“আমি নয়না। সামাজিক উন্নয়ন ক্ষেত্রের একনিষ্ঠ উৎসাহী কর্মী। এই কাজ শুধু আমার পেশা বা নেশা নয়, জীবনের একান্ত যাপন। রীতি-রেওয়াজের উপরে আমি হৃদয়কে স্থান দিয়ে থাকি। চোদ্দ বছরের এক কিশোরের মা। তার পড়াশুনা এবং আমার পড়া ও কাজ, আমাদের ভোজনরসিক মন, ভ্রমণ, সুফী সঙ্গীত আর সুফীয়ানা দরাজ ভালবাসা, পূর্ণ করে রেখেছে আমাদের জীবন।” – নয়না

একটা, দুটো, তিনটে মেয়ের গল্প

মাঝে মাঝে মনে হয় আমার মধ্যে দুটো, তিনটে, চারটে মেয়ে আছে
মেয়ে কিংবা ছেলে, সবসময় ঠিক ক’রে উঠতে পারি না।
কিন্তু আছে মনে হয় সত্যি।  তিন কি চার বা পাঁচ জনা…
নাকি আরও বেশ কয়েকজন? জানিনা। বুঝে উঠতে পারি না।
“দু’জন তো খুবই স্পষ্ট”, বলতেন জেঠিমা, মুচকি হেসে।
“দুপুরে আমার পাশে শুয়ে ঘুমালো একজন আর
হালকা ঘুমে আধখোলা চোখে যাকে পাঁচিলে দেখলাম, সে অন্য।”
না বোঝার ভান করতাম অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে।
আমি তো নই! শুনব কেন?
“উঁহু! ছেলেই দেখেছি গোটা তিনেক”, ঠাম্মা বলতেন দাঁত পিষে
“বোসেদের ছেলেকে ওরকম মেরে আসা কোন মেয়েছেলের কাজ বাপু?
আর ওই নেড়ির বাচ্চার পেছনে দিনরাত টই টই, খড়ি উঠছে গায়ে?
আর কেই বা দেখেছে কোনো মেয়েকে বাপের ঘাড়ে চড়ে ফুটবল দেখতে যেতে!
এর যদি একটিকেও মেয়ে বলিস, এই রইলো দন্ডবত তোদের পায়ে।”
এরকম কথা শুনে মন খারাপ করার সময় ছিল না আমার
মিলিয়ে গেছে ঠাম্মার জানা কথার একশো পনের বারের পুনরাবৃত্তি।
শুধু কি ঠাম্মারই গলায় জোর? আমার প্যাডেল-এর জোর বুঝি কম?
খানিকটা যেন গল্প হলেও সত্যি
ওই একটা, দুটো, তিনটে মেয়ের কথা।
মেয়ে? নাকি ছেলে? নাকি শুধুই মানুষ তারা?
সব গোলানো। মন ভোলানো। রঙ্গীন কাঁচের ধাঁধা?
কে ও তখনো বসেই থাকে সমুদ্দুরের তীরে?
অন্যজন ঘায়েল যখন তোমার কথার বিষে।
একজন রোজ তারায় খোঁজে মায়ায় ভরা চোখ
অন্যজনের থোড়াই  কেয়ার! আর যা বলে বলুক অন্যলোক!
একজনকার নৌকো বাঁধা খোয়াই নদীর ধারে,
অন্যজনের নদীর সাথে সদাই বিবাদ বাধে।
শহরতলির ঘরে ফেরে ক্লান্ত একজনা
অন্যজনের নেই সে বালাই।  নেইকো ঘরে ফেরা।
গল্প বলো, সত্যি বলো, যেমন মনে ধরে,
রাত্রি হ’ল অন্ধকারের সঙ্গে সন্ধি করে।

*

আমাদের অনেকের কথা
আমি বড্ড ভীতু রে, ছুটি ।  আমি ভয় পাই
তোর-আমার একটুখানি জায়গাকে,
না মুছে ফেলতে পারলে, যাদের খুশি সম্পূর্ণতা পায়না
আমি তাদের ভয় পাই।
যারা খোঁজে আমার প্রতি কথায়, কথার দোষ
কথা শেষের আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে,
লণ্ডভণ্ড করে কথার রেশ
টুঁটি টিপে ধরে যারা প্রতিটা শব্দ’র,
আর অনুভূতির …
জানিস ছুটি, তাদের আমি সত্যি  ভয় পাই।
যেমন ছোটমাসি শেষ করতে পারেন না, আমাকে শেষ করতে পারার উৎসব।
শুনছিস তুই, ছুটি? নাকি মনই নেই আর আমার দিকে?
চলতে থাকে নানান আয়োজন, বহু বছর ধরে
বারো মাসে তেরো পার্বণের মতই।
আর শান্তনু বেঁকায় আমার শব্দ,
শব্দ শিকে গাঁথবে আমায়, তাই।
ওদের দুজনকেই আমি বেশ ভয় পাই।
অনেকে আবার বড্ড ছোট করে রে।
বুঝিয়ে দেয় – আমি তাদের জন্যে কেউ না, কিচ্ছুটি না।
তোর মনে আছে, কি ভীষণ চেয়েছিলাম আমি নির্ঝরকে…
নির্ঝর বুঝিয়েছিল তিল তিল ক’রে,
আমি শূন্য, রিক্ত, “আই ডু নট ম্যাটার”
আর এটাই বোঝাতে ফিরে এসেছিল বহুবার।
আমি ওকে  ভয় পাই এখন, ছুটি।
বিভিন্ন ব্লগ, কবিতা, লেখায় দেখি, কিঞ্জল একজনকে ভালবাসে, খুব।
দীর্ঘ দিন ধ’রে  সেই ভালবাসা ঘর করে আছে ওর বুকে,
ভালো লাগে দেখে ওর ভালবাসা।
কিন্তু অবাক লাগে, সেই একই  কিঞ্জল
অন্যদের ভালবাসাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে পিছপা নয়।
আরও অনেককে দেখি রে ছুটি,যারা বলে ভালোবাসে
কিন্তু, তোর ভালোর সাথে তাদের আত্মিক যোগ নেই।
এদেরও এখন আমি ভয় পেতে শিখছি…
রোজ নতুন ছবি দেয় দীপা নিজের সন্তানের, কিন্তু,
অন্যের সন্তানের প্রতি মমতা শর্তাধীন।
শুভেন্দু রক্ষক শুধু নিজেরটুকুর, যার গণ্ডী ছোট হয় প্রতিদিন
শুধু নিজের স্ত্রী, নিজের সন্তান, নিজের মা বা বাবা
কোনদিন বা শুধুই নিজে ….স্ত্রী মিতাও তখন অন্য মানুষ।
এই ক্রমশ ছোট হয়ে আসা মানুষদের আমি ভীষণ ভয় পাই।
তুই ঠিকই বলেছিস ছুটি, আমি বড্ড ভীতু।
আমি বড্ড ভয় পাই।
*
 খুশি
আমার মাথায় কিছু বানানো খুশি আছে
সচ -নুমা। সত্যির মতো। সত্যির থেকেও সত্যি।
বছর বছর দৈর্ঘে বেড়েছে এই খুশির লিস্ট ,
যোগ হয়েছে নতুন সব খুশি
সব আমার মাথায়…
বাড়ি ফেরার খুশি, আব্বুর সঙ্গ পাবার খুশি
মা এর সাথে লম্বা গল্পের পা ছড়ানো সময়ের খুশি
শান্তির বাড়িতে স্বস্তির খুশি।
তোমার হাত ধরে সারা রাত তারা দেখার খুশি
নিঝুম রাতে খুব কাছাকাছি শুয়ে.. পিঠে নরম ঘাস।
আরো অনেক বানানো খুশি আছে আমার
তারা ভরা রাতে খাটিয়ায় শুয়ে দড়ির বুনুনির মত করে বোনা
দীর্ঘ দিন ধরে, যত্ন ক’রে, যেমন করে ফুল তোলে কুরুশের কাঁটায়
তেমনি বুনেছি আমি এই সব খুশির স্বপ্ন , এমনই মন দিয়ে
অসাবধান মুহুর্তে ভেবে ফেলি, সত্যি।
এতবার শুনেছি আমি সবার মুখে
মনে হয়েছে এই সমস্ত খুশি আমারও আছে।
একটা শীতল কোল আছে। কিছু স্নিগ্ধ দুপুর আছে।
আর আছে গাছে ঘেরা একটা মস্ত তাল পুকুর
যেখানে ডুবে যেতে মানা নেই।
শিউলি ফুল ভরা উঠোন আছে বুক হু হু করা সন্ধ্যের জন্যে।
“তুই এগো রে! আমি আছি সাথে “,
এরকমটা যেন আমিও শুনেছি মনে হয়।
মনে হয় এমন সব সত্যি হয়েছিল’
সত্যি দেখেছি তারা তোমার সাথে রাতভর
শান্তি পেয়েছি রাতের শিশিরে আর শিরশিরে হাওয়ায়।
চাইলেই আবার ফিরে যেতে পারি। যখন খুশি!
ভেবে ফেলি, সত্যি একটা ফিরে যাবার বাড়ি আছে আমার পরবাসীদের মত
সেখানে সত্যি আছে, স্বস্তি আছে। আর আছে নিঃশর্ত ভালবাসার আশ্বাস।
সচ -নুমা স্বপ্নময় খুশির এই এক ভীষন মুশকিল!
মাঝে মাঝেই সত্যি মনে হয়!
*
যাই তাহলে?
কষ্ট দিলাম? যাই তাহ’লে?
অসময়ে, অযাচিত,  এমনি এসে
দুঃখ দিলাম?
যাই তাহ’লে?
দুপুর বেলা কড়া নাড়ে
দুঃসহ সুখ।  অবোধ কারণ!
অসহ্য প্রেম। নানান  বারণ।
শোনা সবই উচিত  ছিল।
কড়া এবং কড়া শাসন।
কষ্ট দিলাম না শোনাতে?
যাই তাহ’লে?
দুঃখ পেলে, না চাওয়াতে ?
চেয়ে এবং না চেয়ে কি ক্লান্ত হ’লে?
নিজের সাথে যুদ্ধ করে, অকারণে
পাগল হলে? শান্তি গেল’? আকুল হ’লে ?
কষ্ট পেলে ? যাই তাহলে?

3 thoughts on “নয়না চৌধুরীর কবিতা

  1. মুগ্ধ হলাম। অচিন পাখিটা উঁকি মেরে গেল পঙক্তি গুলির ফাঁক দিয়ে। লিখে চলুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.