নন্দিনী ধর

কলকাতায় জন্ম, বেড়ে ওঠা, বাচাল হতে, পথ চলতে শেখা। আপাতত চাকরিসূত্রে বিদেশবাসী।

এক

অ্যাই,এদিকে এতো ঘুরঘুর কীসের?
মারব ঠাস করে গালে এক চড়।
কানে ঢোকে না, রান্নাঘরের চৌকাঠ পেরনো বারণ আছে তোর?
পড়তে বোস ।
শেখাব না তোকে তাই পেঁয়াজ ছোলা।
মাছ কোটা।
কিংবা খুন্তী হাতে ধরা।
শিখবি না তুই রাঁধা বাড়া কুটনো কোটা।
কুড়মুড়ে করে আলু ভাজা কিংবা বাটনা বাটা।
তোর জীবন আমার মতো হবে না কক্ষনো।
পড়তে বোস।
কাল না তিন তিনটে পরীক্ষা আছে তোর?

.

দুই

স্বাক্ষর – সহি, দস্তখত।…+, স্বাক্ষরিত
স্বাক্ষর – স্ব+অক্ষর

আহ্বান বিষয়টিকে – তা সে যে রঙেই হোক না কেন – আমার মার বড় ভয়। কালো জিরের শিশিতে মশলাদানার ফাঁকে ফাঁকে ঠোসাঠুসি করে তাই ভরে রাখে কলেজের ক্লাস, কফি হাউসের দেওয়াল উপড়ে ছিঁড়ে নেওয়া একটুকরো পোস্টার, কবিতার খাতা। যে দেশে কখনও পা দেওয়া হয়নি, তার স্মৃতি। শব্দের দিকে হাত বাড়ানোর কোনও স্পৃহা নেই আর। তবু মধ্যবিত্তের গেরস্থালির দরজা জুড়ে হাজার একটা সইসাবুদ। ব্যাঙ্ক। গ্যাসের বিল। আরও কত কী। মা শাড়ির আঁচলে হাত মোছে। আত্মবিশ্বাসহীন আঙুলে কলম ধরে। একটা একটা করে অক্ষর। একটা একটা করে রেখা। একটা একটা করে ফুটকী। মা নিজের নাম লিখছে। কাগজের পাতায় মার কলমের ডগায় ধীর ঘর্ষণ আর আমি বুঝতে শিখি। অনভ্যস্ততা আর আত্মবিশ্বাসহীনতার মধ্যেকার যে ফারাক। যে পরস্পরাশ্লেষণ। আমার মার সই করতে লাগে পাঁচ মিনিট। মা সাদা কাগজে আঙুল ঘোরায় আর চিল্লায়, অ্যাই, গলা খুলে পড় । মা অক্ষরের দখলদারি নেয় আর চিল্লায়, শুনতে পাচ্ছি না কেন তোর গলা? আমাদের বাড়ির ইঁট, সিমেন্ট, সুরকির সুড়ঙ্গপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চিত্রনাট্যের খসড়ার ছেঁড়াখোড়া পাতা। জলে ভিজে দুর্বল হলেও অক্ষরগুলি এখনও অটুট, অ্যাই মেয়ে পড়তে বোস। আমার মার সই করতে লাগ পাঁচ মিনিট। পরীক্ষিত সত্য – আমি আঙুল গুনে দেখেছি।

.

তিন

মানচিত্রের রেখা জুড়ে লাগাতার নখের আঁচড় দাগাদাগিতে হঠাৎ পাতা ফুড়ে বেরিয়ে আসে মৃতপ্রায় এক ধড়। না, বন্দুকের টোটা, বেয়নেট বা সূর্যকণা আঙুলের ডগায় আঁকড়ে ধরে এ গহ্বর আমি খুঁড়তে বসিনি। আবার বিমূঢ় মগ্ন বিস্ময়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসিনি সে সব। নখাগ্র দিয়ে তাই আঁচড়াতে থাকি তার উইরঙা চামড়া, মাংস, হাড়। ঘড়ির কাঁটা তার উদরে যথাবিধি বেঁধালে, রক্তপাত হয় না। বরং দেখি, মিউজিয়ামের যেমন কাঁচের বাক্স, তেমনি একটি বাক্সে গালে হাত দিয়ে বসে আছে আমার মা। সর্বাঙ্গে মা-মাফিক ব্যাকরণ বিধি – হাতে শাঁখা, লোহা, পলা। কব্জিতে নীল শিরা – উপশিরার আঁচড়। মাখনরঙা ত্বক। আঁচলের ডগায় বরাভয়। বৃষ্টির জলে বড়োই যে ত্রাসবোধ, তা মা জানে। তাই, চৌকাঠের এপারেই তার বসবাস। কাঁচের বাক্সের ডালা খোলে না আমার মা।

কাঁচে নাক ঠেকিয়ে একটা একটা করে মুখস্থ করি এই মা – ব্যাকরণের উপাদানসমূহ; সন্ধি, সমাস, কারক আরও যেন কী কী সব। অভ্যস্ত অবয়ব কেটেকুটে বিকৃত করার আগে আসে কিনা ওস্তাদি অর্জন। তবে, মট মট করে এই ধড়ের হাড় ভাঙতে শুরু করলেও, এ ব্যকরণের হয়তো হবে না কোনও পরিবর্তন। মানে, হয়নি এখনও। সেই সহসা হাওয়ার দেশেও না। গৃহ ঝম ঝম করে মধ্যরাত্রেও না। তাই, হাতের মুঠোয় কখনও সূর্য ছোঁয়ার স্বাদ পায়নি আমার মা। পায় না। মুখমণ্ডলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঁকা পরকাল আর কপালের ধ্যাবড়ানো সূর্য নিয়ে মা আমাকে ঘুম পাড়াতে চায়। পিঠে, গালে, কাঁধে আর গলার ঠিক মাঝখানটিতে আমার মার হাতের দাগ। থাবড়ে থাবড়ে ঘুম পাড়ানোর। ঠিক যেন র্দুগা ঠাকুর। মার গাল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে সিঁদুররঙা ঘাম। পতাকাবর্ণীও হতে পারে।

মা আমাকে ঘুম পাড়ায়। ঘুম পাড়ার আর বুজে আসতে থাকে নিজের চোখের পাতা। মা ঢোলে। আর ঢুলতে ঢুলতে পিঁয়াজ কাটে। সুতোর মতো পাতলা পিঁয়াজের ফালি। দুকানে ছোট্ট ছোট্ট সোনার ফুল। মা ঢোলে। আর ঢুলতে ঢুলতে নারকেল বাটে। মরচের মতো মিহি। মা-র আমার লালপাড় সাদা শাড়ি। আঁচলের কোণে বাঁধা বরাভয় – বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই, বন্ধ হবে এ ঘরের দরজা। জানলা। মৃতপ্রায় ধড় কখনো সখনো আঙুল নাড়ে। উঠে বসে না।

.

চার

যে ইতিহাস ঘটে যায় খাটের চাদরের আনাচে-কানাচে, বালিশের ওয়ারের আড়ালে, কিংবা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় পুরনো লালটিপের আঠার দাগ ধরে, তার গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে উলের বলের মতো খুলতে থাকে অবান্তর মুহূর্তের ইতিবৃত্ত যত। মুহূর্তের ভেতরেও আছে আরও মুহূর্ত। তস্য মুহূর্ত। যাত্রাপথে তাই হঠাৎ একাকার হয়ে যায়–সিঁদুরের কৌটো আর অতলান্তিকের ক্রীতদাসবাহী জাহাজ, ব্লাউজের হাতায় লালনীল এমব্রয়ডারি আর শহরের প্রান্তে জমিদার বাড়ির ফোয়ারাপরী, সিঙ্গার সেলাই মেশিনের নিঃসঙ্গ দুপুর আর পুলিশের সাইরেন। বেহায়া একুশি নই। খাতার ভিতরে নেই কোনও ছেলেদের নাম। কিংবা মেয়েদেরও নয়। তাই হয়তো অবাধ্যতার বানান নতুন করে শিখতে কোনও জড়তাবোধ হয়না। অবাধ্যতা মানে তো চোখ টান টান করে জাগতে শেখা। ঢুলতে ঢুলতে চোখে সর্ষের তেল আর আরও কত অকথিত মুহূর্তের ইতিহাস, সেইসব সংকলনার্থে ইতিউতি চেয়ে চেয়ে ফেরা। ল্যাম্পপাস্টের নীচে বৃষ্টির জলে পা ছপছপ। বাঁ গালে মা-র হাতের যে চড়ের লাল-বেগুনি দাগ, যা বহু চেষ্টা সত্ত্বেও পাঠ করতে পারি না মিছিলের যূথবদ্ধ স্লোগান বা আগুন জ্বালানোর ফ্যাকাসে অঙ্গীকার শব্দবন্ধে। তাই তো সেই বৃত্তান্তের পাঠার্থে অক্ষরের এই নিঃশব্দ সন্ধান। কোনও চিঠি লেখার নেই আর আমার মাকে। থানাগারদ থেকেও নয়। প্রবাসবাসের থেকেও নয়।

.

পাঁচ

আসলে, আমি তো খোদাই করতে চেয়েছিলাম একটি মহাকাব্য-প্রমাণ মানচিত্র। বুভুক্ষার। আমার মায়ের। হ্যাঁ, পৃথিবীতে যেখানে যত মা আছে, তাদের ভোজনেচ্ছার একটি মানচিত্র আঁকতে চাই আমি। রঙ মিলিয়ে। রেখায় রেখায় থাকবে আমার মায়ের সাবধানবাণী – বৃষ্টি পড়বে আজ বড়। ঘরেই না হয় কাটল তোর একটা দিন।

.

ছয়

কলোনির কলতলায় আঁশটে গন্ধ, আধ চিবনো সজনে ডাঁটা আর লিকলিকে লাউ ডগার বদলে।

কলোনির রান্নাঘরের দরমার বেড়া, মাটির তোলা উনুন আর ভাঙাচোরা তোবড়ানো মুখ কালিমাখা হাঁড়ির বদলে।

কলোনির শোবার ঘরের রঙচটা সুজনী, আধলা ইঁটের উপর দাঁড়িয়ে থাকা তক্তপোশ আর তেলচিটচিটে বালিশের বদলে।

কলোনির পায়াভাঙা, নড়বড়ে টেবিলে টেবিলে চটি বই, লেনিনের ছবি আর অনুদিত ম্যানিফেস্টোর বদলে।

.

সাত

দেরাজ ভর্তি শাড়ির ভাঁজে আমার মা দুঃখ খোঁজে।
মেরুন-হলুদ পর্দারঙে আমার মা দুঃখ খোঁজে।
হাত আয়নার নিটোল কাঁচে আমার মা দুঃখ খোঁজে।
আকাশরঙা দেওয়ালখানায় আমার মা দুঃখ খোঁজে।
চিনেমাটির টবে টবে আমার মা দুঃখ পোঁতে।


.
আট

ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে যেই না নিজের কান্না খুঁড়তে গিয়েছে আমার মা, অমনি টুপ থেকে রান্নাঘরের দেওয়াল ফুঁড়ে হাজির হয় সেই চালধোয়া হাত কিশোরী। চালধোয়া হাত কিশোরীর নাম নেই।চালধোয়া হাত কিশোরীর কোন মুখ নেই। চালধোয়া হাত কিশোরী খালি চাল ধোয় আর চাল ধোয়। চালধোয়া হাত কিশোরী থামতে জানে না।

চালধোয়া হাত কিশোরীর হাতের পাতায় হাজা। চালধোয়া হাত কিশোরী কোন কথা বলে না। চালধোয়া হাত কিশোরীর হাজার ফাঁকে পুঁজ। চালধোয়া হাত কিশোরী তবু থামতে জানে না। চালধোয়া হাত কিশোরীর হাতের পাতায় জ্বর। চালধোয়া হাত কিশোরী ভাঙতে জানে না। চালধোয়া হাত কিশোরী রাগতে জানে না। চালধোয়া হাত কিশোরী কখনও বড় হয় না।

.

নয়

আমি তখন নবম শ্রেণি
বাবার সাথে আড়ি।
ছাদের ঘরে লুকিয়ে বসে
ম্যানিফেস্টো পড়ি।

.

দশ

ইস্কুল থেকে ফিরে দুধের গ্লাসের মুহূর্তকাল। আমাদের বাড়ির ঘরগুলি জুড়ে তখনও চালধোয়া হাত কিশোরীর ঘুরঘুর। বাড়ির গেটের কাছে বেঁধে রাখি ওকে – গলায় পড়াই নীল ফিতের ফাঁস। তৎসত্ত্বেও, সেসব ছিঁড়ে প্রায়শই আমার বাংলা খাতা, পাঠ্যবই জুড়ে বসে ও। হয়তো বা আমারই বয়সি। কিন্তু, কোনও যে আঁচড় নেই ওর মুখে। তাই, কিছু জানা হয় না। প্রাণপণে মুখস্থ করি ওর হস্তদ্বয়ের অঙ্গভঙ্গি। কিন্তু, কী-ই বা আছে জানার। মনে রাখার। চালধোয়া ছাড়া কিছুই যে শেখেনি ও। চালধোয়া হাত কিশোরী চাল ধোয় আর আমার খাতায় চলকে পড়ে ঘোলা জল। অক্ষর ধেবড়ে যায়। সে-ই ঠিক করা। দিতে হবে ওকে কোন একটা নাম। একটা কোনও ইতিহাস। একটা কোনও গল্প।

.

এগারো

ধরা যাক ওর নাম সূর্যমুখী। আটে বিয়ে, বৈধব্য বারোয়। বালবিধবা তো, তাই বড় হয় না কখনও। দু’চক্ষে দেখতে পারে না অন্য কোনও বউ মানুষের সিঁথির সিঁদুর, পোয়াতি মেয়ের উগরে ওঠা উদর। বালবিধবা কিশোরী চায় বড় হতে। আর বড় হতে গিয়ে হতে থাকে ছোট। আরও ছোট। ছোট্ট। এইটুকুনি। হামাগুড়ি দিয়ে সিঁধোয় রান্নাঘরের দেওয়ালের ফাটলে। আর চাল ধোয়। ধুয়েই চলে। নিরন্তর। নিরবধি

.

বারো

ওমা, তোর মেয়ের জিবের ডগায়
লাগা দেখি একখান তালা।

নতুবা, বড়োই বিপদ। কখন যে ভাঙে
কোন সিন্দুকের ডালা।

.

তের

কিংবা বালবিধবা নয়। খুব পড়ুয়া কোন মেয়ে। বড় হচ্ছে এক এঁদো গাঁয়ে। মেয়ে ইস্কুল নেই। শিখেছে লিখতে চিঠিচাপাটি। হিসেব করতে পারে।আর কী হবে স্কুলে গিয়ে? বাবা বলে সপাটে। চাল ধোঁয় মেয়ে দিনরাত্রি, মুখখানি না তুলে। চালধোয়া কিশোরীরা তো ওইভাবেই রাগে।

.

চোদ্দ

সূর্যমুখী হোক বা চন্দ্রমুখী, আসলে ওর গ্রীবার হেলনে, ভ্রূভঙ্গীতে অথবা চিবুকের ভাঁজে, নেই কোন আত্মকথন।

.

পনেরো

আমার মায়ের রান্নাঘরে
সর্বসময় রক্ত ঝরে।

কড়াইয়ে সর্ষের তেলের দাগ, দেওয়ালের কোণের ঝুল তেলচিটচিটে কালি।
গাজর, বিটরুটের টুকরো, নখের ফাঁকে ফাঁকে অবাধ্য শ্রমচিহ্ন।
দ্বিখণ্ডিত রুইমাছ, মুরগীর ঠ্যাং, মাছের আঁশে, জামবাটির কানায়
গার্নেটের পুঁতির মতো।

আমার মায়ের রান্না ঘরে
সর্বসময় রক্ত ঝরে।

কেটেকুটে দু’ফালি হয় কাঁচকলা, কুমড়ো, কই, মাংসের টুকরো
আর কিছু না হোক, মায়ের আঙুল। বঁটি, ছুরি, আগুন, খুন্তি, হাতা,
আগুন, হাঁড়ি, হাতের ফোস্কা – ওসবে আমার বড় ভয়।

মা আমাকে ভয় পেতে শেখায়।
হাতের আঙুলের ভাঁজে মার মাখা ময়দার আঠা।
শুকনো খটখটে।
মার গলায় রবীন্দ্রনাথ ছোট হতে থাকেন।
যেমন ছোট হয় পটল, পেঁপে।
অন্যসবকিছু।

এ স্বরলিপি আমার মুখস্থ – টেক্সটবইয়ের একঘেয়ে
কবিতার মতন।
প্রথমে গান
তারপর শাপশাপান্ত।
মরিস না কেন তুই রাক্ষুসী?

মার পাঁচ আঙুলের মুঠোয়
আমার ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো চুল।

আমার মায়ের রান্নাঘরে ।
সর্বসময় রক্ত ঝরে।

আমি ভয় পাই।
মা আমাকে ভয় পেতে শেখায়।

কড়াইয়ে সর্ষের তেলের ছাপ,হাঁড়ির মুখে সাদা সাদা ফেনা।
দেওয়ালের কোণে ঝুল, তেলচিটচিটে কালি।
বাড়ির প্রান্তে ঘর, সিলিংয়ে নেই পাখা।
ঘর জুড়ে উষ্ণভাতের সুবাস।

মা আমাকে ভয় পেতে শেখায়।

ওই উষ্ণ সেদ্ধ ভাতের সুবাসে মার  ভয়।
মা আমায় ভয় পেতে শেখায়।
অন্ধকারের থেকেও বেশি।

ভূতের থেকেও বেশি।

(চিত্রণ – কৌস্তভ চক্রবর্তী)

1 thought on “অবান্তর মুহূর্তের ইতিহাসবিদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.