মিত্রাভ ব্যানার্জি‌

বুনুয়েলের পানুয়েল অপবাদটি অলীক! তার সঅব ‘বই’ই লটঘট অ্যাঙ্গেল থেকে ক্যামেরা কর্ম নয়। আরো জানতে পড়ুন…পড়ুন…পড়ুন… – মিত্রাভ

সেই প্রচ্ছন্ন চাহিদার বস্তুটি
that obscure object of desire
লুই বুনুএল

(‘জনমেজয়ের প্রশ্নের উত্তরে বৈশম্পায়ন কহিলেন এই অংশটি ভবিষ্যতে মুখবন্ধ হিসাবে পরিচিতি পাইবে’)
প্রাথমিক সমস্যাগুলির সমাধান করে নিই আগেভাগেই:
সমস্যা ১। যা বলার, বক্তব্য যা, তা পষ্টাপষ্টি করে বললেই হতো। প্রথমে সিনেমা দেখো রে, অতঃপর ক্ষীণকটি কিরীটকের মন্তব্য গাঁতাও রে, এ অপচয় কেন? আমার ব্যক্তিগত ধারণা মানুষ স্বভাবত নেতিবাচক। কঠোর সত্যি কড়া করে বললে মানুষ ছিলায় অছিলায় তা প্রত্যাখ্যান করে। যে বলে কোলকাতা জঞ্জাল আস্তাকুঁড়, তাকে আমরা এন আর আই বলে খেউড় করব, যে বলে লন্ডনের বাসের রঙ লাল, তাকে আমরা এম সি, বি সি, মায় নিরোধ সি বলতে বাকি রাখবো না। এমতাবস্থায় প্রচ্ছন্নর বদলে প্রকট চাহিদা নিয়ে জলকেলি কল্লে তার গণ্ডদেশের জন্য যে মিষ্টি চুম্বন অপেক্ষা করে নেই, সে কথা খোলসা করে না বললেও চলে। মনে হয়, এই আবিষ্কারের স্বত্ত্ব যীশুবাবার। সে যে ওই মধ্য প্রাচ্যের গরমে ঘেমে নেয়ে অত অ্যাকটো কল্লে, কেন কল্লে? জিউ মন্দিরের বাবাজিরা ধত্তে পাল্লে যে তার কবলীতে কাতুকুতু দেওয়া হবে না, সে বিলক্ষণ তার জানা ছিলো। যিশু যুদ্ধ কত্তে পারতো। অনুগামীর সংখ্যা কিছু কম ছিলো না তার জীবৎকালেই। যিশু জিউ মন্দির, উন্মাদ হেরড, মেরুদন্ডহীন পেলতিয়ারকে পালটে নিজে ক্ষমতাসীন হতে পারতো। সেকথা জিজ্ঞেস কত্তে যিশু তার আলখাল্লায় হাত মুছতে মুছতে বললে ‘বেটা, যদি তোমার বউকে বলি, যে বউ তোমার সাথে বিশ বচ্ছর ঘর কচ্ছে সুখে দুঃখে, যদি সত্যি কথাই বলি, যে তুমি লম্পট, তুমি ছবি আঁকা পছন্দ করো না, গান গাওয়া পছন্দ করো না, তবে ফুটফুটে নিষ্পাপ মেয়েটি ভাববে হয় আমি উন্মাদ, নয় আমার কোনো বদ মতলব আছে। ব্যাস। কেস শু-ৎ-zপা হয়ে যাবে। তাচ্চেয়ে ভালো আমি কি করবো? প্রথমে আমি একটা গান বাঁধবো। তোমার বউকে শুদ্ধ কড়ি মিলিয়ে শোনালে তার মনে হবে বাহ! গান ব্যাপারটা তো দারুণ। এরপরে তোমার সভায় গান শোনাতে গেলে তুমি আমার জিহ্বা কর্ত্তণ করবে। তখন আমি কি করবো? আমি তুখোড় একখানা ছবি আঁকবো, তোমার বউ প্রুশিয়ান নীলে মাতোয়ারা হবে। তোমার সভায় সর্বসমক্ষে তুমি তাপ্পর ছবিটি তো ছিঁড়ে ফেলবেই, আবার আমার অঙ্গুলি ছেদন করিবে। তখন…প্রিয় তখন…বিসর্জন নাটক মঞ্চস্থ হবে। বৌমণির মনে হবে এত অক্ত কেন? আরে বাবা এতনা খুন কিঁউ হ্যায়? তখন তোমার প্রতি বিশ্বাসে তার ফাটল ধরবে।’
এর ১৯৭৭ বছর পরে বুনুয়েল তাঁর অঙ্গুলি জিহ্বা ত্বক না হোক, শ্রবণশক্তি বিসর্জন দিয়ে সামান্য ফাটলটুকু আমাদের উপহার দিলেন।

সমস্যা ২। সুররিয়েল কেন? দালির সাথে এক পেয়ালায় মাল খেলেই রিয়েল দূর করে দিতে হবে? এই ছবিতে অনেক চেষ্টা করেও আমি হেন নির্বোধও সুররিয়েলিসম-এর পরমাণুটুকু খুঁজে পেলুম না। মৌল যৌগ যা আছে তা অ্যালেগোরিকাল, রূপকধর্মী। ব্যক্ত করে বলি, কথা দিচ্ছি নাজারেথ অবধি যেতে হবে না। ধরুন কোনো বসার ঘরে মেহেফিল জমেছে। কতিপয় পুরুষ মহিলা আলাপরত। অফুরান সুরা। মদির দৃষ্টি। সবার মুখে মোহময় আবেশ। একটা ছবি মাথায় আসছে কি? কোনো ফোটোগ্রাফার এই স্থিরচিত্র তুলে দুর্দান্ত ফোটোশপে মহিলাদের পোষাক খসিয়ে নিলেন। বিবস্ত্র করলেন। বাকি ঘর, নরম পর্দা, পুরুষ, দারুর পেয়ালা এমনকি সকলের ঢলো ঢলো ভাব সবই অক্ষুণ্ণ রইলো। সাধারণ স্থির চিত্র বাঙ্ম‌য় হয়ে উঠলে। এখানে বক্তব্যটা তীব্র। কিন্তু তার প্রসার সীমিত। এই ছবিটি রূপকধর্মী। অ্যালেগোরিকাল। এবার ফের প্রথমের পোষাক পরিহিত শ্লীল স্থিরচিত্রে ফিরে যান। ফের সেই ফোটোগ্রাফার। ফোটোশপে তার দক্ষতার পরিচয় আমরা আগেই পেয়েছি। এবার মহামহিম তাঁর ক্ষমতাবলে এই ঢলো ঢলো মদিরামেদুর নারীপুরুষদের তাদের মাঝখানের সাত কোর্সের টেবিল সোফা কাউচ শুদ্দু স্থাপন করলেন একটি হিম ঘরের নেড়া নিয়ন আলোয়। চাদ্দিকে কেবল থাক থাক নম্বর লেখা বাক্স। ছবিটির পরিবর্তন হলো। এর বক্তব্য তখন তত তীব্র নয় কিন্তু সুদূরপ্রসারী। নিন্দুকেরা একে সুররিয়েল বলতে পারেন। এই ছবিতে বুনুয়েল সকলের পোষাক খুলেছেন রূপকার্থে। আর ভুলে যাবেন না তাভারিশ, এটা পরিচালকের শেষ ছবি। ফিল্ম জগতের পরিমাপেই বুনুয়েল তদ্দিনে পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ় প্রায় । ততদিনে আমরা যা রূপক ঠাউরাচ্ছি তা তাঁর মজ্জায় মজ্জায় থিতু হয়েছে মাতৃভাষার মত।

গল্প আপাতদৃষ্টিতে সাধারণই। স্পেনসহ অর্ধেক ইউরোপ তখন কমিউনিস্ট আন্দোলোনে টালমাটাল। এর মধ্যে স্পেনের একটি ছোট শহরে পরপর দুটি লক্ষণীয় ঘটনা ঘটে। একটি গাড়িতে বিষ্ফোরণ হয়। নাশকতামুলক – কমিউনিস্ট-সন্ত্রাসবাদী বিষ্ফোরণ। যাত্রী, চালক শুদ্দু। (যাত্রীর ভূমিকায় বুনুয়েল-এর ক্যামিও রান। এটাই তাঁর শেষ ছবি। তাই নিজেকে আগুনে ধোঁয়ায় ভূমিকম্পে মিশিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো কিনা জানি না) আর শহরের ট্রেনস্টেশনে সেই মূহুর্ত্তে ছোট্ট একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। দৃশ্যতঃই আহত, বিস্রস্তবসনা এক তরুণী, ট্রেনের পাদানিতে আসীন এক প্রৌঢ়ের পা টেনে ধরে তাকে যেতে বাধা দেয়। মিনতি করে। প্রৌঢ় কঠিন-শীতল মুখে মেয়েটির গায়ে এক বালতি জল ঢেলে দেয়। দর্শকদের উৎসাহ আরো ঘনীভূত হয়, যখন দেখা যায় সেই প্রৌঢ়ের প্রথম শ্রেণীর ক্যুপে প্রায় সকলেই কর্ম বা সামাজিক বৃত্তের সূত্রে একে অপরের সামান্য পরিচিত। আধোচেনা সহযাত্রীদের কৌতূহলের উত্তরে প্রৌঢ় নিজে থেকেই এই নাটকের পেছনের কাহিনীটি বলতে সম্মত হয়।
প্রৌঢ়ের নাম ম্যাথিউ। সে প্যারিসের প্রোথিতযশা অমিতকাঞ্চন আইনজীবি। মেয়েটির নাম কনচিতা। জন্ম স্পেনে, কিন্তু বর্তমানে ফ্রান্স-অভিবাসিনী, তার বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতো। প্রৌঢ় মেয়েটির প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাকে রাত্রিবেলা শয়নকক্ষে ডেকে পাঠায় এবং প্রায় খোলাখুলিই তার অনুভূতির কথা ব্যক্ত করে। জোর করে চুম্বনের চেষ্টা করলে কনচিতা মৃদুভাবে তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এবং পরদিন সকালে চাকরি ছেড়ে চলে যায়। এর কিছু বছর পরে নাটকীয় ভাবে দুজনের দেখা হয়। এবং তারা অদ্ভুত এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি কনচিতার ভূমিকায় একজন নয়, দু’জন অভিনেত্রী অভিনয়রতা। ম্যাথিউ ও কনচিতার মধ্যে প্রেমের জোয়ার এলেও ম্যাথিউ বহুবারের চেষ্টাতেও শারীরিক সম্পর্ক তৈরীতে মেয়েটিকে রাজি করাতে পারে না। সে উপহারের বন্যা বইয়ে দেয় মেয়েটিকে খুশি করার জন্য। মেয়েটি সেসব উপহার প্রত্যাখ্যান করে। ম্যাথিউ কিছু পয়সা দিয়ে কনচিতার মায়ের কাছ থেকে (পড়ুন মা-কে হাত করে) কনচিতার পাণিগ্রহণের অনুমতি চাইলে তার প্রত্যাখ্যান তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এমনকি কনচিতা নিজেকে একধরনের চেসটিটি বেল্ট পরিয়ে রাখে যৌন মিলন অসম্ভব করে তুলতে। শারীরিক মিলনের প্রতি মেয়েটির এই বিতৃষ্ণা কখনো মনে হয় জেদ, কখনো ছেনালি (ছেনালি কি ছলনার বর্ণবিপর্যয়?)। ফলে বিপত্নীক, মাঝবয়সী, যৌনসংসর্গলোভী দুঁদে আইনজীবি ম্যাথিউ-এর পরাজয়ের রোষে পড়ে মেয়ে এবং তার মাকে ফ্রান্সছাড়া হতে হয়। ফের কিছু বছরের বিরতি এবং আবার এক নাটকীয় মোড়ে তাদের দেখা হয় স্পেনে। পুনরায় প্রেম। এবারে কনচিতাকে নতজানু করতে ম্যাথিউ সর্বস্ব বাজি রাখে। গোটা একটা বাড়ি উপহার দেয় তাকে। ফল হয় উল্টো‌। কনচিতার প্রত্যাখ্যান তীব্রতম পর্যায়ে পৌছয়। এতদিন শারীরিক সঙ্গমে অনিচ্ছুক কনচিতা অন্য এক পুরুষের সাথে যৌনক্রীড়ায় মাতে, তার প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক ম্যাথিউ-এর সামনেই। সেই রাতেই ম্যাথিউকে ট্যাক্সি থেকে টেনে নামিয়ে বন্দুকের ডগায় তার গাড়ি কেড়ে নেয় দুজন বিপ্লবী।
কনচিতার চরিত্রে একপ্রকার অনিশ্চয়তা আগে থেকেই প্রকাশ পেয়েছে। এবার কাহিনীর মোড় ঘুরিয়ে দিতে পরদিন কনচিতা উপস্থিত হয় ম্যাথিউ-এর হোটেলে। কিন্তু অপমান করতে নয়, ক্ষমা চাইতে। সে দাবী করে তার আগের রাত্রের ক্রীড়াসঙ্গী পুরুষটি সমকামী। এরপরে বিধ্বস্ত, পরাজিত ম্যাথিউ তার জন্য ঘা-কতক প্রহার বরাদ্দ করে। এবং শহর থেকে নিজের প্যারিসে ফেরার টিকিট কিনে আনতে যায়। হোটেলে ফিরে এসে আবিষ্কৃত হয় অগোছালো ঘর, পরিত্যক্ত প্রস্রাব-কলঙ্কিত অন্তর্বাস। শহরে বিষ্ফোরণ। ট্রেনে ওঠার সময়ে ফের কনচিতার আবির্ভাব, এবং তাকে জানলা দিয়ে দেখতে পেয়ে ম্যাথিউএর অদ্ভুত সিদ্ধান্ত।
ম্যাথিউ-এর বর্ণনা শেষ হওয়া মাত্র প্রথম শ্রেণীর কামরায় কনচিতাকে দেখা যায়। এবং একটি মধুর কলহের মধ্যে দিয়ে মিলনাত্মক অন্ত।
তবে এর পরে কাহিনীর একটি তুখোড় উপসংহার আছে। সে কথায় যথাসময়ে আসা যাবে। প্রথমে খটকাগুলো পরিষ্কার করা যাক।

খ ১। প্রচ্ছন্ন কেন? অবস্কিওর কই? মাঝবয়সী বিপত্নীক ম্যাথিউ-এর তরুণী সুন্দরী কনচিতাকে দেখে হৃদয় উদ্বেল হওয়ারই কথা। এতে ঝাপসা, অপরিষ্কার-টা কি? প্রথম রাতে যখন ম্যাথিউ কনচিতাকে তার শয্যাকক্ষে আমন্ত্রণ করে, জোর করে, তখন কনচিতা রাজি হয়নি ঠিকই, কিন্তু সে কুইমারী তরুণীর লজ্জা বা ভয় থেকে হতে পারে। কনচিতার প্রত্যাখ্যান ছিলো মৃদু। স্মিত হেসে ম্যাথিউকে সে বলে তার শোবার সময় হয়ে গেছে। কারণ এই আমন্ত্রণ, তাকে বুকে টেনে নেওয়া, পুরোটাই শারীরিক, বন্য, স্বাভাবিক। প্রকট চাহিদা। ছবিটিতে ম্যাথিউকে কামাতুর বললে ভুল বলা হবে। সে অর্থের জোরে গণিকা ভাড়া করে তার কাম তাড়না নিবারণ করতে পারতো। কিন্তু তার প্রয়োজন কনচিতাকে; কেবল তাকেই। এর পরের সাক্ষাতে ম্যাথিউ কনচিতার জন্য উপহারের পর উপহার নিয়ে যায়। তাকে, তার মা-কে প্রায় না চাইতেই টাকার তোড়া হাতে গুঁজে দেয়। সে কি ভালোবাসার জন্য? এখানেই আমার দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করে জনাব। ভুলে যাবেন না, ছবিটি কমিউনিস্ট আন্দোলনের পটভূমিকায়। এই দান, উপঢৌকন সত্যি সে কি ভালোবাসার জন্য, নাকি উচ্চবিত্ত অসুন্দর মধ্যবয়সী পুরুষের নিজেকে তারুণ্যের সামনে নিঃস্ব মনে হওয়ার জন্য – যে তরুণকে দেওয়ার মতো বস্তু বলতে তার কেবল অর্থই সম্বল? নাকি নিম্নবিত্ত নারী তার দাবী অবমাননা করায় উচ্চবিত্তের নিজের পেশী আস্ফালন? তখনো কনচিতা সেই উপহার-অর্থ অস্বীকার করছে। অতঃপর ম্যাথিউ তার মায়ের হাতে মোটা কিছু অর্থ গুঁজে দিলে (প্রচ্ছন্নে, ভারী গোপনে মহানুভব) কনচিতার মনে হয় সেটা ম্যাথিউ-এর তাকে অধিকারের চেষ্টা। নারীকে পুরুষের, বিত্তহীনকে অমিতবিত্তের অধিকার।
শারীরিক সম্পর্কের দাবী কনচিতা ফিরিয়ে দিলো বারংবার। বললো তার পা, জানু, জঙ্ঘা, উরু, কটি, স্তন সব, সব সে দিয়েছে। খালি তার কুমারিত্ব তার নিজের। ম্যাথিউ উন্মাদপারা হয়ে যায়। কেন জাহাঁপনা? কেবল স্নায়ুসুখের বিচ্যুতি হলো বলে? নাকি যতক্ষণ না যোনি-যৌনাঙ্গের আলাপ হচ্ছে, যতক্ষণ না চাদরে রক্ত লাগিয়ে দিতে পারছি ততক্ষণ সে নারী যথেষ্ট আমার, যথেষ্ট অধিকারগত হলো না বলে? অন্তরে সূচ ছুঁয়ে যায়। বাণিজ্যিক ছবিতে এত দরিদ্র পুরুষের সাথে উচ্চবিত্ত নারীর (বা তার উল্টো‌) প্রেম, বেডসীনের আধিক্য কেন? আমরা ক্ষীণবাস পরিহিতাদের, পরাজিত দেশের নারীদের, কাশ্মীরে ‘লেড়ে’ আর উত্তর-পূর্বে ‘চিঙ্কি মাগি’দের নিয়ে ফূর্তি করেছি কেবল অঙ্গসুখের আশ্বাসে? সেইসঙ্গে সে দেশ সেই সামাজিক, অর্থনৈতিক স্তরকে নতজানু করা গেল সেই বিশ্বাসে নয়? শেষে ম্যাথিউ-এর অধিকারের চেষ্টা চরমে উঠলে কনচিতার প্রতিরোধও তীব্র, অসুস্থ আকার নেয়। সেই প্রত্যাখ্যানে যে প্রতিরোধ, মায় প্রতিহিংসাও মেশানো, তা প্রমাণ করতে মাঝরাস্তায় দুই কমিউনিস্ট বিপ্লবীর হাতে ম্যাথিউ-এর হেনস্তা হওয়াটি অতিনাটকীয়।
তাহলে শেষে কনচিতা অত কাকুতিমিনতি করতে গেলো কেন? একদম যমের পায়ে পড়ে সাবিত্রীর মতো নালেঝোলে অবস্থা! একসময় হয়তো কেবল চমকের লোভে তৈরী এই অংশটিকে আমার চিত্রনাট্যের সবথেকে দুর্বল অংশ বলে মনে হয়েছিলো। এতক্ষণের দৃঢ়তা, অনমনীয়তা হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে বাধলো না পরিচালকের? নাকি পরিচালক বলতে চাইলেন ভবিতব্য এই। নারীর, সংখ্যালঘুর, প্রতিবন্ধীর, নিম্নবিত্তের দৃঢ়তার বাঁধ আসলে ভঙ্গুর! ছবির উপসংহারের (যেখানে আমরা যথাসময়ে আসব) দিকে তাকালে বোঝা যায় এই ভেঙ্গে পড়াটুকুর প্রয়োজন ছিলো।
খ ২। ফিল্মটি কি তবে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টুন? প্রোপাগান্ডু বানানোর কল? সব চরিত্রই ঘ্যানঘ্যানে স্টিরিওটাইপ। আরে কনফ্লিক্ট কোথায় গেল? ছবিতে কনচিতা আর কনচিতার মায়ের নামদুটো লক্ষ্য করবেন। কনচিতার আসল নাম ‘কনসেপশন’, আর তার ধর্মপ্রাণ মায়ের নাম ‘ইনকারনেশন’। অর্থাৎ মায়ের যা হইবার কথা ছিলো আর মা যা হইয়াছেন! কনচিতার মা প্রবীণা কিন্তু কর্মক্ষম! অথচ তিনি তাঁর সময় অতিবাহন করেন চার্চে। মেয়ের বন্ধুমহল নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার সীমা নেই, কিন্তু তাঁর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতেই অচেনা প্রৌঢ় ম্যাথিউ-এর সাথে মেয়েকে এক ঘরে ছেড়ে যেতে তিনি দ্বিধা করেন না। কারণে অকারণে নানা উপায়ে বরং আরো বেশী অর্থ যাচনা করেন ম্যাথিউ-এর কাছ থেকে। এমন কি অর্থের বিনিময়ে মেয়েকে তিনি ম্যাথিউ-এর বাড়িতে নিয়ে আসতেও সম্মত হন। প্রেমে, কামে মতিভ্রষ্ট ম্যাথিউ-এর কাছ থেকে লোভী পথভ্রষ্ট নিম্নবিত্ত মহিলার অর্থ নিষ্কাশনের দৃশ্যে ইঁদুর কলে ইঁদুর পড়ার ঘটনাটি অতিনাটকীয় মনে হতে পারে। কিন্তু জাহাঁপনা, ইঁদুরটি কে এবং কলটি কার সে প্রশ্নটিও দোদুল্যমান থেকে যায় যে।
নাম বিপর্যয় অবশ্য এখানেই শেষ নয়। আর্জেন্টিনিয়ান স্প্যানিশে কনচিতা একপ্রকারের খিস্তি। আমেরিকানরা যে অর্থে ‘পুসি’ শব্দটি ব্যবহার করেন, সেই অর্থে। ব্রিটিশদের ‘কান্ট’ খিস্তির সাথে গোলালে চলবে না। কনচিতা বলে গাল পাড়ায় বিরানব্বই সালে রিকার্দো বারেদা শটগান সহযোগে তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের হত্যা করেন এবং অনুতাপস্বরূপ আর্জেন্টিনার সুবিখ্যাত ওয়াইন পরিত্যাগ করে বিয়ার সেবনে রত হন। এখন এই ভাষাতত্ত্ব বুনুয়েল-এর জানা ছিলো কিনা, এবং থাকলেও তিনি এই সিনেমায় সূক্ষ্ম ‘জেন্ডার-কনফ্লিক্ট’-এর আবহাওয়া তৈরী করতে সেটি ব্যবহার করেছেন কিনা, আজ আর জানার উপায় নেই।
খ ২.৫। ছবিটির ভিত্তি কি? ‘জেন্ডার কনফ্লিক্ট’ নাকি ‘ক্লাস কনফ্লিক্ট’? আমার ধারণা, যে কোনো সময়ের ছবিতেই…মস্তিষ্ক থেকে বানানো ছবি আর কি…নারীসংক্রান্ত তিনটি প্রবণতা প্রবল:
১। পুরুষের নারীকে পণ্য মনে করার এবং নারীকে ব্যবহার করার প্রবণতা;
২। নারীর নিজেকে পণ্য মনে করার এবং নিজের ব্যবহৃত হওয়া মেনে নেওয়ার প্রবণতা;
৩। “পুরুষের নারীকে পণ্য মনে করার প্রবণতা” টের পেয়ে নারীর নিজেকে চালকের আসনে অধিষ্ঠিত করার প্রবণতা। (পণ্য হিসাবে নিজেকে ব্যবহার করে বা না করে);
এই ছবিতে বুনুয়েল সম্ভবত দেখালেন যে শ্রেণী-দ্বন্দ্ব বা ‘ক্লাস কনফ্লিক্ট’ও প্রায় একই ভাবে কাজ করে। দুটো ‘কনফ্লিক্ট’-এরই কারণ মূলত ক্রোধ। ক্রোধের মূলে অনিশ্চয়তা।
ব্যক্ত করে বলার জন্য বুনুয়েল-এর আরো একটি ছবির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। (আমার ব্যক্তিগত ধারণা যত সময় যায়, মানুষ, শিক্ষক, সঙ্গীতকার, পরিচালক, সকলেই তাঁদের আগের সৃষ্টিগুলির বিপরীত বা বিরুদ্ধ না হোক, অন্তত সেগুলির থেকে আলাদা কিছু তৈরী করার চেষ্টা সচেতন ভাবে করে থাকেন। তাই সৃষ্টির স্পেকট্রামে কোনো চিত্রপরিচালকের সৃষ্টির ‘উদ্দেশ্য’ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। তাছাড়া এই প্রবন্ধ বুনুয়েল বা তাঁর সৃষ্ট নারীজগতকে সামগ্রিক ভাবে পর্যালোচনা করার জন্য নয়, তবু সাহায্য নিতেই হচ্ছে)
‘ভিরিদিয়ানা’ ছবির কথা বলছি। শুদ্ধাচারিণী ভিরিদিয়ানা। কাকা তার প্রেমে পড়ে কারণ ভিরিদিয়ানার মুখশ্রী তার কাকিমার সমতুল্য। ভিরিদিয়ানা প্রত্যাখ্যান করলে কাকাটি আত্মহত্যা করে। মিটে গেলো। পাতি কাম আর বৃদ্ধ বয়সের যষ্টির প্রত্যাশা ছাড়া এতে আর কোন প্রবণতা নেই।
কাকার ছেলে জর্জ তার বাপের সম্পত্তির দখল নেয়। ধুন্ধুমার এখান থেকেই। ভিরিদিয়ানা কিছু গরীব, প্রতিবন্ধী আর আজ্ঞে হ্যাঁ অকর্মণ্য ভিখারিদের কাকার বাড়িতে আশ্রয় দেয়। জর্জ তাদের মধ্যে থেকে শ্রমজীবী অর্থাৎ কর্মণ্য গরীবদের ওপর কর্তৃত্ব ফলিয়ে বাপের এস্টেটের রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করে। অর্থাৎ সেই ‘কনসেপশন’ এবং ‘ইনকারনেশন;-এর দ্বন্দ্ব শুরু হলো। লক্ষ্য করুন জর্জ ও ভিরিদিয়ানা দুজনেই কিন্তু পরিচালকের আসনে বসে। ভিরিদিয়ানা তার নারীর ‘সহজাত’ মমত্ত্ব আর শুদ্ধাচারী ভাবমূর্তি ব্যবহার করে, আর জর্জ কাজে লাগায় তার কঠোর ধনতান্ত্রিক প্রফেশনাল ভঙ্গী। এটা ছবিটার একটা দিক। জর্জ এবং ভিরিদিয়ানা একে অপরকে তাদের শ্রেণী-অন্তরের মানুষদের প্রতি ব্যবহারের জন্য তাচ্ছিল্য করে। ছবির শেষে ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। ভিরিদিয়ানার ভিখারিরা বাড়ি খালি পেয়ে সেখানে তাণ্ডব চালায়, চুরি করে, এবং সর্বোপরি ভিরিদিয়ানাকেই ধর্ষণের চেষ্টা করে। অন্যদিকে জর্জের শ্রমিকরা দেখা যায় তার প্রতি আনুগত্যে অটল। এই অংশের সাথে নারীবাদ-বিবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা সমতাতন্ত্র নিয়ে বুনুয়েল-এর চিন্তায় আরেকটি ‘অ্যাঙ্গেল’, যেটি অবশ্যই ‘অবস্কিওর অবজেক্ট’ ছবির থেকে খানিকটা আলাদা। সেখানে ইনকারনেশন, অর্থাৎ কনচিতার মায়ের বর্ণনার সাথে ভিরিদিয়ানার ভিখারীদের বর্ণনা মেলে কিন্তু কনচিতা স্বয়ং আবার জর্জের শ্রমিকপন্থার বিরোধী।
এবার মহিলাদের বর্ণনায় আসা যাক। কাকামশাইয়ের ভিরিদিয়ানার প্রতি দৌর্বল্যটি ‘লিবিডো’জ। বুনুয়েল-এর আগামার্ক ধরন মানুষের যৌন স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার। বোঝা গেলো। এরপরে জর্জের প্রবেশ। জর্জ প্রথমে আকৃষ্ট হয় ভিরিদিয়ানার প্রতি। কারন ভিরিদিয়ানা সুন্দরী, সমবিত্তবৃত্তের, এবং সহজলভ্যা নন। ফ্রয়েড এতে ইনসেস্টুয়াস অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেতেন কিনা জানি না, কিন্তু জর্জের প্রেমিকা সেই অপরাধে জর্জকে প্রত্যাখ্যান করে। ভিরিদিয়ানা শুদ্ধাচারী সন্ন্যাসিনী-নান। সে জর্জকে প্রত্যাখ্যান করলে। কেন করলে? জেত যাবার, শুচি বিনষ্ট হবার ভয়ে? তাই যদি হবে জাহাঁপনা তবে খানিক পরে সে রেভারেন্ড মাদার(বা ওই জাতীয় কেউ)-কে বাড়িতে ডেকে ‘নান’ত্ব বিসর্জন দিলে কেন? এখানেও বুনুয়েলিক লিবিডো তত্ত্ব খাড়া করা যেতো, যদি না তিনি ছবিতে আরো অগ্রসর হতেন।
দেখুন জর্জ এরপরে আকৃষ্ট হবে বাড়ির পরিচারিকাটির প্রতি, কারণ সে সহজলভ্যা, ‘অনুগত’। এই আনুগত্যকে জর্জের শ্রমিকদের আনুগত্যের সাথে গুলিয়ে ফেলা অপরাধ হবে কমরেড। পরিচারিকাটি জর্জের বাপের প্রতিও অনুগত ছিলো। সেই আনুগত্য উপকারীর প্রতি উপকৃতর, শক্তিধরের প্রতি শক্তিহীনের আনুগত্য। যে আনুগত্য প্রকারান্তরে ভিরিদিয়ানা এবং জর্জ তাঁদের গরীবগোষ্ঠীর থেকে কামনা করেছিলো। জর্জ এবং পরিচারিকার সম্পর্কটিকে প্রেম নয় বরং ‘সমর্পণ’ বলা যেতে পারে। তবে এই সমর্পণের মধ্যে বিত্তহীনতার চেয়েও ‘লিঙ্গ-অধস্ত্ব‌নতা’-র প্রভাব বেশী বলেই মনে হয়। ফিরে যান ‘অবস্কিওর অবজেক্ট’-এর শেষ ভাগে হোটেলের ঘরে কনচিতার নিজেকে সমর্পণের দৃশ্যে। যাকে এই অজ্ঞ বিত্তহীন, শক্তিহীনের অবশ্যম্ভাবী পরাজয় মনে করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। আসলে এই দুটো ছবি গঠনগত ভাবে খুব কাছাকাছি। নারী-পুরুষ, বিত্তশালী-বিত্তহীনের দ্বন্দ্বর ওপরে ভিত্তি করে তৈরী।
নারীর পুরুষের কাছে আর বিত্তহীনের বিত্তশালীর কাছে নতি স্বীকার করা বা না করা দু’রকম ভাবে আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে। বাহ্‌ তোদের জন্যে ভিরিদিদি এত্তো কল্লে, তোরা তার বাড়িই লুঠ কত্তে গেলি? দেহে মানুষের রক্ত নেই? বা পয়সা পাচ্ছিস বলে মাথা নিচু করে বড়োলোকের বাড়িতে নিজের মেয়েকে বিক্কিরি কত্তে গেলি, দেহে শিরদাঁড়া নেই?
প্রসঙ্গান্তরে নায়ক ছবির কথা স্মরণ করতে অনুরোধ করি। ছবিটি বিশ্বাস না হলেও (ছবিবাবু নিজে অবশ্যই বিশ্বাস) নারী চরিত্রের ওপর বেজায় আলোকপাতকারী। সেই অর্থে নারীবাদী কিনা বলা মুশকিল। শ্রেণীবিভাজনের আভাসমাত্র উপস্থিত আছে। ছবিতে পাঁচটি মূল নারী চরিত্র। এক মধ্যবয়ষ্কা মহিলা নায়কের ধূমপান অপছন্দ করে, কিন্তু তাকে দেখে অলক্ষ্যে প্রসাধন সারতে ছাড়ে না। জ্বি, ‘সমর্পিত’ নায়কের কাছে না হলেও নায়কের আইডিয়ার কাছে তো বটেই। আরেকজনকে তার স্বামী কন্ট্র্যাক্ট বাগাতে ব্যবহার করে। মেয়েটি বিদ্রোহ করে। অথচ মদ্যপ নায়কের কাছে সিনেমায় নামার অনুরোধ জানায়। এ আমার বিভাজনের তৃতীয় শ্রেণীর। জ্বি, ঘাঘু মাল। তৃতীয় মহিলা শর্মিলাকে নায়কের কাছে পাঠায় ইন্টারভিউ নেওয়াতে। একে গৌণ চরিত্র হিসাবে গণ্য করা যায়। চতুর্থ শর্মিলা স্বয়ং: বিদ্রোহ ও সমর্পণের মধ্যে দোদুল্যায়মান। তাকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ‘নায়ক’-এর রিভিউ লিখতে হয়। এবং পঞ্চম? ছবির শুরুতে একটি টেলিফোনে মেয়েটি কাঁদোকাঁদো কাকুতি করে। ‘সমর্পিতা’ হয়। কোন মেয়েটি? যে মেয়েটি কিছু দিন আগে স্বপ্রণোদিত হয়ে নায়কের বাড়িতে মাঝরাতে হানা দিয়েছ, লাইনে নামানোর অনুরোধ করেছে, ইঙ্গিতে নিজেকে পণ্য হিসাবে ব্যবহার করার উপায় বাতলেছে। মেয়েটির দু’ধরনের অর্পণই আমাদের উত্যক্ত করেছে (গুরুকে সিগারেট খেলে ঘ্যাম দেখাত; এ ছাড়া এই ঐ দূরভাষিক নাটকটার আর কোন প্রাসঙ্গিকতা আমি নায়ক ছবিতে খুঁজে পাইনি)।
অর্থাৎ এই দুটো দ্বন্দ্ব: নারী-পুরুষ আর বিত্তশালী-বিত্তহীন দুটোই এক গোত্রের। দুটো নিয়েই আমাদের মধ্যে একপ্রকার ছদ্মবিভাজন বর্তমান। বুনুয়েল সেই প্রবৃত্তি ন্যাংটো করে দিয়েছেন বলা অত্যুক্তি। তবে নিজের এই বিভাজনটি মেনে নিতে দ্বিধা করেননি।
যাই হোক এর পরে তো শেষমেশ ভিরিদিয়ানা লাজ বিসর্জন দিয়ে ‘নায়ক’ ছবির নায়িকার মতো, বা ‘অবস্কিওর’ ছবিতে কনচিতার মতো জর্জের দ্বারে উপস্থিত হলো নিজেকে সমর্পণ করার উদ্দেশ্যে। জর্জের গরীবগুর্বোদের সামলানোর পন্থা সঠিক, ভিরিদিয়ানা হেরো, তাছাড়া জর্জ আবার বেচারা নারীকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করেছে। ভিরিদিয়ানাকে দেখেই পরিচারিকাটি জর্জের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। জর্জ তাকে বাধা দিলেো। বললো সেই ঘরেই উপস্থিত থাকতে। ফিল্ম শেষ হলো। জর্জ কার আনুগত্যকে প্রাধান্য দিলো জানা হলো না (এত সম্ভামনাময় সমাপ্তি পৃথিবীর ফিল্ম ইতিহাসে খুবই কম)। একে পৌরুষের আস্ফালন হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিত্তহীনদের অবদমনের পক্ষের সওয়াল হিসাবেও। মোদ্দা কথা নতিস্বীকার। বিত্তহীনের। নারীর। যে নতিস্বীকার ‘অবস্কিওর অবজেক্টে’ও এসেছে। তবে পূর্বতন সৃষ্টির থেকে আলাদা হওয়ার তাগিদে কিনা জানি না, বুনুয়েল সেখানে তাঁর কাহিনীতে আরো অগ্রসর হয়েছেন। (হ্যাঁ মহামহিম, উপসংহার পর্যন্ত…)
খ ৩। কনচিতার ভূমিকায় দুজন অভিনেত্রী কেন? অভিনেত্রী-চয়ন নিয়ে এই ফিল্মের আগে একটি নাটক ঘটে যায়। মারিয়া শিন্ডলার কে ড্রাগাভ্যাসের অভিযোগে বরখাস্ত করে বুনুয়েল নির্বাচন করেন কঠিনা ক্যারোল বুকে আর লাস্যময়ী অ্যাঞ্জেলা মোলিনাকে। বেশ কিছু অংশে প্রত্যাখান বা সঙ্গমের দাবী ফিরিয়ে দেওয়া বা অন্যায্য ভর্তসনা সহ্য না করে লহমায় হোটেল রিসেপশনিস্টের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার দৃশ্যে ক্যারোল আর নরম, মোহময়ী, লাস্যময়ী নর্তকীর দৃশ্যে অ্যাঞ্জেলার উপস্থিতি। তবে সবক্ষেত্রে সমীকরণ এত সরল নেই। দুজনেই দৃশ্যান্তরে ভেঙ্গে পড়েছে, দৃঢ় হয়েছে, হারিয়ে বা হেরে গেছে। সম্ভবত কনচিতার রহস্যময়তা বোঝাতেই এই অবলম্বন ছিলো পরিচালকের।
খ ৪। বস্তা কেন? ছবিতে চারটি দৃশ্যে বস্তার উপস্থিতি, আর একটি দৃশ্যে তার উল্লেখ লক্ষ্য করার মতো। না করে উপায় নেই। বুনুয়েল করিয়ে ছেড়েছেন।
প্রথম দুটি দৃশ্যে শ্রমিক শ্রেণীর দুজন মানুষকে পিঠে বস্তা বয়ে নিয়ে ফ্রেমে হেঁটে যেতে দেখা যায়। একে তখনকার দুর্মূল্য ফিল্ম রীলের অপচয় বলে মনে হতে পারে। তৃতীয় দৃশ্যে সামান্য বস্তাই দর্শককে নাড়িয়ে দেবে, যখন সেটি দেখা যাবে উচ্চবিত্ত এলিট ম্যাথিউ-এর কাঁধে। রাস্তায় কনচিতার কোমর জড়িয়ে হাঁটার সময়ে। নিম্নস্তরের মানুষের সাথে প্রেম কতো কুৎসিত, এক বোঝার মত, সুন্দরীর ওষ্ঠাগ্রে জঘন্য লোমশ আঁচিলের মতই ভারি তবে?
এর পরে প্রত্যাখ্যাত ম্যাথিউ। কনচিতাকে প্রত্যাখ্যানের অপরাধে সে ফেরত পাঠিয়েছে স্পেনে। কিছুকাল পরে হয়তো কৌতূহলবশে বা আশায় বুক বেঁধেই নিজেও হাজির হয়েছে সেই শহরে। সেখানে এক নৈশাহারের পর বেয়ারা তাকে মনে করিয়ে দেয় তার ফেলে যাওয়া বস্তার কথা। ম্যাথিউ অতি তাচ্ছিল্যভরে বলে, ‘পড়ে থাকে থাক’। সে পরে সময়মতো তুলে নেবার ব্যবস্থা করবে। সেইদিনই তার আবার কনচিতার সাথে দেখা হয়। সময়মতো তুচ্ছ বস্তা তুলে নেওয়ার অবহেলায় সে তার বাস্তুহীন প্রেমিকাকে একটা গোটা বাড়ি উপহার দেয়।
বস্তার শেষ আবির্ভাব ছবির উপসংহারে।

ট্রেনে মধুর কলহের মধ্যে দিয়ে তাদের মিলন হলো। এতদিনের অনমনীয়তা ভাসিয়ে কনচিতা তার আরাধ্য পুরুষ, কাম্য সামাজিক স্তরের সামনে নত হলো। এরপরে দু’জনকে দেখা যায় একটি উচ্চবিত্ত বিপণিতে, ইউরোপ অঞ্চলে যাকে গ্যালারি বলার চল আছে। উপহার নিতে অনিচ্ছুক কনচিতাকে এবার দেখা যায় সহাস্যে উপহার গ্রহণ করতে। অধিকৃত হবার ভয় বিসর্জন দিয়ে। আমার ধর্ষকাম মন শান্তি পায়। ক্রমে এক দোকানের সামনে দাঁড়ায় ম্যাথিউ আর কনচিতা। কাঁচের জানলার ওপারে কোনো পণ্য নেই। বদলে এক নিম্নবিত্ত নারী এই যুগলের সামনে এনে রাখে সেই বস্তাটি। ভেতর থেকে টেনে বার করে একে একে কনচিতার পুরোনো পোশাক। (পরিচালকের প্রথম ছবি আন শেন আন্দালুর শেষ দৃশ্যে সৈকতে পুরোনো পোশাক খুঁজে পাওয়ার সাথে মিল পাওয়া যাচ্ছে?) তাকে আঘাতের পর আঘাত করার সময় ম্যাথিউ ছিঁড়ে দিয়েছিলো যে পোশাক; যে পোশাকে দৃঢ় অনমনীয় কনচিতার মৃত্যু হলো; বিপ্লব ব্যর্থ হলো; সে পোশাকে রক্ত লেগে; কুমারিত্ব রক্ষা করতে গিয়ে আঘাতের রক্ত না, বরং কুমারীত্ব, নিজের অধিকার অর্পণ করতে গিয়ে রুষ্ট, বিত্তান্তরের পুরুষের হাতে লাঞ্ছনার রক্ত। মাইক্রোফোনে ঘোষণা হয় কমিউনিস্টদের সংঘবদ্ধ কোনো হামলার সতর্কবার্তা। দোকানের মহিলাটি আনমনে সেই পোষাক সেলাই করে যত্নে; সাজিয়ে রাখে। অন্য কোন কনশেপশনের জন্য বর্ম প্রস্তুত রইলো। পরাজিত কনচিতার চমক ভাঙ্গে। ম্যাথিউ-এর হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়। পলায়ন বেছে নেয় ফের।
…এক সহসা বিষ্ফোরণে, দোকান পাট সব ঢেকে যায় আগুনে, ধোঁয়ায়। বিপ্লবের অন্তরে প্রচ্ছন্ন, অপরাজেয় দৃঢ়তার দাবী আর বিপ্লবের লক্ষ্যবস্তুর অন্তরের ধর্ষণ কামনা খাক হয়ে যায় অন্তর অন্তরেই।
(বলা মুশকিল ছবিটি আদতে এতটাই বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বানানো কিনা। কিন্তু সমতাকামী অভাগার চোখে সব রক্তই লাল।)
শেষ করার আগে বলে রাখি, ছবিটির প্রযুক্তিগত কিছু সমস্যা সত্যিই আছে। আউটডোর শটে গাড়ি যাতায়াতের সাথে শব্দের সামঞ্জস্য নেই। ফ্ল্যামেঙ্কো গানের ঠোঁট নড়ার সাথে রেকর্ডেড গানের বা নাচে পায়ের শব্দের সাথে অভিনেত্রীদের পদ সঞ্চালন বেমানান। শেষে প্রত্যাখানে ভেঙ্গে পড়া ম্যাথিউকে দেখে কনচিতার হাসির শব্দ আর দেহ বিভঙ্গের কোনো মিলই নেই। সাতাত্তর সালে শব্দগ্রহণ যথেষ্টই উন্নত ছিল। তবে এ আলোচনা চালুনির ছিদ্রান্বেষণের মতো।

2 thoughts on “ধড়াম! একটি তীব্র রক্তিম শলাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.