রীতা ব্যানার্জি‌
(লেখকের ব্লগ থেকে পুনর্মুদ্রিত)

রীতা ব্যানার্জির জন্ম ১৯৫৩ সালে। বেথুন স্কুল থেকে ১৯৭০ সালে হাইয়ার সেকেন্ডারী পাশ করে লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কলেজ ছেড়ে ৭০ দশকের আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী মাসে জেলে যান। ১৯৭৭ সালের শেষ ভাগে বন্দী মুক্তি আন্দোলনের  ফলে ছাড়া পান। পবরবর্তী কালে B.A পাশ করে  ভবন কলেজ অফ ম্যানেজমেন্ট এন্ড জার্নালিজম থেকে জার্নালিজমে ডিপ্লোমা নেন। বিভিন্ন N.G,O তে কাজ করেন আর পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখি শুরু করেন, কিন্তু সেখানে নানা দুর্নীতি দেখে সরে আসেন। ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মের সাথে যুক্ত থাকেন। বর্তমানে  ব্লগ ও ফেসবুকে তাঁর নিজের জীবনে যা কিছু দেখেছেন ও অনুভব করেছেন সেগুলি গল্প কবিতা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ করেন।

মীরা ছিল কুমারী মা।  আর একদিকে সে ছিল স্পেশাল চাইল্ড। ছিপছিপে লম্বা শ্যামলাবরণ রোগা মেয়েটির ডাগর ডাগর চোখ দুটি যেন কথা বলত। অতি সাধারণ সহজ সরল মুখখানিকে যেন অসাধারণ করে তুলেছিল তার চোখ দুখানি। শিশুর মত নিষ্পাপ চোখ দুটিতে অদ্ভুত একটা দ্যুতি ছিল, সবাইকে কাছে টানত। মাতৃত্বের গর্ব ছিল সেই চোখদুটিতে, সেই সঙ্গে মমতার বৃষ্টি ঝরত, সদাই আনন্দের বন্যা বইত। কিন্তু সেই চোখের সতর্ক দৃষ্টি অতন্দ্র প্রহরীর মত সজাগ থাকত তার কোলের হাড় জিরজিরে সন্তানের দিকে।
**************
তখন সত্তরের দশক।  কলকাতার কোনো এক বস্তিতে মীরা থাকত। পরিবারে বাবা মা ছাড়া চারটি মেয়ে ছিল। মীরা সবচেয়ে ছোট ছিল, তার বয়েস তখন বারো। বাবা ঠেলা চালাতো। মা লোকের বাড়ীতে বাড়ীতে ঠিকে কাজ করতো। বড় দুই বোনেরাও মায়ের সঙ্গে কাজ করতো। মীরা তার পিঠোপিঠি দিদিকে ঘরের কাজে সাহায্য করতো ,জল আনা, বাসন মাজা, রান্নার কাজে যোগান দেওযা। কাজ সারা হলে দুই বোন খেলা করতো — কুড়িয়ে পাওযা কৌটোর মুখ, বোতলের ছিপি বা বাবুদের বাড়ীর  মেয়েদের পরিত্যক্ত পুতুল নিয়ে। কখনো বা বস্তির অন্য বাচ্ছাদের সাথে লুকোচুরি, কানামাছি। মোটের উপর মীরা ভালই ছিলো কঠিন দারিদ্রের মধ্যেও। লোকে অবশ্য তাকে বোকা হাবা বলতো।  সবাই তাকে হাবলী বলে ডাকতো। তাতে তার কোনো হেলদোল ছিলোনা। পরিবারে মধ্যে তাকে সবাই বিশেষ স্নেহ করতো।
কিন্তু বিধি বাম। অকস্মাৎ চরম বিপর্যয় ঘনিযে এলো মীরার ছোট্ট জীবনে। বস্তিতে একটা ঘরে ভাড়া থাকত একজন অবসর প্রাপ্ত জওয়ান। বাচ্ছারা সবাই তাকে কাকা বলে ডাকতো। একদিন মীরা একাই নিজেদের ঘরের সামনে বসে পুতুল খেলছিলো। বাড়ীর সবাই কাজে গেছে, মীরার সেজদিদি ঘরের মধ্যে কাজ করছিলো। বস্তির বেশীর ভাগ লোকজন কাজে গেছে বা ঘরের কাজে ব্যস্ত।
এমন সময়ে বস্তির বাচ্ছাদের সেই জওয়ান কাকা সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো। মীরাকে দেখে সে দাঁড়িয়ে যায়, “কিরে হাবলী পুতুল খেলছিস? তা তোর্ পুতুলের হাত-পা নেই কেন? ভেঙ্গে ফেলেছিস?” “না, মা বাবুদের বাড়ী থেকে ওমনি-ই এনেছে। হাত-পা ভেঙে গেছে বলেই না দিয়েছে, তাই তো আমরা পুতুলটা পেয়েছি।” “তোরা মানে কারা? ভারী একটা ভাঙা পুতুল ,তাও আবার কজনের ভাগ?” “কেন আমি আর আমার সেজদিদি।” “তুই আমার কথা শুনলে, আমি  তোকে একটা নতুন গোটা পুতুল কিনে দেবো।  শুনবি কথা?” কাকা প্রলোভন দেখায়। মীরাও নতুন গোটা একটা পুতুলের আশায়ে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। বলে, “কি কথা? সত্যি বলছো নতুন পুতুল দেবে? বল, আমি শুনবো।”
“চল তবে আমার ঘরে , আমি যা বলবো তাই করলে, নতুন পুতুল পাবি।”

কাকার সাথে মীরা তার ঘরে যায়। তারপর যা হবার তাই হয়, কাকা তাকে ধর্ষণ করে। অবোধ, শিশুর মতো মন নিয়ে মীরা বুঝতেও পারেনা কি ক্ষতি তার হয়ে গেলো। সে হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে ,শুধু শরীরে একটা যন্ত্রনা বোধ করে। “কাউকে বলবি না, নাহলে পুতুল পাবিনা।” “কিন্তু আমার এত ব্যথা করছে কেন?” “ওটা কিছু না , একটু পরে কমে যাবে। আজকেই বিকেলেই তোকে পুতুল এনে দেবো। বিকেলে আসিস ,কাউকে কিছু বলবিনা কিন্তু।” কাকা শাসায়। “ঠিক আছে কাউকে কিছু বলবো না। কিন্তু গোটা একটা নতুন পুতুল চাই”, বলে মীরা ঘরে চলে আসে।
বিকেল বেলায় আবার যখন বস্তির বেশীর ভাগ মেয়ে বউরা কাজে চলে যায় বা ঘরের কাজে ব্যস্ত , সেই কাকা মীরাকে ডেকে একটা নতুন পুতুল দেয় আর সেই সঙ্গে আর এক প্রস্থ ধর্ষণ চলে। রাতে বাড়ীর সবাই ঘরে ফেরে। মীরার মা দেখে মীরা একটা নতুন পুতুল আঁকড়ে ধরে অবসন্নের মতো শুয়ে গোঙাচ্ছে, বিছানা ভিজে গেছে রক্তে। বস্তি ভেঙে লোক জড়ো হলো ঘরের সামনে, পাড়ার ডাক্তার ডাকা হোলো। তিনি মীরার বাবাকে অসুস্থতার কারণ বুঝিয়ে বললেন, সেই সঙ্গে থানায় ডায়েরি করতে ও  হাসপাতালে ভর্ত্তি করার পরামর্শ দিলেন। তাই করা হলো।
হাসপাতালে সুস্থ হয়ে হয়ে উঠলে মীরার মা তার কাছ থেকে নতুন পুতুল পাওয়ার রহস্য আবিস্কার করলেন। দোষী কে নির্দিষ্ট করা গেল। বস্তিবাসী মিলে উত্তম মধ্যম দিয়ে, পুলিশের হাতে তুলে দিলেন। মীরা সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে কোর্টে তোলা হলো। অবশেষে রেপ ভিক্টিম হিসাবে তার স্থান হলো জেল হাজতে। কয়েকটা কোর্ট ডেটের পর দোষী জামিনে ছাড়া পেয়ে  গেলো। কিন্তু মীরা পড়ে রইল সেই অন্ধকুপে। আইনের কি অদ্ভুত পরিহাস!
তখন সাধারণত  আইনগত ভাবে রেপ কেসে রেপ ভিক্টিমকে সেফ কাস্টোডি হিসাবে সরকারি তত্তাবধানে জেল কাস্টোডি বা লিলুয়াহোমে (যেটা জেল এর নামান্তর) রাখা হতো,  যাতে রেপ ভিক্টিমের কেউ ক্ষতি করতে না পারে — সেই যুক্তিতে। অবস্থাপন্ন মানুষেরা যে সিকিওরিটি দিতে পারতো, গরীব মানুষদের পক্ষে তা সম্ভব হতোনা। তাদের পক্ষে আইনের মারপ্যাঁচ বোঝাও অসম্ভব। সঠিকভাবে পরিচালনা করার কেউ থাকতনা। অন্য দিকে দোষ প্রমান না হওয়া পর্য্যন্ত দোষী ব্যক্তি অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত হয়না। জামিন যোগ্য ধারায় ধরলে, জামিন পাওয়ার সুযোগ থাকে। তাই বাদীপক্ষ প্রভাব প্রতিপত্তিশালী না হোলে দোষীর পক্ষে জামিনে বার হওয়া কঠিন হয়না। তাই অত্যাচারিতাকে অশেষ দূর্ভোগ সইতে হয়। মীরা এই ব্যবস্থার শিকার হলো।
মীরার পরিবারের পক্ষে পয়সা দিয়ে উকিল রাখা সম্ভব নয়। তারা পুরোপুরি সরকারি খরচে যে উকিল নিযুক্ত হয  তার উপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হলো । এমনকি নিয়মিত কেসের দিনে কোর্টে হাজির থাকতেও পারতনা। এসব ক্ষেত্রে অসৎ উকিলরা দোষী ব্যক্তির  সাথে বোঝাপড়া করে কেসকে প্রভাবিত করতো । ঢিমে লয়ে কেস চলতে থাকলো, ধর্ষণকারী ঘুষ দিয়ে এই ব্যবস্থা করলো। এতসব মীরার বোধের অগম্য। সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বাড়ী যাবার জন্য।
প্রথমে জেলে এসে হকচকিয়ে গেল মীরা। সারা দিন কটা বড় ঘরে গাদাগাদি করে সবাইকে থাকতে হয়। ঘরের কোণে ছোট পাঁচিল দিয়ে ঘেরা জায়গাতে প্রাকৃতিক ক্রিয়া সারতে হয়। দুর্গন্ধে পেটের নাড়ী উলটে আসে। দুই বেলা কয়েক ঘন্টার জন্য দরজা খোলা হয়।মানুষের অযোগ্য খাবার । তবু ক্ষুধার্ত মানুষগুলি গোগ্রাসে তাই গলাধঃকরণ করে। সারাদিন কয়েকজন বন্দিনী আর ওয়ার্ডা‌র একে তাকে মারছে, শাসাচ্ছে। শান্তি নেই এতটুকু। ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে সবাই। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই বেধড়ক অত্যাচার।
সারাদিন মন গুমরে থাকতো মীরা। বাড়ি যাবার জন্য কাঁদত। কোথা থেকে কি হয়ে গেলো। সে তো কোনো দোষ করেনি। বরং কাকাটাই তো তাকে ব্যথা দিযেছে। সে দিব্যি ছাড়া পেয়ে গেল। আর সে পচছে এই নরকে। বাড়ীর লোক মাঝে মধ্যে দেখা করতে এলেই বাড়ী যাবার জন্য বায়না করতো। বাবা মা বুঝতো “শোন মা,  উকিল বলেছে যে কেস মিটে গেলেই, ওই পাজিটার শাস্তি হয়ে যাবে, তখন তুইও ছাড়া পেয়ে বাড়ী যেতে পারবি, আমরাও তোকে বাড়ী নিয়ে যেতে পারবো। ততদিন একটু কষ্ট করে তোকে এখানেই থাকতে হবে, নাহলে ওই লোকটা আবার নাকি তোর ক্ষতি করতে পারে।”
**************
কিছুদিন পরই বোঝা গেলো মীরা সন্তানসম্ভবা।  কালক্রমে মীরা একটি ছেলের জন্ম দিলো। পরিবারের সকলের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ, একমাত্র মীরার কোন চিন্তা নেই। অবোধ শিশুর মতো মন তার। কতবড় অন্যায় অবিচার তার উপর হয়ে গেছে, সেটা বোঝার বুদ্ধি তার নেই। বরং সে যেন খুশীতে ডগমগ, একটা ছোট্ট বাচ্চা পেয়ে। এতদিন সে সবাইয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল, এখন একটা অসহায় ছোট্ট মানুষ একমাত্র তারই উপর সম্পূর্ণ  ভাবে নির্ভরশীল। ছোট্ট হাতটা তার কাপড়ের খুঁটটা মুঠি করে ধরে থাকে, কোলে শুয়ে ছোট ছোট পা-দুটো ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলা করে। ক্ষিদে পেলে তারস্বরে চেঁচাতে থাকে, মায়ের বুকের কাছে মুখ ঘষতে থাকে, মায়ের বুকের দুধে পেট ভরে গেলে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
মীরার মনে হয় এই ছোট্ট মানুষটা একমাত্র একান্ত ভাবেই তার নিজের জিনিস, তার নিজের পরিচয়,তার অস্তিত্বের সার্থকতা। জীবনে একান্ত নিজের বলে তার তো কোনদিন কিছুই ছিল না। পুরানো ছেঁড়া জামা কাপড় তাপ্পি মেরে বোনেরা ভাগাভাগি করে পরেছে। কুড়িয়ে পাওয়া বোতলের ছিপি, কৌটোর মুখ, হাত-পা ভাঙা পুতুলও ভাগাভাগি করে খেলেছে। এক বালিশে দুই বোনে মাথা দিয়ে শুয়েছে, ছেঁড়া কাঁথা বোনেরা মিলে ভাগ করে শীত নিবারণ করেছে।
একটা নতুন গোটা পুতুল পেতে গিয়ে কী শারীরিক যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, জীবন ওলট পালট হয়ে গেছে,পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে এক অদ্ভুত জগতে এসে পড়েছে। আজ যেন সে পুতুলের চেয়েও সুন্দর একটা জলজ্যান্ত ছোট্ট বাচ্চা পেয়েছে। যাকে কেউ দাবি করতে পারবেনা।
সারাদিন বাচ্চাটাকে কোলে  নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সবাইকে দেখিয়ে বেড়ায়। তার সহবন্দিনীরা যখন বলে “তোর ছেলেটা খুব সুন্দর হযেছে রে “, মাতৃগর্বে মীরার বুক ভরে ওঠে। জেলে স্পেশাল চাইল্ডদের নন ক্রিমিনাল লুনাটিক হিসাবে দেখা হতো, তাদের জন্য স্পেশাল ডায়েটের ব্যবস্থা ছিল, তাছাড়া সদ্যজাত প্রসূতি হিসাবে সেই স্পেশাল ডায়েট পাবার কথা তার। জেলের দালাল কিছু বন্দী অন্য বন্দীদের খাবার চুরি করে, তার বিনিময়ে ওয়ার্ডা‌রদের দিয়ে নিজেদের সখের জিনিসপত্র আনায়।
তাই মীরার প্রাপ্য খাবারের অনেকটাই বেহাত হয়ে যেত। দালাল কয়েদীদের নানা কাজ করে, তাদের হাতে পায়ে ধরে বাচ্চার জন্য দুটো জামা যোগাড় করেছিলো। নিজে কম খেয়ে সেই খাবারের বিনিময়ে বাচ্চার জন্য একটা গরম জামার ব্যবস্থা করলো। বয়স্ক বন্দিনীরা কত বোঝাত “তুই পোয়াতি মা,বাচ্চা বুকের দুধ খায়, তোর পেটভরে না খেলে শরীর ভেঙে পড়বে। তখন কে দেখবে তোর ছেলেকে?”, উত্তরে মীরা একমুখ হাসি ছড়িয়ে দিতো।
প্রথম প্রথম বাচ্চাকে কারো কাছে রেখে স্নান ইত্যাদি করতে যেতেও ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতো, যেন হারিয়ে যাবে। কোনমতে কাজ সেরে ফিরে আসত। ক্রমে সহ বন্দিনীদের কয়েকজনের উপর তার আস্থা জন্মালো। তাদের কাছে রেখে যেতো। তবুও যতক্ষণ পারতো কোলছাড়া করতনা তার হারানিধিকে। কেউ কেউ তাকে ক্ষ্যাপাত, “ও মীরা সবাইয়ের বিয়ে হলে বাচ্চা হয়, তোর তো না বিয়ে করেই বাচ্চা হয়ে গেলো। এখন তুই কি করবি?” “কেন ,ভালোই তো হলো। বিয়ে হলে বাবা, মা আর দিদিদের ছেড়ে চলে যেতে হতো। আমাকে আর বাড়ী ছেড়ে যেতে হবেনা। অথচ একটা বাচ্চা আমি ঠিক পেয়ে গেছি” খুশিতে ঝলমল করে উঠতো তার সরল, শ্যামলা মুখ।  দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেলো। মীরা অপেক্ষা করে, কবে ছেলে নিয়ে তার বাড়িতে, পরিবারের মাঝে ফিরে যাবে।
*********************
ইতিমধ্যে ধর্ষণকারী  বস্তি ছেড়ে কোথায় উধাও হয়ে গেলো, পুলিশের তরফ থেকে তাকে খোঁজার জন্য কোনো তত্পরতা দেখা গেলোনা। মীরার পরিবার বাচ্চা সমেত আইবুড়ো মেয়েকে বাড়ী নিয়ে আসতে সঙ্কুচিতবোধ করতে লাগলো। তারা লোকলজ্জার ভয়ে কালক্ষেপন করতে থাকে। মীরা তাদের প্রতীক্ষায় থাকে। অবশেষে একদিন তার সব স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেলো। বুঝতে পারলো বাড়িতে আর স্থান হবেনা — তার এবং তার বাচ্চার।
অবশ্য তার বাবা-মা বার কয়েক এলো। বারবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, “দ্যাখ মা, তুই তো আমাদের অবস্থা জানিস। ওই শয়তানটা তো পালিয়েছে। আর কোনো সুরাহা হবার কোন আশা নেই। তুই চাইলে আমরা তোকে শুধু বাড়ি নিয়ে যাবো, বাচ্চাটাকে তোর ছাড়তে হবে। এমনিতেই আমরা মরলে, তোকেই দেখার কেউ থাকবেনা। তোর বাচ্চাকে কে দেখবে?”
মীরা বুঝতে পারে, এই সংসারে  হিসেবটা তার মতো সরলরেখায় চলে না। শুধু বোঝেনা তার আর তার বাচ্চাটার কি দোষ। তবুও একটু ভেবে দৃঢ় গলায় বলে “যদি আমাকে দেখার কেউ না থাকে, তবে আর কি। আমি এখন আমার ছেলেকে দেখবো, আর আমার ছেলে বড় হয়ে আমাকে দেখবে। এখান থেকে বার হলে আমরা দুজনে বার হবো, নয়তো দুজনেই এই কালকুঠুরিতে মরবো। তোমাদের আর আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা।”
“শোন মা , তুই কুমারী মেয়ে মা হয়েছিস দেখলে, তোর দিদিদের কেউ বিয়ে করবেনা। বাচ্চাটকে সঙ্গে নিয়ে সকলে আমাদের একঘরে করে রাখবে, সেগুলি কি তোর ভালো লাগবে?”
“না ,আমার ভালো লাগবে না, কিন্তু আরও বেশী খারাপ লাগবে আমার ছেলেকে ফেলে যেতে, ও তো আমাকে ছাড়া কিছু বোঝেনা, আমি ছাড়া ওর কেউ নেই, আমি তো ওর মা। তোমরা চলে যাও,পারলে মাঝে মাঝে দেখা করে যেও। না আসতে পারলেও কিছু নেই। আমি আমার ছেলে নিয়ে এখানেই থাকবো। ভাগ্যে যা আছে আমাদের দুজনের তাই হবে। তাতে আমি ভয় পাইনা। কিন্তু আমার ছেলে ফেলে আমি পালিয়ে যাবোনা।”
মীরার বাবা মা অবাক হয়ে মেয়ের কথা বার্তায়, মনে  মনে ভাবেন ,এইকি তাদের সেই হাবলী! কত পরিণত কথা, কত মনের জোর, কত নিঃস্বার্থ বিবেচনা বোধ! ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে পা বাড়ান।  কিন্তু একটা সভ্য সমাজের বুকের উপর একটা অসহায় অবোধ মেয়ের উপর যে নির্মম অত্যাচরের খাঁড়া নেমে এলো সে বোধ মীরার ছিলনা। লোকলজ্জার উর্দ্ধে‌ উঠে মেয়ের পাশে দাঁড়াবার সাহস মীরার পরিবারেরও ছিলো না। তাই ন্যায় অন্যায় সব কিছু সম্পর্কে উদাসীন মীরাকে তার ছেলে নিয়ে ফিরে যেতে হয় তার সেই কালকুঠুরিতে।

3 thoughts on “জেলখানায় মা মেরী

  1. কেমন একটা দমবন্ধ লাগে। লেখাটার জোরের জায়গাটা এটাই যে কোনও ন্যাকামি নেই। বেশি বকাও নেই। অদ্ভুত ভাল লেখা। কিন্তু পড়ে ভয়ানক কষ্ট হয়। একটা অসহায় কষ্ট। কেন এরকম হয়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.