রূপা আইচ

“আমার কথা…আমাকে ঘিরে আরও অনেকের কথা…কথা…কাহিনী…ইতিহাস… আত্মকথনে জীবনের পাতা ওল্টানোর ব্যর্থ(?) প্রয়াস…” – রূপা

সকালে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি — পারাজের সাথে দেখা। হন্তদন্ত হয়ে অফিস যাচ্ছে। আমার চেহারাটা ভারি হয়ে গেছে — জোরে হাঁটতে কষ্ট হয়। তাই হাতে টাইম নিয়ে বেরোই, ধীরে ধীরে চলি বলে। পারাজ আমার পাশ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল, ‘‘রূপাদি এগোলাম। দেরি হয়ে গেছে। পরে কথা হবে।’’ পারাজের পাশে ওর স্বামী ধীমান। আমি জানি এর আগে কী হয়েছে আর এর পরে কী হবে। নিজের চোখে দেখা খানিকটা অভিজ্ঞতা আর কিছুটা পারাজের মুখে নেহাত গল্পের আকারে শোনা কথা থেকেই আমি তা আলাদা করতে পারি। পারাজ খুব ভোরে উঠেছে। নিজের আর ধীমানের জন্য চা বানিয়েছে। ধীমান আধো ঘুমে আলস্য ভরে চা খেয়ে আবার একটু ঘুমিয়ে নিয়েছে। পারাজ সকালে দু’জনের জল খাবার আর টিফিন বানিয়েছে, স্নান করে, রেডি হয়ে আবার চা বানিয়ে ধীমানকে ডেকেছে। ধীমানের এই সময় ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়। তবু সে কথা দিয়েছে, তাই বাধ্য হয়ে পারাজের সাথে চলেছে তাকে বাসে তুলে দেবে বলে। ধীমান অবশ্য এই কথাটা রোজই রাখে। ভালোবাসা নাকি নির্ভরশীলতার প্রতিদান? পারাজ ভিড় বাসে ঠেলা-গুঁতো করে চলে অফিস।

ধীমান পারাজ চলে গেলে সারাদিন কী কী করে তাও আমি অনেকটাই জানি। ও এরপর খবরের কাগজ কিনে পড়তে পড়তে চা খাবে, তারপর বাড়ি গিয়ে সদ্য কেনা টিভিতে নানা খবর ও রাজনৈতিক বিতর্ক শুনবে। তারপর ওর বাবা-মায়ের বাড়ি যাবে দুপুরে। সেখানে স্নান করে ভাত খেয়ে দিবাঘুম দেবে নিশ্চিন্তে। তারপর নিজের বাড়ি এসে কমপিউটারে একটা সিনেমা দেখবে অথবা নিজের তোলা ছবি এডিট করবে। ও, বলতে ভুলে গেছি ও শখের ফটোগ্রাফার। আজকাল অবশ্য কাজ পেলে নানা অনুষ্ঠান বাড়ি, পার্টিতে ছবি তোলে। তাতে কিছু রোজগারও হয়।

পারাজ সারাদিন অফিসে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফেরার পথে ধীমানের সাথে মিট করবে। তারপরে দোকান-বাজার করবে, বাড়ি ফিরে রাতের খাবার তৈরি করবে, ঘরের টুকটাক কাজ সারবে, ধীমানকে দফায় দফায় চা করে খাওয়াবে। তারপর ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে শুতে যাবে। আমি ওদের সেক্স লাইফ সম্পর্কে কিছু জানিনা — তাই বলতে পারবনা নিত্যকার রুটিনে সেই জীবন কেমন করে কাটে।

পারাজ নারীমুক্তি বিষয়ে সংবেদনশীল, এরই মধ্যে যতটা পারে কিছু কাজ করার চেষ্টা করে। আমরা ‘অন্য নারী’ নামে মেয়েদের একটা পত্রিকা করি। ও তার ফাউন্ডার মেম্বার। মাসে একটি শনিবার বিকেলে আমরা একসাথে বসে পত্রিকা নিয়ে নানা পরিকল্পনা করি, নানা সামাজিক বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি, ব্যক্তিগত জীবনের কিছু সমস্যা শেয়ার করে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করি। পারাজ সাধারণত মিটিং-এ এসে কিছুটা অংশগ্রহণ করে ঘুমিয়ে পড়ে। ওকে মিটিং চলাকালীন ঘণ্টাখানেক শান্তিতে ঘুমোতে দেখে আমরা তৃপ্তি পাই। মনে হয়, সারা সপ্তাহের অমানবিক পরিশ্রমের জীবনে এটুকুই তো ওর বিশ্রামের সময়।

ধীমান-পারাজের এ জীবন-যাপন ওদের সাথে ঘনিষ্ঠ মানুষদের চোখ এড়াতে তো পারেনা। পারাজকে আমরা প্রশ্ন করি, কেন সব বোঝা তুই একা বহন করে চলিস? ও বাস্তব চাপা দিয়ে  মিথ্যা বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেনা। নানা উদাহরণ দিতে থাকে মোদ্দা এই কথাটা বোঝাতে যে ওর নানা কাজে ধীমান অনেক সময়ই সাপোর্ট দেয়। পারাজের এই অ্যাটিচিউডে দুঃখ পাই আমরা। ধীমানের মধ্যে সোশালাইজেশনেরও বেশ সমস্যা আছে। নিজের যোগ্যতায় ও কোনও বন্ধুগোষ্ঠী তৈরি করতে পারেনি। পারাজ তাই নিজের সমস্ত সম্ভাবনা ও গুণাবলীকে বিসর্জন দিয়ে, যে সৃষ্টিশীল মনুষ্যজীবন ও যাপন করতে পারত তাকে চূড়ান্ত অবহেলা করে ধীমানকে সঙ্গ দিয়ে, তার একাকীত্ব, হীনমন্যতা ও নানা কমপ্লেক্সকে ম্যানেজ করতেই নিজের সমস্ত এনার্জি শেষ করে ফেলে।
আমরা কষ্ট পাই। ভাবি, একজন ‘নারী স্বাধীনতা’র সমঝদার, অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর, শিক্ষিত গুণী মেয়ে কেন এ জীবন বেছে নিল? ধীমানকে নিরাপদ, সুস্থ, আনন্দে রাখাটাকেই জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্খা করে তুলল? প্রশ্নের জবাব হিসেবে একদলা কষ্ট গলায় ঠেলে ওঠে। অনুভব করি পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি কি গভীর প্রভাব নিয়ে মানুষের জীবনে-মননে বর্তমান। কত কত দীর্ঘপথ লড়তে লড়তে হাঁটতে হবে জানিনা! গ্রামাঞ্চলে যখন মেয়েদের মধ্যে কাজ করতে যাই, দেখি বেশিরভাগ ঘরে ঘরে হাজারো দায়িত্ব বহন করে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত, একাধিক সন্তানের জন্মদাত্রী, অপুষ্ট শরীরের বউদের কারণে-অকারণে কী অমানবিকভাবে বেধড়ক পেটায় তাদের বরেরা। মেয়েরা মিটিং-এ অভিযোগ জানায়, আর একই সাথে অনুরোধ করে, দিদি কিছু বোলো না যেন ওকে। আমাকে আরও মারবে। আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি বলি তাহলে বসে বসে মার খাবে? কেন খাবে? তোমরা তো কিছু করোনি।। এ তো অন্যায়! ওরা বলে হ্যাঁ দিদি, তা ঠিক। কিন্তু আমারই তো বর, বলো? আমাকে ভালোওবাসে। এবার পুজোয় একটা নতুন শাড়ি এনে দিয়েছে। এরকম কত যুক্তি। মূল কথা — জীবনটা শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু সংসারে স্বামীর অভিভাবকত্ব কিছুতেই অস্বীকার করা যাবেনা। যার স্বামী স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যায় তার কী কোনো সামাজিক মর্যাদা থাকে?

গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের এই জীবন আর পারাজের জীবন কতখানি আলাদা — আমার মনে প্রশ্ন জাগে। আমি পার্থক্য খুঁজে পাইনা। পারাজকে আমি খুব ভালবাসি কারণ সে পরিশ্রমী জীবন কাটায়, সে  নিজের যোগ্যতায় সংসার চালায় — এমন মেয়েকে আমি মনে মনে সম্মান করি। কিন্তু পারাজ, তোর এই জীবন যতখানি সম্মান পেতে পারত, ধীমানকে তার পুরুষতান্ত্রিক জীবনযাপন ও আচরণকে আড়াল করার মধ্য দিয়ে যে সে সম্মান হারিয়ে যায় রে! তুইও বুঝবিনা, আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মান ছাড়া নারী যে মুক্তির পথে এক পা-ও হাঁটতে পারবেনা? পারাজ, তুই যদি না বুঝিস, গ্রামের মেয়েদের কেমন করে আমরা অন্য জীবনের স্বপ্ন দেখাব? কেমন করে এগোবে আমাদের পুরুষতন্ত্র-বিরোধী লড়াই?

পারাজ প্রশ্নগুলোকে আর এড়িয়ে যাসনা প্লিজ। আমি তোর উত্তরের অপেক্ষায়।

1 thought on “আমার জীবন কাটে উত্তরের অপেক্ষায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.