অর্ণব দত্ত

“জন্মেছি ওই মুক্তির দশকে। বেঁচে আছি যে সময় – মুক্তিদাতাকে যেন কোনো একটা চেয়ারের মত দেখতে – এই টানাপোড়েনে নেশার মত গল্পের অন্য নাম জীবন তাই সমুদ্রস্নানের আরাম আসে ওই অল্প অল্প গপ্পেই।” – অর্ণব 

মানুষ সারাটা জীবন ধরে যদি ফানুস ওড়ায়, সে বরং একটা কাজই। মানুষ নিজেই আসলে এক-একটা ফানুস। রঙিন বেলুনের মতো হাজারো স্বপ্ন আর আশা। হিসেবে এর ক’টা ঠিকটাক মেলে?
আশায় বাঁচে চাষা। শতকরা নিরানব্বইজন মানুষের কৃষিকাজ ওই হিসেব বরাব্বরের তালে। কে মরল, কে বাঁচল, আহত বা পঙ্গু হল কিনা, তাতে কী আসে-যায়! আমাকে আমার মতো থাকতে দাও গানটা বেজায় হিট। হয়তো গানটার ব্যাথাবেদনা-মাখা অর্থ আছে। সে তো ‘ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো’-রও আছে!
মানে বই জিনিসটা ভীষণ একঘেয়ে। স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে মানে বই চারুও কিনত। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ যা কিছু সিলেবাসে আছে, সব ব্যাপারেই কেমন যেন অভয় দিত সবের মানে বাতলে দেওয়া গাবদা টাইপের বইটা। যদিও পাতা উল্টোলেই ঘুম পেত। এও চারু টের পেত, মানে জিনিসটা বিরক্তিকর।
চারু ভাবছিল, মানে না থাকলে সবই আবোল-তাবোল সৃষ্টি ছাড়া? চিন্তাটা পেয়ে বসল। স্বরচিত যে জালটা আষ্টেপৃষ্টে ক্রমশ আত্মনিগ্রহের ডাঙায় তুলে ফেলছে, সেখান থেকে জীবনপ্রবাহ অন্তহীন তরঙ্গে ফের নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার আকুতি উদ্বুদ্ধ করল চারুকে । বাদ সাধল ছোটবেলার বদভ্যেস ওই মানে বইটা। চারুর একটা বিজ্ঞাপন মনে পড়ল, যৌবনের বদভ্যেস কাটাতে সেবন করুন। সুখের নিদান।
উপায় নেই। ফের গোড়া থেকেই শুরু করতে হবে। এক নমস্য নাকি বলেছিলেন, জন্মই পাপ। চারু এও পড়েছে, মানুষ অমৃতের সন্তান। দু’টি সম্পূর্ণ উল্টো কথার আকর্ষণ-বিকর্ষণের প্রভাবে আপনা-আপনিই চারু বলে ওঠে, বোঝ ঠেলা।
কয়েকদিন আগে জরুরি কাজে কর্পোরেশনে গিয়েছিল। ক্লার্ক ছেলেটা অল্পবয়স্ক। বলল, চিন্তা করবেন না দাদা । হয়ে যাবে। তবে ক’টা দিন ওয়েট করুন।
এখন মনে হচ্ছে, চিন্তাটিন্তা সত্যিই খানিক কমানো দরকার। চিন্তামনি হয়ে আর কাজ কি? যেমন ভাবা, তেমন কিন্তু কাজ হল না। মাথায় রাজ্যের চিন্তা কিচিরমিচির করছে। সে যেন কলকাতা শহরে ঠাসাঠাসি একটা বাসের যাত্রী। জানলা দিয়ে একজন অসভ্যের মতো নাক ঝাড়ছে, প্যা-প্যা করে বাচ্চা কাঁদছে, মহিলাদের সিটের দিকটা বিপুল গোলমাল। চারুর মাথা ঝিমঝিম করে। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে সিগারেটের প্যাকেট খোঁজে সে। হাতের কাছে না পেয়ে চিৎকার করে, কনক, অ্যাই কনক…
পাশের বাড়িতে একজন মাস্টার ভাড়া এসেছে। থলথলে চেহারা। গাদাগুচ্ছের টিউশন করে। বাচ্চাদের মায়ের সঙ্গে দেদার বকে। রাতে মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের বাবারা এসে মাস্টারের সদর দরজায় বাড়ি মারে। সেদিন কনককে আদর করার মুহূর্তে ওরকম জোরে বাড়ি পড়ছিল। সুর কেটে গেল চারুর। ডাকাত পড়ল নাকি? অনেকদিন পর তুমুল আগ্রহ দেখাচ্ছে কনক। চারু প্ল্যান করছিল, গোটাটা কীভাবে সামলাবে। এদিকে ধাক্কাটা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। ফিসফিসিয়ে কনক বলল, ছাড়ো। মাস্টারটা বাচ্চাদের খুব পেটায়। …দেখো, দরজাটা ও খুলবেই না।
ওই ব্যাপারের মধ্যেই চারু খেয়াল রাখল, কনকের কথাটা ফলে কিনা! কথা মিলেও গেলেও দু’মুখো মন নিয়ে কাজ সারায় একদফা বউয়ের মুখ ঝামটা খেল চারু।

আজ রবিবার। ফ্রিজে চিকেন ছিল। কনককে মাখোমাখো করে বানাতে বলেছে। বউ এখন গ্যাসের সামনে। চারু গলা পেয়ে বসার ঘরে উঁকি মেরে বলল, কী ব্যাপার, চিৎকার করছ কেন?
চারু সোজাসুজি দেখল কনককে। দু’বছর হল বিয়ে করেছে। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। চারু খুব শখ ছিল লাভ ম্যারেজের। এদিকে মেয়েরা পাত্তা দেয়নি। অন্তত যাদের মনে ধরেছিল। কনককে পাওয়ার পর সে খেদ মিটেছে। ভাবলে হাসি পায়, প্রেম হচ্ছে না বলে একসময় কী হীনমন্যতাই না ছিল। কর্পোরেশনের ওই ছেলেটা দূরদর্শী বটে! বলে কিনা, হয়ে যাবে। দাদা চিন্তা করবেন না।
চারু বউকে বলে সিগারেটের প্যাকেটটা…
–   খুঁজে নাও। আর একটা শব্দও খরচ করে না করে চলে গেল কনক।
ছোট্ট সংসার। বউ আর সে। তিনকুলে তেমন কেউ নেই। বছর খানেক আগে বিধবা মা গত হয়েছেন। মায়ের মৃত্যু নিয়ে ভাবতে বসলে, গোড়াতেই চারুর মনে হয়, মা কোথায় গেল? কখনও সে দেখে অসীম আকাশের ওপারে গ্রহনক্ষত্রের দিকে তীর বেগে ছুটে চলেছে মায়ের প্রাণ। কখনও বা ডুব দিয়েছে বিরাট সাগরের অতলে। এসবের মানে হয়? কে জানে! আজগুবিও মনে হয় না যে!
প্যাকেটে সিগারেট নেই। চারু পাঞ্জাবি গলিয়ে সিগারেট কিনতে বেরোয়। রাস্তায় লোক চলাচল দেখতে দেখতে ভাবে, হয়তো নিছক কল্পনা। তা কুৎসিত নয়, বরং সুন্দর। নিজের মায়ের প্রাণ ওই বিরাটের দিকেই ছুটবে, মানুষটা বেঁচে থাকাকালীন ঘুনাক্ষরেও তা টের পায়নি চারু।
কেমন এক অপরাধবোধে ভোগে চারু। বড়রাস্তার ধারে বাড়ি। বাস, অটোর গতিবিধি লক্ষ্য করতে করতে বিমর্ষ লাগে। কয়েকটা দিনের জন্যে অফিস ছুটি নেবে সে। কম খরচে পুরী ঘুরে আসবে। একটানা সমুদ্র গর্জনের শব্দ স্মৃতি থেকে অনেক অপমান সরিয়ে দেয়। রিক্তা সরাসরি না বলার পর প্রথমবার পুরী গিয়েছিল। সেবার রাতে ঘুমের ভিতর ঢেউয়ের গর্জন শুনেছিল। টাকা ছিল না। পৈতের আংটিটা বন্ধক রেখেই ছুটেছিল। মাকে কী একটা বানিয়ে বলেছিল। এখন আপশোস হয়। রিক্তার জন্যে নয়, ওই মিথ্যের জন্যে। খুব কষ্ট করে আংটিটা বানিয়ে দিয়েছিল মা। সোনার আংটি সেই যে স্যাঁকরার ঘরে ঢুকল, আর ছাড়তে পারেনি।  চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়ছিল। ছাড়ানো সম্ভব ছিল না। আসলে রিক্তার মধ্যে এমন একটা টান ছিল, যা তাকে অস্থির করে তুলছিল। কাটা কাটা সংলাপে রিক্তা বলেছিল, তুমি যদি আমাকে বিরক্ত করো পুলিশে কমপ্লেন করব। কথাটা মনে রেখো।
অপমানে আরক্ত হয়েছে চারু। মোটের উপর লোকে তাকে ভদ্র ছেলে বলে জানে। যে মেয়েকে ভালবাসে, সে-ই থানায় ঢোকানোর হুমকি দেওয়ায় চারুর মনে হয়ছিল, সত্যিই ধ্বংস হয়ে যাবে সে।
এ পাড়ায় বছর কুড়ি আগেও বড়সড় কয়েকটা বাড়ি ছিল। ভেঙেভুঙে বেশিরভাগই ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। ফ্ল্যাট বাড়ির মানুষগুলো – যাকে বলে ওই ফ্ল্যাট কালচারের। হিজ হিজ হুজ হুজ। ভাবভঙ্গিও আলাদা। যেন নিজেদের আলাদা করে রেখেছে। মিশ খাচ্ছে না। মুখোমুখি পড়ে গেলে আলগা হাসি, সব ঠিক আছে গোছের দায়সারা সংলাপ।
চারুদের বাড়িটা ভাড়ার। দুটো ঘর, রান্না ঘর, বাথরুম একফালি বারান্দা-ভাড়া মোটে দু’হাজার। এই এক বাঁচোয়া। চারুর রোজগার অল্প। নিতান্ত সাধারণ সে। দুর্মূল্যের বাজারে টানাটানির সংসার। কনক বড্ড হিসেবে চলে। মধ্যে মধ্যে চারুর খরচের হাতই বরং লম্বা হয়। টানাটানির সময় কনকের কাছে হাত পাতলে কিছু না কিছু পায়-ও। কিভাবে সম্ভবপর হয়, ভেবে থই পায় না চারু।
ছুটির দিনে রকের আড্ডা চলছে। বাচ্চার গলিতে খেলছে। সুখময় দৃশ্য। সুখটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে করতে রিক্তাকে মনে পড়ল চারুর। রিক্তা ভালবাসে এমন গোলমেলে মর্মোদ্ধার কেন যে করেছিল, ভাবতে বসে তালগোল পাকিয়ে যায়। মেয়েরা আলগা প্রশয় দিয়েই থাকে। কনকের ছত্রছায়ায় বুঝেছে, সেটা প্রেমের ধারে কাছেও নয়। কত ভাবেরই ঘোর কাটল!
ক্রমাগত মেশিনের একঘেয়ে বিকট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে চারু। ছবি আঁকতে পারলে ওই মেশিনটা আঁকত। কি ভীষণ হিংস্র! যেন খতম করার জন্যেই আর্বিভাব। টেনে-পিষে ছিবড়ে করে স্বস্তি। ভেঙেচূরে জিনিসটা গুড়িয়ে দিতে চায় চারু। অক্ষরে অক্ষরে ধ্বংসের কর্তব্য তামিলে যেন ওটার উদয় হয়েছে।
একটা নেড়ি পায়ের কাছে ল্যাজ নাড়ছে। এক টুকরো ইঁট হাতে তুলে নেয় চারু। মেশিনটার সঙ্গে নেড়িটার কী যেন সাঁট আছে। লিকলিকে উচ্ছিষ্ট খাওয়া শরীর। তেড়ে এল। কামড়ে দিলেই চিত্তির। চারুর জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে। ঘাড় ধরে নেড়িটাকে মেশিনের পেটে ছুঁড়ে দিল চারু। তীক্ষ্ম চাকাগুলো ধুরন্ধর গতিতে ঘুরছে। কেঁউ কেঁউ করে তীব্রভাবে আর্তনাদ করে নেড়িটা।
ক্ষণিক স্বস্তি অনুভব করে চারু। আর একটা সিগারেট জ্বেলে, পাড়ার সুখী ছুটির দিন রিক্তার সঙ্গে বোকামির সাতকাহন দেখতে দেখতে ফের চারু দেখে ওই মেশিনটা। এও শোনে, দাঁতওয়ালা মেশিনটা যেন কিছু বলছে। নির্দেশ? উপদেশ? সান্ত্বনা? প্রতিশ্রুতি? কথাগুলো কানে ঢুকল না। কেঁউ কেঁউ করে আর্তনাদ করে উঠল অন্তরাত্মা।
চারু স্বগতোক্তি করে, জানতে জানতে জানোয়ার। পরের লাইনটা? ও হ্যাঁ খেলতে খেলতে খেলোয়াড়। বিশ্বচরাচরের মানে সবটাই বুঝিয়ে দিতে জোর করছে মেশিনটা। অতিকায় মেশিন খতম বা অগ্রাহ্য করার সাধ্য যে নেই, ঘোরতরভাবে এটা চারু যখন টের পেল, হাওয়ায় তরঙ্গে খেলোয়াড়ির সত্যের চিরন্তনটা অনুভব করল সে।
সদর দরজা ভেজানো। যে ঘরটাকে কনক বেডরুম বানিয়েছে, ছেলেবেলা কেটেছে সে ঘরেই। অভ্যেসমতো ঘরটা আজও ভিতরের ঘর। বাড়ির পেছনের ঘর। রাস্তার সাড়াশব্দ নেই। রহস্যময় নির্জনতার ছোঁয়া পাওয়া যায়।
টিভিতে কয়েকদিন আগে শুনছিল, শহরে নাকি পাখি কমে যাচ্ছে। পাখপাখালির ডানা মোবাইল টাওয়ারের তরঙ্গাভিঘাত সহ্য করতে পারছে না। ভিতরের ঘরে ঢুকে চারু বিছানায় হামাগুড়ি দিয়ে জানলার দিকে এগোল।
ঘরে ঢুকে কনক বলছে, ফের পা না মুছে বিছানায় উঠলে? দিলে তো সাদা চাদরটা নষ্ট করে।
চারু কিছু বলল না। কানে ঢুকল না কনক আরও কী বলছে।
সাফসুতরো জানলা। একটা পিঁপড়ে নেই। না লাল, না কালো। সার সার পিঁপড়ে এগিয়ে চলেছে তো চলেছেই। কয়েক দানা চিনি ছড়ালে কী হুড়োহুড়িই না পড়ত। বংশধরদের একটিকেও দেখতে না পেয়ে আজ চারু ভীষণ অসহায়। কনক অবাক হয়ে তাকে দেখছে।
চারু বলল, আচ্ছা কনক, পিঁপড়েরাও কী দূষণে হারিয়ে যায় নাকি?
ভাবভঙ্গি দেখে কনক এক গ্লাস জল নিয়ে আসে। গ্লাসের কানা চারুর ঠোঁটের কাছে ধরে। এদিকে চারুর মনে হচ্ছে, কনক তাঁর ঠোঁটে টলটলে বিষ ছুঁইয়ে দিতে চায়! মেশিনটাও পিছু ছাড়ে নি। সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে করাতের মতো ধারালো দাঁতগুলো বের করে হাসছে।
কী ভয়ঙ্কর! দরজা ভেঙে ঢুকতে চাইছে। কেলিয়ে উঠে বীভৎস মেশিনটা বলল, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝবে না? ঘরে খানিকটা জায়গা আছে দেখছি। আরামসে এঁটে যাব।
– আমার আর কনকের জীবনে কোনও জায়গা হবে না। বেরোও, আহাম্মক কোথাকার, বেরোও।
চারু চিৎকার করে। একটানা চিলচিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এল। আর বিভ্রান্তের মতো মোবাইলের সুইচ টিপছে কনক।
ওহ, কী বজ্জাত। কুত্তাটাকে এখনও পিষে মারছে মেশিন। চারুও আর মায়ের প্রাণ খুঁজে পাচ্ছে না। বেইজ্জত হয়ে যাচ্ছে সব।
ওরা বলল, এখনই ডাক্তার ডাকো। সাইক্রিয়াটিস্টের ফোন নম্বর…,
চারুর চোখ লাল। তুমুল চিৎকার করে চারু বলল, কে তুমি?
একই বিনয়ের সঙ্গে মেশিনটা বলল, এবার আমার পরিচয়টা দিই। আমার নাম মিনিং। বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়াচ্ছে, মানে।
স্রেফ একটা বাচ্চা ছেলের আবদারের কান্না কাঁদছে চারু। নাছোড়বান্দা চারু।
– এখনই কিছু পিঁপড়ে চাই, এখনই।

(চিত্রণ – রু)

1 thought on “যখন বাজে মানেটা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.