ত বাংলাদেশ। আমার ইডেন উদ্যান’।
ইমন দেখে তাদের চারদিকে বেশ কিছু বাড়ি মাথা উঁচিয়ে আছে। তাদের মধ্যে দিয়ে ছন্দোবদ্ধ রাস্তা, সারি সারি প্রক্সি গাড়ি ছুটে চলেছে অবিরত। রাস্তার ধারে সমান মাপ করে কাটা গাছ। ইমনের দূরত্বের হিসেব থাকলে বুঝতে পারত এই বাড়ির সারি রাস্তা বাগান বিস্তৃত মাত্র কয়েক বর্গ কিলোমিটার। তারপরে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের ওপরে ছোট ছোট খুপরি গুলো ইমন জানেনা আসলে প্রহরাকক্ষ। পাঁচিলের বাইরে পৃথিবী অন্যরকম। সেখানে বাগান নেই, বাড়ি গুলি খর্বকায়, ভঙ্গুর, রাস্তা প্রায় দেখাই যায়না। ইমন ভারসাম্য রাখতে ছাদের পাঁচিল ধরে শক্ত করে।
‘এইই? এই আমাদের পৃথিবী। এত বছর আমরা মাত্র এটুকুতেই…’
‘সন্তুষ্ট ছিলেন…আর দেখুন দৃষ্টি ফেরত পাওয়া মাত্র আপনার সেই সন্তুষ্টি উধাও। দৃষ্টিই রোগ ইমন, অ্যাম্পসি তার উপশম মাত্র।’
‘আমাদের ইসলামি জাগরণ…’
‘কেবল মাত্র এখানেই। এর বাইরে আজও অশিক্ষিত মানুষরা ধর্মের নামে রক্তপাত বন্ধ করতে পারেনি।’
‘কিন্তু ইসলামই কেন? আপনার এই নতুন পৃথিবী তৈরি করতে ধর্মের কি প্রয়োজন ছিলো?’
মেহেদি খানিকক্ষণ অপলক চেয়ে থাকেন ইমনের দিকে। তারপর হতাশ কন্ঠে বলেন
‘আপনি সত্যিই জানেননা, না?’
‘কি?’
‘আল্লা…ইমন, মেহেদি আমার নাম নয়। আমিই মেহেদি। ইসলামের শেষ নেতা, শ্রেষ্ঠ খালিফ। ওই দেখুন পাঁচিলের বাইরে মানুষ পোকামাকড়ের মত অপেক্ষা করছে কয়ামতের আগুনে পুড়ে মরবে বলে। আমি আপনাদের সে আগুন থেকে রক্ষা করেছি ইমন। ইসলাম আপনাদের রক্ষা করেছে।’
মেহেদির বাচনভঙ্গিতে অনেক্ষণ থেকেই ইমনের অস্বস্তি হচ্ছিলো। সন্দেহ হচ্ছিলো। এবার আর সে সন্দেহ প্রকাশ না করে থাকতে পারলনা। তীক্ষ্ণ কন্ঠে ইমন বলে
‘আপনি উন্মাদ!’
‘আর’? বৃদ্ধ উত্তেজিত হন। ইমনের কনুই সজোরে চেপে ধরে উত্তেজিত কন্ঠে বলেন ‘আর? মহম্মদ লম্পট, য়েশু তস্কর, মারিয়ম ভ্রষ্টা, মোসেস বিশ্বাসঘাতক। তোমাদের বিশেষণ আমাদের জন্য কোনোদিন ফুরাবেনা ইমন!’
‘তারা অন্তত নিজেদের খেয়ালে কয়েক হাজার মানুষকে নিজের কল্পনার জীবন মেনে নিতে বাধ্য করেননি!’
‘নিজের খেয়ালে? তোমার…আপনার কি মনে হয় এই বিশাল কান্ড একা আমার খেয়ালে? আচ্ছা আপনার আশ্চর্য লাগছেনা যে কোন দৃষ্টিশীল মানুষ আপনার আটান্ন বছরে আপনাকে সত্যিটা বলেনি বলে!
শুনুন ইমন। সত্যি শুনতে চান যখন। কোনো সমাজ, যে কোনো সমাজের উন্নতির জন্য তাকে একটা ছাতার তলায় আনাটা জরুরি। তাতে সমাজের গ্রন্থি মজবুত হয়। ইসলাম ধরে নিন সেই ছাতাটুকু। আর সমাজটির সবাই যে ছাতার তলায় আশ্রয় নেবেই তার নিশ্চয়তা কি? নেই। আপনি এক্ষুনি ফ্যাসিজম এর কথা বলছিলেন না? দেখুন সেই ফ্যাসিজম তার নানা রূপে মানুষকে এই এক ছাতার তলায় আনার জন্য, এক অর্থে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কখনো বন্দুক দেখিয়েছে, কখনো তাকে কোন এক অলীক শত্রুর সাথে লড়িয়ে দিয়েছে। আমি মানুষকে শ্রেণী বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে একটা সাধারন সমস্যার মুখে দাঁড় করিয়েছি মাত্র। দুশো বছর আগেকার সেই কুখ্যাত ইহুদি নিধনের থেকে সমস্যা হিসাবে অ্যাম্পসি যে অনেক…মানবিক সেটা অস্বীকার করবেন কি? বহু মানুষ আমার এই মত মেনে নিয়েছিলো ইমন, তারা স্বেচ্ছায় নিজের, নিজের পরিবারের নিজের সন্তানের দৃষ্টি বিসর্জন দিয়েছিল উন্নত জীবন, উন্নত সভ্য জীবনের আশায়। মানুষ ইসলাম গ্রহন করেছিলো। অন্ধত্ব বরণ করেছিলো। আর কোন প্রশ্ন আছে আপনার?’
‘আর এই ভাষা, শিক্ষা?’
মেহেদি উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসেন। এই অভিব্যক্তি দৃষ্টিহীন ইমনের অপরিচিত।
ইমন পাঁচিলে ভর দিয়ে মৃদু শ্বাস ফেলে। নিচে অসংখ্য অন্ধ্ব মানুষ তাদের স্বাধীনতা, সভ্যতার গর্বে মাথা উঁচু করে নগ্ন মিছিলে হেঁটে যায়। হঠাত ফোন বেজে উঠলে ইমন মেহেদি দুজনেই একটু চমকে ওঠেন। জিনির ফোন। ইমন সামান্য ইতস্তত করলে মেহেদি বলেন ‘ধরুন।হাসপাতাল থেকে। সুখবর আছে।’
‘মেয়ে হয়েছে।’ জিনি ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠে বলে। তোমার আসতে কতক্ষণ?’
‘দেখছি।’ বলে ইমন ফোন কেটে দেয়।
মেহেদি শান্ত গলায় বলেন ‘নিজেকে বঞ্চিত বলে মনে করার কারণ নেই ইমন। আপনি একটি ইন্দ্রিয়ের বিনিময়ে কি পেয়েছেন দেখুন, সুস্থ জীবন, সভ্য সুরক্ষিত সমাজ…আর আপনার কি প্রয়োজন?’
ইমন মেহেদির দিকে তাকায়, তাকে অপাঙ্গে নিরীক্ষণ করে। বলে
‘স্বাধীনতা।’
মেহেদি মৃদু হাসেন। বলেন ‘চলুন আপনাকে হাসপাতালে পৌছে দিই।’
‘আপনার রহস্য আমি ফাঁস করে দিই কিনা দেখে আসতে চাইছেন নিজে চোখে তাইতো?’
‘সেটা আপনি পরেও করতে পারেন। আপনি পণ্ডিত ইমন। বুদ্ধিমান। আপনি জানেন মানুষের বিশ্বাস মানুষকে সুরক্ষা দেয়, লালন করে। বিশ্বাস হীন মানুষ মৃতদেহের মত। তাই আল্লাহপাক আমাকে পাঠিয়েছেন। মানুষের মনে বিশ্বাস সঞ্চার করতে। সেই দৃঢ় বিশ্বাস ভেঙ্গে দেওয়ার মতো সাহস, নির্বুদ্ধিতা বা ক্ষমতা কোনোটাই আপনার নেই। চলুন, হাসপাতালে সবাই অপেক্ষা করবে।’

যখন ইমনের প্রক্সি কারে ইমন আর মেহেদি, পেছনে আরো দুটো গাড়িতে মেহেদির কিছু অনুচর হাসপাতালে পৌঁছল তখন ইমনের মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। ইমন বুঝতে পারে তার দেহ, মস্তিষ্ক নতুন ইন্দ্রিয়কে প্রত্যাখ্যান করছে। চেক কাউন্টারে ডান হাত তুলে ইমন বলল ‘শিরিন’। কোড স্ক্যানারে তার জি চিপ স্ক্যান হওয়ার কয়েক মূহুর্তের মধ্যে পাশে একটি প্রক্সি চেয়ার এসে বিপ শব্দ করল। মেহেদি কে কিছু বলতে হলোনা। তার জি চিপের নিশ্চই সমস্ত জায়গায় প্রবেশের অনুমতি আছে! ইমন আনমনে হাসে হঠাৎ। মেহেদির বা মেহেদির অনুচরদের জি চিপ নেই। আগে মানুষ ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের ওপর গবেষণাগারে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতো। তারা যাতে হারিয়ে না যায়, বা অনেকের মধ্যে সঠিক ইদুরটিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তাদের গলায় বিশেষ সেন্সর বেঁধে রাখা হতো। আজকে মেহেদির পরীক্ষাগারে ইমনের নিজেকে মনুষ্যেতর ইঁদুর মনে হতে থাকে। ঘেন্নায় ইমন মুখে চাপা শব্দ করে। বহু বছরের অনভ্যাসে মানুষ মনের ভাব মুখে ফুটিয়ে তোলা অপ্রয়োজনীয় মনে করেছে, ভুলে গেছে। মেহেদি আগে এগিয়ে যান। বোঝা যায় শিরিনের কক্ষ কোনটি তিনি জানেন। ইমনের নিজেকে অসহায়, প্রতারিত মনে হতে থাকে। কক্ষের একটু দূরে কয়েকজন মানুষের জটলা। ইমন বোঝার চেষ্টা করে জিনি কোনজন।পারেনা। দৃষ্টিহীন মানুষের নবলব্ধ দৃষ্টি অভিশাপের সামিল। ইমন হঠাৎ বলে
‘মেহেদি আপনি রেডিও শোনেন?’
‘সময় পাইনা। আগে সব সম্প্রচার আমার অনুমোদনে হতো, এখন সেক্রেটারি সম্প্রচারের দায়িত্বে আছেন।’
ইমন একটু বিপদে পড়ে, অর্থাৎ রেডিওর অধিকাংশ খবরই মেহেদির বা তার অনুচরদের তৈরি।
ইমন আর মেহেদি শিরিনের কক্ষে প্রবেশ করেন। জানলা হীন অন্ধকার ঘর। ইমন একটু স্বস্তি পায়। ইমন শিরিনকে দেখতে পায় আবছা অন্ধকারে। শিরিন তার সদ্যজাত মেয়ের সাথে কি খেলা করছে কে জানে। মেহেদি আর ইমন আরেকটু কাছে পৌছতেই শিশুটি কাঁদতে শুরু করল। ইমনের নিজেকে যেন ভারমুক্ত মনে হয়। সব খবর মিথ্যে নয়। এখনো আশা আছে তার মানে।
ইমন এই প্রথম মেহেদিকে স্পর্শ্ব করে কাঁধে হাত দিয়ে, যাতে শিরিন শুনতে না পায় তাই ফিসফিসিয়ে বলে
‘দেখলেন মেহেদি, দেখলেন? বাচ্চাটা কাঁদছে!’
‘চিন্তা করবেন না…সদ্যজাত শিশু…’
গন্ধ পেয়ে কাঁদছে মেহেদি। অচেনা মানুষের গন্ধ। শিশুরা অচেনা মানুষ পছন্দ করেনা।’
আস্তে আস্তে নিজের মাথা থেকে নাকের ওপর থেকে দৃষ্টিদায়ী যন্ত্রটি খুলে ফেলে ইমন। আরোপিত অন্ধকার তাকে আরাম দিচ্ছে দেখে ইমনের নিজের ওপরেই ঘেন্না হয়। যন্ত্রটা মেহেদির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে ‘আর কটা ছিদ্র বন্ধ করবেন মেহেদি? আর কটা অসুখ সারাবেন?’
মেহেদি উত্তর দেননা।

*

চিত্রণ: রু দাস

1 thought on “প্রিয় তমঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.