জিনিয়া ব্যানার্জ্জী অধিকারী

 

এক

কামারদের খামারে পাঁচিল ঘেরা ফাঁকা জায়গাটায় একদিকে ধান ঝরানো আর একদিকে খড়ের পালুই বাঁধা চলছে দিনকতক হল। সকালবেলা কিছুক্ষণ কাজ বন্ধ থাকে। সেই সময়টা ডাঁই করা খড়ের গাদাতে পাড়ার ছেলেমেয়েগুলো এসে জোটে রোজ। টুকি, পুকু, মিনি, রতন ও পম্পা। পালুইয়ের পিছন দিক থেকে হঠাৎ একটা সরসর আওয়াজ হতেই সবাই ‘কে? কে?’ করে চেঁচিয়ে উঠল। সাহস করে পিছন দিকটা একবার দেখবে নাকি বাড়ি ফিরে যাবে, ভাবতে ভাবতে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, এমন সময় টুকির চোখে পড়ল সবুজ-কালো, চেক-প্রিন্ট শাড়ীর আঁচল। সঙ্গে সঙ্গে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ির দিকে দৌড় দিল টুকি। কামারদের বাড়ি থেকে চারটে বাড়ি পেরিয়ে সাদা রঙের বড় দালান বাড়ি। ব্যানার্জ্জী-বাড়ি। ছোট কালো গেট খুলে, সরু গলি পেরিয়ে সদর দরজা। দরজা খুলেই বড় বাঁধানো উঠোনে রোদে শুকনো হচ্ছে বড়ি, আমচুর আর কাঁচের বয়ামে আমতেল। একপাশে একটু ছায়া দেখে কাঠের চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগ সহকারে খবরের কাগজ পড়ছে পুষ্পাঙ্গিনী। পাশে একটা মোটা বাঁশের কঞ্চি। ছাগল আর কাকের বড্ড উপদ্রব তাই এটা লাগে। পরনে দুধসাদা ইঞ্চিপাড় কাপড়, ছিপছিপে চেহারা, ইষৎ কালো, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। আচমকা টুকি হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলল,

– ঠাকুমা, রাঙাদিদাকে দেখতে পেয়েছি।

– কই রে, কোথা সি হতচ্ছাড়ি?  চ’তো দেখি, আজ তার একদিন কি আমার একদিন। আমারই খাবে, আমারই পরবে আর আমাকেই জ্বালিয়ে মারবে! পান থেকে চুন খসল কি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল! আমার ভাত বাঁচিয়ে আমাকে উদ্ধার করে দিল। খুব আমার দরদী!

কথাগুলো বলতে বলতে পায়ে চটি গলিয়ে নিল পুষ্পাঙ্গিনী। কঞ্চিটাকে শক্ত করে ধরল, যেন দেখতে পেলেই পিঠের উপর বসিয়ে দেয় আর কী! উঠোনের উত্তরে বড় বাঁধানো দাওয়া সমেত মাটির চাতাল। কাঠের উনুনে জ্বাল দিয়ে ভাত রান্না করছে মালতী। পুষ্পাঙ্গিনীর ছোটছেলের বউ। এতক্ষণ আড়াল থেকে সবটা শুনছিল। শাশুড়ীকে অমন রেগে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি আধসিদ্ধ ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে রেখে জ্বলন্ত উনুনে একটা বড় পাত্রে খানিক জল বসিয়ে দিল।

তারপর ছুটে এসে বলল, ‘মা আপনি বসুন, না হলে ছাগলে সব মুখ দিয়ে দেবে। আমি দেখচি।’

মালতী জানে পুষ্পাঙ্গিনী যতই মেজাজ দেখাক, ভালোমা তাকে দেখলে কিছুতেই বাড়িমুখো হবে না।

মাথার ঘোমটাটা একটু টেনে নিয়ে, খালি পায়েই ছুটে বেরিয়ে গেল মালতী। যাবার পথে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে প্রায় জনা সাতেক মিলে গিয়ে পৌঁছল যখন, তখন রাঙাদিদাকে আটকে রাখতে গিয়ে চারপাঁচটা ছেলেমেয়ের নাজেহাল অবস্থা। খুব গোল বেঁধেছে যা হোক। একবার এদিকে ছোটে তো একবার ওদিকে, এও যেন এক মজার খেলা তাদের কাছে। যাইহোক সকলে মিলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে গণ্ডগোলটা একটু থামলে বোঝা গেল, মালতীর ভালোমা আর টুকির রাঙাদিদার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হল, মাত্র দুদিনের জ্বরে সে ঘরের কোনো কাজ করতে পারেনি, সেই সুযোগে মালতী একটি ঠিকে ঝি বহাল করেছে।

‘আহা কী বুদ্ধি! লক্ষীমন্ত রূপটিই আচে, আর রঙটো কটা, তাই লিয়ে দেমাকে আর পা পড়ে না। কাজের বেলায় কিচুই তো পারে না। আবার সাহস কত! আমি থাকতে কাজের লোক রাখা! কার আসকারায় ইসব হয় আমি জানিনা?’ মালতীকে দেখে ভালোমা বলেই চলেছে, ‘আমি বেঁচে থাকতে আমার হাতের কাজ কেড়ে লেয়, এতবড় অপমান! আমি যাব না, যা সব পালা, আমি যাব না। ওই পুষি আমাকে খেতে দেয় বলে কম হতচ্ছেদা করে না। আমারও বাবার ভিটে, ওর একার লয়। ওকে বলে দিও। তুমি তো সাধের বৌমা, তুমিই বলে দিও।’

মালতী তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘ভালোমা, আপনার বয়স হয়েচে, এত কাজ আপনি আর করতে পারবেন না। তাই আমরা…’

মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে ভালোমা বলে বসে, ‘হ্যাঁ আর কী বলবে? বলি বয়স তো হয়েচে তবু মনে করে বলোতো এই গতরটো না লরাইলে কোন কাজটা ঠিক করে হয়? লোক রাখবে আমাকে জিজ্ঞেস না করে, তোমরা এখান ওখান যাবে আমাকে জিজ্ঞেস না করে, তার বেলা দোষ নাই আর আমি পালিয়ে গেলেই লোক নিয়ে জড়ো হবে আমাকে ধরতে… আহা-হা-হা কী সুক!’

যতই মালতী তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে ততই যেন আগুনে ঘি পড়তে থাকে। শেষমেশ  চারপাঁচ জন মিলে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে গিয়ে ব্যানার্জ্জী বাড়ির উত্তরের দাওয়ায় বসিয়ে দেয় ওকে। ওর ভালো নাম তুলসীরাণী ব্যানার্জ্জী। পুষ্পাঙ্গিনীর সহোদরা। দিদির কাছেই থাকে। দিদির ছেলেমেয়েরা ডাকে ‘ভালোমা’, নাতিনাতনিদের ‘রাঙাদিদা’, পাড়া-প্রতিবেশীর ‘তুলিপিসি’ আর দিদি ডাকে ‘হতচ্ছাড়ী’। তবে সবসময় নয়, দিদির দেওয়া আদরের নাম ‘তোলন’।

ছোটখাট দোহারা চেহারা। বয়স ষাটের আশেপাশে। গায়ের রঙ ধবধবে পরিষ্কার। মুখে অসংখ্য বলিরেখা। কুঁচকে যাওয়া চামড়ার কোটরে দুখানি উজ্জ্বল চোখ। বাঁ গালে একটা গভীর কালো পোড়া দাগ। বড় ও গোলাকার। মাথায় সিঁদুর, পায়ে আলতা, হাতে শাঁখা-পলা-নোয়া। চুল ছোট করে কাটা, হাসিখুশী স্বভাব, লাজুক। রেগে গেলে একটা কথা বারবার বলতে থাকে। ঠিক এই মুহূর্তে যেমন বলেই চলেছে,

‘যা, ছাড় আমাকে ছাড়। পুষি ঠাকরুন, খুব একবারে ভরা সংসার, নাতিনাতনি, ছেলে আর ঐ মৌগাঁয়ের বিটি… খেতে লিতে হতে ধুতে সেই বেলা পাঁচটা, আহা-হা-হা, কী কাজের ছিরি! তোর বাপের ভিটে? আমার বুঝি বাপ লয়? তোর কী এমন খাই, পরি যে তোর দেমাক দেকতে হবে? খবরদার আমাকে ডাকবি না, আমি কারুর বুন লই, কারুর রাঙাদিদা লই, কারুর ভালোমা লই।’

পুষ্পাঙ্গিনীর কানে এসব কথা যায়নি। সে তখন দক্ষিণের দালানে পালঙ্কে শুয়ে। দুশ্চিন্তায় গত রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। পাওয়া গেছে শুনে এতক্ষণে একটু শান্তি পেয়েছে। মালতী যখন গেছে, ঠিক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসবে পুষ্পাঙ্গিনী জানে। তাই রোদে মেলা জিনিসগুলোকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিয়ে একটু শুয়েছে। জৈষ্ঠের তপ্ত দিন, বেলাও হয়েছে অনেকখানি। মাঝের উঠোনটা এতটাই বড় যে এদিকের কথা ওদিকে শোনা যায় না। মালতীও এসব ঝামেলার কথা তাকে কিছুই বলেনি।

‘ভালোমা ফিরেছে, দুদিন ধরে সেভাবে কিছু খায় নি তাই একটু মাথাটা গরম। আমি শরবত দিচ্ছি, একটু পরে আপনি একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে দুটো ভাত খাইয়ে দিলেই শান্ত হয়ে যাবে।’ এই বলে মালতী একঘটি জল আর একগ্লাস শরবত নিয়ে এসে বলল,

‘ভালোমা, এটা খেয়ে নেন।’

‘না, তোমার হাতে শরবত আমি খাব না। আমার অত দুর্দিন আসে নাই।’

‘বেশ তো খেতে হবে না। এখন মাথাটা দেন দিকি, চুলটা আঁচড়ে দিই।’

ভালোমা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, ‘এই লাও তবে। এই কিন্তু শেষ। আর একদিন যদি হয়েছে আমি আবার পালাব। এমন পালান পালাব… এবার সমুদের বাড়ি পালাব।’

আরো বারকতক ওই একই কথা বলে যখন চুপ করল তখন দুপুর হয়ে এসেছে। মালতী প্রায় সেদ্ধ হয়ে আসা ভাতের হাঁড়িটা আর একবার জ্বাল দিয়ে দিল। কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়ার সাথে গরম ভাতের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। বাবলু চলে এসেছে ভাত খেতে। বাবলু পুষ্পাঙ্গিনীর ছোট ছেলে। মালতী দুপুরের আহারের বন্দোবস্ত করতে লাগল। আর শাশুড়ীকে আস্তে আস্তে বোঝাতে থাকল, কেন ভাত খাওয়াতে তারই যাওয়া উচিত। এদিকে মালতী আড়াল হতেই তোলন সব শরবতটা খেয়ে নিল। এটা তার অভ্যাস, কারো সামনে সে খায় না। এ বাড়ির সবাই জানে এ কথা। তাই মালতী শরবতটা দিয়েই সরে এসেছিল।

গরম ভাতের গন্ধে জিভে জল আসে তোলনের। ছেলেমেয়েগুলো স্কুল যাবার সময় ওই গন্ধটা পায় ও। খুব ইচ্ছে করে ওই সময় চাট্টি ভাত খায় কিন্তু লোভ সম্বরণ করে নেয়। সে জানে কাজের সময় ভাত নিয়ে বসে গেলে ওরা বিরক্ত হতে পারে। তাছাড়া দিদি তো পরিষ্কার বলে দেয়, ‘না খাটলে গতরে, ভাত দেয় না ভাতারে।’ আরো অনেক কথা মনে আসতে থাকে। জামাইবাবুর মতো ভালমানুষ বর পেয়েচে, দিদি কি জানে? গতরে খেটেও বরের মন পাওয়া যায় না। ওটা আসলে ভাগ্য। ওটা মানুষ নিয়ে জম্মায়। আমারও তো খুব ভালো ঘরে জম্ম। কিন্তু মেয়েদের তো চিরটাকাল এক যায় না, তোলন ভাবতেই থাকে। খালি পেটে শরবতটা পড়তেই শরীরে ঝিমুনি আসে একটু একটু করে।

দুই

বয়স তখন তেরো। ছোট্ট  ফুটফুটে একরত্তি মেয়েটার মহা ধুমধামে বিবাহ হয় আসানসোলের কাছাকাছি কুলডিহাতে। অবস্হাপন্ন পাল্টিঘর। স্বামী পেশায় উকিল। স্বর্ণালঙ্কার, অনান্য যৌতুক আর সর্বোপরি সুন্দরী পাত্রী দেখে উকিলবাবু লোভ সামলাতে পারেন নি। তাই অনান্য দিক বিবেচনা না করেই তড়িঘড়ি বিবাহে মত দিয়ে দেন। কিন্তু এমন সাদামাটা, পার্থিব জগৎ ও আত্মসুখের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন একজন মানুষ তাঁর জীবনে যে একেবারেই অচল সেটা আস্তে আস্তে  উকিলবাবুর মনে চেপে বসতে থাকল। বনিবনা না হওয়ার নানান কারণ দেখিয়ে উকিলবাবু তাকে ফেরৎ পাঠাবার ফন্দী আঁটতে থাকলেন। কিন্তু তোলনও ছাড়বার পাত্রী নয়। শুরু হল টিকে থাকার লড়াই। দুর্বিষহ জীবন একটু একটু করে গা সওয়া হতে লাগল। এমন সময় উকিলবাবু আবার বিবাহ করলেন এবং দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীকে ঘরে এনে তুললেন। উকিলবাবু যতই ভাবেন এবার হয়তো তোলন চলে যাবে, তোলন সংসারে ততই অপরিহার্য হয়ে উঠতে লাগল। একে একে দ্বিতীয়পক্ষের তিনটি সন্তান হল। একা হাতে তিনটেকে সামলাতে তাদের মা হিমসিম খায়। তোলন তাদের পরিচর্যা করে অপার স্নেহে। মাঝখান থেকে উকিলবাবুর অঙ্কটায় গরমিল দেখা দেয়। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার অপরাধে আদালতে নালিশ করা অথবা উকিলবাবুকে ছেড়ে চলে আসা তো দূর অস্ত, যেন তোলনেরই সংসার ভরে উঠছে দিনদিন। তোলনও মনে মনে নিজেকে ওই ভরা সংসারের কর্ত্রী বলেই ভেবে বসে। তার সতীনের ছেলেগুলিকে আপন সন্তানজ্ঞানে মানুষ করতে গিয়ে নিজের চাওয়াপাওয়ার কথা ভুলে যায়। উকিলবাবু পড়েন মহা বিপদে। একে সরকারি উকিল তার উপরে দুইজন স্ত্রী একসঙ্গে, এক ছাদের তলায় এবং এক অন্নে সংসার করছে। কেউ কোনোদিন খুঁচিয়ে দিলে চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে। দিন দিন যে ভাবে শত্রুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে, খুব বেশিদিন এভাবে টানা যাবে না। ফলে শুরু হল তোলনের উপর অত্যাচার। দিন দিন তা বাড়তে লাগল। তারপর একদিন প্রবল অশান্তির পর আর সহ্য করতে না পেরে, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে শুধু উকিলবাবুর দেওয়া কয়েকটি উপহার, যেমন সিঁথির সিঁদুর, পায়ে আলতা আর গালে সিগারেটের ছ্যাঁকা নিয়ে পাকাপাকিভাবে তোলন চলে এল বাপের বাড়ি। চলে আসার পর আর একটিবারও যায়নি।

হায়রে জীবন! যেখানেই একটু সুখের সন্ধান মেলে সেখানেই হাজার বিড়ম্বনা। তোলন বোঝেনি, জন্ম না দিয়ে, কেবল সন্তানস্নেহের বন্যা বইয়ে দিলেও সন্তান কখনো নিজের হয় না। আরো অনেক কিছুই সে বোঝেনি। সে বোঝেনি, কোন অপরাধের জন্য তাকে এমন দণ্ড পেতে হল। তবে এটা বুঝেছিল, সাধ না মিটলেও এজন্মের মতো স্বামীর ঘর করা তার শেষ।

বাপেরবাড়িতে ফিরে এসে পুষ্পাঙ্গিনীর সংসারে একটু একটু করে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। আগের চেয়ে সাবধানী হয়েছে। উপলব্ধি করেছে, এ সংসারও তার নয়। জীবনটা যেন কাটা ঘুড়ির মতো মাঝ আকাশে দিকশূন্য হয়ে বিচরণ করে। আঘাত বড় বিষম বস্তু। একবার যার উপর পড়ে, সে কী আর আগের মতো থাকতে পারে? সে ধাতুই হোক বা মানব মন। আঘাত তাকে শক্ত করে তুলবেই। তোলনও ব্যতিক্রম নয়। তাই তার মন শক্ত হয়েছে আগের থেকে। আস্তে আস্তে এই সংসারের নানান দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আপন মনে খেলনাবাটি খেলতে থাকে। কেবল বর্তমানকে খোঁড়া আর অতীতকে ওলটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তার জীবন। এ জীবনে ছিল না ভবিষ্যতের কোনো খোঁজ। শুধু ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায় তেমনই সে ভয় পায়। তার ভাগের কাজ কোনোদিন কেউ করে দিলেই সে চক্রান্তের গন্ধ পায়। মনে হয়, আবার যদি সব হারাতে হয়! একটা রাগ, একটা প্রতিশোধস্পৃহা তখন ওর মনে বাসা বাঁধে আর নিদারুণ অভিমানে মাঠ ছেড়ে পালাবার কথাই মনে হয়। তাই ও দিদির সংসার ছেড়ে চলে যায়। বার বার।

তোলন আপন মনে ভাবে, সহ্য করে কোনো লাভ নেই। নিজের মতো প্রতিবাদ, নিজের শর্তে বাঁচার মধ্যে একটা আলাদা তৃপ্তি আছে। তাছাড়া সহ্য তো সে কম করেনি। সংসারে নিজের অস্তিত্বটুকু অটুট রাখতে তার বিরুদ্ধে যাবতীয় ষড়যন্ত্রকে সহ্য করেছে। সতীনের কটাক্ষ, স্বামীর অনাদর-অত্যাচার সহ্য করেছে। শুধু তার স্বামীর সন্তানেরা তাকে ‘মা’ বলে ডাকলে তার মনে হত, সে তার প্রাপ্য পেয়েছে। অথচ সব সাধ ধুলায় মিশিয়ে মাঠ ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। হেরে গেছে তাদের কাছে, প্রতিনিয়ত যাদের সেবা করেছে। বিনিময়ে কিছু পায়নি। তাই তার হারাবার কিছু নেই এই পৃথিবীতে। সেদিন গালের টাটকা দগদগে ঘায়ে এতটুকু যন্ত্রণা হয়নি, অথচ অতীতের পাতা ওলটাতে বসেলেই ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। শুধু গালের ক্ষতে নয়, সারা শরীরে যন্ত্রণা হয়। কেউ যেন ওকে নির্মমভাবে কঞ্চিপেটা করে।

কারোর জন্য কোনো কিছু থেমে থাকে না। সংসার চলে তার নিজের নিয়মে। উকিলবাবুর সংসারও তাকে বাদ দিয়ে দিব্যি চলছে। তবু মানুষ তাকে আঁকড়ে ধরে। অধিকার ফলায়। তোলন জানে, যেখানেই অধিকারের প্রশ্ন সেখানেই অনিবার্য সংঘাত। দিদির সঙ্গে তার একটা চাপা সংঘাত আছে। তবে দিদির অবস্থান ও ব্যক্তিত্বের সামনে তোলন মুখ খুলতে পারে না।

তোলন আর পুষ্পাঙ্গিনী ছাড়া এ বাড়িতে থাকে বাবলু, মালতী, টুকি আর পুকু। পুষ্পাঙ্গিনীর ছোটছেলে, পুত্রবধু আর নাতিনাতনি। বড়ছেলে চাকরিসূত্রে আসানসোলে বাসায় থাকে। আর তিন মেয়ে থাকে লাভপুরে। গ্রামেই রাস্তার ধারে বাবলুর কাপড়ের দোকান। নাবালক বয়সে একমাত্র পুত্রের  অকালবিয়োগের কারণে পুষ্পাঙ্গিনীকেই যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী করে দেহ রাখেন তার বাবা। তোলন তখন নেহাৎ নাবালিকা। তখন থেকেই পুষ্পাঙ্গিনীর স্নেহছায়া তোলনের মাথার উপর। যথাসময়ে সহোদরা বোনকে পাত্রস্থ করে সে নিশ্চিন্ত হয়েছিল। কিন্তু তোলন ফিরে এল। পুষ্পাঙ্গিনী সব শুনে তাকে আর ফিরে যেতে জোর করল না। স্বামীপরিত্যক্তা বোনকে পাঁচজনের বাঁকা নজর থেকে আগলে আগলেই রেখেছিল। কিন্তু বোনের সমানাধিকারের প্রশ্নে সে চিরকালই উদাসীন। বরং আর্থিক ক্ষমতার বলে সে কিঞ্চিৎ অহংকারী। তার পরলোকগত স্বামী রেলের চাকুরে ছিলেন। সেই সুবাদে মাস গেলে পেনশন বাবদ টাকা আসে। এছাড়াও জমি, পুকুর, গাছগাছালির মালিকানাও তার। সে বিষয়ী এবং বিচক্ষণ। এবাড়ির প্রত্যেকে তার অধীনস্থ। এটা তার কাছে বেশ একটা আত্মতুষ্টির বিষয়। বাবলুর কাপড়ের দোকান থেকে আয় বিশেষ হয় না। তা নিয়ে পুষ্পাঙ্গিনীর কোনো আক্ষেপ নেই। পুষ্পাঙ্গিনী বাইরে থেকে দাপুটে আর  দাম্ভিক। অন্তিমকালে বাবাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিকেই বড় কর্তব্য ভেবে পালন করে। বিষয়বুদ্ধি এবং কর্তব্যপরায়ণতাই হয়ত তাকে একটা কঠোর খোলসের মধ্যে পুরে দিয়েছে। সময়ে অসময়ে বকাবকি করলেও সে তার ছোট্ট বোনটিকে ভালোই বাসে। সময় সময় ডেকে ওঠে “তোলন, তোলন…”

এ আসলে আদরের ডাক।

তিন

দিদির ডাকে সম্বিত ফিরল তোলনের। ঘুরে দেখল দিদি ভাতের থালা হাতে দাঁড়িয়ে। দিদির প্রতি চাপা রাগ, ক্ষোভ থাকলেও ভয় বা সম্ভ্রমের অভাব নেই। তাই চোখে চোখ পড়তেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল তোলন। প্রায় দেড়দিন হল পেটে কিছু পড়েনি। মুখটা শুকিয়ে আমচুর হয়ে আছে, দেখেই মায়া হল পুষ্পাঙ্গিনীর। কথা না বাড়িয়ে, ‘নাও খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর,’ বলেই ভাতের থালাটা নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

একথালা ভাতের পাশে কলমি শাক ভাজা, একটু পটলের তরকারী, একটু আলুপোস্ত আর একটুকরো মাছের টক। খাবে কি খাবে না ভাবছিল। কিন্তু মাছের টক দেখে সব দোনামোনা চলে গেল। মালতী আগেই এক ঘটি জল রেখে গিয়েছে। হাত ধুয়ে গোগ্রাসে খাবারটা খেয়ে সোজা  উঠে গেল চিলেকোঠায়। এখানেই ওর থাকার ব্যবস্থা। কাঠের দরজার সামনাসামনি একটা বড় সিমেন্টের বেদী, তার একপাশে আর একটু উঁচু আরেকটা বেদীতে কাঁথা ও বালিশ পেতে শোয়ার ব্যবস্থা। নীচের বেদীটায় একটি শীতলপাটি পেতে বিশ্রামের ব্যবস্থা। এছাড়া এতবড় দালানের আর কোথাও যাওয়া-আসার রাস্তাটুকু ব্যতীত, খুব প্রয়োজন ছাড়া পা ফেলে না তোলন। বোধ হয় মনে ভাবে এইটুকুই তার এক্তিয়ার। তবুও এমন অনাড়ম্বর জীবনেও সে কিছু শর্ত দিয়ে রেখেছে এ বাড়ির গিন্নিকে। বাড়িতে কাজের লোক রাখা যাবে না। সে যদি টেনে টেনে কাজগুলো না করে, তাহলে এ সংসারে তার কোনো অবদান থাকবে না। আর তা না থাকলে কোথাও বেশিদিন টেকা যায় না। সকালসন্ধ্যা দুইবেলা চা করার দায়িত্বও সে নিয়েছে। বাড়িতে যেকটি গোরু বা ছাগল আছে তা বিক্রি করা যাবে না। শেষ শর্তটি নিয়ে পুষ্পাঙ্গিনীর সঙ্গে তার বিবাদ লেগেই থাকে। গোরুছাগলগুলির পরিচর্যা করতে গিয়ে এমন মায়া পড়ে যায়! তাদের বেচতে বুক ফেটে যাওয়ার দশা হয়। অথচ পুষ্পাঙ্গিনীর মতে সংসারে আয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই গবাদি পশু পালন করা হয়। দুপয়সা লাভের জন্যই তো ছাগলগুলিকে খাইয়ে দাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করা!

মোটমাট শর্তগুলির কোনো একটির অন্যথা হলেই তোলন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে  যায়। গিয়ে ওঠে কখনও কুলুপুকুরের পাড়ে, কখনও আখশালে, কখনও মৌনা আমগাছের ডালে। প্রায় দেড় থেকে দুদিন বাদে ওকে খুঁজে পাওয়া যায়। সারাদিনে দুতিন কাপ চা, একবেলা শুকনো মুড়ি আর আর একবেলা ভাতের বাইরে কেউ তাকে কোনোদিন কিছু খাওয়াতে পারে না। এই কটা নিজের সৃষ্টি করা নিয়মে বেঁচে সে তৃপ্তি পায়। আরো একটা অভ্যাস তার আছে। দিদির ফতোয়াকে উপেক্ষা করে মাঝেমাঝে মালতীর কাছে খানিক লঙ্কা, পেঁয়াজ অথবা সর্ষের তেল চেয়ে নিয়ে জমিয়ে রাখে ছাদের চিলেকোঠায়। মালতীর আলতা পরার সময় ও আড়চোখে তাকিয়ে থাকে। মালতী ডাকলে তবে যায়। তারপর দুই জোড়া আলতারাঙা পায়ের মধ্যে তারটাই যে বেশি সুন্দর সেটা বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে। তখন যেন সে আর মালতী দুই সখী। পুষ্পাঙ্গিনী এসবদিকে খুব একটা নজর দেয় না। তোলন ফিসফিস করে বলে, ‘ওর হিংসে হয়।’

সখীর মতোই সে মালতীর সঙ্গে মিলে ‘জয়মঙ্গলবার’, ‘নোটন ষষ্ঠী’, ‘চাপড়া ষষ্ঠী’, ‘শীতল ষষ্ঠী’ র উপবাস করে। তোলন মালতীকে বলে ‘ষষ্ঠী করতে হয়। তোমার আছে দুই সন্তান, আমার আছে তিন। হোকগে সতীনের, আমাকেও তো ‘মা’ বলে তারা।’ 

এর বাইরে তোলনের একার আছে অমাবস্যা-পূর্ণিমার পালন।

তার অনাড়ম্বর জীবনে বিলাসিতা বলতে এই আলতা-সিঁদুর এর প্রসাধন আর ভাতের পাতে মাছের টক। তোলন জানে উকিলবাবু বেঁচেবর্তে থাকলে এই সাধটুকুনও থাকবে। তাই তার মঙ্গল কামনা করা!

প্রত্যেকদিন প্রায় অন্ধকার থাকতে ঘুম থেকে উঠে পড়ে তোলন। সদর দরজা থেকে শুরু করে খিড়কি দরজা পর্যন্ত ঝাঁটপাট দিয়ে, মারুলী দেয়। তারপর উঠোনের মাঝখানে বড় ইন্দারা থেকে জল তুলে চৌবাচ্চা ভর্তি করে। এঁটো বাসন নিয়ে চলে যায় পুকুরঘাট। বাসন মেজে যখন ফেরে তখন সব ঘুম থেকে উঠে। তোলন চা করে। তারপর গরুছাগলগুলোকে গোয়াল থেকে বার করে তাদের খাবার দেয়, জল দেয়। ছানি কেটে রেখে দেয় যথাস্থানে। গোবর থেসে ঘুঁটে দেয় গোয়ালঘরের দেয়ালজুড়ে। এরপর কাঠের উনুন জ্বালানোর সরঞ্জাম প্রস্তুত করে। রান্নার জল তোলে। গরু নিয়ে মাঠে যায়। ফিরে এসে যায় পুকুর আগলাতে। দুপুরবেলা মালতীর কাছে খোঁজ নেয় দিদির খাওয়া হয়েছে কিনা। তারপর মুড়ি খেয়ে চিলেকোঠার ঘরে বিশ্রাম নেয়। বিকেলবেলা ছাগলগুলো ছেড়ে দিয়ে সবার জন্য চা বানায়। তারপর গরুগুলোকে গোয়ালে ভরে দিয়ে ছাগল আনতে যায়। সন্ধ্যেবেলা ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরটাকে কোনোমতে টানতে টানতে নিয়ে যায় ছাদের চিলেকোঠায়। যাবার সময় কোনো কোনো দিন মালতীকে বলে যায় ‘আমাকে একটু চা দিও তো।’ মালতী চা করে ছাদে দিয়ে আসে। এরপর কিছুটা সময় তার নিজের জন্য বরাদ্দ। শীতকাল ছাড়া এই সময়টা তোলন সাধারণত কাঠের দরজা খুলে ছাদে গিয়ে বসে। সারাটাদিন খোলা আকাশের নীচে কাটলেও, কাজের ভিড়ে সেই আকাশের দিকে মুখ তুলে চাওয়ার অবসর হয় না। এই সময় প্রাণভরে রাতের আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। এই একান্ত নিজস্ব সময়টুকুতে নিজের মুখোমুখি হওয়া তার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। কোনো কোনোদিন সুরেলা কন্ঠে গান ধরে। গায় শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম। সুরের মূর্ছনায় ডুবে যায় গোটা পাড়া। কত জন রেডিও টিভি বন্ধ করে শোনে। মালতী অতি সন্তর্পনে টুকি আর পুকুকে নিয়ে এসে বসে সিঁড়িতে। তারপর আবার সন্তর্পণে নেমে গিয়ে ভালোমা’র খাবার বেড়ে নীচ থেকে ডাক দেয়, 

– ‘ভালোমাআআ, খাবার দিয়েছি।’

তোলন আস্তে আস্তে নেমে আসে নীচের চাতালে। এই সময় সে খুব শান্ত, ধীর। খাবারে কী কী আছে কোনোদিনই জানতে চায় না। প্রায় দিনই সকালে মালতীর কাছে খোঁজ নেয়, মাছের টক হয়েছে কিনা! সেইমতো খেতে বসার আগে আড়চোখে চেয়ে দেখে নেয়, মাছের টক আছে কিনা। কোঁচড়ে পেঁয়াজ লঙ্কা গুঁজে আনে। প্রয়োজন না হলে বের করে না। খুব তৃপ্তি সহকারে আহার শেষ করে দিদির কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, তার শরীর কেমন আছে। দিদিও জিজ্ঞেস করে তার খাওয়া হয়েছে কিনা। বেরিয়ে যাবার সময় ছোট নাতিনাতনি দুটোর সঙ্গেও একটু মস্করা করে,

‘পুকুবাবুর জ্বালাতে/ কাক বসে না চালাতে। টুকি রাণী ফরফরাণী / ফড়িং ভেজে খায়…’

বলতে বলতে চলে যায় ছাদের সিঁড়ির দিকে। এটা যে প্রতিদিন করে তা নয়। মন ভালো থাকলে করে।

চার

পুষ্পাঙ্গিনী রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে। রেডিওতে রাত ন’টার সংবাদ শুনেই ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু সেদিন সারাটা দিন ভাগচাষীদের সঙ্গে ধানের ভাগ নিয়ে পুষ্পাঙ্গিনীর বচসা হয়েছে কাদপুরের মাঠে। এবছর ভাল ধান হয়নি। পুষ্পাঙ্গিনীর হিসেব যা বলছে তার থেকে অনেকটা কম ধান দিচ্ছে ওরা। যা ধান পায় তাতেই সারা বছর এতগুলো পেট চালানো যায় না, বাড়তি চাল কিনতে হয়। তার উপর আবার আরো কম দিলে চলে কী করে? যত্তসব  উটকো ঝামেলা। প্রতি বছর এটা করে ওরা। কাদপুর থেকে আসা ইস্তক পুষ্পাঙ্গিনীর মনটা বড্ড খিচিবিচি হয়ে আছে।

মালতীকেও একটু বকেছে, ‘সংসারের খরচ কমাও বুঝলে। একটু হিসেব করে চলতে শেখ। রাতদিন এই আনতে হবে ওই আনতে হবে করলে চলবে না।’ 

কী যে হয়েছে আজকাল! বয়স যতই বাড়ছে কেমন যেন খিটখিটে হয়ে উঠছে। এইসব সাতপাঁচ ভাবছে এমন সময় তোলন এসে শরীর কেমন আছে জানতে  চাইলে পুষ্পাঙ্গিনী ঝাঁঝিয়ে উঠল,

‘সবাই মিলে আমাকে মারার জোগাড় করে আবার জানতে চাওয়া হচ্ছে কেমন আছি? যা, দূর হ তো সব আমার চোখের সামনে থেকে।’

দিদির কাছে মুখ ঝামটা খেয়ে আর এক মূহুর্ত দাঁড়াল না তোলন। ঝাপসা চোখে সোজা চলে গেল চিলেকোঠায়। কিন্তু ঘুম হল না। পরের দিন পুষ্পাঙ্গিনী আবার কাদপুর যাবে বলে সকাল সকাল তৈরী হয়ে তোলনকে ডেকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চা দে।’

সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটল, ‘তোমার সংসার, তোমার বেটা-বউ-নাতি-নাতনি। আমার কী? আমার কী দায় যে চা করে খাওয়াতে হবে? খবরদার আমাকে মেজাজ দেখাবে না, এই বলে দিলাম। আমারও সোয়ামি আছে, ছেলে আছে। এখুনি ডাকলে আমাকে নিয়ে চলে যাবে কুলটি। তোমার সংসার অচল হয়ে যাবে এই সরমাকে ছাড়া সিটো সবাই জানে।’

পুষ্পাঙ্গিনীরও মেজাজ গেল গরম হয়ে। একে তো সারাটা দিন কী ঝামেলা পোহাতে হবে ঠিক নেই তার উপর বেরোনোর সময় এইসব কাণ্ড। তোলনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পুষ্পাঙ্গিনী চিৎকার করে উঠল, ‘যা কেনে হতচ্ছাড়ি, যা পালা! ছেড়ে এসেছিলি কী কত্তে? একবারে তো রাজরাণীটি হয়ে ছিলি! এসে তো হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলি। মুখ ছোটানোর বহর দেখলে জ্ঞান হারাতে হয়।’

মালতী অন্যসময় মধ্যস্থতা করতে আসে। আগের দিন থেকে ওরও শাশুড়ির উপর রাগ হয়ে আছে। দুই বোনের ঝগড়ায় বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে মালতী এঁটো হাঁড়িকুড়ি নিয়ে কুয়োতলায় মাজতে বসে গেল। ছেলেমেয়ের ইস্কুলের ভাত বসাতে হবে। তোলন মালতীকে হাঁড়ি নিয়ে যেতে দেখেই তেড়ে গেল, ‘ছাড়, ছাড় বলছি, ছাড়। আবার আমার কাজে ভাগ বসানো! দিদি মরলে বুঝি তুমিই মালিক হবে মনে করেছ?’

মালতীর হাত থেকে হাঁড়িটা নিতেই পুষ্পাঙ্গিনী একটা চেলা কাঠ নিয়ে তেড়ে গেল তোলনের দিকে। রক্ত চক্ষু বের করে বলল, ‘মার খাবি? অত যদি গিন্নী হবার সাধ, যা নিজের ঘরে ফেরত যা!’

দিদিকে দেখে চোখ ফেটে জল এল তোলনের। চুপচাপ এঁটো হাঁড়িখানা নিয়ে পুকুরঘাটের পথ ধরল। দিদির শেষে কটা কথা গরম শলাকার মতো বিঁধেছে। ও মনে মনে বলল, ‘সারা জীবন ভাল মানুষ নিয়ে ঘর করলে। একতরফা ভালবাসার ভার তো কোনোদিন বইতে হল না। তুমি কি বুঝবে দিদি!’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোলন। সেদিন আর কোনো কাজই ঠিক মতো হল না। গোবরটা দেওয়ালে ধরে না। ছানি কাটতে বসতে দেরি হয়ে গেল। বটিতে যখন বসল তখন ভরা জৈষ্ঠ্যর সূর্য মাথার ওপর। অন্যমনস্কভাবে ছানি কাটার বটিতে হাত কাটল! গড়গড় করে রক্ত গড়াল। কাউকে কিছু না বলে খুঁটের কাপড়টা একটু ছিঁড়ে শক্ত করে বেঁধে নিল। ঐ অবস্থাতেই হাতের সব কাজ শেষ করল। যন্ত্রণাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ইচ্ছে করল একটু শুতে। উপরে যাবার সময় মালতীকে ডেকে বলল তার হাত কেটেছে। তাই সে এখন শোবে, আজ আর কিছু খাবে না।

মালতী হাতটা টেনে ধরল। ধমকের সুরে বলল, ‘এইখানে বসুন চুপ করে।’ হাতের বাঁধনটা খুলে গরমজলে একটু ডেটল ফেলে দিয়ে পরিষ্কার করে দিল। তারপর কাটা জায়গাটায় বোরোলীন লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর বাঁধবেন না। একেই গরমের দিন, একটু হাওয়া না পেলে চট করে শুকাবে না।’ অনেকক্ষণ পরে মালতী ওর জন্যে ভাত তরকারি নিয়ে গিয়ে বলল, ‘এবার একটু মুখে দেন।’

‘না। তুমি জানো না, আমি এইবেলা ভাত খাই না! এখন কিছু খাব না। তোমাদের কম পড়বে। দিদির যা মুখ! খালি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে!’

‘ভালোমা, কাল তো জয়মঙ্গলবার। সারাদিন ভাত খাবেন না। আজ এবেলাই ভাতটা খেয়ে নেন।’

একে জৈষ্ঠ মাসের তপ্ত দুপুর তার সঙ্গে ক্রোধের তাপ ওর সর্বাঙ্গে। হয়তো সেই জন্যে ‘জয়মঙ্গলবার’এর কথাটা সে ভুলে গেছে। নাহলে সে নিজেই একখানা আস্ত পঞ্জিকা। এবাড়িতে, এমনকি এ পাড়াতে কারো দিনক্ষণ, তিথিনক্ষত্র  জানার প্রয়োজন হলেই ছুটে আসে তোলনের কাছে!

মালতীর মুখে মমতা মাখা কথাগুলো শুনে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল তোলন। বুঝতে পারল না যন্ত্রণাটা ঠিক কোথায়? হাতে না বুকে না পেটে খিদের? 

মালতীরও চোখদুটো ভিজে এল, কিন্তু সে দাঁড়াল না। যেতে যেতে শুনতে পেল, ‘বেশ খেচি। তবে দিদিকে বোলো না। আর বাসন রেখে দিও, আমি ধোব।’

রাত্রে আর দিদির সঙ্গে দেখা করতে গেল না তোলন।

মোটা শালকাঠের তক্তায় শুয়ে ছিল পুষ্পাঙ্গিনী। রেডিওতে রাত ন’ টার খবর চলছে। মালতী তার পায়ে তেলমালিশ করতে করতে বলল, ‘ভালোমা’র আজ হাত কেটে গেছে ছানিকাটা বঁটিতে।’

পুষ্পাঙ্গিনী রেডিওর ভলিউমটা কমিয়ে দিয়ে বলল, ‘অ্যাঁ! সে কী? আমাকে তো কই বলো নাই কেউ?’

‘ভালোমা’ই বারণ করল। কাঁদতে কাঁদতে বলল দিদিকে বোলো না।’

পুষ্পাঙ্গিনী বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। দেখলো তোলন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মাথায় আলতো করে দুবার হাত বুলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মুখের দিকে। প্রচণ্ড গরমের কারণে ছাদের দরজাটা একটু খোলা রেখেছিল তোলন। ফর্সা, গোল মায়ামাখা মুখটিতে চাঁদের নরম আলো এসে পড়েছে। পুষ্পাঙ্গিনীর চোখ থেকে টপ করে একফোঁটা জল এসে পড়ল তোলনের কপালে। সে টেরটিও পেল না। পুষ্পাঙ্গিনী আস্তে আস্তে  নীচে নেমে এল।

পাঁচ

পরের দিন সকাল থেকে জয়মঙ্গলবারের জোগাড়ে খুব ব্যস্ত তোলন আর মালতী। পুজো শেষ হলে ফলার করে একে অপরকে তিনবার করে জিজ্ঞেস করে

‘জয়মঙ্গলবার হ’ল?’

‘হ্যাঁ হ’ল।’

তারপর দুজনেই হেসে গড়িয়ে পড়ে।

দিন যায়। মাস গড়িয়ে পুজো আসে। ভালোমা মাঝেমাঝেই মালতীকে ডেকে খোঁজ নেয়, ‘কমল কবে আসবে কিছু জান?’

কমল পুষ্পাঙ্গিনীর বড় ছেলে। প্রত্যেকবার পুজোর সময় সকলের জন্য জামাকাপড় নিয়ে আসে। সপরিবার ক’টা দিন এখানেই থাকে। বড়বৌমা কাপড়ের গাঁট খুলে সবার আগে তোলনের রঙীন চেক শাড়ী বের করে জিজ্ঞেস করে ‘ভালোমা শাড়ী পছন্দ হয়েছে?’ তোলন নেড়েচেড়ে দেখে জানায় ভালোই হয়েছে। পুজোর ক’টা দিন বাড়িতে এক্কেবারে হৈহৈ কাণ্ড। ছেলেমেয়েগুলো বাজি রোদে দেয়। রাঙাদিদা সেগুলো ঠিকসময়ে ভরে রাখে। প্যান্ডেলে নতুন চটিজুতো ফেলে আসে। রাঙাদিদা সেগুলো নিয়ে আসে। বাড়িতেও সমানভাবে ফাইফরমাস খাটে। এই সময় ছোটখাট রাগারাগি হয় দিদির সঙ্গে। তোলন সেসব মনে নেয় না। তোলনের তখন ঝগড়া করার বা পালিয়ে যাওয়ার ফুরসৎ থাকে না। পুষ্পাঙ্গিনীও এই ক’টা দিন রান্নাঘরে উঁকিঝুঁকি দেয়। বাবলুকে বারবার দোকান পাঠায়। সমস্ত দিক ঠিকঠাক চলছে কিনা সেই তত্বাবধানে ব্যস্ত থাকে। তোলন হাজারো কাজের মাঝে নতুন কাপড় পরে মণ্ডপে যায় দুবেলা। আসাযাওয়ার পথে যার সঙ্গে দেখা হয় ডেকে বলে, ‘এই একবার এলাম। নতুন কাপড় পরতে হবে তো! কমল এনেছে, আসানসোল থেকে!’

নবমীতে পুষ্পাঙ্গিনীর বড়মেয়ের বাড়িতে সবার নিমন্ত্রণ। সবাই লাভপুর যায়। তোলন ঘর আগলায়। দশমীতে এবাড়িতে সবার নিমন্ত্রণ। তিন মেয়ে, জামাই, নাতিনাতনি। পুষ্পাঙ্গিনী সেদিন ‘গরবিনী মা’, চারিদিকে তার নজর। তোলনেরও গর্ব কিছু কম নয়। তার জন্যে সবাই কাপড় আনে। সেও বেজায় খুশি, কিন্তু থাকে দূরে দূরে। কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকে। জামাইদের কাছে আসে না। সামনে পড়ে গেলে বড়ো ঘোমটা টেনে সরে যায়। সারাদিনের হৈহুল্লোড়ের মাঝে তোলনের কথা কারো মনে থাকে না। সন্ধ্যেবেলা সকলে মিলে ঠাকুরঘরে বসে প্রার্থনা করে। তোলন দরজার আড়াল থেকে শোনে। সবার জন্য চা নিয়ে আসে। তোলন জানে এরপর একে একে সবাই তাকে প্রণাম করবে। সেই মুহূর্তে কেউ প্রস্তুত না থাকলেও তার পরের কাজে পাছে দেরি হয়ে যায়, তাই সে নিজেই আলতারাঙা পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘লাও, সব তাড়াতাড়ি সারো। আমি যাব ছাগল আনতে, অন্ধকার হয়ে গেল।’

পুষ্পাঙ্গিনীর পরেই এবাড়িতে সবার বড় তোলন। তাই সবার প্রণাম নিয়ে আহ্লাদে ডগমগ করতে করতে ছাগল খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। যাবার আগে প্রায় ঝড়ের গতিতে, মুখের দিকে না তাকিয়ে পুষ্পাঙ্গিনীকে টুক করে একটা প্রণাম করে বলে, ‘এই লাও’। যেন বচ্ছরকার পাওনাগন্ডা চুকিয়ে দিল।

অন্ধকার রাস্তা তার হাতের তালুর মতো চেনা। হনহনিয়ে যেতে যেতে ভাবে, দিদির কাছে বুঝি তার ঋণের শেষ নাই। তবুও অমন গম্ভীর স্বভাবটা গোলমেলে। যদি উকিলবাবুর সংসারে আর একটু মানিয়ে নিতে পারত তাহলে বোধহয় দিদির এত দেমাক দেখতে হতো না। উকিলবাবুর কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে ওর। কোনো সুখস্মৃতি নেই, তবু একটা একপেশে টান অনুভব করে বৈকি। ‘আমারও স্বামী আছে’ কথাটা ঢালের মতো তার ব্যর্থতা থেকে তাকে আড়াল করে। এই একটি বাক্য উচ্চারণ করেই প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারে সে। পাশে না থাকলেও, তার অস্তিত্বটুকুই সব। হবে নাই  বা কেন, স্বামী আছে তাই জীবনে অনেক কিছুই আছে। শাঁখাসিঁদুর আছে। পায়ে আলতার বিলাস আছে। পরনের কাপড়ে বাহারি রঙের বৈচিত্র আছে। ভাতের পাতে মাছের টুকরো আছে। দিদির জীবনে এসব কিছুই নেই। দিদি এইখানে তার কাছে হেরে গেছে। তাই কি দিদির তার  উপর এত রাগ? মাঝে মাঝে অবশ্য মনে হয় দিদি রাগ করে না। শাসন করে, ঠিক যেমন টুকিপুকুকে মালতী করে। কিন্তু তবুও মানে লাগে। এত কথা তার মনের মধ্যে জন্মায় আবার বুদবুদের মতো মিলিয়ে যায়।

ছয়

একদিন আকস্মিক ভাবেই তোলনের মনের সব টানাপড়েন মিটে গেল। সেদিনও আর পাঁচটা দিনের মতোই সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ শক্তিপিওন এসেছে, হাতে একখানা চিঠি। শক্তিপিওনের এই গ্রামেই বাড়ি। গ্রামেরই পোস্টঅফিসের পিওন। পরিচিত মহলে সবাই জানে, সে পত্রপ্রাপকের হাতে চিঠি তুলে দেবার আগে নিজে একবার পড়ে নেয়। তাই তার মুখ দেখেই অনেকে বোঝার চেষ্টা করে চিঠিতে কী আছে। দুঃসংবাদ নাকি সুসংবাদ! কোনো সাধারণ চিঠি হলে সে চিঠি দরজার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিয়ে চলে যায়। সেদিন এক্কেবারে মাঝউঠোনে ঢুকে পড়ে বলল, ‘চিঠি আছে।’ তোলন বাইরেই ছিল। বলল, ‘দাও।’ কিন্তু শক্তি তার হাতে চিঠি না দিয়ে বলল, ‘দিদিকে ডাকো।’

পুষ্পাঙ্গিনী বেরিয়ে আসতেই তার হাতে চিঠিটি দিয়ে শক্তিপিওন তোলনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার নিরীক্ষণ করে নিয়ে বলল, ‘আসি’। চশমাটা গলিয়ে নিঃশব্দে চিঠি পড়তে লাগল পুষ্পাঙ্গিনী। তোলন পুবদিকের ধানগোলাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিন হলে সে চিঠিখানি দিয়েই কাজে মন দেয়। কিন্তু আজ শক্তিপিওনের চাউনিটা সন্দেহজনক লেগেছে।

‘কী হয়েচে দিদি? কার চিঠি? কী লেকা আছে?’ জিজ্ঞেস করেই ফেলল।

‘তোর নামে চিঠি। উকিলবাবু দেহ রেখেছে দিন কুড়ি হল। এতোদিন কাজের চাপে, শোকের মুখে ওদের মনে পড়েনি। এখন সব কাজকর্ম চুকে যেতে চিঠি দিয়েছে।’

সবাই চুপ করে আছে। তোলনও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, ‘অ, তাই বল। বেশ। আমাকে যেতে হবে লিখেচে?’

পুষ্পাঙ্গিনী বলল, ‘মরে যাওয়ার কুড়িদিন পর চিঠি দিল। কাজকম্ম চুকিয়ে তোর কথা মনে পড়েছে। তোর  কি মনে হয় আমি তোকে পাঠাব? হতচ্ছাড়ি বয়সই হয়েছে, বুদ্ধি আর হল না!’ 

‘তাহলে এখন আমাকে কী কী করতে হবে?’

শক্তিপিওন সম্ভবত যাবার সময় পাড়ায় বলতে বলতে গেছে। খোলা দরজা দিয়ে একে একে প্রতিবেশীরা ঢুকে পড়েছে। একজন মালতীকে বলল, ‘একবার পুকুরঘাটে নিয়ে যেতে হবে।’

তোলন ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, ‘আমি যাব না। আমি কিছু খুলব না। আমাকে জোর কোরো না কেউ। দিদি গো আমি পারব না, এইগুলো নিয়েই তো আমি…’

মালতী ওকে ধরে দাওয়ায় বসাল। তারপর বলল, ‘ভালোমা, আমরা তো সবাই আছি, আপনার কোনো ভয় নাই। আর দেরি করলে, অবেলায় চান করলে শরীর খারাপ হবে। মন খারাপ করেন না।’

উঠোনে একদল মহিলা জুটেছে। ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, ‘আহা রে! মাছের টক খেতে বড় ভালোবাসত! জম্মের মতো ঘুচে গেল মাছ খাওয়া!’

আরেকজন সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘টকটকে গায়ের রঙ। রঙীন চেকশাড়ীটি পরে পাশ দিয়ে যখন পেরিয়ে যেত তাকিয়ে থাকতে হত।’

আরো একজন বলল, ‘বলে কি আর শেষ করা যায়? বামুনের ঘরের বিধবা বলে কথা! কী কষ্ট যে কপালে লেখা আছে!  দুগ্গা! দুগ্গা!’ আস্তে আস্তে তোলনের ভবিষ্যৎ আলোচনায় মুখর হয়ে উঠল ব্যানার্জ্জীবাড়ির উঠোন। তোলন চুপটি করে মালতীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে। সবাই নিয়মকানুন পালন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এল।

এমন সময় পুষ্পাঙ্গিনী হঠাৎ বলে উঠল, ‘কেউ ওকে কোনো জোর করো না। তোলন যেদিন স্বামীর ঘর ছেড়ে এই ব্যানার্জ্জী বাড়িতে এসে উঠেছে, তখন প্রায় আটদশ দিন সে কিছু মুখে দেয় নি। আমি মনে করি তখনই ওর অশৌচ পালন হয়ে গিয়েছে। আমাদের ঘরে সেদিনের পর থেকেই উকিলবাবুর আর কোনো অস্তিত্ব নেই। আর যার স্বামীই নেই, তার আবার বৈধব্য পালন কিসের? ও নিজের ইচ্ছেমতো সবকিছু করবে। আজ আর ওকে বিরক্ত করো না কেউ। আর হ্যাঁ, মালতীকে বলছি, ওর ভাতের পাতে মাছের টক থাকবে। আমি খাই না, আমার রুচি হয় না। ও সব খাবে।’

তারপর উঠোনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এবার সব যাও। বেলা গড়িয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া সেরে নাওগে।’

তোলনের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মালতীর কাপড় ভিজে গিয়েছে। আনন্দ হচ্ছে নাকি কষ্ট ও ভেবে তল পেল না তোলন।

সাত

আরো কবছর পর শরীর ভাঙতে লাগে তোলনের। আগের মতো কাজ করতে পারে না। কাজের লোক রাখা হয়েছে তোলনের সম্মতি নিয়েই। আর কোনোকিছুতেই আগের মতো প্রতিক্রিয়া দেখায় না ও। উপরনীচ করতে কষ্ট হয়। দুপুরের পর আর নামে না নীচে। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম গাইতে গাইতে লাইন ভুল হয়ে যায়। দেখাশোনার অভাবে পুষ্পাঙ্গিনী সব ছাগল বিক্রি করে দেয়। মালতী বার-ব্রত-উপবাস সব একাই করে। ঠাকুরের আশীর্বাদী ফুল মাথায় ঠেকিয়ে দিয়ে বলে, ‘ভালোমা, আপনার নামেও পুজো দিলাম।’

এক সময় বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলল তোলন। পুষ্পাঙ্গিনীর আদেশে তারই শোবার ঘরের মেঝেতে তোলনের শোবার বন্দোবস্ত করা হল। সুস্থ অবস্থায় দিদির ভয়ে যে ঘরে ঢুকতে পা কাঁপত সেই ঘরে দিদিরই পাশে তার  বিছানা! মালতী এসে খাবার দিয়ে যায়। পুষ্পাঙ্গিনী নিজে হাতে খাইয়ে দেয় ছোট শিশুটির মতো করে। ওষুধ দেয় সময়মতো, শরীরের তাপমাত্রা বাড়লে জলপট্টি দেয়। মলমূত্র পরিষ্কার করে। ঘন ঘন কাঁথা পালটায়। সেই কাঁথা নিজের হাতে কাচে, মেলে, শুকোতে দেয়। প্রায় মাসাধিক কাল ধরে দিনরাত এক করে পুষ্পাঙ্গিনী তোলনের শুশ্রূষা করে। তোলন মাঝে মাঝে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দিদির দিকে। কথা বলতে পারে না আর।

‘শেষ বয়সে, যখন পরিশ্রম করার ক্ষমতা চলে যাবে তখন কী হবে?’ এই ভাবনায় কত রাত ভোর হয়ে গেছে তোলনের।  এত যত্ন, এত ভালোবাসা দিদির কাছে পাওনা ছিল এ তার কল্পনারও অতীত। পৃথিবীতে সবচেয়ে  কাছের মানুষটিকে চিনতে একটা গোটা জীবন লেগে গেল!

চতুর্দিক থেকে অন্ধকার তাকে চেপে ধরে তাকে। হৃদযন্ত্র জোরে জোরে কেঁপে ওঠে। সারা জীবন ধরে এসব সুখ তার পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেছে, তোলন যেন ধরতেই পারেনি। শেষ সময়ে সেই মহামূল্য সুখকে যেন সে আবিষ্কার করল। সে সম্পদ থেকে গেল তার হৃদয়ের গভীরে। কেউ জানতে পারল না। না দিদি, না মালতী।

জিনিয়া ব্যানার্জ্জী অধিকারীর বীরভূম জেলার ইন্দাশ গ্রামে জন্ম। গ্রাম জীবনের অপার আনন্দ গায়ে মেখে বড় হওয়া। ছাত্রজীবন ছড়িয়ে ছিল নিজের গ্ৰাম, প্রতিবেশী গ্ৰাম বিপ্রটিকুরী এবং লাভপুর জুড়ে। পরবর্তী পড়াশোনা বর্ধমান বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে। বৈচিত্রময় ছাত্রজীবন প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে সামাজিক বৈচিত্র্যকে দেখতে ও চিনতে শিখিয়েছে। জিনিয়া বর্তমানে বোলপুর স্কুলবাগানের বাসিন্দা এবং আকাশবাণীর ঘোষিকা হিসেবে শান্তিনিকেতনে কর্মরতা।

বড়পিসির সান্নিধ্যে বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল ছোটবেলা থেকেই। কবিতা পাঠ করতে ভালোবাসেন আর ভালোবাসেন মানুষের সঙ্গে মিশতে।

সঙ্গের ছবি – কে সি মোনাপ্পা (ইন্টারনেট)

1 thought on “তোলন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.