নীতা মণ্ডল

 

‘দেখ বাবা দু’পক্ষই যদি গোঁ ধরে থাকিস তাহলে তো কাজ হয় না। একপক্ষ পেছিয়ে এলেই তো মিটে যায়। আর তাছাড়া গাঁয়ের মানুষ দু’দিন ধরে দেখবে তোদের যাত্রা, যেমন এতকাল দেখছে।’

গলা নরম করে শেষবারের মত বলল রাখাল মণ্ডল। বয়ঃজ্যেষ্ঠ মানুষ। এককালে পঞ্চায়েতের মেম্বার ছিল। লোকে মান্যিগন্যিও করত। এখনও করে বলেই তার ধারণা। ঘণ্টা খানেকের ঝগড়াঝাটিতে পরিবেশ উত্তপ্ত হলেও মাথা ঠান্ডা রাখাল মন্ডলের। পাঁচজনের কাজে জলঘোলা হয় ঠিকই কিন্তু তা কীভাবে সামাল দিতে হয় তা পোর খাওয়া রাখাল মণ্ডল ভালো জানে। যার যা বলতে ইচ্ছে করে, বলতে দেয়। কেউ লম্ফঝম্প করে, কেউ গালমন্দ করে, করতে দেয়। কেউ আবার পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটে, ঘাঁটতে দেয়। সবটা ধৈর্য ধরে দেখে শুনে শেষ নিদানটা ওই হাঁকে। এসব সে কোন কাল থেকে করে আসছে! এসব ঝগড়াঝাটি পল্লীজীবনের অঙ্গ। ভাইয়ে ভাইয়ে, জ্ঞাতিতে গুষ্টিতে, পাড়ায় পাড়ায় নানা স্তরের ঝগড়ার মিটমাট করতে করতে চুল পাকিয়েছে রাখাল। এরা আজ ঝগড়া করে, কাল আবার গলাগলি করে। আবার গলাগলি করতে করতে কখন মারামারি লেগে যায় ঠিক নাই। তবুও সে মিটমাট করতে যায়। এসব মীমাংসার ভেতর দিয়েই যে তার সামাজিক উত্থান ও প্রতিষ্ঠা তা কখনও ভোলে না রাখাল। তাই এসব ব্যাপারকে সে হেলাফেলা করে না।

ঝগড়া হচ্ছিল জেলেপাড়া আর বায়েনপাড়ার মধ্যে। জেলেপাড়ার রামু আর বায়েনপাড়ার শিবুর তেজে গগন ফাটছিল। দোহারের কাজ করছিল যার যার পাড়ার ছেলেরা। দুই দলই তুল্যমূল্য।

রামু কালো চকচকে পেশীবহুল হাত দু’খানা আস্ফালন করে বলল, ‘উ সব কথায় চিঁড়ে ভিজবে না মোড়লজেঠা। পয়লা বোশেখ তো পয়লা বোশেখ। প্রতিবার ঐ দিনটো আমরা পাই, এবারও ঐ দিনেই আমাদের পালা হবে।’ যেন দাঁড়ি টেনে দিল ঝগড়ায়। রাখাল মোড়লের রায় শোনার অপেক্ষা না করে হনহন করে হাঁটতে লাগল নিজের পাড়ার দিকে। পেছনে পিঁপড়ের সারির মত পাড়ার ছেলেরা।

শিবু তেড়ে গেল। বলল, ‘এই রেমো, তাহলে তুও শুনে যা রে। বছর বছর পয়লা তারিখটো তোদিকে দিতে হবে এটো কেমন আব্দার? তোর বাপের জমিদারী পেয়েছিস? তু যেটো চাইবি সেটো হবে! এবারে পয়লা তারিখটো আমাদের।’

শিবু ও রামু সমবয়সী। বাইশ তেইশ বছরের পরিশ্রমী, সাহসী এবং সপ্রতিভ যুবক। প্রাইমারী ইশকুলের পড়া শেষ করে হাই ইশকুলেও গিয়েছে ক’বছর। সুবিধা করতে পারে নাই তেমন। যত ক্লাস বেড়েছে, ভদ্রবাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে পিছিয়ে পড়েছে। ক্লাসের ছেলেদের উপহাস হজম করেছে উঠতে বসতে। উঁচু ক্লাসের ছাত্র অথবা মাস্টারমশাইরাও কি ছেড়ে দিয়েছে? সকলে যেন কান ধরে বুঝিয়ে দিয়েছে, ওদের লেখাপড়া শেখার স্বপ্ন আর পিঠে পাহাড়প্রমাণ কুঁজ নিয়ে চিৎ হয়ে শুতে চাওয়া একই।

ক্রমে বয়স বেড়েছে। বেড়েছে পেটের জ্বালা আর সংসারের অভাব। কবে যে কোন অদৃশ্য শক্তি দু’জনকেই ঘাড় ধরে পারিবারিক পেশায় নামিয়ে দিয়েছে নিজেরাও জানতে পারেনি। লেখাপড়া উঠে গিয়েছে শিকেয়। শৈশব কৈশোরের তিক্ত স্মৃতি মনের কোনও অজানা কুঠুরিতে সঞ্চিত আছে কিনা ওরা জানে না। স্বভাবে দু’জনেই উগ্র। দু’জন দু’জনের বিরুদ্ধে তাল ঠুকছে আর যেন কোনকালের ছাইচাপা আগুন ধকধক করে জ্বলে উঠছে দুই চোখে।

রাখাল মণ্ডল এতক্ষণে বিরক্ত হল। ভাবল, এদের বাপ ঠাকুরদা যে মানমর্যাদা দিয়েছে এদের সে সবের বালাই নেই। এবার বোধ হয় দূরে সরে যাওয়াই মঙ্গল। তবুও একটা কিছু না বলে চলে গেলে যে মান বাঁচে না! তাই বুড়ো হাড়ে সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে বলল, ‘আমার শেষ কথাটোও তবে শুনে যা। এবারে কোনও পাড়াই যাত্রাপালা করবে না। সংক্রান্তির দিনে মোচ্ছব হবে আর মেলা শেষ। আর কেউ যদি এরপরও পালা করতে আসিস, তখন দেখিস রাখাল মোড়ল কী করতে পারে… ’

বলেই সে স্থান ত্যাগ করল। যুযুধান দু’পক্ষ বোকার মত চেয়ে থাকল একে অপরের দিকে।

সময়টা চৈত্র মাসের শেষ। আলোচনা হচ্ছিল আসন্ন মেলা প্রাঙ্গণেই। জায়গাটির তিনদিকে দিগন্তবিস্তৃত খেত আর একদিকে গ্রাম। সূর্য ডুবলে জায়গাটা অন্ধকারেই পড়ে থাকে বারোমাস। শুধু বছর শেষে ক’দিন উৎসবে মুখর হয়। উৎসবের অন্তরালে কূটনীতি আর ক্ষমতা প্রদর্শনের চোরাস্রোত বয় প্রায় প্রতি বছরই। দক্ষিণ দিক থেকে শরীর জুড়িয়ে দেওয়া হাওয়া বইছিল। সে হাওয়া যেন ওদের না ছুঁয়েই বয়ে গেল।

লড়াইয়ের সূত্রপাত একটি তারিখ নিয়ে। দুই দল দু’টি যাত্রাপালা নামাবে তার জন্যে দরকার দুটো দিন। এমন নয় যে দুটো দিনের বড় অভাব ওদের জীবনে। ওরা খেটে খায়, খুঁটে খায় একথা সত্য তাই বলে ওদের জীবন কি এমনই অবসরহীন?

বর্ষার হাড়ভাঙা খাটনি যখন শেষ হয়, তখন কচি ধানচারাগুলো হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। বায়েনপাড়ার লোকেরা কদিনের জন্য সামান্য বিরতি পায়। ওদের বর্তমান প্রজন্ম বায়েন বললে রাগ করে। ওরা পাড়ার নামকরণ করে ওদের পদবী দিয়ে। ‘দাসপাড়া’, শুনতে সভ্য। বাকি গ্রাম তার মর্যাদা রাখে না, বায়েনপাড়াই বলে। ধান পোঁতা শেষ হলে কিছুদিন লৌকিকতা চলে। ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে কুটুমবাড়ি যায়। শ্বশুরবাড়ি, বোনের বাড়ি, মামামাসির বাড়ির তত্ত্বতালাশ করে। ওদের ঘরেও কুটুম আসে। সাড়া বছর ধরে মনিবের মুরগি পালার দরুন পাওয়া মোরগ কাটা হয়। ভাত পচিয়ে মদ তৈরি হয় ঘরে।

বর্ষা পেরিয়ে শরৎ আসে। পুজোয় ঢাক বাজানোর বরাত আসে। তবে ঢাক আছেই বা কজনের! যার আছে সে গ্রামান্তর থেকেও ডাক পায়। ঢাক বাজানোই ওদের আদি পেশা। তাই ওরা বায়েন। পুজো পার হতে আবার জমিতে হাজার কাজ। ঠিক সময় সেচ দেওয়া, আগাছা নিড়োনো, বিষ দেওয়া। তবে সে কাজ তো সারাদিনের নয়। শরৎ শেষে হেমন্তও এমনই গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। নবান্ন দিয়েই শুরু হয় ধান কাটার তোড়জোড়। আবার হাড়ভাঙা খাটনি। ধান কাটা, বোঝা বাঁধা, গরুর গাড়িতে বোঝাই করা। সেসব মনিবের বাড়িতে ফেলা, ধান ঝড়ানো, খড় গোছানো, মরাই বাঁধা, পালুই বাঁধা। কাক ভোরে শুরু আর এক প্রহর রাতে শেষ। ধান উঠে গেলে কলাই, সরষে, আলুর চাষ শুরু হয়। তবে রবি ফসলের চাষে, ধান চাষের মত হাড় ভাঙা খাটনি নেই।

বায়েনরা এই গ্রামের চাষ আবাদের মূল কান্ডারী। গ্রামের উচ্চবর্ণের মানুষরা জমিজমার মালিক। বায়েনরা হল ভূমিহীন। ওদের বাদ দিলে কেবলমাত্র সদগোপ অর্থাৎ চাষারাই জমির জলকাদায় নামে। হাল বয়, লাঙ্গল চালায়, বীজ বোনে, ধান পোঁতে। ওরা বায়েনদের মতো ভূমিহীন নয়। রাখাল মণ্ডল সে রকমই এক চাষার ছেলে। বয়সকালে সাহসী আর বলিয়েকইয়ে ছিল। পার্টির সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে মেম্বার পর্যন্ত হয়েছিল। শুধু এ গ্রাম নয় আশপাশের পাঁচটা গ্রাম ওকে মানত। সে মর্যাদা ওর নিজের অর্জন করা। ওর হাত ধরে গোটা মোড়লপাড়া জাতে উঠেছে। নাহলে চাষাদের আর কে কবে অত মান দিয়েছে! যত মান্যিগন্যির মানুষ তো বামুন আর কায়েতরা। ওদের যার যত জমি, পা দু’খানিও মাটি থেকে তত উপরে। পায়ে চটি গলিয়ে, মাথায় ছাতা ধরে একবার গিয়ে জমির আলে দাঁড়ালেই ওদের জমি ভরে যায় সোনার ধানে। বায়েনরা ওদের বাঁধা মুনিশ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একএকটা পরিবার বাঁধা পড়ে আছে একএকটি পরিবারের কাছে। কী রহস্যে তারা যে মনিবের কাছে চিরঋণী, তা তলিয়ে ভাবেনি কেউ। যত শ্রম ওরা এবারে দেয়, তার মূল্য নাকি আগেরবারের ঋণের সঙ্গে শোধবোধ হয়ে যায়। তারপর নতুন ঋণ জমে। তবুও ওরা মনিবের কাজে একশত ভাগ বিশ্বাসী। পেট ভরা থাকলেই সুখে থাকে। অতো হিসেবনিকেশ বোঝে না। এহেন বায়েন পাড়ার স্বঘোষিত উঠতি নেতা শিবু দাস।

প্রতিপক্ষ দলটি জেলেপাড়া। ওদেরও বর্তমান প্রজন্ম জেলে বা কেওট বললে রাগ করে। ওরা বলে কৈবর্তপাড়া। ওরা মাছ ধরে। গ্রামে যেমন প্রচুর খেতখামার, তেমনই আছে পুকুর ডোবা। সম্পন্ন গৃহস্থের পরিবার পিছু তিনচারটে পুকুর। এছাড়া ভাগের দীঘি, ছোট ডোবা কি কম আছে? মাছ ধরার কাজ সারা বছর থাকে। সকাল সকাল তিন চারজনে মিলে যাওয়া, জাল বিছনো আর সময় বুঝে জাল গুটিয়ে আনা। যা মাছ ওঠে তার পাঁচ ভাগের একভাগ জেলেদের। আর যাদের পুকুরে নিত্যদিন যাওয়া তারা ছয়ভাগের এক ভাগ দেয়। প্রাপ্ত মাছটুকু বিক্রি করতে পারলে ঘরে চাল, ডাল, নুন আসে। যেদিন দু’তিনটে পুকুরের বরাত পায় সেদিন খাটনি বেশি। বড়সড় দীঘি হলেও খাটনি থাকে। তবে তা বছরে একদু’দিনের বেশি জোটে না।

মোদ্দা কথা হল তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের ভেতর থেকে দুটো দিন বের করা এদের পক্ষে অসম্ভব নয়। তবুও সহজ সমাধানের দিকে কেউ গেল না। কেনই বা যাবে? দাবী কি দু’পক্ষের কারোরই কম! যখনই ওরা নিজেদের অধিকারের কথা বিবেচনা করছে, বুঝতে পারছে নিজেদের দিকের পাল্লাটাই ভারি। তাছাড়া যা নিয়ে বছর বছর মন কষাকষি হয়, তাকে সহজ করে ফেলবেই বা কেন! ঝামেলা হলে হোক। আসন্ন ঝামেলা নিয়ে কেউ বিচলিত নয়। কেউ নিজের অবস্থান থেকে একচুল নড়ে না।

 

গ্রামটিতে নানা জাতি, নানা পেশা ও নানান অর্থনৈতিক অবস্থানের মানুষের বসবাস। প্রত্যেক প্রান্তে এক একটি অন্ত্যজ পল্লী। তারা নিচু স্তরের বাসিন্দা। তাদের জীবন আবর্তিত হয় উঁচু জাতির মানুষদের ঘিরে। যাদের বাস গ্রামের কেন্দ্রে। ভদ্রলোকের উৎসব অনুষ্ঠানে প্রান্তিকরা সেভাবে সামিল হয় না। যদিও দুর্গাপূজা, শ্যামাপূজা, অন্নপূর্ণা, জন্মাষ্টমী, রথ, দোল সবেই তাদের বাড়তি শ্রম দিতে হয়, তবুও উৎসবে ভাগ নেই।

তাবলে ওদের নিজেদের জীবনে উৎসব নেই ভাবলে ভুল হবে। বোশেখ জ্যোষ্ঠি মাসে ধরমপুজো, বর্ষায় ইন্দপুজো, ভাঁজো, ভাদ্র মাসে ভাদু, মনসা পুজো, খেপাকালী সব মিলিয়ে ওদের পালাপার্বণ বছরে তেরোর বেশি তবু কম নয়। উৎসবগুলোয় জৌলুস না থাক, আমোদ আছে। ওদের দেবতা হয়তো তাতেই তুষ্ট। তিনি নিশ্চয় জানেন, ভক্তদের যেমন দশা তাদের উপাস্য দেবদেবীর দশাও তেমনই হবে।

জেলেপাড়া ও বায়েনপাড়া সেরকমই দু’টি প্রান্তিক পল্লী। একই রকম স্তরে অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে একতার চেয়ে রেষারেষি বেশি। কেন সেই রেষারেষি বুঝতে হলে পিছিয়ে যেতে হয় কয়েক প্রজন্ম আগে। ওদের সংঘাতের কেন্দ্র একটি দেবস্থান, খুড়খুড়িতলা। এমন দেবীর নাম তামাম হিন্দু ধর্মাবলম্বীর জানা না থাকতেই পারে তবে স্থানীয় গ্রামেগঞ্জে এমন অনেক আছে। যেমন তড়বড়ে তলা, ন্যাড়াবুড়ির থান। ন্যাড়াবুড়ির থানে বাচ্চাদের মাথা মুড়িয়ে চুল উচ্ছুগ্যু করলে এক মাথা ঘন কালো চুল হবে তা কে না জানে! তড়বড়ে তলায় নতুন ধানের খই ছিটিয়ে এলে বাচ্চার মুখে বাক্যির খই ফুটবে এও সবার জানা। তেমনই এ গ্রামের খুড়খুড়িতলায় তোমার বাড়ির শিশুটিকে পরপর তিনটে সংক্রান্তিতে তিন পাক করে ঘুরিয়ে আনো, তারপর দেখ পায়ে কেমন ঘোড়ার জোর হয়!

খুড়খুড়ির উত্থান ঠিক কতকাল আগে ভাবতে বসলে হিসেব গুলিয়ে যায়। যে যার আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অতীতকে আরও সুদূরে ঠেলে দেয়। সবাই তাদের ঠাকুরদা, ঠাকুরমার মুখে শুনেছে। কোনও প্রত্যক্ষদর্শী নাই। অতএব ধরে নিতে হয় দেবী প্রাচীন।

দেবীকে এই গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিল জেলেপাড়ার নোটন। সে অনেক পুরুষ আগের কথা। তখন গ্রামের মধ্যে জেলে আর কুমোরদের পাড়াদু’টি ছিল লাগোয়া। আর সব চেয়ে ছোট। বর্তমানে কুমোরপাড়ার কোনও অস্তিত্ব নাই। নোটন কৈবর্তের বড় নাতি দু’বছর পেরিয়ে গেলেও দাঁড়াতে শেখে নাই। বুক টেনে টেনে মাটির উঠোনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে চলে ফেরে। নোটনের মনে শান্তি ছিল না। বাড়িতে একটি বেটাছেলে মানে একটি সম্পত্তি। সময় থাকতে তাকে নামিয়ে দিতে হবে জাতিগত পেশায়। একবাড়িতে দু’তিনটে মরদ হলে নিজেরা কত স্বাধীন! মাছ ধরে পারিশ্রমিক বাবদ পাওয়া মাছটা এক বাড়িতেই আসবে। নচেৎ অন্যলোকের সঙ্গে জোট করে যেতে হয়। তারপর যা আয় হয় তাতে চাল হলে মাছ থাকে না। আর মাছ রাখলে ভাতের জোগাড় হয় না।

সে আমলে গাঁয়ের বৃদ্ধদের একটা দল ছিল। তাঁরা ছিলেন গাঁয়ের স্বঘোষিত অভিভাবক। রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলেও তারা ছিল উঁচু জাতি আর পুঁথিপড়া মানুষ। তাঁদের একজন বিধুঠাকুর। তাঁর পৈত্রিক দুর্গামন্ডপটি ছিল একেবারে রাস্তার ধারে। সকাল বিকেল সেখানেই অধিষ্ঠান ছিল বিধুভূষণের। সঙ্গে ছিল পারিষদের দল। রাস্তার চলমান জনতাকে ধরে দু’দশ মিনিট আমোদ করে নেওয়াই ছিল তাঁদের বিনোদন। বিশেষ করে গাঁয়ের ছোটলোকদের আচার আচরণ, বোকামি নিয়ে ঠাট্টা করে তাঁরা ভারী মজা পেতেন। ভুঁড়ি দুলিয়ে দুলিয়ে ঠা ঠা করে হাসতেন। গাঁয়ের লোকের উপকার যে করতেন না এমন নয়। আড়ালে যে যতই গালমন্দ করুক, দরকারে বিধুঠাকুরের কাছেই যেত ওরা। দরখাস্ত লিখতে, চিঠি পড়ে নিতে কি খাজনার হিসেব বুঝতে বিধু ঠাকুরেরই পায়ে ধরত।

সেই বিধুঠাকুর নোটনকে বলেছিলেন, ‘তু কি দুধের শিশুকে জলে নামাবি? ওরে কেউ বছর না ঘুরতে হাঁটে, কারোর দু’তিন বছর লেগে যায়। সাধে কি বলে তোদের আশি না পেরলে বুদ্ধি হয় না!’

অমন জ্ঞানবৃদ্ধ মানুষের কথা নোটনের ভালো লাগে নাই।

কদিন পরেই গ্রামে রটেছিল নোটন কৈবতের স্বপ্নের কথা। ‘গ্রামের ঈশান কোণে একটি আঁশফল গাছে জবা ফুল ফুটবে। সেই গাছেই মা খুড়খুড়ির অবস্থান। ঐ গাছখানি পর পর তিন মাসের সংক্রান্তি তিথিতে বাচ্চাকে তিন পাক করে দেওয়ালেই বাচ্চাটি হাঁটতে শুরু করবে।’

নোটন মুখ্যু হলেও ঈশেন কোণ বিলক্ষণ চেনে। ঈশেন কোণে মেঘ দেখলেই তো চাষারা মাঠের কাজ ফেলে ঘরে ফেরে, জেলেরা জাল গুটোয়, রাখাল বাগালরা গরুবাছুরের পাল নিয়ে ঘরমুখো হয়।

স্বপ্নের কথা পাঁচকান না করে সকালের আলো ফোটার আগেই বেরিয়েছিল নোটন। বায়েনপাড়ার শেষ সীমান্তে আবিষ্কার করেছিল সেই অলৌকিক দৃশ্য। আঁশফল গাছে জবাফুল। জায়গাটার একদিকে আম আর তেঁতুলগাছে ঘেরা কাঁঠালদীঘি। অন্যদিকে বামনিপুকুর। নোটনের কাঙ্খিত গাছটা পুকুর দু’টি থেকে দূরত্ব রেখে একদিকে গ্রাম অন্য দিকে চাষের জমির সঙ্গে ভিন্ন হয়ে কেমন একটা পরিত্যক্ত ভূমির উপর দাঁড়িয়ে ছিল। এমন পরিত্যক্ত, নিষ্ফলা, পতিত জমিও গ্রামে কম নেই। কে যে তার মালিক কেউ জানে না। আশ্চর্য! গাছটা কোনওদিন চোখেই পড়ে নি নোটনের। এই কাঁঠালদিঘি বা বামনিপুকুরে কতবার জাল ফেলেছে তাও আশেপাশে চেয়ে দেখে নি!

‘চোখের সামনে কত কিছু যে দেখাই হয় না। না দেখেই একটা গোটা জীবন কেটে যায়! এমনিতেই মুখ্যু মানুষ চোখ থাকতে কানা!’ হঠাৎ করেই নোটনকে দার্শনিক ভাবনায় পেয়ে বসে। ক্ষণিক পরে ফিরে আসে ভক্তিভাব। সে গাছটির দিকে তাকিয়ে গদগদ হয়। ঝাঁকড়া গাছ। ঘন সবুজ পাতা। একদিকের ডালগুলো ঝুঁকে পড়ে যেন মাটিকে চুম্বন করছে। মেটে রঙের আঁশকে ফল ধরে আছে থোকা থোকা। দেশি লিচু। দমকা বাতাসে গাছের ডাল নড়ে উঠে। নোটনের মনে হয় হাত বাড়িয়ে ডাকছে তাকে। ও যত এগিয়ে যায়, পাতার আড়ালে ছোপ ছোপ লাল রং হয় স্পষ্ট। আর কোনও বিভ্রম থাকে না। এমন আশ্চর্যের ঘটনা কত পুণ্যি করলে দেখতে পাওয়া যায় সে নিয়ে ও নিঃসন্দেহ। পর পর তিন সংক্রান্তিতে নাতিকে ধরে ধরে তিনপাক করে হাঁটিয়ে আনে নোটন।

‘জবাফুলের দর্শন আর কেউ পেয়েছিল? অন্তত কাউকে একখানা সাক্ষী মানলে পারতিস।’ বিধুঠাকুরের কূট পরামর্শে নোটন হাত জোড় করে বলেছিল, ‘তাতে যদি মা দোষ ধরে! পুণ্যি করে প স্বপন যদি ব্রেথা হয়ে যায়!’

বিধুঠাকুর তার দলকে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘ওরে হিন্দু দেবদেবীর লিস্টিতে তাইলে নোটনার দেবীর রোলনম্বর কত হল রে? তেত্রিশ কোটি এক না দুই নাকি আরও পরে?’

নোটনের নাতি হাঁটতে শিখল। নোটনও কুমোরদের কাছে বরাত দিয়ে দুটো মাটির ঘোড়া তৈরি করে লাল টুকটুকে করে পুড়িয়ে নামিয়ে দিয়ে এসেছে গাছের গোঁড়ায়। এই সূত্রে জেলেপাড়া হয়ত  গ্রামে কিছুটা আভিজাত্য অর্জন করতে পারত কিন্তু হল না। বাদ সাধল চিধরা বায়েন ওরফে শ্রীধর দাস।

নোটন কৈবতের পর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিল চিধরা। তার দাবী, মা জানিয়েছে সেই ‘দেয়াসি’। সোজা কথায় ‘প্রধান ভক্ত’ পদখানি  তার। তার হাতের সেবা নিতেই মা এসেছে এই পাড়াতে। চিধরা হবে একাধারে সেবায়েত ও রক্ষী। সারাদিন ঠাকুরথান দেখে শুনে, পাহারা দিয়ে রাখবে। দেবীদেবতা বলে তাদের তো অভিভাবকহীন হলে চলে না। কাজেই এক্ষেত্রেও হবে না। পুজোর কোনও বিধান দু’জনের কেউই পায় নাই স্বপ্নে। সুতরাং বামুন, পুরোহিত নিষ্প্রয়োজন। চিধরার বৌ  ঠাকুরথান পরিষ্কার করবে, দু’বেলা মারুলি দেবে। একথা শুনে বায়েনপাড়া কোনও আপত্তি করল না। ওরা অতি আহ্লাদে চিধরাকে দেবাংশী বলে মেনে নিল।

শুধু নোটন কৈবত চেল্লামেল্লি জুড়ে দিয়েছিল। সে চিধরার কথা বিশ্বাস করে নাই। বলেছিল, বায়েনপাড়ার ঠাকুরথানে লোকে কৈবতদের নাম করবে সেটা চিধরা হতে দেবে না তাই ফন্দী এঁটেছে। কথাখানা যদি সত্যিও হয় তবে চিধরার বুদ্ধির কথা ভেবে বায়েনরা তাকে মাথায় তুলে নিয়েছে। তাদের উল্লাসের নীচে নোটন কৈবতের সন্দেহ চাপা পড়ে গিয়েছে। ক্রমে হাঁড়ি, ডোম, শুঁড়ি, ছুতোররাও দুটো পাড়াকেই সমর্থন করেছে। নোটনের স্বপ্নে পাওয়া দেবী গোটা গাঁয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

বেশ একটা নতুন ঢেউয়ের মত ঘটেছিল ব্যাপারটা। গ্রাম জীবনের মূল এরকম ছোট ছোট ঢেউ। পাঁচজনে সেই ঢেউয়ে ভেসেছে ক’দিন। নোটন এবং চিধরা দু’জনের স্বপ্নের ব্যাপারে তারা নিরপেক্ষ। গ্রামে একটা ঠাকুর উঠছে এটা গোটা গ্রামের মঙ্গলের কথা। তা নিয়ে অবিশ্বাস করা, ঠাট্টা করা পাপ। কে জানে কিসে কী ত্রুটি ঘটে যায়! তখন দেবতার রোষ কার উপর পড়বে ঠিক আছে? ওরা ক্ষুদ্র মনিষ্যি, তাই বিশ্বাস করে নিয়েছিল। তখন সব কটা প্রান্তিক পল্লী তাদের বিশ্বাসে এক হয়ে গিয়েছিল।

নোটন কৈবত একান্তে হাত কামড়েছিল। স্বপ্নটা একটু অন্য রকম হতে পারল না! ‘গাছখানা বায়েন পাড়াতেই হতে হল! কী ক্ষতি হত নিজের পাড়ায় হলে? হারামজাদা চিধরা, সাত ঘোড়েলের এক ঘোড়েল। স্বপন দেখেছে! নিজেকে আর নিজের পাড়াকে পিতিষ্ঠে করবে! মা খুড়খুড়িই তোর ঐ মিছে কথার সাজা যদি না দেয়, তো আমার নাম নোটনা নয়!’

নোটনের দেওয়া অভিশাপে অবশ্য কোনও কিছুরই বদল হয় না। দু’জনের কেউই দেবীর কোনও মূর্তিরূপ স্বপ্নে দেখে নাই। কোনও পাথরের টুকরোটাকরার সন্ধানও পায় নাই। পেয়েছিল কেবল ঐ গাছখানা। যেন কোনও অশরীরী দেবী বাতাসের মত ঐ গাছের মধ্যেই আছে। গাছটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল চিধরা ও তার সহধর্মিণী। চুলদাড়ি না কাটায় বেশ একটা সাধু সাধু ভাব এসে গিয়েছিল ক’মাসের ভেতরেই। ভাষারও উন্নতি হয়েছিল। হাতের কাছে যাকে পেত, উন্নত ভাষায় তার কাছে দেবীর মহিমাকীর্তন করত। জায়গাটা আর কেউ নোংরা করত না। গাছের ডালপালা ভাঙ্গত না। ছাতার মত আচ্ছাদন গাছের তলায় গরমে একটি সুশীতল আশ্রয় তৈরি করেছিল। রাখালবাগালেরা গরু চরাতে চরাতে দু’দন্ড জিরিয়ে নিত। মাঠ বেয়ে যাওয়া ভিন গাঁয়ের যাত্রীও থামত। হঠাত ঝড়বৃষ্টিতে মাঠ থেকে লোক ছুটে আসত এই গাছের তলায়।

প্রথম প্রথম সংক্রান্তির দিনগুলোয় দু’চারজন আসতে শুরু করেছিল কচি শিশুকে সঙ্গে নিয়ে। তারপর কয়েক বছরেই মধ্যেই উচ্চনীচ ভেদে গ্রামের সব বাড়ির শিশুকেই খুড়খুড়িতলায় ঘোরানো রেওয়াজ হয়ে গেল। ভদ্রলোকেরা বলত, ‘ক্ষতি তো কিছু নেই!’ আর মনে মনে ভাবত, ‘অবহেলা করলে না জানি কুদৃষ্টিতে পড়তে হয় কিনা!’ তাছাড়া খরচ আর কী? দক্ষিণা কেবল দু’খানা মাটির ঘোড়া। বাচ্চা হাঁটতে শিখলে দিয়ে এলেই হল। নোটন কৈবর্তর জোড়া মাটির ঘোড়া দেওয়াটা খুড়খুড়ির কৃপা পাওয়ার মূল শর্ত হয়ে উঠেছিল।

চিধরা মরতেই ওর ছেলে হয়েছিল দেয়াসি। তারপর থেকে ওরাই বংশানুক্রমে সেবায়েত হয়ে চলেছে।

ধীরেধীরে প্রতিবেশী গ্রামের মানুষেরও বিশ্বাস জন্মেছিল। তারাও আসতে শুরু করেছিল সংক্রান্তির দিনগুলিতে। কেউ গাছের গোড়ায় ধূপ জ্বালিয়ে দিত। কেউ দু’একটা পয়সা ছুঁড়ে দিত। কেউ আবার কলাটা, মণ্ডাটাও নামিয়ে দিত গাছের গোড়ায়। এসবও ধীরে ধীরে রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল।  কালেভদ্রে দূর থেকেও কেউ কেউ এসে হাজির হত। তাদের বাচ্চাকে দেখলেই বোঝা যেত মামলা জটিল। হয়ত চিকিৎসায় কাজ হয়নি, তাই শেষ চেষ্টা। এমনই একবার এক মাড়োয়ারি পরিবার এসেছিল। গরুর গাড়ি চেপে গরমে ঘামতে ঘামতে এসেছে। তখনকার দেবাংশী চিধরা বায়েনের কত নম্বর উত্তরাসূরী সে হিসেব কারোর কাছে নেই। তার কাছে ছেলের মা কেঁদেই আকুল। যেন ঐ মাতাল গাঁজাল লোকটা একটা কিছু বিধান দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। পাঁচ বছরের ছেলের ঘাড় সোজা হয় নাই। পা গুলো লিকপিকে। তাকে তিনজনে ধরে ধরে যখন ঘোরাল, দেবাংশী তাকিয়ে থাকল ফ্যাল ফ্যাল করে। ছেলেটার মা মানত করেছিল অনেক। তার ছেলে হাঁটলে সে খুড়খুড়িমাকে সোনার নূপুর দেবে। গাছের গোড়া বাঁধিয়ে দেবে। দেয়াসির চালে টিন দিয়ে দেবে। পরপর তিনবার নিয়ম মেনে তারা এসেছিল তারপর আর কোনোদিন এল না।

ততদিনে গাছের গোড়ায় জমে উঠেছে পোড়া মাটির ঘোড়ার স্তূপ। ডালে ডালে ঝুলছে লাল কারে বাঁধা ইটের টুকরো। মনবাঞ্ছা পূরণের নিশানা। গর্তে ভরা বালিরাশির মধ্যে পোড়া ধূপকাঠির অবশেষ।

বায়েনপাড়া ও জেলেপাড়া দুইপাড়া আজও খুড়খুড়ির সূত্রে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে আছে ঐক্যে এবং সংঘাতে। বহু বছর একটা বার্ষিক উৎসব করে দুই পাড়া মিলে। সেই উৎসব কালেকালে বিবর্তিত হয়েছে। পুজোর সঙ্গে হয় সংস্কৃতিচর্চা। মেলা বসে। অন্নমোচ্ছব হয়। একদিন রাতে আলকাপ হয়। একদিন হয় বোলান গান। দু’একটা যাত্রাপালা গাঁয়ের ছেলেরা মিলেই নামিয়ে দেয়। নিজেদের রচিত শিল্প দেখানোর জন্যে ওরা বছরভর অপেক্ষা করে। উৎসব শেষ হয়ে যাবার পর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেসবের আলোচনা করে বেশ ক’দিন ঘোরের মত কাটায়।

উৎসবের নাম খুড়খুড়ির মেলা। মেলায় কিছু মানুষ দু’হাত ভরে উপার্জন করে। ওরা তাদের কাছে বাড়তি চাঁদা আদায় করে। মিষ্টির দোকান, চপ-ফুলুরি-পাঁপড় ভাজার দোকান, ‘হরেক মাল আটআনা’, কাঠের নাগরদোলা এসব বসে। তিনদিন ধরে চলে। বিকেলবেলায় ভিড় জমে। চৈত্র সংক্রান্তির দুপুরে মোচ্ছব হয়। নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী ওরা দেয় চাল, ডাল, আলু, কুমড়ো, লাউ। যার যেমন আছে। বস্তা নিয়ে ভদ্রপল্লীগুলিতেও সাহায্য প্রার্থনা করে। তাতে তেল নুনের সুরাহা হয়। মাটির উনুনে কুড়নো কাঠি, শুকনো পাতার জ্বালানিতে খিচুড়ি রান্না হয়। রুক্ষ ফসলহীন জমিতে ভূমিই আসন। খিচুড়ির গন্ধে পাড়া ঝেঁটিয়ে লোক আসে।

চৈত্র সংক্রান্তিতে মোচ্ছব হয়ে মেলা শেষ হয়েছে। খুড়খুড়িতলার আঁশফলের গাছটির চারিদিকে পড়ে আছে ক্ষতচিহ্ন। ছেঁড়া এঁটো শালপাতা, কালো ছাইয়ের গাদা, ভাঙা উনুন, এদিক ওদিকে গর্ত। শেষ পর্যন্ত কোন পাড়াই যাত্রাপালা করেনি। তাই দেখে রাখাল মণ্ডলের মনে খটকা লেগেছে। ওর ঘোষণা তারা এত সহজে মেনে নিয়েছে? রাখাল তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা মানুষ। দৃষ্টি ঝাপসা হলেও নিজের মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। উৎসব পরবর্তী বাতাস হালকা ফুরফুরে লাগে না তার কাছে। কিসের যেন গুমোট! তলে তলে কিছু কি ঘনিয়ে উঠছে? দু’দিন পাড়া বেড়িয়েই রাখাল বুঝতে পারল পুজো শেষ হতেই জেলেপাড়া ও বায়েনপাড়া পরস্পরের মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দিয়েছে।

নতুন বছর শুরু হয়েছে। দুটোদিন কেটেও গিয়েছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ রাখাল মণ্ডল তিন তারিখ রাতে ভারমুক্ত মনে ঘুমোতে গেল। পরদিন চৌঠা বৈশাখ, শম্ভুসায়রে মাছ ধরা হবে। সন্ধ্যবেলা সে নিয়ে আরেকবার আলোচনা করে ফিরে গিয়েছে জেলেরা। যে যার কাজে লাগছে। জীবনে ছন্দ ফেরার এর চেয়ে বড় নিদর্শন আর কী!

শম্ভুসায়র একটি সুবিশাল দীঘি। এই গ্রামের ত্রিসীমানায় এত বড় দিঘী একটাও নেই। এ পাড়ে দাঁড়ালে ওপাড়ের মানুষকে ঠাহর করা যায় না। দীঘিটি গ্রামের গর্বও বটে। পদ্মদীঘি নাম না দিয়ে কে যে শম্ভুসায়র নাম দিয়েছিল কে জানে! এতবড় পদ্মবন আর কোথায়! কেমন সুন্দর পদ্মের কুঁড়ি, ফুল, টাটি মাথা উঁচু করে থাকে। কিছু পাতা উঁচু হয়ে থাকে পতাকার মত। আর কিছু পাতা সোহাগ করে এলিয়ে থাকে জলের উপর। তার ফাঁকে ফাঁকে শাপলা, কলমি, হেলেঞ্চা, শুষনি শাক চাপ বেঁধে থাকে। গরিবের পেট ভরানোর জন্যেই যেন প্রকৃতি একটি ভাণ্ডার খুলে রেখেছে। মাঠেঘাটে কাজ সেরে, বেলা গড়িয়ে আঁচল ভরা শাক অথবা গেঁড়িগুগলি তুলে ঘরে ফেরে বায়েনপাড়ার মেয়েবৌরা। পুকুর মারা হলে, শুকনো খটখটে মাটি খুঁড়ে পদ্মের শেকড় তোলে। এসব শাকপাতার জন্যে পুকুরের মালিকানার প্রয়োজন হয় না।

তবে মাছের জন্য অন্য নিয়ম। পুকুরটির এত শরিক যে নিয়মিত সেখানে মাছ ধরা, ভাগ বাঁটোয়ারা করা রীতিমত ঝঞ্ঝাট। তাই লিজ দেওয়া হয় জেলেদের। কী মাছ ফেলবে, কতটা ফেলবে, কী ভাবে মাছ চুরি আটকাবে, সব দায়িত্ব তাদের। মাছের কথা জেলেদের চেয়ে ভালো আর কে বোঝে! নিন্দুকে অবশ্য বলে, মূর্খামি। কথায় আছে, ‘বোকা পাঁচ, পরের পুকুরে ফেলে মাছ’। দশ ধরণের বোকার মধ্যে পরের পুকুরে মাছ চাষ করা জেলেরা পঞ্চম।

শম্ভুসায়রে মাছধরার দিনটা এ গ্রামে একটি বড় ঘটনা। রাত থাকতে বড় জাল বিছিয়ে রাখা হয়। রবারের ভেলায় এপাশে ওপাশে জেলেগুলো জাল নিয়ে কীসব কেরামতি করে। সকাল হতে না হতে শরিকরা হাজির হয় বস্তা হাতে। অতগুলো ভাগ হয়েও ছোটখাট শরিকে যা মাছ পায় তা থলে বা খালুইয়ে আঁটে না। একটানে কম সে কম ছয় থেকে আট কুইন্টাল মাছ ওঠে। বড় বড় রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবোশ। তিন থেকে পাঁচ কেজি ওজন একএকটার। মাছের অর্ধেকটা পায় জেলেরা। ওটাই ওদের সম্বৎসরের পরিশ্রমের মূল্য। হাজার অনিশ্চয়তা পেরিয়ে পাওয়া ধন। শারীরিক পরিশ্রমটাই আসল পুঁজি বলেই হয়ত কখনও ভেবে দেখে না, সত্যি কি লাভ হল নাকি পাঁচ নম্বর বোকা বনেই থেকে গেল ওরা! তবে মাছ ওঠা দেখে আহ্লাদ হয়। সেই মাছ বিক্রি করে হাতে কিছু টাকা আসে।

এত বড় ঘটনার দিনে বায়েনরা কিন্তু উদাসীন। ওদের কারোরই ভাগ নেই ওই পুকুরে। কলমি, শুষনি শাক খেয়ে দিন কাটলেও এইদিনটাতে ওরা যায় না। যায় পুকুর গাবার দিনে। সেদিন পুকুর সবার জন্যে খোলা। চাষ করা সব মাছ দফায় দফায় তুলে নিয়ে মেশিন দিয়ে জল মারতে মারতে যখন শুধু পাঁক আর সামান্য জল পড়ে থাকে, তখন যে কেউ নেমে পড়তে পারে ঐ কাদা জলে। চুনোপুঁটি, পাঁকাল, চ্যাং, ছিঙ্গুরি, শোল, মাগুর কিলবিল করে।

প্রায় চার কুইন্টাল মাছ ভাগে পেয়েই বস্তা বন্দি করে সাঙ্গপাঙ্গদের মাথায় তুলে রওনা করিয়ে দিয়েছে রামু। সকালের প্রথম বাস ধরে ওরা পৌঁছবে শহরে। দেরি না করে মহাজনকে ধরতে হবে। মাছ ভালো থাকতে থাকতে তার হাতে তুলে দিতে হবে। রামু ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে। দর কষাকষি, হিসেবপত্র ওই গিয়ে বুঝে নেবে। শরিকদের মধ্যে মাছ ভাগ না করে ও যেতে পারবে না। কাজ শেষ করে, জাল গুছিয়ে সেসব পাড়ায় পাঠিয়ে দিয়ে ও যখন রাস্তায় নামল তখন পুবদিক লাল হয়ে সূর্য উঠে পড়েছে। বাস না পেলে ট্রাক, মোটরসাইকেল যা দেখবে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়বে ও। ভাবতে ভাবতে রামু হনহন করে হাঁটছিল নৈঋত কোণ থেকে ঈশান কোণ বরাবর। মাঠে মাঠে হেঁটে পাকা রাস্তায় উঠবে। শর্টকাট।

খুড়খুড়িতলার সামনে আসতেই ওর সামনের মাঠ দুলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ও। সামনে অন্ধকার। উঠে দেখার চেষ্টা করতেই এদিক ওদিক থেকে ছিটকে এল পাথর। একটা বড় বোল্ডারের আঘাতে ও উল্টে পড়েছিল। সেটা উড়ে এসেছিল ঝোপের আড়াল থেকে। নিমেষেই খবর ছড়িয়ে পড়ল গোটা গাঁয়ে। জেলেপাড়ায় সেদিন পুরুষ মানুষ কম। যে কজন ছিল তারা বেরিয়ে এল। তবে খালি হাতে নয়। লাঠি, টাঙ্গি, কুড়ুল, কোদাল, হাঁসুয়া, বটি যে যা সামনে পেল তাই নিয়ে দৌড়ল।

চোখের পলকে জায়গাটা পরিণত হল রণক্ষেত্রে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এলোপাথাড়ি মারামারি করছিল একদল মানুষ। আর একদল সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে অবাক হয়ে দেখছিল। একপক্ষের কাছে বস্তা বস্তা পাথর আর অন্যপক্ষের কাছে ঘরোয়া অস্ত্রশস্ত্র। যারা দেখছিল তারা যেন থামাতেও ভুলে গেল।

রাখাল মণ্ডল যখন অকুস্থলে পৌঁছল, তখন পাড়া কাঁপিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে, ধুলো উড়িয়ে দু’তিনটে পুলিশের গাড়ি ঢুকল। পুলিশ দেখে ভিড় পাতলা হল। তিনটে অসাড় দেহ উঠে গেল ভ্যানে। ক’জন কম বয়সি ছেলেকে তুলল খাঁচা গাড়িতে। তারপর আবার পাড়া কাঁপিয়ে, ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।

এমন সকাল এগ্রামে আগে কখনও এসেছে কিনা কেউ মনে করতে পারল না। বায়েনপাড়ায় মরাকান্নার রোল উঠেছে। মরাকান্না কাঁদছে জেলেপাড়ার মেয়েরাও। রামু কৈবর্তের বৌ সন্তানসম্ভবা। ক’মাস আগেই বিয়ে হয়েছিল তার। মূর্ছিতা মেয়েটিকে ঘিরে রেখেছে একদল মেয়ে। তখনই কাঁদছে তখনই কথা বলছে। অসংলগ্ন, অর্থহীন।

কমবয়সী ছেলেছোকরারা গ্রাম ছেড়ে যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল। আবার যদি পুলিশ আসে! আবার যদি তুলে নিয়ে যায়! ওরা কি বিচার করে, কে দোষী কে নয়? মেয়েমানুষ, ছেলেপুলে আর অশীতিপর বৃদ্ধরা থাকল গ্রামে। থানা থেকে কী খবর আসে এই আশঙ্কায় দিন গড়াতে লাগল! ভয়, আশঙ্কা, কৌতূহলে কেউ স্থির হতে পারল না। কেবল ঘর-বার করল।

সূর্য পশ্চিমে ঢলল। ভারী ট্রাকের গর্জনে আবার সচকিত হল গ্রাম। পুলিশের সঙ্গে নেমে এল পঞ্চায়েতের বর্তমান মেম্বার। নেমেই ঘোষণা করল, তিনজনেই মরেছে। রামু, শিবু আর শিবুর বুড়ো বাপ। বেটাকে বাঁচাতে গিয়ে টাঙ্গির এক কোপেই কুপোকাত।

প্লাস্টিকে বাঁধা দেহগুলো একটা একটা করে নামানো হল।

সমবেত জনতা থেকে কেউ একজন ডুকরে কেঁদে উঠল।

পঞ্চায়েত মেম্বারের ধমকে কান্না থেমে গেলেও কথা ভাসল বাতাসে। কত রকমের কথা।

কে যেন বলল, ‘ছোটলোক, মূর্খ! নাহলে নিজেরাই মারামারি করে মরে!’

কেউ বলে উঠল, ‘মা খুড়খুড়ির যে বলি চাই, সে কথা স্বপন দিলেই পারত!’

একজন বলল, ‘আহা! তার যে কেওট আর বায়েনেরই রক্ত পচন্দ গো। তিনি নিজের পচন্দের ভোগ নিজে তুলে নিয়েচে।’

কেবল রাখাল মণ্ডল চুপচাপ সরে গেল জটলা থেকে। শ্মশানের অদূরে, বাঁশঝাড়ের আড়ালে অন্ধকারে ধপ করে বসে পড়ল। সে রাজনীতি করেছে বটে, তবে গাঁয়ের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল খাঁটি। সেই ভালোবাসা জন্মেছিল সব রকমের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসার ফলেই। ছোটলোক, মূর্খ, গরীব, হাভাতে কারোর প্রয়োজন বা আবেগকে কোনোদিন খাটো করে দেখে নাই। সে আমলের প্রধান হরেণবাবু শিখিয়েছিল। গাঁয়ে আর মায়ে সমান। তাই গাঁয়ের মানুষের সেবা করা আর মায়ের সেবা করায় সমান পুণ্য। রাখাল ওদের চিরদিন বেঁধে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেছে। দরকারে কঠোর হয়েছে। তারজন্যে গাঁয়ের লোকে হয়ত ভুলও বুঝেছে। তবুও সে চেষ্টা করেছে বড়সড় অশান্তি, দাঙ্গাহাঙ্গামা আটকে রাখার। আজ বড় আপশোস তার! সে বেঁচে থাকতে এমন ঘটনা তার গাঁয়ে ঘটে গেল। আহা এ যে মায়ের গায়ে কলঙ্কের কালি। ছোটছোট ছেলেপিলেরা বড় হয়ে এই গল্প করবে! ‘পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গা হয়েছিল আমাদের গাঁয়ে।’ কে বলতে পারে এই বিষ দু’পাড়ার ছেলেপিলেরা মনে পুষে রাখবে না? হয়ত অনেক বছর বাদে আবার ধিকিধিকি জ্বলা আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে আরও একটা দাঙ্গা হয়ে!

গ্রামে একটাই খবরের কাগজ আসে। মজুমদারদের মুদি দোকানে। বিকেলবেলা রাখাল সেখানে যায় কাগজটা উলটে পালটে দেখতে। তাছাড়া ওর নিজের একটা রেডিও আছে। খবর মানেই ইদানিং অশান্তি আর হিংসা। কত বড় বড় শহরে পর্যন্ত মানুষ হিংসার আগুনে জ্বলে। দলে দলে, জাতে জাতে, ধর্মে ধর্মে লড়াই, মারামারি ও খুনোখুনি। ভগবানেরও রেহাই নাই। একদল বলছে আমাদের ঠাকুরথান, আরেক দল বলছে, না আমাদের। বছর দুয়েক আগেই যা হল! কোথায় উত্তরপ্রদেশে মসজিদ ভেঙেছে আর দেশের আনাচে কানাচে দাঙ্গা বেঁধে গেল। এগ্রামে মুসলমান না থাকলেও আশপাশের গ্রামে আছে। দুটো ছোটছোট মুসলমান প্রধান গ্রাম আছে এই এলাকায়। সেখানে নামমাত্র দু’এক ঘর হিন্দু। রাখাল খবর পেয়েছিল, পঞ্চায়েত থেকে গোপনে নজর রেখেছিল তখন। এ চত্বরে অশান্তির আঁচ পড়ে নাই।

রাখালের সন্দেহ হল সে একই সঙ্গে অন্ধ ও বধির হয়ে গিয়েছে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া মোরাম রাস্তাটা পাকা হচ্ছে। বোল্ডার-চিপস পড়েছে। সেই স্তূপ থেকে বায়েনরা বস্তা বস্তা পাথর সরিয়েছে। অথচ ওর চোখে পড়েনি। মাথাগরম ছেলে ছোকরা সব। হাতে কাজ না থাকলে ওরা ছোটখাট ঝগড়া বিবাদ করেই থাকে। সেসব মারামারি হাতাহাতি ওদের বয়েসকালেও হয়েছে। সেসব মিটতে সময় লাগত না। কেউ মনে পুষে রাখত না। বলত, ‘হয়ে গিয়েছে, বয়ে গিয়েছে’। কিন্তু এ যে মাথা ঠাণ্ডা করে মানুষ মারার তাল! নিজেও মরতে পারে জানে, তবুও মেরে মরবে! এত বিষ মনে? ‘মানুষের জীবনের চেয়ে বড় কিছু নাই’ কথাটা তাদের গুরুজনেরা শিখিয়ে গেলেও রাখালরা পারল না তাদের ছেলেপিলেদের শেখাতে! হতভাগারা নিজেরা তো মরলই উপরন্তু কলঙ্ক দেগে দিল গাঁয়ের নামে! হঠাৎ রাখালের চোখ দুটো কড়কড় করে উঠল। চোখে ধোঁয়া আর নাকে পোড়া গন্ধ ঢুকছে। অদূরে তিনটে চিতা একসঙ্গে জ্বলে উঠেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে। কোন চিতায় রামু শুয়ে আছে আর কোনটায় শিবু দেখে বোঝবার উপায় নাই।

নীতা মন্ডলের জন্ম বীরভূমের লাভপুর সংলগ্ন ইন্দাশ গ্রামে। বিপ্রটিকুরী উচ্চবিদ্যালয় ও বোলপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন সময় থেকেছেন। পেশা অধ্যাপনা। নেশা বই পড়া, গান শোনা ও আড্ডা দেওয়া। ফলে যা হল, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাকে দেখে মনে হতে লাগল ‘ঠিক যেন গল্পের মত!’ আবার, কখনও আড্ডার ফাঁকেই মনে হল, ঘটনাগুলো জুড়ে দিলেই তো নতুন গল্প। বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকা ছাড়াও ‘কথা সাহিত্য’, ‘দেশ’ এর মত বাণিজ্যিক পত্রিকায় অণুগল্প, ছোটগল্প ও বড় গল্প লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস।

 

সঙ্গের ছবি – ইন্টারনেট থেকে

1 thought on “যার খেলা সে জানে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.