নীতা মণ্ডল

জন্মেছিলাম গ্রামবাংলায়। বীরভূম জেলার বিপ্রটিকুরী উচ্চবিদ্যালয় ও বোলপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে উচ্চশিক্ষা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশা অধ্যাপনা আর নেশা বই পড়া, গান শোনা ও আড্ডা দেওয়া। ফলে যা হল, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাকে দেখে মনে হতে লাগল ‘ঠিক যেন গল্পের মত!’ আবার, আড্ডার ফাঁকেই মনে হল, এই কথাগুলো জুড়ে দিলেই তো নতুন গল্প জন্ম নেবে। তাই এখন অণুগল্প, ছোটগল্প ও বড় গল্প লিখি লেখার আনন্দে।


(১)

রাস্তাটা সাপের মত একটা বাঁক নিয়ে সোজা চলতে শুরু করেছে। ঠিক ওই বাঁকের মুখে দোতলা পাকা বাড়িটা হাই ইশকুল। একতলার শেষ ঘরটার দরজার উপরে সবুজ কালিতে বড় করে লেখা ভি-এ। দরজার পাশে একটা আর উল্টোদিকে দুটো বড় বড় জানলা। জানলায় লোহার রেলিং থাকলেও পাল্লা নেই। ঢুকেই বামদিকে ব্ল্যাকবোর্ড। তার সামনে কাঠের চেয়ার টেবিল। দুই সারি বেঞ্চ টেবিলের হাত তিনেক দূর থেকে শুরু হয়ে থেমেছে একটা অসমাপ্ত দেওয়ালে। দেওয়ালের ইঁটগুলো যেন দাঁত বের করে আছে। ওপাশে ভি-বি।

সবে তিন দিন হল পঞ্চমশ্রেণীর ছেলেমেয়েরা আসছে। এখনও সবার সব বই কেনা হয় নি। বইয়ের তালিকা প্রথমদিনেই পেয়েছে ওরা। পর দিন বিভাগ নির্দিষ্ট হয়েছে আর রুটিন দিয়েছে। ‘বুক লিস্ট, রুটিন, সেকশন’ এসবই নতুন ওদের কাছে। এমন কি বই কেনাটাও, আর স্কুল থেকে বই দেবে না।

এক ঘন্টার টিফিন। যারা এ গ্রামের, তারা বাড়ি গিয়েছে। হঠাৎ একদল মেয়ে এসে ঢুকল ক্লাসে। ওদের একজন প্রতিনিধি বলল ‘আমার নাম সোমদত্তা ব্যানার্জি। আমরা এইটে পড়ি। তোদের সঙ্গে পরিচয় করতে এলাম।’

ওরা বসে পড়ল নিজেদের জায়গায়। তারপর একজন একজন করে নিজের পরিচয় দিতে শুরু করল।

‘এই, এই আলো এবার তোর দান।’ বলে আলোর কোমরে খোঁচা দিল ডালিয়া। জানলার বাইরের ধান খেত ছাড়িয়ে দূরের পুকুরটার দিকে তাকিয়ে ছিল ও। সোমদত্তা বলল, ‘কবি কবি ভাব।’ ‘হি হি’ হাসির থামার আগেই সসংকোচে উঠে দাঁড়াল আলো। নিজের নাম, বাবার নাম, পুরনো স্কুলের নাম, গ্রামের নাম বলে বসতে গেল। ওরা বলল, ‘দাঁড়া, বসিস না। তোদের গ্রামের রমাকে চিনিস?’

‘হ্যাঁ। রমাপিসিদের আর আমাদের লাগালাগি বাড়ি।’ বলল আলো।

‘রমা, পিসি?’ বলেই হাসতে শুরু করল ওরা, ‘তা রমাপিসি আজ আসে নি কেন রে?

ইস্, আজই রমাপিসিকে কামাই করতে হল! ভেবে আলো বলল, ‘শরীর খারাপ।’

‘কি শরীর খারাপ? জ্বর, সর্দি, কাশি, পেট খারাপ?’ বলে ওরা একে অন্যকে চোখ টিপে ইশারা করল। যেন শরীর খারাপের থেকে মজার ঘটনা আর কিছু হয় না।

আলো বলল, ‘জানি না।’ রমাপিসির যে এর কোনটাই হয় নি সেটা ও জানে। স্কুল আসার সময় ডাকতে গিয়ে শরীর খারাপ শুনে ঠিক ওই প্রশ্নটাই ও করেছিল। উত্তরে রমাপিসির ঠাকুমা খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল, ‘তোর এত খোঁজে কি দরকার লো? কদিন পরে যখন নিজের হবে বুঝবি।’ কে জানে কি ছোঁয়াচে রোগ, ভেবে পালিয়ে এসেছিল। ওই ঝগড়ুটে বুড়ির সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকে নি। ছোঁয়াচে রোগের কথাটা ও এড়িয়ে গেল। তাছাড়া রমাপিসিকে ওর বেশ ভাল লাগে। তুলি বা ডালিয়া থাকলেও রমাপিসির সাহায্য ছাড়া এই ভিন গাঁয়ের স্কুলে মানিয়ে নিতে পারত না। ‘নিজের জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গেলেই মানিয়ে নিতে হয়।’ বাড়িতে তো দিনরাত শুনছে, ‘কত মানিয়ে নিতে হবে! মেয়ে হয়ে জন্মেছ, শ্বশুরঘর যেতে হবে, শাশুড়ি ননদ…।’ সেসব তো পরের কথা, ইশকুল পাল্টাতেই ওর তিনদিনে তিন অবস্থা। ভেতরটা কেমন খালি লাগে! সমানে বুক ঢিপ ঢিপ করে।

সবার পরিচয় দেওয়া শেষ হয়েছে। যারা বাড়ি গিয়েছিল, তারাও ফিরে এসেছে। পুরো শ্রেণীকক্ষ ভর্তি। সোমদত্তার কথায় আলো বাস্তবে ফিরল, ‘বিপ্রটিকুরী, মহুটার, মিলনপুর, কাদোয়া, পূর্বকাদিপুর, ডেঙ্গেরা, পুতুন্ডি, ইন্দাস, লালবাজার, সারিপা, মালিতপুর এতগুলো গ্রাম থেকে তোরা এসেছিস। যত স্কুল, তত ফার্স্ট বয়, ফার্স্ট গার্ল। ফাইভ থেকে সিক্সে উঠতে কে ফার্স্ট হয় সেটাই দেখার!’ ঢিল ছোড়ার মত করে চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দিল সোমদত্তা।

দেবদাস প্রামাণিক উঠে বলল, ‘আলো হবে। ও থ্রিতে পড়তে ফোরের অঙ্ক করে দিত। আমি একবার ফার্স্ট হয়েছিলাম। পরে ও আমাকে হারিয়ে ভূত করে দিয়েছে।’

দেবদাসের হেরে ভূত হয়ে যাবার আনন্দে সবাই হাসলেও আলো লজ্জায় মাথা নিচু করল। প্রথম বেঞ্চের মেয়েরা বলল, ‘ইংরাজির মাস্টার সুব্রতবাবুর মেয়ে সুপর্ণাকে কেউ হারাতে পারবে না।’

ছেলেদের দিক থেকে আবার শোরগোল উঠল। ‘সায়ন্তন হবে। যা বুদ্ধি! সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নোত্তরে  ওর মাথা গজগজ করছে। ক্যুইজে সবসময় ওর ফার্স্ট প্রাইজ বাঁধা।’

‘শুধু সায়ন্তন কেন? আশুতোষ আছে, পুষ্পিতা আছে। সেকেন্ড, থার্ড সবই এই গ্রাম থেকেই হবে।’ আগের দেওয়া চ্যালেঞ্জটা আর একটু শানিয়ে, সঙ্গে কিছু উপদেশ ও আদেশ দিয়ে দলটা বেরিয়ে গেল।

(২)

টিফিনের পর তিনটে ক্লাস। প্রথম ক্লাসটা অঙ্কের। সকাল থেকে চারটে ক্লাস হবার পর এই সময়টা সবাই নেতিয়ে পড়ে। একদল ভাত খেতে বাড়ি যায়। একদল ব্যাগ থেকে টিফিন বের করে। টিফিনও বিচিত্র। কারোর কাছে রুটি-আলুভাজা, কারোর পাউরুটি-কলা, কারোর শুধু গুড় আর মুড়ি। টিফিন কৌটোর মধ্যে কি আছে সেই অনুযায়ী খাবার সময় আলাদা আলাদা জটলা। আরও একটা দল আছে তাদের টিফিন বলে কিছু নেই। তারা বাড়ি থেকে বের হয় এক পেট মাড়-ভাত-আলুসেদ্ধ খেয়ে। আবার ফিরে এক পেট ভাত। কাজেই এই ঝিমঝিম ভাবটা সকলের ক্ষেত্রে যে ভাতঘুম তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে নাথুবাবুর ক্লাসে ঝিমিয়ে থাকার উপায় নেই। ওনার হাতে চক, ডাস্টারের সঙ্গে আরও একটা মূল্যবান জিনিস থাকে। একটা তেল চকচকে কঞ্চি। ঢুকেই উনি সেটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। গোটা ক্লাসরুম স্তব্ধ হয়ে থাকে।

নাথুবাবু আসতেই সকলে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। বাঘের ‘হালুম’ এর মত গমগমে স্বরে উনি বললেন ‘বসে পড়’। ‘হালুম’টা কিছুক্ষণের জন্য থামল। সেই ফাঁকে নাকে এক গাদা নস্যি ঠুসে নিয়ে বই খুললেন। সরল করার নিয়মগুলো ধাপে ধাপে লিখে, উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর ডাস্টার দিয়ে বোর্ডটা মুছে একটা অঙ্ক লিখে বললেন, ‘কে করতে পারবি?’
ক্লাসরুম আগের মতই নিস্তব্ধ।

‘পারবি? তাহলে উঠে আয়।’ গর্জন শুনে সবাই ঘুরে দেখল, আলো।

‘অঙ্কটা তো সোজা। তাছাড়া মাস্টারমশাই এত যত্ন করে বোঝান যে কোনদিনই আটকায় না।’ ভাবতে ভাবতে আলো এগিয়ে গিয়ে হাত পাতল। নাথুবাবু ওর হাতে চক দিলেন। তৃতীয় ধাপ লেখার পর ও পৌঁছল বোর্ডের নীচের প্রান্তে। অঙ্ক শেষ হয় নি, এখনও কয়েকটা ধাপ বাকি। বোকা বোকা মুখে তাকাতেই নাথুবাবু দুহাতে তুলে নিলেন। বললেন, ‘আহা। চেহারার কি ছিরি! তোকে তো বেগুনগাছে আঁকশি দিতে হয়! নে এবার কর বাকিটা।’

একদিকে নাথুবাবুর ঘামের, মাথার তেলের, নাকের নস্যির গন্ধ অন্যদিকে নিজের লজ্জা, ভয়, বুক দুরদুর এ সবকিছুই একত্রে আলোর চেতনাকে গ্রাস করল। অসাড়ে পুরো অঙ্কটা শেষ করে ও মুক্তি পেল। শীর্ণ পা দুখানা ঠকঠক করে কাঁপছে। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দ। নাথুবাবুর উপরের পাটিতে সবকটা দাঁত নেই। মুখের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ। ওনার তৃপ্তির হাসিটুকু রুক্ষতার আড়ালে হারিয়ে গেল। অঙ্কটা ঠিক হল না ভুল কে জানে! ওর কানের কাছে প্রতিধ্বনি হল, ‘এই স্কুলের অঙ্কের মাস্টাররা সবাই রাগী।’ সোমদত্তাদির সেই সাবধানবাণীটা আগে কেন মনে পড়ল না ওর!

আলোর চারিপাশে যেন মৌমাছির গুঞ্জন। পঞ্চম পিরিয়ড শেষ হবার ঘণ্টা পড়েছে। নাথুবাবু বেরিয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ ফিকফিক করে হাসছে। সায়ন্তনকে ঘিরে জটলা ‘তুই পারতিস না?’

একজন বলল, ‘নাথুবাবুর কোলে চাপতে পেতিস… হি হি…’

(৩)

ষষ্ঠ পিরিয়ড শেষ হতেই ওরা বই গুটিয়ে ফেলেছিল। আজকে সঞ্জয়বাবু নেই তাই বাংলার ক্লাস হবে না। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছলে অনেকক্ষণ খেলতে পাবে। ওদের আশায় ছাই দিয়ে হেডস্যার আবির্ভূত হলেন দরজার সামনে। এই দ্যুতিময় মানুষটিকে দেখলে ‘আবির্ভূত’ শব্দটাই মাথায় আসে। ক্লাস না নিলেও কবে কোন ক্লাসে পৌঁছে যান বলা যায় না। গত তিন বছরে ওদের ক্লাসে এই প্রথম। এতদিন ওরা দূর থেকেই দেখেছে এই রাশভারী মানুষটিকে। তাই বলে দূরের মানুষের জন্যে কৌতূহল হবে না এমন নিয়ম নেই। যেতে আসতে এল শেপের স্কুল বাড়ির নম্বই ডিগ্রী কোনের লাগোয়া ঘরটায় আলো চোরা চোখে তাকায়। বাইরে একটা কাঠের ছোট্ট বোর্ডে লেখা ‘সুনির্মল ভট্টাচার্য’। নামটার মত চেহারাটাও গুরুগম্ভীর। একই রকম গম্ভীর ওনার ঘরটা। তিনটে বড় বড় জানলা। দেওয়াল জুড়ে বড় বড় কাঠের আলমারি। তার উপর নানান মনীষীর ছবি। আলমারি ভর্তি মোটা মোটা বই। মাঝখানে বিশাল টেবিল। পণ্ডিত মানুষ, সংস্কৃত আর ইংরাজি দুটো বিষয়ে এম এ।

হেডস্যারকে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে আলোর ভেতরটা কেমন করতে লাগল। ভয় না শ্রদ্ধা নাকি আনন্দ বুঝতে পারল না। ওনার হাতে একটা মোটা বই। সবুজ মলাটে সাদা অক্ষরে লেখা ‘তারাশঙ্করের গল্পগুচ্ছ, প্রথম খন্ড’। বললেন, ‘কে কে আমার নাম বলতে পারবি হাত তোল।’

প্রশ্নটা বাহুল্য। কেউ হাত তুলল না। উনি বই খুললেন। গমগমে গলায় পাঠ শুরু হল। গল্পের নাম ‘তাসের ঘর’। দুই সারি বেঞ্চের মাঝখানে পাইচারি করতে করতে পড়ে চলেছেন। পড়ছেন, বোঝাচ্ছেন, ব্যাখ্যা করছেন, অচেনা শব্দগুলোর মানে বলে দিচ্ছেন আবার জিজ্ঞেসও করছেন মাঝে মাঝে।

‘শাশুড়ি বাসন-অন্তপ্রাণ, সিন্ধুকের চাবি পুত্রদের দিয়া বাসনের ঘরের চাবি লইয়াই বাঁচিয়া আছেন। পেয়ালাটার খোঁজ না পাইয়া ফুটন্ত তৈলে নিক্ষিপ্ত বার্তাকুর মত সশব্দে জ্বলিতেছিলেন…’

বাক্যটি শেষ হল ঠিক আলোর কাছে এসে। ওকে বললেন, ‘বল, বার্তাকু মানে কি?’

আলো শিহরিত হল। শব্দটা প্রথম শুনল ও। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখটা নীচু করতেই মনে পড়ল বহুল ব্যবহৃত ‘তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠা’ বাগধারাটি। অস্ফুটে বলল ‘বেগুন’।

‘বাহ্‌।’ বলেই আবার পড়তে শুরু করলেন সুনির্মলবাবু। যখন যার কাছে গিয়ে একটা নতুন শব্দ আসে, সেখানেই উনি মানে জিজ্ঞেস করেন। কখনও বা নিজের খুশি মত। বলতে পারলে খুশি হন। না বলতে পারলে নিজেই বলে দেন। আলো আগাগোড়া মুগ্ধ হয়ে শোনে। কি সুন্দর ক্লাস! ভয় নেই, হুঙ্কার নেই, ছড়ির বাড়ি বা কানমলা কিচ্ছু নেই। আর গল্পটা কি সুন্দর! ঠিক যেন নিজেদের বাড়িরই ঘটনা। ভাগ্যিস রমাপিসির ঠাকুমা দিনরাত তেলে বেগুনে জ্বলছে। তাই তো আন্দাজে ঠিক উত্তর দিতে পারল।
‘শৈল বিছানায় মুখ গুঁজিয়া আকুল হইয়া কাঁদিয়া উপাধান সিক্ত করিয়া তুলিল। সেকথা যে অমরকে মুখ ফুটিয়া বলিবার নয়।’ পড়ে সশব্দে বই বন্ধ করলেন সুনির্মলবাবু। গোটা ক্লাসে ওনার চোখ ঘুরল। আলো সিক্ত শব্দটার মানে জানে। ‘শোবার ঘরের কথা বলা হচ্ছে, তাহলে উপাধান মানে কি বালিশ!’ ভাবনা শেষ হবার আগেই স্যার তর্জনী নাড়ালেন আলোর উদ্দেশেই, ‘বল, উপাধান মানে কি?’

আলো উত্তর দিল। আর ঠিক সেই সময় ঢং ঢং ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল। হেডস্যার আলোকে নাম জিজ্ঞেস করলেন। বললেন, ‘কাল টিফিনের সময় আমার অফিসে আসিস, দরকার আছে।’

(৪)

আলো এখন অষ্টমশ্রেণীতে। ফার্স্ট গার্ল তকমাটা স্থায়ী ভাবে লেগে গিয়েছে ওর নামের সঙ্গে। ওকে কেন্দ্র করে শিক্ষক মহলেও দুটো দল তৈরি হয়েছে। আজ পর্যন্ত এই ইশকুলের রেকর্ড করা ছাত্র বলতে শুভাশিস। কিছু শিক্ষকের মতে আলো শুভাশিসকে ছাড়িয়ে যাবে, আর কিছুজনের মত, ‘অসম্ভব। ওকে ক্লাসে বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তে দেখা যায়। কয়েকজন ফেল করা মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব। সুযোগ পেলে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পালায়। এসব কাজ শুভাশিস কক্ষনও করে নি।’
এত কথা আলো জানে না। বেশির ভাগ মেয়ের মত রামকৃষ্ণবাবুর ইতিহাসের ক্লাসটা সচরাচর করে না ও। স্কুলের এক প্রান্তে একটা নতুন ঘর হয়েছে। এখনও জানলা দরজা বসে নি। ওখানে এইট-এ এর ক্লাস হয়। তাই পালিয়ে যাওয়াটা সহজ। আর রামকৃষ্ণবাবু পড়ানই বা কি? এসে বই নিয়ে বিড়বিড় করে রিডিং পড়ে যান। তৃতীয় বেঞ্চের পর কেউ শুনতে পায় না। দুপাতা পড়ার পর ওটাই বই দেখে লিখতে বলেন। নিজে চেয়ারের উপর একটা পা তুলে বসে বসে ঢোলেন। লেখার ধার না ঘেঁষে বেশিরভাগই তখন কাটাকুটি খেলায় মন দেয়। একদিন ও রকম চেয়ারে এক পা তুলে ঘুমোচ্ছিলেন, আর তুলি আবিষ্কার করেছিল, ‘স্যার আণ্ডারপ্যান্ট পরেন নি।’ ওরা এমন কোরাসে হেসে উঠেছিল যে রামকৃষ্ণবাবুও ধড়মড়িয়ে উঠে পড়েছিলেন। একদম হাতে নাতে একদল মেয়েকে ধরে সোজা বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।

শুধু এই কারণেই ওরা রামকৃষ্ণবাবুর ক্লাসে থাকে না, তা নয়। উনি মেয়েদেরকে অভিনব পদ্ধতিতে শাসন করেন। সেদিন ডালিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব কে?’ উত্তর দিতে পারে নি। তাই ডালিয়ার বামহাতের তালুতে ধরে বললেন, ‘পড়িস না? কেন পড়িস না?’ ‘বল, কেন পড়িস না?’ প্রশ্নটার যত পুনরাবৃত্তি হয় ওনার হাত তত উপরে ওঠে। যখন ওনার হাত ডালিয়ার কাঁধ ছুঁতে যাবে, দেবদাস বলল, ‘স্যার, ওর বাড়ি সারিপা।’ যেন  জোঁকের মুখে নুন পড়ল, ডালিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে উনি নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন। পরে দেবদাস জানিয়েছে, সারিপার এক মহিলার সঙ্গে স্যার থাকেন। বৌ, ছেলেমেয়ের কাছে যান না। তাই সারিপার ছেলেদের ভয় পান।

রামকৃষ্ণবাবুকে এড়াতে তৃতীয় পিরিয়ড শুরু হবার আগেই ওরা পালিয়ে এসেছে। পালাতে গিয়ে কারোর সামনে পড়লেও ভয় নেই। বলে দেয়, ‘জল খেতে চললাম।’ জল খেতে যাওয়া মানে, যেকোনও প্রাকৃতিক কারনে ক্লাসের বাইরে যাওয়া। এটাই অলিখিত নিয়ম। ইশকুলে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। নেই কোনও শৌচাগার। ছেলেরা স্কুলের পেছনের মাঠে কাজ সারে। কিছু ক্লাসে মূত্রের ঝাঁঝালো গন্ধ ঢোকে। নাথুবাবু মাঝেমাঝে কঞ্চি হাতে তেড়ে যান ওদের স্কুল থেকে দূরে পাঠাতে।
শিক্ষকদের জন্যে একটা ছোট্ট সাদা ঘর আছে। বেশির ভাগ শিক্ষক এই গ্রামের হওয়ায় ঘরটা তালা বন্ধ থাকে। সমস্যা শুধু মেয়েদের। সে নিয়ে কেউ ভাবে না। তাই নিজের সুবিধা-অসুবিধা নিজেকেই বুঝে নিতে হয়। উঁচু ক্লাসের মেয়েরা ইশকুলে অনিমিয়ত হয়। সবাই জানে, সেটাই স্বাভাবিক।

আলোরাও নিজেদের মত ব্যবস্থা খুঁজে নিয়েছে। এ জন্যে টিফিনের সময়টা আদর্শ। নাহলে একটা গোটা ক্লাস নষ্ট করতে হয়। রামকৃষ্ণবাবুর ক্লাস থাকলে সেটা বাদ দেয়। আজ চলল বংশী ময়রার বাড়ি। বংশী ময়রা হাড় কিপ্টে। তবে ওর বৌটা ভাল। তাছাড়া ওদের বাড়িটা স্কুলের কাছেই। তার পেছনেই বিশাল বড় দীঘি, বুড়ো পুকুর। দীঘির পাড়ে তেঁতুল গাছ। দোয়েল লোভ দেখিয়েছে কাঁচা তেঁতুল পেড়ে নুন দিয়ে খাবে। কাজেই সময়টা ভালো কাটবে। তাছাড়া আর কারোর যদি বাইরে যাওয়ার থাকে! সেজন্যে লোকের বাড়িতে যাওয়ার থেকে আড়াল দেখে পুকুরের পাড়ই ভাল।

বাইরের কালো দরজাটা বন্ধ দেখে শিকলটা নাড়িয়ে দিল দোয়েল। বংশী ময়রা ভুঁড়ির উপর আধময়লা গামছা বাঁধতে বাঁধতে দরজা খুলে দিতেই ডালিয়া গিয়ে কলের মুখে হাত পাতল। আলো হাতল ধরে প্রাণপণে পাম্প করতে শুরু করল। বংশী ময়রা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘এই হারামজাদী, ওই রকম করে টিপচিস যে কল খারাপ হলে সাড়াবার পয়সা কে দেবে তোদের মায়ের নাং না ভাতার?’ আলো কলের হাতল ধরেই কাঠের পুতুলের মত স্থির হয়ে গেল। জল পড়া বন্ধ হয়ে গেলেও কল থেকে হাত সরিয়ে নেওয়ার কথা মাথায় এল না ডালিয়ার। দোয়েল আর তুলি হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকল বাতাবিতলায়।

‘কাকে অমন করে দাঁতে পিষছ? ছি ছি, কি ভাষা?’ বলে বংশী ময়রার বৌ বেরিয়ে আসতেই ওদের হতভম্ব ভাবটা কেটে গেল আর একছুটে বেরিয়ে সোজা বুড়ো পুকুরের ঘাটে গিয়ে উঠল ওরা।

(৫)

ডালিয়া আর তুলি কি করে যে সারাটাদিন কাটিয়েছে সে ওরাই জানে। আলো না থাকলে স্কুলে মন টেকে না। ওদের তিনজনের বন্ধুত্ব সেই ওয়ান থেকে! প্রাইমারী ইশকুলেও তিনজনে একসঙ্গে যেত। আলোর রেজাল্টের সঙ্গে ওদের রেজাল্টের তুলনা হয় না ঠিকই কিন্তু সে জন্যে ওদের বন্ধুত্বে ভাঁটা পড়ে নি। আলো রোজ তুলিকে ডেকে নিয়ে ডালিয়াদের বাড়ি যায়। তারপর তিনজনে মিলে ইশকুল।

আজকে নিয়ে পর পর ছদিন কামাই হয়েছে আলোর। কারণটা ডালিয়া বা তুলির অজানা নয়। দেরি করে হলেও ও বড় হয়ে গেল। ওদের মধ্যে ডালিয়া সবার আগে বড় হয়েছে। তারপর তুলি।

তুলির বেলা শুনে আলো বলেছিল, ‘বড় তো সবাই হয়। তোর কটা হাত-পা গজিয়েছে নাকি?’

ডালিয়া বলেছিল, ‘বড় হওয়া মানে জানিস না? শরীর খারাপ হওয়া।’

‘যা বাবা! বড় হওয়া মানে শরীর খারাপ হওয়া! অদ্ভুত কথা!’

তুলি বলেছিল, ‘তোকে নিয়ে পারি না আলো! বড় বড় অঙ্ক বুঝতে পারিস আর এই সোজা কথাটা বুঝিস না? মেন্স রে বাবা, মেন্স। তুই রোগা বলে তোর এখনও হয় নি। আমাকে তো জেঠিমা বলে দিয়েছে, আর ছেলেদের সঙ্গে খেলবি না, সাবধানে থাকবি। ছেলেদের সঙ্গে যেন ছোঁয়াছুঁয়ি না লাগে।’

তারপর নাইনে উঠেই দোয়েলের সেই কান্ড। ছুটির সময় উঠে দাঁড়িয়েছে, সাদা শাড়ির পেছনে রক্তের দাগ। পেছন থেকে দেখতে পেয়ে চারিদিক থেকে ওরা ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। ডালিয়া কায়দা করে সেফটিপিন আটকে দিল। আর বেশ কজন মিলে পেছন থেকে আড়াল করে পৌঁছে দিয়ে এল বাড়িতে। সে দৃশ্য দেখে আলোর কি ভয়! ‘মাসে এই পাঁচ ছটা দিন কি করে কাটবে!’ ভয় পেলেও কি ছাড়ান আছে? আলোকেও স্কুল কামাইয়ের রাস্তাটাই বেছে নিতে হয়েছে।

তুলি আর ডালিয়া হই হই করতে করতে এসে দুজনে মিলে আলোকে চেপে ধরল। ওদের মুখ থেকে অহংকার ঝরে পড়ছে। বলল, ‘আলো, তুই পুরো ইশকুল কাঁপিয়ে দিয়েছিস।’

আলো বলল, ‘ছাড় আগে, ঢং না করে সোজা কথা বল। কি হয়েছে কি?’

এমন সময় ওদের ভূগোলের শিক্ষক শিবশঙ্করবাবুকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন অঞ্চলপ্রধান মানবেন্দ্র হাজরা। মানবেন্দ্র হাজরার এ বাড়িতে পা দেওয়া একটা অভিনব ঘটনা। তাই রঙ্গ দেখতে পাড়ার বেশ কিছু নানান বয়সি লোক জুটে গেল। রমাপিসির বড়দা, সুকুমারজেঠু একটা মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে রমাপিসি। আলোর দাদুর মুখেই সুকুমারজেঠু প্রথম রসগোল্লাটা ভরে দিলেন।

উপস্থিত সকলের মুখের হাঁ বন্ধ করতে শিবশঙ্করবাবু ভাষণ দিতে শুরু করলেন, ‘‘আমাদের স্কুলের ইতিহাসে এটা দ্বিতীয় বার। প্রথমে ছিল শুভাশিস ঘোষাল। সে বছর দশেক আগের কথা। বিষয়টা হল, আলোলিকা  ‘ন্যাশনাল স্কলারশিপ ফর ট্যালেন্টেড চিলড্রেন অফ রুরাল এরিয়াজ’ এ পাশ করেছে। তাই তিন বছর ভারত সরকার ওকে বৃত্তি দেবে। সুনির্মলবাবুর আশা ও ভবিষ্যতেও আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। কালকে হেডমাষ্টার ওকে দেখা করতে বলেছেন। …’

শিবশঙ্করবাবুকে থামালেন মানবেন্দ্র হাজরা, ‘শিবুর মুখে শুনেই আমি এলাম। আমার ছোটব্যাটা এবারে ওই পরীক্ষায় বসবে। তোমার নাতনি যা পড়েছে, সব আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিও। বুঝলে ঘোষমশাই।’

তুলি আর ডালিয়ার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। এমন একটা খবর ওরা আগে দিতে পারল না। এখন দেখা যাচ্ছে সবাই জেনে গিয়েছে। নাহলে সুকুমারজেঠু মিষ্টি আনতে গেলেন কেন!

শিবশঙ্করবাবু আলোকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কদিন থেকে ইশকুল যাচ্ছিস না কেন রে?’

আলো উত্তর দিল না। মাটিতে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ঘষতে লাগল। এমন সময় মা একগলা ঘোমটা দিয়ে চা আর বিস্কুট হাতে এগিয়ে এল। ঘোমটার ফাঁক দিয়েই ইশারা করল মাস্টারমশাইয়ের পায়ের দিকে। আলোর দেখাদেখি ডালিয়া আর তুলি ঢিপ ঢিপ করে সবাইকে প্রণাম করে ভেতরে পালাল।

(৬)

এই নিয়ে তৃতীয়বার। আলোর ডাক পড়েছে হেডস্যারের ঘরে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ও।

‘খুব বড় মুখ করে বলেছিলাম, আলোলিকা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। অঙ্কে যা মাথা তাতে শুভাশিসের রেকর্ড ভেঙে দেবে। আর তুমি কি করলে? নিজের গত পাঁচবছরের রেকর্ড নিজেই ভেঙে দিলে! আর তিনমাসও নেই ফাইনাল পরীক্ষার আর তুমি টেস্টে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড কোনও পজিশনেই নেই!’ বিস্ময়, রাগ, আক্ষেপ সবকিছু উগরে দিলেন সুনির্মলবাবু। আলোর সব কটা খাতা খোলা রয়েছে ওনার টেবিলে। তার একটায় তর্জনী ঠেকিয়ে বললেন ‘অঙ্কে তোমার এই অবস্থা?’

হৃৎস্পন্দন বাড়লেও আলো আগের মতই স্থির। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে, কিন্তু ঝাপসা চোখের আড়ালে ভেসে উঠছে অঙ্ক পরীক্ষার দিনের স্পষ্ট দৃশ্য। সকাল থেকে তলপেটে ব্যথা। পাগুলো কনকন করছে। লজ্জায় মাথা কাটা যায়। ওই কটা দিন যতটা পারে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে। পরীক্ষা না থাকলে সেদিন স্কুলেই আসত না। পরীক্ষার সময় তিন ঘণ্টা ভয়ে নড়াচড়া করে নি। দোয়েলের শাড়ির দৃশ্যটা মনে পড়েছে কেবল। দোয়েলের দিদা কিছুটা হলেও অসুবিধাটা বুঝতে পেরেছিলেন। বলেছিলেন, ‘দরকার হলে তোরা আসিস।’ কিন্তু ওদের বাড়ি যেতে আসতেই আধঘণ্টা লাগে। ফিরে কি কৈফিয়ত দিত! তাই পুরো সময়টা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কেটেছে। প্রশ্নপত্রটা শেষই হয় নি।

‘আবার দেখ জীবনবিজ্ঞান আর ইংরাজিতেও ভরাডুবি। এবার তোমার বাবাকে ডাকতেই হচ্ছে আলোলিকা। যাক গে, যা হয়েছে ভুলে যাও। প্রতিদিন বিকেলে আমার কাছে আসবে। আমি ইংরাজি পড়াব তোমাকে। সাইকেল চালাতে পার?’

আলো হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়ল।

‘সাইকেল না থাকলে বল, আমি কিনে দেব।’

আলো বলল, ‘আছে।’

‘তোমার আশেপাশে অনেক বন্ধু জুটেছে শুনতে পাই। এই কমাস ওদের কাছ থেকে দূরে থাকলে তোমারই মঙ্গল। এখন শুধু মন্ত্রের সাধন। যাও, এখন এস।’

আলো মাথা নিচু করেই বেরিয়ে এল। ও ভাবছিল, ‘যিনি প্রয়োজনে নিজের পকেট থেকে ছাত্রছাত্রীদের অর্থ সাহায্য করেন তিনি একটা বাথরুমের ব্যবস্থা কেন করেন না! এমন একটা দরকারি বিষয় কি সত্যিই আসে না ওনার মাথায়!’ পরক্ষণেই মনে হল, এসব ভেবেই বা কি হবে! এই স্কুলে পড়া তো শেষ হয়েই গেল। টেস্টের পর আর আসতে হচ্ছে না। তখন শুধু বাড়িতে বসে পড়া! আর বিকেলবেলা হেডস্যারের কাছে পড়তে এলেও সে আর কতটুকু সময়!

(৭)

দুই দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। ইশকুলটা সেই রাস্তার বাঁকে আজও দাঁড়িয়ে আছে। পুরনো মাস্টারমশাইরা অবসর নিয়েছেন। তাঁদের জায়গায় নতুন এসেছে। বছর বছর একদল করে ছেলে মেয়ে এসেছে আর একদল করে বেরিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ দাগ রেখে গিয়েছে, তবে তা সংখ্যায় নগণ্য। এ নিয়ে অবশ্য কারোর কোনও অভিযোগ নেই।

মাস দুয়েক আগের কথা। সেদিন অফিসে গিয়ে নিজের ইনবক্সে একটি ইমেইল পেয়েছিল আলো। ইমেল পাঠিয়েছিল সায়ন্তন চট্টরাজ। আলোর সঙ্গে যার শেষ দেখা প্রায় বাইশ বছর আগে। মাধ্যমিকের মার্কসিট হাতে পাবার দিন। তারপর আর যোগাযোগ ছিল না। থাকার কথাও নয়। বন্ধুত্ব বলে কিছু হয় নি, পুরোটাই কম্পিটিশন। আর একটু বড় হতেই লজ্জা। সায়ন্তন এখন ওই স্কুলেরই শিক্ষক। স্কুলের হীরক জয়ন্তী উৎসবের নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছে ও। কৃতী ছাত্রী হিসেবে ওর কাছে মোটা চাঁদার দাবী রেখেছে।
আলো ভাবল, স্কুলের জন্যে চাঁদা অবশ্যই দেবে। ঘটনাচক্রে এবছরে দেশে গ্রীষ্মযাপন আর স্কুলের অনুষ্ঠান একসঙ্গে। এত বছরে একবার পুরনো ইশকুলে যাবার সময় হল না ওর! স্মৃতির ভেলায় ভাসতে ভাসতে কিছুক্ষণ নিজের মনেই কাটাছেঁড়া করল। স্কুল সম্পর্কে খানিক অবহেলা, খানিকটা করুণা বোধ হয়ত নিজের আচরণেও ছিল। যেন ও নিজের কেরিয়ার গুছিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। সুযোগ পেলে লোকের কাছে ফলাও করে বলেছে ছাত্রজীবনের সংগ্রামের কথা। সেই আলোচনার মধ্যে কি আত্মশ্লাঘা ফুটে উঠত না! ভাবতে ভাবতে চোখ ঝাপসা হয়ে গেলেও ভেতরে কিসের যেন চোরা স্রোত।

সায়ন্তন পরম আত্মীয়ের মত সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে আর নতুন প্রজন্মের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। ‘ডঃ আলোলিকা ঘোষ, পরিবেশ বিজ্ঞানী। এই স্কুলের গর্ব। আমাদের ব্যাচের ফার্স্ট গার্ল। শুভাশিসদা ছাড়া আজ পর্যন্ত এই একজনই এই স্কুল থেকে বিদেশে গিয়েছে।’ সায়ন্তনকে দেখে হঠাৎ করেই আলোর সুনির্মলবাবুকে মনে পড়ল। সায়ন্তন জানাল, সুনির্মলবাবু, নাথুবাবু, রামকৃষ্ণবাবু সকলেই মারা গিয়েছেন। সঞ্জয়বাবুর ছেলে আত্মহত্যা করেছিল তারপর থেকে উনি ভারসাম্যহীন। স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন। পুরনোদের মধ্যে আছে শুধু দিলীপদা, যে ঘন্টা বাজাতো। অদ্ভুতভাবে একই রকম আছে দিলীপদা। মিনিট খানেকের জন্যে আলোর ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাল। সময় নেই, রান্নাবান্নার তদারকিতে ব্যস্ত।

আলো ওর ক্যামেরাতে সব ধরে রাখছে। হেড স্যারের ঘর, সেই প্রথম বসা ক্লাসরুম, ‘ভি-এ’। জানলাগুলোয় পাল্লা বসেছে, তাই জানলার ছবিও উঠল। দোতলা থেকে তিনতলায় যাবার সিঁড়ি। ওখানে বসে কুলের আঁচার খাওয়ার স্মৃতি ভাগ করে নিল সায়ন্তনের সঙ্গে। তিনতলার ছাদটা আর নেই। সেখানে বেশ কয়েকটা ঘর হয়েছে। স্কুলটা এখন উচ্চমাধ্যমিক, তাই বাড়তি শ্রেণীকক্ষ। তিনতলা পেরিয়ে ওরা চারতলার ছাদে পৌঁছল। আলো যে গাড়িটায় এসেছে সেটা এসে থামল বড় ফটকের সামনে। একদল কুচোকাঁচা নেমে এল গাড়ি থেকে। আর একদল উঠে পড়ল। ইচ্ছে করেই আলো এত বড় গাড়ি ভাড়া করেছে। ওই কৌতূহলী চোখগুলো ওর খুব চেনা। মাত্র ক’বছরের ব্যবধানে যেন ওই দল থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে আলো। ড্রাইভারকে বলা আছে দলে দলে ছেলেমেয়েগুলোকে গাড়ি চাপিয়ে ঘুরিয়ে আনার জন্যে। রান্নার গন্ধে ম ম করছে চারিদিক। আলো বলল, ‘রান্না কোথায় হচ্ছে রে? ধোঁয়া নেই!’

সায়ন্তন বলল, ‘গ্যাসে। কিচেনে এখন সব কিছুরই ব্যবস্থা আছে।’

‘কিচেন!’ রাজ্যের বিস্ময় আলোর গলায়।

সায়ন্তন নিরুত্তাপ। বলল, ‘চল নীচে যাই।’

চারতলা থেকে নেমে এল দুজনে। যেখানে শিক্ষকদের জন্যে সাদা রঙের একটা ছোট্ট তালাবন্ধ শৌচাগার ছিল  সেখানে নিয়ে গেল সায়ন্তন। চৌকো উঠোনের মত অনেকটা জায়গা ঘেরা, আগে ছিল না। সামনের দিক থেকে দেখতে পাওয়া যায় নি। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচটা গোল করে বাঁধানো। পাশেই টিউব ওয়েল। নিমেষেই আলোর ক্যামেরায় ঝিলিক। টিউব ওয়েলের পাশে কিচেন। আলোর মুখে খুশির সঙ্গে বিস্ময়ের ছাপ পড়ল।

সায়ন্তন বলল, ‘মিড ডে মিল রান্না হয়। এখন অনেক সুবিধা দেয় সরকার। ভাব, তখন যদি এত সুবিধা থাকত! সবাই টিফিনে পেট ভরে খেতে পেত। স্কুলছুটের সংখ্যা কত কমে যেত!’

স্কুলছুটের কথায় আলোর যেন কিছু মনে পড়ল। বলল, ‘এত কিছু হয়েছে যখন মেয়েদের টয়লেটও হয়েছে নিশ্চয়। সেটা কোনদিকে? সেখানে জলের ব্যবস্থা আছে তো?’

সায়ন্তন বলল, ‘চল নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তুই কি টয়লেটেরও ছবি তুলবি নাকি?’

আলো মুচকি হাসল। সায়ন্তন ওকে নিয়ে কোনাকুনি হাঁটতে শুরু করল। আলো দেখল দূরে পাঁচিল ঘেঁষে সারিসারি খোপ খোপ ঘর। সায়ন্তন বলল, ‘এই পুরো জমিটা সুনির্মলবাবু তাঁর রিটায়ারমেন্টের সময় পাওয়া টাকায় কিনে দান করেছিলেন। বিয়ে করেন নি, কেউ তো ছিল না স্যারের…।’ এসব কথা আলোর কানে গেল না। সায়ন্তন দাঁড়িয়ে পড়লেও ও আরও এগিয়ে গেল। দেয়ালে স্কার্ট পরা বেণী দোলানো মেয়ের ছবি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। আলো ক্যামেরা ফোকাস করতে লাগল।

*

চিত্রণ: জয়িতা করণ

7 thoughts on “আলোর কথা

  1. ভালো হয়েছে লেখাটা। আলোর বড় হয়ে ওঠার গল্প। স্কুল জীবনের ছোটোছোটো টুকরো ছবি উঠে এসেছে।
    আরো লেখো নীতাদি।

  2. খুব ভাল লেগেছে নীতাদি! এই সমস্যা যে গ্রাম বাংলার স্কুল এ কত গভীর তা দূর থেকে আমরা বুঝতে পারিনা- হয়ত বোঝার চেষ্টাও করি না। সহজ, সাবলীল ভাবে তুমি এটা লেখায় ফুটিয়ে তুলেছ।

  3. নীতা দি, ভীষন সুন্দর লেখা আর সাবলীল। ঠিক যে কারনে বারবার ইচ্ছে হয় তোমার লেখা পড়তে।
    ছোট্ট আলো যে কখন ডঃ আলোকিকা ঘোষ হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। ফ্লাসব্যাক টাও অদ্ভুত সুন্দর। রাস্তার বাঁকে আজও দাড়িয়ে থাকা ইশকুল টা কি সুন্দর ভাবে “আলো” ফিরে পেল, ডঃ আলোকিকা ঘোষ আর ডঃ নীতা মন্ডল এর যৌথ ভাবনার ‘ফোকাসে ‘ । দারুন নীতা দি, লিখতে থাকো,আরও লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

  4. গায়ত্রীকে মনে পড়ে গেল।আমার ক্লাসের ফার্স্ট গারল। আমার স্কুলও ছিল গ্রামে।গায়ত্রীরও মাসিক হত বুঝি! কি মুশকিল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.