অনির্বাণ ঘোষ

তোমরা বল্লে ইস্কুল আমি শুনলাম গোয়াল, তবে সেকুলার গরু, ভেড়া, এমনকি শূয়োরও, একসাথে পড়তাম।
আধা সরকারি ল্যাদপ্রাপ্ত ইস্কুল।
এমনকি ইউনিফর্মটাও Go as you like।
দশটা চল্লিশে প্রার্থনা, জীবন বাজি রেখে বলতে পারি কোনোদিন সময়ে যাইনি। গানের মাঝখানে রোজ ঢুকতাম। তবে দোষ কি আমার নয়, আমার দোশরের, দালির আঁকা গলন্ত ঘড়ি সেই philosophy আমার দোশর জীবনে প্রয়োগ করে ফেলেছে, জন্মে ইস্তক। অগত্যা রোজ lateral entry।

ধনধান্যে পুষ্পে ভরা
আমাদের এই বসুন্ধরা।
খেয়াল করবে গানের এক জায়গায় জন্মভূমি শব্দটা আছে। ব্যাস ওখান থেকেই সুর যেত পাল্টে। কাট টু। টিভি ধারাবাহিক জন্মভূমির টাইটেল ট্র্যাক সব শিয়াল একসাথে। হ্যানোকালে উদয় হতেন হেডস্যার, এক হাতে ঊনচল্লিশটা চাবির ছড়া, যা দেখে মল্লিক রাজবাড়ীর বড় গিন্নিও হিক্কা তুলবে, আরেক হাতে সজনে ডাঁটা inspired লাঠি, বুকপকেটে রামধনুর প্রত্যেক রঙের একটা করে কলম থাকতো।
দরজার সামনে হেডু, অবিরত কাশি সহযোগে আমরা আবার ডি.এল.রায়ে ফিরতাম।

আমার দোশরের এখন মাথায় গেঁটে বাত, আর আমার হাতে আছে বলতে arnica mont তাই আমরা এখন গোস্বামী মতে পরিচিত।

আরও একটা ছেলে যেত আমাদের সাথে, রোজ নয় যদিও, তার সাকিন ছিল পাশের ইস্কুল।
জন্মাবার সময়ই সে ধনুকভাঙা পণ করেছিল
Play boy সে হবেই,
পনেরো টাকার জন্ডিস চশমা, তায় হাঁটু অবধি ঢোলা হাফ প্যান্ট, এই নৈস্বর্গিক combination-এ গার্লস ইস্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ে পটানোর চেষ্টা… মানুষের বিশ্বাস যে কতটা নিষ্পাপ আর আবেগতাড়িত বলে তখন মনে করতাম! নিতান্তই যদি কোনো মেয়ে মুখ তুললো, আমরা সান্ত্বনা দিতাম, হ্যাঁ ভাই তুই।
পাড়ার বাইরে এক পচা খাল, তার ধার দিয়ে যেতাম।
সঙ্গে তুমুল আলোচনা শচীনের কভার ড্রাইভ, রোনাল্ডিনহোর ইলাস্টিকো, শিল্পা শেঠীর কোমর, ঝিঙ্কু বৌদির দেওর।
ঝুলিতে সবই ছিল।

হাওয়াকলে লাগতো জোলো বাতাস,মিঠে ভীমরুলের দল।
ভনভন করে বেড়াত চারিদিকে, আলতো কিছু মনখারাপ।
এই নিয়ে জীবন ছুটে চলতো উল্কা গতিতে। রক্তের প্রতিটা কণার ভেতরে গহিন এক বিশ্বাস ছিল, এই ফ্রেম কোনোদিন পাল্টাবে না। সত্যিটা কানে ফিসফিসিয়ে দেওয়ার কেউ কোথাও ছিল না।
ইস্কুল ফেলে এসেছি বহুকাল, না মনে মনে কফিহাউসও গাই না। তবে যাতায়াত হয় সে পথ ধরে।
সেই ভাঙা বাড়ি আর নেই, দেদার সিমেন্ট ঠুসেছে চারিদিকে, কার্নিশের বট-পাকুড় – তারাও অ্যাসিডপ্রাপ্ত।

খুঁত সব নিখুঁত কিন্তু ইস্কুলটা হাপিশ্।

জীবন প্রতিস্থাপনে বিশ্বাসী, এই নিশ্চিন্দিপুরে এখন অন্য কুশীলবেরা ছুটে বেড়ায়। আমাদের স্মৃতিগুলো আনাচে-কানাচে সন্ধে হলে উজাগর হয় হয়তো। বেঞ্চ ভাগ করে বসে পড়ে হয়তো। মায়াবী ক্লাস হয়তো রোজই হয় ।মাঝে-মাঝে ইস্কুলের লোকজন, টিচার , দেখা যে হয় না তা নয়, কেমন যেন কত জমে থাকা ভিড় করে আসা কথা, সব “ভালো আছি” দিয়ে জল ঢেলে এগিয়ে গেছি, দীর্ঘশ্বাস টা দেখাতে পারিনি।

আজ জল তুফানের অ্যালার্ট, তাই রাত ভাগাভাগি করে পাহারা দিচ্ছি, ক্যাফিন ও নিকোটিনের দাওয়াই অগ্রাহ্য করে কখন যে চোখ লেগে গেছে… একটা স্বপ্নও দেখে ফেললাম –
টিফিনের পয়সা দিয়ে কেনা সেই ছিপ নিয়ে বসে আছি ইস্কুলের পুকুরে, সন্ধে সবে শুরু, বুড়ো মোড়ল তেলাপিয়া খাবি খায় আর বলে, ও বাবা , দোহাই তোমার, আমার কেঁচো চাইনে,
এই… এই দ্যাখো আমি এমনি গিলচি তোমার বড়শি, হ্যাঁ ,মোছো চোখের জল মোছো। মুখ আমার তখনো ভার বুঝি।

গোলাপী চাঁদ খানিক কেশে বললে ওরে বাবা দ্যাখাবো স্বপ্ন, এখন সবে সন্ধে, এই বুড়ির কি সেই আগের বয়স আচে! রাত বাড়ুক, সব হবে খন ক্যামন। বুড়ি ফোকলা দাঁতে হাসে। হঠাৎ খানিক পরে দেখি হাওয়া বাড়ছে। কারখানার ধারের নারকেল গাছ পাগলের মত দুলছে। হঠাৎ ভেঁপু বাজল, চমকে তাকিয়ে দেখি কালো সেই প্রাগৈতিহাসিক স্কুল বাস, সেই ড্রাইভার কাকা‌।
পেছনে লাইন দিয়ে আলুকাবলি-মোহন দা,আচার-স্বপন, কুলফি-বিমল দা… হাওয়া বেড়েই চলেছে।
দিলীপদা ঘন্টা হাতে মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে চলছে, এক এক করে বাস থেকে নামতে রাজিব,কমলেশ, রাতুল , সবাই , সবাই এসেছে, হাওয়া মাতালের মত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আকাশের ঠিক মাঝখানে খিলখিলিয়ে চাঁদ বলে যাচ্ছে, কি! বলেছিলুম তো…
মোড়ল তেলাপিয়া অহরহ জলে ঘাই মারছে।
ছিপ ফেলে দিলাম এক ছুট।

খানিক দৌড়ে বুঝলাম খিদে পেয়েছে, এদিকে পয়সা নেই পকেটে। নাম ধরে কেউ ডাকে?
তাকিয়ে দেখি দোশর, আর সেই পাশের ইস্কুলের ছেলেটা।
দাঁড়িয়ে দাঁত ক্যালাচ্ছে, একটা ঠোঙা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
ফুলুরি আছে, খা! সতেরো বছর আগে ভাজা, কিন্তু বোজো ঠ্যালা! এ যে এগোনো গরম!

লেখক পরিচিতি : অনির্বাণ ঘোষ

“আমি অনির্বাণ / আদতে নাবিক, সহজ কথা বুনতে / ভালবাসি কখনো কবিতা হয় / অথবা গান লিখে যাই আর / ভেসে বেড়াই…”

1 thought on “ইস্কুল টিস্কুল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.