সুশীলা টাকভোরে

অনুবাদ – নন্দিনী ধর 

মামী আদর করে ওর নাম রেখেছিলেন সিলিয়া। দাদা তার শিক্ষাপ্রাপ্ত বোঝাপড়ার ওপর দাঁড়িয়ে নাম রেখেছিলেন শৈলজা। আর মা-বাবার কাছে ও ছিল বরাবরের সিল্লী রাণী।

১৯৭০ সালে সিলিয়া এগারো ক্লাসের ছাত্রী। শ্যামলা গায়ের রঙ, বর্ষাকালের পূর্ণিমার চাঁদের মতো ঢলঢলে মুখ, নিষ্পাপ, সরল ও গম্ভীরস্বভাব সিলিয়াকে বাড়বাড়ন্ত স্বাস্থ্যের কারণে নিজের বয়সের থেকে একটু বড়োই দেখাতো। আশেপাশের লোকজনও ওর বিয়ের কথা বলাবলি করতে শুরু করেছে। ওই বছরই ‘নয়া দুনিয়া’ নামের হিন্দি পত্রিকাতে একটি বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল – “শূদ্রবর্ণের পাত্রী চাই।” মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভূপালের এক নামজাদা যুবনেতা নাকি এক অচ্ছুত কন্যাকে বিয়ে করে প্রজাদের সামনে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। নেতার একটাই শর্ত যে, মেয়েটিকে অন্তত মেট্রিক পাশ হতে হবে।

গ্রামের বহু লেখাপড়া জানা ব্রাহ্মণ কন্যারা সিলিয়ার মাকে উপদেশ দিল, “ও সিলিয়ার মা, তোমার সিলিয়া তো মেট্রিক পাশ। আর খুব চালাকচতুর মেয়ে! বুঝেশুনে চলাফেরা করে। তুমি ওর ছবি দিয়ে নেতাকে চিঠি লেখো, তোমার মেয়ের ভাগ্য ভালো…”

সিলিয়ার মা এতবার কথা কাটাকাটির মধ্যে পড়ে বেশি কিছু বলতে পারতেন না। কেবল বলতেন, “হ্যাঁ তাই”, কিংবা “হ্যাঁ দাদা, ভেবে দেখবো”। সিলিয়ার সহপাঠিনী-বান্ধবীরা পেছনে লাগতো, মুখ টিপে হাসিঠাট্টা করতো, কিন্তু সিলিয়া ঠিক বুঝতে পারতো না, এই কথা নিয়ে এতো মাথা ঘামানোর কী আছে।

এই বিষয়টা নিয়ে পরিবারের মধ্যেও কম আলোচনা হচ্ছিলো না। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শির একটিই বক্তব্য – “নাম ঠিকানা সহ ফটো পাঠিয়ে দাও।” তখন সিলিয়ার মা বলতেন, “না ভাই, এসব বড়লোকদের খেয়াল। আজ হয়তো সমাজে সবাইকে দেখানোর জন্য আমাদের মেয়েকে বিয়ে করে নেবে, আবার কালই তাড়িয়ে দেবে… তখন আমরা গরীব মানুষ, কী করবো? নিজেদের সমাজের ভেতরেই নিজেদের ইজ্জত, নিজেদের মানসম্মান খুঁজে নেওয়া যায়! ওই ওদের লোকদেখানো চারদিনের ইজ্জতের আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের মেয়ে, ওদের সমাজে না ঠিকমতো আদরযত্ন-মানসম্মান পাবে, না আমাদের সমাজে ফিরে আসতে পারবে। না-এদিক-না-ওদিকের গল্পে আমাদের থেকেও দূরে সরে যাবে। আমি ওদেরকে আমার মেয়ে দেবো না। বরং, আমি ওকে প্রচুর লেখাপড়া শেখাবো। যদি ওর কপালে লেখা থাকে, নিজের মানসম্মান ও নিজেই খুঁজে নেবে… নিজের ভাগ্য ও নিজেই গড়ে নেবে।”

মায়ের কথা শুনতে শুনতে সিলিয়ার মধ্যেও এক ধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। সেসব কথা সিলিয়ার আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।

যখন সিলিয়ার বারো বছর বয়স, তখন সিলিয়া ভয়ে গুটিসুটি মেরে এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘটনাটি ঘটে সিলিয়ার মামার বাড়িতে। সিলিয়ার মামী চুলের মুঠি ধরে নিজের মেয়ে মালতীকে বেধড়ক পেটাচ্ছিলেন। চিলচিৎকার করে বলছেন – “কেন রে, তুই জানিস না, ওই কুয়োতে আমাদের যেতে মানা? ওখানকার জলে আমাদের হাত লাগানো বারণ? তাও কেন গেছিস ওখানে? কেন ছুঁয়েছিস ওখানকার দড়িবালতি?” – বাক্য পুরো শেষ হতে না হতেই আরো চড়চাপাটি বর্ষাতে শুরু করলো মালতীর উপর। বেচারি দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে আকুল। গলা দিয়ে কেবল একটিই বাক্য বেরোচ্ছে – “মা রে, মাফ করে দে। আর কখনো এমন করবো না।”

মামীর রাগ আর মালতীর কান্না দেখেশুনে সিলিয়ার নিজেকে বড়ই অপরাধী বোধ হচ্ছিল। ওর বড়ই ইচ্ছে হচ্ছিল নিজের সাফাই গাইতে, কিন্তু এতো ঝুটঝামেলা-হট্টগোলের মধ্যে সেসব করে কোন লাভ হতো না। কিন্তু, মামীকে একটু শান্ত হতে দেখেই সিলিয়া বলে ফেলল, “মামী, আমি মালতীকে বারণ করেছিলাম, কিন্তু ও আমার কথা শুনলোই না! খালি বলে কিনা, দিদি তেষ্টা পেয়েছে, জল খাবো। আমি বললাম, কেউ দেখলে কী হবে? মালতী বলে কিনা, এই ভরদুপুরে কে আর দেখতে আসবে? বাজার থেকে এতটা দৌড়ে এলাম, তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে গেছে।”

মামী বিরক্ত হয়ে বললো, “আমাদের বাড়িটা কি এতই দূরে নাকি, হ্যাঁ? মরে তো যেতো না। আর মরলেও কিছু এসে যেতো না। অন্তত আমায় এতগুলো কথা শুনতে হতো না।” মামী মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন আর আপনমনে নিজের মেয়ের গুষ্টির তুষ্টি রগড়াতে লাগলেন।

সিলিয়া ভাবছিল,সত্যিই তো, গাডরী পাড়ার যে কুয়ো থেকে মালতী জল খেলো, ঠিক তার কুড়ি-পঁচিশ হাত দূরেই মামা-মামীর বাড়ি। যাদের দড়িবালতি স্পর্শ করে মালতী অপবিত্র করে দিয়েছে, সেই মহিলার ছাগল চরাতো মালতী। গাডরী ঘরের লাগোয়া আট দশ ঘর ভাঙ্গী থাকতেন। সেখানেই মামা-মামীর বাস। মালতী আর সিলিয়া একই বয়সের কিন্তু সিলিয়ার থেকে মালতী অনেক বেশি হুঁশিয়ার। ভয়ডরের ওর কোন বালাই নেই। যে কাজটা মালতীকে করতে বারণ করা হবে, সেটাই ও করবে। তুলনায় সিলিয়া অনেকটাই গম্ভীর, সহজসরল আর বাধ্য স্বভাবের মেয়ে।

মালতীকে কান্নাকাটি করতে দেখে সিলিয়ার খারাপ লাগেনি, এমনটা নয়। কিন্তু ও ব্যাপারটাকে অনেকটা এইভাবে দেখেছিল যে এর মধ্যে মালতীরও ভুল আছে।

“ও তো জানেই যে আমরা অদ্ভুত, কুয়োর ধারপাশ মাড়ানো আমাদের বারণ। তাহলে ওদিকে যাওয়ার দরকারটা কী বাপু?”

ওই ছাগলওয়ালী কেমন চিল্লাচ্ছিল, “আরে ভাই, দেখো তো, না করা সত্ত্বেও কুয়োর দড়িবালতিতে হাত দিচ্ছে! দিল সব খারাপ করে। পালা পালা এখান থেকে। হতভাগী মুখপুড়ি কোথাকার!” আর মামীকেও কতই না কথা শোনালো!

“বাঈ, তোমাদের মতলবটা কী বলোতো, শুনি? এরপরে তো বাচ্চাদের আমাদের ঘরেদোরে পেচ্ছাপ করতে শেখাবে। তোমাদের কাছাকাছি থাকি বলে কি আমাদের কোন মানসম্মান নেই? অ্যাঁ? না ধর্ম নেই? মতলবটা কী তোমার? পরিষ্কার করে খুলে বলো দেখি?”

মামী প্রায় পায়ে পড়ে বলছিল, “মাফ করে দাও, বাঈ। এতো বড় হয়ে গেল, তবু মেয়েটার বুদ্ধি হলো না। কী মার খায়, তবু বোঝে না…”

সেই থেকেই মামী মালতীকে মারছে। মারতে মারতেই ঘরে তুলেছে।

বেচারি মালতী, সিলিয়া ভাবছিল। ভগবান করুন, ওর মগজে যেন কিছু বুদ্ধি গজায়। ভবিষ্যতে যেন এমন কাজ না করে। এই ঘটনার ঠিক এক বছর আগে, সিলিয়া যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে, তখন একটা টুর্নামেন্ট হচ্ছিল। খেলাধুলার ব্যাপার, তাই সিলিয়াও অংশগ্রহণ করেছিল। ক্লাস টিচার আর বন্ধুদের সাথে সিলিয়াও তহসিলে স্কুলে গেছে। আশেপাশের গ্রাম থেকেও আরও অনেক ছাত্রছাত্রী এসেছে। সিলিয়ার ইভেন্ট তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। দৌড়ে ফার্স্ট হলো সিলিয়া। স্কুলের খোখো টিমও জিতলো ওর জন্যই। শরীরশিক্ষার শিক্ষক গোকুল স্যার সবার কাছে সিলিয়ার প্রচুর প্রশংসা করলেন।

“এই তহসিলে যদি তোমার কোন আত্মীয় থাকে তো বলো। আমরা তোমাকে পৌঁছে দেবো।”

সিলিয়া মামা-মামীর বাড়ির ঠিকানা জানতো, কিন্তু বাকি শিক্ষকদের সামনে সেই ঠিকানা বলতে ওর কেমন সংকোচ হলো। লজ্জা করে কিছুই বলতে পারলো না। মুখ নীচু করে বললো, “এখানে তো আমি কারুর ঠিকানা জানি না।” তখন স্যার সিলিয়ার বান্ধবী হেমলতাকে বললেন, “হেমলতা, তুমি সিলিয়াকেও তোমার দিদির বাড়িতে নিয়ে যাও। সন্ধ্যাবেলায় আমরা সবাই একসাথে গাঁয়ে ফিরবো আবার। ততক্ষণ নাহয় একটু আরাম করে নেবে।”

হেমলতা আসলে ঠাকুর। সিলিয়ার সাথে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তো। এই তহসিলেই ওর দিদির বাড়ি। বলা ভালো, শ্বশুরবাড়ি। ওদের বাড়ি স্কুলের ঠিক পাশেই। হেমলতা সিলিয়াকে নিয়ে ওর দিদির বাড়িতে এলো। দিদির বাড়িতে দিদির শাশুড়ি হেসে হেসে কথা বললেন, হেমলতাকে চা খেতে দিলেন। দ্বিতীয় গ্লাসটা হাতে করে জিজ্ঞেস করলেন, “এই মেয়েটা কে? ওর বাবার নাম কী? কোথাকার ঠাকুর?…”

সিলিয়া কিছুই বলতে পারলো না। হেমলতা বললো, “মাসি, ও আমার বন্ধু, আমার সাথে এসেছে।” দিদির শাশুড়ি চোখ সরু করে সিলিয়াকে দেখতে লাগলেন।

হেমলতা বললো যে ওর মামা-মামী এখানেই থাকে, কিন্তু তাদের ঠিকানা ও জানে না। মাসি তখন হেমলতাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে সিলিয়ার জাত জিজ্ঞাসা করে। হেমলতাও আস্তে করে বলে দেয়। তখন মাসি সিলিয়াকে জিজ্ঞাসা করে, “তোমার মামা-মামী গাডরি পাড়ার পাশেই থাকে তো?”

সিলিয়া মাথা নিচু করে কোনোক্রমে “হ্যাঁ” বলে।

মাসি তখন অতিরিক্ত আদর দেখিয়ে বলে, “মা তুমি কিছু চিন্তা করো না, আমার ভাই তোমাকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে মামার বাড়ি পৌঁছে দেবে”।

সিলিয়ার প্রচন্ড জল তেষ্টা পেয়েছিল। কিন্তু মাসির কাছে জল চাওয়ার সাহস হয়নি।

মাসির ছেলে ওকে গাডরী পাড়ার পাশে ছেড়ে দিয়ে এলো।

সিলিয়াকে দেখে ওর মামা-মামী, মালতী খুব খুশি হলো। কিন্তু, হেমলতার দিদির শাশুড়ির সাথে যে কথোপকথন সিলিয়ার হয়েছে, তার স্মৃতি ও কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিল না। বিকেলবেলা মামা আবার সাথে করে নিয়ে গিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন।

সিলিয়ার আগের চেয়ে অনেক বেশি ভাবতে শিখছিল। ঐতিহ্য-পরম্পরা এসবের বাইরে নতুন সব কথা ওর মাথায় ঘুরছিল। ও ভাবতে শুরু করছিল যে, মালতী এমন কী দোষ করেছে, তেষ্টা পেয়েছে, জল খেয়েছে… আবার ওই যে হেমলতার দিদির শাশুড়ি, কেন তার হাত থেকে সিলিয়া জলের গ্লাস নিতে পারেনি? অচ্ছুত মেয়েকে বিয়ে করা… সমাজের সামনে আদর্শ স্থাপন করা… এসব তো ওই লোকটার ঢঙ! আম্বেদকরই হচ্ছেন সেই আসল মহাপুরুষ যিনি এই সমাজের ঐতিহ্য-পরম্পরাকে বদলাতে চেয়েছিলেন।

সিলিয়া মনে মনে ভাবতো, যদি ওর জীবনেও এমন কোন মহাপুরুষের দেখা মেলে,তাহলে ও নিজের সমাজের জন্যও কিছু করতে পারতো।

কিন্তু সত্যিই কি এমন কখনো হবে? তবে সে তার নিজের মা’র গভীর অনুভবের সাথে বলা কথাগুলো নিয়েও ভাবতো। নিজের মা’র ওপর অগাধ বিশ্বাস ছিল সিলিয়ার। ১৯৭০ সালের মধ্যপ্রদেশের জমিতে এমন কোন ফসল জন্মায়নি, যার ওপর দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট গ্রামের অচ্ছুত বলে পরিচিত একটি নিষ্পাপ কিশোরীর মনে আত্মবিশ্বাস জন্মায় – নিজের ভেতরকার আত্মসম্মান এবং উপরন্তু অন্যদের সম্মান করতে পারার ক্ষমতা – অন্যের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর ভর করে চলা – না, তা যেন কখনোই না হয়,কখনোই না – আমরা কি এতটাই নীচ? এতটাই আত্মসম্মান রহিত? আমাদের নিজেদেরও তো কিছু অহংকার অবশিষ্ট আছে, এ সমাজের তো আমাদেরও প্রয়োজন আছে, কিন্তু ওদের ঠিক কতটা প্রয়োজন আমাদের! কেন আমরা ওদের ভরসায় বাঁচবো? আমরা নিজেরাই নিজেদের সম্মান বৃদ্ধি করবো।

সিলিয়া মনে মনে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে। আমি প্রচুর পড়াশোনা করবো। পড়তেই থাকবো। এই সমস্ত নিয়মকানুন, পরম্পরা যা মানুষকে অচ্ছুত বানিয়ে রাখে, তার মূল অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবো। আমি বিদ্যা, বুদ্ধি ও বিবেক খাটিয়ে নিজেকে ওদের সমান বলে প্রতিপন্ন করবো। কারুর কাছে মাথা নীচু করবো না। কারুর কাছে নিজের অপমান সহ্য করবো না।

সিলিয়া মনে মনে এই কথাগুলো ভাবতো। একদিন মা আর দিদিমার সামনে সাহস করে বলেই ফেলল – “আমি বিয়ে করব না, আমাকে আরো পড়তে হবে।”

মা আর দিদিমা এই নিষ্পাপ, আড়ম্বরহীন মেয়েটিকে দেখছিলেন।

দিদিমা খুব খুশি হয়ে বললেন, “বেশ, তাই হবে। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা কর। বড়ো হয়ে উঁচু জাতের একটা চাকর রাখবি নিজের বাড়িতে।”

মা মনে মনে হাসছিল।

“আমার সিল্লো রাণীকে আমি পড়াবো… যতদূর ওর মন চায়…”

“অচ্ছুত কন্যার সাথে বিবাহ” – এই বিজ্ঞাপনের এইভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটলো।

সিলিয়ার বারবার এই ঘটনাটার কথা মনে পড়তো। যখন পিপাসায় ওর গলা শুকিয়ে আসছিলো আর হাতের সামনে ধরা দিয়েও জলের গ্লাস পিছলে পিছলে যাচ্ছিলো, কারণ ও অচ্ছুত। হিন্দু হয়েও ও যেন ঠিক হিন্দু নয়। পিপাসা কোনদিন ওকে অতটা কাতর করতে পারেনি, যতটা করে তুলতো এই অপমানজনক প্রশ্নটি – “তোমার জাত কী?” এই প্রশ্নটি সিলিয়ার কানে নিরন্তর হাতুড়ি পেটাতো। ওই বাড়িতে কুত্তাবিল্লী যা হোক তা হোক যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু দলিত কেউ হলেই হল, অমনি তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দেওয়া হবে। কী করা যেতে পারে এই অবস্থাকে ভাঙতে হলে? ভাবতে ভাবতে সিলিয়ার পাগল পাগল লাগতো। সারাজীবন কি তবে এই অমানবিক যন্ত্রণাই সয়ে যেতে হবে? অপমানের বোঝা বইতে হবে?

সিলিয়া ভাবতে শুরু করেছিল কীভাবে এই অবস্থার মোকাবিলা করা যায়? কীভাবে আমরা পেতে পারি আমাদের মান ইজ্জত, বাঁচতে পারি সমতাকে জীবনধ্বজা বানিয়ে? আর ‘ঝাড়ু’? ওই ঢ্যামনার দুশ্চক্রে পড়ে আমাদের জীবন তো জন্তুর থেকেও অধম।

এই সমাজে জন্ম নেওয়া বা না-নেওয়া তো আমাদের হাতে থাকে না, কিন্তু এই অপমানজনক গোলামির বন্ধন ছেড়ে বেরনোটা তো আমাদেরই হাতে। তাই না? এইটুকু তো আমরা অবশ্যই করতে পারি। সিলিয়া নিজের মনে মনে দৃঢ়তার সাথে ভাবার চেষ্টা করতো। হ্যাঁ অবশ্যই করতে পারি। সিলিয়ার চোখে তখন একধরনের চমক। হীনতা-দীনতার ভাব তখন ওর মন থেকে আস্তে আস্তে উধাও হতে শুরু করেছে। সিলিয়া মনে মনে ভাবতে শুরু করেছে, ঝাড়ু নয়, কলম। হ্যাঁ, কলমের মধ্যে দিয়েই ও নিজের সমাজের ভাগ্য বদলাবে।

তো, সিলিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো যে, ও খুব পড়বে। সম্মানের একদম উচ্চশিখরে উঠতে হবে ওকে। আজ ও একটি স্ফুলিঙ্গ, কোনো না কোনো একদিন ও হয়ে উঠবে একটি অগ্নিশিখা। সিলিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, ও চেষ্টা করবে যাতে করে সমাজের কাছে এইসব কথা বোধগম্য হয়ে ওঠে, এইসব কথার মর্ম স্পষ্ট হয়, সম্মান আর অপমানের মধ্যে যে ফারাক, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সঠিক রূপে সম্মান যেন সে অর্জন করতে পারে…

.

প্রায় কুড়ি বছর বাদে….

দেশের রাজধানীর সবচাইতে বিখ্যাত প্রেক্ষাগৃহে একটি প্রখ্যাত সাহিত্যসংস্থা ডক্টর শৈলজা নামে এক মহিলা সাহিত্যিকের সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করেছে। মহান বিদুষী, সমাজনেত্রী, কবি, সাহিত্যজগতের মধ্যমণি…ইত্যাদি প্রচুর বিশেষণ প্রয়োগ হতে লাগলো মুহুর্মুহু। অবশেষে মাননীয় মন্ত্রীমশাই শাল, সম্মানপত্র, ফুলের স্তবক ও স্মারক হাতে নিয়ে, সেই মহিলাকে মঞ্চে আসতে আহ্বান জানালেন। প্রেক্ষাগৃহ তখন হাততালিতে ফেটে পড়ছে। তার মধ্যে মহিলার গলা শুকিয়ে কাঠ। সবর্ণ সমাজের এক যুবতী মহিলার পিছনে পিছনে একটা ঠান্ডা জলের গ্লাস হাতে ঘোরাঘুরি করছিল। তার সারা শরীরে সমাদরের ভাষা। বক্তব্য রাখার মধ্যিখানে, দু ঢোঁক জল খেয়ে মহিলা ভাবছিলেন, পুরনো জীবনের কথা। গর্বভরে তিনি একবার চারপাশে চেয়ে দেখলেন, সামনে বসা দর্শকমহলের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন, আর নিজের বক্তব্য রাখতে লাগলেন…

এই মহিলাটি আর কেউ নন। আমাদের সিলিয়া।

লেখক পরিচিতি : সুশীলা টাকভোরে 

সুশীলা টাকভোরের জন্ম মধ্যপ্রদেশে। থাকা-লেখা মহারাষ্ট্রে। লেখক ও দলিত অধিকার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। জন্ম ১৯৫৪। দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি বিশিষ্ট সেবা সম্মান ইত্যাদি একাধিক সম্মান ও পুরস্কার প্রাপ্ত টাকভোরে বেশ কিছু কাব্য সংগ্রহ, ছোট গল্প সংগ্রহ ও নাটকের রচয়িতা।

অনুবাদক পরিচিতি : নন্দিনী ধর

লেখক ও সাহিত্যের অধ্যাপক।

 

1 thought on “সিলিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.