দেবাশিস সেনগুপ্ত

দেবাশিস সেনগুপ্ত গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে বেলঘরিয়া এথিক নাট্যগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত।  

পাণ্ডব পক্ষের ঘোষণা ছিল – যুদ্ধ সমাপ্ত। তারা বিজয়ী। ধার্তরাষ্ট্রেরা নিহত। শুধু আহত, পঙ্গু, প্রায় চলৎশক্তিহীন, শূন্য-অস্ত্র দুর্যোধনকে তাঁর নিজস্ব নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছেন – পাণ্ডবেরা। সেই রাতে। ঘোষণা হয়েছে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শুরু হবে – পরবর্তী সূর্যোদয়ের সাথে। গণদাহকার্য হবে অগণিত লাশের। একদা যারা বীর ছিল, অন্তত সৈনিক। ঘোষণা হয়েছে,  কেউ ইচ্ছা করলে, শনাক্ত করতে পারলে, ওই স্তূপ ঘেঁটে নিয়ে যেতে পারেন প্রিয়জনদের দেহ বা দেহাংশ – প্রথানুগ সৎকারের জন্য। সেই রাতে। এপারে কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে, অথবা নির্লিপ্ত নদীস্রোত পেরিয়ে ওপারে, পাণ্ডবশিবিরে সব মশাল জ্বালানিহীন হয়ে অন্ধকার সেই রাতে। কৌরব পক্ষের পরিচিত অথচ জীবিত, আহত তবুও সক্ষম শেষ তিন ব্যক্তি মিলিত হচ্ছেন জীবিত বলেই সম্ভবত। কৃপাচার্য, কৃতবর্মা এবং অশ্বত্থামা। নৌকো বেয়ে নদী পেরিয়ে পৌঁছিয়ে যাচ্ছেন তারা নিদ্রিত পাণ্ডবশিবিরে। অশ্বত্থামা ক্লান্তি ও নিশ্চিন্ততায় নিদ্রিত ছয় রাজপুরুষের শির দেহভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন পঞ্চপাণ্ডব এবং তাদের সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন ভেবে। সেই রাতে। বাস্তবত অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকা, ধৃষ্টদ্যুম্নের ওই পাঁচ সাথী – প্রতিবিন্দ্য, শ্রুতসেন, শতাণীক, শ্রুতসোম ও শ্রুতকীর্তি। দ্রৌপদীর পাঁচ সন্তান। পাণ্ডবদের ঔরসজাত। নদী পেরিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন অশ্বত্থামারা। দ্রৌপদীকে এই পৃথিবীতে সন্তান-বন্ধনহীন, ভ্রাতৃহীন ক’রে। জেগে উঠছে পাণ্ডব শিবির। আতঙ্কে। বিস্ময়ে ক্রোধে। কে বা কারা বা ওই কোলাহলই হয়ত, দ্রৌপদীকে জানিয়ে দিচ্ছে সংবাদ। দ্রৌপদী, পাশাখেলার রাজসভার অপমানের প্রতিশোধ – যুদ্ধ জয়ে সদ্য তৃপ্ত দ্রৌপদী, রণসাজ খুলে পাঁচ দয়িতকে আবার আপন করে পাওয়ার স্বপ্নে নিদ্রিত দ্রৌপদী – ছুটে আসছেন অকুস্থলে।
এই প্রেক্ষিতে শুরু হয় দ্রৌপদীর এই একক সংলাপ-গুচ্ছ। এবং তার মঞ্চ সময়।
আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। আমার কী করা উচিত। আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার আর কোনও প্রয়োজন নেই, কৃষ্ণ। আমি সম্মতি দেব ওদের দেহ সৎকারের। দেব। শুধু একটা কাজ একটু করবে কৃষ্ণ? এই যে আমার পাঁচ সন্তানের দেহ অংশের সাথে ওদের ছিন্ন হয়ে যাওয়া শির তোমরা সাজিয়ে রেখেছ…ওগুলো যথাযথ সাজানো হয়নি। তোমার পঞ্চ সখাকে বলবে মুখাবয়ব দেখে…ওই বিচ্ছিন্ন মুণ্ডগুলোয় যা এখনো জেগে রয়েছে…সেই মুখাবয়ব দেখে ঠিক ঠিক মতো সাজিয়ে রাখতে…প্রতিবিন্ধ্যের দেহের সঙ্গে তাঁরটাই…শতানীক, শ্রুতসোম, শ্রুতকীর্তি, শ্রুতসেন…ওদের তো অন্তত এটুকু আকাঙ্খা থাকতেই পারে-শেষবার আগুনের কাছে ওরা স্বপূর্ণ নিজস্ব পরিচয়ে আশ্রয় নেবে। নিজের শরীরের সাথে নিজের…অবশ্য সম্পূর্ণ, নিটোল নিজস্ব পরিচয় ওরা জীবিত অবস্থাতেও পায়নি কখনো…। বলবে কৃষ্ণ, তোমার পাঁচ বন্ধুকে? হা! আমি জানি ওরা পারবেন না। ওঁরা কেউ চেনেন না এদের। শিশু শরীরে জন্মচিহ্নগুলো দেহের সাথে বাড়তে বাড়তে কী আকার, কী রং নিয়েছে জানেন না ওঁরা। এদের কাউকেই তো ওঁরা নিজের নিজের সন্তান বলে ভাবেননি কখনও। সব ভাই-এর মিলিত ধান্যক্ষেত্রে যেই বীজ সিঞ্চন করুন না কেন – ফসল যেমন সকলের – এরাও তেমনি।
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, পরাক্রমী ভীম, ধীরোদাত্ত অর্জুন, কন্দর্পপুত্র নকুল সহদেব – কেউই তো নিজের কাছে নিশ্চিত নন প্রতিবিন্ধ্য না শ্রুতসোম…না শতানীক…না শ্রুতকীর্তি…না শ্রুতসেন…ঠিক কে…কে ওঁর নিজস্ব সন্তান। হ্যাঁ মহর্ষি ব্যাস এদের এক একজনের লিখিত পরিচয় স্থির করেছিলেন-শ্রুতসেন যুথিষ্ঠিরের সন্তান…শ্রুতকীর্তি অর্জুনের ঔরসজাত…ব্যাস স্থির করেছিলেন…কিন্তু ওরা কেউই তো নিশ্চিত নয়…দ্রৌপদীও না। সে তো সবার সাথেই শয্যাগমন করে চলেছে ক্রমাগত। এরাও ওদের পাঁচজনকেই পিতা বলে সম্বোধন করে এসেছে। আমৃত্যু। তাই এরা শুধুই নিশ্চিতভাবে দ্রৌপদীর সন্তান। সম্পূর্ণ, নিটোল নিজস্ব পরিচয়…এরা জীবিত অবস্থাতেই পায়নি কখনো। আর শুধু ওই দ্রৌপদীর সন্তান বলেই যার কাছে আদর ছিল ওদের…হাতের তালুতে করে শৈশব থেকে কৈশোর পার করে যৌবনে পৌঁছে দিয়েছে…আমার ভাই…ধৃষ্টদ্যুম্ন সে তো মৃত্যুতেও সঙ্গী হয়েছে ওদের। সে চিনতো…দীর্ঘতম কেশের অধিকারী শতানীকের বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলে রথচক্রে পিষ্ট হওয়ার ক্ষত আছে…। চিনত…কৃষ্ণ। মনে পড়ছে তোমার অভিমন্যুর মৃত্যুর পর প্রিয়তম অর্জুনের হাহাকার। কান্না। সুভদ্রাকে বুকে জড়িয়ে। তোমার সান্ত্বনাবাক্য ভেসে গিয়েছিল বন্যার খড়কুটোর মতো…মনে পড়ছে ঘটোৎকচের মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে ভীমসেনের তাণ্ডব…মনে পড়ছে? স্বাভাবিক ছিল। পুত্রের জন্য, নির্মমভাবে নিহত পুত্রের জন্য, তাদের পিতাদের ওই শোক। স্বাভাবিকই ছিল। আমার ভীষণ মনে পড়ছে কৃষ্ণ। মনে পড়তো না হয়তো…কিন্তু, তুমি আমাকে ঘিরে অথচ নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়ানো ওই পাঁচজনের দিকে তাকাও কৃষ্ণ। ওই পাঁচজোড়া চোখে অসতর্ক পরাজয়ের লজ্জা, অপমান, ক্রোধ আছে। অপরাধ বোধ আছে ও আনত মুখগুলোয়। দ্রৌপদীর কাছে…আছে। কিন্তু সন্তান হারানো পিতার কান্না? কই?
উঠে দাঁড়ান দ্রৌপদী। শেষবারের মতো শায়িত মৃতদেহগুলির দিকে তাকিয়ে দূরে সরিয়ে নিতে থাকেন নিজেকে।
আমি স্বীকার করলাম। আমার ভাই ও সন্তানদের মৃত্যু। আপনারা ওদের মৃতদেহ ও মুণ্ডুগুলি সৎকারের জন্য নিয়ে যেতে পারেন।
চলে যান দ্রৌপদী তাঁকে ঘিরে থাকা ভিড় পেরিয়ে। দূরে। মৃতদেহগুলি সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন, আয়োজন শোনা যায়। দূর প্রান্ত থেকেই কথা বলেন দ্রৌপদী, না তাকিয়ে। কারণ শেষবারের মতো তিনি দেখে নিয়েছেন তাঁর সন্তানদের।
শোন কৃষ্ণ, পাণ্ডব সেনাপতি মহারথী ধৃষ্টদ্যুম্নের সৎকারের জন্য যদি উপযুক্ত কাউকে জীবিত না পাওয়া যায়, আমি নিজেই করবো।
সকলেই চলে গেছেন। সুভদ্রা এসে দাঁড়িয়েছেন দ্রৌপদীর পিছনটিতে।
তুমি যাও সুভদ্রা। আমি একটু একা থাকতে চাই। এখানে।
সুভদ্রাও চলে যান। তাই শূন্য প্রান্তরের মতো এ শূন্য মঞ্চেও দ্রৌপদী একাকী। এখন। তাঁর চোখে জল নেই তো! নিভন্ত দাবানলের মতো অপ্রত্যক্ষ আগুন আর পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া বৃক্ষের বিষাদময় নির্লিপ্ততা। সময় নেন তিনি। তারপর সরাসরি কথা বলেন দশর্কদের সাথে।
অশ্বত্থামার কপালে মণি বসানো আছে। তার আলোয় ওই চাঁদহীন রাতের জমাট অন্ধকারে সে পথ চিনে পৌঁছোতে পেরেছিল পাণ্ডব শিবিরে। খুন করেছিল ঘুমিয়ে থাকা আমার পাঁচ-পাঁচটা ছেলেকেই। অবশ্য পঞ্চপাণ্ডব আর তাদের পরামর্শদাতা কৃষ্ণ ভেবে। আমি এরপর মহারাজ যুধিষ্ঠিরের কাছে চাইব অশ্বত্থামার জীবন। সে নাকি অমর। সেক্ষেত্রে অন্তত তার মাথার ওই মণি। চাইব। আমার পাঁচ ছেলের অকাল মৃত্যুর বিনিময়ে। প্রতিশোধে যুথিষ্ঠির তাঁর স্বভাব অনুযায়ী আমার প্রতিশোধ স্পৃহায় সম্মতি জানাতে দ্বিধাবোধ করবেন। ধর্মবোধ তাকে বাধা দেবে বৌ-এর ইচ্ছে পালনের জন্য আর কাউকে খুন করতে। যুদ্ধ শেষের পর। তাও ভাগের বউ। ভাগ! তখন আমি ভীমকে বলবো, আমার সন্তানদের মৃত্যুতে তোমাদের শোক না হতে পারে, কিন্তু তুমি যদি আমাকে ভালবেসে থাক, তাহলে অশ্বত্থামার মণি আমাকে উপহার দাও। এই একটা কথা, একটা প্রশ্ন, একটা সংশয়ের সামনে অমন তাগড়া ভীমের সব জারিজুরি শেষ। তাকে বারবার নিজের কাছে প্রমাণ দিতে হয় – সে-ই সবচেয়ে ভালবাসে দ্রৌপদীকে। ভালবাসে। যুথিষ্ঠিরের মতো ধর্ম মেনে নয়। অর্জুনের মতো নায়কোচিত দুরত্ব থেকে নয়। নকুল বা সহদেবের মতো শ্রদ্ধা-বিস্ময় মিশিয়ে নয়। ভালবাসে। প্রেমিকের মতো। আবেগতাড়িত পুরুষের মতো। তাই সে আবারও রওনা দেবে -অশ্বত্থামাকে খুঁজে বের করতে। আরও একজন মানুষ অবশ্য আছেন, যার প্রমাণ করার কোনও দায় নেই, কিন্তু এই কৃষ্ণা-দ্রৌপদীর যন্ত্রনা, আকাঙ্ক্ষাকে ছুঁয়ে দেখার মতো মন আছে। ইচ্ছে আছে। তাগিদ আছে। তিনি অর্জুনকে নির্দেশ দেবেন ভীমের সাথে যেতে। নির্দেশ দেবেন। আর, অর্জুনকে তো নির্দেশ দিতে হবে। নির্দেশ মানবে সে। না হলে একটা মেয়েছেলের শোক-সময়ের কামনাকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো সাধারণ পুরুষ তো তিনি নন। তিনি অর্জুন। জরাসন্ধ, কর্ণকে মেরে ফেলার পর বীরের তালিকায় তিনি চোখ বন্ধ করে এক নম্বর। ভীম ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা, ছাই দিয়ে মণি ঢেকে রাখা অশ্বত্থামাকে খুঁজে বের করবে। তার কপাল থেকে উপড়ে নেবে মণি। দুই হাতে করে আমার সামনে তুলে ধরবে – কৌরব পক্ষের শেষ সম্মানের প্রতীক। এবং এই প্রথম সে আমাকে হিসেব দেবে – আমাকে দেওয়া সব কথা সে কীভাবে পালন করেছে-দুর্যোধনকে খুন করে, দুঃশাসনের রক্ত পান করে, ধৃতরাষ্টের সব ছেলেগুলোর লাশ একের পর এক সাজিয়ে কুরুক্ষেত্রে…হিসেব দেবে। এই প্রথম। তার চোখে একটাই শুধু প্রশ্ন জেগে থাকবে, একটাই অনুরোধ তোমার পুত্রদের হত্যাকারী দ্রোণপুত্রের মাথার মণিও তোমায় এনে দিলাম – এরপরও কী তোমার প্রতিহিংসা বাকি রয়ে যাবে? এরপরও কী তুমি নিজের কাছে `যুদ্ধ শেষ’ ঘোষণা করতে পারবে না দ্রৌপদী?
যুদ্ধ শেষ…
আপনাদের মনেও একটা প্রশ্ন জাগছে হয়তো…হয়তো কেন জাগছে নিশ্চয়ই – এই কি উপযুক্ত সময় হল? মায়ের কাছে? পাঁচ-পাঁচটা জোয়ান ছেলে এরকম ভাবে খুন হওয়ার পর…মা, তার নিজের কথা বলতে বসবে? পারে? তখন তো শোক তাকে পাগল করে দেবে। যন্ত্রণা বোবা করে দেবে। সেই সময়ে সে নিজের কথা বলতে ডাকলো কেন? হ্যাঁ, আমি তো ডেকেছি আপনাকে। এই মুহূর্তটা বেছে নিয়েছি, আমার বুকের ভেতর জমাট কিছু কথা উগড়ে দেবো বলে। ‘জমাট কিছু কথা উগড়ে দেবো’-এই কথাটা শুনে আপনার শ্লেষ্মার কথা মনে হল, না? কফ্? মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে জমতে থাকে। জমতে জমতে জমাট বাঁধতে থাকে। দম আটকে আসে। যে ক’রে হোক…কাশতে কাশতে…যতক্ষণ না বের ক’রে দেওয়া যায়। ছিটকে গিয়ে পড়ে, বাইরে। একটা থকথকে হলুদ দলা। ওই বস্তুপিণ্ডটা কিন্তু যার বুকে বিঁধেছিল তার কাছে খুব গুরুত্বের। মানে ওর বেরিয়ে যাওয়াটা। বের করে দেওয়ার পদ্ধতিটা। আর যার সামনে গিয়ে পড়ল! থকথকে…পিচ্ছিল…ঘিনঘিনে একটা দলা!
কিছুকিছু কথাও তো আসলে তাই-ই।

জমতে জমতে নিঃশ্বাস আটকাতে থাকে। কিন্তু যখন তখন যেখানে সেখানে সেগুলোকে বের করে দেওয়া যায় না। সামনের মানুষটার নাক আর চোখ কুচকে যাওয়ার ভয়ে। মহাভারতের মঞ্চে যতক্ষণ থাকে দ্রৌপদী, তাকে দিয়ে অনেক কথাই বলিয়েছেন ব্যাস। সে তো ঘোমটা টানা গৃহবধূ ছিল না। নিময়মাফিক জীবনও তার জন্য লিখে যাননি মহাকবি। যন্ত্রণায়, অপমানে, তার বদলাগুলোর হিসেব নিতে নিতে, পাঁচ-পাঁচটা রাজপুরুষকে সঙ্গ দিতে দিতে, বনে অজ্ঞাতবাসে, অন্য রাণীর চুল বাঁধতে বাঁধতে, স্বামীদের অন্য স্ত্রীদের জন্য জায়গা করে দিতে দিতে…অনেক অনেক কথা বলতে হয়েছে দ্রৌপদীকে। কিন্তু সেই বলতে থাকা কথাগুলো ফাঁকে ফাঁকে যে বাক্যগুলো জমে থেকেছ-তার খবর তো স্বয়ং ব্যাসদেবও রাখেননি কখনো। হ্যাঁ…একজন ছিল দ্রৌপদীর…বাইরে আগুন ঝরিয়ে এসে যার কাছে কান্নায় গলে যেতে পারতো, বাইরের প্রজ্ঞার কঠিন আস্তারণটা মাতাল হয়ে হেসে উঠতে পারতো…ছিল। একজন। বন্ধু। কিন্তু সেও তো ওই চেনা গণ্ডিরই মানুষ। তাঁর কাছে কৃষ্ণা, কৃষ্ণা হয়েও বন্ধুপত্নী। বন্ধু হয়েও পাণ্ডবদের বৌ, দ্রুপদরাজের মেয়ে, ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন। তাই তার কাছেও সব কথা বলতে পারতাম না। সবটা। এই…এখন…ওই প্রতিবিন্ধ্যদের শরীরগুলো সামনে নিয়ে কই তাকে তো বলতে পারলাম না-কৃষ্ণ, দাও আমাকে রক্ত আর শ্বেত চন্দন-আমি ওদের সজ্জিত করবো। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঘৃতভাণ্ডগুলো নিয়ে এসো। মাখাবো ওদের। তারপর নিজের হাতে চন্দন কাঠের চিতায় তুলব-জ্বালিয়ে দেব। ওদের রক্ত-মাংস-হাড়-মজ্জা-মেদের ভারে ভারাক্রান্ত শরীরগুলো বায়বীয় হালকা হয়ে উঠতে উঠতে আকাশে, বাতাসে মিশে যাবে। মিলিয়ে যাবে। নির্ভার। আমার মতো। এই মুহূর্তে এদের মৃত-শায়িত দেখে আমার নিজেকে অসম্ভব নির্ভার লাগছে। কৃষ্ণ! এত ভারহীন উন্মুক্ত আমি নিজেকে কখনো অনুভব করিনি। কখনো না।
এক নিঃশ্বাসে এই কথাগুলো বলে থামেন দ্রৌপদী। যেন অন্তঃ-উদ্ভূত কোনও প্রবল ধাক্কায় সরে যান দূরে। দৃশ্যতই জোরে শ্বাস নিতে থাকেন। কিছুক্ষণ। ধীরে ফেরেন, দর্শকের সামনে। এক অসম্ভব প্রত্যয়ের গভীরতা থেকে শব্দ উচ্চারণ করেন।
এই কথাগুলো বলার জন্য – ঠিক এই মুহূর্তে ডেকেছিলাম আপনাকে। যখন আমার পেট থেকে জন্মানো পাঁচটা ছেলের মুণ্ডহীন কবন্ধগুলো শোয়ানো হবে আপনার সামনে।
আবার থামেন দ্রৌপদী। সময় নেন। আবারও কথা বলতে শুরু করেন।
আমি জানি বিস্ময়ে আপনি নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছেন। কিংবা ঘৃণায় এলোমলো হয়ে যাচ্ছে আপনার মুখের রেখাগুলো। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কারণ এই হাজার হাজার বছরের এপার থেকে আপনাকে আমি চিনি না। আর এখন এ আলোকিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওই অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের কোনো এক কোণায় বসে থাকা আপনাকে দেখতেও পাচ্ছি না। তাদের প্রশ্ন, তাদের বিস্ময়, তাদের ঘেন্নাই তো আমাদের ভাবিয়ে তোলে – যাদের আমরা চিনি। যে মানুষ যত ছোট সে তত বেশি মানুষকে চেনে, তার অন্যের কথায় তত বেশি এসে যায়। মানুষ যত বড় হতে থাকে – তত বেশি মানুষ তাকে চিনতে থাকে…আর তার চেনা মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে ক্রমাগত…। অন্যের কথায় তার এসে যায় কম…ক্রমাগত আরও কম।
তাই এই দীর্ঘ সময় এসে, যে কথা কোনদিন কাউকে বলিনি, বলতে পারিনি…বললাম।
এক্ষুণি হয়তো সুভদ্রা এসে দাঁড়াবে। বলবে, ‘পুত্রদের দাহকর্ম সেরে ওঁরা শিবির প্রান্তে উপস্থিত। অস্থায়ী হলেও এই তো এখনও গৃহ। আপনি চলুন আর্যে। সংস্কার সম্পন্ন করে ওদের শিবির অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি দিন।’
ঠিকই। ক্ষত্রিয় জীবনে ‘যুদ্ধ-শিবিরই গৃহ’। ওখানে থেকেই তো যুদ্ধ পরিচালিত হয়। যুদ্ধ। যা ক্ষমতাকে নির্ধারিত করে। সিংহাসনকে। রাজমুকুটকে। একজনের মাথায়। একজন। পাণ্ডবরা যুদ্ধে জিতেছে।
হঠাৎই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুভদ্রাকে বলেন।
তুমি যাও সুভদ্রে, ওদের জানিয়ে দাও আমার পঞ্চপুত্রের মৃত্যুর জন্য যা কিছু অভিঘাত, তা শুধু আমার। তাই দাহকর্মজনিত সমস্ত অশুচিতার সংস্কার নিয়ে ওদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। ওরা নির্দ্বিধায় যেখানে ইচ্ছে প্রবেশ করতে পারেন। ওদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিও আমার দাবির কথা। অশ্বত্থামার শিরস্থিত মণি। আমার চাই।
সুভদ্রা চলে যান। তার চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন দ্রৌপদী। তারপর আবারও কথা বলতে শুরু করেন।
অভিমন্যুও মারা গেছে। তাকেই যুবরাজ করা হয়েছিল। না আমার আপত্তি ছিল না। আমার পাঁচ-পাঁচটা সন্তান বেঁচে ছিল তখন। তবু আমার আপত্তি ছিল না। অভিমন্যুকে আমিও স্নেহ করতাম খুব। আমার ছেলেদের তো ছোট থেকে নিজের কাছে পাইনি…ওকে পেয়েছিলাম…তবু…
কিছুক্ষণ স্মৃতির কাছাকাছি নিশ্চুপ থাকেন দ্রৌপদী। তারপর পরিবর্তিত দৃঢ়স্বরে বলেন –
কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। আমি জানতাম এই যুদ্ধে পাণ্ডবরা জিতবে। গোটা রাজ্য, সিংহাসন, ক্ষমতা তাদের হাতেই আসবে। লক্ষ্য করেছেন-আমি কিন্তু বহুবচনে কথা বলেছি। পাণ্ডবরা সিংহাসনে বসবেন…এবং আপনারও কোথাও এতে কোনও ব্যাকরণগত অসুবিধা বোধ হয়নি। কোনও মানুষেরই হয়নি…কখনো। কিন্তু এই না হওয়াটা-পঞ্চপাণ্ডবের পাঁচ বহুবচনীয় সংখ্যাটাকে  একবচনের মতো ব্যবহার করতে পারাটা এমনি এমনিই হয়ে যায়নি। ক্ষমতা আর তার উৎস সম্পত্তির দৌড়ে ভাই-এর সাথে ভাইয়ের লড়াইয়ের সাক্ষী গোটা পৃথিবী। আপনিও হয়তো। সাধারণ ভাইয়ের সঙ্গে ভাইরা লড়ে যায়। এখানে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির…গাণ্ডীবধন্য অর্জুন…বীর শ্রেষ্ঠ ভীম… পাঁচজনের মধ্যে নিজের শ্লাঘা, অহংকার বিলীন করে খুশি থাকার পক্ষে বড্ড বড় বড় নাম…। তবু তাই ছিল তারা। যাতে থাকে তার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল…সেকথা হয়তো জানেনও আপনি…দ্রৌপদী…তার রূপ যৌবন, প্রজ্ঞা, যৌনতাকে ব্যবহার ব্যবহার করা হয়েছিল…
ধীরে উঠে যান দ্রৌপদী। সময় নেন। তারপর হঠাৎ-ই তাকিয়ে বলেন –
ওই যে স্বয়ংবর থেকে ফিরে কৌতুক করে যুধিষ্ঠিরের বলা, `মা আজ দেখ কী ভিক্ষা এনেছি’, মারও না দেখে নিদান দেওয়া-‘ভাগ করে নাও বাবারা’…ওসব গল্প কথা। ছোটদের জন্য। রাজ্য উদ্ধারের জন্য মুঠোটা শক্তই রাখতে হবে। তাই অসমান কিন্তু প্রয়োজনীয় পাঁচটা আঙুলকেই চাই একসাথে গাঁথা। সেই মাপমতো তৈরি করা হয়েছিল দ্রৌপদীকে। পাঁচ পাণ্ডব তাদের মাকে নিয়ে যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, জতুগৃহের আগুনে নিরীহ ছ’জনকে পুড়িয়ে দিয়ে, ছদ্মবেশে, তখন ব্যাসদেবও স্বয়ং তাদের সাথে দেখা করেছেন, বলেছেন দ্রুপদরাজার ঘরে এই যাজ্ঞসেনীর জন্মকথা – যজ্ঞের পবিত্র আগুন থেকে। এবং জানাচ্ছেন তাঁর উপন্যাসের পরবর্তী অধ্যায়ে ওই পাঁচ ভায়ের সাথেই আমাদের বিয়ের পরিকল্পনা। ঠিক আপনাদের আধুনিক-উত্তর সময়ের কোনো উপন্যাসের মতো, পাঠকের উত্তেজনা ধরে রাখার জন্য, সেখানে সময়ক্রম মেনে তুরুপের তাস খেলার প্রয়োজন হয় না। এর সঙ্গে অবশ্য তিনি তার পুরাণকথা মেলাচ্ছেন অবলীলায়। আমদানি করছেন পূর্বজন্মের কোনো এক রূপগুণবতী ঋষি কন্যার গল্প। সে ‘বিলগ্নমধ্যা সুশ্রোণী, সুভ্রূঃ সর্বগুণান্বিতা।’ বেচারির এত সুন্দর শরীর আর গুণ হওয়া সত্ত্বেও মনমতো বর পাচ্ছে না। তাই শিবের আরাধনায় বসেছে। শিবকে কাছে পেয়ে, ভোলাভালা শিব ঠিক মতো বুঝতে পারছেন কিনা সেই অধৈর্যপনায়, পাঁচবার একই কথা বলে ফেলেছে। কিন্তু শিব, এত সময় নষ্ট করে সেই কৈলাস থেকে আসা শিব, অত বেশি কথা সইবেন কেন? বলে দিলেন-‘তুমি ভালো স্বামীর আকাঙ্ক্ষা আমাকে পাঁচবার জানালে, বেশ তোমার এক বরে পাঁচবর হোক।’ এবং সে মেয়ে অবিবাহিত, অব্যবহৃত থাকার জ্বালাতেই বোধহয় পাঁচ স্বামী সম্ভোগ সম্ভাবনা মেনে নিচ্ছে। আনন্দেই-‘এবমিচ্ছম্যহং দেব ত্বৎপ্রাসাদাৎ পতিংপ্রভো’। এব তপস্যায় যৌবন বিইয়ে দেওয়া সেই মেয়েই এই যাজ্ঞসেনী – নতুন যৌবন নিয়ে জন্ম নিচ্ছি রাজা দ্রুপদের যজ্ঞশালায়। যজ্ঞের আগুন থেকে। যুবতীই।
আবার উদাস হয়ে যান দ্রৌপদী। যেন তার মনে পড়তে থাকে তার জন্ম বৃত্তান্ত। যেন কোন যজ্ঞ আয়োজনের স্মৃতি-শব্দে ভ’রে যায় সময়। কে যেন ভবিষ্যবাণী করেন ‘রাজ্ঞি পৃষাতি মিথুনং ত্বামুপস্থিতম্’। কারা যেন উত্তেজনায় ধারা বিবরণী দিয়ে ওঠেন সচিৎকারে-‘কুমারী চাপি পাঞ্চালী বেদীমধ্যাৎ সমুত্থিতা।’ ঘোর কাটিয়ে আবার কথা বলেন তিনি।
তাই আমারা পাঁচজন স্বামী থাকা নাকি শিবের আশীর্বাদ। আশীর্বাদ না অভিশাপ…এ নিয়ে গবেষণায় আপনারা হাজার কোটি শব্দ খরচ করেছন…সে কথায় আসার আগে, যা বলেছিলাম…আমার পাঁচ ছেলেকে একত্র রাখার জন্য এরকম কোনও দ্রৌপদীকে তো তৈরি করা হয়নি মহাভারতে। আর একটা দ্রৌপদীর জীবন কাটানোর পর, কোনও মেয়ে, নারী, মা কী ক’রে পারবে শুধুমাত্র রাজনীতির কারণে অন্য কোনও মেয়েকে এই জীবনটায় ঠেলে দিতে…?
আমার ছেলেরা…ওরা কেউই তো…ওই যে বলছিলাম সম্পূর্ণ, নিটোল রাজপুত্রের পরিচয় পায়নি কখনও…রাজপুত্র কেন, বাবা মায়ের সাথে থেকে তাদের স্নেহে আদরে বড় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক সন্তানের জীবনও পায়নি ওরা। তাই ক্ষমতা…রাজত্ব…সিংহাসন…এ সবের সম্ভাবনা যদি ওদের সব না পাওয়া…অপূর্ণ কামনাগুলোকে জ্বালানি করে আগুন জ্বালায়… সে আগুনে পুড়ে যেতে থাকে…এক ভাই-এর ধনুক ছেড়ে লোভ আর হিংসার তীরগুলো ছুটে যেতে থাকে অন্য ভাই-এর বুকের দিকে…হা! আর কতো পুড়বে দ্রৌপদী?
তার হাহাকার শুষ্ক বাতাস হয়ে ফেরে। তাপ দিয়ে যায় দহনের। অন্তত শ্রোতার শ্রবণেদ্রিয়ে। তারপর…আবারও প্রত্যয়ের মতো মন্দ্রতা উচ্চারিত হয় তার স্বর।
তাই আমি চাইনি আমার কোনও সন্তান যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হোক। ক্ষমতার চাঁদমারিতে চোখ রাখার অধিকার পাক।
সময় নেন দ্রৌপদী।
অভিমন্যুও মারা গেছিল এই যুদ্ধে। চক্রব্যূহে নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল পাণ্ডব শিবিরের যুবরাজকে। সেদিন কম কষ্ট হয়নি আমার। শুনেছি খবরটা শোনা মাত্রই জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি। দীর্ঘক্ষণের চেষ্টায় জ্ঞান ফিরিয়েছিলেন বৈদ্য। মনে আছে, জ্ঞান ফেরা মাত্রই আমি শ্রুতসেনকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম শিবিরে। শ্রুতসেন আমার বড়ছেলে। সকলেই ভেবেছিল সে বেঁচে আছে কি না দেখে নিতে চাইছি আমি নিজের চোখে। শ্রুতসেন এসে দাঁড়িয়েছিল। নতমুখ। আপাত বিষণ্ণ। আমি, ওই সদ্য সংজ্ঞা ফিরে পাওয়া অশক্ত শরীর নিয়েও এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়েছিলাম ওর মুখোমুখি। শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম ওর চোখের দিকে। সেখানে কোনও লোভ, কোনও আকাঙ্ক্ষার ছায়া দুলতে শুরু করেছে কি না দেখার জন্য। অভিমন্যুর অনুপস্থিতির মুহূর্তে। বুঝতে পারিনি। আবার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি আমি।
আবার সময় নেন দ্রৌপদী। যেন মনে করতে চান সেদিন পড়তে চাওয়া তার সন্তানের চোখের ভাষাকে।
তারপর ক্রমাগত যুদ্ধজয়ের খবর যত উৎসাহ নিয়ে এসেছে পাণ্ডব শিবিরে, প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসার চরিতার্থতায় যখন ক্রমশ উল্লসিত হয়ে উঠেছে একটা দ্রৌপদী, যে নারী, রাজকন্যা, রাজজায়া…প্রকাশ্যে অপমানিত, বঞ্চিত তার সব অধিকার থেকে…তখনই, ঠিক তখনই, ভেতরে ভেতরে আশংকায়, উদ্বেগে কাঁটা হয়ে থেকেছে আর একজন। সে, মা। যে তার স্বামীদের পাশাপাশি তার ছেলেদেরও ক্রমশ দেখতে পাচ্ছিল ক্ষমতার চৌহদ্দিতে। সে তার জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার আশংকায় আরো একটা ক্ষেত্রযুদ্ধ দেখছিল যেন তার চোখের সামনে। আমি তো দেখেছি মা কুন্তির যন্ত্রণা – কর্ণ আর অর্জুনের মুখোমুখি যুদ্ধের দিন যত প্রকট হয়েছে। আমি তো শুনেছি দীর্ঘ এগারো বছর বাদে রথে চড়ে সেই বৃদ্ধা কী আকুতিতে ছুটে গেছিলেন কুরুক্ষেত্রে। লাশ ঘেঁটে, লাশ ঘেঁটে ঘেঁটে, শিয়াল কুকুর তাড়িয়ে, তার বড় ছেলের দেহ উদ্ধার করতে। যে কিনা হত হয়েছে তারই সফলতম সন্তান অর্জুনের হাতে।
অর্জুন! যে অর্জুন যুদ্ধ করতে চায়নি। এমন কী যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তেও তো সে বলেছিল – রাজ্য চায় না, ধন-সম্পদ-প্রতিশোধ চায় না। কৈ র্ময়া সহ যোদ্ধব্যম অস্মিণ রণ সমুদ্যতে। কার কার সাথে লড়তে হবে আমাকে? এরা সবাই তো আমার আশৈশব আপনার জন। সেও কিন্তু মুক্তি পায়নি। চিৎকার করে বলেছিল – ন যোৎস্যে ইতি। না যুদ্ধ করব না! সে কিন্তু মুক্তি পায়নি। তাকে প্ররোচিত করার জন্য কৃষ্ণ মজুত ছিল, গোটা গীতার উপদেশ বাণী নিয়ে। নানান রাজ্যের রাজা-রাজড়ারা নিজের নিজের অঙ্কের হিসেবে দু’ভাগে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দু’দিকে। তাকে সব আত্মীয়ঘাতের সম্ভাব্য গ্লানি থেকে মুক্ত করেছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণ – সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং স্মরণং ব্রজ।
আর তারপর যাদের সাথে খেলতে খেলতে বড় হয়েছে, যাদের কাঁধে কোলে পিঠে চেপে বড় হয়েছে, তাদেরই সাথে লড়তে লড়তে লড়তে অর্জুন এসে দাঁড়িয়েছে কর্ণের মুখোমুখি। রথের চাকা বসে যাওয়া – কবচকুণ্ডলহীন অসহায় বীরকে তীরের পর তীর বিঁধেছে! কর্ণ। তার সাথে অর্জুনেরও তো সে-ই সম্পর্ক – আমার শ্রুতসেনের সাথে প্রতিবিন্ধ্য বা শতানীকের যা – ওরা একই মায়ের সন্তান।
একটা গোটা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ পার করে এসে কোন মা একটা সিংহাসন, একটা রাজমুকুট, একটা রাজদণ্ডের আশেপাশে পাঁচ সন্তানের উপস্থিতি চাইতে পারে? সহ্য করতে পারে?
কাকে প্রশ্ন করেন দ্রৌপদী? মহাশূন্য, মহাকালের দিকে যেন তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। অপলক। শূন্যদৃষ্টি। তারপর, একটু আগে সেখানে শায়িত ছিল তাঁর পাঁচ সন্তানের মৃত শরীরগুলো, সেখানে, সেই শূন্যস্থানে – তাদের কল্পিত জীবিত অস্তিত্বের সাথে কথা বলেন।
তোমরা ক্ষত্রিয়ের সন্তান, যুদ্ধকালে নিহত হয়েছ। ক্ষত্রিয় সন্তানের কাছে এ মৃত্যু গর্বের। তাছাড়া এ যুদ্ধের নির্মাণে কোনও ভূমিকা ছিল না তোমাদের। কোনোও রাজত্বের লোভ। কোনও ক্ষাত্র-প্রতিহিংসা। তোমরা শেষ দিন পর্যন্ত নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের হত্যার চেষ্টায় অস্ত্রধারণ করনি কখনও ।এর চেয়ে তৃপ্তিদায়ক আর কিছুই হতে পারত না তোমাদের মায়ের কাছে। তোমরা একসঙ্গে অপেক্ষা করো তোমাদের মায়ের জন্য। সে তোমাদের একসাথে পায়নি কখনো। সুখী থেকো – ত্রিলোকের যেখানেই থাকো তোমরা। একত্রে। ভাই-এর মতো। পরস্পর…। এই উপন্যাসে আর যেটুকু ভূমিকা বাকি রেয়ে গেছে আমার…নির্ধারিত… পালন করেই ফিরে আসবো…তোমাদের কাছে…শুধু তোমাদের জন্য।
এই প্রথম, এ নাটকের মঞ্চ সময়ে এই প্রথম, অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে দ্রৌপদীর চোখ। দ্রৌপদীর বাচন। কৃষ্ণ এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। সান্ত্বনা দিতেই হয়তো। হয়তো অন্য কোনও সংবাদ। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করছে দ্রৌপদীকে। সচকিত দ্রৌপদী চকিতে ফিরে পেতে চাইছেন তাঁর আপাত কাঠিন্য। স্পর্শেই অনুভব ক’রে, পিছনে না ফিরেই কৃষ্ণকে সম্বোধন করছেন।
কৃষ্ণ! আমি জানি কী বলবে তুমি। ওঁরা আমার প্রতীক্ষায় আছেন। আমি জানি। ওঁরা তো আমার প্রতীক্ষায় আছেন…সেই কবে থেকেই। অসীম তৃষ্ণায়। মনে নেই ওঁরা আমাকে দেখার মুহূর্তকে বর্ণনা করতে গিয়ে ব্যাস কী লিখছেন – তাং দ্রৌপদী প্রেক্ষ্য তদা স্ম সর্বে কন্দর্পবাণাভিহতা বভূবুঃ। দ্রৌপদীকে দেখা মাত্রই ওরা সবাই কামমোহিত হয়ে পড়ছেন। অবশ। তাই-তো উদ্দেশ্য ছিল তোমাদের দ্রৌপদী সৃষ্টির। ওদের সে প্রতীক্ষা হয়তো আজও একই রকম তীব্র…কিন্তু কৃষ্ণ এই দ্রৌপদীর কী আর কোনও আকাঙ্ক্ষা আছে অন্য কারো কোনও প্রতীক্ষায় সাড়া দেওয়ার। না। না তুমি যাও কৃষ্ণ জানিয়ে দাও ওদের। দ্রৌপদীকে নিয়ে চিন্তিত না হলেও চলবে। বৃত্ত এখন সম্পূর্ণ প্রায়। কৃষ্ণ, তোমাকেও ভিন্ন কিছু বলার নেই আমার। হয়তো আহত হলে তুমি, কারণ তুমি তো নিজেকে সেই বাঁধমুখ ভেবে এসেছ চিরকাল, যে আমার অন্তঃস্থিত উদ্বেল, অতিরিক্ত জলরাশিকে সঠিক প্রবাহে প্রবাহিত করে, তারা ধারাকে বিপদসীমার মধ্যে সাজিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু আজ আর তোমাকে নতুন করে কিছু বলার নেই আমার। হাজার হাজার বৎসর কালের ওপার থেকে ওঁরা আমার কাছে এসেছেন। আমি ওদের সাথে কথা বলতে চাই। নিভৃতে। তুমি যাও।
কৃষ্ণ বোধহয় কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। তারপর চলে যেতে থাকে। দ্রৌপদীও বোঝহয় প্রতীক্ষা করেন তার চলে যাওয়ার জন্য। দৃষ্টি তাঁর অনন্তকে ছুঁতে চাইছে। অনুসন্ধান। খুব ধীরে কথা বলতে শুরু করেন আবার।
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম আমরা…যুদ্ধশেষ…এই সব…বিয়ে…পাশাখেলা…বনবাস…রাজত্ব উদ্ধার…যুদ্ধ পেরিয়ে এসে মনে হচ্ছে – গোটা জীবনটাই আসলে একটা ভাগ অঙ্ক – শরীর, মন, সময় ভূমি। যে অঙ্কটাই একটা যুদ্ধ। ভাজ্যের সাথে ভাজকের। ক্রমাগত এই যুদ্ধটা লড়তে লড়তে এই মুহূর্তে, আমার গর্ভজাত পাঁচটি শিশুকে নিস্প্রাণ শায়িত দেখে, হঠাৎ আবিষ্কার করলাম নিজস্ব শরীরী মৃত্যুর পর আমার আর কোনও চিহ্ন, কোনও বহমানতা রইবে না মহাভারতে।
রাজ্য থাকবে, রাজত্ব থাকবে, পাণ্ডবদের উত্তরাধিকারীরাও থাকবে সেই রাজত্ব আর ক্ষমতাকে ঘিরে। হয়তো সেই ক্ষমতা নিয়ে আরও অনেক সংশয়-দ্বন্দ্ব-যুদ্ধও থাকবে, হয়তো শান্তিও থাকবে…কিন্তু দ্রৌপদী সেখানে থাকবে না কোথাও…
আর এই সত্য আবিষ্কার করার সাথে সাথে দ্রৌপদী, এমন এক অনুভূতিতে পৌঁছল – যেখানে সে আগে পা দেয়নি কখনো। যেন একটা বৃত্ত আঁকা সম্পূর্ণ হল। সম্পূর্ণ হলে যা দেখতে শূন্যের মতো। শূন্য। যুদ্ধের উত্তেজনা নিয়ে ওই অঙ্কটার একটার পর একটা ধাপ পেরোতে পেরোতে হঠাৎ-ই অশ্বত্থামার খড়গের আঘাতে, সে দেখতে পেল ভাগ শেষ শূন্য। এরপর…ভাগফল নিয়ে কোনও কৌতুহল বা আকাঙ্ক্ষা নেই আমার। নেই । তার বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ বা আকার নিয়ে আপনাদের গবেষণা চলুক। হাজার হাজার বছরের ওপারে।
মহাভারত নামে এক মহতী উপন্যাস, যা নাকি এই – ক্রমাগত পাল্টে যেতে থাকা মানুষজীবনের সবচেয়ে বড় আয়না…যে আয়নাটা নিজেকে বদলাতে পারে, সময়ের সাথে সাথে, ভূগোলের সাথে…সেই…সেই উপন্যাসের একটা নির্মিত…নিয়ন্ত্রিত নারী চরিত্রের…
হঠাৎই বাক্যের মাঝপথে থেমে যান দ্রৌপদী। একটু ভাবেন।। তারপর গভীরতম বেদনার মুহূর্তে সামান্যতম সান্ত্বনা সে হাসিটুকু বয়ে আনে-সেই হাসি হাসেন। দর্শকের চোখে চোখ রেখে। আবার উচ্চারিত হয় তার শব্দ।
শেষ বিচারে সব চরিত্ররা বোধহয় তাই-ই। নির্মিত। নিয়ন্ত্রিত। কেষ্টর জীব। যা বলছিলাম…এই মুহূর্তে আমার প্রকটতম সত্যটুকু জানানোর জন্যই আপনাদের ডেকেছিলাম। শুধু। সেটুকুই জানালাম।
বাক্য শেষ করেন দ্রৌপদী। শেষ করে স্তব্ধ হয়ে যান। বোঝা যায় না আর কোনও কথা কারো উদ্দ্যেশ্যে বলবেন কিনা। তবু বসে থাকেন তিনি সময় এবং দর্শকদের স্থানু রেখে। বসে থাকেন নতমুখ। কিছুক্ষণ। হঠাৎ মুখ তোলেন। সরাসরি। আরও একবার উচ্চারণ করেন –
এবং সকলেরই ভাগশেষ শূন্য।
চকিতে উঠে দাঁড়ান, হাতজোড় করে নমস্কার করেন দর্শককে। একই গতিতে পিছনে ফিরে সরাসরি চলতে শুরু করেন আর একটিও বাক্য, শব্দ, অক্ষর, যতি চিহ্নের জন্য কোনও অবকাশ না রেখে। চলতে থাকেন…এবং আকস্মিকভাবেই ঘুরে দাঁড়ান। দর্শকদের চোখে তীক্ষ্ণ চোখ রেখে শেষ প্রশ্ন করেন –
এই বাইরে থেকে – কৃষ্ণ ব্যাসদেবদের নির্মাণ করা, নিয়ন্ত্রণ করা জীবনটাকে পেরিয়ে নিজের, সত্যিকারের নিজের জীবনটা খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করে না আপনার? করেনি কখনও?

1 thought on “বৃত্তান্তে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.