পার্থপ্রতিম মৈত্র

”মাথায় মেঘমুকুট পরে এলিয়ে বসে আছে নীল বড়াইল। কোমর জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে মাহুর আর জাটিঙ্গা নদী। তার-ও ওপারে সাইত্রিশ সুড়ঙ্গের ভয়ালসুন্দর রেলপথ পেরিয়ে বদরপুর জংশন। সেই কোন যুগে আমার কমনিস বাপ নির্বাসিত হয়েছিল বরাকভ্যালির হৃদয়পুরে। তখন থেকে কলকাতা আমার জননী জন্মভূমি হলেও বদরপুর আমার স্তন্যদায়িনী ধাইমা।
দুদশকের-ও বেশি সময় কলকাতাবাসের পর-ও আমি বদরপুরের পার্থ-ই রয়ে গেলাম। বদরপুর আমার অস্তিত্বে জড়ানো। মাঝরাতে ভূতগ্রস্থের মত ঘুম থেকে উঠে বসি। শুনতে পাই দুহাত বাড়িয়ে আমার ধাত্রীমাতা ডাকছে আয় ! আয় ! একদিকে চিতাকাঠ অন্যদিকে জাদু-পৃথিবী। একদিন ফিরে যাব। যাবই।
কিছুই তো ফেরানো হয়নি। ঋণ রেখে চলে গেলে মহাপাতক হয়। নির্বাণ হয়না। ধাত্রী-মাতৃ-ঋণ অপরিশোধ্য। আমি তো নির্বাণ চাইনা। আমি আবার ফিরে আসতে চাই। এই ভাঙ্গাচোরা, এই আদিম, অনাধুনিক বদরপুর জংশনেই। মেরী মাতার আশির্বাদে তাই আমার প্রতিটি বাক্যরচনায় প্রোথিত থাকুক আমার প্রণত ভালবাসা। আমি দ্বিজ হই, সহস্রজ হই, অথবা পঞ্চভূতে বিলীন; বদরপুর যেন আমায় স্পর্শ দেয়, ভিক্ষা দেয়। ভবতী ভিক্ষাং দেহি।”  –  পার্থপ্রতিম


 
এই সেই বঙ্গভূমি, দত্তক নিয়েছে যারে, নদী আর মাটির সংসার
সর্বনাশ ব্যপ্ত হলে, পোড়া মাটি নোন্তা জলে, ছেপে আসে ভ্রমণ প্রচার
ঘরগুলি পরিত্যক্ত, নদীগুলি মরাখাত, শরীরে শবের গন্ধ ভাসে
ভ্রমণে যেওনা, এই মন কোণে থাকো, এই ভরা মলমাসে
 
কী করে বোঝাই তাকে, আমিও বাঙালি, আর ভ্রমণ বিলাসী
বাংলাদেশে ঘরবাড়ি, উদ্বাস্তু দিয়েছে পাড়ি, ঘোর অবিশ্বাসী
হাতানিয়া দোহানিয়া, জলপথে পাড়ি দিয়া, অবশেষে ইন্ডিয়া সুদূর
অদৃষ্ট যে ঘাটে বাঁধা, দেশভাগে আধা আধা, এই সেই মায়া বদরপুর
 
বরাক নদীর নাম, তার পাশে উপত্যকা, তার পাশে ঘরের নোঙর
নদীটি যখন ভাঙে, দুই কন্যা জলে নামে, মধ্যিখানে শিব সদাগর
পরিত্যক্ত পরিচিতি, নদীজলে রাজনীতি, শরীরে মাছের মতো আঁশ
ভ্রমণে যেওনা, এই মন কোণে থাকো, এই ভরা মলমাস

.


 
এমনও তো হতে পারতো, আমি যেন তোমার প্রথম
রেল লাইন ধরে হেঁটে যেতে যেতে, দেখা হলো আমার সঙ্গেই
সবাই তো ফার্স্ট হতে চায়, কেউ ফার্স্ট হয় কেউ হয় না
 
আমি চিরকাল চলি দূরবর্তী দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ প্রেমিক
 
এমনও তো হতে পারতো, কোথাও তেমন কোন ভিলেন নেই

মাঝে মাঝে কালভার্ট, মাঝে মাঝে স্বপ্নের টানেল

সর্বত্র অ্যাসফল্ট পথে একশো চল্লিশ বেগে উড়ে চলে সুমো
প্রতিটি মূহূর্তে ভাবি এই বুঝি শূণ্যে পাখসাট
ডানা ভেঙে থুবড়ে পড়বে পাখি,
এই বুঝি ছিঁড়ে গেল সিক্ত যোনিদ্বার, এই বুঝি উদাসী খনন
এখনও ধ্বংসের চেয়ে দ্রুতগামী সেই মন আবিষ্কার বাকি রয়ে গেল
 
এমনও তো হতে পারতো, তোমার সঙ্গেই হল প্রথম মৈথুন
শুভ্র জ্যোৎস্নার জলে প্রবল হুলুস্থুলু খেলা সাঙ্গ হল আমার সঙ্গেই
আমিই প্রথম গর্ভ, আমিই প্রথম পুরোহিত, উভলিঙ্গ প্রাণী
চিরকাল দূরবর্তী দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ সারণী
 
সবাই তো ফার্স্ট হতে চায়, কেউ ফার্স্ট হয় কেউ হয় না

.


 
উনত্রিশ দিনের পর কমে এলো মারণ বর্ষণ
পৃথিবীর সব পথ মিলে গেলো এসে এই অকূল পাথারে
শুধু পথ, বাঁক পেরোলেই অন্য‌ পথ
পথের শুরু ও শেষ কখনও ছিল না, আজও নেই
 
সপ্তবিংশ শতাব্দীর পরে
তোমার পোষাকি নাম আবিষ্কৃত হলো এক বয়লার ঘরে
ইতিহাস প্রাচীন সেই বদরপুর প্রত্যক্ষ জংশন
সেখানেই জন্মমৃত্যু, সেখানেই কাব্যচর্চা, মধ্যিখানে ভূ পর্যটন
থোকা থোকা বাবরি চুল, বাঁকা ঠোঁট, লিঙ্গ আস্ফালন
সযত্নে বরফ চাপা, আড়াই হাত জমি মাপা
একুশটি নারীর যৌবন
 
তোমার রোপণ করা অর্ক বৃক্ষমূল
আজ এই একবিংশ শতাব্দীর পূর্বপাদে এসে
ডানা মেলে উড়ে গেল জাটিঙ্গা পাহাড়ে
 
হেঁটমুণ্ড ঊর্দ্ধপদে হেঁটে গেলে লংরাঙ্গাজাও
রেললাইন সমান্তরাল, নারী ও পুরুষে ভেদাভেদ
দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর, যেন খাপ পেতে বসে থাকা খাপ পঞ্চায়েত
তোমার রোপন করা অর্ক বৃক্ষমূল, তার নীচে
বয়লার ঘর, তার নীচে চিতাচুল্লী, তার নীচে সুদৃশ্য কফিন
তার মধ্যে রঙীন পোষাক, পোষাকে জড়ানো নাম
 
শিলালিপি, তাম্রলিপি, ভূর্জপত্র পাঠ
শীর্ণ এক কাব্য পুঁথি তার এক আশ্চর্য মলাট

.


 
তুমি যে সমুদ্র দিলে
তার শান্তশিষ্ট নিস্তরঙ্গ জল
এ যেন তরঙ্গভঙ্গে জলোচ্ছ্বাসহীন আর নাব্যতা বিহীন বন্দর
যেন নিরুদ্বিগ্ন শান্ত জনপদ
যেন তোমার মতই জলটলটলে চোখ
রহস্যের জটিল জঙ্গল, শব্দছকে ভাসা ডোবা
 
বয়সের মতো অগোচরে
চাঁদের কুয়াশা আলজিভ ছুঁয়ে দেয়
এর নাম ভালবাসা হলে আমি রাজি আছি
 
মাছরঙা স্বপ্নের বুদবুদ
শরীরে শেল্টার দিবি?
ভিজিয়ে দে মুখের বারুদ

.


 
চুল ভিজেছে সন্ধ্যা হাওয়ায়
চোখ ভিজেছে শোকে
এ মেয়ে স্বৈরিণী হবে
গুণে বলছে লোকে
 
স্বৈরিণী হোক, সঙ্গে যদি অর্ধাঙ্গিনীও হয়
মিডলক্লাস লোকের মনে এই একটাই ভয়

.


 
প্রথমাবধি জেনেছি তুমি অন্যপূর্বা দেবী
ভেবেছি তবু হৃদযোগাযোগ ক্রমশ সম্ভবই
 
আয়না বলো, আমার চেয়েও উদাসী কোনজন
বরাকজলে, খেলাচ্ছলে, কাহার বিসর্জন
আয়না বলো, আয়না বলো, আয়না ভাঙ্গা কাঁচে
আমার ভাঙ্গা মুখ পুড়ছে কার ঐ চিতার আঁচে?
 
ঠোঁট ভাসালে লালরাস্তায় চোখসায়রের জলে
ভর দুপুরে জ্যোৎস্না রাতের রবীন্দ্রসঙ্গীতে
অন্য পুরুষ, অন্য পুরুষ পূজাপাঠের ছলে
অন্ধকারে আবিষ্কারের খননস্পৃহায় মাতে
 
প্রথমাবধি জেনেছি তুমি অন্যপূর্বা দেবী
ভেবেছি তবু আত্মহনন ক্রমশ সম্ভবই
 
আয়না বলো আমার চেয়েও আগ্রাসী কার পাপ
কার কফিনে, কার যাপনে, আমার মনস্তাপ
আয়না বলো, আয়না বলো, আয়না ভাঙ্গা কাঁচে
আমার মুখের বলিরেখায় কাহার বয়স বাঁচে ?

.


 
নবমী পোহালো তবু তার সঙ্গে বেড়ানো হলো না
কাল বিসর্জন
 
তুমি কি কখনও ছিলে এই গম্ভীর শতকে, এই দেবীপক্ষে
একা একা ওয়ালজ নৃত্যরত? যেখানে ধানের শীষে প্রেম
যেখানে চিতার সঙ্গে প্রেম, যেখানে দেহের বিষে প্রেম
উপচে পড়ে নবমী সকালে
 
ভাঙ্গাচোরা পথ বেয়ে ভেসে যাচ্ছে কলার মান্দাস
ভাঙ্গাচোরা মন বেয়ে ভেসে যাবে ভাঙ্গাচোরা বাস
তোমার গোড়ালি জুড়ে খোল বাজে খমকের টান
অনাথদা ব্যাকুল কণ্ঠে অন্ধচোখে গীতগোবিন্দ গান
তুমি কি সময় পাবে অনুষ্ঠানে আসবার আগে
আমাকেও ডেকে নিতে?
 
বিসর্জনে ফুলে ওঠে জল
একা কি ওয়ালজ হয়? একা কি বেড়ানো যায় বল?
 
নবমী পোহালো তবু তোর সঙ্গে হলো না বেড়ানো
আজ বিসর্জন

.


 
তোমার রোপন করা সাইপ্রাস বৃক্ষের স্বর্ণমূল
দল মেলল হৃদয় আকাশে, এক মুষ্টি আতপ তন্ডুল
ফেলে দিলে ভিক্ষাপাত্রে, ভান্ড ভরে ওঠে স্নিগ্ধ দানে
জল ওঠে মাটি ফুঁড়ে , চোখে জল এ দক্ষিণায়নে
 
এ যাত্রা নিশ্চিত ছিল, শবযাত্রী প্রস্তুত দুয়ারে
তোমার রোপন করা সাইপ্রাস বৃক্ষের স্বর্ণমূল
নুয়ে পড়ল বাগানের ঘাসে, তীব্র বাঁশ কাটা শব্দ
শীতল পাটিতে ঢাকা দেহ, কার কাছে রেখে যাচ্ছো
ঘর গেরস্থালী, শূন্যোদ্যান, নির্ধনের খ্যাতি ও অখ্যাতি
আজীবন সঞ্চয়িত ভয়, নির্বান্ধব পুরী ছেড়ে চলে যাওয়া
শব্দহীন হাহাকার অনর্গল বলে চলে, এই ভাবে… এই ভাবে নয়
 
তুমি তো জানতেই বল, এভাবেই মৃত্যু আসে রোখে
হৃদয় বিদারী কান্না, নদী কাঁদে বৃষ্টিজল শোকে
পিছুটান পড়ে রইলো, উর্দ্ধটান ভেসে গেল স্রোতে
টুকরোটাকরা গল্পগাথা গেঁথে রইলো নদী ও পর্বতে
 
তোমার রোপন করা সাইপ্রাস গাছের স্বর্ণমূল
শিকড় ছড়িয়ে দিল আমাদের মমিজন্মে, নামঘর গানে
পিরামিড ঘরে ঢোকে জীবনপ্রবাহ, মৃত্যু নামে রাত্রির শ্মশানে

.


 
হেঁটে যাচ্ছি লক্ষ্য অভিমুখে
বন্ধুরাই সঙ্গে হাঁটছে এবং তাদের পরিজন
কলোনির অলি গলি, বাজারের মধ্যচ্ছদা
চৌমাথায় পাক মেরে ফিরে আসা, শবানুগমন
 
অথবা পশ্চিম বেয়ে করিমগঞ্জে চলে যাও কুশিয়ারা তটে
জানালা খুললে বাংলাদেশ, দরজা খুললে নটিখাল ব্রিজ
লঙ্গাই এর ঘোলা জলে পাক খায় অধরা সংকেত, রাষ্ট্রনীতি
অর্থহীন রেফারেণ্ডাম, অর্থহীন দেশান্তর, অর্থহীন সীমান্ত স্বীকৃতি
বুকের ভিতরে ভাষা, দারিদ্র্য ও অবজ্ঞার মেয়ে, মেঘ নয় অভেদ্য কুয়াশা
গোপন শ্রীহট্ট টান, মানচিত্র ভগবান, নদী নয় নিষেধ পিপাসা
 
শেষ ট্রেনে বদরপুরে ফেরা
বন্ধুরাই সহযাত্রী এবং তাদের পরিজন
সীমান্ত নদীর ঘাটে পাক মেরে ফিরে আসা, শবানুগমন
 
এইভাবে টিকিটহীন চলাচল বিপদজনক
মানববর্জিত এই স্টেশন চত্ত্বর জুড়ে
একা একা উড়তে থাকে উদ্বাস্তু বালক

.

১০
 
দৃষ্টির আঘাতে তার ভেঙে গেল বর্ম শিরস্ত্রাণ
আমি যোদ্ধা তাই জানি, যে অস্ত্রেই যুদ্ধ জেতা যাক
তাই ন্যায়, দৃষ্ট বা অদৃষ্টে যাই থাক
 
শরীরের বাৎসায়ন বৃষ্টিভেজা মধ্যরাত জানে
মন্দিরের দরজা ভাঙে, রক্ত ঝরে নিষিদ্ধ তর্পণে
নিষিদ্ধ সম্পর্কভেদ, নিষিদ্ধ অশ্লীল ক্রিয়াকাজ
সব ন্যায়, সওদাগর ভাসালে জাহাজ
 
দেবী পুরোহিত আমি, তাই এই বদরপুর বাস
তাই এই জংলাকালী,  যোনিচিহ্নে পূজার অভ্যাস
দেবীপক্ষে ছিন্ন শিশ্ন, খোজায়ণ, শ্বেতপুষ্পে কামনা রুধির
সর্বন্যায়, বিচারক উভলিঙ্গ, অন্ধ ও বধির

.

১১
 
ও পায়ের আলতা ছাপ, ঐ পায়ে নীলকণ্ঠ ফুল
ঐ পায়ে আনুগত্য, ঐ পায়ে জন্মের জড়ুল
ঐ পদ বোধিবৃক্ষ, ঐ পদ কাঁকড়ার দাঁড়া
ও পায়ের পাদোদক, ও পায়ের মিথ্যা ঘরে ফেরা
 
ঐ পায়ে নতজানু, ঐ পায়ে সমর্পিত মন
ঐ পায়ে পরম্পরা, ঐ পায়ে নির্ভুল চুম্বন
বুকে ঐ পদচিহ্ন, চোখে ঐ নামের গোলাপ
মুখে ঐ বিশ্বরূপ, বিস্ফোরণে ধূলার উত্তাপ
 
তোমার চরণে যদি প্রত্যাখ্যাত হই
তবে কোন সংঘে স্থান পাব আমি?

.

১২
 
এই শ্মশানটি ভালো, এই শ্মশানটি ফাঁকা
এই শ্মশানের চাতাল জুড়ে মায়ের শব রাখা
মায়ের শব, মায়ের স্তব, মায়ের অনুভব
এক শ্মশান ভালবাসা, মৃত্যু মহোৎসব
 
অবশেষে মায়ের ছবি পুষ্প আলোকনে
কিয়দ্দিন ভাসে প্রথায় কবিতা কীর্তনে
ক্রমশ সব থিতিয়ে আসে,সব কষ্টই মরে
মায়ের নতুন বাসস্থান স্মৃতির অগোচরে
 
এখন শুধু যাওয়ার  পথে শ্মশানটিকে দেখা
ওই শ্মশানের আঁচলজমি মায়ের ছবি আঁকা
এখন শুধু বাৎসরিক, এখন বিদ্ধিস্নান
জীবদ্দশায় মা পায়নি এতটা সম্মান
 
পালক ছেঁড়ে পালক ওড়ে , পালক ডানায় তীর
মায়ের মুখ হারিয়ে গেল অনেক মুখের ভীড়
মুখে আগুন, চুলে আগুন, মন্ত্রে আগুন জ্বলে
ভস্ম ভাসে, অস্থি ভাসে, তিস্যা নদীর জলে
 
একটি মাত্র প্রহেলিকা রইলো অগোচর
ঘুমের মধ্যে শুনি মায়ের ঘুম জড়ানো স্বর
প্রশ্ন তো নয়, ভয়ের আলোক দাপিয়ে মরে ঘরে
খুব কি কষ্ট হয় বাছা মানুষ যখন মরে?

.

১৩
 
জন্মান্ধ ও আংশিক অন্ধের মধ্যে যেটুকু সুতোর ব্যবধান
তুমি এলে তাও ঘুচে যায়, সঞ্চিত আলোয় টান পড়ে
সেই জ্যোতির্ময়ী আলো হতে উৎসারিত তীব্র অম্ল ঘ্রাণ
তোমার গায়ের গন্ধে মেশে
আমি বুঝতে পারি এইমাত্র তুমি
লেভেল ক্রশিং অতিক্রম করে
পা রাখলে কলোনি রাস্তায়
 
তোমাকে দেখাবো আমি কীভাবে ওই ভাঙ্গাচোরা পথ
নদীর ভাঙ্গনে অসহায় । যত তার ফাণ্ডা শুধু স্থবির ও
স্থানু ওই পাহাড়ের সানুদেশ জুড়ে। তুমি ভাবলে পুরুষের
হৃদয়দৌর্বল্য আর মেয়েটির সর্বনাশ আশা, দুই মিলে ভালবাসা হয়
 
তুমি তো দেখনি শেষবার মাইগ্রেংডিসার কাছে
ধ্বসে গেল নির্জন পাহাড়, যেন ফিরে গেল অতীত জঠরে
এখন সেখানে খাদ অতলান্ত, যোনিপথ বিপদসংকুল, শ্বাপদ প্রহরা
এড়িয়ে তোমাকে আমি নিয়ে যাব, যেখানে শরীর মেশে অপেক্ষ শরীরে
আমি তো তোমার পাশে শুয়ে থাকি সংজ্ঞাহীন মৃত্যু অধিকারে
 
তক্ষকের ডাক শুনে কেঁপে উঠি কংক্রিট বাসরে,
আমি তো তোমার পাশে শুয়ে থাকি সংজ্ঞাহীন মৃত্যু অধিকারে
সারারাত মৃত্যু শুধু বিলি কাটে চুলে, মৃত্যুস্পর্শ পাই
সেই সে প্রচণ্ড ইচ্ছা, রোমহর্ষ আজ আর নাই
আমি তো তোমার ঘরে যাই শুধু সুরাসিক্ত মৃত্যু অভিসারে
 
অপেক্ষায় থাকি
তোমাকে শেখাবো, কবে কীভাবে বাঁধতে হয় কলার মান্দাস
শোনাবো তোমাকে এই কলোনির ঘরে ঘরে মনসামঙ্গল পুঁথি পাঠ
দেখাবো শ্রাবণ জলে, ভেজা পথে হিলহিলে, সাপেদের ফণা আন্দোলন
সব পথ মিশেছে জংশনে। রাস্তা যায়, কোনও রাস্তা ফিরে ফিরে আসে
তোমার শরীর জুড়ে কবিতার নদী বয়, আমি ভাসি কলার মান্দাসে

.

১৪
 
হে যীশু তোমার কাছে কোনদিন চাইনি কিছুই
 
আতঙ্কে উদযাপিত যে কয়েকটি রাত মাত্র বাকী
আমি যেন বদরপুরে থাকি
 
যেভাবে গোপন ভয়ে শিউরে ওঠে হাত আর পায়ের আঙ্গুল
গৌতমবাহিনী আসে হেঁটে যায়, শুধু প্রত্যক্ষ বুটের শব্দ ঘাসে
হাইলাকান্দি-বদরপুর, বাসরুটে বহুদূর, ট্রেনে গেলে দুই মহাদেশ
আমাদের শিরদাঁড়া, স্থিতিস্থাপকতা ছাড়া, বোধিসত্ত্ব প্রণম্য আবেশ
 
যেভাবে গোপন গর্তে শিউরে ওঠে শহরের অটোমোবাইল
দিদির ভাইয়েরা আসে, হেঁটে যায়, কবিতার পচা গলা লাশে
শব্দপিক ফেলে, ধর্ষণ আর সঙ্গমের ভেদাভেদ রেখা লুপ্ত হয়
আমাদের ক্লীবলিঙ্গ, স্থিতিস্থাপকতা জাড্যে চিন্তার দুয়ারে দেয় খিল
 
পাদ্রীঘাটা গিলে খাচ্ছে নদী, ক্রমে চার্চের জমিতে পড়ে টান
ওহে ক্যাথলিক প্রভু, তোমাকে বিশ্বাস করি, অদ্ভুত বাংলায় করি গান
প্রতি নির্বাচনপর্বে, ধর্মনিরপেক্ষ গর্বে, সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক হাসে
তারপর বিশুগুণ্ডা, কালীপূজা, ঝান্ডিমুণ্ডা, রাঙ্গাজবাকুসুমসংকাশে
 
হে যীশু স্বীকার করি, হিন্দু হয়ে যদি মরি, শশ্মানে প্রবল জ্বলবে চিতা
দাহ্য দেহ দাহ্য মন, ভাবনায় উচাটন, তার চেয়ে কফিন ভাল পিতা
 
ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে ঝিঁ ঝিঁ অন্ধকার, ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে ত্রাস
তবুও প্রার্থনা এই, তবুও নিশ্চিত হোক, মৃত্যু অবধি বদরপুর বাস

.

১৫
 
বিছানা এবং শরীরময় ভালবাসার ধুলো
পরাগরেণু ঠোঁটের রঙে জিভেতে মিশছিল
রূপালী তার শরীর এবং দীপালী তার চোখ
নিদানকালে বলেছিল আলোয় আলো হোক
 
কিছু কিছু রতি মুদ্রা সে জানে আর জেনেছিলাম আমি
শ্লীল অশ্লীল উন্মাদনায় বরাকভ্যালী সম্ভাবনাগামী
ফুল ভেঙেছে, কূল ভেঙেছে, গর্ভ ভাঙা জল
নিদানকালে পাহাড় জুড়ে বর্ষা নদীর ঢল
 
উলঙ্গ দুই নারী পুরুষ বহুগমন সুখে
প্রসব করে ভালবাসা সভার সম্মুখে
ক্ষিপ্ত সমাজ, ক্ষিপ্ত রাষ্ট্র, ক্ষিপ্ত বিচারক
ভালবাসার নাম দিয়েছে মাতৃহন্তারক

1 thought on “বদরপুর জংশন – দ্বিতীয় কিস্তি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.