নন্দিনী ধর
কলকাতায় জন্ম, বেড়ে ওঠা, বাচাল হতে, পথ চলতে শেখা। আপাতত চাকরিসূত্রে বিদেশবাসী।
সাদা পাতার ডানদিকে একটা ত্রিভুজ। তার ঠিক নীচে লাইন বরাবর একটা চৌকো। ওইটা হলো গিয়ে তোমার একটা বাড়ি। বাড়ি মানে ঘর। বাসা। বাড়ি মানে আমার বাড়ি। বাড়ির আছে জানালা। জানালা মানে আরও কতগুলো চৌকো। পেন্সিলের ধ্যাবড়া আঁচড়। আর আছে দরজা। দরজার নীচে সিঁড়ি। সারিসারি। যদিও কোথায় যাবে এই সিঁড়ি কেউ জানেনা।
যাকগে যেখানে খুশি। খাতা আর সাদা পাতা – ওই পর্যন্তই তো তোর দৌড়। সাদা পাতার গন্ডি পেরিয়ে আর যাবি কোথায়?
সাদা পাতার বাঁদিকে একটা সরলরেখা। ঘাড় উঁচু করে নাক বরাবর আকাশের দিকে উঠে গেছে। ওইটা একটা গাছ। গাছের মাথায় সবুজ প্যাস্টেলের ছোপছোপ। ওইগুলো গাছের পাতা। বাড়ির উঠোনে কাঠি মা, কাঠি বাবা,কাঠি ছেলে, কাঠি মেয়ে। কাঠি হাতের ধরাধরি। অর্ধচন্দ্রাকার হাসি। হাসিখুশি খুশিহাসি হাসিখুশি। বাড়ির ভেতর ঘর। ঘরের পর ঘর। তস্য ঘর। সেসব কি করে আঁকতে হয়, তোর জানা নেই। শেখায়ও নি কেউ তোকে। পেন্সিলে দাগ টানার বিদ্যে তোর ওই দোরগোড়ায় এসেই শেষ। হলে কি হবে, সাধ আছে। সাধ্যটা গজিয়ে ওঠার সময় পায়নি এখনও। বাড়ির ভেতর – ভেতর পেরিয়ে ভেতর – তারও ভেতর। সে ভেতরে আছে রান্নাঘর। সেই রান্নাঘরের দেওয়ালের ধার ধরে পেন্সিলে বুলোতে চাস তুই। কারণ, জানা তো আছে তোরও। ওই ওখানে, দরকচা শসা ছেনে হয় কথাবলা পাখি। বকবক বকবক আর বকবক। ম্যাজিক। তোরও ভাগ পেতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু হলে কি হবে, তোরও আছে বিছানার তলায় বাক্সবন্দী চায়ের কাপের ভাঙ্গা টুকরো, দেশলাই বাক্সের ছবি, সিগারেটের প্যাকেটের ফেলে দেওয়া রাংতা। সেসব জুড়ে জুড়ে হবে কোলাজ এক। অনেকও হতে পারে। কঠিন নয় এমন কিছু। কোলাজ মানে তো ভাঙাচোরারই সমাহার। ধ্বংসাবশেষের টুকরোটাকরায় নকশিকাঁথা। তেলকালি, মশলাপাতির ঝাঁঝ – সেসবের চিহ্নমাত্র নেই।
বাড়ির ঘরে ঘরে একটা করে গ্যাসের উনুন। গ্যাসের উনুনে শূন্য কড়াই। তোমার মা খুন্তি নেড়ে চলেছে।রাত নামে আর মা ঝিমোতে থাকে। তোমার মা খুন্তি নাড়ে – ঝিমোতে ঝিমোতে। ঘুমোতে ঘুমোতে। ঘুমের চটকা ভাঙে আর তোর মা পাড়া মাথায় করে চিল্লোয় – একদিন নাকি সবকটা গ্যাসের উনুন খুলে জ্বালিয়ে দেবে এই বাড়ি। ঘামে ভেজা তোমার মায়ের ব্লাউজ। পিঠে ঘাম। বগলে ঘাম। মনে মনে ইচ্ছে, কাগজ ভাঁজ করে করে বানাবে একশ আটটা উড়ন্ত সারস। কিন্তু, মা’র তোমার সময় নেই। মুখে হাসি নেই। তোমার মা কারুর হাত ধরেনা। ধরবেনা। মা বড্ড রেগে আছে। মা বড় রাগী রাগী রাগী।
মা-ময় এই বাংলা। ক্যালেন্ডারের ছবিতে মা, বইয়ের মলাটে মা, লিফলেটে মা, বুকলেটে মা। মা মা মা। তবুও, ওই হঠাত রেগে ওঠা সর্বসময়ে রেগে থাকা হিস্টিরিয়াগ্রস্থ মা’র ছবি আঁকতে কেউ শেখায়নি তোকে। হিস্টিরিয়া মানে মৃগী রোগ নয়। ফ্রয়েডীয় ফিমেল হিস্টিরিয়া আর কি। তবু অবাধ্য মেয়ে তুই আঁক কাটিস। এক একেকটা পেন্সিলের আঁচড় তোর। আর মড়মড় করে ভাঙতে থাকে তোর মা। পাঁজর, হাড়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। ভাঙার শব্দে তোর যেমন নেশা, তাই মাথার ওপর তুলে আছাড় মারিস তোর মাকে। সশব্দ বিস্ফোরণে ভাঙতে থাকে তোর মা। দুই, চার, আট, ষোলো, বত্রিশ টুকরো।
বোধহয় এতদিনে ঘরবাড়িদুয়ার আঁকা শেখা হল তোর, মেয়ে। বিশেষত রান্নাঘর।
ভালো লাগল। অন্যরকম। বাস্তব…