সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

কারিগর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভাষা’ নিয়ে লেখা বইটির একটি পাঠ। সঙ্গের ছবি বইটির ‘ভাষা ও নারী’ পর্ব থেকে ‘আলপনা : নারীর লিখন’ প্রবন্ধটি থেকে ধার নেওয়া। এই লেখাটি লিখেছেন সোমনাথ মুখোপাধ্যায় — সোমনাথদা। সোমনাথদা আমাদের বহুদিনের বন্ধু। গদ্যলেখক সোমনাথদা ১৯৯৪-এ মাঠে নেমে উনিশ বছর ধরে হৈ হৈ করে শেষে ২০১৩ সালে উঠে যাওয়া অপর পত্রিকার সম্পাদক। আয়নানগরের সম্পাদিকাদ্বয়ের ছোটপত্রিকায় লেখালেখির শুরু অনেকটা সোমনাথদার হাত ধরেই। হাতেখড়ি একটা ছোট পত্রিকা কিভাবে ডকে তুলে দিতে হয়, তাতেও।

আমাদের, ভাষা নিয়ে ভাসা-ভাসা কথা লেখার কোনো প্রয়োজন বা অধিকার নেই। আমরা ভাষাবিজ্ঞানী নই, এমনকী ভাষাতত্ত্ব যে একটা বিষয়, যা নিয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশুনো করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা পেরবার আগে তা জানাও ছিল না। আমরা সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিচর্চায় ব্যস্ত ছিলাম। যে চর্চার সঙ্গে খুচরো কিছু চর্যাচেষ্টাও থাকে। তো, অমন এক কালে, অন্তত বিশ বছর আগে ভাষার রহস্য যেন ইশারায় অন্ধকার দেখায়। যেসব শব্দ — শ্রমিক, বুর্জোয়া, সমাজতন্ত্র, সামন্ত, বিপ্লব — প্রায় স্থির সংজ্ঞা নিয়ে মাথায় জাঁকিয়ে বসে ছিল, চর্যার অভিঘাতে ঘা খেতে খেতে প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, দুর্বোধ্য মন্ত্রের মতো মুখস্থ আউড়ে যাচ্ছি যেসব তত্ত্ব, নিজেরাই কি অর্থ বুঝেছি সেসবের? গুরুজনের বুঝিয়ে দেওয়া অর্থই বা কেন জগৎপ্রপঞ্চকে সহজবোধ্য এবং বদলযোগ্য করতে পারছে না? সরলীকরণের আলোকে যা যা ছিল সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট, অভিজ্ঞতা তাতে ধীরে ধীরে ধূসর ঢালে। গত শতাব্দীর আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে বিভ্রান্তির মায়াপ্রবাহ অবশ করে অস্তিত্ব। বোঝা যায়, রেডিমেড আর আমদানি করা ওষুধে সব রোগ সারে না। এমনকী, কী যে রোগ, আর ওষুধই বা কী — গুলিয়ে যায় সবই। সেই স্বর্গপতনের কালে অক্ষরব্রহ্মের উপর বিশ্বাস টলে যায়। বই-ই ছিল আমাদের ঈশ্বর, সেই বইকেই মনে হতে থাকে মিথ্যে — শুধু মায়া, মরীচিকা — কত ছুটেছি তারই উদ্দেশে, এই জীবন-মরু এখন তাহলে পেরই কেমনে?
অতঃপর জানা হয়, সত্যি-মিথ্যে, ফিকশন-ননফিকশন, প্রকৃত জ্ঞান-মিথ্যে তত্ত্ব—এসব বলে কিছু হয় না। যে শব্দ, অক্ষর, বাক্যগঠনরীতি দিয়ে তৈরি সব বই, সেসবই যদি হাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে কে এমন বই লেখে, যে সত্যের দাবিদার? ইঁটই শালা হাওয়া-হাওয়া, প্রাসাদ কি হবে সত্য, স্থির, সমুজ্জ্বল? একটি শব্দের লিখিত রূপ, চিহ্ন, প্রতীকটির সঙ্গে তার অর্থের যদি কোনো স্থির এবং যৌক্তিক সম্পর্কই না থাকে, তাহলে ওসব শব্দ সাজিয়ে সাজিয়ে কে-ই বা লিখবে এক মহাগ্রন্থ, যা চিরসত্য?

এই প্রেক্ষিতেই একদমে পড়ে ফেলা গেলো সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভাষা ভাষা কথা’। প্রকাশক : কারিগর; দাম : ৩৩৫ টাকা। সন্দীপবাবুর কিছু প্রবন্ধ-স্মৃতিকথা আগে পড়া ছিল — পত্রপত্রিকায়। জানতাম, সহজ করে লিখতে পারার গুণ তাঁর আছে। গত পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে তাঁকে দেখছি বিভিন্ন মানবিক-নাগরিক সভা-সমাবেশে। আলাপ নেই, জানি, ভান নেই তাঁর। লেখাতেও। নয়তো, ভাষা-টাষা নিয়ে কত গুরুগম্ভীর বই তো বাংলাভাষাতেও লেখা হয়, কত বিশ্বখ্যাত ভাষাবিদরা লেখেন, পড়তে আগ্রহ জাগেনি। আমাদের প্রশ্ন তো ভাষাতত্ত্বের অন্দরমহলের নয়; ভাষাতত্ত্ব দিয়ে আমরা কী করব? আমরা তো জ্বলছি এই যাপিত জীবনের অর্থহীনতা-ব্যর্থতার জ্বালায়। ভাষাতত্ত্ব কী সান্ত্বনা দেবে তাকে?
অতএব ভাষাতত্ত্ব নয়, সত্য-তত্ত্বের অস্তিত্বের তাগিদে একাধিকবার পাঠ করি এই বই। আলোচনা-সমালোচনা কিছুই লেখার ক্ষমতা নেই যখন, হাজির করি বইটির এক সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। পরিচয় করানো এই আনন্দে যে, আলাপিত হয়ে বড়ই আহ্লাদে আছি, ভাগ করে নিই।
পাঁচটি স্বতন্ত্র বিভাগের পূর্বে যে ভূমিকা-পরবর্তী লেখাটি আছে, সেখানেই স্পষ্ট যে, উনি পেশাদারি ভাষাবিদ নন। ভাষা কী? শব্দের অর্থ থাকে কোথায়? শিশু ভাষা শেখে কেমন করে? ভাষার সাথে চিন্তার সম্পর্ক কী? — এসব প্রশ্নই তাঁর কাছে এসেছে বস্তিতে-ফুটপাতে বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে। ঐ চর্যাই তাঁকে নিয়ে গেচ্ছে ভাষার সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক অনুসন্ধানে। দীর্ঘদিন তিনি নিজের মতো করে এসব নিয়ে পড়েছেন, ভেবেছেন, লিখেছেন। সেইসব লেখা নিয়েই এই সংকলন। কিন্তু প্রবন্ধ-সংকলন নামে আজকাল কেউ কেউ যে তাঁদের ইদানীংকালের বিভিন্ন বিষয়ের লেখাপত্র দুইমলাটে ভরে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন — এ বই তেমনটি নয়। বোঝা যায় দীর্ঘ সহবাসের অভিজ্ঞতা ও ভালোবাসা ছাড়া এ জিনিস হবার নয়। হয়তো দশ-বারো বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছে লেখাগুলি — অথচ মনে হয় যেন একটি বই-এর কথা ভেবেই পর্বে পর্বে লিখিত। সম্পাদনা, নিশ্চয়ই লেখকের, প্রায় নিখুঁত।
প্রথম পর্ব — প্রসঙ্গ : ভাষা। সাতটি রচনা। প্রথমটি, ‘অক্ষরের ভাষা’ — শব্দের সঙ্গে তার অর্থের সম্বন্ধবিচার। আধুনিক সোসুর যা বলেন, আমাদের ন্যায়-মতেও তার পূর্বধ্বনি — শব্দ থেকে অর্থের যে বোধ জন্মায়, তার মূলে আছে শব্দ-ব্যবহারের নিয়ম। শব্দ আর শব্দার্থের মধ্যে কোনো স্বভাবজ সম্বন্ধ আছে বলা যায় না। তাহলে ন্যায় আর পতঞ্জলি থেকে সোশ্যুর খুব আলাদা নন — আমাদের জানা হয় সন্দীপবাবুর বয়ানে। দ্বিতীয় লেখা, ‘মুখের ভাষা : প্রাণের ভাষা’। “একটি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের ধারা আর চিন্তার ধরন তার সংস্কৃতির ছাঁচটা গড়ে দেয় — ভাষার জন্ম হয় এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই” — সন্দীপবাবুর অনুধ্যান। তাই আদিবাসীর কাছে প্রেয়সী হয় ‘পুষ্পিত শালগাছ’। মুখের ভাষাই মানুষের বুকের ভাষা। ‘শব্দের প্রতাপ : মুখের বাক্য’ — এই পর্বের তৃতীয় লেখা। “ভাষাকে চিন্তা-চৈতন্য থেকে বিযুক্ত করে দেখার প্রবণতা ইউরোপে একসময় বেশ প্রবল ছিল কিন্তু প্রাচীন ভারতে এবং গ্রীসে ভাষাকে চিন্তা বা মননেরই রূপান্তর মনে করা হয়েছে” (মত লেখকের)। চতুর্থটি — ‘অস্পষ্ট গোধূলির আকাশ’। কাব্য ছাড়া অন্যত্র ব্যঞ্জক শব্দের ব্যবহার নন্দনশাস্ত্রীরা অনুমোদন করেননি। সাহেব বলেছিল, মিস্টিসিজম হল সুইসাইড অফ ল্যাঙ্গুয়েজ। আমরা জানি, নিরর্থ চিহ্নকে অর্থময় করে তুলতে একটা রসিক মন লাগে — শাস্ত্রে বলে সংবিত্তি। পঞ্চম লেখা — ‘শব্দের আবহ আর ভাষার সীমানা’-য় সাহিত্যের অনেকার্থবোধতা নিয়ে লিখেছেন; অনেকার্থের বীজ বহন করে যে সাহিত্য, তা-ই মহৎ। ‘শব্দের ফাঁদ’ নামক ষষ্ঠ রচনায় প্রচলিত ভারী ভারী শব্দগুলোর হাস্যকর এবং নিরর্থক প্রয়োগ নিয়ে মজা করেছেন। এই পর্বের শেষ লেখা — ‘বইপড়া আর লেখাপড়া’। গৌতম ভদ্রের ‘ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার?’ নামক দামী ও ভারী গ্রন্থটির সমালোচনা। ‘লেখাপড়া’র ‘লেখা’টা আগে কেন? — সন্দীপবাবু এ প্রশ্ন তুলেছেন, যা গৌতম ভদ্র এড়িয়ে গেছেন। যে বলতে পারে, পড়তে পারে না, সে লিখবে কী করে? মানে, সে কি লেখা থেকে পড়ায় যাবে, নাকি, বলা থেকে পড়া হয়ে লেখায়?
দ্বিতীয় পর্বটির শিরোনাম : ‘ভাষা-ভাবনা’। তিনটি প্রবন্ধ আছে এই পর্বে। হাবেরমাস, বাখতিন-বার্নস্টাইন, আর হেলেন কেলার। হাবেরমাস নৈতিকতা আর যুক্তিবোধকে একসঙ্গে ধরে রাখতে চান। আধুনিকতা বিজ্ঞানের যুক্তিকে মেনে নৈতিকতাকে জ্ঞানচর্চা থেকে দূর করে দেয়; হাবেরমাস অতএব এই বিচ্ছেদে উদ্বিগ্ন। বাখতিন এখন খুব চলে। উনি কী যে বলেন, তা অবশ্য স্পষ্ট বোঝা যায় না, সন্দীপবাবু সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন — কোনো মানুষই একটামাত্র ভাষা নিয়ে কারবার করে না, ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে সে ব্যবহার করে আলাদা আলাদা ভাষা। আর, বার্নস্টাইন তো ঘোর বিপ্লবী — বলছেন, স্কুল-কলেজ তৈরিই হয়েছে তেলা মাথায় তেল মারার জন্য। এই পর্বের শ্রেষ্ঠ লেখা ‘হেলেন কেলার আর ভাষার দর্শন’। ভাষাতত্ত্বের জগতে হেলেন কেলারের স্থানমাহাত্ম্য আমরা জানি না, কিন্তু তাঁর সাক্ষ্যেই সুদৃঢ় হয় এই বোধ, যে ভাষা আছে অবচেতনের স্মৃতিতে, যা বহু শতাব্দীর উপহার।
তৃতীয় পর্ব ‘ভাষা ও নারী’। তিনটি লেখা। কেন মেয়েদেরকে লেখা শেখানোতে এত আপত্তি — বোঝা গেল সবই তাদের যৌনতাকে বেঁধে রাখবার ছল। তাদের স্বাধীন ব্যক্তিত্ব বিকাশে বাধা দেবার জন্যই এই নিষেধ। দ্বিতীয়টি — ‘আলপনা : নারীর লিখন’ — অনবদ্য। শুধু এই লেখাটির জন্যই বইটি কিনে ফেলা যায়। আমরা যারা আধুনিক — আলপনা মানেই বুঝি পুজোআচ্চা, ব্রতকথা মানেই প্রতিক্রিয়াশীল — তাদের জন্য অসংখ্য তথ্য আর অজস্র চিন্তার খোরাক এই প্রবন্ধটি। তৃতীয় রচনা ‘প্রান্তবাসিনীর ভাষা’ — বেশ্যাদের ভাষা নিয়ে। এই লেখাটি বেশ দুর্বল, যেন খবরের কাগজের ফিচার।
চতুর্থ ও পঞ্চম পর্বে বাংলাভাষা এবং নিজস্ব ভাবনা নিয়ে চারটি প্রবন্ধ লিখেছেন সন্দীপবাবু। মূলত বাংলাভাষায় যে ভাষাচর্চার প্রবাহ তার একটা ইতিহাস রচেছেন। বিস্মৃত হেমন্তকুমার সরকারও আছেন। তবু এই অংশদুটি বেশ অপ্রতুল। তৃষ্ণা যায় না। মনে হয় দেখা হলে সন্দীপবাবুকে বলি, বাংলাভাষায় যে ভাষাচর্চা বিশেষ হয়নি বলে ওনার ক্ষোভ, আমাদেরও, উনিই তো পারেন তা মেটাতে। আমরা অপেক্ষা করব, ওনার পরবর্তী বই-এর জন্য, ভাষার বন্ধন পেরিয়ে অনির্দিষ্ট মহাকাশে উড়াল দেবে যে বই — ডানা বিনাই।

2 thoughts on “ভাসা ভাষা কথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.