পার্থপ্রতিম মৈত্র

প্রথম প্রকাশ – গুরুচণ্ডা৯, ২০১৭। দ্বিতীয় প্রকাশ – আয়নানগর, বইমেলা সংখ্যা ২০১৮।

প্রথম কিস্তি
আমার ওয়ার্ডের সামনের টানা বারান্দা দিয়ে নিচে দেখা যায় স্কুল অব ট্রপিকাল মেডিসিন-এর আউটডোর। কারমাইকেল হাসপাতাল। কাতারে কাতারে লোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ওয়ার্ডের পিছনের টানা বারান্দা দিয়ে একটু দূরে দেখা যায় কলকাতা মেডিকাল কলেজ-এর আউটডোর। কাতারে কাতারে লোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। কত লোক? তিন হাজার বা পাঁচ হাজার, বা দশ হাজার? আমার কোনও আন্দাজ নেই। “এখানে স্কিনের দিন সবচেয়ে বড় লাইন পড়ে। এইডস আর থ্যালাসেমিয়ার দিন কম। ডেঙ্গুর সময় তো দাঁড়াবার জায়গা পাবেন না।” সব ইনফরমেশন আমাকে জোগায় রুগীর আত্মীয়েরা, ওয়ার্ড অ্যাটেনডেন্টরা এমনকি নার্সেরাও। দু টাকার টিকিট, ডাক্তার লিখে দিলে ওষুধও ফ্রী। সারাটা দিন হয়তো এখানেই কাটবে, কিন্তু তাতে কী? পাড়ার ডাক্তারও ভিজিট একশো টাকা করে দিয়েছে। ওষুধের দাম আকাশছোঁয়া। চুলকুনি হলেও খরচ আছে তিনশো টাকা। জ্বরজারি হলেতো কথাই নেই। টেস্টের খরচ আছে কম করে পাঁচশো টাকা। তার চেয়ে একটা দিন নষ্ট হলে কী আর লোকসান।
আমার ওয়ার্ডের সামনে টানা বারান্দা, পিছনেও তাই। তিন চারটি জেনারেল ওয়ার্ড, আর আটটা কেবিন। ওয়ার্ডের নামগুলোও অদ্ভুত। পাইকপাড়া ব্লক, তার পাশে লুকাইস ব্লক। আমি আছি লুকিস-আট নম্বর কেবিনে। কেবিন মানে বহুত উঁচু বড়-বড় ঘর। কেবিন ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ। মেল ওয়ার্ডে একটিই মাত্র কেবিন, যেখানে অ্যাটাচড বাথরুম আছে। ট্রপিকাল সবাইকে অফার করে, আমাকেও করেছিল। কিন্তু কেউ সেটা নিতে চায়না। আমিও না। আমার পাশের ঘরে একটি হোমোসেক্সুয়াল ছেলে। তার পাশের ঘরে স্পুটাম পজিটিভ, মানে টিবি। তার পাশে সুন্দরপানা একটি ছেলে সম্ভবত অতিরিক্ত তাম্বাকু সেবনের অপকারিতায় আক্রান্ত। তার পাশে ছোট্ট একটা ছেলে যার অজানা রোগের জ্বর নামছে না। তাকে ঘিরে সব সময়ে ডাক্তার এবং নার্সের ভীড়।
আমার ছাতার মাথা একটা রোগ হয়েছে। মানে মাথার মধ্যে ছত্রাক সংক্রমণ। লেফট স্পেনয়েড রিজিয়নে অ্যাসপারোজিলেসিস। চোখ, নাক, ব্রেন সব ডাক্তার দেখিয়ে, কলকাতার সবচাইতে দামি হাসপাতালে অপারেশন করিয়ে, নিঃস্ব হয়ে, লাভের মধ্যে এই হলো যে বাঁ চোখে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, আর ডান চোখে শুধু আণ্ডার-এক্সপোজড ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট ছবি। আমি দশ বছর ধরে ক্রিপ্টোজেনিক সিরোসিস অব লিভারে আক্রান্ত। পিজির ডাক্তার অভিজিত চৌধুরী বলেছিলেন “সো নাউ ইউ হ্যাভ লার্ণড হাউ টু লিভ উইথ সিরোসিস।” আজ পর্যন্ত কখনও এমন হয়নি ইউ-এস-জি করতে গিয়ে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেনি “খুব দারু খেতেন?” আমার তো দারু, সিগারেট, পান, এমনকি গুটকার নেশাও নেই। বন্ধু বান্ধবের সৎসঙ্গে যতটুকু হয়। নেশা বলতে বই পড়া আর মাঝখানে হয়েছিল সিনেমা করার নেশা। সেই রঙ্গিন পৃথিবীটা চোখের সামনে সাদাকালো হয়ে যেতে দেখেছি আমি। আর তার সঙ্গে মাথার তীব্র যন্ত্রণা। বই পড়তে না পারা, আর মৃত্যু তো সমার্থক।

যাকগে অসুখের কথা। আগে তো মানুষের কথা বলি। গত আট মাসের মধ্যে একটা দিনও রাত্রে ঘুমাইনি, ব্যথায় চিৎকার আর ছটফটানিতে ইন্দ্রাণী আর বিহানও ঘুমায় নি কয়েক মাস। সেদিন সন্ধ্যাবেলা হাসপাতালে, কেউ নেই ঘরে। চোখটা একটু বুজে এসেছে, হঠাৎ তীব্র চিৎকারে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। পাশের ঘর থেকে আসছে? ড্রিপ চলছে, ফলে উঠে বেরুতেও পারছি না। আমি চিৎকার করে ডাকলাম “খোকন দা…।” অ্যাটেনডেন্ট খোকনদা ছুটে এলো।
– “আমার ড্রিপটা একটু বন্ধ করবেন”?
– “কেন টয়লেট যাবেন?”
– “না পাশের ঘরে কে যেন চিৎকার করছে।”
খোকনদা এবার গম্ভীর। “চুল কেটে দিয়েছে বলে।”
আমি বল্লাম “বাচ্চা ছেলে? আগের ছেলেটা কোথায় গেল?”
খোকনদা আগের চেয়েও গম্ভীর। “আগের ছেলেটাই চিৎকার করছে।”
– “আগের ছেলেটার মাথায় অত বড় বড় চুল, কেটে দিল কেন?”
– “মাথায় ঘা হয়ে গেছিল। ঘুমের মধ্যে কেটে দিয়েছে। এখন জেগে উঠে বুঝতে পেরে চিৎকার করছে। আসলে একটু লেডিজ টাইপ তো। লম্বা চুল ভীষণ ভালবাসতো।” খোকনদা প্রায় ছেলেটার মতই বিধ্বস্ত। “কত ভাল বাড়ির ছেলে, কেন যে এরকম হয়ে যায়!”
তার পরদিন থেকে দেখেছি খোকনদা পরম যত্নে হুইলচেয়ারে বসিয়ে ছেলেটিকে টয়লেটে নিয়ে যাচ্ছে, স্নান করিয়ে দিচ্ছে। যে ছেলে বাড়ির লোকদের দেখেও চিৎকার করে, ফল ছুঁড়ে মারে, ডাক্তার এলেই বলে “ভেতরে ঢুকলেই ছুরি চালিয়ে দেবো,” সে খোকনদার কাছে শান্ত সুবোধ তরুণ। আমি দাবি করছিনা যে বেসরকারি হাসপাতালে এই সার্ভিস পাওয়া যায় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়তো বেশীই পাওয়া যায়, তবে তার দামও বেশী থাকে। কিন্তু অ্যাপোলো-গ্লেন ঈগলস, সল্টলেক আমরি, মেডিকা বা টাটার মত হাসপাতালে থেকে দেখেছি এই ইমোশনটা কোথাও পাওয়া যায় না। সব কেমন যেন রোবোটিক। অবশ্য এসবই আমার দেখার ভুলও হতে পারে। সাদা-কালোয় দেখেছি তো।
দ্বিতীয় কিস্তি
কলকাতার অধিকাংশ বেসরকারী হাসপাতাল হচ্ছে সরকারী ডাক্তারদের (বর্তমান ও কিছু প্রাক্তন) প্রাইভেট প্র্যাকটিসিং গ্রাউণ্ড। এ অনেকটা প্রাইমারী স্কুলে বারোশো টাকায় শিক্ষকতা করে, বাড়িতে পনেরো হাজার টাকায় প্রাইভেট ট্যুইশন করার মত। ছিপ ফেলে বসে থাকো, আর কোনও মাছ ঘাই মারলেই তুলে নিয়ে নিজের নীল অ্যাকোয়ারিয়ামে ঢুকিয়ে ফেলো। যে কতিপয় ডাক্তারের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যত্যয় দেখেছি তার মধ্যে একজন হচ্ছেন পিজির হেপাটোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী। নাইটিঙ্গেলেও বসেন। পিজিতে সেই দীর্ঘলাইন আর অফিস কামাই এড়াতে নাইটিঙ্গেলেই চলে গেলাম। যথারীতি অনেক পরে আমার নাম। রাত প্রায় সাড়ে আটটায় যখন গিয়ে ঢুকলাম তখন তিনি আমায় চিনতে পারেন নি। দেখতে শুরু করার পর হঠাৎ বললেন, “আপনি সেদিন পিজিতে দেখিয়ে ছিলেন না? এখানে এসেছেন কেন? আমি তো পিজির পেশেন্ট এখানে দেখিনা, আর এখানকার পেশেন্টদের পিজিতে ডাকিনা।” আমি সাধ্যমত বোঝাতে চেষ্টা করলাম। তিনি বল্লেন, “সব বুঝলাম কিন্তু প্রিন্সিপল ইজ প্রিন্সিপল। আপনার জন্য আমি সেটা ভাঙ্গতে পারি না।” বলে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়েই বার করে দিলেন। এখানেই থামেন নি। নান্দীকারের গৌতম হালদার (যিনি আমায় পিজিতে ডাঃ চৌধুরীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন) কে ফোন করে জানতে চেয়েছেন এই পার্থপ্রতিম লোকটার সুলুক সন্ধান কি তুমি জানো? কাল তো পিজিতে আমার আউটডোর নেই, উনি যেন আমার রুমে আমার সঙ্গে দেখা করেন। পরদিন ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকতেই বল্লেন শুয়ে পড়ুন। প্রায় আধঘন্টাটাক দেখলেন। নিজের লেখা ছড়া শোনালেন এবং যখন ঘর থেকে বেরুলাম তখন আমি অনেকটা সুস্থ। পরবর্তী সময়ে ডাঃ বিভূতি সাহা যখন বল্লেন, “আমি আপনাকে নাইটিঙ্গেল বা সিএমআরআই তে ভর্তি করতে পারবো, কিন্তু এই কেসে আমি ট্রপিকালে আমার টিমকে নিয়ে কাজ করতেই বেশী পছন্দ করবো”, তখন আমার এই কথাটাই মনে পড়লো। অতএব ডাক্তারীর এক্সপার্টাইজ এর দিক থেকে বেসরকারী হাসপাতালের সঙ্গে সরকারী হাসপাতালের কোনও তুলনামূলক আলোচনাই সম্ভব নয়। তবু আমরা কেন বেসরকারী হাসপাতালের দিকে পতঙ্গের মত ছুটি?
এ সমস্যা আমাদের মত একান্ত মধ্যবিত্তদের। গরীব-গুর্বোদের এ সমস্যা নেই, কেননা তারা জানে তাদের অন্য কোনও অপশন নেই। তাই অসুখ গম্ভীর হলেই তারা আজ্জি-কল বা মেডিকাল বা এনারেস, বা চিত্তরঞ্জন ছোটে। যারা সেটুকু করতেও অপারগ তাদের জন্য মিউনিসিপালিটির হাসপাতাল ভরসা। আর যাদের অগাধসম্পত্তি বা যারা প্রিভিলেজড ক্লাস, তারা জানে সরকারী হাসপাতাল গরীবদের জন্য। যা কিছু হাই-এণ্ড সব আমাদেরই জন্য। এসব বেসরকারী হাসপাতালও আমাদেরই জন্য। মাঝখানে ফাটা বাঁশে আটকে গেছে মিডলক্লাস। যাদের সাধ আছে সাধ্য নেই। যথারীতি তাঁরা বেসরকারী হাসপাতালেই যান, নিঃস্ব হয়ে ফেরেন, এবং হীনমন্যতায় ভোগেন। বেসরকারী হাসপাতাল কী খারাপ বলে শাপশান্ত করেন। কিন্তু কদাপি সরকারী হাসপাতালে যাবার কথা ভাবেন না।
বেসরকারী হাসপাতাল আমাদের কী কী দেয়। পেশেন্ট পার্টির জন্য দেয় পূজা মন্দির, ঝকঝকে তকতকে ওপর নিচ, ফ্রন্ট ডেস্কে চোখে আউটার লাইন কাজল লাগানো পরী-সেবা, এসি ওয়েটিং লাউঞ্জ, ডক্টর উইথ কো-অর্ডিনেটর (আসলে সেক্রেটারী), কাফেটেরিয়া (চায়ের নূন্যতম দাম কুড়ি টাকা, এক লিটার জল পঁচিশ টাকা, লাঞ্চ চালকুমড়োর ঘ্যাঁট দিয়ে নিরিমিষ্য়‌ি ভাত ষাট থেকে আশী টাকা) সিস্টেম জেনারেটেড বিল, রেকর্ড মেনটেনেন্স চার্জ, ভিজিটিং আওয়ার্সে ডিসিপ্লিন মেনটেনেন্সের জন্য বাউন্সার অবধি। আর পেশেন্ট দের জন্য আছে স্লিপার, অক্সিজেন মাস্ক (দরকার না থাকলেও), টুথপেস্ট, টুথ ব্রাশ ( বাড়ি থেকে আনলে হবে না), উত্তরপূর্ব অথবা দক্ষিণ ভারতীয় ট্রেনি নার্স (যারা অন্তত বাংলা ভাষাটা জানেনা, এবং হিন্দীতেও দুর্বল), হাউসকিপিং দাদা (আসলে গ্রুপ-ডি স্টাফ), ডায়েটিসিয়ান, ক্লিনিং স্টাফ (আসলে সুইপার), ছোট্ট কিন্তু ঝকঝকে টয়লেট উইথ ওয়েস্টার্ণ কমোড, টিভি, হাইড্রোলিক বেড, একজন আরএমও (যাকে ডেকে ডেকে সারা)। খেয়াল করে দেখুন এগুলোর অধিকাংশই সরাসরি চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত নয়। ট্রপিকালে সারাদিন ডক্টর সাহা, ডক্টর শুভায়ন বা ডক্টর দেবজ্যোতি বা ডক্টর বৌধায়ন বা অন্য কোনও ডাক্তার (যাদের ছাই নামও জানা হয়নি) না এলে মনে হতো ব্যাপারটা কী? এরা কী বুঝে গেল আমার কেসে আর কিছু হবার নেই? গন কেস? ট্রপিকালের ভোকাবুলারিতে “পেশেন্ট খারাপ হয়ে গেছে?” আর আমরি বা অ্যাপোলোতে ডাক্তার ভিজিটে এলেই বুক ধড়াস ধড়াস করতো, আবার সন্ধ্যেবেলা আসবে না তো! পার ডাক্তার পার ভিজিট আটশো থেকে বারোশো টাকা। আমার কাকার ক্ষেত্রে মেডিকায় দেখেছি টিইউআরবিটির জন্য প্যাকেজ চুয়ান্ন হাজার, কিন্তু মেডিক্লেইম থাকলেই সেটা বেড়ে হয়ে যাচ্ছে চুরানব্বই হাজার।
– “কেন?”
– “না ম্যাম আমরা তো প্যাকেজের জন্য ডিটেল ব্রেক আপ দিই না, আপনার রিইমবার্সমেন্টে প্রবলেম হয়ে যাবে।”
– “কেন দেবেন না?”
– “এটাই এখানকার সিস্টেম ম্যাম।”
আর সিস্টেম দেখতে হলে চলে যান যে কোনও বেসরকারী হাসপাতালে। উরি শ্লা কী চার অক্ষর রে। একেই বলে পরী-সেবা। আড়াই মিনিট ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার জন্য অর্থদণ্ড ছাড়াও খরচ হচ্ছে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময়। ডিসচার্জ সামারি উইথ বিল বার করতে সাত থেকে আট ঘন্টা। যাঁরা এটিএম থেকে দুহাজার টাকা তোলার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যে লাইন দিতে পারেন, ডাক্তার সন্দর্শনের জন্য কতকগুলো নির্বোধ বালক-বালিকার নির্দেশে স্টিলের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে পারেন ঘন্টার পর ঘন্টা, তাঁদের জানাই সরকারী হাসপাতালে বিল বা ডিসচার্জ সামারি নিতে কিউ এ এত সময় লাগেনা। কথাগুলো বল্লাম এই কারণে যে অ্যাপোলোতে দুদিনে জেনারেল ওয়ার্ডে থাকতে এবং অপারেশনে আমার খরচ হয়েছে (তার মধ্যে বেড ভাড়া পার ডে তিন হাজার টাকা) কমবেশী দু লক্ষ টাকা। আর ট্রপিকালে প্রায় একমাস কেবিনে থাকার খরচ (সব টেস্ট মিলিয়ে) হয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এবার কোন দিক সাথী/ কোন দিক তুই / কোন দিক বেছে নিবি বল।
যাকগে, এবার একটা জরুরী তথ্য বলে শেষ করি। ট্রপিকালেও একটা ক্যান্টিন আছে বটে। ছোট। কিন্তু যদি কোনদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা, সময় পান, যাবেন। আমি নিজে খাইনি, মানে টোস্ট ছাড়া কিছু খাইনি, বারণ বলে। কিন্তু অনেকে খেয়েছে। তারা উচ্ছসিত। রিজনেবল দামে এমত পরিচ্ছন্ন ক্যান্টিন কলকাতায় কম আছে। দেখবেন ডাক্তাররাও বসে নিশ্চিন্তে খাচ্ছে। এই বিজ্ঞাপনের জন্য আমি কোনও পয়সা পাবো না, মাইরি বলছি, শুধু একটা ঠেক চেনানোই উদ্দেশ্য।
তৃতীয় কিস্তি
আচ্ছা অ্যাপোলোর মহেশ গোয়েংকা কোনদিন আপনাকে টাচ করে দেখেছেন?” একটা হাসিখুশী উচ্ছল তরুণ ডাক্তার প্রশ্নটা করেই ফেল্লো। যদিও সে শুনলাম অ্যাসোসিয়েট প্রফেসার।
কেন টাচ করবেন না ? উনিই তো আমার এণ্ডোস্কোপি করলেন।”
না না ওরকম নয়, এমনিতে একটু পেটে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন, স্প্লিনটা কত বড় দেখলেন, ফাইব্রোসিস কতটা, এসওএল আছে কিনা, জল আছে কিনা এসব দেখলেন? দেখেননি তো? আমি জানেন, একটা পেশেন্টও দেখিনি যাকে উনি ছুঁয়ে দেখেছেন।”
আমি আর ভয়ের চোটে বল্লাম না যে সেদিনও (সিডেটিভ ছাড়া আমি এণ্ডোস্কাপি নিতে পারিনা) সময়মত সিডেটিভ দেওয়া হয়নি কেন, আর যদি হয়নি তবে তাঁকে ডেকে দু মিনিট সময় নষ্ট করার মানে কি বলে নার্স মেয়েটিকে বিস্তর গালিগালাজ করার ফাঁকে ডক্টর গোয়েংকা উইদাউট সিডেটিভ এফেক্ট নলটা পুশ করে দিলেন আমার গলায়। বেচারা নার্স তখনও বিস্তর চেষ্টা করে চলেছেন হাতে সূঁচ ফোটানোর। এণ্ডোস্কোপি শেষ এবং সিডেটিভ এফেক্ট শুরু একই সঙ্গে সম্পন্ন হল।
অল্প বয়সী ডাক্তারটিকে তার সতীর্থরা বকতে শুরু করলো চুপ করানোর জন্য। আমার মনে পড়লো ইসরোর টেলিমেডিসিন প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর দিলীপ ঘোষ স্যার বলেছিলেন “তুমি একটু অভিজিতের সঙ্গে কথা বলো। ওর কী সমস্ত রিজারভেশন আছে এই বিষয়ে।” অভিজিত চৌধুরী প্রস্তাব ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বল্লো, “ধুর ডাক্তার যদি রুগীর শরীর ছুঁয়েই না দেখে, তাদের মধ্যে যদি একটা টাচিং বণ্ডেজ তৈরী না হয়, তবে সেটা ডাক্তারী নয়। রুগী কাৎরাচ্ছে পাঁচশো মাইল দূরে, আর ডাক্তার এখানে বসে পাঁচটা রিপোর্ট দেখে বিধান দিল কী করিতে হইবে? রিপোর্ট আর কাগজ দেখে উকিল, ডাক্তার দেখে রুগী।”
সকাল ঠিক সাতটায় খোকনদা এসে ডাকবেন। টয়লেট যাবেন তো। ডেটল দিন।” এরা জানে আমি ইমিউনো-কম্প্রোমাইজড। ফলে আমার জন্য এক বালতি জলে ডেটল ঢেলে টয়লেটটা ধুয়ে দেয়। আমি বেরুলেই বলবে “এবার স্নানটা করে নিন। কষকষে গরম জল করেছি।” যত বলি আমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে, শুনবে না। “চান করে রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকবেন।” আটটায় রাও-দা (দিনের অ্যাটেণ্ডেন্ট) আসবেন। ফাইল আসবে। একটু পরে ডক্টর শুভায়ন, বা ডক্টর দেবজ্যোতি বা ডক্টর বৌধায়নের মতো কেউ আসবেন। খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করবেন কী অসুবিধে। পালস প্রেশার মাপবেন, টেস্ট থাকলে ব্লাড নেবেন। তারপর যাবেন পাশের ঘরে। দশটা সাড়ে দশটায় ডক্টর বিভূতি সাহা আসবেন সঙ্গে দশ-পনেরো জন ডাক্তার। বলবেন “শুনুন আপনাকে এখানে আটকে রাখার কোন ইচ্ছে আমাদের নেই। শুয়ে পড়ুন।” আবার এক প্রস্থ পরীক্ষা। তারপর শুরু হবে টিমের মধ্যে আলোচনা। পয়েন্ট ফাইভ না ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ। টেনশন রিলিজার দেওয়া হবে কি হবে না। অ্যালডাক্টন চালু রাখা হবে না। কি হবে ডোজ। মাঝে মাঝে আমিও পারটিসিপেট করতাম নন-ক্লিনিকাল ডিসকাশনে।
ফাইনালি ঠিক হলো যেহেতু আমার ক্রিয়েটিনিন কম তাই ইন্টারভেনাস লাইপোজোমাল অফো-বি শুরু করা হোক। প্রতিদিন পাঁচটা করে ভাইল এর ডোজ, ড্রিপের সঙ্গে। প্রতিটা ভাইলের দাম পাঁচ হাজারের টাকার ওপর। হসপিটাল ডিসকাউন্ট ধরে আমরা পেতাম আঠাশশো টাকায়। যেহেতু এত কস্টলি ওষুধ সিস্টেমে থাকে না, তাই কিনতে হবে। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল সবার। ভাগ্যিস আমি তখন প্রায় দেখতে পাই না। বাকীদের তখন পাগল পাগল অবস্থা। ডক্টর সাহা তখনও আশ্বাস দিয়ে বলছেন “ঠিক আছে দেখাই যাক না। প্রথম দিনের ওষুধটা তো কিনুন।” সেইমত ডোজ শুরু হলো ডিসেম্বরের বারো তারিখে, চোদ্দটা ডোজ কমপ্লিট করার লক্ষ্যে। দ্বিতীয় দিন থেকেই সিস্টেমে চলে এল ওষুধ, ঠিক কার বা কাদের অতি সক্রিয় উদ্যোগে তা আমি জানলেও প্রকাশ্যে জানাতে পারবো না কেননা বারণ আছে। তারাও সরকারী বৃত্তেরই মানুষ। এখনও কিছু মানুষ গোপনে সহযোগিতায় বিশ্বাসী, যখন প্রচারের লাইমলাইটে আসার জন্য অনেকাংশের জিভলালা ঝরতেই থাকে অহর্নিশ।
আলোচনায় ফিরি। মধ্যবিত্ত মানুষ এত সুযোগ সুবিধা থাকা সত্বেও সরকারী হাসপাতালের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেন কেন? আমি কেন এড়িয়ে চলতাম? আমার কারণগুলিকে এইভাবে চিহ্নিত করতে পারি।
১. আমাদের চিকিৎসা অভ্যাস। প্রাথমিকভাবে পাড়ার পরিচিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া। তিনি সারাতে না পারলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের খোঁজ করা। মানে নিজস্ব পরিচিতি সূত্রে যিনি বিশেষজ্ঞ। এবার তিনি কোথায় কোথায় বসেন খোঁজ করা। নিজের সুবিধা এবং সামর্থ অনুযায়ী অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তাঁকে দেখানো। সরকারী সিস্টেমে এটা সম্ভব নয়। ওপিডিতে যে ডাক্তার থাকে তাকেই দেখাতে হয়। তাঁর মনে হলে তবে সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ছাড়পত্র পেলেন।
২. সরকারী ব্যবস্থাপনায় অবিশ্বাস। সাধারণ ধারণায় দু টাকায় যে চিকিৎসা হয়না তাও চালু করা হয়েছে শুধু মাত্র ভোটের অংক মেলানোর জন্য। শুধু জেলা নয় অন্য রাজ্য থেকেও লোক চলে আসছে। বিহার থেকে ঝাড়খণ্ড থেকে। ফলে অপরিচ্ছন্নতার ভয়। সংক্রমণের ভয়।
৩. যে অর্থনেতিক শ্রেণী-অসাম্যের অবস্থান থেকে উচ্চবিত্তেরা পোকামাকড়সম দৃষ্টিতে দেখে মধ্যবিত্তকে, আমরাও সেই একই দর্শন ও অবস্থান-লালসা বুকের গভীরে লালন করে চলি। নিম্নবিত্তদের সঙ্গে একই সারিতে দীর্ঘ কিউ, তাদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ডাক্তার দেখানোর জন্য অপেক্ষা, এসবই একটা মেন্টাল ব্যারিয়ার তেরী করে। সরকারী হাসপাতালকে আমাদের প্রাথমিক চয়েসের বাইরে রাখে।
৪. প্রিভিলেজড ক্লাস সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল ছাড়া অন্য কিছু ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনা। ভাবতে পারেন কোনও মন্ত্রী-সান্ত্রী-উজির-নাজির আর.জি.কর. বা এন.আর.এস বা মেডিকাল কলেজে ভর্তি হচ্ছেন? আমি প্রথম যেবার সল্টলেক আমরি তে অ্যাডমিশন নিই, তখন আমার মাথার ওপর ডিলাক্স স্যুইটে অধিষ্ঠান করছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। আর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর তো কোনদিনই বেলভিউ ছাড়া কিছু পছন্দ নয়। মধ্যবিত্ত সমাজের চিরকালীন স্বভাব হচ্ছে উচ্চবিত্তকে অনুসরণ ও অনুকরণ করা। তাই কুঁজোর চিৎ হয়ে শুতে সাধ জাগে। এভাবেই তারা গণ্ডি পেরিয়ে যায়, পেরোতেই থাকে, যতক্ষণ না উলঙ্গ জীবন বা মৃত্যু তাকে নির্বাচন করছে।
৫. হাসপাতালের নীচুতলার কর্মীদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। কোন কাজ করতেই টাকা ছাড়া এদের নড়ানো যায় না। প্রফেশ্যনাল অ্যাটিটিউড নেই বলে, কর্মদক্ষতা-কর্মসংস্কৃতি নেই বলে, সেই কাজগুলোও এরা সঠিক ভাবে করেনা। টয়লেটগুলি ব্যবহার অযোগ্য। ঘরগুলি নোংরা, ইত্যাদি প্রভৃতি….। আজ অবস্থার ফেরে আমায় ট্রপিকালে ভর্তি হতে হচ্ছে। কে জানে কাল অবস্থা পাল্টালে আমিও হয়তো উল্টো গাইবো। এসবই অবস্থানগত দৃষ্টিভঙ্গী। শ্রেণী-দর্শন। বেসরকারী হাসপাতালে এই সব কিছুর জন্যই মূল্য ধরা থাকে (তাই আলাদা করে চাইতে হয়না)।
ফলে প্রথম চারটি অনীহা নিয়ে আলোচনা করে কোনও লাভ নেই। শুধু এটুকু বলবো যে এইসবই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত, যা কিনা সরকারী হাসপাতালের বিচক্ষণতা, কার্যকারিতা, এবং নিম্নবিত্ত হিতকারীতাকেই প্রমাণ করে। আমি শুধু পঞ্চম পয়েন্টটি নিয়েই আলোচনা করতে পারি। এই পয়েন্টের বাস্তব অভিযোগগুলি মিথ্যা নয় আবার সত্যও নয়। ট্রপিকালে অন্তত দশ-পনেরোটি বড় ফ্লেক্সে বড় বড় হরফে পরিষ্কার লেখা আছে যে “এই হাসপাতালের প্রতিটি পরিষেবা এমনকি ওষুধ পর্যন্ত বিনামূল্যে দেওয়া হয়। কেউ যদি কারও কাছে টাকা চায় তবে তা অবিলম্বে কর্তৃপক্ষের নজরে আনুন।” কেউ আনে না। কেননা আমরা অনৈতিক এবং আইন-বহির্ভূত সুবিধে নেবার জন্য লালায়িত।  সবাই যা পায় আমি তার চাইতে বেশী চাই। সন্ধ্যে ছয়টা অবধি ভিজিটিং আওয়ার্স হ’লে, আমি সাতটার সময় গেটকিপারের হাতে ত্রিশ টাকা গুঁজে দিয়ে ঢুকে পড়ি। অ্যাটেনডেন্টের হাতে এক দেড়শো টাকা ধরিয়ে আমি সার্বজনীনতার বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করি। আমি দুই টাকার টিকিটে লাইন না দিয়ে মাত্র পঞ্চাশ টাকা খরচ করে সবার আগে নিজের ঢুকে পড়ার ব্যবস্থা পাকা করি। দুটো ভিজিটিং কার্ডে চারজন একসঙ্গে না ঢুকলে আমার তৃপ্তি হয় না। সবাই যা যা পায় না, আমাকে তাই পেতে হবে। আমার পেশেন্ট যতই ভীড় হোক না কেন, মেঝেতে বা স্ট্রেচারে শোবেনা, বেড চাই। তাই আমি বকশিস দিই (আসলে ঘুষ দিই), তারপর বলি টাকা ছাড়া এদের নড়ানো যায় না। মেদিনীপুরের সেই ডার্মাটোলজির পেশেন্ট বা ঝাড়খণ্ডের টিবি রোগী ট্রাক ড্রাইভারের কাছে এরা তো টাকা চায় না। এরা টাকা চায় এবং আমরা টাকা দিই এর মধ্যে কোনটা আগে? ডিম আগে, না মুরগী আগে?
বাকী রইলো অপরিচ্ছন্ন ঘর আর অব্যবহারযোগ্য টয়লেটের গল্প। তো মিশন নির্মল বাংলা, আর স্বচ্ছ ভারত অভিযানে তো কোটি কোটি টাকা উড়ছে।  শুধু শৌচাগার বানানোর ক্যাম্পেন করতে। যাদের বাড়িতে শৌচাগারই নেই, তারা আপার-স্ট্রাটার ক্লিন টয়লেট ইউসেজটা শিখবে কোত্থেকে। আর ঠিকঠাক টয়লেট ব্যবহার করতে পারেনা বলে গ্রাম্য পেশেন্টকে রাস্তায় শুইয়ে মেরে ফেলাটাও সামাজিকভাবে রিস্কি হয়ে যায়। ফলে দুটো সমান্তরাল ট্র্যাক কোনওদিনই মিলে যাবে না। এমনই চলতে থাকবে।
চতুর্থ কিস্তি
এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন, আমার অসুস্থতাটা কী ছিল ? আমার দশ বছরের সিরোসিস অব লিভার। ক্রিপ্টোজেনিক, মানে অজানা কারণে। ডক্টর অশোকানন্দ কোনার, ডাঃ অভিজিৎ চৌধুরী, ডাঃ সুজিত চৌধুরী হয়ে বর্তমানে ডাঃ কৌশিক দাশের আণ্ডারে চিকিৎসাধীন। তিন বার ভ্যারিসিয়াল ব্লিডিং হয়েছে, একবার রক্তবমি, দুবার ম্যালিনা। আঠারোটা ব্যাণ্ডিং, তিনবার অ্যাসাইটিস নিয়ে দিব্য বেঁচে ছিলাম। আলুনি জীবন ছাড়া কোনও সমস্যা ছিল না। এবারে সমস্যা হলো।
প্রথমে কপালে চিনচিনে ব্যথা। সবাই বল্লো চোখ দেখা। পাওয়ার পাল্টানো হলো, কিছুই হলো না। এরই মধ্যে এক শুভসন্ধ্যায় নাক থেকে রক্ত বেরুতে শুরু করলো। এর আগে বেসিন ভর্তি রক্তবমি করেও যে ভয় হয়নি এবার হলো। প্রথমে ভাবলাম ব্রেন টিউমার। তবু রিক্স নিয়ে গেলাম চেনা ই এন টি কল্লোল দাশের কাছে। তিনি বল্লেন ও কিছু নয়, কমে যাবে। কমে গেলও ব্লিডিং, কিন্তু বাকী সব যে কে সেই। আমার বন্ধু এবং সহকর্মী অসীম আর মৃণাল বল্লো নিউরো দেখাও। দুজনেই বল্লো সন্দীপ পাল। তো গেলাম সন্দীপ পালের কাছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পরীক্ষা করে তিনি বল্লেন এটা নিউরোর কেসই নয়। আপনি ই এন টির কাছে যান। আগে যে ই.এন.টি-র কাছে গেছিলাম, বল্লাম। তিনি বল্লেন তাহলে আগে গ্লোকোমার পসিবিলিটি এক্সক্লুড করুন। গেলাম সি এম আর আই এর ডাঃ দেবাশিস চক্রবর্তীর কাছে। তিনি বল্লেন দু চোখেই গ্লোকোমা, কিন্তু মাথার ব্যথা তার জন্য কিনা বলতে পারি না। লেজার ট্রিটমেন্ট হলো, কিন্তু ব্যথা কমলো না। সন্দীপ পাল তবুও বলে চলেছেন আমি বলছি এটা নিউরো নয়। তবু যখন আপনাদের সন্দেহ যাচ্ছে না একটা ব্রেন স্ক্যান করে নিন।
কোয়াড্রা থেকে স্ক্যান রিপোর্টে প্রথম জানা গেল ব্রেন ক্লিন, কিন্তু লেফট স্ফেনয়েড রিজিয়নে ইনফেকশন এবং ইরোশন। সন্দীপ পাল বল্লেন আবার ই এন টি র কাছে যান। আবার ছুটলাম কল্লোলদার কাছে। তিনি রিপোর্ট দেখে খুবই বিরক্ত হলেন এবং বল্লেন ব্রেন সিটি স্ক্যান করে এসব বোঝাই সম্ভব নয়। আমি বলছি সাইনাসে কিছু হয়নি। তাহলে কী জন্য এই অসহ্য ব্যথা। তিনি বল্লেন এটাকে বলে প্যানিক হেডেক। বলে দু একটা অ্যান্টি ডিপ্রেশন আর ট্র্যাঙ্কুলাইজার দিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে মাস চারেক কেটে গেছে। ব্যথা উত্তরোত্তর বাড়তে বাড়তে রাতে ঘুমানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশে ইন্দ্রাণী আর বিহানও জেগে বসে থাকছে রাতের পর রাত। মাথায় কখনও গরম জল কখনও ঠাণ্ডা জল ঢালছে, কেননা কেউই জানেনা কী করিতে হইবে। আমার মাথা ভর্তি কালো কোঁকড়ানো চুল ছেঁটে ফেলতে হলো ভোলিনি স্প্রে করার জন্য। মাত্র দেড় মাসে চুলে পাক ধরে গেল। দিনের পর দিন নিজস্ব প্রসক্রিপশনে দিনে একটা, দুটো, তিন-চার-পাঁচ-ছয় করে প্যারাসিটামলের ডোজ বাড়িয়েই চলেছি। যা কিনা আমার লিভারের জন্য নিষিদ্ধ।
আর তারপরই হঠাৎ এক সুপ্রভাতে আবিষ্কার করলাম বাঁ চোখে সামনের কিছু দেখছি না। অদ্ভূত অপার্থিব ক্যালাইডোস্কোপের মত চেঞ্জিং প্যাটার্ন যা ভাল করে দেখতে গেলেই মিলিয়ে যায়, অন্য প্যাটার্ন চলে আসে। ডান চোখ হাত দিয়ে ঢেকে দিলেই বিশ্বময় শুধুই যেন কোনও বিচিত্র ক্রাফটসম্যানের নিপুণ দক্ষতায় আঁকা আল্পনা। আমি আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমার শরীর বলতে তখন শুধুই মাথা ভর্তি আল্পনা আর যন্ত্রণা। পাপু (ভাস্কর) আর দেরী না করে ছুটলো কৌশিকের কাছে। ডক্টর কৌশিক দাশ, পিজির হেপাটোলজিস্ট, অল্পবয়সী ছেলে, যিনি আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন সিরোসিসের হাত থেকে। চোখের বিষয়টি শুনে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন নিউরোলজিস্ট বিমান রায়-কে। গোটা বিষয়টা বললেন। অ্যাডভান্সড নন-কমপেনসেটেড সি-এল-ডি, তাই জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া করা রিস্কি, এটাও বললেন। পরদিন পিজিতে দীর্ঘ লাইন দিয়ে বিমানবাবুর কাছে পৌঁছানো গেল। তিনি সেই ব্রেন স্ক্যান প্লেট দেখেই বল্লেন এটা নিউরো কেস নয়। আপনারা ই-এন-টির কাছে যান। বলেই পীযূষ রায়কে ফোন করলেন। বল্লেন আমাদের হেপাটোলজির কৌশিক একজনকে পাঠিয়েছে, তাকে আমি তোমার কাছে রেফার করছি। আবার লাইন। নতুন টিকিট। অনন্ত প্রতীক্ষা। অবশেষে তিনি এলেন।
পীযূষ রায় পিজির সিনিয়ার ই-এন-টি। আমার থেকে খুব বড় হবেন না । কিন্তু প্রায় সবাইকে তুই তুমি করে কথা বলেন। ঘর ভর্তি পেশেন্ট বা তার আত্মীয়স্বজন। তাদের সামনেই চিৎকার করে আমার কেস হিস্ট্রি পড়লেন। খুব বিরক্ত লাগছিল। এবার বললেন,  “জিভ বার করো। করে ঈঈঈঈঈঈঈ বলো।” এ তো মহা সমস্যা। ঈঈঈঈঈঈঈঈ করতে গেলেই জিভ ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। দু তিন বার চেষ্টার পরেই তিনি অধৈর্য হয়ে পড়লেন। টেবিল থেকে একটা কাঁচের বাটিতে রাখা দু টুকরো গজ তুলে নিলেন।তারপর বল্লেন “এবার তুই জিভ বার কর আর ঈঈঈঈঈঈঈঈ বল।” হঠাৎ করে তুই তে নেমে যাওয়ায় আমি জিভ বার করলাম বটে কিন্তু কোনও শব্দই বেরুলো না। তিনি এবার অদ্ভূত দক্ষতায় খপ করে বাঁ হাতে আমার ভ্যাংচানো জিভ চেপে বল্লেন “বল ঈঈঈঈঈঈঈঈঈ, নৈলে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।” এতক্ষণে আমার গলা দিয়ে ঈঈঈঈঈঈঈ বেরুলো। ডান হাতে একটা টর্চ নিয়ে তিনি দেখলেন এবং বললেন “লেফট স্ফেনয়েডে যে মাস টা আছে সেটাকে অপারেট করতে হবে, তারপর সেটার বায়াপ্সি হবে, বায়াপ্সি বোঝো তো, ক্যানসার হয়েছে কিনা দেখবে। স্যাম্পল নিয়ে রায়-ত্রিবেদী যাবে। ওখানে ভাল করে। সেটার রিপোর্ট দেখে তারপর চিকিৎসা শুরু হবে। তবে একটু সময় লাগবে। নিউরোলজিস্ট থাকবে, হেপাটোলজিস্ট থাকবে, অ্যানেসথেসিস্ট থাকবে আর আমি থাকবো অপারেট করে মাস টাকে বার করার জন্য। ভর্তি থাকতে হবে, আমি বিমানের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।”
বেরোনোর সময়ই সিদ্ধান্ত নিলাম অপারেশন করাতে হলে বাড়ির পাশে কল্লোলদার কাছেই করাবো। আর ম্যালিগনেনসি থাকলে কিচ্ছু করাবো না, দিব্য রোদে পিঠ দিয়ে বসে বিক্রমের গান শুনে, টিউবে আমাদের যুগের কিছু গান শুনে কাটিয়ে দেবো। আমার বন্ধু মৃণাল আদতে ক্যামেরাম্যান, কিন্তু চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোনও বিষয় ওর কাছে বেশী আকর্ষণীয়। আমার এই মাথা ব্যথা বিষয়টা ওই ডিল করেছে। বাকী তিনজন ইন্দ্রাণী, সুবর্ণা আর ভাস্কর (পাপু) তো বাড়ির লোক। তো মৃণাল ফোন করলো অগতির গতি সন্দীপ পালকে। তিনি তখন গাড়িতে। খানিকটা শুনেই বললেন “আমার কাছ কী চাইছেন?” মৃণাল বল্লো “একজন ভালো ই.এন.টি সার্জন।” বললেন “ফোনটা হোল্ড করুন।” তারপর নিজেই ফোন-ব্যাক করলেন,  “আজ রাতে কাঁকুড়গাছিতে ডক্টর ইন্দ্রনাথ কুণ্ডুর কাছে চলে যান। আমি কথা বলে নিয়েছি।” গেলাম। প্লেট দেখলেন এবং বল্লেন এটা ফাঙ্গাল ইনফেকশান। একটা উলবোনার কাঁটার মত কিছু নাকের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে, মনিটর দেখিয়ে, বললেন “এই দেখুন ফাঙ্গাস নাক অবধি নেমে এসেছে। অপারেট করতে হবে।” তারপর যা বললেন হুবহু ডাঃ পীযূষ রায়ের কথা। কিন্তু সফিস্টিকেটেড ভাষায়। মিনমিন করে বল্লাম “ডাক্তারবাবু কোথায় করবেন অপারেশনটা?” তিনি বল্লেন “ড্যাফোডিলে।” আমি ভেবেছিলাম আর.জি.কর বলবেন, কেননা তিনি ওখানকারই ডাক্তার। প্রশ্ন করলাম “আমার একলাখ টাকার মেডিক্লেইম আছে তার মধ্যে হবে তো?” তিনি গম্ভীর মুখে বল্লেন “হয়ে তো যাওয়া উচিৎ। তবু একটা এম.আর.আই করিয়ে নিন ব্রেনের।”ব্রেন স্ক্যান করতে আমি খুবই উৎসাহী কারণ প্রতিবারেই মনে পড়ে ছোটবেলায় শোনা গল্প আইনস্টাইনের ডাবল ব্রেন ছিল। প্রতিবারেই মনে হয় আমার রিপোর্টে এমনই কিছু বেরুবে। শুধু ফাঙ্গাল ইনফেকশানের রিপোর্ট বেরোয়। এবারো তাই বেরুলো।
যেহেতু আমি সি.এল.ডি পেশেন্ট, খেলাটা সহজ হয়ে গেল। জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া করা যাবে না, তাই স্পেশাল অ্যানেসথেসিস্ট ডাকতে হবে, ড্যাফোডিলে করা যাবে না, অ্যাপোলো গ্লেনঈগলস এ করতে হবে, হেপাটোলজিস্ট ছাড়া করা যাবে না, তার জন্য মহেশ গোয়েঙ্কার আণ্ডারে অ্যাডমিশান নিতে হবে….গোটাটা তখন হাতের বাইরে। আমি দশ বছরের সিরোসিস পেশেন্ট। কিন্তু আমি সিরোসিস পেশেন্ট কিনা জানতে, আমার ফাইব্রোস্ক্যান থেকে শুরু করে এণ্ডোস্কোপি, এমনকি এ.এফ.পি (লিভার ক্যানসার হলো কিনা জানতে), পি-টাইম, কমপ্লিট হেমোগ্রাম, এল.এফ.টি সব করে আবিষ্কার করা হলো যে আমি একজন সিরোসিস পেশেন্ট। তবে অপারেশন করা যাবে। আমাদের বরাকে চালু কথা ছিল হারাইয়া, মারাইয়া, কাশ্যপ গোত্র। এও তাই দাঁড়ালো,শুধু একলাখের এস্টিমেশানটা চড়াং করে দু লাখ হয়ে গেল। বায়াপ্সি রিপোর্ট বেরুলো ফাঙ্গাল ইনফেকশান…নো ম্যালিগন্যান্সি। বাকী রইলো ফাঙ্গাসের চরিত্র নির্ধারণ। সেটা একমাসের আগে কিছুতেই জানা যাবেনা। এদিকে মাথাব্যথা বেড়ে গেল টেন ফোল্ডস, বাঁ চোখে নেমে এলো সম্পূর্ণ আঁধার, আর ডান চোখ ঝাপসা, যেন হারাঙ্গাজাও এর কুয়াশা ঝরছে। সন্দীপ পাল সব রিপোর্ট দেখলেন, আমাকে আবারও দেখলেন এবং বললেন “এখনও ফাঙ্গাসের ট্রিটমেন্ট শুরু হয়নি?  দুটো অ্যান্টিবায়োটিক তো আমিই দিতে পারতাম। কিন্তু ফাঙ্গাসের চিকিৎসা আলাদা। ইমিডিয়েটলি এমন কারও কাছে যান যিনি ফাঙ্গাসের চিকিৎসা করেন এবং মনে রাখবেন এ চিকিৎসা কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী।” কার কাছে যাবো? এমন কাউকে তো চিনিই না । তখনই উঠে এলো ডক্টর বিভূতি সাহার নাম। এই মুহূর্তে এই বিষয়ে কোলকাতায় যাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই।
ডক্টর বিভুতি সাহা সব শুনে বললেন “কালই গিয়ে অ্যাপোলো থেকে বায়াপ্সির স্লাইড গুলো চেয়ে এনে রায়-ত্রিবেদীতে রিভিউএর জন্য জমা দিন।” “কিন্তু …” “কালই জমা দিয়ে দিন।” ডাক্তার সাহা কম কথার মানুষ। ঠিক দুদিন পর রায়-ত্রিবেদি রিপোর্ট দিল ফাঙ্গাসের নাম অ্যাসপারজিলোসিস। ভর্তি হলাম কারমাইকেল স্কুল অব ট্রপিকাল ডিজিসেস। আর উপায়ান্তরও ছিল না। অ্যাপোলো সব টাকা খেয়ে নিল যে। অ্যাসপারজিলোসিস এর চিকিৎসার দুটো মাত্র পদ্ধতি। এক ইন্টারভেনাস লাইপোজোমাল এফ-বি, আর একটা ভোরিকনোজল। যেহেতু আমি লিভারের পেশেন্ট, ঠিক হলো যে লাইপোজোমাল দেওয়া হবে।
কাজ হলো মিরাকলের মত। গত আট মাসের মধ্যে আমি প্রথম অনুভব করলাম মাথা ব্যথা ছাড়াও মানুষের ঘুম হয়। যে ঘুমের ওষুধ এবং এনার্জী বুস্ট‌-আপের ওষুধ এতদিন কাজ করে নি তারাও কাজ করতে শুরু করেছে। আমার নষ্ট চোখের চিকিৎসার জন্য ট্রপিকাল থেকেই পাঠানো হচ্ছিলো মেডিকাল কলেজের আর.আই.ও (রিজিওনাল ইনসটিটিউট অব অপথালমোলজি)তে। প্রথম দু তিন দিন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, তারপর একদিন ভর দুপুরে আবিষ্কার করলাম আলো ক্রমে আসিতেছে।
তবু অসুখ সারলো না। লাইপোজোমাল দেবার সঙ্গে সঙ্গে চড়চড় করে ক্রিয়েটিনিন .৮৭ থেকে বেড়ে ৩.৫ হয়ে যাচ্ছিল। পনেরোটা ভাইলের জায়গায় আটটার বেশী দেওয়া গেলনা। অতএব শুয়ে থাকা ছাড়া কোনও কাজ নেই। চোখে দেখিনা। লেখা পড়া দুটোই গেছে। বড়দিনে সান্টা ক্লজ এসে ঘুরে যাবে, আমায় পাবেনা। বিহান পুপে তরী-কে দেখি না মাস খানেক হতে চললো। আমার বাড়ি, আমার বই, আমার ল্যাপটপ ছুঁয়ে দেখিনা কতকাল হয়ে গেল। শুধু সারা দিন, সারা রাত, জল খাও, ওষুধ খাও, খাবার খাও, ঘুমাও। কেননা ক্রিয়েটিনিন কমছে না বলে ইন্টারভেনাস দেওয়া যাচ্ছে না। অন্য যে ওষুধটা দেওয়া যেতে পারতো ভোরিকোনাজল, সেটাও সিরোসিস পেশেন্টের লিভার অ্যাফেক্টেড হয়ে যেতে পারে ভয়ে দিতে পারছে না।
সেদিন ডক্টর সাহা আসতেই বল্লাম “আমি একটু দেখতে পারছি।” তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। বল্লেন “কোন চোখে ? যেটায় কিচ্ছু দেখতে পান না ? সেদিন যে বল্লেন টর্চের আলোও দেখতে পাচ্ছেন না ?” “আজ মনে হচ্ছে পাবো।” ডানচোখ চেপে বন্ধ করে প্রথমে একটু দেখতে পেলাম মোবাইল টর্চের আলো। আলোটা নড়ছে। দ্বিতীয় পরীক্ষার দিনে, চোখের সামনে কিছু একটা ধরলেন, বল্লেন “রংটা বলুন।” বল্লাম “সম্ভবত নীল।” প্রতিটি পরীক্ষার পর একটা হুইল চেয়ার চাপিয়ে নিয়ে যেতো আমাদের দিনের অ্যাটেনডেন্ট রাওদা…. আর.আই.ও তে। শেষ দিন ডক্টর সাহা যখন ঢুকেছেন খেয়াল করিনি। ভোরিকোনাজল চালু হয়ে গেছে। লোডিং ডোজ দেওয়া হয়েছে তিন দিন আগে। বাঁ চোখ ঠিক হয়নি, চেষ্টা করছি, এমন সময় সদলবলে তাঁদের প্রবেশ। ডক্টর সাহা বললেন অবাক হয়ে, “বই পড়তে পারছেন ?” আমি বল্লাম “অসুবিধা হচ্ছে, কিন্তু চেষ্টা করছি।” “ঠিক আছে শুয়ে পড়ুন।” সব দেখলেন, মাথা ব্যাথা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। বল্লাম “করছে না।” এবার চোখ। সেই ডান হাত দিয়ে ভাল চোখ চেপে ধরে বল্লেন “চেনা কাউকে দেখতে পাচ্ছেন?” বল্লাম “ঐতো ইন্দ্রাণী।” “ভাল করে তাকিয়ে দেখুন।” দেখলাম যেখানে ইন্দ্রাণী দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে নেই। তবে কি অন্য কোথাও দাঁড়ালো। লুকোচুরি। দেখলাম ডাক্তারের পিছন থেকে ইন্দ্রাণীর শাড়ী। বল্লাম “আপনার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।” শিশুর মত হাততালি দিয়ে উঠলো সব ডাক্তারেরা। আমি বল্লাম “ঠিক বলতে পেরেছি?” ডক্টর সাহাও উচ্ছ্বসিত, কিন্তু সংযত। বল্লেন “ইমপ্রুভ তো করেইছে দেখা যাচ্ছে।” আমি বল্লাম “তবে আমাকে ছেড়ে দিন, আর ভাল্লাগছে না হাসপাতালে থাকতে।” গভীর আলোচনায় নিমগ্ন হলেন ডাক্তাররা। শেষপর্যন্ত ঠিক হলো শনিবার ছেড়ে দেওয়া হবে। আর ভোরিকোনাজলের মত দামি ওষুধ? কিন্তু সরকারী কর্তৃ‌পক্ষ সহায়। ঠিক হলো দশ দিনের ওষুধ দিয়ে দেওয়া হবে। তারপর? তারপর আমরা দেখছি কী করা যায়। অবশেষে শনিবার। আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে…..
ফিরে আসার পর থেকে এখনও অ্যাসপারজিলেসিস আমায় ছেড়ে গেছে কিনা বলা যাচ্ছে না। ভোরিকোনাজল খুব কম ডোজে খেতে হচ্ছে। তাতেই সারা শরীর সানবার্ন হয়ে যাওয়া আটকানো যায়নি। বাঁ চোখে দেখতে পাচ্ছি বটে কিন্তু দু চোখে দু রকমের ভিশন, ডাবল ইমেজ দেখছি। পড়তে লিখতে অসুবিধা তো হচ্ছেই। হাত পা গুলো ল্যাগব্যাগ করছে, দু দিন সিঁড়িতে স্টেপ মিস হয়ে পড়েও গেলাম। কিন্তু লাস্ট ল্যাপ যত এগিয়ে আসছে উত্তেজনা বাড়ছে।
পঞ্চম কিস্তি
 ট্রপিকাল থেকে ছাড়া পেয়েছি প্রায় দু’মাস। এখনও দুই সপ্তাহান্তে একবার যেতে হয় হাসপাতালের আউটডোরে। লাইন দিতে হয়। টিকিট কাটতে হয়। অপেক্ষায় থাকতে হয়, কখন খিটখিটে দিদিটা নাম ধরে ডাকবে। কোন ডাক্তার যে দেখবে, ভগা জানে। কমবয়সী ডাক্তারগুলো হেসে কথা বলে, আমার সঙ্গে নয়, সবার সঙ্গে। মৃদু কথা বলে। কেন? এখনও তালেবর হ’য়ে ওঠেনি তাই ? আমাকে ওরা পরীক্ষা করে, তারপর বসিয়ে রাখে ডাক্তার সাহার জন্য। তিনি এলে আবার পরীক্ষা করেন। ওষুধ লিখে দেন। সে ওষুধের জন্য ফার্মাসীতে দীর্ঘ লাইন দিতে হয়। তারপর উইণ্ডোতে পৌঁছালে ভোরিকোনাজল আছে কি না সেটা দেখতে স্টোরে পাঠানো হয়। থাকলে পেয়ে যাই। নৈলে পরদিন লাইন। একদিন তো অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে যাবার মুখে ডাক্তার সাহার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। “দাঁড়ান, দাঁড়ান, কোথায় যাচ্ছেন?” বলে রাস্তার পাশে একটা হাফ ওয়ালে বসেই পেট টিপে, স্টেথো লাগিয়ে, অজস্র প্রশ্ন করে তবে ছাড়লেন। লাইনে দাঁড়ানো অসংখ্য রুগী সাক্ষী রইলেন এই অপূর্ব চিকিৎসার।
আর.আই.ও তে অবশ্য এতটা স্মুথনেস নেই। লাইন অনেক বেশী দীর্ঘ। এক একটা ডাক্তার আউটডোরে একশোর বেশী রুগী দেখছেন। তিতিবিরক্ত। কথা বল্লেই খেঁকিয়ে উঠছেন। এখানে দারিদ্র আরও বেশী। টেস্ট এবং অপারেশন আরও বেশী। দরিদ্র মুসলিম এর সংখ্যা বেশী। অ-চিকিৎসক কর্মীদের দাপট বেশী। চিৎকার চেঁচামেচি বেশী। কিন্তু সবটাই বিনামূল্যে। তিনটে টেস্টের জন্য তিন দিন সময় নিতে হলো। যেটা শংকর নেত্রালয়ে দশ ঘন্টায় হয়ে গেছিল। অবশ্য তার জন্য দক্ষিণা দিতে হয়েছিল প্রায় দু হাজার টাকা। এখানে সর্বসাকুল্যে খরচ দু’টাকা।
সমস্যা হলো অন্যত্র। আমার স্বজনেরা ছাড়া কেউ মন থেকে বিশ্বাস করতে চাইছে না, যে মেনে নিতে পারলে এবং উপায়ান্তর না থাকলে সরকারী হাসপাতালেও ভালই চিকিৎসা হয়, সুস্থও হয়। মানুষ কি গাণ্ডু না কি যে দু’টাকায় একটা বেটার চিকিৎসার এনভায়রনমেন্ট ছেড়ে দু লক্ষ বা কুড়ি লক্ষ টাকার ইনফিরিয়র চিকিৎসার এনভায়রনমেন্ট এর পিছনে দৌড়োবে? উপায়ান্তর না থাকলেই লোকে বেসরকারী তে যায়। এদের চেষ্টা করেও বোঝাতে পারিনি যে চিকিৎসার এনভায়রনমেন্ট আর চিকিৎসা এক নয়।
বেসরকারী হাসপাতাল চিকিৎসার এনভায়রনমেন্ট-এর যোগান দেয় ঠিকই, কিন্তু তার জন্য গুনে গুনে মূল্য নেয়। রুগীদের কাছ থেকে সে মূল্য আদায় করতে পারলে, বা করলে,সরকারী হাসপাতালেও বেসরকারী চিকিৎসার এনভায়রনমেন্ট যোগান দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তাতে দারিদ্রসীমার নীচের মানুষদের কী হবে? নিম্নমধ্যবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্তদেরই বা কী হবে?
“আসলে তোর চারপাশে তো একটা ইন্টেলেকচুয়াল অরা আছে, যাতে ঘাবড়ে গিয়ে সরকারী হাসপাতালের মূর্খগুলো স্পেশাল কেয়ার নিয়ে ফেলে। তোর জায়গায় আমি হলে গুনে মূল্য নিতো। প্লাস শুনেছে তোর সরকারী মহলে যোগাযোগ আছে, তোর ছবি দিয়ে প্রগ্রেস রিপোর্ট আনন্দবাজারে ছাপা হয়, ফলে তোকে শুধু প্রদীপের আলোটুকু দেখানো হয়, আমাদের জন্য পড়ে থাকে শুধু অন্ধকার।” এসব কথা বিভ্রান্ত করে দেয়, ভাবি সত্যি তো, একটা যুক্তিবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, নিজের ঘটিবাটি বিক্রি করার জন্য বেসরকারী হাসপাতালে যাবে কেন? আমি এতদিন যেতাম কেন ? যায় যদি যাক প্রাণ, কর্পোরেট সেক্টরের ডাক্তার ভগবান…বলে ঝাঁপিয়েছি কেন ? যখন আমি এটাও জানতাম এই সরকারী হাসপাতাল আমার… আমারও করের টাকায় এর চলন। ভাবি আর লিখে রাখি। দেখতে দেখতে সেটা এক তুলনামূলক সারণীর রূপ নেয়। সংখ্যাতত্ব কন্টকিত সমীক্ষা-সারণী নয়, আমার বোধগম্যতার জন্য নেহাৎই দশটি পয়েন্টের একটা তুলনা ও প্রতিতুলনা।

ক্রমিক সংখ্যা সরকারী হাসপাতাল বেসরকারী হাসপাতাল
১. সরকারী হাসপাতাল মূলতঃ সেবা মূলক প্রতিষ্ঠান। চলে সরকারী অনুদানে। অর্থাৎ জনগণেরই করের টাকায় চলে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার, বাজেট, থেকে শুরু করে ডাক্তারদের ফিজ, ওষুধ সবই করের টাকায়।পরিচালনও তাই। স্বাস্থ্যদপ্তরের।
 
বেসরকারী হাসপাতাল আসলে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যার মালিক আছে, অথবা মালিকপক্ষ আছে। প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় তাদের দ্বারা এবং তাদেরই অর্থানুকূল্যে চলে। ফলতঃ তাদের মুনাফাই প্রথম এবং শেষ কথা।
২. সরকারী হাসপাতালের পরিষেবা বেশীরভাগ সময়েই হয় বিনামূল্যে নয়তো স্বল্পমূল্যে দেওয়া হয়। বেসরকারী হাসপাতাল এর খরচ তুলনামূলক ভাবে সরকারী হাসপাতালের চাইতে বহুগুণ বেশী।
৩. সরকারী হাসপাতালে বিরক্তিকর দীর্ঘ লাইন। এমনকি ইউ.এস.জি, এক্স-রে, স্ক্যান বা অন্য কোনও পরীক্ষার জন্য ডেট নিতে বহু সময় ব্যয় হয়। বেসরকারী হাসপাতালে টাকা বেশী থাকলেই সব সমস্যার সমাধান। দীর্ঘ ক্লান্তিকর অপেক্ষার ঝক্কি নেই। ঝটাঝট পরীক্ষা, ফটাফট টাকা। টাকা থাকলে ঝক্কি শূন্য।
৪. সরকারী হাসপাতালে যদিও দামী ও আধুনিক যন্ত্রাদির কোনও অপ্রতুলতা নেই, কিন্তু প্রচুর ব্যবহার ও যত্নহীন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলি প্রায়শঃই বিকল হয়ে থাকে। নিজস্ব অভিজ্ঞতার জন্যই ডাক্তারেরা প্রায়শঃই অধুনা বিলুপ্তপ্রায় ক্লিনিকাল আই এর ওপর নির্ভর করেন।
 
বেসরকারী হাসপাতালে দামী এবং আধুনিকতম যন্ত্রাদির বহুল ব্যবহার, এবং কেয়ারফুল ব্যবহারের জন্য সেগুলির আয়ুও অনেক বেশী। নিত্য নতুন যন্ত্র আর নিত্য নতুন খরচ। রুগীদের মধ্যেও ধারণা হচ্ছে যত দামী যন্ত্র, তত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা। নো রিস্কি ট্রিটমেন্ট।
৫. যেহেতু দরিদ্রতম রুগীর সংখ্যাই সরকারী হাসপাতালে বেশী, ফলতঃ বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য প্রচুর পরিমান রুগীর চিকিৎসায় ডাক্তার যথেষ্ট মনোযাগ দিতে পারেন না। ডাক্তার নিজেই রুগী দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। রুগী প্রতি ডাক্তারের সংখ্যা অনেক কম।
 
যেহেতু উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত রুগীর সংখ্যাই বেসরকারী হাসপাতালে বেশী, তাই রুগী প্রতি ডাক্তারের সংখ্যাও বেশী। প্রচুর অর্থব্যয়ের ক্ষমতা সম্পন্ন রুগীর প্রতি ডাক্তারের মনোযোগ বেশী হবার কথা। যদিও প্রফিট মোটিভেশান প্রায়শঃই কদাকার রূপ ধারণ করে।
৬. সরকারী হাসপাতালে ডাক্তারদের মধ্যে নন-প্রফিটেবল ডায়গোনিস্টিক টেস্ট করানোর প্রবণতা কম। এর প্রভাব পড়ে ডায়গোনিস্টিক সেন্টারের কর্মীদের ওপর। যদিও বিরল প্রজাতির কিছু ডাক্তার যারা চিকিৎসাকে এখনও সেবা বলে গণ্য করেন তারা বাইরে কিছু নির্দিষ্ট ল্যাব থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনতে বলেন।
 
যেহেতু বেশীর ভাগ বেসরকারী হাসপাতালের নিজস্ব ডায়গোনিস্টিক সেন্টার রয়েছে, ফলে ডাক্তারের মধ্যেও অকারণে বিভিন্ন টেস্ট লিখে দেওয়ার তাগিদটা বেড়ে যায়। ওপর মহলের (একজন সি.ই.ও-র মাসিক আয় ১৪-১৫ লক্ষ টাকা) চাপও থাকে। যে বিপুল পরিমাণ অর্থ এই ডাক্তাররা পান, তা কড়ায় গণ্ডায় উসুল করে নেবার চাপ ।
৭. স্বাস্থ্যখাতে সরকারের যে বাজেট, তার ধারেকাছে পোঁছাতে পারেনা বেসরকারী হাসপাতালের সম্মিলিত বাজেট। তবু যে তারা ভাল সার্ভিস দিতে পারেনা সে গলদের কারণ লুকিয়ে আছে সরকারী সিস্টেমে। ফলে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে নয়, নানাবিধ অ-চিকিৎসা পরিষেবা বিষয়ে ভোগান্তির কারণেই মধ্যবিত্ত মানুষ সরকারী হাসপাতাল এড়িয়ে চলে। জেলা স্থাস্থ্যকেন্দ্র গুলির অবস্থা আরও খারাপ।
 
আমাদের দেশে চিকিৎসা হচ্ছে সবচাইতে লুক্রেটিভ ব্যবসা। ফলতঃ ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে বেসরকারী হাসপাতাল আর মাঝারী মানের নার্সিং হোম। যেখানে অতি উন্নত মানের অ-চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানেই বেসরকারী হাসপাতাল খদ্দের টানে। সরকারী ডাক্তাররা বেসরকারী হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, ফলে প্রাইভেট আর সরকারী চিকিৎসায় প্রায় কোনও পার্থক্যই নেই।
৮. সরকারী হাসপাতালে এই সবটাই বিনামূল্যে, যদি না কোনও বিশেষ ডায়গোনিস্টিক টেস্ট বাইরে কিংবা হাসপাতালেরই পিপিপি সেন্টারে করতে হয়। ওষুধের ক্ষেত্রেও তাই। বহুমূল্যবান ওষুধের ক্ষেত্রে ন্যায্যমূল্য অথবা বিনামূল্যে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ডাক্তারদের মধ্যে সরকারী হাসপাতালের রুগী ভাঙ্গিয়ে বেসরকারীতে নিয়ে যাবার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। কেননা রুগীভিত্তিক কোটা পূরণ এইসব ডাক্তারদের কাছে বাধ্যতামূলক।
 
বেসরকারী হাসপাতালে সামান্য রোগের জন্য কোনও স্পেশালিস্ট ডাক্তার (আজকাল অবশ্য সব ডাক্তারই স্পেশালিস্ট) এর কাছে গেলে দিনে খরচ হয় কনসাল্টেশন ফিজ বাবদ ৫০০ টাকা, পরীক্ষা নিরীক্ষা বাবদ ১০০০ টাকা আর ওষুধ বাবদ ৩০০ টাকা অর্থাৎ কমপক্ষে ১৮০০ টাকা। খদ্দেরের জটিল অপারেশন বা খরচসাপেক্ষ চিকিৎসার জন্য ডাক্তাররা এঁদের সরকারী হাসপাতালের সুবিধাও পাইয়ে দিয়ে থাকেন।
৯. সরকারী হাসপাতালে নন-মেডিক্যাল সার্ভিস খুব বাজে। টয়লেট বাজে, জেনারেল হাইজিন খারাপ, গ্রুপ-ডি থেকে শুরু করে মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার দের ব্যবহার খুব খারাপ, ডাক্তারদের হাইহ্যাণ্ডেডনেস ডক্টর-পেশেন্ট রিলেশানশিপ নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দেয়। সরকারী মানেই খারাপ, এটা অনবরত মাথায় প্রবিষ্ট করানো হয়।
 
বেসরকারী হাসপাতাল মূলতঃ বিক্রি করে নন-মেডিক্যাল সার্ভিস। পেশেন্ট আসলে তারই দাম চোকায়। ব্যবসার সিস্টেম মেনে বেসরকারী হাসপাতালগুলি এখন প্রচুর বিজ্ঞাপন করে। যা সরকারী হাসপাতাল করে না, প্রয়োজন নেই বলে। বেসরকারী মানেই ভাল, এ এক ধরণের মগজ ধোলাই এর ফল। বড় একটা চক্র কাজ করে এর পেছনে।
১০. সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রায় সব পরিষেবাই বিনামূল্যে। ফলে কতিপয় কমিটেড ডাক্তার ছাড়া বাকীরাও বিশ্বাস করেন সরকারী ব্যবস্থায় সুচিকিৎসা সম্ভব নয়। প্রথম কারণ এই ডাক্তারী শিক্ষায় প্রবেশমূল্য (ক্যাপিটেশন ফী) বাবদ যা খরচ, অতি দ্রুত তুলে ফেলা একমাত্র বেসরকারীতেই সম্ভব। দ্বিতীয় কারণ বেসরকারীতে অর্থাগমের বিভিন্ন পন্থা উন্মুক্ত থাকে। তৃতীয় কারণ অবশ্যই ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া।
 
বেসরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থার দুটি ক্রম। এক হাসপাতাল দুই প্রাইভেট নার্সিং হোম। প্রাইভেট নার্সিং হোমে ডাক্তাররা (অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা সরকারী ডাক্তারও বটে) ভিজিট নেন কিন্তু রসিদ দেন না। ফলে এই টাকাটা ব্ল্যাক মানি হিসাবেই গণ্য হওয়া উচিৎ। আর হাসপাতালে রসিদ দেওয়া হয়, কিন্তু ডাক্তারের ওপর চাপ থাকে মাসিক একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা রুগীদের কাছ থেকে খিঁচে নেবার জন্য।

ফিরে আসার পর থেকে এখনও অ্যাসপারজিলেসিস আমায় ছেড়ে গেছে কিনা বলা যাচ্ছে না। ভোরিকোনাজল খুব কম ডোজে খেতে হচ্ছে। তাতেই সারা শরীর সানবার্ন হয়ে যাওয়া আটকানো যায়নি। বাঁ চোখে দেখতে পাচ্ছি বটে কিন্তু দু চোখে দু রকমের ভিশন, ডাবল ইমেজ দেখছি। পড়তে লিখতে অসুবিধা তো হচ্ছেই। হাত পা গুলো ল্যাগব্যাগ করছে, দু’দিন সিঁড়িতে স্টেপ মিস হয়ে পড়েও গেলাম। কিন্তু লাস্ট ল্যাপ যত এগিয়ে আসছে, উত্তেজনা বাড়ছে।
এর মধ্যে মমতা ব্যানার্জীর সরকার “পশ্চিমবঙ্গ ক্লিনিকাল এসটাব্লিশমেনেট (নথিভুক্তি, পরিচালন এববং স্বচ্ছতা) বিল,২০১৭” বিধানসভায় প্লেস করেছেন এবং তা পাশও হয়ে গেছে। যেহেতু বিলের অনুপুঙ্খ বর্ণনা ইন্টারনেটে সহজেই পাওয়া যায়, তাই তার আলোচনা বিস্তারে যাচ্ছি না। শুধুমাত্র এইটুকু বলার যে মিডিয়ায় প্রকাশিত বিলের প্রতিটি শব্দ বেসরকারী হাসপাতালগুলির রক্তচোষা চরিত্র এবং অমানুষিক ব্যবহারের স্বরূপ উদ্ঘাটন। পরবর্তী কোনও সময়ে এই বিল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতেই পারে। আজ নয়।

“….তুমি তো প্রহর গোনো /ওরা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি/ তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ/ শূণ্য মাঠে কংকাল করোটি / তোমাকে বিদ্রূপ করে /হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে/ কুজ্ঝটি তোমার চোখে/ তুমি ঘুরে ফেরো দুর্বিপাকে…” সুকান্ত ভট্টাচার্য।

আমার বক্তব্য খুব সহজ। সরকারী হাসপাতাল যদি আমার নিজস্ব হয়, আমার মধ্যে যদি ওনারশিপ ফিলিং থাকে…তবে বেসরকারী নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, আমি/আমরা আমাদের সরকারী হাসপাতালগুলিকে সুস্থ করতে চেষ্টা করিনা কেন ? আমার বিশ্লেষণে আমি আগেই বলেছি, সরকারী হাসপাতালে নন-মেডিক্যাল সার্ভিস খুব বাজে। টয়লেট বাজে, জেনারেল হাইজিন খারাপ, গ্রুপ-ডি থেকে শুরু করে মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার দের ব্যবহার খুব খারাপ, ডাক্তারদের হাইহ্যাণ্ডেডনেস ডক্টর-পেশেন্ট রিলেশানশিপ নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দেয়। সরকারী মানেই খারাপ, মাথায় প্রবিষ্ট এই আতংকের সূত্রগুলোকে যদি পরিবর্তন করা যেতো! বাজেট বৃদ্ধি আর তার সঙ্গে ভাল এবং পর্যাপ্ত নন-মেডিকাল সার্ভিসের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা যেতো, পেশেন্টদের পক্ষ থেকে নিয়মিত ভিজিল্যান্স রাখা, স্বাস্থ্যভবনের সঙ্গে সমস্যাগুলি নিয়ে যোগাযোগ রাখা যেতো, মুমূর্ষূ রুগীকে টয়লেট ইউজ শেখানোয় পণ্ডশ্রম না করে ক্লিনিং স্টাফ, নার্সিং স্টাফ বেশী নিয়োগ করা হতো, তাহলে এভাবেই স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উন্নত করা সম্ভব ছিল। তা না করে বেসরকারী হাসপাতালের কুষ্ঠি গাললে কোন লাভ নেই। আজ বখরা নিয়ে বিরোধ হলে, কাল আমে দুধে মিশও খেয়ে যেতে পারে। আঁটি জনগনের তখন রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়াই ভবিতব্য।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের কাজ। ডিফেন্স আর ল-অ্যাণ্ড-অর্ডারের চাইতে অনেক বেশী জরুরী। বেসরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা জাহান্নামে যাক। আমি দেখেছি সরকারী চিকিৎসায় অসংখ্য প্রতিকূলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগে মাত্র এক মাস। আমার এখন দীর্ঘ লাইন দেখলে গা গুলোয় না। এসি নেই বলে কান্না পায় না, এমনকি বিভিন্নজনের দাঁত খিঁচুনিও গা সওয়া হয়ে গেছে। কেননা দিনের শেষে লাভবান তো আমিই। দু’টাকায় চিকিৎসা। সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তো এভাবেই বেঁচে আছেন।
ষষ্ঠ কিস্তি
কারমাইকেল থেকে ফেরার পরেও দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। প্রতি সপ্তাহে একদিন আর আই ও, অথবা ট্রপিকাল মেডিসিন, বা মেডিকেল কলেজের ই এন টি, ফ্রি ওষুধের ফার্মাসী আর ইমেজিং বিভাগে পাক খেতে খেতে বাড়ি পৌঁছোনোর পর আর দম থাকতো না বাইরে বেরোবার মত। ভাববেন না এর জন্য বেসরকারী হাসপাতালের প্রতি আমার কোনও নাক সিঁটকানো ভাব নেই। বরং এই সেদিনও আমার সত্তর ছুঁই ছুঁই কাকা প্রি-অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকা সত্বেও  ব্লাডারে ম্যালিগন্যান্সি নিয়ে সকাল নটা থেকে সাড়ে তিনটে অব্দি টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারে স্রেফ বসে থাকেন জুনিয়ারের কাছ থেকে এটা শোনার জন্য যে, স্যার বলেছেন আরেকটা ডেট নিয়ে নিতে। একথা সত্যি যে সরকারী হাসপাতালের প্রতিটি লোক একটু খেঁকিয়ে কথা বলেন (কারমাইকেলে যেটা একেবারেই অনুপস্থিত ছিল,  অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে) ঠিকই, কিন্তু ওরকম জনসভার মত মানুষের ঢল, যাদের সত্তর শতাংশ জেলা বা ভিন রাজ্য থেকে আসা, তাদের সামাল দিতে ওটুকু বোধহয় করতেই হয়।
আমি যখন কারমাইকেলে ভর্তি, সে সময় থেকেই বাইরে রুগী চিকিৎসক সম্পর্কে উথালপাথাল হচ্ছে। ডাক্তাররা হেনস্থা হচ্ছেন। হাসপাতালে ভাংচুর হচ্ছে। ডাক্তারেরা সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছেন, প্রচারে নামছেন।  দূরত্ব বাড়ছে। ভুল শত্রু চিহ্নিতকরণ হচ্ছে। ডাক্তাররা রুগীদের আর রুগী (পরিজন সহ) ডাক্তারদের শত্রু ভাবতে শুরু করেছেন। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার কর্তৃপক্ষ (সরকারী বেসরকারী নির্বিশেষে)  এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্লাউট বেমালুম অলক্ষ্যবাসী হয়ে গেল। এটি একটি পলিটিকাল ঘটনা। কিছু সংখ্যক লোভী, অমানবিক, উন্নাসিক, ঈশ্বরম্মন্য, অর্থগৃধ্নু ডাক্তারের জন্য রুগীদের সঙ্গে চিকিৎসকের আবহমানকালের যে সম্পর্কের সুতো ছিঁড়তে বসেছিল, পলিটিকাল প্ল্যানিং সে সুতোটা ছিঁড়েই দিল। রোগী-ডাক্তারের সম্পর্কের মাঝখানের ব্যবধানের উঁচু দেওয়ালটাকে আরও উঁচু করে, বিপন্ন মানুষগুলিকে রাজনৈতিক প্রকল্পজাত ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর ক্যাম্পে ঠেলে দিল। ডক্টরস ফ্র্যাটারনিটির দায় বইতে গিয়ে অভিমানাহত সৎ ডাক্তারেরা দূরত্ব বাড়িয়েই চললেন। ভাবলেন না, তাঁদের চারপাশে হিউম্যান শিল্ড গড়বে কিন্তু এই অসহায় বিপন্ন মানুষগুলোই। ব্যবসায়ী কর্তৃপক্ষ নয়। যারা বিজনেস দিতে না পারলেই, পেছন দেখাবে। মানুষ ডাক্তারদের ওপর নির্ভর করতে চায়, ভালবাসতে চায়, কিন্তু ভালবাসা তো এক তরফা হয় না।
সাধারণভাবে কোন রুগী ডাক্তার বিরোধী হামলাবাজীতে সামিল হয় না। ভায়োলেন্সের এলিমেন্ট যার মধ্যে নেই তার দ্বারা ভায়োলেন্স হয় না। বিশেষ করে কোলকাতায় রেফারড কোনও রুগী (ধরা যাক তার সঙ্গে জনা চারেকের পেশেন্ট পার্টি) মানসিকভাবেই সেই জায়গায় থাকে না, যেখানে তারা চার বা পাঁচজন মিলে বেসরকারী হাসপাতালের বাউন্সার বাহিনীকে কাবু করে, ভাঙচুর বা ডাক্তার পেটাই-এর মত মহান অ্যাজেণ্ডায় ব্রতী হবে। আমি আরজিকরের পাশেই থাকি। একাধিকবার দেখেছি একই মুখ শূন্য থেকে আবির্ভূত হয়ে পেশেন্ট পার্টির মধ্যে মিশে যায়, এবং তারাই ঘটনা ঘটায়। তারপর তারা ছায়ার মত মিলিয়েও যায়। যে ডাক্তাররা পরপর লাঞ্ছিত হয়েছেন, এটা তাঁদের বেটার জানার কথা। এরকম হুলিগানদের অসংখ্য গ্রুপ তৈরী হয়েছে, এবং এটি একটি পলিটিকাল ডিসকোর্স। অতএব এই মুখগুলিকে চিহ্নিত করা এবং দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়।
কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি চিকিৎসা ব্যবস্থা একটা জিনিষ সহ্য করতে পারে না, তা হলো পেশেন্ট বা পেশেন্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা। দেয়ারস নট টু রিজন হোয়াই / দেয়ারস বাট টু ডু অ্যাণ্ড ডাই। অনেক ভেবে আমি দুটি মাত্র সদুত্তর আবিষ্কার করতে পেরেছি। প্রথমটি প্র্যাক্টিকাল। পেশেন্ট পার্টির জিজ্ঞাসার শেষ নেই। কৌতূহলের অন্ত নেই। সেগুলিকে এন্টারটেইন করতে গেলে চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা কমে যাবে। দ্বিতীয়টি থিওরেটিকাল। বেশী প্রশ্ন করলে আসলে চিকিৎসকের প্রতি রোগীর অনাস্থা প্রকাশ পায়। রোগী নিজেকে ডাক্তারের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করে। ডাক্তারের সুপ্রিম অথরিটি মেনে না নিলে চিকিৎসা চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ে।
বহু ডাক্তারের সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে। বহু ডাক্তারকে আমি শ্রদ্ধা করি সম্ভ্রমপূর্ণ দূরত্ব রেখেই। তাদের কাউকে অশ্রদ্ধা করার কথা ভাবতেই পারি না। কিন্তু ম্যাল-প্র্যাকটিসে ছেয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের মেডিকাল সিস্টেম। আজ থেকে নয়, অনেকদিন থেকে। সরকারী বেসরকারী দুটো সিস্টেমই। আমি এখনও বিশ্বাস করি এই সিস্টেম নিজের অপকর্মের ভারে এতদিন মুখ থুবড়ে পড়তো, পড়েনি কিছু সৎ ও দক্ষ প্রবীণ ডাক্তার এবং এক দল জুনিয়ার, সেবাব্রতে উজ্জ্বল মুখের তরুণের জন্য। কিন্তু তাঁরাই তো সংখ্যালঘু। ফলে তাঁরাই স্কেপগোট। যেমন আমরা বাইরের অক্ষম যাপন, হতাশা, ক্রোধ বাড়ির নিশ্চিন্ততায় বমন করি তেমন।
আগের কথায় ফিরে আসি। দীর্ঘদিন কারমাইকেলে ভর্তি থেকে এবং সেখান থেকে বাড়ি ফিরে বিছানায় চিকিৎসাধীন শুয়ে থেকে প্রায় জগৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। বহুদিন পর বেরিয়ে স্বজন-বান্ধব আত্মীয়-পরিচিত দের বাড়িতে যেতে শুরু করি। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, প্রতিটি বাড়ির অধিকাংশ মানুষ-মানুষীর জগৎবিদারী সমস্যা অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়, এমনকি বিপন্ন বিস্ময়ও নয়। ধন নয় মান নয় একটুকরো ভালো বাসা, ভালবাসাও নয়। সমস্যা হলো তার বিগড়ে যাওয়া শরীর এবং সে শরীরের চিকিৎসা ব্যবস্থা। নিজে অসুস্থ না হলে, বা অতি-নিকটজন অসুস্থ না হলে, এই পরিস্থতি দৃষ্টিগোচর হয় না।
সেদিন গিয়েছিলাম আমার মাসীর বাড়ি। ৪৫ নং বাস স্ট্যাণ্ডের কাছে বরদা অ্যাভেনিউ তে। মাসী মেশো অসুস্থ। মেশোর বিবিধ অসুস্থতা, মাসীর বার্ধক্যজনিত। মাসী মেশো নিঃসন্তান। আর উল্টোটা হলেই বা কী হতো? এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগে? বৃদ্ধ বৃদ্ধা প্রতি রাতে অনিদ্র থাকেন আতংকে, যে হঠাৎ রাত-বিরেতে বা দিনমানেও ডাক্তারের প্রয়োজন হলেই বা কী হবে? জেরিয়াট্রিশিয়ান বা  স্পেশালিস্ট ডাক্তার এর কথা ছেড়েই দিলাম, পাড়ার সাধারণ ডাক্তারও বাড়িতে আসতে বললে, ধমক দিয়ে হাঁকিয়ে দেন। আমাদের ছোটবেলায় ডাক্তারকে ‘কল’ দেবার যে রীতি ছিল, সেটি শহর কোলকাতায় প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য আমার মেশোমশাই প্রয়াত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের ছোট ভাই, যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের “এসো মুক্ত করো” বা “নবজীবনের গান” গেয়ে কমিউনিস্টরা একদিন বাংলা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। মেশোমশাইরা তিন চারটি বৃদ্ধাশ্রমে থেকে এসেছেন, কিন্তু সেখানেও চিকিৎসা ব্যবস্থার সমাধান হয় নি। ট্রেইণ্ড নার্স রাখা এসব পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে আনট্রেইণ্ড আয়া দিয়ে কাজ চালাতে হয়। যারা আসলে ডোমেস্টিক হেল্প। এই গ্যাপের ফয়দা তুলতে বাজারে নেমেছে দেশী বিদেশী সংস্থা “ওল্ড এজ কেয়ার গিভিং” এর নামে। যাঁরা বিদেশে বাসরত, বা স্বদেশেই অন্যত্র, তাঁরা টাকার বিনিময়ে বাপ মায়ের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা কেনার চেষ্টা করেন। যে টাকা সাধারণ মধ্যবিত্তের ছয় মাসের বাজেট। কিন্তু তাতেও সর্বরক্ষা হলো কোথায়? রাত বিরেতে অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে পৌঁছানো যাবে কী করে? মাসী মেশোমশাইকে সারাদিন দেখি প্যানিকস্ট্রিকেন।  ভাবেন,আজকের রাতটা কী ভাবে কাটবে?
ঠিক এখানেই সেতুবন্ধ হতে পারতো ডাক্তার এবং রোগীর। অসুস্থতায় অক্ষম রোগী যদি “এক কল” দূরত্বে ডাক্তার বন্ধুকে পেতেন, অবলুপ্ত “কল সিস্টেম” যদি চালু হতো নতুন করে, আতঙ্কে হাত পা ঠাণ্ডা মেরে আসা রোগী পরিজনেরা চিকিৎসকের উষ্ণ স্পর্শ পেতেন, তবে কোনও ব্যবসায়ী, কোনও হুলিগানের সাধ্য কী ছিল এই সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে পড়ার। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, কেন চিকিৎসকদেরই কেন এমত কৃচ্ছসাধন করতে হবে? আমি বলবো ঈশ্বরপ্রতিম হবার জন্য কিছু ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে। নৈলে আপনি একজন সার্ভি‌স প্রোভাইডার আর আমরা কাস্টমার। এর ওপর সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকবে। যা আমরা বা আপনারা কেউই চাই না।
আর সবধরণের সার্ভিসেই অক্ষম মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটা অলিখিত প্রথা চালু আছে। লিগাল এইড সার্ভিস পর্যন্ত চালু আছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলি নন-গভর্নমেন্ট, নন-কর্পোরেট সার্ভিস। ডাক্তাররাও অনেকেই করেন কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে, এবং ততটা ভিজিবল নয়।
করা যায় না?
সপ্তম কিস্তি
কারমাইকেল থেকে লেখা শুরু করার পর থেকে প্রচুর খিস্তি খেতে হয়েছে। ফেসবুক ইনবক্সে, ফোনে, সাক্ষাতে, ভিডিওচ্যাটে, মেইলে। সাধারণ মানুষ জানেন সব ডাক্তার ঈশ্বর নন, ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যে কিছু স্যাটানও থাকে, এবং তাদের অনেককেই তারা চেনে। ফলে যখনই ডাক্তারদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছি, তখনই তারা ক্ষিপ্ত হচ্ছে, কেননা  তাঁদের সর্বস্বান্ত করা ঐ যে ডাক্তারটি প্রফেশনে পা রেখেই নিশান হাঁকিয়ে বা ফোর বিএইচকে  বাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের মুখ গুলি তাদের সামনে ভেসে ওঠে।
সাধারণভাবে ডাক্তাররা  হুলিগানদের সফ্ট-টার্গেট। সেই ডাক্তারদের সামনে ডক্টরস কমিউনিটি নিয়ে একটি সামান্য প্রশ্ন উত্থাপন করলেও তাঁরা ফোঁস করে ওঠেন। যাঁরা সৎ, তাঁরা ধরে নেন তাঁদের সততাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে। আর যাঁরা সততার এলাকা মাড়ান না তাঁরা ভাবেন এই বুঝি ধরা পড়ে গেলেন। মুহূর্তে তাঁরা অলআউটে চলে যান।
আমার একটা পাল্টা প্রস্তাবনা ছিল। সরকারী হাসপাতালগুলিকে শুধুমাত্র নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক।  অন্ততঃ উচ্চবিত্তের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হোক। গাছেরও খাওয়া তলারও কুড়ানোটা বন্ধ হোক। তাঁদের জন্য তো বেসরকারী আছেই। অ্যাফোর্ডও করতে পারেন। এই স্রোত বন্ধ হলে অনেক উমেদারী, অনেক গোপন সাঁট, অনেক অনৈতিকতা বন্ধ হয়ে যাবে। গ্রামাঞ্চলে বিপিএইচসি বা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলিতে যে ডাক্তার প্রতিদিন সময়মতো পৌঁছাতে পারবেন না তাঁদের ছাঁটাই বা সমতুল্য শাস্তিবিধান করা হোক। গাঁইগুঁই করলে গডস গেম খেলার থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া হোক। আরও একটা কথা। প্রাইভেট টিউশানি করলে যদি শিক্ষকদের শাস্তিবিধান হয়, একই যুক্তিতে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ হবে না কেন?  ডাক্তাররা কি শিক্ষকদের তুলনায় দুঃস্থ, যে সংসার চলেনা? এমনকি নন-প্র্যাকটিসিং অ্যালাউন্স যদি ডাক্তারেরা পেতে পারেন তবে অন্য প্রফেশান কী দোষ করলো? তবে হ্যাঁ এটা অনস্বীকার্য  যে কোনও প্রতিষ্ঠান যদি মনে করে কোনও রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য বিশেষজ্ঞ সরকারী ডাক্তারকে কনসাল্ট করা জরুরী, বা তার সার্ভিস জরুরী, তবে তাঁকে নিশ্চয়ই ডাকা হতে পারে। কেননা রোগীর সুস্থতার চাইতে কোনোকিছুই বড় নয়। কিন্তু সেসব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচের দায়িত্ব রোগী নয়, প্রতিষ্ঠানের বহন করা উচিত।
সরকারী হাসপাতালে বিপিএল-রা অগ্রাধিকার পাবে, অনুন্নত শ্রেণীর মানুষ অগ্রাধিকার পাবে, নিম্ন আয়ের মানুষ অগ্রাধিকার পাবে, সুচিকিৎসা পাবে, সমব্যথী ডাক্তার নার্সদের ভরসার হাতের স্পর্শ পাবে, বিনামূল্যে বেড পাবে, ওষুধ পাবে। রাজনীতির কলুষ হাসপাতালের বাইরে রেখে আসতে হবে, হাসপাতালের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা দুষ্টচক্রকে মেরে তাড়ানো হবে। যা কিছু এই সিস্টেমের জন্য অশুভ তাকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করা হবে।  যাঁরা বিত্তবান তাঁদের জন্য বেসরকারী হাসপাতালগুলি তো রইলই। পয়সা ফেকো তামাশা দেখো। বেসরকারী হাসপাতালের নিজস্ব রোগসমূহ সরকারী হাসপাতালগুলিতেও যে সংক্রমন ঘটাচ্ছে তার অবসান হওয়া প্রয়োজন।
যে ডাক্তার বন্ধুরা শুধু  নগদনারায়ণ পুজোর জন্য এই প্রফেশনে আসেন না, কমিটমেন্টের জন্য আসেন (এঁদের সংখ্যাও কিন্তু নিতান্ত কম নয়), তাঁরা লাইনের এপারে চলে আসুন না।  দেখবেন প্রত্যাশী মানুষগুলি কেমন শবরীর প্রতীক্ষায় স্থিত। কারা আপনাদের গায়ে হাত তুলবে? আমরা আছি না?  আপনাদের ঘিরে রাখবো না? কার ক্ষমতা আছে আমাদের টপকে আপনাদের কাছে পৌঁছানোর?
ডেঙ্গু মহামারীর আকার নিচ্ছে। সরকার দায়িত্ব অস্বীকার করছে। এমনকি ডেঙ্গুকে ডেঙ্গু বলে স্বীকার করছেন না। ডাক্তারদের অলিখিত হুমকি দিচ্ছেন ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়া না লিখে অজানা জ্বর লিখতে। এই নিয়ে কোনও ডাক্তার স্যোশাল মিডিয়ায় দু লাইন পোস্ট‌ করলে সাসপেনশান খেয়ে যাচ্ছে।
মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকারী ব্যর্থতার দায় সাধারণ মানুষের অবৈজ্ঞানিক মূর্খামি আর তেঁঞটে ডাক্তারদের হারামীপনা বলে সহজেই চালানো যাচ্ছে। ডাক্তার এবং রুগী, যাঁরা সম্মিলিতভাবে এই রাষ্ট্রগ্রাস থেকে পরস্পর কে বাঁচাতে পারতো,  তারা দংশনক্ষত শ্যেন-বিহঙ্গ আর ভুজঙ্গ হয়ে উন্মত্ত লড়াই এ সামিল। একদা জুনিয়ার ডাক্তার আন্দোলনে সরকার প্রাণপণ চেষ্টা করেও তাদের জনবিরোধী প্রমাণ করে পাবলিক সাপোর্ট এগেনস্ট‌-এ নিতে পারেনি। আর আজ?
যে ডাক্তাররা মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত করাপ্টেড, দোহাই আপনাদের, তাঁদের সমর্থন করতে যাবেন না।  যে ডাক্তার রোগীদের সঙ্গে সঙ্গে গডস গেম প্লে করবেন, ধমকানোর ওপর রাখবেন, উদ্বিগ্ন হয়ে একটা এক্সট্রা প্রশ্ন করলে অপমানজনক অবজ্ঞা দেখাবেন, জিজ্ঞাসা করবেন ডাক্তার আপনি না আমি, দাঁত খিঁচিয়ে বলবেন আপনার একটা পেশেন্ট আমার একশোটা। মালিক পক্ষের সব অনৈতিকতাকে হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙের মত সাপোর্ট দিয়ে যাবেন, আর বিপদে পড়লেই আমরা তো নিমিত্ত মাত্র বলে লেজ গোটাবেন এতো হয় না। সব ডাক্তারকে তো মারে না। এতদিন তো মারে নি। ভালো ডাক্তাররা চটজলদি মারও খাননা, আর ভ্রমবশতঃ মার খেলেও চটজলদি মানবিকতার পথ থেকে সরে আসেন না। মানবিকতা শব্দটি পেশাগত নয়, বাণিজ্যও নয়, হৃদয়বত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। সেটা অনুধাবন করা আজকের বঙ্গে একটু কঠিন। প্রফেশন কথাটার এখন সুপ্রযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ধান্দা। ফলে কোন প্রফেশনে সব মানুষ অনেস্ট‌, এই জাতীয় জেনারালাইজেশনে কোনও লাভ নেই। আমাদের জ্ঞান মিনিমাম বলেই রোগ হলেই ডাক্তারের কাছে ছুটি। সিস্টেমটাকে মাউসট্র্যাপ বানিয়ে তোলার কৃতিত্ব কার? তার পরেও যদি “এরপর কিন্তু আমাদের মানবিকতা শুকিয়ে যাবে বলে থ্রেট করেন”, তাহলে পেশেন্ট পার্টির হঠকারিতার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ডিফেণ্ড করবেন কী করে? হালের ক্লিনিকাল এস্টাব্লশমেন্ট বিল এর জন্য দায়ী এমন কথা বলবেন না প্লীজ। দমদম দাওয়াই এর গল্প তো বহু পুরোনো।
এ বিষয়ে আরও দু-একটি কথা, যা আমি ভাবি….
এক.  আপনি কি জানেন ডিমনিটাইজেশনের জন্য বহু প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার ডাক্তার ইতিমধ্যে তাদের ফিজ অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছেন? জিএসটি-র জন্য লাইফ সেভিং ড্রাগসের দাম বাড়ার কথা নয়, কিন্তু বেড়েছে তো? কেউ কোন প্রতিবাদ করেছেন?
দুই.   আপনি কি বলতে পারবেন সব প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার ফিজ নিয়ে রসিদ দেন তো?  না দিলে ওটা তো তবে কালো টাকা হয়ে যায়? এরকম বিপুল আনঅ্যাকাউন্টেড মানি ডাক্তারদের গায়ে কালির ছোপ দেয় না?
তিন.  যে পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তারী পড়ার ছাড়পত্র পেতে হয়েছে এতদিন, সেখানে সততা এবং স্বচ্ছতা বজায় থাকে তো? নৈলে দায়বদ্ধতা আসবে কী করে? আর এই দায়বদ্ধতা কার কাছে? কিছু ওপেন সিক্রেট, যেমন অনেক ডাক্তারই ল্যাবরেটারী গুলোর থেকে কমিশন নেয়, এটা কি মর্যাদাবর্ধক?
চার.    আদালতে ডাক্তারের দোষ প্রমাণ করা? সেটা তো করা যায়না। করতে গেলে কুণাল সাহার মত অঢেল টাকা, ডাক্তারী জ্ঞান এবং টেনাসিটি থাকতে হয়। সাধারণ রোগী তা করবে কী করে? কোর্ট চত্বরে পাক খেয়ে খেয়ে জীবন খারাপ হয়ে যাবে। প্রমাণ পাবে কী করে? ডিসচার্জ সামারি ছাড়া আর তো ভ্যালিড কোন ডকুমেন্ট তো রোগীর পরিবারের হাতে দেওয়া হয় না।
পাঁচ. যতই গুগল ডাক্তারের পেশেন্ট বলে বিদ্রূপ করুন না কেন, আজকের সময়ে কোনও শিক্ষিত মানুষ (এ ক্ষেত্রে রোগী) বাধ্যতামূলকভাবে প্রি-নেট যুগে পড়ে থাকবে এটা সত্যিই আশা করেন? রোগী এবং তার পরিজন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রশ্ন করবেই। আগে তার সে সুযোগ ছিল না, এখন ইন্টারনেট সেটা এনে দিয়েছে। ডাক্তাররা গুগল করেন না? না করলে অন্যায় করেন।
ছয়.   ডাক্তার মাত্রেই মহাপুরুষ হন না, বিচারক মাত্রেই যেমন ঈশ্বর হন না।  গ্রিডি, ইনহিউম্যান, স্যাডিস্ট, সাকিং ডাক্তারদের নিজেদের কমিউনিটিভুক্ত করে ফেলবেন না প্লীজ। ওটা পাপ।  এনআরএস হোস্টেলে একটি তরুণ রাজমিস্ত্রীকে যে পিটিয়ে মারলো হবু ডাক্তারেরা, শুধুমাত্র মোবাইল চুরি করেছে এই সন্দেহে, তাদের তো কোনও শাস্তি হয়নি।
সাত.  কোন কোন সদ্য ডাক্তার  লজিকে এঁটে উঠতে না পারলেই, ধরে নেন যে অ্যাটাকিং ইজ  দা বেস্ট ডিফেন্স এবং আক্রমণ শুরু করেন এই বিন্দু থেকে, যে জয়েন্ট ক্র্যাক করতে পারেন নি তাই ডাক্তারদের হিংসে করছেন। অথচ বেসরকারী হাসপাতাল গুলিতে যে ধরণের নষ্টামি চলে বা স্বাস্থ্যভবনকে কেন্দ্র করে যে দূর্নীতির চাষ হয় তার বিরুদ্ধে কনফরমিস্ট এর ভূমিকা  ছাড়া কখনও কি ডাক্তারদের মূল স্রোতটিকে দেখা যায়?
শেষ কিস্তি
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে ছিলেন সব সরকারী চিকিৎসালয়ে বিন পয়সায় (দু টাকার টিকিটে) চিকিচ্ছে হবে। ব্যস, জেলার সর্বত্র শুধু নয়, ভিন রাজ্য থেকেও হতদরিদ্র চিকিচ্ছে প্রার্থীর ঢল নামলো শহরের হাসপাতালগুলিতে। দুহাত তুলে তারা আশীর্বাদ জানালো মমতাময়ীকে। পাবলিকের গলায় বঁড়শি বিঁধলো। বিনে পয়সার ডাক্তার আর ওষুধের টোপ। দু টাকায় চিকিচ্ছেরও। নিন্দুক এবং দুর্মুখদের মুখ বন্ধ।
বিনে পয়সার চিকিচ্ছে মিথটা সরকারীভাবেই ভাঙ্গতে শুরু করেছিল কিছুদিন ধরে। এটা পাওয়া যাবেনা, ওটাও না। টের পাচ্ছিলাম আমার সপ্তাহে সাতদিন সাতটা ভোরিকোনাজল প্রয়োজন যা এতদিন হাসপাতাল থেকেই পাচ্ছিলাম। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। ফাঙ্গাল ট্রিটমেন্টের সেই মহার্ঘ ওষুধ টাকার অভাবে বন্ধ করে দিতে হলো। শুধু আমার নয়, আমার মত আরও কতিপয় অ্যাসপারজিলোসিস আক্রান্তের। কোনও দামী ওষুধই আর পাওয়া যাচ্ছে না। সবই যদি মুফতে পাওয়া যায় তবে বেসরকারী হাসপাতালের স্বাস্থ্যব্যবসা চলে কী করে? এবার সরকারী হাসপাতালেও শ্রেণীভেদপ্রথা চালু হবে। সামর্থ্য ও অসামর্থ্যের ভিত্তিতে। কিন্তু এর চাইতেও বড় কথা দাঁড়ালো, সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থার অভিমুখটাই পাল্টে গেল। গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়া হলো। অথচ প্রতিবাদ করার কেউ রইল না।  সরকারী হাসপাতালে ফ্রি ওষুধ পাওয়ার উৎকট যন্ত্রণায় এবার দাঁড়ি।
আসলে হয়েছিল কি, বেসরকারী হাসপাতালের সঙ্গে হিস্যা, বখরা নিয়ে এত হুজ্জুত। তবে সবাই জানতো, সব মধুরেণ সমাপয়েৎ হবে। মাঝখান থেকে কয়েকজন ডাক্তার অকারণে পেটাই খেয়ে গেল। এমনই কর্মফল যে আসলে পেটাচ্ছে যারা, তারা যে সাধারণ মানুষ নয়, রাজনৈতিক হুলিগানদের জারজ সন্তানেরা, সে কথা সাহস করে বলার অবস্থাও নেই আজকের পচ্চিমবঙ্গে। যাই হোক, এখন থেকে আর সরকারী হাসপাতালে দামি ওষুধ পাওয়া যাবেনা।  দু চারটে লোক দেখানো কেস ছাড়া হুলিগানেরা দামি হাসপাতালে হুজ্জুতি করবে না। ডাক্তারেরা এযাত্রা বেঁচে গেলেন। কিন্তু বিনিময়ে কী দিতে হবে তাঁরাই জানেন। শুধু মাঝখান থেকে প্রায় নিঃশব্দে রাজ্যের চিকিৎসা নীতির অভিমুখ পাল্টে গেল। পাল্টে গেল না পূর্বাবস্থায় ফিরে গেল সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য জটিল সিঁড়ি ভাঙ্গা অঙ্ক।
দিন তিনেক আগে কাকার তৃতীয়বার টি.ইউ.আর.বি.টি হলো টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারে। টিএমসি একটি অসাধারণ চিকিৎসাকেন্দ্র। বেসরকারী হাসপাতালের গুণাবলী কেউ যদি চাক্ষুষ করতে চান তবে টাটায় ঘুরে আসুন। বেশীরভাগ রুগী মুম্বাই টাটা আর কোলকাতা টাটার মধ্যে তালগোল পাকিয় ফেলেন। যতদূর জানি মুম্বাই টাটা সরকারী ক্যান্সার হসপিটাল, কিন্তু কোলকাতা টাটা আগপাশতলা বেসরকারী। পূর্বভারত, আর উত্তরপূর্বের রোগীর ঢল তো রয়েছেই, তার সঙ্গে বাংলাদেশ, ভুটান সহ বহু বিদেশী রোগী। ক্যান্সার হাসপাতালে মানুষ মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই যায়।কিন্তু সেই মরণউন্মুখজনেদের নিংড়ে নেবার কোনও সুযোগ হাতছাড়া করে না। টিপিকাল কর্পোরেট অ্যাটিটিউড।
কাকার প্রথম এবং দ্বিতীয় টি.ইউ.আর.বি.টি র সময় মেডিকা সুপার স্পেশিয়ালিটি হসপিটাল যে স্টেইন্ট বসায় নি তার জন্য স্বনামধন্য টাটার ডাক্তার মেডিকার ডাক্তারের গুষ্ঠির শ্রাদ্ধ করে বলেছিলেন আলু-পটলের ব্যবসায়ীরা হাসপাতাল খুললে এই হবে। এই কথাটা রুগী বললে ভাবুন, কত বড় অন্যায় হতো! বহু ব্যায়ে স্টেইন্ট বসানো হলো, ছ মাস পর তা পাল্টানোও হলো। তার তিন মাস পর চেক সিস্টোস্কোপি  এবং পরবর্তী টি.ইউ.আর.বি.টি র নিদান। তার সঙ্গে স্টেইন্টটা খুলে দেবার ঘোষণা (যে স্টেইন্ট একবছরের জন্য বসানো হয়েছিল)। সে মরুকগে। ওটির পর ডাক্তার মুখ বাড়িয়ে জানালেন স্টেইন্টে হাত দেওয়া হয়নি। কারণ ব্লাডারটা অ্যাংগ্রি লুকিং ছিল। বার চারেক অ্যাংগ্রি লুকিং  বলার পরেও যখন দেখলেন ক্যালানেগুলো কিছুই বুঝছে না, তখন নিরুপায় হয়ে বুঝিয়ে বললেন, “বায়াপ্সি হয়ে আসুক তার পর দেখা যাবে।” বাড়ি এসে সেই গুগলে দেখতে চেষ্টা করলাম অ্যাংগ্রি লুকিং ব্লাডার মানে, কিন্তু পেলাম না। বুঝলাম এই জন্যই আমরা জয়েন্ট ক্র্যাক করতে পারতাম না।
টাটা মেডিক্যাল সেন্টার আমার উপলব্ধিতে অত্যন্ত খারাপ এবং রক্তচোষা টাইপের মেডিকাল সার্ভিস প্রোভাইডার। যেখানে ক্যান্টিনের খাবার থেকে ট্রিটমেন্ট পদ্ধতি, সব কিছুর দাম আকাশছোঁয়া। সে যাক। যার পয়সা আছে যাবে,য়ার উপায়ান্তর নেই তাকে তো যেতেই হবে। সবচাইতে সরেস হচ্ছে এদের ফ্রন্টডেস্ক। উরি শ্লা। রুগীকে তো মানুষ বলেই মনে করে না। স্বয়ং ডাক্তারদের সম্বন্ধে যা সব উক্তি করে শুনে যে কোনও রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবার উপক্রম। কিন্তু এহ বাহ্য। টাটায় তিনরকমের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু। জেনারেল, প্রাইভেট, আর সম্ভবতঃ ডিলাক্স। টাকার অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। সে ভাল। বাজারের এইতো নিয়ম। যেমন গুড় ঢালবে তেমন মিষ্টি। কিন্তু সমস্যা হয় অওকাত অনুযায়ী আমরা হলাম জেনারেল পাবলিক। যাদের সামান্য দেড় দু লাখ টাকা মেডিক্লেইম পুঁজি। কিন্তু যদি আপনি জেনারেল রুগী হন তবে আপনি মেডিক্লেইমের কাগজপত্র কিছু পাবেন না। ফলে আপনার ক্লেইম ভয়েড হয়ে যাবে।
অনেকক্ষণ টাটা বাই বাই বলছি বটে কিন্তু সব বেসরকারী হাসপাতালে এই প্রথারই রকমফের। প্রলুব্ধ করার সময় বলবে প্যাকেজ ডিল। কম খরচে হবে। পরে বলবে প্যাকেজ ডিলে আমরা তো মেডিক্লেইম ব্রেক আপ দিই না। এটাই সিস্টেম। ব্রেক আপ ছাড়া ক্লেইম ভয়েড। ফলে আপনি হাতে হ্যারিকেন নিয়ে ঘুরে বেড়ান। আমার অনেক শ্রদ্ধাভাজন স্বাস্থ্যে সাম্য চান। এই সোসাইটিতে?
যাই হোক, বেসরকারী মহানুভব চিকিৎসা বিক্রেতাদের সঙ্গে নতুন করে সাঁট হয়ে তোলাবাজি পূর্ণোদ্যমে চালু হওয়ায়, হাসপাতালে পুনর্বার শান্তিকল্যাণ বিরাজমান হলো। তাতে ইলেকশান ফাণ্ডের লক্ষ্মীভাণ্ড উপচে পড়ছে ঠিকই কিন্তু গাঁটকাটা যাচ্ছে পাঁচপাবলিকের। প্রতিবাদ করার কেউ নেই। লাভের গুড় সব পিঁমরেই খাবে। ডাক্তাররা যদি ট্যাঁফুঁ করে তবে মব লিঞ্চিং-এর নামে একটু ধুনিয়ে দিলেই হলো। শান্তিকল্যাণ। শান্তিকল্যাণ।
ফাটল ক্রমে বাড়ছে, আর না বাড়ানোই মঙ্গল। মানুষ বিপদে পড়েই ডাক্তারের কাছে যায়, চা খেয়ে আড্ডা মারতে যায় না। বিশ্বাস করে যায়, বিশ্বাস করতে চায়। ডাক্তারকে বিশ্বাস করতে চায়। অল্প নিয়ে থাকে তাই তাদের যাহা যায় তাহা যায়। সম্পর্কটাকে ক্রমশঃ দাঁড় করানো হয়েছে সার্ভিসপ্রোভাইডার এবং কাষ্টমারের সম্পর্কের মত। সম্পর্কের এই পরিণতির জন্য শুধু ননমেডিকাল কমিউনিটিই দায়ী? ভেলোর সিএমসি, বা নিমহান্স ব্যাঙ্গালোর বা দিল্লী এইমসে কি রুগী মরে না? এখানের থেকে ভাল ডাক্তার ওখানে আছে বিশ্বাস হয় না, কিন্তু বিশ্বাসটা আছে। মানুষ তাদের জীবন রক্ষার জন্যই ডাক্তারদের ওপর নির্ভরশীল। মাঝখানের এই মধ্যসত্বভোগী মালগুলানকে হটান তো। দেখবেন জীবন আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে।

2 thoughts on “কারমাইকেল থেকে কয়েক কিস্তি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.