সুব্রতা দাশগুপ্ত

ভানুর আব্দারেই গল্প বলা শুরু। কিন্তু সব গল্প তো আর ছয় বছরের ছেলেকে বলা যায়না! তাই এখানে …” -সুব্রতা

কাল রোববার। আজ থেকেই সাথী প্ল্যান করে রেখেছে কাল সারাদিন রিল্যাক্স করবে। অফিস ফেরৎ বিগ বাজার থেকে কফি, গুঁড়ো দুধ, নানাবিধ বিস্কুটের প্যাকেট, চিপ্‌স্‌, ম্যাগি ন্যুডলস্‌, রেডি-টু-কুক পালক পনীর, নানারকম সস আরো সব হাবিজাবি খাবারদাবার কিনে ঘর ভর্তি করেছে। অনেকদিন পর রোববার বাড়িতে কেউ থাকবে না আর তাকেও কোথাও যেতে হবে না। নিশ্চিন্ত।
সাথীর বাড়ি বোলপুর। কলকাতায় আছে এম.এ. পড়ার সময় থেকে। তখন তো শ্যামবাজারের কাছে এক জায়গায় পেয়িং গেস্ট হয়ে ছিলো। ফলে নিয়মের মধ্যেই থাকা। রাত আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হোত। সকালে দেরী করে উঠলে আর ব্রেকফাস্ট পাওয়া যেত না। আরো নানারকম নিয়মের কড়াকড়ি ছিল।
সে সব দিন এখন গেছে। সাথী এম.এ. পাশ করেছে। ভদ্রগোছের একটা চাকরিও পেয়ে গেছে। সেকটর ফাইভে অফিস। বাবা রিটায়ার করে নিউটাউনে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনেছেন। যদিও বোলপুরের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে কারুরই কলকাতায় আসার ইচ্ছা নেই। তাছাড়া সাথীর মেজদিও বোলপুরে থাকে, স্কুলে পড়ায়। তার ছেলেটাও দিনের বেলা মার কাছে থাকে। তাই ফ্ল্যাটটা খালিই পড়ে ছিল। চাকরি পাওয়ার পর থেকে সাথী ঐ ফ্ল্যাটেই থাকছে। খালি ফ্ল্যাট ফেলে রাখার তো কোনো মানে নেই। ব্যাপারটায় বাবা-মার আপত্তি ছিল। একা একা থাকা। সাথী আমল দেয়নি। সে একা একা স্বাধীনভাবে থাকতে চায়। আসলে বাবা-মা-ঠাকুমা দুই দিদির মাঝখানে সাথীর কোনো দিন একা থাকা হয়ে ওঠেনি। এই শখ তার অনেকদিনের। সাথী ছোট থেকেই একটু জেদি আর আহ্লাদী গোছের। তার ওপর এম.এ. পাশ করে পট্‌ করে একটা চাকরিও পেয়ে গেছে। তাই তার ওপর কেউ আর বিশেষ জোর করতে পারেনি।
কিন্তু একা থাকার কি যো আছে? সাথী চাকরি পেয়েছে মাস তিনেক হোল। প্রথম মাসটা তো মা এসে ছিলেন। কারণ তখন মেজদির স্কুল ছুটি ছিল। তারপর কোথা থেকে একজন মহিলাকে যোগাড় করে ফেললেন। তিনি সোম থেকে শুক্র থাকবেন। শনি-রবিবার থাকতে পারবেন না। ফলে দ্বিতীয় মাসটা – নয় মা শনিবার চলে আসতেন, না হয় সাথী বোলপুর যেত। এ মাসে বাবার শরীরটা একটু বিগড়োতে মা আর আসতে পারছেন না। কিন্তু তাতে কি? ভবানীপুরে সাথীর ছোটপিসি বলেই দিয়েছে মা না আসলে বা সাথী বোলপুর যেতে না পারলে ভবানীপুরেই থাকতে হবে। ও বাড়িতে বিশাল গ্যাঞ্জাম। প্রচুর লোক, জয়েন্ট ফ্যামিলি, ঘর কম। সাথীর খুব বিরক্ত লাগে। এদের সব মাথা খারাপ, একা থাকলে যে কি সমস্যা সাথী বুঝতে পারে না। একটা হাউসিং কমপ্লেক্সের মধ্যে ফ্ল্যাট। এতগুলো সিকিওরিটি, ফ্ল্যাটে কোল্যাপসিবল গেট, বারান্দায় গ্রিল – আর কি চাই? সাথীর অফিস যাতায়াতও খুবই নিরাপদ। অফিসের গাড়ী সকালবেলা বাড়ির সামনে থেকে তোলে আবার রাত আটটার মধ্যে পৌঁছে দেয়। শনিবার আগে ছুটি বলে সাথী আর গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে না। এর মধ্যে বিপদটা কোথায়? সে কথা আর কাকে বোঝাবে?
এই শনি-রবিবারটা যে কি ভাগ্য করে ফাঁকা পেল তা সাথীই জানে। আসলে যে মহিলা সারা সপ্তাহ থাকেন তিনি বলেছিলেন এই শনি-রবিবার বাড়ী যাবেন না। মা, পিসি সবাই তাই জানত। কিন্তু হঠাৎ-ই তার খুড়শ্বশুর দেহ রাখায় বাড়ি থেকে ফোন এসেছে যেতে হবে। সাথী মহানন্দে তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পড়তে বলল। মা ভাগ্যিস জানে না, জানানোর দরকারও নেই। মাকে জানাতে বারণ করে দিল সাথী, অকারণ চিন্তা বাড়িয়ে লাভ নেই। মা হয়তো শুনেই ট্রেন ধরবে।
তিনটের সময় অফিস ছুটি হয়। সাথী আর রিমি বেরিয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। রিমির প্রচুর বিয়ে বাড়ির গিফট্‌ কিনতে হবে আর সাথী খাবারদাবার কিনবে। রিমির সাথে সাথীর ভালোই ভাব আছে, কিন্তু রিমির অনেক সমস্যা। আর সেই সব কাহিনী সাথীকেই শুনতে হয় – সেটাই মুশকিল। আজ আর এসব ভালো লাগছে না। বাড়ী ফিরে সাথী কি কি করবে এই ভাবনাতেই বুঁদ হয়ে আছে। বাকী ফ্ল্যাটটা মা ছবির মতো সাজিয়ে ফেলেছেন, শুধু সাথীর ঘরটাই বাকী। সাথী নিজের ঘর নিজেই সাজাতে চায়। চাকরি পেয়ে একটা বুক শেলফ্‌ কিনেছিল। কিন্তু বইগুলো এখনো স্যুটকেস থেকে বেরোয়নি। মেলায় গেলেই টুক্‌টাক্‌ ঘর সাজানোর জিনিস কেনা সাথীর অভ্যাস। সেই সব জিনিসও বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে। আজ তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে রাত্তির অবধি ঘর গোছাবে সে। তারপর সিনেমা দেখতে দেখতে বা গান শুনতে শুনতে ঘুম দেবে। কাল সকাল এগারটার আগে উঠবে না।
বাড়ি ফিরতে ফিরতেই সাতটা বেজে গেল। রিমির গিফট্‌ কেনার শেষ নেই। সাথীকেও ছাড়বে না। বাড়ি এসে অবশ্য মনটা ভালো হয়ে গেলো। মহিলা বেশ কাজের। ঘরদোর গুছিয়ে রেখেছেন। টেবিলের ওপর বিকেলের জন্য পরোটা আর আলুর চচ্চড়ি, রাত্রের জন্য ক্যাসারোলে ভাত আর মুরগীর ঝোল করে রেখে গেছেন। এমন কি প্লেট, বাটি, চামচ, গ্লাস সব সাজিয়ে রাখা। মা যে এনাকে কিভাবে যোগাড় করল কে জানে! মার কাজের লোক জোগাড় করা আর তাদের ট্রেনিং দেওয়ার একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। সাথীদের বোলপুরের বাড়ীতে তিনজন কাজ করে বহুদিন ধরে। তাদের সাথী জন্ম থেকে দেখছে। দারুণ এফিসিয়েন্ট কিন্তু ওবিডিয়েন্ট – এরকম কম্বিনেশন সহজে পাওয়া যায় না। যাই হোক এ বাড়ীরটিও যে মার ট্রেনিং কোর্সের মধ্যে দিয়ে গেছেন সেটা বোঝা যায়। মহিলার নামটাই জানা হয়নি। ‘মাসি মাসি’ করেই কাজ চলে যাচ্ছিল। ইনি আবার লেখাপড়াও জানেন দেখা যাচ্ছে। ফ্রিজের দরজায় ম্যাগনেট আনারস দিয়ে চাপা দেওয়া একটা কাগজের টুকরোয় লেখা—“কাল সকালের দুধটা বন্ধ করা হয়নি নিয়ে নিও।” যাঃ গুঁড়ো দুধটা না কিনলেই হোত।
আজ আর বই গোছানো হবে না। রাতও হয়েছে, খিদেও পেয়ে গেছে। সাথী তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে খেতে বসল। মাকে ফোন করা হয়ে গেছে বিগ বাজার থেকেই। মাও বাড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করেনি সাথীও একা থাকার কথা বলেনি। ফোনটা এখন থেকে সাইলেন্ট করে দিলেই হবে। একটু টিভি দেখলে হয়, অনেকদিন দেখা হয় না। খাওয়া সেরে সোফাতে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে। মাঝরাতে ঠাণ্ডায় ঘুম ভেঙে গেলো। তাড়াতাড়ি টিভি বন্ধ করে ঘরে গিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুল। কাল রোববার, কি মজা! সারাদিন একা একা…।
সকাল সাতটায় প্রথম বেল বাজল। তিনবার বাজার পর সাথীর ঘুম ভাঙল। ঘুম চোখে দরজা খুলতে এসে দেখে রাত্রে দরজাই বন্ধ করা হয়নি। কোল্যাপসিবল গেটও খোলা। যাক্‌ গে বিপদ তো হয়নি কিছু। দুধওয়ালা বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। “কতবার বেল মারব দিদি? মাসিমা নেই? দুধের বিলটা দেওয়া ছিল। টাকাটা দেবেন?” এক নিশ্বাসে বলে ফেলে লোকটা।

– “কত টাকা?”
– “দেখুন না বিলটা। ওতেই আছে।”
বিল খোঁজা সাথীর কর্ম নয়
– “আমাদের কত টাকা হয়? আন্দাজে একটা বলুন না।”
– “থাক তাহলে মাসীমা এলেই দেবেন। এভাবে কি বলা যায়? আপনারা তো সারা মাস নেন না। থাক দিদি আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি পরে নিয়ে নেব।”
সাথী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তাড়াতাড়ি সোজা লেপের মধ্যে ঢুকল।
সকাল আটটায় দ্বিতীয় বেল। সাথী এবার একবারেই জেগেছে।
– “ময়লাটা দেবেন?”
– “কি?” সাথী ভালো বুঝতে পারেনি।
– “ময়লা, ময়লা, ডাসবিন! মাসীমা নেই?”
– “না আমি দিচ্ছি।”
– “রান্নাঘরে দেখুন। ওখানেই থাকে।” এ দেখছি সব জানে। রান্না ঘর থেকে ডাস্টবিনটা বার করতেই ছেলেটা বলল—
– “আর একটা বাঁশের আছে বারান্দায়।”
– “বাঁশের না বেতের।”
– “ওই একই হোলো।”
সাথী আর কথা বাড়ালো না। খালি ময়লার বালতি গুলো যথাস্থানে রেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল আর একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যেতে পারে। সবে তো আটটা আর তো কেউ আসার নেই।
সকাল ন’টায় তিন নম্বর বেল।
“একটু জল দেবেন?” ঝাঁটা হাতে একটা ছেলে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
– “জল? খাবার জল?”
– “আরে দিদি, সিঁড়ি ধোবার জল। তাড়াতাড়ি দিন। এক বালতি হলেই হবে। দিন্‌ দিন্‌।”
কি তাড়া রে বাবা! যেন ঘোড়ায় জিন্‌ দিয়ে এসেছে।
ঘুমটা এখন পুরো কেটে গেছে। বাথরুম থেকে এক বালতি জল এনে দরজার বাইরে বসিয়ে দিলো সাথী। নিমেষের মধ্যে ছেলেটা জল ঢেলে দিলো সিঁড়িতে। কি পরিষ্কার করল কে জানে। খালি বালতিটা ঠক্‌ করে ঘরের মধ্যে রেখে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। সাথী বুঝেছে এবার ঘুমের আশা ত্যাগ করতে হবে। সকাল থেকে গয়লা, ময়লা, ঝাড়ুদার এসে গেছে। আবার বেল। এবার খবরের কাগজ। এটার দরকার ছিলো। সাথী খুশী হয়ে ভাবল এবার এক কাপ কফি সহযোগে অনেক্ষণ ধরে কাগজ পড়বে।
হাত-মুখ ধুয়ে সবে এক কাপ কফি বানাতে যাবে আবার বেল।
– “দিদিভাই, মাসীমা নেই বুঝি?”
পাজামা-পাঞ্জাবী শাল পরিহিত এক ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখে দাঁরিয়ে আছেন।
– “মা একটু বোলপুরে গেছেন। কি দরকার বলুন?”
সাথী মুখটা একটু হাসি হাসি করার চেষ্টা করে।
– “আসলে সরস্বতী পুজোর চাঁদাটা যদি দিয়ে দিতেন। বেশী দেরী তো নেই। মাসীমা জানেন। ওনাকে বলা আছে সব।”
– “কত দেব?”
– “হেঁ হেঁ দিদিভাই, মাসীমার সঙ্গে তো কথা হয়েই গেছিল। এবার আসলে ব্যাপক খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থাকছে। ইলিশ মাছ-টাছ – এলাহি ব্যাপার।”
– “সরস্বতী পুজোয় ইলিশ মাছ?”
– “আরে ছেলেদের আবদার। আমাদের তো সবার কথাই রাখতে হয়। হেঁ হেঁ।”
– “কো-অপরেটিভ-এর মেইনটেনেন্সের মধ্যেই পুজোর চাঁদা ধরা থাকে না?”
– “আরে দিদিভাই, তাই দিয়ে কি আর এত দেবদেবীকে সন্তুষ্ট রাখা যায়? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।” হাসি আর থামেই না। সাথী তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করে – “তাহলে কত দিতে হবে? মা কতো দেবেন বলেছিলেন?”
– “মাসীমার সঙ্গে তো পাঁচশো টাকার কথা হয়েছে। আমি বিলও কেটে এনেছি।”
– “পাঁচশ? আচ্ছা একটু দাঁড়ান নিয়ে আসছি।”
– “আরে দিদিভাই তাড়া নেই। আপনি ধীরে সুস্থে আনুন। আমি বসছি। মাসীমার সঙ্গে তো কত গল্প হয়। আপনার সঙ্গেই আলাপ হয় নি। আজ কেমন হয়ে গেলো। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।”
সাথী প্রমাদ গোনে। ইনি একবার বসলে সহজে উঠবেন না। যে তাড়াতাড়ি বলল—
“না না এক্ষুণি দিচ্ছি। আসলে এই উঠলাম তো। কোনো কাজই হয়নি।”
বলেই বুঝল কি ভুল করেছে।
– “দিদিভাইয়ের চা খাওয়া হয়নি নাকি? তাহলে এক কাপ হয়ে যাক্‌। শীতটা জমিয়ে পড়েছে।”
সাথী ক্ষীণ স্বরে শেষ চেষ্টা করে—
– “চা তো আমি খাই না। কফি খাব।”
– “আরে দিদিভাই, শীতকালের সকালে এক কাপ গরম গরম কফি – ব্যাপক হবে।”
ইনি কথায় কথায় ব্যাপক বলেন আর – হাঃ হাঃ করে হাসেন।
সাথী আর কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে সোফায় জমিয়ে বসলেন। সাথী আর দেরী না করে কফির জল বসিয়ে টাকাটা আনতে গেলো। যত তাড়াতাড়ি এনাকে কফি খাইয়ে বিদায় করা যায় ততই মঙ্গল।
ভদ্রলোক আবার শুরু করলেন—
“দিদিভাই আপনারা কতদিন আছেন শান্তিনিকেতনে?”
– “শান্তিনিকেতনে না বোলপুরে।”
– “ওই একই হোল।”
এই কমপ্লেক্সের ঝাড়ুদার থেকে ফ্ল্যাটের মালিক সবারই “ওই একই হোল” বলার অভ্যাস। সাথী আর কথা বাড়ায় না। কফি নিয়ে টেবিলে রাখল। বিস্কুট দেবে কি না ভাবছে।
– “দিদিভাই, একটা বিস্কুট থাকলে দিন। আমি আবার শুধু কফি খেতে পারি না। অম্বল হয়।” এই রে। এবার অম্বলের কথা শুরু হলে আর রক্ষে নেই। তাড়াতাড়ি বিস্কুটের কৌটোটা এনে হাজির করে সাথী।
– “এই যে টাকাটা। আমাকে আবার একটু বেরোতে হবে।” ধাঁ করে মিথ্যে কথাটা মুখে এসে গেলো। তা না হলে এনাকে ওঠানো কঠিন।
– “আরে তাই নাকি? আগে বলবেন তো? আজও অফিস নাকি? সত্যি আপনাদের দারুণ খাটায় না? অল্প বয়সী মেয়ে পেয়েছে। তবে কফিটা আপনি ভালোই বানান। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।”
টাকাটা নিয়ে দরজার দিকে এগোলেন ভদ্রলোক।
ঘড়িতে দশটা বেজে গেছে। স্নান করে নেওয়া যাক্‌। গিজারটা চালিয়ে বিছানাটা তুলে ফেলল সাথী। তোলা আর কি! পাতাই হয়নি ভালো করে। বাসনপত্র গুলোও ধুয়ে ফেলতে হবে। কাজ ফেলে রেখে লাভ নেই। আবার কাদের উপদ্রব শুরু হবে।
স্নানটা নির্বিঘ্নে সারা গেছে। তবে দুপুরে আর জাঙ্ক ফুড গুলো খেতে ইচ্ছা করছে না। রবিবার দুপুরে ভাত-মাংস – এতো কতদিনের অভ্যেস। কাল রাত্রের মুরগীর ঝোল আছে একটু আর ভাত করে নিলেই হবে। সবে চাল ধুয়ে বসিয়েছে – আবার বেল বাজল। সাথীকে কি কেউ শান্তিতে থাকতে দেবে না?
দরজার বাইরে সিল্কের শাড়ী, মাটির গয়না পরিহিত দুই মূর্তি, হাতে কতগুলো ফর্ম। এরা আবার কারা?
– “ম্যাডাম, ব্যস্ত? একটু সময় হবে?” যাক্‌ এরা অন্ততঃ সময় হবে কিনা জিজ্ঞাসা করেছে।
– “বলুন।”
– “আসলে আমরা এখানে একটা মেডিটেশন ক্যাম্প করছি। আপনি যদি একটু পার্টিসিপেট করতেন খুব ভালো হত। দেখবেন একটু আমাদের কাগজপত্রগুলো?”
– “আপনাদের সঙ্গেও কি মার কথা হয়েছে?”
– “না, না ম্যাডাম, আমরা আজই নতুন আসছি। এই কমপ্লেক্সে আগে আসিনি। একটু বসতে পারি?”
– “এই একটু রান্না করছিলাম। বলুন না।”
– “আমরা বেশী সময় নেব না ম্যাডাম, জাস্ট পাঁচ মিনিট। একটু বসি?”
সাথী নিরুপায়। বসতে দেওয়া ছাড়া গতি নেই।
– “এটা সাতদিনের কোর্স ম্যাডাম। সময়টাও খুব কনভিনিয়েন্ট। রাত আটটা থেকে। আপনাদের মতো ওয়ার্কিংদের জন্য আদর্শ। আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে আপনি খুব স্ট্রেস্‌ড্‌। আপনি কোর্সটা করে দেখুন। খুব উপকার পাবেন।”
সাথীকে স্ট্রেস্‌ড্‌ লাগছে? লাগলে আর দোষ কি? সকাল থেকে যা চলছে। মেয়েটি বলেই চলে –
– “কোর্স ফি-ও বেশী না। পার ডে একশ টাকা। এখন তিন দিনেরটা অ্যাডভান্স নিচ্ছি। বাকীটা ওখানে গিয়ে জমা দেবেন।”
এরা ধরেই নিয়েছে সাথী কোর্সটা করছে। কিন্তু সাথী এবার শক্ত হোল।
– “দেখুন আমি খুব সরি। এই কোর্সটা আমার পক্ষে করা সম্ভব না। আমার বাড়ি ফিরতেই আটটা হয়ে যায়। তারপর এত টায়ার্ড লাগে যে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।”
– “এটাই তো সবার সমস্যা। আপনি একদিন কষ্ট করে আসুন। পরদিন দেখবেন আপনি আসার জন্য ছট্‌ফট্‌ করছেন। মেডিটেশন এমনই জিনিস। ক্লান্তিটান্তি সব হাওয়া হয়ে যাবে। কত কাজ করতে ইচ্ছা করবে, লাফাতে ইচ্ছা করবে। খিদে হবে, ঘুম হবে।”
সাথীর খুব খিদে পাচ্ছে, সঙ্গে ঘুমও। কিন্তু সে কথা এদের বলে লাভ নেই।
– “আচ্ছা ফর্মটা রেখে যান। আমি যদি যাই তাহলে ফিল আপ করে আপনাদের কাছে জমা দেব।”
– “আমরা তো আর আসব না ম্যাডাম। আজই জমা দেবার শেষ দিন। সব তো ভর্তিই হয়ে গেছে। এই কটা ফর্ম পড়ে আছে দেখুন।”
সাথী দেখেছে এক গোছা ফর্ম পড়ে আছে। এত বাজে কথা বলে না এরা।
– “আসলে আমার কাছে এখন টাকা নেই। তুলতে যাব যাব করে বেরোতেই পারছি না।”
– “ওঃ ম্যাডাম, তিনশো টাকাও হবে না?”
– “ছিলো তো। সকাল থেকে দুধের বিল, সরস্বতী পুজোর চাঁদা দিয়ে সব শেষ হয়ে গেলো। মাত্র একশ টাকা পড়ে আছে।” দুধের বিলটা যোগ করে সাথী।
মেয়েদুটির মুখ প্যাঁচার মতো হয়ে গেছে। ফর্মটা রেখেই যাবে স্থির হল। বিকেলের দিকে এসে নিয়ে যাবে। তার মধ্যে সাথী যেন অবশ্যই টাকা তুলে রাখে।
সাথী খেতে বসল বেলা দেড়টায়। ভাত আর রাত্রের মুরগীর ঝোল। ফ্রিজে টক্‌ দই ছিল। খাওয়াটা মন্দ হোল না। কিন্তু এবার কি হবে? বাড়িতে থাকতে ভরসা হচ্ছে না। বিকেল বেলা তো আবার মেডিটেশন পার্টি এসে হাজির হবে। আরও কত অজানা অচেনা বন্ধুর দল এসে হাজির হবে বলা যায় না। কাছেই সিটি সেন্টার টু। একটা সিনেমা দেখে আসবে? একা একা সিনেমা দেখতে যাওয়া ব্যাপারটা বোরিং। কারুর সাথেই কোনো প্ল্যান করা নেই। তার বয়সী কেউই রবিবার বিকেলে বাড়ী বসে রিল্যাক্স করে না। কোথাও না কোথাও চরতে বেরোয়। সাথীর কয়েকজন আঁতেল বন্ধুর একটা আঁতেল আড্ডার ঠেক আছে। সেখানে গেলে তারা খুশীই হবে। কিন্তু যাবে কেন?
হঠাৎ মনে পড়ল ফোনটা সেই কাল রাত থেকে সাইলেন্ট মোডে করা আছে। মা হয়তো অনেকবার ফোন করেছে। সে তাড়াতাড়ি দেখল। না, মার একটাও ফোন নেই। ব্যাপার কি? মা হঠাৎ এত নিশ্চিন্ত হয়ে গেলো কি করে? বলতে বলতে মার ফোন—
– “কিরে একা একা কি কি মজা করলি?”
– “তুমি জানো আমি একা আছি?”
– “হ্যাঁ, ঝর্ণা বলল তো ফোন করে। বলল তুই নাকি বলতে বারণ করেছিস? আর তুইও তো সন্ধ্যেবেলা ফোন করে কিছু বললি না? তোর মেজদি বলল, ও এত `একা থাকব’ একা থাকব’ করে। থাক্‌ না একটা দিন। কি আর হবে। ওকে আর ডিসটার্ব কোরো না। তা খুব মজা হয়েছে তো?”
– “মজার কি আছে?” সাথীর গলায় বিরক্তি।
– “না তাই বলছিলাম আর কি। রাত্রে দরজা ঠিক করে বন্ধ করেছিলি তো? না কি ভুলে গেছিস?” মা কি অন্তর্যামী? সাথী উত্তর দিল না।
– “কিরে কথা বলছিস না কেন? ময়লা টয়লা বার করে দিয়েছিস তো? নাকি জমিয়ে রেখেছিস? ঘরে খুব গন্ধ হবে কিন্তু। দুধ দিয়েছে তো? দুধের বিলটা ফ্রিজের মাথায় ছিলো, পেয়েছিস?” মার নানাবিধ প্রশ্ন।
– “আমি বিল-টিল খুঁজে পাইনি। পরে নেবে বলেছে। দুধ নিয়েছি তো। ময়লাও বার করেছি। সিঁড়ি ধোওয়ার জলও দিয়েছি। সরস্বতী পুজোর চাঁদাও দিয়েছি। পাঁচশ টাকা। তোমার সঙ্গে নাকি কথা হয়েছিল?”
– “ও স্বর্ণকমলবাবু এসেছিলেন?”
বাবা, নামের কি বাহার! স্বর্ণকমলবাবু।
– “হ্যাঁ সেই বাবুটিই মনে হয়। খুব কথা বলে আর হাসে। অসহ্য একদম।”
– “ইস্‌ তাহলে তো তোর সকালের ঘুমটা একেবারে মাটি হয়ে গেলো নারে? ময়লার বালতিটা রাত্রে বার করে রাখলি না কেন? তাহলে তো ভোর বেলা উঠতে হোত না।”
– “আর দুধটা কি করে নিতাম? লোকটা তো বিল বিল করে অস্থির। সেই জন্যও তো বেল দিচ্ছিল।”
– “দরজার বাইরে একটা বাজারের থলি ঝুলিয়ে রাখলে দুধের প্যাকেটটা তার মধ্যেই দিয়ে যায়। বুঝলি? আমি তো তার মধ্যেই একবার বিল আর টাকাটা কাগজে মুড়ে দিয়ে দিয়েছিলাম। এসব ব্যবস্থা না করলে ঘুম তো ভাঙাবেই সোনা।”
– “তা এসব আমাকে আগে বলে দিলেই হোত। তুমি তো জানতে আমি একা থাকব।”
– “আমি তো বলার জন্য ফোন করছিলাম। মেজদি বারণ করল। কি করব বল?”
মেজদির ওপর খুব রাগ হচ্ছে সাথীর। সব সময় সাথীকে জব্দ করার তাল।
– “রাগ করিস না। একা থাকার মজাও যেমন আছে, ঝামেলাও তো আছে? যাক, গে, বেরোবি না কি কোথাও?”
সাথী প্রথমে ভেবেছিলো পালাবে। এখন মত পালটেছে।
– “না বাড়িতেই থাকব। দেখি আর কে কে আসে? তুমি চিন্তা কোর না। আর মেজদিকে বোলো সকালে উঠতে হয়েছে, ঠিকই, কিন্তু সারাদিন বেশ মজাই হয়েছে।” কট করে ফোনটা কেটে দিলো সাথী।
বিকেল চারটে অবধি নির্বিঘ্নেই কাটল। এমনকি দুপুরে একটা সিনেমাও দেখে ফেলল।
সাড়ে চারটে নাগাদ আবার বেল। মেয়ে দুটির সাজগোজ একটু মলিন হয়ে গেছে সারাদিনের ধকলে। সঙ্গে, আবার দু’জন লোক – এই কমপ্লেক্সেরই বোধ হয়। তাদের অবাক করে এক গাল হেসে সাথী অভ্যর্থনা জানাল।
– “আসুন আসুন আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বসুন বসুন। আপনাদের ঠিক চিনলাম না তো?” সাথী ভদ্রলোক দুটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। আবার নিজেই উত্তর দেয় –
– “আসলে আমি তো সারাদিন বাড়িতেই থাকি না। তাই এখানকার কারুর সঙ্গে পরিচয় হয়নি। আজ সকলে শুধু স্বর্ণকমলবাবুর সাথেই যা আলাপ হোল।”
সাথী বলেই চলে –
– “আমি খুব দুঃখিত জানেন। আপনাদের কোর্সটা করতে পারব না বলে। আমার খুব ইচ্ছা ছিল। সত্যি আমরা সবাই খুব চাপের মধ্যে থাকি। আপনারা যে এরকম একটা উদ্যোগ নিয়েছেন সেটা দেখেও ভালো লাগছে।”
মেয়েদুটি কিছু একটা বলার জন্য হাঁ করতেই সাথী আবার শুরু করে –
– “আসলে আমি না বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি – এটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। এখনো রয়ে গেছে। রাত আটটায় বাড়ি ফিরি। খুব খিদে পায়। খেয়ে নি। তারপরই ঘুম। কখনো কখনো ঘুম ভাঙে, কখনো ভাঙেই না। তখন কেউ যদি আমায় জোর করে জাগাতে যায় তাহলেই খুব বিপদ। সব বমি হয়ে যায়।”
– “সে কি?” চারজন সমস্বরে বলে ওঠে।
– “হ্যাঁ দেখুন না। মা তো প্রথম প্রথম বুঝতে পারত না, ডেকে ফেলত। আর ব্যাস্‌! সেই রাত্রে বমি টমি পরিষ্কার করে একাকার কাণ্ড। কি বিপদ হবে বলুন তো আপনাদের ওখানে মেডিটেট করতে করতে যদি ঘুমিয়ে পড়ি? আপনারা তো কেউ আমায় তুলতেই পারবেন না। এই জন্যই বলছি, আমাকে আপনাদের ক্লাসে ভর্তি হতে বলবেন না। সবাই কে তো এসব বলা যায় যায় বলুন?”
এতক্ষণে মেয়ে দুটির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বাবু দুটিও অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। সাথীর বক্তৃতায় কাজ দিয়েছে। সে আবার শুরু করে –
– “আজ যেমন আমার অফিস ছিলো না। আজ আবার তাড়াতাড়ি ঘুম পেয়ে যাবে। আজ সন্ধ্যের পর এ বাড়িতে কেউ এলে খুব মুশকিল হয়ে যাবে। এই জন্যেই আমি কখনো একা থাকি না জানেন তো?”
এতক্ষণে একটি বাবু মুখ খুলেছেন –
– “তাহলে আপনি একা থাকলে কারুর না আসাই ভালো।”
– “সে তো বটেই। বিশেষ করে বিকেলের পর। দয়া করে সবাইকে একটু বলে দেবেন, হ্যাঁ।”
– “নিশ্চই, নিশ্চই। তাহলে এবার আমরা উঠি। আপনার আবার ঘুমের সময় হয়ে যাবে।”
– “আরে না না, এখনি কি? বসুন না একটু কফি খাবেন?”—
– “না না, আমরা উঠব।” মেয়ে দুটি চট্‌ পট্‌ কাগজপত্র গুছিয়ে নেয়। সাথী ভদ্রতা করে ওদের দরজা অবধি এগিয়ে দিল।
– “ম্যাডাম, একটা কথা বলব? কিছু মনে করবেন না তো?”
একটি মেয়ে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে।
– “না না, মনে করব কেন? বলুন না।”
– “না মানে, বলছিলাম কি, আপনার দরজার বাইরে একটা কাগজে “বমি হইতে সাবধান” লিখে ঝুলিয়ে দিলে ভালো হয়, তাই না? বিশেষ করে ঘুমোতে যাবার আগে। তাহলে আর কেউ আসবে না।”
– “ঠিক বলেছেন। সেই রকমই একটা কিছু করতে হবে। থ্যাঙ্ক ইউ। বাই বাই।”
নিজের সম্পর্কে এরকম একটা গল্প বানিয়ে সাথী খুব উত্তেজিত। তবে কাগজ ঝোলানোর আর দরকার হবে না। এ গল্প বাতাসে উড়বে। কুকুরে ভয় না থাকতে পারে কিন্তু বমিতে ভয় নেই – এরকম লোক বিরল। সাথী একা একাই কিছুক্ষণ হাসল। যাক আজ সন্ধ্যেটা শান্তিতে কাটানো যাবে – এটা নিশ্চিত। তবে তার আগে এই কথাটা একবার মেজদিকে জানানো দরকার। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ব্যাপক মজা হয়েছে।

(চিত্রণ – রু)

7 thoughts on “রোববার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.