মৈত্রেয়ী সরকার

২৪ পরগণার এক মফস্বল শহরে বড় হয়ে ওঠা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনো। আপাতত বাংলা ছোট গল্পে কৃষক বিদ্রোহ ও কৃষক আন্দোলন নিয়ে গবেষণা চলছে। পেশায় দমদম মতিঝিল কলেজে বাংলা বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর ও নানা ইন্সটিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্ট লেকচারার। লেখার চর্চা ছোটবেলা থেকে – কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হয়েছে নানা পত্রিকায়, নিয়মিত লেখা চালু এখনও – কথা সাহিত্য, আরম্ভ, অহর্নিশ, শিলালিপি, কবিজন্ম ও আরও নানা পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্য পীরের পাঁচালি – মধ্য যুগের ভিন্ন স্বর, বাংলা ছোটগল্প – নানাস্বরের কোলাজ, বাংলা উপন্যাস বহুবর্ণ বহু ছটায়, সময়ের পরিপ্রেক্ষিত ও বাংলা ছোটগল্প। বর্তমানে রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা নিয়ে বইয়ের কাজ চলছে।

রিমঝিম রিমঝিম সুরে বুন্দ বুন্দ বৃষ্টি ঝড়ে পড়ছে মাটি-পৃথিবীর বুকে। সোঁদা মাটির মধুর গন্ধে মুখরিত আকাশ বাতাস। ‌‘পিয়া মিলন কি দিন আ গ্যায়ে’ ডাকে ডাহুক, ডাকে শিখি পেখম মেলে। কচি সবুজ লেবুর পাতা সদ্য নবীন বৃষ্টির জল পেয়ে মেলেছে তার প্রথম দুটি ডানা। আজ সারাদিন ধরে ঝরে অঝোর ধারা। মেঘ মল্লারের সুর বেজে ওঠে আকাশে বাতাসে। মেঘদেবী তার সাদা ডানা মেলে শীতল হাতের ননী ননী আদর মাখিয়ে দিয়ে যায় ধরিত্রীর মুখমণ্ডলে। বাতাবি লেবুর সাদা কুঁড়ির বুকে জমে স্ফটিক বিন্দু। কামিনী গন্ধে বিধুর হয় সদ্য স্নাতা স্নিগ্ধ সকাল। একি অপূর্ব ধরিত্রীর রূপ! একি অপূর্ব মিলন! আকাশ আর মেঘের বিচিত্র যুগলবন্দি। কাজল কালো শ্যাম বাঁশি বাজায় বৃন্দাবনে। কাম ও প্রেমের মিলনমালা গ্রন্থিত হয় মালতী লতার পুঞ্জে। গন্ধরাজের শুদ্ধ পাপড়ি থেকে ঝরে পড়ে কালরাতের বাসরজাগা শিশির বিন্দু। গিরি চলে পূজার জন্য মন্দিরের পথে।
রাধাগোবিন্দ মন্দিরের ঘণ্টা বাজে দূর প্রান্তর মুখরিত করে। গ্রামের শেষে শ্বেত মর্মর খচিত শুভ্র মন্দির। পূজারী দেবেন্দ্র ব্রাহ্মণ। সহকারী পূজারী রামু, গিরির রামুদাদা। রামুর গ্রাম গিরির গ্রামেই। রামুদাদার পূজার পদ্ম বড় প্রিয়। গিরি ভোরের প্রথম আলোর সঙ্গে সঙ্গে পেখম মেলে তালপুকুরের তীর বেয়ে চৌধুরির জঙ্গল থেকে তুলে এনেছে গোলাপি কোমল কমল। গোলাপি রঙে বেতের সাজির রূপ গেছে খুলে, উপচে পড়ছে ফুটন্ত ফুলের যৌবনের তরঙ্গ। কাঁসার থালায় প্রদীপ জ্বেলে চন্দনগন্ধে মুখরিত করে সে পদ্মফুলে গেঁথেছে অর্ঘ্য। গিরির শীতল চরণ নবীন বৃষ্টির অঙ্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলেছে মন্দিরের পথে। প্রদীপের মৃদু শিখা উষ্ণতার ছোঁয়া দিয়ে যায় অভিসারিকার মনে। গিরি চলে কৃষ্ণ অভিসারে। গিরির পরনে শ্বেতশুভ্র থান। চন্দনে চর্চিত কপাল। বৈধব্যের স্নিগ্ধ ছোঁয়া অঙ্গ জুড়ে। পূর্বদিনের বিকেলে ফোটা শ্বেতকামিনী একরাত্রি পর বৃষ্টি জলভারে যেভাবে নুইয়ে পড়ে গিরির রূপ সেভাবেই নুইয়ে পড়েছে কৃষ্ণ প্রেমে।
দূর মন্দির থেকে ভেসে আসে ব্রাহ্মণের মন্ত্র উচ্চারণ, কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ। আজও গিরির বড় দেরি হয়ে গেছে। পদ্ম ফুল তুলে মালা গেঁথে ভরা শ্রাবণের ভরা নদীতে স্নান করে পূজার থালা তৈরি করতে করতে তপনের তেজ গেছে চড়ে। গিরি মন্দিরে প্রবেশ করে ব্রাহ্মণের হাতে অর্ঘ্য তুলে দিয়ে বসে রাধাকৃষ্ণের সম্মুখে। রামুদাদা গান ধরে, ‌‘মেরা তো গিরিধারী গোপালা, দুসরা না কোয়ি।’ সুর ভেসে যায় মন্দির ভেদ করে, গ্রাম ভেদ করে, চরাচর ভেদ করে দূরে, আরও দূরে, বহু দূরে। পৃথিবীর পথে পথে, বাঁকে বাঁকে, আকাশ ধরিত্রীর মিলন সীমান্তে। শ্রাবণের ঘন কালো মেঘের আড়ালে, নদীর দুকূল ভাসানো জলে, অর্ধমগ্ন ধরিত্রীর কোলে উঠে আসে এক অপূর্ব সকাল। অনন্ত সকাল। নবীন সূর্য দুরু দুরু বুকে তার প্রথম প্রেম নিবেদন করে সদ্য সমুদ্রস্নাতা কিশোরী ধরিত্রীর চরণে।

রামু মানে গিরির রামুদাদা ছেলেবেলা থেকেই বড্ড আনমনা। গিরির বাড়ি রামুদের বাড়ি থেকে গুনে গুনে ঠিক চারটে বাড়ি পরে। গিরি রামুর থেকে বয়সে তিন-চার বছরের ছোট বটে তবে দুজনের মধ্যে এক অপূর্ব বন্ধন। এ যেন শুধু পূর্বজন্ম নয়, জন্ম-জন্মান্তর ধরে একসঙ্গে এদের পথ চলা। রামু এমন বৃষ্টির দিনে গিরির জানালায় এসে গুনে গুনে তিনটে টোকা দিত। গিরি পা টিপে টিপে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসতো আর তারপর শুরু হতো নদীর তীর ধরে, ধানক্ষেত ধরে, নাটা কাঁটার জঙ্গল ধরে প্রাণখোলা দামালপনা। বর্ষায় যখন চারিদিক ভেসে যেত, নদীর জল উঠে আসত গ্রামের রাস্তা বেয়ে, দুজনে গামছা দিয়ে মাছ ধরত। নানা জাতের মাছ উঠত গামছার ছাকনিতে। পুঁটি, চিংড়ি, ট্যাংরা, খোলসে আরও কতো কী! ছোট ছোট মাছ গামছায় বেঁধে গিরির সে কী আনন্দ!  আর রামুর আনন্দ গিরির হাসি দেখে। স্নিগ্ধ তনু পঙ্কে কারুকার্য করে বেলা দ্বিপ্রহরে চলে তাদের দুজনের ঘরে ফেরার পালা।
রামুর পেয়ারা গাছের প্রথম পেয়ারা বরাদ্দ থাকে গিরির জন্য। বরাদ্দ থাকে বন জামরুলের সবচেয়ে গোলাপি জামরুলটা। বাঁশঝাড়ের ভেতরের আনারস বাগান থেকে উঠে আসে চুরি করা পাকা আনারস গিরির জন্য। গাব গাছের মাথা থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে তিনটে গাবের এক তাড়া। রসাল ফলের গুচ্ছ আসে চৌধুরির বাগান থেকে। ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগে চলে ফুল তোলার অভিযান। দুটো সাজি হাতে অবোধ বালক বালিকা চলে সদ্য কুঁড়ি থেকে ফোটা স্নিগ্ধ পুষ্পের খোঁজে। রায়বাড়ি, চৌধুরি বাড়ির বাগান থেকে চলে দেদার ফুল চুরি। টগর, করবী, শিউলি, পদ্ম, জবা, মালতী. কামিনী ফুলে ভরে যায় সাজি। ফুলগুচ্ছে লেগে থাকে গোপন প্রেমের প্রথম আকুলতা। লেগে থাকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা। লেগে থাকে ক্ষণিক না দেখা পাওয়ার খ্যাপামি।
— রামুদাদা! আজ আমরা নদীতে স্নান করতে যাবো না?
— যাবো গিরি। পাঠশালা থেকে ফিরেই যাবো নদীতে। তুই গামছা নিয়ে তৈরি থাকিস। তোকে সঙ্গে নিয়ে পূব দিক বেয়ে সাঁতারে যাব ওই সোনাদিঘির পাড় পর্যন্ত। এক ডাক বই যেন দুই ডাক দিতে না হয়!
— না দিতে হবে না। আমার তো গুরুমশাইয়ের ব্যামো হয়েছে, পাঠশালা বন্ধ। ততক্ষণ তোমার জন্য বসে বসে বৈঁচি ফুলের মালা গাঁথব।
— কেন? মালা গাঁথবি কেন?
— তোমায় পরাব বলে।
— ধুর পাগলি! আমায় পরাবি? কেন? আমি তোর বর নাকি? তোর যখন বিয়ে হবে, তখন লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে তোর বরকে রোজ বৈঁচি ফুলের মালা গেঁথে পরাস। আমায় পরাতে হবে না।
চূর্নী‌ নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে গিরির দেহে যৌবন আসে। প্রথম ভালবাসার নবীন আলোয় মুদিত হয় কুন্দের প্রথম কলি। গিরির দুচোখে শুধুই রামুদাদা। ‌‘পিয়ামিলন কি গীত গায়ে সখিয়া, পিয়ামিলন কি গীত গায়ে।’ শরতের সাদা মেঘের অট্টহাসে ভেসে আসে পুলক, যৌবনের আমোদ। প্রথম যৌবনের স্পর্শে জ্যোৎস্না রাত্রে গিরি চন্দ্রালোকিত উঠোনের ধারে ধারে পৌঁছে যায় চূর্নী‌ নদীর তীরে, কচি ঘাসের বিস্তৃত ভূমিতে নবীন দেহশয্যা পেতে চাঁদের মুখে মুখ রাখে। চন্দ্রালোকে ভাসিয়ে দেয় তরঙ্গায়িত দেহ। জ্যোৎস্নার আদর মেখে ঘরে ফেরে। রামুদাদার কথা ভেবে চাঁদের মুখে আলতো সুখে চুম্বন বসায়। সকালের মেঠো পথে দুর্গার আগমনী ভেসে আসে। চন্ডীতলায় কুমোর প্রতিমার রূপ নির্মাণ করে। সেজে ওঠে গিরিও। দুর্গার প্রতিদিন অঙ্গসজ্জা চলে। রং বসে, পটচুলা বসে; শাড়ি জড়ায়, চোখে কাজল ওঠে। গিরিও তৈরি হয় রামুদাদাকে তার মনের একমাত্র গোপন কথাটি জানাতে। সেও তৈরি হয় নব নব সাজে। অঙ্গসজ্জা হয়। দেহ চর্চিত হয়, চন্দনের প্রলেপ ওঠে, খোঁপায় লাগে মালতীর গুচ্ছ। দেখা করে শরতের বানভাসি চূর্নী‌ নদীর ধারে, নতুন কচি ঘাসের গালিচায়।
— রামুদাদা! তোমায় একটা কথা বলার ছিল!
— কি কথা রে? তোর তো কথার কোনও শেষ নেই। আবার একটা কথা বলে তুই থামতে পারবি বুঝি!
— না, থেমে যাব।
রামু গুনগুন করে গাইতে থাকে,‌ ‌‘মাধব তুয়া অভিসার লাগি, দূতর পন্থ গমন ধ্বনি সাধয়ে, মন্দিরে যামিনী জাগি।’
— জানিস গিরি! কাল পূজারীর মুখে এ গানটি শুনলাম। বড় মধুর, মুখে মুখেই সুর ধরে তুলে নিলাম। আজকাল গ্রামের শেষের রাধামাধবের মন্দিরটা বড় ভাল লাগে রে! সময় পেলেই ওখানে গিয়ে বসি। শান্তি পাই। অনেক যন্ত্রণার প্রশমন ঘটে।
— তোমার আবার কি যন্ত্রণা গো রামুদাদা?  তোমার তো সেই কোন ছেলেবেলায় মা বাবা দুজনেই বসন্ত রোগে চলে গেছে, এক ঠাকুমা তাও সে অন্ধ। তোমার তো বেশ মজা। শাসন বারণ কিছু নেই।
— না রে, একদিকে ভালই হয়েছে ওরা চলে গেছে, এখন আমি বাঁধন ছাড়া, উড়ন্ত বক, কোথাও আমার উড়ে যাওয়ায় নেই মানা। ছাড়! কী যেন বলছিলি বলবি?
— রামুদাদা! তোমায় বড্ড ভালবাসি গো আমি, তোমার সঙ্গে ঘর করার সাধ জাগে। একসঙ্গে জীবনে মরণে বাঁধা পড়বার সাধ জাগে। তুমি পূরণ কর আমার এ সাধ। তোমা বিনা আমি এ ভুবন শূন্য দেখি রামুদাদা।
— তা হয় না রে পাগলি। আমি তোর রামুদাদা। আমি থাকব চিরকাল তোর পাশে রামুদাদা হয়েই। তোর বিয়ে হবে। গোলা ভরা ধান হবে, সিঁথি ভরা সিঁদুর হবে, ঘর ভরা সুখ হবে, কোল ভরা সন্তান হবে। স্বামী, ছেলে মেয়ে নিয়ে তুই সুখি থাকবি। তোর রামুদাদা দুহাত ভরে তোকে আশীর্বাদ করবে, তুই ফিরে যা গিরি। মন থেকে এ ভাবনা দূর কর।
আবার গাইতে থাকে রামু। ‌‘দুহু করি দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া’ হেঁটে যায় মুখ ঘুরিয়ে নদীর তীর বেয়ে। গিরি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে রামুর হেঁটে যাওয়া পথের পানে, কী নির্বিকার, কী পাথর হয়ে গেছে সেই মানুষটা, কী পরিবর্তন রামুদাদার। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে লাল হয়ে যায় গিরির নবীন নধর তনু। বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যায় গ্রামের পথে।
হেমন্তের ঝরা পাতার বিদায়ের সাথে সাথে পিতৃগৃহ থেকে বিদায় হয়ে যায় গিরি। অগ্রহায়ণের নতুন ধানের গন্ধ নিয়ে গিরি চলে নতুন সংসারে। লাল টুকটুকে কাপড়ের ভাঁজে ছড়িয়ে পড়ে লক্ষ্মী প্রতিমার রূপ। নতুন আমন ধানের গোছা গোছা সুখ চলে গিরির লক্ষ্মী ভাণ্ড ভরে ভরে। রাঙ্গা আলতা পায়ের স্পর্শে নবান্ন লাগে শ্বশুরগৃহে। গিরি স্বামী সোহাগে আদরে মজে সংসারে। রামুদাদা অন্তরের গভীর থেকে আরও গভীরে লুকিয়ে পড়ে। হেমন্তের গোধূলিতে জাগে স্মৃতি রোমন্থনের বেহাগ। জাগে চূর্নী‌ নদী, জাগে রাধামাধব মন্দির। জাগে রামুদাদার গান ‘হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে … পরাণ পিরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে’।
বৎসর দুই পর নবীনা পৃথিবীর দিগন্তের তীর ঘেঁষে ঘন কালো কুয়াশা নামে। মাঘের শীত লাগে বাঘের গায়ে। জীর্ণ, শীর্ণ পৃথিবী শুষ্কতার গভীরে মুখ লুকোয়। সাতদিনের কালাজ্বরে গিরির সিঁথির সিঁদুর মুছে যায়। চূর্নী‌ নদীর জলে ভেসে যায় ভাঙা শাঁখা-পলা আর সিঁদুর। চূর্নী‌র ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে যায় বহু জল। অলক্ষ্মী, কূলটার অপবাদ ভেসে যায়, ভেসে যায় গিরির মা হওয়ার স্বপ্ন। গিরি ফিরে আসে পিতৃগৃহে। শ্বেত পাথরের মর্মর মূর্তি হয়ে। সাদা থান আর চন্দন চর্চিত কপালে, ফিরে আসে শৈত্যের দৈন্যতা নিয়ে।
যদিও শীত আসে তবুও তা চিরস্হায়ী হয় না। দীর্ঘ শীর্ণতার শেষে আমের বনে বনে নতুন মুকুল জাগে। দুটি পাতার আড়াল থেকে হেসে ওঠে নতুন কিশলয়। পাতা ঝরার শেষবেলায় লাগে নতুন অঙ্কুরের হিল্লোল। মাদারের টকটকে লাল ফুলে ভরে যায় গ্রামের মেঠো পথ। ভাঁটি ফুলের সাদা কুঁড়ি জ্যোৎস্নার ছোঁয়া এনে দেয়। শিমুল, পলাশ রাঙা হয়ে ফোটে বনে বনে। জারুল, পারুল, মহুয়ায় জোটে অলিকূল। কুহু কুহু কোয়েলিয়া গায় পিয়া মিলন পরসঙ্গে। গিরি চলে ফাগুনের বন মাড়িয়ে পূজার মন্দিরে। শুভ্র মহাশ্বেতারূপী হয়ে সরস্বতীর চরণ বন্দনা করে। মন্দিরে সে রামুদাদার সঙ্গে সুরে সুর মেলায়। বেজে ওঠে খোল, করতাল, ঢাকি। ‌‘সখি কি পুছসি অনুভব মোর, পিরিতি অনুরাগ বাখানিতে তিলে তিলে নূতন হোয়।’
পূজা শেষে মন্দির ভক্তশূন্য হলে গিরি প্রণাম করে তার রামুদাদার চরণে। এখন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামুদাদা। মন্দিরই তার গৃহ, মন্দিরই তার আলয়। গিরি অভিসার লাগি চিরসখার সঙ্গ কামনা করে। গেয়ে ওঠে‌ ‌‘মেরে তো গিরিধারী গোপালা, দুসরা না কোয়ি।’ কামনা করে অনন্ত প্রেম। তবে আজও গিরির রামুদাদা নিথর। শীতল কষ্টি পাথরের শক্ত মাধব যেন! পাষাণ হৃদয়, পাষাণ শরীর। গিরিকে বাহুর বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে ছুঁড়ে দেয় রাধামাধবের মূর্তির চরণে। চিরকালের জন্য রাধামাধব গিরির হাতে সঁপে রামু বিদায় নেয় অনন্তের পথে। যে পথ মন্দিরের সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছে দিগন্তের পানে। যেখানে আকাশ আর ধরিত্রীর মিলন খেলা চলে প্রতিনিয়ত। শুধু যাবার পথে রামুর চোখ থেকে ঝরে গোপন দুফোঁটা নোনা জল। যে জল তার পৌরুষহীন জীবনের জন্য। যে জীবন থাকল গিরির চিরকালের অজানা।

1 thought on “তুয়া অভিসার লাগি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.