নন্দিনী ধর

 

একতলার ফ্ল্যাটটার জন্য ভাড়াটে খুঁজছে বাবা মা। ওই ফ্ল্যাটটা ভাড়াই দেওয়া হয়। মিঠাই জন্ম ইস্তক এমনটাই দেখে আসছে। আসলে ওই ফ্ল্যাটটার মালকিন পিসি। এই বাড়িটা ওভাবেই বানিয়েছিল দাদু ঠাকুমা। দুই ছেলেমেয়ে, দুটো ফ্ল্যাট। একই বাড়ি ওপরে আর নিচে। “একটু একটু করে, অল্প অল্প করে। টাকা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে।” একসাথে হলেই বলে বাবা আর পিসি দুজনেই। পিসি থাকে ব্যাঙ্গালোরে। ওখানেই চাকরি করে। পিসেমশাইও। “ছেলেমেয়ের ঘাড়ে গলগ্রহ হবো না কোনোদিন,” বলে দাদু-ঠাকুমা নিজেরাই চলে গেলো বারুইপুরের দিকে বৃদ্ধাশ্রমে। মাসে একবার সেখানে মিঠাই যায় মাবাবার সাথে। গাড়ি করে সেদিন ঘোরা হয় প্রচুর। যাইহোক, এই ফ্ল্যাটটার সব দায়দায়িত্বই বাবার। পিসি মাথাও ঘামায় না। এমনকি ভাড়াটা পর্যন্ত নেয় না।

এইখানে, মিঠাই যখন ছোট, তখন ছিল বাসবকাকু আর শর্মিষ্ঠা কাকিমা। ওরা নাকি নিজেদের ফ্লাট কিনে উঠে গেছে। এরপরে এলো দেবাশীষদাদা আর সৌম্যদাদা। ডাক্তারি পড়তো ওরা। ওদের সঙ্গে প্রায় রোজ দেখা করতে আসত জয়ীদিদি, ঊর্মিদিদি। ওরাও ডাক্তারি পড়ত। আরও আরও দাদাদিদিরাও আসতো। তারাও নাকি সবাই ডাক্তারি পড়ত।

যে মাস পাঁচেক ওরা এখানে ছিল, মিঠাইয়ের খুব মজা হতো। ওই জয়ীদিদির ল্যাপটপেই তো মিঠাই দেখেছিলো ‘মাই নেবার তোতোরো’, ‘হোয়েল রাইডার’, আরও কত কি! সিনেমা, কার্টুন, মিউজিক ভিডিও। ঊর্মিদিদি ছবি আঁকা শেখাত ওকে। কেমন করে ছোট ডিম আর বড়ো ডিম জুড়ে হয় টিয়াপাখি। মাও প্রায়ই অফিস থেকে ফিরে নীচে যেত। সৌম্যদাদা চা বানিয়ে দিত মাকে।

“এই যে সৌম্য, তুই আমাকে চা বানিয়ে দিস, তার জন্য তোর কেনা গোলাম হয়ে থাকতে পারি রে,” মা বলত সৌম্যদাদাকে।

“শ্রাবণীদি,আবার ন্যাকামো?” সৌম্যদাদা বলত।

“না রে, তোর সুমিতদা তো এইটুকুও করলো না কোনোদিন,” মা বলত। মিঠাই দাদাদিদিদের কারুর একটা কোল ঘেঁষে বসে দেখত। মা এই কথাগুলো বলার সময়ে স্থির দৃষ্টিতে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারুর দিকে তাকায় না। মিঠাইয়ের দিকেও নয়। তবে বাড়ির ভেতরকার ঝগড়া, চিলচিৎকার, এসবের থেকে এই একই কথা প্রতি সপ্তাহে বলা, বারবার বলা অনেক ভালো।

“কী যে বলো না! সুমিতদা তোমাকে কী সুন্দর প্রতি উইকএন্ডে ঘোরাতে নিয়ে যায়। গত সপ্তাহের মলের ছবিগুলো কী যে সুন্দর!” জয়িদিদি বলত।

“তা যায়,” বলে মা চুপ করে যেত। কোনো কোনোদিন এক চুমুকে চা শেষ করে বলত, “না যাই। এরপরে হেঁশেল ঠেলা আছে, এনার হোমওয়ার্ক আছে।” দরজার কাছে গিয়ে পায়ে চটি গলাতে গলাতে বলতো, “সৌম্য, তোকে আবার থ্যাংকু দিতে হবে না কি চা-টার জন্য?”

এই যে মা’র দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পায়ে চটি গলানো, এটা আসলে অনেকটাই মিঠাইয়ের কাছে ইঙ্গিত। অবশ্য মা এইসময়ে একবার মিঠাইয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবেই তাকাবে। আর তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে যাবে। দশ-পনেরো মিনিট পরে, গুটিগুটি পায়ে মিঠাইও। যদিও এই সময়টা মিঠাইয়ের কাছে বড়ো অসহ্য।

কারণ, মা। কারণ, স্কুল। কারণ, হোমওয়ার্ক। 

মা জামাকাপড় ছেড়ে হাতে ফোন বাগিয়ে মিঠাইয়ের ঘরে চেয়ারে বসবে। মিঠাই বসবে বিছানায়। একে একে ব্যাগ থেকে বার করে মাকে দেখাতে হবে সবকটা খাতা। বলতে হবে কোনটায় কত নম্বর পেয়েছে মিঠাই। বলতে হবে পরের দিনের জন্য ঠিক কী হোমওয়ার্ক আছে। মাঝে মাঝে মা বলবে, “এই, দাঁড়া দাঁড়া!” ফোন খুলে কীসব লিখবে। মিঠাই জানে, ক্লাসের সবার মা’দের নিয়ে যে হোয়াটস্যাপ গ্রুপ আছে, সেখানকার কথা আর তার মুখের কথা মিলিয়ে নিচ্ছে মা।

এরপরে শুরু হবে আসল কাজের পালা। মিঠাই পড়বে, মা দেখিয়ে দেবে। মধ্যে মধ্যে উঠে গিয়ে রান্নাঘরের কাজ সারবে। একসময়ে আরতিমাসি আসবে, রুটি বানাবে। ঘর ঝাড়বে। মা’র জন্য চা বানাবে, দুজনে মিলে টিভি সিরিয়াল দেখবে। মা মিঠাইয়ের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে। “এই, এক পা যদি বেরিয়েছিস ঘর থেকে, পা ভেঙে দেব। রাতের খাওয়ার আগে যেন সবকটা অঙ্ক হয়ে যায়,” মা বলবে। অংকের বদলে কোনোদিন হবে ইংরিজি। কোনোদিন হবে ইতিহাস। অথবা অন্য কিছু। মা ভুল করে ফোনটা মিঠাইয়ের ঘরে ফেলে গেলে, মিঠাই চুরি করে খেলে নেবে দুরাউন্ড গেমস। মা’র পায়ের শব্দ পেলে আবার পড়ার বইয়ে মুখ ঢাকবে।

তবে, এসবই হলো সে সব দিনের কথা যখন মার মেজাজ ভালো। ঘড়ি ধরে চলছে বাড়ির সান্ধ্যকালীন রুটিন।

আর কোনো কোনোদিন এমনও হয় যখন মা চিলচিৎকারে ভরিয়ে দেয় তিন কামরার এই ফ্ল্যাট। কেন যে মা এরকম করে মিঠাইয়ের তা ঠিক বোধগম্য হয় না। যেমন গত সপ্তাহে মা রেগে গিয়েছিল, কারণ পেন্সিলবক্সের ভেতরের দরজায় পাখির ছবি এঁকেছিল মিঠাই।

‘এই, এখানে এঁকেছিস কেন শুনি? তোকে ড্রয়িং খাতা কিনে দেওয়া হয় না নাকি?”

এই দিয়ে শুরু। তারপর খাতাবই সব মেঝেতে ছুঁড়ে দেওয়া। তারপর মিঠাইয়ের গালে ঠাসঠাস চড়। তারপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে মা’র কান্না। এই সমস্ত সময়ে মা কী কী বলবে বা বলতে পারে, তা মোটামুটি মিঠাইয়ের মুখস্থ।

“সমস্ত ঘরসংসারের দায়িত্ব আমার কাঁধে ফেলে তিনি রিসার্চ রিসার্চ করে নেচে বেড়াচ্ছেন।”

“মেয়ে যেন আমার একার! … কোনোদিন যদি ভাবি অফিস থেকে বেরিয়ে যাব একটা সিনেমা বা নাটক দেখতে, তার উপায় নেই। বাড়ি এসে হাঁড়ি ঠেল, মেয়ে সামলাও।”

মা’র পিসতুতো বোন সোহিনীমাসি এসে ছিল তিনদিন এখানে। কীসব যেন চাকরির পরীক্ষা। তো, মা’র রাগ দেখে তো সোহিনীমাসি হেসে অস্থির।

“দিদি, যাত্রা করিস না প্লিজ। এতে মিঠাইয়ের কিচ্ছু লাভ হচ্ছে না। আর এতো পুরো আমাদের মায়েদের ভাষা। আর তুই হলি গিয়ে বিলেতফেরত সাংবাদিক। কোত্থেকে শিখলি এসব?”

“এসব শিখতে হয় না। ভেতরেই থাকে,” মা ফোন নাড়াচাড়া করতে করতে বলে। তারপর একটু থেমে যোগ করে, “ও বিয়ে হলে তুইও বুঝবি।”

সোহিনীমাসির এখানে আসাটা ছিল রুটিনভাঙা। যে তিনদিন সোহিনীমাসি এখানে ছিল মা বিকেলে বাড়ি ফিরলে, রোজই কোথাও না কোথাও যেত তিনজনে। যেমন, সেইদিন অটোতে চেপে তিনজনে মিলে গিয়েছিল মোড়ের মাথার সিসিডিতে। সোহিনীমাসি আর মা কাপুচিনো খেয়েছিল, মিঠাই হট চকোলেট। সোহিনীমাসি মিঠাইকে ব্রাউনি কিনে দিতে চাইলে, মা চোখ পাকিয়ে বলেছিল, “এখনো কিন্তু চাকরিটা লাগেনি,” আর সোহিনীমাসি অপ্রস্তুত হেসেছিল।

তবে সেদিন ছিল সত্যিই একটা রুটিনভাঙা দিন। তাই অটো থেকে নেমে মা, মিঠাই আর সোহিনীমাসি ঠিক যখন গলির মুখে, আর মিঠাই মনে মনে ভাবছে, মা কি এবার তাকে টুক করে নিচে সৌম্যদাদাদের ঘর থেকে ঘুরে যেতে দেবে, তখনই চিলচিৎকার। চিলচিৎকার এ জীবনে অনেক শুনেছে মিঠাই। মার চিলচিৎকার যেমন। শুনলে মিঠাইয়ের কেবল মনে হয়, মা যেন কিছু একটা চেয়েছিল এ জীবনে, কিন্তু পেল না। তাই, খালি রাগ দেখাচ্ছে। যেমন মিঠাইও দেখায়, মা মাসের প্রথম দিন গিফট কিনে না আনলে। এ চিলচিৎকার কিন্তু আলাদা। এখানে না পাওয়ার কোনো যন্ত্রণা নেই। আছে অনেক কিছু পাওয়া যাবে, এমন আশ্বাসের আত্মবিশ্বাস।

“বোল শালে বোল, ভারতমাতা কি জয়!”

“বোল বন্দেমাতরম।”

চিলচিৎকারের মালিককে মিঠাই আগেও দেখেছে। ওদের বাড়ির পাশেই যে মোহনা অ্যাপার্টমেন্টস সেখানে থাকে। সকাল সকাল ভুঁড়ি দুলিয়ে জগিংয়ে বেরোয়। চারপাশে অবশ্য আরও লোকজন। তারাও কেউ কেউ বলে, “হ্যাঁ, ভারতমাতা কি জয় বোল।”

কেউ কেউ বলে, “পাথ্থর কিঁউ ফেকতা হ্যায় রে? অভি বন্দেমাতরম বোল।”

কাকে বা কাদের বলছে ঠিক বোঝা যায় না যদিও। যে বাড়ির সামনে এতো হল্লা, সেখানে তখন সম্পূর্ণ অন্ধকার। কেউ ভেতরে আছে কিনা বোঝার উপায় নেই। যারা বলছে, তাদের কারুর বা মুখ পরিচিত মিঠাইয়ের কাছে, কারুর বা নয়। মিঠাইরা হয়তো চলেই যেত পাশ কাটিয়ে, যেমন যায় সবাই। যেমন যায় মেয়েরা। বিশেষত যদি না ওদিক থেকে দৌড়ে আসতে দেখা যেত সৌম্যদাদাদের। সৌম্যদাদা, দেবাশীষদাদা আরও দুটো দাদা, যাদের নাম মিঠাই জানে না।

তাদের একজনের কানে ফোন।

“পুলিশকে ফোন কর। শিগগিরই। তোরাও চলে আয়।”

“এই সৌম্য, কি হয়েছে রে?” মা জিজ্ঞাসা করে।

“এখনও বুঝছ না? পুলওয়ামা…”

“ব্যাস, ব্যাস …আর বলতে হবে না। আরশাদরা কি…”

“হ্যাঁ, ভেতরে। ভয়ে সিঁটিয়ে বাথরুমে বসে আছে। আমাদের সাথে ফোনে কথা হয়েছে।”

“দা…দাঁড়া …আমি থানায় যাচ্ছি। সোহিনী, তুই মিঠাইকে নিয়ে বাড়ি যা।” মা বলে।

“দিদি, তুমি আবার এসব ঝামেলায়…”

“বললাম না, মিঠাইকে নিয়ে বাড়ি যা।”

তো, মিঠাই আর সোহিনীমাসি বাড়ি আসে। সোজা ওপরে। নিচে আর যাওয়া হয় না মিঠাইয়ের। সোহিনীমাসি কাকে যেন ফোন করে।

“জানিস তো। …হ্যাঁ হ্যাঁ কাশ্মীরি। শালওয়ালা। … হবে হয়তো। …ও, কী বলছিস? ওরা আসলে সব্বাই টেররিস্ট? হবে হয়তো। আমি কখনো ভেবে দেখিনি এতো। …কী? কী বলছিস? …. মেডিয়াভেল পীপল ডিমান্ড মেডিয়েভ্যাল জাস্টিস? ….মেবি। …ওরে বাবা, কাশ্মীরি পন্ডিতদের সাথে কী হয়েছিল, আমি জেনে কী করব? ….এই শোন না, দিদির বোধহয় সুমিতদার সাথে একটু প্রব্লেম চলছে। …সারাদিন রেগে থাকে। এই শোন, মিঠাইটা আবার চোখ গোল গোল করে আমাদের কথা শুনছে।”

সোহিনীমাসি ফোন রেখে দেয়।

“কে গো, সোহিনীমাসি?”

“আমার বন্ধু।”

সোহিনীমাসিকে মিঠাই তার সাড়ে সাত বছরের জীবনে দেখেছে ঠিক পনেরোবার। গড়ে বছরে দু’বার করে। অবশ্য, মা ফোনে সোহিনীমাসির সঙ্গে ফোনে কথা বলে সপ্তাহে অন্তত একবার। তখন মিঠাইকেও ডেকে নেয়। সোহিনীমাসি এই এমএ পড়া শেষ করলো বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইতিহাসে।

আরশাদমামুদের মিঠাই বছরে প্রায় ছ’মাস দেখে প্রতিদিন। গাঁঠরি নিয়ে বেরোচ্ছে বাড়ি থেকে, ফিরছে। ওই গাঁঠরিতে কী আছে, জানে মিঠাই। শাল, ফিরহান, সোয়েটার, জ্যাকেট। গতবার জন্মদিনে মিঠাইকে একটা জ্যাকেট কিনে দিয়েছে মা। আরশাদমামুর থেকে। নিজেও প্রতিবছর নেয় কিছু না কিছু। কখনো শাল, কখনো ফিরহান। ওরা আসে অবশ্য সৌম্যদাদাদের ঘরে। বাড়িতে ওপরে নয়। মা বলেছিল সৌম্যাদাদাকে, “তোর সুমিতদা এসব পছন্দ করে না।”

“কোন সব?” সৌম্যদাদা জানতে চেয়েছিল।

মা উত্তর দেয়নি।

আরশাদমামুদের বাড়ি শ্রীনগরে। মাকে বারবার বলে আরশাদমামু, “একবার আইয়ে না, দিদি। আপকো কাশ্মীর সে পেয়ার হো যায়েগা।”

গতবার আরশাদমামু মিঠাইয়ের জন্য আখরোট এনে দিয়েছে। সেসব অবশ্য খায়নি মিঠাই। ভালো লাগেনি। তেতো।

কাশ্মীরের ইতিহাস জানে না মিঠাই। স্কুলে পড়ানো হয় না। তবে ভারতবর্ষের ম্যাপে কোথায় কাশ্মীর তা জানে।

“টেররিস্ট কী সোহিনীমাসি?”

“ও বাব্বা, তুই আমাদের কথা গিলছিলি নাকি?”

“বলো না…”

“খারাপ লোক। অন্যের ভালো দেখতে পারে না…”

“আরশাদমামু ওরকম নয়।”

“কে?”

“আরশাদমামু।”

“ও। …আচ্ছা বুঝেছি। তোকে অতো কিছু ভাবতে হবে না। তুই পড়তে বস। দিদি যদি ফিরে এসে দেখে তুই এখনো আমার সাথে আড্ডা মারছিস তাহলে ক্যালাবে ধরে। তুই তো ফাঁসবিই, তার সাথে সাথে আমিও।”

মা’র ফিরতে দেরি হয়। সোহিনীমাসি খাবার গরম করে দেয়। যখন মিঠাই শুতে যাচ্ছে, তখনও মা ফেরেনি। ঘুমের ঘোরে মিঠাই বড়োদের গলার আওয়াজ শোনে। বাবা। …সোহিনীমাসি। …মা।

“সোহিনী তো ঠিকই বলেছে। কে বলেছিলো তোমাকে এসবে জড়াতে?”

“চিনি তো…”

“দিদি, ঐটুকুতে কতটুক চেনা হয় রে? আর, জেহাদিরা কাশ্মীরে একের পর এক যা ঘটাচ্ছে…”

“ওরে বাবা, তুইও কি হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নাকি?”

“সোহিনীর সাথে ওভাবে কথা বোলো না। …কিছু ভুল বলছে না তো। …কাশ্মীরেরও যা অবস্থা, পশ্চিমবঙ্গের ডানদিকেও একই অবস্থা। …ওই জন্যই তো এনআরসি চাই।”

“শোনো, শালী-জামাইবাবু মিলে তোমরা যাই বল না কেন, কোথায় কে জেহাদি, তার জন্য একটা গোটা কমিউনিটি বা অঞ্চলের মানুষকে আমি অপরাধী ভাবতে পারব না। …যা করেছি আজ বেশ করেছি। দরকার হলে আবার করব। …আমি গেলাম শুতে এখন।”

এইভাবেই, এক বিকেলে “জেহাদি”, “টেররিস্ট” ও “কাশ্মীর” শব্দগুলো একাকার হলো মিঠাইয়ের অভিধানে। অবশ্য, পাড়ায় আর কোনোদিন দেখা গেলো না আরশাদমামুদের। মা আর সৌম্যদাদাদের টুকটাক কথা থেকে মিঠাই জানল, ওরা শ্রীনগর ফিরে গেছে। প্লেনে। প্লেনের টিকিটের টাকার অনেকটাই দিয়েছে মা। 

এভাবেও কখনো কখনো রুটিন ভাঙে…

অবশ্য, রুটিনভাঙা বিষয়টা মিঠাই আগেও দেখেছে। যেমন কেমন একদিন চা খেতে খেতে মা জয়ীদিদিকে বলেছিল, “শোন, ওইসব ফেসবুকের ছবি, শনিবারের মল, রবিবারের সিনেমা দিয়ে কিছু হয় না, কিছু যায় আসে না। বিয়ে হোক, নিজেই বুঝবি।”

জয়ীদিদি আস্তে আস্তে, গলা নামিয়ে বলেছিল, “বিয়ের দরকার নেই, এখনই বুঝি।”

মা গলা ছড়িয়ে বলেছিলো, “না, বুঝিস না। আর শোন, সৌম্যকে আমি রোজ দেখি। ছেলেটা কী না পারে। এই এতো পরিশ্রম করে ফিরছে, ঘর পরিষ্কার করছে, রাঁধছে, বন্ধুদের খাওয়াচ্ছে। আর সুমিত? এই এতো বছরে আমাকে না করে খাইয়েছে এক কাপ চা, না খাইয়েছে বানিয়ে একটা ডিমের পোচ।”

“মানে, বলছ, আই হ্যাভ মেড আ গুড ক্যাচ?” জয়ীদিদি বলে।

“সে তোমরা বুঝে নাও বাবা।”

মা ঠকাস করে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে মেঝেতে। কারুর দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যায় ফ্ল্যাট থেকে। মিঠাই দেখে, মায়ের কাপটা পুরোটাই তখনও ভরাট। মেরেকেটে এক চুমুকের বেশি মা খায়ইনি।

সেদিন রাতে, মিঠাই বাড়ি ফিরলে এবং রাতের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে, মা মিঠাইকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলে, “বাবুসোনা, একটা কথা বলি তোমায়। এই যে আমরা নীচে যাই, সবাই মিলে এতো মজা করি, এগুলো বোলো না কিন্তু বাবাকে। কেমন? বাবা এসব একদম পছন্দ করে না।”

“কোন সব?”

“এই যে আমরা নীচে যাই, গল্প করি। তুমি ল্যাপটপে সিনেমা দ্যাখো।”

“কেন পছন্দ করে না?”

“করে না। সবার তো সব কিছু ভালো লাগে না। তোমার যেমন ঢ্যাঁড়স খেতে ভালো লাগে না।”

মা মিঠাইয়ের পেটে কাতুকুতু দেয়। মিঠাই খিলখিল করে হাসে। দুজনে মিলে চটকাচটকি খেলে। কখন যেন মিঠাই ঘুমিয়ে পড়ে।

তবে মিঠাই ভোলে না। বাবার সাথে যখন গল্প করে মিঠাই – স্কুলের গল্প, ভালুকের গল্প, মিখাইল নামে কুমিরছানার গল্প – তখনও ভুল করেও বলে না যে কেমন মা আর মিঠাই মিলে নীচে যায় রোজ। মা কেমন চা খায়। মিঠাই কেমন ল্যাপটপে সিনেমা দেখে।

“কিন্তু তুমি যে বলো মিথ্যে কথা বলা খারাপ? শুধু নটিগার্লরাই মিথ্যে বলে?”

কারণ মিঠাইয়ের মনে আছে সেই চড়থাপ্পড়, কান্নাকাটি। মানে, মিঠাইয়ের মনে হয়েছিল, এই যে পেন্সিলটা হারিয়ে গেছে, এটা দিশা মানে, আরতিমাসির মেয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেই তো হয়। না হলে, আরও কত কী শুনতে হবে।

“কোথায় তোমার মন থাকে শুনি?”

“পেনসিল, ইরেজার এসব কি বিনে পয়সায় আসে? রোজগার তো করতে হয় না।”

তো, দিয়েছিল দিশাকে দেখিয়ে। দিশা তো বড় একটা আসত না এ বাড়িতে। হয়তো চারমাসে একদিন। কিংবা তাও নয়। আর এলেই কেমন ফ্যালফ্যাল করে দেখতো মিঠাইকে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতো মিঠাইয়ের পেন্সিল, গন্ধওয়ালা রঙ্গীন রবার।

“এই ও নিয়েছে!” দিশার দিকে আঙ্গুল তুলে বলেছিলো মিঠাই।

মা কেমন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল একবার মিঠাইয়ের দিকে, একবার দিশার দিকে।

“না গো মামী, আমি নিইনি।” দিশা প্রায় চিৎকার করে বলেছিল। একছুট্টে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে, আরতিমাসিকে জড়িয়ে ধরে, আরতিমাসির আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল।

“দেখ না মা, কী সব বলছে! আমি নিইনি কিন্তু, কিচ্ছু নিইনি।”

আরতিমাসি মা’র দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “বৌদি, ও কিছু নেবে না। তেমন শিক্ষা আমি ওকে দিইনি।”

আর, যেহেতু দায় আরতিমাসিরই, যে দিশার শিক্ষাপ্রণালী সম্পূর্ণ ভিন্ন সেটা প্রমাণ করার, তাই সেই দায় মেটাতে ঝাঁটা হাতে আরতিমাসি তৎক্ষণাৎ লেগে পড়ে। আর, কী অদ্ভুতভাবে, মিঠাইয়ের পেন্সিল হাজির হয় খাটের দূরবর্তীতম তলদেশ থেকে।

মা’র চোখে তখন আগুন। মিঠাইয়ের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় দেওয়ালের দিকে।

“বল, কেন মিথ্যে বললি গরীব মেয়েটার নামে? বল?”

মা হাঁপাতে থাকে আর নাগাড়ে মিঠাইয়ের ওপর পড়তে থাকে চড়থাপ্পড়। যেন মিঠাই একটা পাপোষ। যখন মা মিঠাইয়ের মাথা দুহাতে ধরে দেওয়ালে ঠুকতে থাকে, আরতিমাসি এসে বাধা দেয়।

“তোমার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে বৌদি? বাচ্চামানুষ, করে ফেলেছে। বোঝেনি।”

যেভাবে যে তৎপরতায় প্রায় আরতিমাসি নিজের মেয়ের চোর বদনাম ঘুচিয়েছিল, প্রায় সেই তৎপরতা নিয়েই মিঠাইকে বাথরুমে নিয়ে যায়, চোখমুখ ধুইয়ে কান্না থামায়। আরতিমাসির হাত ধরে বাথরুম থেকে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে মিঠাই আড়চোখে দেখে, দিশা বসার ঘরের সোফার এককোণে বসে আছে। কোনোক্রমে। যেন বসতে না পারলেই ভালো হয়। হাতে ধরা মাঝারি মাপের আমূল মিল্ক চকোলেট। মা’র দেওয়া ঘুষ। ফ্যালফ্যাল করে দিশা তাকিয়ে থাকে মিঠাইয়ের দিকে। চোখের পলক না ফেলে।

পরে, মা যখন জয়ীদিদি, সৌম্যদাদাকে গল্পটা বলে, তখন বারবার বলতে থাকে, “আমি খালি ভাবছি, ও এটা শিখল কোথা থেকে! কার কাছ থেকে! কোথেকে বুঝলো যে একটা গরিব মেয়ের ওপর দোষ চাপানো যায়?”

সৌম্যদাদা বলে, “ও তুমি ছাড়ো তো শ্রাবণীদি। বাচ্চারা এসব অনেককিছু শেখে, অনেককিছু ভোলে। মিঠাইও এসব ভুলে যাবে।”

মিঠাই চোখ পিটপিট করে তাকায় ল্যাপটপের পর্দা থেকে। সৌম্যদাদা জানে না। বড়োরা কেউ জানে না, মিঠাই কিছুই ভোলে না।

তো, তারপর থেকে মিঠাই আর মিথ্যা বলে না। দিশাও অবশ্য আর আসেনি এ বাড়িতে।

মিঠাইয়ের বাবা কলেজশিক্ষক। জন্ম ইস্তক যেমন মিঠাই দেখছে ওদের বাড়ির একতলায় কোনো না কোনো ভাড়াটে, তেমনি দেখছে যে বাবা একটার পর একটা বই লিখে চলেছে। মোটা বই, কঠিন বই। মিঠাই নেড়েচেড়ে দেখেছে। পড়ার চেষ্টা করে দেখেছে। বড়ো একটা কিছু বোঝেনি। মিঠাই জানে, মা আর বাবা পড়ত একসাথে কলেজে। মিঠাই এও জানে, মা আর বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। তাও একসাথে। মানে, এই চার দেওয়ালের মধ্যে মা কথাটা ভুলতে দেয় না।

“আমার লেখা নোটস মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে তুমি হলে কিনা গবেষক, লেখক। আর আমি হলাম গিয়ে অন্যের কপি এডিট করা দু টাকার সাংবাদিক।”

বাবাও ছেড়ে কথা বলে না।

“তো কে তোমাকে হতে বারণ করেছিল যা মন চায়?”

“সেসব হতে সময় লাগে না? কে জুতে দিয়েছিলো সংসারে? কে আমার পেটে বাচ্চা ভরতে গিয়েছিল শুনি?”

“তো খসাতে পেট। জানোই তো, আমি বাধা দিতাম না।”

“তা বাধা দেবে কেন? মাঝে বাচ্চা না থাকলে তো তোমার চরে বেড়াতে আরও কোনো বাধা থাকত না।”

চলতে থাকে এমন। এমুখ থেকে সেমুখ। এধার থেকে ওধার। ঘরের এই দেওয়াল থেকে অন্য দেওয়াল।

মিঠাই জানে, “পেট” মানে ও নিজে। তবে বাবা ঠিক কী করে ওকে মায়ের পেটে ভরে দিয়েছিল, তা ওর বোধগম্য হয় না। এই সময়গুলোতে কানে ইয়ারপ্লাগ লাগিয়ে মিঠাই কার্টুন দেখে। বা বলা ভালো, দেখার চেষ্টা করে। গেম খেলে। অথবা বলা ভালো, খেলার চেষ্টা করে। আর না পারলে মা বাবার ঘরে গিয়ে চিৎকার করে বলে, “তোমরা থামবে?” ওরা থেমে যায়। বাবা মিঠাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “সরি।” তবে মিঠাই জানে, এতে কিছু যাবে আসবে না। আবার শুরু হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। অল্পসময়ের মধ্যেই শুরু হবে।

তাই বাড়িতে বাবা বেশি না থাকলেই খুশি হয় মিঠাই। অবশ্য ইদানীং শনি-রবিবার বাদ দিলে, বাবা বেশিরভাগ সময়েই থাকে না বাড়ি। বাবা পিএইচডি থিসিস থেকে বই বানাচ্ছে। লাইব্রেরি যেতে হয় তাই ঘনঘন।

অবশ্য শনি-রবিবার বাবা বাড়িতে থাকা মানে প্রায় নিয়ম করে বেড়াতে বেরোনো। কখনো মলে যাওয়া, কখনো দোকানে দোকানে ঘোরা, তারপর ফুডকোর্টে তিনজন মিলে খাওয়া। এই সময়টা মা বেশ খুশি খুশি থাকে। প্রতি সপ্তাহেই প্রায় ফ্যাব ইন্ডিয়ার দোকান থেকে কিছু না কিছু কেনে। কখনো একটা কুর্তি, কখনো রং মিলিয়ে পুরো সেট। কেনে একটা, পরে পরে দেখে পাঁচটা আর ঘাঁটে পনেরোটা।

মা একটা একটা করে জামা ট্রায়ালরুম থেকে পরে বেরোয়, বাবা দাঁড়িয়ে থেকে বাইরে। মোবাইলের ক্যামেরায় বিভিন্ন এঙ্গেলে মা’র ছবি তোলে। মাকে দেখায়। এইরকম অনেক অনেক ছবি দেখার পর, অনেক অনেকবার ট্রায়ালরুমে ঢোকা আর বেরোনোর পর মা একটা জামা পছন্দ করে।

“তোমার পছন্দ হয়েছে? ঠিকঠাক যাচ্ছে তো আমার গায়ে?” মা জিজ্ঞেস করে বাবাকে।

“তুমি যা পরো তাতেই জুলিয়া রবার্টস।” বাবা বলে।

মিঠাই বুঝতে পারে না, প্রতি সপ্তাহে প্রতিবার বাবা কেন একই কথা বলে। মা-ই বা কেন একই কথা জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু, এই সময়টা মা কেমন ওপর ঠোঁটটা বেকিয়ে লাজুক লাজুক হাসে। বাবা অবশ্য মা’র দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয়।

মিঠাই অবশ্য জানে, বাবার মলের কোন দোকানটা সবচেয়ে ভালো লাগে। চিনেমাটির দোকান, যেখানে থরে থরে সাজানো চিনেমাটির কাপপ্লেট। বাবা কেনে না কখনো। দেখে, খালি দেখে। মিঠাইকে বলে, “এখন কিনে লাভ নেই, বুঝলি। আমাদের এই তিন কামরার ফ্ল্যাটে এসব মানাবে না। আমাদের যখন আরও বড়ো একটা ফ্ল্যাট হবে, খুব বড়ো -সেখানে এসব কিনব। সেখানে সব সুন্দর সুন্দর জিনিস থাকবে।”

মিঠাই জানে, বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের ফোনে সুন্দর সুন্দর বড়ো বড়ো বাড়ির ছবি দেখে। মিঠাই যে জানে বাবা দেখে, এটা বাবা জানে না।

মিঠাইয়ের অবশ্য এ দোকানটা থেকে ফ্যাব ইন্ডিয়ার দোকান অনেক বেশি ভালো লাগে। ওখানে কেমন সব কিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা যায়। আর এখানে কোনো কিছুতে হাত দিতেই তো ভয় করে। যদি ভেঙে যায়। আর বাবাও তো বারণ করে।

মিঠাইয়ের ভালো লাগে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ রং। ফুডকোর্টে ঢোকার মুখে বয়ামে বয়ামে থাকে। ওগুলো নাকি লজেন্স। অবশ্য মিঠাইয়ের এই লজেন্স কখনো খেতে ইচ্ছে করেনি। খালি তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। যেমন গন্ধ রবার। আর কতরকমের আদল,কতরকমের রং। আনারস, আম, মিকি মাউস। ডোরা। হাতে ধরে রাখতে ইচ্ছে হয়, দু চোখ মিলে দেখতে ইচ্ছে হয়। ওই রবার দিয়ে মুছতে ইচ্ছে হয় না একেবারেই। তেমনি এই ফুডকোর্টের লজেন্সের বয়াম। মিঠাইয়ের যখন খুব কান্না পায়, মিঠাই চোখ বুজে ভাবে ওই সবুজ লাল লজেন্সের বয়ামটা আমার। ওটা আমি তুলে নিয়ে এসেছি ফুড কোর্ট থেকে বাড়িতে। বয়ামটা জড়িয়ে ধরে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঐসব সবুজ আমার, ভেতরের লজেন্সগুলো আমার, বয়ামটাও আমার। কোনোদিন সবুজ আম বদলে হয় কমলালেবু অথবা লাল টুকটুকে আপেল লজেন্স।

অবশ্য খাওয়া নিয়েও মিঠাইয়ের একটা ছোট্ট গোপন অনুষ্ঠান আছে। গতবার জন্মদিনে বাবা যে ডায়েরিটা উপহার দিয়েছিল, সেখানে আছে একটা লিস্ট। মিঠাই প্রতি সপ্তাহে সেই লিস্টে কিছু না কিছু লেখে। আবার কিছু না কিছু কেটে দেয়। যেমন মলে কটা রেস্টুরেন্ট আছে। ফুডকোর্টে কটা খাবার জায়গা আছে। কোথায় কবার মিঠাই খেলো ওর বাবা-মার সাথে। কী খেলো। প্রতি সপ্তাহে, বাবা মিঠাইকে কোনো না কোনো নতুন আইটেম অর্ডার দিতে দেয়। আর বলে, মার দিকে তাকিয়ে, “এইভাবেই ওর জিভ তৈরী হবে।” তবে, লিস্টের যে অংশটি নিয়ে মিঠাইয়ের সবচাইতে বেশি আগ্রহ, তা হল আইসক্রিম। মলে আইসক্রিমের নতুন দোকান হয়েছে। নতুন ব্র্যান্ড। কলকাতায় নাকি এই ব্র্যান্ডের আইসক্রিম কেউ আগে কক্ষনো খায়নি।

দিল্লির ব্র্যান্ড, বাবা বলে। ওদের বিশেষত্ব হল, ওরা অর্গানিক। ওদের মতো দেশজ ফল থেকে আইসক্রিম নাকি আজ অবধি কেউ বানাতে পারেনি। বাবা-মা খায়। ফলসা, নারকেল, পেয়ারা, বেদানা। মিঠাইয়ের অবশ্য এর একটাও পোষায়নি। মুখে দিয়েই সবকটা থু থু করে ফেলে দিয়েছে। মিঠাই খায় চকোলেট, খালি চকোলেট। আর, এই দোকানটাতে চকোলেটই তো কতরকমের। ডার্ক চকোলেট, মিল্ক চকোলেট, বেলজিয়ান চকোলেট, মোজাম্বিকি, মাদাগাস্কের। আরও কত কী। প্রতি সপ্তাহে একটা একটা করে খেয়ে দেখে মিঠাই। আর ডায়েরিতে লিখে রাখে। রিপিট যেন না হয়।

মলে এলেই বাবা গাদা গাদা ছবি তোলে। মিঠাইয়ের ছবি, মার ছবি। আর সেগুলো ফেসবুকে দেয়। সাথে থাকে ক্যাপশন। “অ্যানাদার উইকেন্ড উইথ ফ্যাম।” “উইথ দা টু মোস্ট ইম্পরট্যান্ট লেডিস ইন মাই লাইফ।” মিঠাইয়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। কিন্তু মিঠাই কেমন করে ফেসবুক ছবি আপলোড করতে হয় জানে। মার ফোন ঘেঁটে ঘেঁটে শিখে নিয়েছে।

যেমনভাবে, মিঠাই এও জানে যে মা দেবাশীষদাদাকে মেসেজ করে। দেবাশীষ দাদাও উত্তর দেয়। দেবাশীষদাদা মাকে লিখেছিল, “ইউ আর সিক্রেট বিকজ ইউ আর সেক্রেড।” মা জবাবে লিখেছিল, “ইউ আর প্রেশস। বাট আই আম নট অ্যান ইজি পার্সন টু ডীল উইথ।” বদলে দেবাশীষদাদা পাঠিয়েছিল ইয়া বড়ো টুকটুকে লাল হার্ট সাইন। নীচে লেখা, “আই লাভ ইউ অ্যাজ ইউ আর।” মাও বদলে পাঠিয়েছিল তিন তিনটে একইরকমের বড় বড় লাল হার্ট সাইন। কিছু লেখেনি অবশ্য।

মিঠাইয়ের খুব রাগ হয়েছিল। দেবাশীষদাদাকে কি মা মিঠাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসে ? কিন্তু নীচে গেলে তো মা দেবাশীষদাদার সাথে কথাও বলে না। প্রায় তাকায়ই না ওর দিকে তখন তো যত কথা সৌম্যদাদা আর জয়ীদিদির সাথে। এমনিতেও তো দেবাশীষদাদা কথা বলে খুব কম। মিঠাইয়ের সাথেও প্রায় কথা বলে না বললেই চলে।

নিচে গেলে এখন মিঠাই ড্যাবড্যাব করে দেবাশীষদাদাকে দেখে। অতীব তৎপর ছাগলছানার মতো চোখ করে দেখে মাকেও। কই মা তো ফিরেও তাকায় না দেবাশীষদাদার দিকে।

তখন মিঠাইয়ের ভয় করে। কেন, মিঠাই ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবে না। কিসের ভয়, তাও ঠিক মিঠাই বুঝিয়ে বলতে পারবে না। তবে ভয় করে।

যখন মিঠাই শনি-রবিবার মলে যায়, আর মা মিঠাই আর বাবাকে ফুডকোর্টে ফেলে রেখে বাথরুমে যাবার নাম করে উঠে যায়, আর অনেকক্ষণ ফেরে না, মিঠাই জানে, মা দেবাশীষদাদাকে মেসেজ করছে।

মিঠাইয়ের তখন ভয় করে।

এইরকম ভয় পেতে পেতে মিঠাই একটা খেলা শুরু করে। মা’র চোখ এড়িয়ে মা’র ফোন থেকে দেবাশীষদাদার মেসেজ ডিলিট করে। রোজ নয়। তিনচারদিন বাদে বাদে।

মা লিখেছে দেবাশীষদাদাকে, “মিঠাই জানে।”

দেবাশীষদাদার উত্তর, “ও বাচ্চা, শ্রাবণীদি।”

“এই, তুই আমাকে এখনো দিদি বলিস কেন রে?”

“:)”

“দিদি বললে কি উত্তেজনা বাড়ে? হুঁ?”

“মিঠাই নোজ, বাট ডাজন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড।”

“আই হোপ, ইউ আর কারেক্ট।”

কী জানে মিঠাই? আর কী-ই বা বোঝে না?

মিঠাই জানে কী করে টেক্সট ডিলিট করতে হয়। মিঠাই মার মুঠোফোনে বোতাম টেপে, ডিলিট করে।

তিনচার দিন বাদে মা লেখে দেবাশীষদাদাকে।

“এটা হয় না।”

“কেন হয় না?”

“বিকজ, আয়্যাম নট ইয়াং এনিমোর।”

“তো?”

“সবকিছু এভাবে ভাঙা যায় না। তুই বড়ো হলে বুঝবি। বিসাইডস, দিস ইজ আ রিলেশনশিপ উইদাউট স্ট্রিংস। অ্যান্ড আই ওয়ান্ট তো কিপ ইট দ্যাট ওয়ে।”

“আর আমি?”

“তুই ছোট। থিংস উইল চেঞ্জ ফর ইউ।”

মিঠাই জানে কী করে স্ক্রিনশট নিতে হয়। মিঠাই স্ক্রিনশট নেয়। পাঠিয়ে দেয় বাবাকে। মা’র হোয়াটস্যাপ নম্বর থেকেই। মিঠাই কিছু ডিলিট করে না। মার নম্বর থেকে পাঠানো মেসেজও নয়। স্ক্রিনশটও নয়।

আর তিনদিন বাদে বাবা সৌম্যদাদাকে ফোন করে। তখন মিঠাই খাবার টেবিলে বসে স্কুলে যাওয়ার আগে টোস্ট চিবুচ্ছে।

“সৌম্য, বাড়িটা তো একটু মাসখানেকের মধ্যে ছাড়তে হবে, ভাই।”

বাবা চুপ তারপর।

নিশ্চয়ই সৌম্যদাদা কিছু বলছে এখন।

“দ্যাখো, আমি কনজারভেটিভ নই। কিন্তু আমাকেও তো পাড়ায় থাকতে হয়, ভাই। তারপর মেয়েটা বড়ো হচ্ছে। তোমাদের বান্ধবীরা আসছে, এতক্ষণ ধরে থাকছে। রাতেও থাকছে কখনো কখনো। সে তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু পাড়ায় কথা হচ্ছে। লোকে আমাকে নালিশ করছে। আর এমনটা তো ঠিক কথা ছিল না। তুমি আর দেবাশীষ থাকবে, এমনটাই কথা ছিল।”

আবারও বাবা চুপ। কিন্তু মুখটা হাঁ হয়ে আছে। যেন এখুনি কিছু বলবে।

অবশ্য সেসব আর মিঠাইয়ের শোনা হয় না। স্কুলবাস ধরার জন্য আরতিমাসির হাত ধরে বেরিয়ে পড়তে হয়। তবে, অন্যান্য দিন যেমন মা খাবার টেবিলে বসে এটা খাও, ওটা খাও বলে ঘ্যানঘ্যান করে, আজ ঠিক তেমনটা হল না। মা ঘরে বসে চশমা পরে কী যেন একটা পড়ছে ফোনে। মিঠাই বেরোনোর সময়ে টাটা করলেও “হুঁ”-র বেশি কিছু বলে না।

এর সপ্তাহ দুয়েক পরে, সুটকেস, ডাফল ব্যাগে নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে সৌম্যদাদা-দেবাশীষদাদা চলে গেল। যাওয়ার আগে “চুক আর গেক” নামে একটা বই মিঠাইকে দিয়ে গেল। সেখানে প্রথম পাতায় মিঠাইয়ের নাম লেখা।

তো, সেই থেকে নিচের ঘর ফাঁকা। মিঠাই জানে, মা-বাবা ভাড়াটে খুঁজছে।

শনিবার যখন ওই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা আসেন, মিঠাই তখন খাবার টেবিলে বসে ছবি আঁকছে। বিষয়গুলো যেভাবে পরপর ঘটে, তাতে মিঠাইয়ের বেশি মনোযোগ দেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। ওঁরা আসেন, বসেন, বাবার সাথে নিচে গিয়ে ঘরটা দেখেন, ফিরে আসেন, মা চা বানিয়ে দেয়।

“মানে, আপনার পুরো নামটা জানা হলো না।” বাবা বলে।

“সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থ আহমেদ।”

“মানে…”

“হ্যাঁ। আমার মা হিন্দু, মা মুসলিম। অবশ্য, সেইরকম কোনো ধর্মীয় আচার আমাদের বাড়িতে মানা হয় না। আমার স্ত্রীর নাম রেহানা। উনি সরকারি স্কুলে পড়ান। আর আমি তো, আপনি জানেনই স্টেট ব্যাংকের কর্মচারী।”

মিঠাই খেয়াল করে, ঘরে কেমন সবাই চুপচাপ। কথা বন্ধ। সিদ্ধার্থ আর রেহানা উঠে দাঁড়ান।

“তো আমরা কবে আবার কথা বলব?” সিদ্ধার্থ জানতে চান।

“আসলে কি বলুন তো, আমরা না অলরেডি ভাড়াটে পেয়ে গিয়েছি,” রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলে মা।

সিদ্ধার্থ একটু চমকে তাকান মার দিকে, তারপর নিজের স্ত্রীর দিকে, তারপর মিঠাইয়ের দিকে।

“ওহ, আচ্ছা। নমস্কার তাহলে।” খুব দ্রুত চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে যান। রেহানাও। যাওয়ার আগে রেহানা একটিও কথা বলেন না।

সিদ্ধার্থ-রেহানা বেরিয়ে গেলে, খাবার টেবিল থেকে মার ফোনটা দেওয়ালে ছুঁড়ে মারে মিঠাই। ফোনটা সশব্দে দেওয়ালে লেগে মাটিতে পড়ে। বেরিয়ে আসে নাড়িভুঁড়ি। মা-বাবা দুজনেই চমকে উঠে তাকায় মিঠাইয়ের দিকে। সিদ্ধার্থ আহমেদ যতটা না চমকেছিলেন, তার থেকে অনেক অনেক বেশি।

“তবে যে আমাকে বলো মিথ্যে কথা না বলতে? আমাকে মারো খালি মিথ্যে বললে। তুমি মিথ্যুক। তোমরা মিথ্যুক।”

চিৎকার করতে করতে কেঁদে ফেলে মিঠাই। কাঁদতেই থাকে। আর খালি বলে, “মিথ্যেবাদী। মিথ্যুক তোমরা।” দেওয়ালে লাথি মারে। মা ও বাবা দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। দেখে। মিঠাইকে সামলাতে আসে না। ধরতে আসে না। মিঠাই চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে মেঝের ওপরেই দলা পাকিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বাবা কোলে করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। অনেকদিন পর, এই শনি-রবিবার মা বাবার সাথে মলে যায় না। ছবি তোলা হয় না। ফেসবুকেও লাগানোর মতো কিছু থাকে না।

নন্দিনী ধর লেখক ও সাহিত্যের অধ্যাপক।

 

সঙ্গের ছবি – ইন্টারনেট থেকে

1 thought on “জ্ঞাতব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.