সুব্রতা দাশগুপ্ত
”ভানুর আব্দারেই গল্প বলা শুরু। কিন্তু সব গল্প তো আর ছয় বছরের ছেলেকে বলা যায়না! তাই এখানে …” -সুব্রতা
কনফেশন ডায়রী
এখন সকাল। খবরের কাগজের টুকরো পাকিয়ে কান খোঁচাচ্ছিল দিয়া। এরকম নানা জিনিস দিয়ে মুখ পরিষ্কার করা, দাঁত খোঁচানো, কান খোঁচানোটা দিয়ার বাতিক। বিশেষ করে চিন্তা করার সময়। আজকের চিন্তা বাবাকে নিয়ে। বাবাকে নিয়ে মানে বাবার তেইশ নম্বর বান্ধবীকে নিয়ে। শেফালিদি। শেফালিদি বাবার প্রথম দিককার ছাত্রী। বাড়িতেও নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল। কলেজের পড়া চুকিয়ে কোনও এক ছাপাখানায় প্রুফ রিডারের কাজ করে। বাবই জুটিয়ে দিয়েছে কাজটা। বারাসত অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া করে মা, আর মেয়ে থাকে। শেফালিদির বাবা নেই।
বাবার এই প্রেম রোগ অনেকদিনের। জীবনের নানা সময়ে অনেক মেয়ের প্রেমে পড়ছে। অনেক সময় লোকে ভেবেছে তিনি প্রেমে পড়ছেন কিন্তু আসলে তিনি পড়েননি। বাড়িতে প্রচুর অশান্তি হয়েছে। কিন্তু দিয়া মোটের উপর শান্তিতেই ছিল। কারণ বাবার কনফেশন ডায়রী। যেখানে বাবার সব প্রেমের ডিটেলটা দেওয়া থাকত। যেমন মৌসুমীদি প্রেমে পড়েছে বলে মা যখন ভীষণ অশান্তি করছে, তখন দিয়া বাবার ডায়রী পড়ে জানতে পারে যে বাবা আদৌ মৌসুমীদির প্রেমে পড়েনি। একদিন গাড়িতে লিফট দিয়েছিল মাত্র। সেটা সুশোভন কাকু দেখে মাকে লাগিয়ে ছিল আর পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় সন্তোষকাকুকে খবর দিয়েছিল। আর সন্তোষকাকু তো আকাশবাণীর ছোটভাই। খবরটা রটতে সময় লাগেনি। আমার বাবা যখন তৃণা বোসের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তখন বাড়িতে একটুও অশান্তি হয়নি কারণ খবরটা কেউ জানত না দিয়া ছাড়া। বাবার ডায়রীটা এই সব সময়েই কী করে দিয়ার হাতে এসে পড়ছে সেটা একটা রহস্য। এমনি করে বাবার বাইশটা প্রেমের কিনারাই দিয়া করতে পেরেছ। বাবা কোথায় গেছে, কী কী জিনিসপত্র দিয়েছে কেন প্রেমে পড়ল, কেন প্রেম ঘুচল সবই জলের মতো পরিষ্কার। কিন্তু এবার শেফালিদির ব্যাপারটা কিছুই জানা যাচ্ছে না। ডায়রীর পাতা ফাঁকা।
শেফালিদির সঙ্গে বাবার প্রেম ব্যাপারটা এতটাই অবাস্তব যে রহস্য আরও বেড়েই চলেছে। এখানে শেফালিদির রূপগুণের কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। শেফালি ঘোষের বয়স তিরিশ–একত্রিশ বছর। উচ্চতা চার ফুট নয় ইঞ্চি। ওজন আশি কেজি। গায়ের রঙ ফ্যাকাশে গোছের কালো, দাঁতের সেটিংটা অদ্ভুত, বর্তমানে মাথার চুল কমে যাওয়ায় বব ছাঁট। ফোনে গলার স্বর শুনলে ছেলে না মেয়ে গুলিয়ে যেতে পারে। পড়াশুনায় মাঝারি। বাবার নোট পড়ে অনার্সটা রাখতে পেরেছে আর কি। আর গুণ বলতে প্রচণ্ড খাটতে পারে। মোট বইতে পারে। দু’বস্তা বই নিয়ে একদিনে বারাসত থেকে বেহালা সোদপুর থেকে বারুইপুর করতে পারে। বাড়িতে একমাস কাজের লোক না এলেও কুছ পরোয়া নেই। দশ–বারোটা আলমারির হাজার পাঁচেক বই ঝেড়ে পুঁছে গুছিয়ে রাখতে ঘণ্টা খানেকের বেশি সময় লাগে না। আর সবচেয়ে ভাল গুণ হল খুব ভাল রান্না করতে পারে। বিশেষ করে রুগীর পথ্য। বাবার যখন জন্ডিস হয়েছিল তখন মাস তিনেক ধরে শেফালিদির বাড়ি থেকে নানা রকমের খাবার আসত। এসব গুণের জন্য বাবা প্রেমে পড়তেই পারে। কিন্তু কনফেশন ডায়রীর পাতা ফাঁকা কেন?
দিয়ার আর ভালো লাগছে না। শোনা যাচ্ছে বাবা নাকি শেফালিদির নামে বারাসতের কাছে একটা ফ্ল্যাট বুক করেছে। ভারী অদ্ভুত। বাবা আজ অবধি তার প্রেমিকাদের বই, পেন, চাবির রিং, ফোটো ফ্রেম, কমদামী পারফিউম, সফট টয় ছাড়া কিছুই কিনে দেয়নি। একেবারে ফ্ল্যাট বুক করাটা খুব আশ্চর্য। মা রোজ সকালে মিনতিদির কাছে বাবার নামে যা–তা বলছে। মিনতিদি বাবার টিফিনের লুচির ময়দা মাখতে মাখতে ‘কী করবে বলো বৌদি? মন শক্ত করতেই হবে’, গোছের কথা বলে চলেছে। তারপরই বাবা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মা ফোঁৎ ফোঁৎ কান্না সহযোগে বাবাকে খেতে দিচ্ছে আর লুচি তরকারি মিষ্টি ফল সমেত টিফিন গোছাচ্ছে। এটা আরও অসহ্য। এরকম অবস্থায় কয়েকদিন আগে দিয়াকে পড়তে হয়েছে বটে। কিন্তু তখন দিয়ার কোনও টেনশন থাকত না। কারণ সে সবই জানত। এবার আর পারা যাচ্ছে না। কাল আবার জয়ন্তকাকু এসে খবর দিয়েছে বাবা নাকি ব্যাঙ্ক থেকে দাদুর দেশের বাড়ি বিক্রির অর্ধেক টাকা শ্রীমতি শেফালি ঘোষের নামে ট্রান্সফার করে দিয়েছে। জয়ন্ত কাকুর ব্যাঙ্কেই আবার অ্যাকাউন্ট। তাই অবিশ্বাস করার কিছু নেই।
দিয়ার মনে হচ্ছে এবার একটা কিছু করা দরকার। শেফালিদির কাছে যাবে? শেফালিদির ছাপাখানা কলেজ স্ট্রিট পাড়ায়। দিয়া আগে অনেকবার গেছে। ঠিক দুটোয় টিফিন টাইমে টোস্ট আর ঘুগনি খেতে বেরয়। তখন দেখা হতেই পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো কী–দু’টোর সময় ছাপাখানার অফিসের সামনে যখন শেফালিদির সঙ্গে দেখা হল তখন শেফালিদিই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগল– ‘বাবা কেমন আছেন? মা কেমন আছেন? পড়াশুনা কেমন চলছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকদিন দেখা হয় না, কবে হবে ঠিক নেই কাজের খুব চাপ, সামনেই বইমেলা–এসব বলে দুঃখ করতে লাগল। তার মানে বাবার সঙ্গে শেফালিদির দেখা হয় না। এ কেমন প্রেম?
এতদিন ধরে কনফেশন ডায়রী থাকার সুবাদে বাবাকে ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞাস করার অভ্যাসটাই তৈরি হয়নি। মাসের প্রথমে হাত খরচা নেওয়া, পুজো বা জন্মদিনে আগে উপহারের টাকা পাওয়া, বন্ধুদের সাথে বাইরে বেড়াতে যাওয়ার আগে পারমিশন– এছাড়া টুকিটাকি দরকারি কথা ছাড়া বাবার সাথে কথাই হয় না। বাবার পড়ানো, টিউশন, বইলেখা, খাতা দেখার ফাঁকে সময় কোথায় কথা বলার? মার সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলতে যাওয়া বিপদ কারণ মা ডায়রীর কথা জানে না। মানে দিয়া বলেনি কখনও। বলতে পারেনি আর কী। প্রতিবারই বাবার এক একটা প্রেম শুরু হবার পর আশ্চর্যভাবে ডায়রীটা দিয়ার হাতে আসে। প্রেম ঘুচলে হাওয়া হয়ে যায়। এবারও হাতে এসেছে কিন্তু কিছুই লেখা নেই।
এভাবেই দিন কাটছে। বাবার সঙ্গে শেফালিদিকে নিয়ে অনেক গল্প কানে আসছে ঠিকই কিন্তু ওদের দু’জনকে একসাথে কেউই দেখতে পাচ্ছে না। বারাসতে শেফালিদির পাড়াতেও খোঁজ নিয়ে দিয়া জেনেছে যে বাবা সেখানেও যায় না। নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশও যায়নি। বাবার কলেজে শেফালিদি যায় না, শেফালিদির ছাপাখানাও বাবা যায় না, কফি হাউস, সিটি সেন্টার, নলবন, গঙ্গার ঘাট, নন্দন, বইমেলা কোথাও দু’জনকে একসাথে দেখা যাচ্ছে না।
এমনি করে দু’একটা বছর কেটে গেছে। বিএ পাশ করে দিয়া ঝাড়া হাত–পা ঘরে বসে আছে। রেজাল্ট বেরোতে দেরি আছে। শেফালিদিকে নিয়ে গুজব আস্তে আস্তে কমে এসেছে। যদিও ডায়রীর পাতায় একটি আঁচড়ও পড়েনি । আজ রবিবার। বাবা বাড়ি নেই। মাও বেরোবে বলেই তৈরি হচ্ছে। কোথও একটা নিমন্ত্রণ আছে। দিয়াকে ভাগ্যিস যেতে হবে না সেখানে। ভালই হল। দিয়া কতগুলো বই খুঁজে পাচ্ছে না। বাবার ঘরে প্রচুর বই। তার সঙ্গে মিশে গিয়ে থাকতে পারে। বাবার ঘরে বইপত্র একটা সময় শেফালিদি গোছাতো। তারপর অনেকদিন ওর উপর ঝাড়াঝাড়ি ছাড়া আর কিছুই হতো না। ইদানিং মিনতিদির মেয়ে মাঝে মাঝে গোছায়। তবে তাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সে নিরক্ষর।
অনেকদিন পর বাবার ঘরে এল দিয়া। বাবার ঘর না বলে বইয়ের ঘর বলা ভাল। প্রায় পনেরোটা আলমারি আর ছ’টা ড্রয়ারওয়ালা একটা টেবিল –প্রচুর ফাইল, পরীক্ষার খাতা, কাগজপত্র আর বইয়ে ঠাসা। বাবার বসার চেয়ারটা আর দু’একটা চেয়ার ছাড়া ফাঁকা জায়গা কিছু নেই। কোথা থেকে শুরু করা যায়? আলমারির পাল্লাগুলো কাঁচের, বইয়ের নাম দেখা যায়। সেটা দিয়েই কাজ শুরু করা ভাল। এগারোটা আলমারি দেখার পর দিয়া ক্ষান্ত দিল। প্রায় চারটে বাজে। এবার ড্রয়ারগুলো দেখা যাক।
বই পাওয়া গেল না। কিন্তু যেটা পাওয়া গেল তার জন্য দিয়া প্রস্তুত ছিল না। একটা পুরানো ডায়রী। দাদুর। দাদু হাতের লেখা চিনতে অসুবিধা হয়নি। দাদু ছোটবেলায় তার সঙ্গে অঙ্কে মজার মজার খেলা খেলত, ছড়া লিখে দিত। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা টাকা–পয়সার হিসেব। তারপর লেখা শুরু। এটাও কী কনফেশন ডায়রী?
মায়া ঘোষ কে? আরে–মায়া ঘোষ তো ঠাকুমার আয়া ছিল? ঠাকুমার কাছে সে গল্প শুনেছে। ঠাকুমার কী একটা অপারেশন হয়েছিল। বাবার তখনও বিয়ে হয়নি। ঠাকুমাকে দেখাশোনা আর ঘরের টুকটাক কাজের জন্য এসেছিল মায়া ঘোষ। ঠাকুমাকে নাকি খুব যত্ন করত। অনেক কাঁথাও বানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এর কথা দাদুর ডায়রীতে কেন?
মায়া ঘোষ হঠাৎ কাজ ছেড়ে দিল। বাড়িতে খুবই মুশকিল। তবে সে আর ফিরে এল না। কারণ তার বাচ্চা হবে। কিন্তু মায়া ঘোষের তো বিয়েই হয়নি।
পরের পাতায় আবার টাকার হিসেব। হাসপাতালের খরচ। মায়া ঘোষের মেয়ে হওয়ার সব খরচ দাদু দিয়েছেন। বারাসতের বাড়িভাড়ার টাকা মাসে মাসে দাদুই দেন। মেয়ের লেখাপড়ার খরচ দাদুরই।
মায়া ঘোষ আর এল না। কিন্তু তার মেয়ে এল। শেফালি ঘোষ। বাবার কাছে পড়তে। দাদুকে চিনতে পারেনি। কিন্তু মারা যাওয়ার আগে দাদু চেয়েছিল যাতে শেফালি তার বাবাকে চিনতে পারে এবং নিজের প্রাপ্য বুঝে নেয়। তাই এই কনফেশন ডায়রী। ছেলে মেয়ে দু’জনকেই পড়াবার জন্য। বাবার ডেস্কেই পাওয়া যায়। শেফালিদিই বই গোছানোর সময় দেখতে পেয়ে বাবাকে দিয়েছে হয়তো। বাবা সেটা দিয়াকে দেয়নি কখনও।
পরের পাতায় আবার হিসেব। তবে এবার আর দাদুর হাতের লেখা নয়। বাবা লিখছে–দাদুর দেশের বাড়ি বিক্রির টাকার হিসেব। শেফালি ঘোষের নামে যা যা ট্রান্সফার করা হয়েছে। তার হিসেব। কিন্তু এই হিসেবগুলো বাবা নিজের ডায়রীতে লিখল না কেন? নিজের কথা মেয়ের সামনে সহজেই তুলে ধরতে পারলেও বাবার কথা বোধহয় কেউ বলতে পারে না।
কয়েকদিন আগে শেফালিদির বাড়ি ঘুরে এল দিয়া। শেফালিদি নয়, শেফালি পিসি। শেফালি পিসির ব্যাপারটা মাকে বলেছে দিয়া। মাকে অনেকদিন পর বেশ খুশি খুশি লাগছে। সকালে মিনতিদির কাছে বাবার গুণগান করছিল। সম্পত্তি দান করা কি মুখের কথা? বাবা না দিলে শেফালিদি কি জোর করে নিতে পারত? ইত্যাদি। মিনতিদি ময়দা মাখতে মাখতে বলছে, ‘বলেছিলাম না বৌদি, মন শক্ত করো। দেখলে তো?’
Asadharan! Khub bhalo laglo.
Amar barite je Diya achhe take paralam. Eti idaning kaler ekti onyotomo shrestho chhoto golpo.
golpo ta onubad korlam. onek dhonnobaad subrata dasgupta ebong aainanagar er shompadok mondoli ke: http://humanitiesunderground.wordpress.com/2013/12/01/confessional-diary/
Amar galpo ta onubaad korar jonno anek dhonnobaad.Anubad ta bhalo hoyechhe.
asadharon concept…. chaliye jan ma’am
vison valo..onnorokom but khub realistic !!
Khub bhalo hoechhe. Bonophul gharanar uttarshuri !!
onyorokom… besh laglo. style-ti attractive.
গল্প ভালো লেগেছে। আমি চলচ্চিত্র পরিচালক। মূলত ছোট ছবি নিয়ে কাজ করি। আপনার গল্প নিয়ে কাজ করতে চাই। রাজী হওয়া না হওয়া একান্ত ব্যক্তিগত। তবে মেইল করে অথবা ফোনে জানালে বাধিত থাকবো। ৮৫৮৩০৮৮১৮৮
Apnar mail id-ta pathaben. Amra lekhok-ke janiye dicchi. Onek dhonyobad.