নার্গিস পারভিন

 

সকাল প্রায় এগারোটা হতে চলল। ব্যালকনিতে রোদটা তীব্র হচ্ছে দেখে, সালমা বেগম আলমারি থেকে সযত্নে সংরক্ষিত পুরনো দুটো কাঁথা বার করলেন। রোদে দেবেন। তাঁর দাদীর আমলের, মায়ের আমলের জিনিস! এসব এখন আর দেখা যায় না। কত দীর্ঘ সময় ব্যয় করলে তবে এমন সূচিশিল্প গড়ে উঠতে পারে! সালমা বেগম কাঁথাগুলো মাঝেমাঝেই বের করে দেখেন, অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। মিহি, নরম, ধপধপে সাদা কাপড়ের উপর নানা রঙের সুতো দিয়ে এত সূক্ষ্ম সেলাই! গাছের লতা, ফুল, পাখি! মায়ের হাতের বানানো কাঁথাটা আবার অন্য আর এক রকমের নকশা। অনেকটা জ্যামিতির ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ আর রম্বস মনে হয়! মা তো এসব জানত না। বলত তিনকোনা, চারকোনা। দুটো কাঁথা যেন দুই প্রজন্মের প্রতিনিধি। সালমা কাঁথাটার ওপর মোলায়েমভাবে হাত বোলাতে থাকেন। যেন তাঁর মায়ের গায়ে হাত বোলাচ্ছেন।

ইম্মু এতক্ষণ তার নানুর সঙ্গে বকবক করছিল পাশের ঘরে। নানীআম্মাকে খুঁজতে এসে কাঁথাগুলো দেখে অবাক।

‘নানীআম্মা এগুলো কী গো? ব্ল্যাঙ্কেট? কী সুন্দর! কালারফুল!

নানীআম্মা বলেন, ‘এটা হল কাঁথা।’

ন বছরের ইম্মু বলে ওঠে, ‘আই সী!’

ইম্মু একটা কাঁথা নিয়ে লুটাতে লুটাতে ওর মায়ের কাছে ব্যালকনিতে চলে আসে। শামিরা তখন তার আব্বুর আরাম কেদারায় বসে বই পড়ছে। সেই সকাল থেকে। ইম্মু মাঝে মাঝে এসে মাকে দেখে যাচ্ছে। আজ শামিরার অফ্ ডে। কলেজ নেই। গতকাল বিকেলে মেয়েকে নিয়ে এ বাড়িতে এসেছে। কয়েকটা দিন থেকে যাবে। সেই কয়েকটা দিন এ বাড়ি থেকেই কলেজ যাবে। এ এক মস্ত সুবিধা তার। দুই বাড়ি থেকেই সে তার কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে পারে। ইম্মু খুব উত্তেজিত হয়ে কাঁথাটা এনে মায়ের কোলে ফেলে দিল।

‘মা দেখ কি সুন্দর! তুমি জানো এটা কি?’

শামিরা বলে, ‘জানি তো, কাঁথা, নকশী কাঁথা।’

শামিরা মেয়ের কাছে জানতে চায়,’তুমি জানো?’

‘জানি,নানী আম্মা বলেছে।’

‘জানো ইম্মু, এটা খুব পুরনো একটা জিনিস। অনেক বছর আগের।’ শামিরা ইম্মুকে আরও বলে, ‘এটা কে বানিয়েছে জানো? মাই গ্র্যান্ মা।’

ততক্ষণে নানীআম্মা অন্য কাঁথাটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। পিছন থেকে নানীআম্মা বলেন, ‘আর এটা বানিয়েছিলেন আমার গ্র্যান্ মা।’

ইম্মু ভাবতেই পারছে না, হ্যান্ড মেইড! ওয়াও! ইম্মু খুব উৎসাহিত। কীভাবে করতে হয়, আমাকে বল না! যেন ও নিজেও একটা বানাবে।

নানীআম্মা হাসতে হাসতে বলেন, ‘বলছি বলছি। রঙবেরঙের সব সুতো দিয়ে এই কাঁথাটা বানানো হয়েছে। জানো তো, এই এ্যাতো সুন্দর রঙিন কাঁথাটা আসলে কতগুলো পুরনো, বাতিল শাড়ি জুড়ে বানানো।’

উৎসাহিত ইম্মু, ‘দ্যাট মিনস্ ওয়েলথ্ ফ্রম ওয়েস্ট! আমাদের স্কুলের মত প্রজেক্ট! তোমার গ্র্যান্‌ মায়ের স্কুলেও ছিল ওয়েল্থ ফ্রম্ ওয়েস্ট?’

নানীআম্মা আর শামিরা হেসে ওঠে।

ইম্মু বলে, ‘আমার জন্য একটা করে দাও না!’

নানীআম্মা বলেন, ‘এগুলো তো সব তোমারই।’

‘সত্যি!’

‘হ্যাঁ তো।’

‘আমি তাহলে এগুলো ও বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি?’

শামিরা হেসে ওঠে, ‘পরে নিয়ে যাবে।’

নানীআম্মা বলতে থাকেন, ‘পুরনো, বাতিল শাড়ি সেলাই করে এই কাঁথা তৈরি হলেও একে হেলা করো না, কত মজবুত দেখেছ! তুমি ছিঁড়তেও পারবে না। বছরের পর বছর ব্যবহার করতে পারবে। আগেকার সময়ে মানুষ তাই করতো।’ নানীআম্মা কথার পিঠে কথা জোড়েন, ‘তুমি কি জানো, এভাবে যদি মানুষও সবাই একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে, বেঁধে বেঁধে থাকে তখন দলবদ্ধ মানুষও হয়ে ওঠে মজবুত! এভাবেই গড়ে ওঠে একতা!’

ইম্মু বুঝতে না পেরে প্রতিধ্বনি তোলে, ‘একতা!’

শামিরা তখন পড়া থামিয়ে মেয়েকে বলে, ‘ইউনিটি।’ শামিরা আরও বলে, ‘এই যে কাঁথাটার মধ্যে বিভিন্ন রঙের সুতোর সেলাইয়ে কালারফুল একটা ছবি গড়ে উঠেছে, এটা ঠিক আমাদের দেশের মতো। আমাদের দেশেও রয়েছে কত ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ। তাদের খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক রীতিনীতি সব ভিন্ন। আর এটাই এদেশের মৌলিকতা। কত রকমের ফেস্টিভ্যাল, কার্নিভ্যাল! ইম্মু তার মায়ের কাছে এমন কথা অনেকবার শুনেছে। শামিরাও এই দেশের বৈচিত্র্য এবং একতা ব্যাপারটা নানাভাবে মেয়ের মধ্যে বুনে দিতে চায়। এরাই যে দেশের আগামী। ভবিষ্যত কাণ্ডারী। সে ইম্মুকে বলে, ‘আবার দেখো, এই নানারঙের সুতোগুলোই কিন্তু পাশাপাশি সারিবদ্ধ ভাবে বেঁধে বেঁধে আছে বলেই এতটা মজবুত হয়েছে। দ্যাট ইজ কল্‌ড ইউনিটি।’

মেয়ে বলে উঠল, ‘একতা!’ শামিরা হেসে মেয়েকে আদর করে। কিছুক্ষণ পর ইম্মু বলে, ‘মাম্মি, দ্য সেম লজিক উই ক্যান অ্যাপ্লাই ফর দ্য হোল ওয়ার্ল্ড! আই মীন, ডাইভারসিটি… ইউনিটি..’.

শামীরা বলে ওঠে, ‘ইয়েস, অফকোর্স। হাউ নাইসলি ইউ থট! এক্সে‌লেন্ট! এই বিশ্বভাতৃত্ববোধ, এই মানবতাবোধই মানুষকে করে তোলে কাইন্ড, অনেস্ট, কেয়ারিং আর লাভিং। এই সবগুলো গুণের অধিকারী ছিলেন মাদার টেরিজা। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সারা বিশ্ববাসীর মা। অলদো শী ডিড নট হ্যাভ হার ওন চাইল্ড।’

মায়ের মুখ থেকে এইসব গল্প শুনতে ইম্মু ভীষণ ভালোবাসে। ইম্মু গল্প শুনতে চাইলে শামিরাও এইসব জীবন্ত মানুষদের বীরগাথাই বেশি বলে। ব্যালকনিতে বসে কথা বলছিল ওরা। ঘরের ভেতর থেকে শামিরার আব্বু ডেকে উঠলেন, শামিরার ফোন বাজছে। শামিরা উঠে গিয়ে ফোন রিসিভ করল। ফোনের কথোপকথনে শামিরার উৎকণ্ঠা এবং দুশ্চিন্তা লক্ষ্য করে আব্বু বুঝে গিয়েছিলেন কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। ফোন রাখতেই আব্বুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আটকে গেল শামিরা।

 বলল, ‘আমাদের কলেজের প্রিন্সিপালকে ঘেরাও করেছে।’

 ‘কারা? কেন! উনি তো একজন সৎ ও নির্ভীক মানুষ।’

‘ঠিকই বলেছ। আসলে উনি আপোষহীন বলেই ওনাকে নিয়ে সবার সমস্যা। ওনার কোনো রাজনৈতিক ছত্রছায়াও নেই।’ শামিরা সবিস্তারে বলতে থাকে, ‘কিছুদিন থেকে কলেজের ফান্ডের হিসাব নিয়ে একটা জট পাকিয়ে উঠেছে। তাতে একটা হিউজ অ্যামাউন্টের ফারাক, প্রায় দশ লক্ষ টাকা। কনস্ট্রাকশন খাতে যে ফান্ড পাওয়া গেছে সেই খাতের টাকা। কাজটা সবে শুরু হয়েছে, তার প্রথম দফার অডিটেই গড়বড়। এদিকে প্রিন্সিপালকে তো জানোই, এসব মেনে নেবেন না। বলেছেন সঠিক হিসাব দিতে, তবেই তিনি স্বাক্ষর করবেন। দু’দিন আগেও প্রিন্সিপাল সব ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপকদের নিয়ে মিটিং করলেন। দু’একজন ছাড়া প্রায় সকলেই আমরা উপস্থিত ছিলাম। আমরা সবাই প্রিন্সিপালের বক্তব্যের সঙ্গে একমত। যথাযথভাবে হিসাব দেয়া হলে তবেই তিনি স্বাক্ষর করবেন। মূল হোতা লাইব্রেরিয়ান বিপুল দেব। নতুন এসেছেন ভদ্রলোক। বছর দুয়েক হবে। এবারে নতুন ম্যানেজিং কমিটি গঠন হল, সেখানে ঢুকেছেন। এলাকার প্রভাবশালী লোক। সাবকমিটিগুলোতেও নিজের পছন্দের লোক ঢুকিয়েছেন। পিছনে আরও কেউ কেউ থাকতে পারেন। টিচিং স্টাফেদের তিনজনের মধ্যে একজন খুব নীরব রয়েছেন। কি ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে না। কী জানি, বিপুল দেব এর সঙ্গে জড়িত কিনা! এখন শুনছি প্রিন্সিপালকে হঠাতই ঘেরাও করেছে, আটকে রেখেছে। কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও নাকি সেমিনার রুমে ভরে উত্তেজনামূলক বক্তব্য রাখা চলছে। প্রিন্সিপালের নামে নানা মিথ্যা অভিযোগ ছড়াচ্ছে। এমনকি ঐ তহবিল তছরুপের দায়টাও প্রিন্সিপালের নামে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’

আব্বু বলে উঠলেন, ‘মিথ্যা অভিযোগ করলেই তো হল না। প্রমাণ দিতে হবে না?’

‘ওটাই তো বড় সমস্যা! এরা আইন বা প্রমাণের পরোয়াই করেনা। অথচ আগেও বহুবার দেখেছি, প্রিন্সিপাল কোনোদিনই অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি। কিন্ত সেসব সংঘাতগুলো ছিল আইন নির্ভর। উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তার নিষ্পত্তি হয়েছিল। এখন তো মিথ্যাচারকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিথ্যা গল্প বানাচ্ছে। বলছে, ওরা যা করেছে সেসব প্রিন্সিপালের কথা মতই করেছে। মনে করছে জোরগলায় বললেই মিথ্যা সত্য হয়ে উঠবে। এদিকে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। আর সত্যমিথ্যার যাচাই হওয়া তো যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। মানুষ ততদিনে আবার অন্য একটা বিষয় নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠবে! ভাবছি, ভিতরে ভিতরে কতটা এগিয়েছে! বিপুল দেব আবার একটা শক্তপোক্ত সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত। কলেজের মধ্যে বেশকিছু ছাত্রছাত্রীদেরও তারা ওই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করেছে, ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে ভিতরে ভিতরে। সেই সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা আবার বিপুল দেবের অন্ধভক্ত। মাঝেমাঝে তাদের মাঝে বক্তব্য দেয় সে। মাঝেমাঝেই অন্য সংগঠনের ছাত্রদের সঙ্গে কলহ সংঘাতের রূপ নিচ্ছে। মাসদুয়েক আগে প্রিন্সিপাল সব সংগঠনের ছাত্রনেতাদের ডেকেছিলেন। কলেজের সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে আবেদন করেছেন। কী যে ওদের উদ্দেশ্য, কী যে পরিকল্পনা ঠিক বোঝাও যায় না। কেবল মনে হয় ভিতরে ভিতরে যেন একটা কিছুর চক্রান্ত চলছে। কেবল আমাদের কলেজে নয়, আরো অনেক কলেজেই নাকি ওরা ছড়িয়ে পড়েছে। আর তাদের চালনা করছে ওইরকম এক একটা বিপুল দেব। ছেলেমেয়েগুলো সবসময় যেন একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে থাকে। দলবদ্ধভাবে ঘোরাফেরা করে। কী যেন সব আলোচনা করে। ওরা মনে করে, যে পথে শিক্ষা-সংস্কৃতি এগোচ্ছে সে পথ প্রকৃত পথ নয়। প্রকৃত পথটা যে কী সেটাও তারা পরিস্কার করে বলছে না। খালি শোরগোল তুলছে। গোপনে গোপনে কিছু পরিকল্পনার ছক গড়ে তুলছে বলেই মনে হচ্ছে। আজকের ঘটনা যেন তারই প্রমাণ দিচ্ছে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন ছেলেমেয়েও যুক্ত ওদের সঙ্গে। কিছুদিন ধরেই অদ্ভুত এক বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করছি ওদের মধ্যে। চোখের ভাষা, ব্যবহার সব দুর্বোধ্য লাগে। অথচ আগে এমনটা ছিল না। স্পষ্টই বোঝা যায় ওদের পিছনে কোনো শক্ত মাথা রয়েছে।’

শামিরার দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়ে আব্বুর মধ্যেও। তিনি জানেন তাঁর মেয়ে কতটা দৃঢ় স্বভাবের। এমনিতে মৃদুভাষী কিন্তু কাজে বা কথায় সে দৃঢ়। এহেন মেয়েকে এতটা দুশ্চিন্তামগ্ন দেখে বুঝতে পারেন আকাশের মেঘ কতটা দুর্যোগপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভিতরে ভিতরে। তিনি বলে ওঠেন, ‘সেকী! এতো কিছু হয়ে যাচ্ছে কলেজে, কই তুমি বলনি তো?’

শামিরার সম্বিৎ ফিরে আসে। সে চায় না এসব ঝঞ্ঝাট এর মধ্যে আব্বুকে টেনে আনতে। আব্বুর বয়স হয়েছে। তার ওপর বছরখানেক হল আর্টারিতে স্টেন্ট বসেছে। এখন আর খুব বেশি দুশ্চিন্তায় রাখা ঠিক হবে না। সেইসব ভেবেই শামিরা বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছিল। আব্বুর প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, ‘আসলে অনেকদিন এ বাড়িতে আসা হয়নি। সবকিছু নিয়ে ওবাড়িতেও একটু ব্যস্ত ছিলাম। তাই আর বলা হয়নি।’

আব্বু বলেন, ‘আকাশকে জানিয়েছ? সে কি বলল?’

শামিরা বলে, ‘হ্যাঁ, ও জানে। কি আর বলবে? তাছাড়া বিষয়টা যে এতদূর গড়াবে তা তো আমরা কেউই জানতাম না। শামিরা দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন।বলে, ‘খুব অবাক হচ্ছি জানো! বলছে নাকি অন্যান্য কলেজ থেকেও বহু ছাত্রছাত্রী এসে বেশ বড়সড় একটা ভিড় বানিয়ে প্রিন্সিপালকে আটকে রেখেছে।’

আব্বুর প্রশ্ন, ‘এখন?’

‘সেটারই ভাবনা চিন্তা চলছে। সঙ্গীতা ফোন করে ওটাই বলল। সত্যজিৎবাবুসহ কয়েকজন অধ্যাপক আর বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী একত্রিত হতে পেরেছে। বাকিদেরও ফোন করা হচ্ছে। পুলিশও নাকি এসেছে। দেখি আমিও একবার যাই। বোঝা যাচ্ছে না বিষয়টা কোন দিকে গড়াচ্ছে। আসলে এই তহবিল তছরুপের বিষয়টা হয়ত মীমাংসা হয়ে যেত। চিন্তাটা হচ্ছে, এভাবে একটা দোষকে আড়াল করে, পায়ে পা দিয়ে ঝামেলা সৃষ্টির প্রচেষ্টায়। আর সামনে এগিয়ে দিয়েছে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের। তাদের ক্রমাগত একটা ভুল পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।’

আব্বু বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, সবসময়ই অমূল্যদের আবেগের অপব্যবহার ঘটে থাকে আর কী! দেখো কি হয়! তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’

‘আচ্ছা।’ শামিরা বলে, ‘আমি আকাশকে একটা ফোন করে দিচ্ছি। ফেরার পথে কলেজ হয়ে আমাকে নিয়ে আসবে।’

‘হ্যাঁ সেই ভালো।’

‘মাম্মি তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

 ‘আমি একবার কলেজ যাচ্ছি।’

‘আজ তো তোমার অফ ডে!’

 ‘হুম, আজ আমার অফ ডে। কিন্তু একটা বিশেষ প্রয়োজনে আজকে আমাকে যেতে হচ্ছে। তুমি লক্ষী মেয়ে হয়ে থেকো। কেমন? নানীআম্মার সঙ্গে লাঞ্চ করে একটু রেস্ট কোরো। আমি বিকেলের মধ্যে ফিরে আসব।’

অনিচ্ছার ভাব নিয়ে ইম্মু উত্তর দেয়, ‘আচ্ছা বেশ। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো কিন্তু।’

শামিরা রিকশায় বসে ভাবতে থাকে, ‘অদ্ভুত এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেন! ভালোমন্দ, সাদাকালোর তফাতগুলো যেন মুছে দেওয়া হচ্ছে। ক্রমশ দোষীদের কন্ঠস্বরই উচ্চগ্রামে উঠছে। অর্থ মানুষকে পুতুলের মত নাচাচ্ছে। প্রয়োজনে দিন কে দিন নয়, রাত বলতে শেখাচ্ছে। আজকাল দোষীদের শাস্তি হয়না বরং তাদেরনিয়ে চর্চা করলে দোষ হয়ে যায়। চিন্তাধারায়, কাজেকর্মে আমরা কি পিছনদিকে ফিরে চলেছি? আর ঐ একএকটা বিপুল দেব কী সেই ক্রম অবনতিরই মূর্তিমান রূপ?’

শামিরা একটা সামগ্রিক চিন্তার আবর্তে ঢুকে পড়ে, ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে চুয়াত্তর বছর পার হয়ে গেল। আজও কি আমরা মানবিকতায়, সহনশীলতায়, নিষ্ঠায় সেই সত্যের পথ বেছে নেব না? প্রশ্নহীন আনুগত্য নয়, যাচাই এর মাধ্যমে, গ্রহণবর্জনের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠবে যে নৈতিক মূল্যবোধ, সেই মূল্যবোধই তো জাতির বা দেশের মেরুদন্ড। সেই দেশের জনগণই তো বলতে পারবে, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই। সেই একই ভাবনায় প্রভাবিত হবে সমগ্র দেশ। সেই বুনিয়াদের ওপরে মেরুদন্ড সোজা করে উঠে দাঁড়াবে সেই দেশের প্রতিটা পরিবার। প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি দেশের কাণ্ডারী!’ ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে সঙ্গীতার ফোনে। ফোনটা ছেড়ে, প্রথম যে ভাবনাটা শামিরার মনে এল তা হল প্রিন্সিপালকে ভয় দেখিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া বা তাকে শারীরিক আঘাত করা বিপুল দেবের উদ্দেশ্য নয়। ওরা যেনতেন প্রকারে একটা ঝামেলা বাধাতে চাইছে। প্রিন্সিপালের নামে বদনাম রটিয়ে, সবার সামনে অপমানিত করে, কলেজের মধ্যে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইছে। আসলে এখনও কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের কাছে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, মানবিকতা সবার ওপরে। সেই মানুষগুলোকে কষ্ট দিতে শারীরিক আঘাতের প্রয়োজন হয় না। তাঁদের চরিত্র কলঙ্কিত করতে পারলেই হল। প্রিন্সিপাল যে সেই জাতের মানুষ। সমগ্র কলেজ সেটা জানে। তাছাড়া প্রিন্সিপালই ওদের পথের একমাত্র কাঁটা। বাকিরা ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক ওদের সঙ্গেই থাকবে। একমাত্র প্রিন্সিপাল স্যারই বুক দিয়ে এই কলেজকে রক্ষা করে চলেছেন বছরের পর বছর। তাঁর প্রয়াসেই কলেজের প্রায় সব শিক্ষকরা ছোটখাট মতবিরোধ বাদ দিয়ে একটা পরিবারের মত মিলেমিশে কাজ করার পরিবেশ পেয়েছেন। ওরা জানে, প্রিন্সিপালই এই একতার মেরুদণ্ড। এবার কি তবে সেই একতায় ফাটল দেখা দেবে!’ শামিরা মনে মনে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে একটা যোগ্য প্রতিরোধের জন্য।

রিক্সা থেকে নেমে পয়সা মিটিয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে গেল শামিরা। সঙ্গীতার ফোনে বলে দেওয়া কথামত পিছন গেট দিয়েই কলেজে প্রবেশ করল সে। সামনেই কিছু চেনা ছাত্রছাত্রী চোখে পড়ল। কয়েকজন এগিয়ে এসে বলতে শুরু করল, ‘ম্যাম, বাংলা ডিপার্টমেন্টে চলুন। ওখানে বাকি স্যার-ম্যামরা আছেন। খুব গণ্ডগোল বাঁধবে মনে হচ্ছে। প্রিন্সিপাল স্যারের নামে হাবিজাবি হাজারো মিথ্যা অভিযোগ এনেছে ওরা। কী বাজে ব্যবহার করছে স্যারের সঙ্গে! বিপুলবাবু, কিছু ননটিচিং স্টাফ, আর আমাদের কলেজের বেশকিছু ছাত্রছাত্রী পুরো ব্যাপারটা ঘটাচ্ছে। ক্রাউড হিসেবে অন্য কলেজ থেকে অনেকে এসেছে, সেই সঙ্গে ছাত্র নয় এমন অনেকেও আছে। আমরা কিন্তু ছাড়বোনা। ওরা যা খুশি করে বেরিয়ে যাবে, তা হতে দেব না। এই কলেজের একটা মানসম্মান আছে।’ 

শামিরা দ্রুতপদে হাঁটতে হাঁটতে কেবল বলল, ‘এই সময় মাথা গরম কোরো না। কোনো ঝামেলায় যাবেনা তোমরা। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।’ তারপর একটু শাসনের ভঙ্গিতে, ‘যতক্ষণ না কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বা তোমাদের কোনো নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তোমরা কিচ্ছু করবে না।’ 

ছাত্রগুলো যেন একটু নিভে গেল। বলল, ‘ওকে ম্যাম।’

ওরা বাংলা বিভাগের কাছে পৌঁছে গেছে। সামনের মাঠে প্রায় শখানেক ছাত্রছাত্রীর ভিড়। একজন ছাত্র তাদের মাঝে বক্তব্য রাখছে। পাশে কয়েকজন শিক্ষক রয়েছেন। সম্ভবত আশু পরিকল্পনার কথা তাদের জানানো হচ্ছে। মেইন বিল্ডিং থেকে চেঁচামেচি আস্ফালনের তীব্র আওয়াজ ভেসে আসছে। কিছু পুলিশ মেইন বিল্ডিং এর সামনে দেওয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে। কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিকওদিক। তবে পুলিশ যে কেন এই ঝামেলাটা মিটিয়ে দিচ্ছে না তা বোঝা যাচ্ছে না। সঙ্গীতার কথামতো শামিরা বাংলা ডিপার্টমেন্টের কমনরুমে ঢুকে গেল। আরও দু’জন শিক্ষক, ইকোনমিক্সের সুমিতবাবু এবং কেমিষ্ট্রির আহমেদ স্যারও তখনই পৌঁছালেন। সেখানে ইতিমধ্যেই বেশকিছু অধ্যাপক, ছাত্রনেতা অস্থিরভাবে এদিকওদিক করছেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। ঘরের মধ্যে একটা শোরগোল চলছে। সকলেই যেন একটা নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। অবশ্য এক পর্ব আলোচনা হয়েছে অধ্যাপকদের মধ্যে। বিপক্ষের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। তবে খুব বড় দলে গেলে ওরা অশান্তির সৃষ্টি করতে পারে ভেবে পাঁচজন অধ্যাপক গেছেন, সত্যজিৎবাবুর নেতৃত্বে। সত্যজিৎবাবু এবারের কমিটিতেও আছেন।

একটু পরেই সত্যজিৎবাবুদের ছোট্ট দলটা শোরগোল তুলতে তুলতে ঘরে ঢুকল। সত্যজিৎবাবুর উত্তেজিত কণ্ঠ। পুলিশ আটকে দিয়েছে তাঁদের। কিছুতেই ঘটনাস্থলে যেতে দেয়নি। অজুহাত দেখিয়েছে ওখানে গেলে পুলিশ তাঁদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে পারবে না।

সত্যজিৎবাবুর রাগত উক্তি, ‘ওরা আমাদের আটকাতে পারছে, অথচ সারাদিন ধরে একটা মানুষকে ঘেরাও করে রেখে যারা ঝামেলা পাকাচ্ছে, যার অধিকাংশই বাইরের লোক, তারপরও পুলিশ তাদের কিছুই করছে না। অদ্ভুত! আর পুলিশ করবে কেন? শোনা যাচ্ছে পুলিশের বড়বাবু নাকি বিপুল দেবের সংগঠনের সমর্থক। প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা দিচ্ছেন তিনি।

দু’তিনজন ছাত্র এক সঙ্গে উঠে দাঁড়াল, ‘স্যার আমাদের নির্দেশ দিন। আমরা দলবদ্ধভাবে যাব। স্যারকে নিয়ে আসব। দেখি কে কী করতে পারে!’

বিপদের গন্ধ ভেসে আসছে দেখে উঠে দাঁড়াল শামিরা। উচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘না, কেউ মাথা গরম করবে না। আমাদের এখন পরিকল্পনা করেই এগোতে হবে।’ তারপর সত্যজিৎ স্যারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, খুব দ্রুত কয়েকটা বিষয় নিয়ে একটু বলতে চাই, যদি অনুমতি দেন।’

কলেজের অন্যান্য অধ্যাপকরা তো বটেই, বর্ষীয়ান শিক্ষক সত্যজিৎবাবুও শামিরাকে সমীহ করেন। কলেজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ যৌথ উদ্যোগে সম্পন্ন করার সময় সত্যজিৎ বাবু শামিরার বিচক্ষণতা লক্ষ্য করেছেন। তার উপর ভরসা করা যায়। এমন একটা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি পোষণ করেন শামিরা সম্বন্ধে অন্যান্য অধ্যাপকরাও। কমবেশি সকলেই।

সত্যজিৎবাবু সম্মতি দিলে শামিরা শুরু করল, ‘এখন উত্তেজিত হওয়ার সময় কিন্তু একদম নয়।’ সত্যজিৎ বাবুর দিকে চেয়ে বলল, ‘স্যার ওরা তো ঝামেলাই চাইছে। ভেবে দেখুন, প্রায় কয়েক ঘন্টা হতে চলল ওরা প্রিন্সিপাল স্যারকে ঘেরাও করে রেখেছে। যদি স্যারের স্বাক্ষর আদায় করাই ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য হতো তাহলে অন্যরকম হতো। ওদের প্রকৃত উদ্দেশ্য একটা ঝামেলা বাঁধানো। ছাত্রদের বিরুদ্ধে ছাত্রদের লড়িয়ে দেওয়া। এভাবে কোনো দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। আর সেটাকে ইস্যু করেই ওরা তখন মূল সমস্যা থেকে সরে আসবে। মানুষকে ভুল বোঝাবে। নিজেদের প্রভাব খাটাবে। তাছাড়া আমরা দেখতেই পাচ্ছি পুলিশেরও প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে। সুতরাং আমাদের আরো সাবধান হতে হবে।’

একজন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন? এই মুহূর্তে আমরা কি করব তাহলে?’

একটু থেমে শামিরা বলল, ‘সবদিক ভেবে আমার মনে হচ্ছে আমরা মহিলা অধ্যাপকরা যদি যাই, পুলিশ আমাদের আটকাতে পারবে না। বা আটকালেও চট করে দুর্ব্যবহার করতে পারবে না।’

ছাত্রীরাও অনেকে উঠে দাঁড়াল। তারাও যেতে চায়।

শামিরা তাদের বসতে অনুরোধ করে আবার বলতে থাকে, ‘স্যার,এইমুহূর্তে এই কলেজে কোন সংবাদ মাধ্যমেরও উপস্থিত হওয়া প্রয়োজন। হোক স্থানীয়, তবু ক্যামেরার সামনে চট করে বিশেষ কিছু করা কারোর পক্ষে সম্ভব হবে না। এমনকি পুলিশও কিছু করার আগে একবার ভাববে। এমনিতেই চারিদিক মিথ্যা খবরে ছেয়ে যাচ্ছে। পরে কী সংবাদ পরিবেশিত হবে জানা নেই। আমাদের দিক থেকে একটা প্রমাণ থাকলে ভালো। এবার শামিরা তার পরিকল্পনা জানাতে থাকে। পাঁচসাতজনের বা বড়জোর দশজনের একটা দল গড়ে তুলে ওরা শান্তিপূর্ণভাবে যাবে। তার আগে আর একটা কাজ করতে হবে। শামিরা ভিড়ের মধ্যে থেকে খুঁজে তার ডিপার্টমেন্টের দু’জন ছেলেকে একবার স্টাফরুমে যেতে বলল। সেখানে তার লকারে কয়েকটা বই রাখা আছে। সেগুলো নিয়ে আসার নির্দেশ দিল। শামিরা লকারের চাবিটা ব্যাগ থেকে বের করে ছুড়ে দিতেই ওদের একজন লুফে নিল। তারপর তারা বেরিয়ে গেল।

পলিটিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষক হিসেবে ক্লাসে পড়াতে পড়াতে শামিরার মনে হয়েছে, সংবিধান বা তার ধারাগুলো সম্বন্ধে ছাত্রছাত্রীদের আর একটু বিশদে জানা প্রয়োজন। সহজেই যাতে ছাত্রছাত্রীরা সংবিধান পাঠের সুযোগ পায়, তার জন্য সংবিধানের বেশ কিছু কপি লাইব্রেরিতে থাকা প্রয়োজন। সে মনে করে যে সংবিধান মানুষের স্বাধীনতার সুরক্ষা এবং তার অপব্যবহার রোধ করতে গড়ে তুলেছিলেন বাবা আম্বেদকর। সেই সংবিধানের শিক্ষায় দেশের নাগরিকদের শিক্ষিত হওয়া জরুরি। বেশ কিছু ধারা এবং মৌলিক অধিকারগুলো সম্বন্ধে নাগরিকদের অবহিত হওয়া প্রয়োজন। তার মনে হয়েছে, লাইব্রেরিতে সংবিধানের কয়েকটা কপি থাকলে ছাত্রছাত্রীরা সেগুলো নিজেদের মত করে পড়তে পারবে। দু’একটা কপি আছে ঠিকই, তবে সেগুলো শিক্ষকদের হাতেহাতেই ঘোরাফেরা করে। ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছায় না। সেই সব ভেবেই দশটা মত সংবিধানের কপি সে নিজেই কিনে এনেছে। লাইব্রেরির ভরসায় বসে থাকা সময় সাপেক্ষ ভেবে। সেই দশটা কপির একটা কপি সে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। সেটাই সকালে পড়ছিল। ভেবেছিল, একটু দেখে নিয়ে লাইব্রেরিতে জমা দেবে। আপাতত বাকি কপিগুলো তার লকারে রাখা আছে। কিন্ত এরকম একটা মুহূর্তে শামিরার এই বই আনতে বলার নির্দেশে সবাই হতবাক! সত্যজিৎবাবুও সংশয়ে। তিনি শামিরার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। শামিরাও জানে, সবার মনে প্রশ্ন জাগছে। সে সত্যজিৎবাবুর দিকে চেয়েই শুরু করল, ‘স্যার আমি বুঝতে পারছি, এই মুহূর্তে বই আনতে বলাই সবার মনে কৌতুহল দেখা দিয়েছে। বিষয়টা বুঝিয়ে বলছি। স্যার ভেবে দেখুন, ওরা সংখ্যায় অনেক বেশি। আমরা মুষ্টিমেয়। এমনকি পুলিশ ওদের সমর্থনে। ওরা চাইলেই হিংসা ছড়াতে পারে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এবং কাজে সফল হওয়া। এখানে কেবল প্রিন্সিপালকে উদ্ধার করাই নয় এই কলেজের পরিবেশ যাতে ভবিষ্যতেও কেউ কলুষিত না করতে পারে সেই বার্তাও দেওয়া প্রয়োজন। কোনরকম বিভাজন যে এই কলেজের মধ্যে সহজ নয় তা বুঝিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। আর তার জন্য প্রয়োজন এই বইটা।’

শামিরার ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বইটা এখন তার হাতে। বইটা দেখিয়ে সে বলছে, ‘এটি আমাদের মহাগ্রন্থ। আমাদের সংবিধান। সমগ্র ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে এই গ্রন্থের সূত্রে। আমরা জানি, এই গ্রন্থটি সেই গ্রন্থ যার পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ব্যক্তি মানুষ খুঁজে পায় তার সীমাহীন আকাশে ওড়ার ছাড়পত্র। আবার এই গ্রন্থটিই মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছে কীভাবে অন্যের অস্তিত্বকে, অন্যের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিতে হয়। নিজেদের চারপাশে নিয়ন্ত্রণের গণ্ডি টেনে। এই গ্রন্থ সেই গ্রন্থ যা গণতান্ত্রিক দেশের সাধারণ মানুষের হাতে উঠে এলে তা হয়ে ওঠে একটি ধারালো অস্ত্রের থেকেও শাণিত। আবার এই গ্রন্থই ক্ষমতাসীন স্বেচ্ছাচারী মানুষকে করে তোলে অস্ত্রহীন। সুতরাং আমার মনে হয়, আজ আমাদের এই সংকটময় মুহূর্তে সংবিধানই পারে আমাদের অভিযানের মূলমন্ত্র হয়ে উঠতে।’

শামিরার এই বক্তব্য সকলের মধ্যে এক ইতিবাচক সাহসের জন্ম দিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। সবার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এটাই যথার্থ করণীয়।

শামিরার কথা শেষ হলে সত্যজিৎবাবু উঠে দাঁড়ালেন। শামিরাকে সমর্থন করলেন। কিন্ত এই বিপদের মধ্যে তিনি শামিরাদের একা ছাড়তে রাজি নন। সিদ্ধান্ত নিলেন দশজনই যাবেন। কিন্ত সঙ্গে থাকবেন সত্যজিৎবাবুও। ছাত্র নিরঞ্জনও তাদের সঙ্গে যাবে। দু’জন ছাত্রীও। একজন ছাত্রকে বলা হল তাদের পরিকল্পনা শান্তিপূর্ণভাবে অন্যান্য ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে।

তখন আকাশের সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে। বিকেলের নরম আলোর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে ওরা দশজন। ওদের সবার হাতে সংবিধান। ওরা জানে, একটু যাওয়ার পর প্রথমেই পুলিশের মুখোমুখি হতে হবে। মুখোমুখি হতে হবে বন্দুকের। তবুও ওরা এগিয়ে চলল। দুইহাতে সংবিধান তুলে ধরে এগিয়ে যেতে যেতে ওরা অদ্ভুতভাবে সাহসী হয়ে উঠল। তাদের বুকের ভেতর জেগে ওঠা সাহস তারা নিজেরাও টের পাচ্ছিল যেন। ওদের মুখের বলিরেখা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল। ওদের পদক্ষেপ হয়ে উঠল দৃঢ়! কিছুটা দূর থেকে পুলিশগুলো ওদের আসার ধরণ দেখে বুঝতে পারছিল ওদের থামানো দুষ্কর। একমাত্র বন্দুকের নলই পারে ওদের থামাতে। ওপর থেকেও তেমন নির্দেশই আছে। শূন্যে গুলি ছুড়ে যেন ভয় দেখানো হয়। কিন্ত তা সত্ত্বেও ওরা পারল না। সংবিধান হাতে এগিয়ে আসা মানুষগুলোকে দেখে তাদের বন্দুকের নল নত হল। শান্তিপূর্ণভাবে প্রিন্সিপালকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার পর সেই রাতেই আইনজ্ঞ সহযোগে প্রিন্সিপাল থানায় এফ.আই.আর. করলেন। পরের কয়েকদিন কলেজ ক্যাম্পাস জুড়ে প্রচার চলল। কবিতায়,গানে,বক্তব্যে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকসহ সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন চ্যানেলে বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়ল ঘটনাটা। কয়েক মাসের মধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের এই ধরন। সংবিধানের কপি ঘুরতে থাকে মানুষের হাতে হাতে। সে বছর একটা পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সর্বোচ্চ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে শীর্ষস্থান লাভ করে সংবিধান। আরও শোনা যায়, এক গর্ভবতী নারীকে যখন অন্যায় ভাবে জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মিথ্যা অভিযোগে, তখন তার পরিবার অসহায় ভাবে ভেঙে পড়লে সেই নারী তার পরিবারকে আশ্বস্ত করে এই বলে, তার সঙ্গে সে নিয়ে যাচ্ছে তার রক্ষাকবচ, মহাগ্রন্থ সংবিধান।

নার্গিস পারভিনের বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে লেখালেখিতেই নিয়োজিত। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই, মনের নিজস্ব তাগিদে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। সময়, সমাজ, প্রকৃতি, প্রেম, নারীবাদ, রচনার মূল বিষয়। ২০০৯-২০১১ এগারো জাপানে থাকাকালীন সময়ে হিরোশিমা পরিদর্শন এবং ‘হিরোশিমার সন্ধানে’ গ্রন্থের উৎপত্তি। প্রকাশ কাল ২০১৪ (পরম্পরা প্রকাশন)। ‘স্বপ্নখোরের শার্সি’ কবিতা গ্রন্থের প্রকাশ কাল ২০১৯ (পৌষালী প্রকাশনী)। ‘ঝিঁঝি ডাকা নীরবতা’ কবিতা গ্রন্থের প্রকাশ কাল ২০২০ (বাংলা জার্নাল, বাংলাদেশ)।

সঙ্গের ছবি কৃতী চক্রবর্তী

3 thoughts on “মহাগ্রন্থ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.