শরণ্য দত্ত

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। এম.ফিল. সমাপ্ত হয়েছে এই বছরেই। আগ্রহের বিষয় মানবাধিকার এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা। ধর্মে অবিশ্বাসী, সামাজিক রীতিনীতিরও কঠোর সমালোচক। কিছুটা আত্মমগ্ন, অমিশুক, ঘরকুনো। কোনও সক্রিয় আন্দোলনে যুক্ত থাকার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় কুঁড়েমি। লেখালিখি অনিয়মিত। কৌষীতকি এবং শুক্রচক্র সমাচার নামে দুটি লিট্‌ল্‌ ম্যাগাজিন সম্পাদনার অভিজ্ঞতা আছে। দুটি পত্রিকারই যে অকালমৃত্যু ঘটেছে তা কাকতালীয় না-ও হতে পারে।

fonta
নতুন জামাটা বুকে জড়িয়ে ধরে শূন্য চোখে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিলো সে। টিউশনের পয়সা জমিয়ে এই প্রথম সে একপ্রস্থ সালোয়ার-কামিজ কিনেছে। বেশি দামী নয়, তবু নিজের রোজগারে কেনা, তার দাম তো শুধু টাকার অঙ্কে মাপা যাবে না। আনন্দে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরেছিলো সে। অথচ দাদা কিনা এক ঝলক দেখেই বাতিল করে দিলো। “এটা পরলে অনেকখানি পিঠ দেখা যাবে,” গম্ভীর মুখে বললো দাদা, “নিজেকে কী ভাবিস তুই, হিরোইন?” মায়েরও মুখ থমথমে। বোঝা যাচ্ছে, দাদার প্রতিই মায়ের সমর্থন। “যা, দোকানে গিয়ে এটা ফেরত দিয়ে আয়, বুঝেছিস? ফেরত নিতে না চাইলে আমাকে একটা মিস্‌ড্‌ কল দিস, আমি দশ মিনিটে পৌঁছে যাবো। আর ভালো করে দেখে নিস, এবারে যেন ভদ্রসভ্য কিছু দেয়!” বলতে বলতে দাদা বেরিয়ে গেলো। ফুটবল খেলতে। পাড়ার মাঠে দাদা ও তার বন্ধুরা খালি গায়েই ফুটবল খেলে। খেলার শেষে ধুলোকাদা মাখা শরীর নিয়ে ঝাঁপ দেয় পাশের পুকুরে। বাইরে কোথাও খেলতে গেলেও দাদা অনেক সময়ে জার্সি খুলে শূন্যে ওড়ায়। ওটাই হলো ম্যাচ জেতার লক্ষণ। দাদার এইরকম ছবি ফেসবুকেও আছে। দাদাই দিয়েছে। নীচে যারা কমেণ্ট করেছে তারা প্রায় সবাই ম্যাচ জেতার জন্যে অভিনন্দন জানিয়েছে; একটি ছেলে শুধু ইয়ার্কি করে লিখেছে, “ভাই, এটা কি ওয়াইল্ড স্টোন সাবানের অ্যাড নাকি? মেয়েগুলো কোথায়?”
ফেসবুকের কথাটা মনে পড়তে আরওই বিশ্রী লাগলো কারণ ইদানীং সে ফেসবুক থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। বাধ্য হয়ে। দাদা কিছুতেই ফেসবুকের পাসওয়ার্ড বদলাতে দেবে না। একবার সাহস করে পাসওয়ার্ড বদলে দিয়েছিলো সে। তাই নিয়ে দাদা তুলকালাম কাণ্ড করলো বাড়িতে। “মা, তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও, তোমার মেয়ে প্রেম করছে। এইসব ফেসবুক-টেসবুক ভালো জিনিস নয়! রোজই তো কাগজে দেখছো, মেয়েরা সব ফেসবুকে প্রেম করছে আর টপাটপ বাড়ি থেকে পালাচ্ছে!” দুঃখ, রাগ, অপমানের মধ্যেও হাসি পেয়ে গেছিলো কথাগুলো শুনে। পরের দিন কলেজে পাপিয়াকে ঘটনাটা বলায় পাপিয়া পরামর্শ দিয়েছিলো একটা ফেক প্রোফাইল খুলতে। না, সেটাও তার সাহসে কুলোয় নি। সে কম্পিউটারে বসলেই দাদা দু-এক মিনিট অন্তর এসে উঁকি মেরে যায়। অথচ দাদা যখন কম্পিউটারে বসে তখন সেই ঘরে তার প্রবেশ নিষেধ। অনেক সময়ে দাদা জানালা-দরজাও বন্ধ করে রাখে। কী এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে দাদার, কে জানে! জানার কোনও ইচ্ছেও তার হয় না।
হঠাৎ মনে পড়লো পাপিয়ার জন্মদিনের কথা। হয়তো আজকের ঘটনার সাথে সাদৃশ্য আছে। হয়তো নেই। পাপিয়া সেদিন পাপিয়ার সবথেকে প্রিয় চারজন বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেছিলো। স্নিগ্ধা, আয়েশা, দেবারতি আর সে। এছাড়া ছিলো পাপিয়ার পাশের বাড়ির বোন, টুকটুকি। এই ছজন মিলে দুটো দলে ভাগ হয়ে চলছিলো অন্তাক্ষরী (যাকে ‘আন্তাক্‌শারি’ না বললে অবশ্য জাত খোয়াতে হবে) খেলা। তখন বড়োজোর সাড়ে আটটা বাজে। রান্নাঘর থেকে মাংসের গন্ধে জিভে জল এসে যাচ্ছে। আর এদিকে আয়েশা একের পর এক গান ‘ল’ দিয়ে শেষ করে বিপদে ফেলে দিচ্ছে তাকে। “লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া”, “লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে”, “লম্‌হা লম্‌হা” ইত্যাদি অনেকক্ষণই হয়ে গেছে। “লাজে রাঙা হলো কনে বউ গো” গাইতে গাইতে সে আকাশপাতাল ভাবছিলো, ‘ল’ দিয়ে পরবর্তী আক্রমণের জন্যে তৈরি করছিলো নিজেকে। এমন সময়ে দাদার এসএমএস: “তোর মতো নিলোজ্জো মেয়ে লাজে রাঙা হওয়ার গান গাইছে!” (দাদা ‘নিলোজ্জো’-ই লিখেছিলো – ‘nilojjo’) অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাতেই জানালা দিয়ে একটা দৃশ্য দেখে তার রক্ত জল। আধো অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে পাপিয়াদের বাড়ির সামনের রাস্তায়। দাদা। “এই আমি আর বসবো না, অনেক রাত হয়ে গেছে…।” পাপিয়া এবং তার বাড়ির সকলে মহা-অপ্রস্তুত। শেষে দশ মিনিটের মধ্যে যেটুকু রান্না হয়েছিলো সেটুকুই নাকেমুখে গুঁজে তাকে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিলো। পুরো রাস্তা দাদা একটাও কথা বলে নি। উদ্বিগ্ন মুখে মা দরজা খোলার পর শুধু বলেছিলো, “আমি আকাশদের ওখানে চললাম, মা। যেতে তো দেরি হলো, ফিরতেও দেরি হবে। তোমরা খেয়ে নিও।” শেষের কথাটা অর্থহীন কারণ দাদা ফেরার আগে মা কিছুতেই খাবে না। দাদার ফিরতে ফিরতে সেই এগারোটা।

চিন্তার সূত্র ধরে মাথায় আসতে থাকলো একের পর এক ঘটনা। প্রত্যেকটাই হতাশার অন্ধকারে আরও বেশি বেশি করে ঠেলে দিতে থাকলো তাকে। এদিকে ঘরটাও অন্ধকার হয়ে গেছে। সন্ধে নেমেছে। মশা কামড়াচ্ছে। পুবদিকের বাড়িটা থেকে শাঁখের আওয়াজ, পশ্চিমদিকের বাড়িটা থেকে সিরিয়ালের শব্দ ভেসে আসছে। এসব ছাপিয়ে দাদার গমগমে গলাটা একটু একটু শোনা যাচ্ছে রাস্তার দিক থেকে। নিশ্চয়ই খেলা শেষ করে বাড়ির পথ ধরেছে। হ্যাঁ, ঐ তো, মা একটা গামছা নিয়ে দরজার দিকে যাচ্ছে। দাদা ফিরলেই মা পরম যত্নে দাদার মাথা ও পিঠ মুছে দেবে। বাকিটা দাদা নিজেই মুছবে। মৃদু অনুযোগের সুরে মা বলবে, “এই করেই তো ঠাণ্ডা লাগাবি! কতদিন বলেছি, সন্ধে করবি না!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বিছানা থেকে উঠলো। ঘরের আলো জ্বাললো। এবার রান্নাঘরে গিয়ে দাদার জন্যে চা করতে হবে। বারান্দায় বেরোতেই দাদার হাফপ্যাণ্ট পরা, আপাদমস্তক ভিজে অবয়বটা দৃষ্টিগোচর হলো তার। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দাদা একবার তার দিকে তাকালো কেবল। দাদার চোখে ভর্ৎসনা। কারণ সে লোককে নিজের পিঠ দেখাতে চেয়েছিলো। কারণ সে নির্লজ্জ, থুড়ি, নিলোজ্জো মেয়ে।

* * *

কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। আজ ভাইফোঁটা। বাড়িতে উৎসবের মেজাজ। পিসিরা এসেছে বাবাকে ফোঁটা দিতে। সকাল সকাল স্নান করে ভদ্রসভ্য পোশাক পরে সেও তৈরি হচ্ছে ফোঁটা দেওয়ার জন্যে। শুধু নিজের দাদা তো নয়, খুড়তুতো জেঠতুতো পিসতুতো মাসতুতো মামাতো এবং পাড়াতুতো অনেক দাদা ও ভাই আছে তার। শেষজনকে ফোঁটা দেওয়া পর্যন্ত দাঁতে কিছু কাটা চলবে না। এই দাদা ও ভাইরাও প্রত্যেকেই একাধিক বোন ও দিদির কাছ থেকে ফোঁটা নেবে। প্রত্যেকবার ফোঁটা নেওয়ার পর এক থালা করে মিষ্টি সাবাড় করবে। ছেলেদের এইসব উপোস-টুপোসের বালাই নেই। কখনও থাকেও না।
শুরু হলো ফোঁটা-পর্ব। বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে চন্দন নিলো সে। পিসিরা তারস্বরে শাঁখ বাজাচ্ছে। দাদা তার সামনেই বসে আছে হাসি হাসি মুখে। ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না যেন। দাদার কপালের দিকে সে তার হাতটা এগিয়ে দিলো। হাত কাঁপছে। আচমকা মাথাটাও কেমন যেন ঘুরে গেলো। বাঁ হাতকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো ডান হাত। দুটো হাত শক্ত করে চেপে ধরলো দাদার গলা। সাঁড়াশির মতো। দাদার চোখ বিস্ফারিত হলো, জিভ বেরিয়ে এলো। খাবি খেতে খেতে এক সময়ে মিষ্টির থালাটার উপর লুটিয়ে পড়লো। সাদা ধবধবে রসগোল্লাগুলো দাদার নাক থেকে বেরিয়ে আসা রক্তে লাল হয়ে গেলো। ওগুলো আর খাওয়া যাবে না, ভেবে খুব অনুশোচনা হতে থাকলো তার। শাঁখের আওয়াজ আরও তীব্র।
সম্বিৎ ফিরলো পলকে। খালি পেটে থাকলে মাথা ঘুরে যেতেই পারে, আর মাথা ঘুরে গেলে কত কী-ই তো মনে হয়! সে এখনও তার জায়গাতেই বসে, দাদাও স্বস্থানে। দাদার হাসি হাসি মুখে মিশেছে হালকা অস্বস্তির ছাপ। এদিকে তার হাতটা শূন্যে ভাসমান অবস্থায় যেন ঠিকানা খুঁজছে। অবশেষে সব অস্বস্তির অবসান ঘটিয়ে দাদার কপালেই স্থির হলো সেটা। মুখ থেকে কোনও এক অবিশ্বাস্য, অলৌকিক প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে এলো, “ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা…”
সবই তো ঠিকঠাক চলছে।
বড়ো বেশিদিন ঠিকঠাক চলছে সব।

2 thoughts on “ভাইফোঁটা

  1. খুব ভালো লাগল। লেখকের আত্মপরিচয়ের বর্ণনাতেও সরসতার ছোঁয়া। আরো লিখুন। বর্তমানে ভালো বাংলা লেখার অভাব রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.