সৌমিত্র ঘোষ

এই কিস্যার লেখক অনেকদিন ধরে বনজঙ্গল নিয়ে,মানে বনে থাকা মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করছে।সে চাঁদমণি আন্দোলনের,মানে শহুরে যৌথ সংগ্রাম কমিটির কনিষ্ঠ ও অন্যতম আহ্বায়ক ছিলো।


উচ্ছেদ
গত পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে ‘উচ্ছেদ’ শব্দটি এই দেশে একটি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে—মুখ্যত জমি-জিরেত-জঙ্গল থেকে যে মানুষেরা ক্রমাগত উচ্ছেদ হয়েছেন, বা হতে পারেন, তাঁদের প্রতিবাদ আন্দোলনগুলি যত শক্তিশালী ও দৃশ্য হয়েছে, এই শব্দটি আমাদের রাজনৈতিক ঘর-গেরস্থালিতে ঢুকে গেছে। অথচ উচ্ছেদ বিষয়টি সে অর্থে নতুন নয়—যে মানবসভ্যতার সামাজিক পরিমন্ডলে আমাদের বাস,তা নিরন্তর উচ্ছেদ ভিন্ন সম্ভব হতো না। একটি চালু উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তে যখন দ্বিতীয় উৎপাদন ব্যবস্থা আসে, তা শুধুমাত্র এক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া থাকে না, যে সমাজ বা রাজনীতি ওই ব্যবস্থাকে ঘিরে গড়ে ওঠে,তা-ও অনেকাংশে ভেঙে পড়ে,অর্থাৎ উচ্ছেদ হয়। বিশেষ, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায়,যা চালিত হয় নৈর্বক্তিক ও অমানবীয় এক ধারণার স্বার্থে, অর্থাৎ পুঁজি, এই বদল হয়ে ওঠে হিংস্র, পেশীবহুল, যে যে শ্রেণী বা সমূহ এই প্রক্রিয়া থেকে পুষ্টি পায়, তাদের স্বার্থে চালু ব্যবস্থাগুলিকে জবরদস্তি তছনছ করা হয়। ভারতবর্ষ যখন ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খপ্পরে গেলো,সেই সময়ে ও তৎপরবর্তীতে বাংলায় নানান জাতের উচ্ছেদ চলতে থাকে—স্বাধীন রায়তি চাষিরা জমিদারদের খপ্পরে গিয়ে পড়েন, তন্তুবায় ও হস্তশিল্পীরা বিলিতি মিলে তৈরী দ্রব্যাদির বাজার তৈরীর প্রয়োজনে কাজ হারান, মাঝিরা জাহাজ কোম্পানির চাপে জীবিকাচ্যুত হন। সবচাইতে প্রকট হয় যে উচ্ছেদ, তা অবশ্য জঙ্গল এলাকায়। যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের দখল কায়েম হয়, এবং সেই সম্পদের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল যে আদি উৎপাদন ব্যবস্থাগুলি ছিলো, যথা ঝুমচাষ, খাদ্যসংগ্রহ কি শিকার, তার প্রায় সবটাই নষ্ট হয়ে যায়। ফলত আরো উচ্ছেদ—ছিন্নমূল ঝুমচাষী ও খাদ্যসংগ্রহকারী মানুষেরা শ্রমের বাজারে পণ্য হয়ে ওঠেন। ছোটনাগপুর ও রাঁঢ়বাংলার মালভূমি থেকে, কি তৎসন্নিহিত ওড়িষা থেকে দলে দলে মানুষ চালান হতে থাকেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, যেখানে জঙ্গল হাসিল করে জমিদারী চালানো, খাদান থেকে লোহা-কয়লা তোলা, বাণিজ্যিক মূল্য আছে এমন গাছের বনবাগিচা তৈরী ও চা-কফি-নীল আদি গাছের লাভজনক এস্টেট-বাগিচা তৈরী, এসব কাজে কাঁচা ও বিনামূল্যের দাসশ্রমের প্রয়োজন ছিলো। এই দাসশ্রম কি সস্তা শ্রম ঘটায় শেষ স্তরের উচ্ছেদ—একটি ভৌগোলিক এলাকার তামাম স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিসর্গ বদলে যায় অন্য কিছুতে, যথা জঙ্গলের জায়গায় খাদান কি বাগিচা, গ্রামের জায়গায় শহর।
‘উচ্ছেদ’ সে কারণে এক ঐতিহাসিক এবং বিরামহীন প্রক্রিয়া। যে মানুষেরা একবার উচ্ছেদ হয়েছেন,কখনো এক পুরুষে, কখনো কয়েক পুরুষে তাঁরা আবার উচ্ছেদ হতে পারেন। যে বাগিচাচাষ একসময় লাভজনক ছিলো, স্বাধীনতা উত্তর ভারতে নানান আইনকানুন ও শ্রমিক অধিকারের ধাক্কায় তা এখন ‘তত’ লাভজনক নয়, অথবা যে জমিতে বাগিচা কি জঙ্গল আছে তাতে আরো লাভজনক কিছু বানানো যায়। এ হচ্ছে নিতান্তই পুঁজির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া—বাড়ের সময় সেখানে অন্য কোন ফ্যাকড়া ঢুকতে পারে না। অনেক লড়াইকাজিয়া না হলে, রক্ত না ঝরলে,রগরগে হিংসা না থাকলে,এই প্রক্রিয়া সচরাচর খবর হয় না। অধিকাংশ উচ্ছেদকাহিনী সেকারণে অনুল্লেখিত থাকে, এমনকি রক্তের দাগও ফিকে হয়ে গিয়ে মিলিয়ে যায়,নিসর্গ ও সমাজ বদলাতে থাকে নিজের নিয়মে,সেই বদলের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
ঘটনাচক্রে এখানে যে উচ্ছেদকাহিনীর মধ্যে বর্তমান লেখক ঢুকে পড়েছিলো, সেটিতে লড়াইকাজিয়া ছিলো, রক্তারক্তি ছিলো, তা খবরও হয়েছিলো। এতদ্‌সত্বেও, গল্পটি আমানি হতে চলেছে, দুদিন পরে তা বলবার, এমনকি মনে রাখবার লোক পাওয়া যাবে না এই আশঙ্কায় ছোট করে সেটি বলা হলো—স্থানাভাবে অনেক কিছু বলা গেলো না, খুঁটিনাটি তথ্য বাদ দিতে হলো।
চাঁদমণি চা বাগান উচ্ছেদ
চাঁদমণি চা বাগান ছিলো নিতান্তই দিশি বাগান, দীর্ঘদিন অবধি বাগানে ঢোকার মুখে যে বিবর্ণ বোর্ডটি লাগানো থাকতো,তাতে লেখা ছিলো ১৯২১-এ এর জন্ম। দিশি হলেও, নিসর্গ উচ্ছেদের যে সর্বব্যপী প্রক্রিয়ার কথা আমরা বলছিলাম, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি,এমন ধরা যেতে পারে। অর্থাৎ দার্জিলিং পাহাড়ের তলায় তরাই-এর ঘাসে ঢাকা প্রান্তর ও উঁচু জমির শালবন হাসিল করে বাগানটি বসানো হয়, এবং সে সময়ের যা দস্তুর, আড়কাঠিরা ভুলিয়েভালিয়ে বাগানশ্রমিক ধরে আনে ছোটনাগপুর থেকে। বাগান তৈরী হয় জলপাইগুড়ির স্বনামধন্য চা-কর এস পি রায় গোষ্ঠীর হাতে,এবং তাদের অন্য আর দশটি বাগানের মতো এটি দীর্ঘদিন দিব্যি চলছিলো। ১৯৯১-২ নাগাদ, সম্ভবত খানিক নয়া-উদারনীতিবাদি অর্থনীতির বিশ্বায়িত তাড়নায়, খানিক স্থানীয় ট্রেড-ইউনিয়ান নেতা ও প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থীদের যৌথ উদ্যোগে এই পুরোনো বাগানটিকে আক্ষরিক অর্থে নিকেশ করার নীল নক্সা তৈরী করা হয়—তার আগে অবশ্য বাগান একবার হাতবদল হয়ে এসেছে শিলিগুড়ির বিনয় দত্ত মশাই-এর হাতে, এবং সেখান থেকে, দফায় দফায় ধর্মঘট লকআউট ইত্যাদির পর, লক্ষ্মী টি কোম্পানির কাছে। সে গল্প বলতে গেলে বর্তমান লেখকের পুরোনো একটি লেখার (এখন বাগানটিও নেই,লেখাটাও নেই,মানে অন্যত্র তাকে পাওয়া যাবে না) মধ্যে ঢোকা দরকার—‘বিসম্বাদ’ পত্রিকায় ছাপা হবার পর সেটা প্রায় অপরিবর্তিতভাবে সে সময়ে(অর্থাৎ ১৯৯৮-এ চাঁদমণি চা-বাগান উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন যখন দানা বাঁধছে) উচ্ছেদ-বিরোধী যৌথ সংগ্রাম কমিটির প্রচারপত্র হিসেবে বিলি হয়েছিলো। আন্দোলন শুরুর উচ্ছাস ও গোড়ার কাব্যি বাদ দিলে, বাগান উচ্ছেদের ও প্রতিরোধ আন্দোলনের গোড়ার প্রসঙ্গটি বিস্তারিতভাবে লেখাটাতে ছিলো এই বিবেচনায়। এখানেও, খুব একটা না বদলে তার অংশবিশেষ দেওয়া হলো:
উচ্ছেদ ও প্রতিরোধের গোড়ার কথা—১৯৯৬-১৯৯৮
(ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮-এ লেখা ‘চাঁদমণি চা-বাগানঃ হাইটেক উন্নয়ন ও প্রতিরোধের নকসা’ থেকে)         
প্রাক্‌কথন
শিলিগুড়ি শহর যেখানে শেষ হচ্ছে, দার্জিলিং হিমালয়ের পাদশৈল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, জাতীয় সড়ক ৩১ ধরে এগোলেই ডাইনে-বাঁয়ে সবুজের প্লাবন। ধোঁয়া-ধুলোয় ঢাকা শিলিগুড়ির পথঘাট নয়, ঘিঞ্জি বসতি-এলাকা বা বাজারের বিরামহীন চিৎকারও নয়, এ শহরে যাঁরা প্রথম আসছেন তাঁদের কাছে এই ছবিটিই স্থির: হিমালয়ের নীলে মিশে আছে ক্রান্তীয় অরণ্যের বর্ষা-ভেজা সবুজ। তার পর আদিগন্ত এক সবুজ গালচে, সেখানে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আরো অজস্র রঙের আঁচড়, কর্মরত চা-শ্রমিকের দল। দার্জিলিং তরাই-এর খুব সাধারণ, পরিচিত চিত্রই এক, বহু বছরেও বদলায়নি। অথচ অতি অখ্যাত অনামা এক গঞ্জ রূপান্তরিত এক কসমোপোলিটন জঙ্গলে, লোকসংখ্যা গত তিরিশ বছরে বেড়ে পাঁচগুণ, গ্রাম্য হাট বদলে এ. সি. মার্কেট কমপ্লেক্স, হোটেল, রেঁস্তোরা, বার, দোকান, স্কাইস্ক্র্যাপার, তবু এসব কিছুর চিৎকৃত আবর্তের বাইরে তরাই তার চিরকেলে পাহাড়, অরণ্য, চা বাগান নিয়ে একইরকম, রূপান্তরহীন, শান্ত।এই রূপান্তরহীনতা, এই শান্তি নিতান্তই আপাত এক বোধ, হয়তো বা ক্লান্ত নাগরিকের ইচ্ছাপূরণ, অর্থহীন, পর্যটক-আকর্ষক প্রচার-পত্রিকা।
ন্যাড়া পাহাড়ে ধ্বস, অজস্র স-মিলে, আসবাবের দোকানে অরণ্যের ধ্বংসাবশেষ, চা-বাগানের সবুজে মুনাফা-তৈরির দায়িত্বজ্ঞানহীন ঘোষণা। আর ‘উন্নয়ন’ সবার উপরে, প্রায় ঈশ্বরের মতো, প্রশ্নাতীত উন্নয়ন। লাগামছাড়া লোভ, শয়তানি, বদমাইসি ঢেকে দেওয়া একটি শব্দ, যে কোনও কদর্য ধ্বংসলীলার একমাত্র ব্যাখ্যা।
তরাই-এর এপিটাফ লেখা চলছে।
চাঁদমণি চা-বাগান: পূর্বকথা
শিলিগুড়ি পুর নিগমের উত্তর সীমায় চাঁদমণি-চা-বাগান। এই শতকের কুড়ির দশকের গোড়ায় তৈরি এই বাগানটি প্রাচীনতম স্বদেশী বাগানগুলির অন্যতম। শুরুতে বাগানের এলাকা ছিল ৮৫০ একর। স্বাধীনতার পর, যখন শিলিগুড়ি শহরের গুরুত্ব বাড়ে, বিভিন্ন সময়ে এই বাগানের জমি অধিগ্রহন করা হয়। ১৯৫০-এ শিলিগুড়ি জংশনের জন্য ৭৪.১৯ একর, ’৬২-তে জাতীয় সড়ক ৩১-এর জন্য ৪২.২১৫ একর, ১৯৭৫-এ পুলিশ-চৌকির জন্য ৭.২১০ একর, ১৯৯১-এ রাজ্য বিদ্যুত পর্ষদের সাব স্টেশানের জন্য ২.৫৫০ একর। ১৯৮৬-র আগে বছরে গড়-উৎপাদন ছিল: তৈরী চা বা ‘মেড টি’ ২ লাখ কেজি, পাতা অবস্থায় বা গ্রিন টি ৭.৫০ – ৮.০০ লাখ কেজি।
আশির দশকের গোড়ায় চা-বাগানটিতে শ্রমিক-অসন্তোষ বাড়ে এবং দীর্ঘদিন বিক্ষোভ-ধর্মঘট চলার পর ১৯৮৬-তে চাঁদমণিতে লক্‌-আউট ঘোষণা করা হয়। ১৯৯২-এ বাগান কিনে নেন কলকাতার দীপঙ্কর চ্যাটার্জিরা। তরাই-অসম মিলিয়ে তাঁদের মোট ছটি বাগান। চাঁদমণি কিনবার পর তাঁদের প্রথম বার্ষিক হিসেবে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ক্ষতির পরিমান দেখানো ছিল ৫,৭৮,৫৭৫.৫২ টাকা। ১৯৮৭ তে বাগান পুরো বন্ধ ছিল। ১৯৮৮-১৯৮৯ এ আবার উৎপাদন শুরু হয়। তখন থেকে ১৯৯০-৯১ পর্যন্ত বাগানের উৎপাদন ছিল গড়ে ৫ লাখ কেজি (পাতা চা) এবং ১ লাখ কেজির (সাধারণ চা) কিছু ওপরে। চ্যাটার্জ়িদের মালিকানায় উৎপাদনের শেষ হিসেব এইরকমঃ ১৯৯৪-৯৫-এ ৬,৫৭,৯০৭ কেজি (পাতা চা), ১,৫১,৩১৮ কেজি (তৈরী চা), ১৯৯৫-৯৬-এ ৭,৩৭,৬৯৮ কেজি (পাতা চা), ১,৬৯,৬৭০ কেজি (তৈরী চা), ১৯৯৬-৯৭-এ ৫,৮১,৯২৬ কেজি (পাতা চা) এবং ১,৩৩,৪২৫ কেজি (তৈরী চা)।
 চ্যাটার্জিরা এখন বলছেন তাঁদের পক্ষে চা-বাগানটি চালানো আর সম্ভব নয়, কেননা বাগানটির পুঞ্জীভূত ক্ষতির পরিমাণ এখন ২.৫ কোটি টাকা। তাঁদেরই দেওয়া আর এক হিসেব অনুযায়ী বাগানের বর্তমান এলাকা ৬৬৪.৩৯৫ একর।
 কয়েকটি পর্যবেক্ষণ:
 (১) বাগানের প্রাক্তন মালিক এবং চাঁদমণি টি কোম্পানির প্রাক্তন ডিরেক্টর বেদব্রত দত্ত বলছেন বাগান বিক্রি করতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। নানাভাবে তাঁদের ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছিল। তিনি আরও জানাচ্ছেন, তাঁদের বাগানের কাছাকাছি অন্য একটি চা বাগানের মালিক বাগানটি কিনতে উৎসাহী ছিলেন এবং এই প্রস্তাব নিয়ে আসেন শিলিগুড়ির এক সিটু নেতা, চাঁদমণির শ্রমিক ইউনিয়নটি তিনিই চালাতেন। বেদব্রত আরও বলেছেন, সিটু-পরিচালিত আন্দোলনের মূল লক্ষই ছিল বাগান বিক্রি করতে তাঁকে বাধ্য করা। ১৯৯১-৯২-তে ট্রান্সপোর্ট নগরের জন্য জমি দিতেও তাঁকে রাজ্য প্রশাসন বাধ্য করে।
 (২) চ্যাটার্জিরা বাগান কিনবার পর, ১৯৯৪-৯৫ থেকে ১৯৯৬-৯৭ পর্যন্ত হেক্টর প্রতি উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৮২৯, ৯৫৩ এবং ৭১৬ কেজি। চা বাগানের খুব ভাল সময়ে এই পরিমাণ ছিল – যেমন ১৯৭৮ বা ১৯৮০-৮১-তে – ১,২০০ কেজির কিছু বেশি।
 (৩) চ্যাটার্জিদের দেওয়া হিসেব মোতাবেক ’৯৬-’৯৭ সালে তাঁরা যে চা উৎপাদন করেছেন, বাজারে তার ন্যূনতম মূল্য দাঁড়ায় ৮০ কোটি টাকা (তৈরী চা ৬০ টাকা/কেজি ধরে)। দামের হিসেব অবশ্য চ্যাটার্জিরা দেননি। বাগানের খরচ-খরচার এক বিকল্প হিসেবে(সে সময়, অর্থাৎ ১৯৯৭-এ চাঁদমণি চা-বাগানের আই এন টি ইউ সি শ্রমিক নেতা অলক মুখার্জী এই হিসেব তৈরী করেন) দেখা যাচ্ছে বাগান চালাতে তাঁদের ৩০-৩২ লাখ টাকার বেশি খরচা হওয়া উচিৎ নয়। লাভ-ক্ষতির হিসাব বুঝতে অতি বুদ্ধির দরকার হয় না।
 (৪) চা বাগানের যাবতীয় জমির প্রকৃত মালিক রাজ্য সরকার এবং বাগান মালিক সরকারের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে থাকেন। শেষবার চাঁদমণির জমি লিজ নেওয়া হয়েছিল ১৯৭৩-এ, লিজের মেয়াদ ছিল তিরিশ বছর। চা-বাগান সম্পর্কিত একটি আইন মাফিক (১৯৫৩-র কেন্দ্রীয় টি য়্যাক্ট বা চা আইন) চা-বাগানের জমিতে চা-বাগান ছাড়া অন্য কিছুই করা যায় না অন্ততঃ যে জমিতে চায়ের চাষ চলছে, তাতে তো নয়ই। ১৯৭৯-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শহর ও গ্রামাঞ্চল পরিকল্পনা আইন(টাউন য়্যান্ড কান্ট্রিস প্ল্যানিং য়্যাক্ট) অনুযায়ী শহর উন্নয়ন পরিকল্পনার রূপরেখায়(আউটলাইন ডেভলপমেন্ট প্ল্যান) যে জমি উল্লেখিত থাকে না,তা নগরায়নের কাজে ব্যবহার করা যায় না। দ্বিতীয়ত, চা-বাগানের জমি চা-চাষ বা বাগান সংক্রান্ত কাজ ছাড়া অন্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায় না। ১৯৯৫-এ আইনটিতে একটি সংশোধনী এনে অবশ্য বিশেষ সামাজিক প্রয়োজনে ‘রাজ্য সরকারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে’। বিশেষ সামাজিক প্রয়োজন কথাটা মনে রাখা দরকার। অধিগৃহীত জমি চায়ের চাষ ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারেন একমাত্র রাজ্য সরকার, বাগান-মালিকের সে অধিকার নেই।
 (৫) ট্রান্সপোর্ট-নগরের জন্য অধিগৃহীত চাঁদমণির জমি এবং পাশের কিছু জমিতে রাজ্য সরকারই একটি সংস্থা হিমাঞ্চল বিহার নামে এক আবাসন তৈরি করছেন এবং জমি বেচছেন ৪০/৫০ হাজার টাকা প্রতি কাঠায়।
 (৬) চা-শিল্প উত্তরবঙ্গের, রাজ্যের, গোটা দেশের একটি প্রধানতম শিল্প, যদি বিদেশি মুদ্রার আমদানীর কথা হিসাব করা হয়।
 (৭) রাজ্য সরকার শিল্পায়নে, মৌ-সইতে এবং প্রোমোটারীতে বিশ্বাস করেন এবং এবং শহরে এসেছে প্রমোটার।
 নভেম্বর ৯৭-এর ১৩ তারিখে সই হয়েছে চাঁদমণি চা কোম্পানি আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে সমঝোতাপত্র। সাক্ষী হিসেবে সেখানে সই করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং পশ্চিমবঙ্গ শিল্প উন্নয়ন নিগমের সভাপতি সোমনাথ চ্যাটার্জি মশাই। কানাঘুষো চলছিল অনেকদিন ধরেই, ৯৫-এর গোড়া থেকেই। উপনগরী হচ্ছে, হাই-টেক আসছে। চেহারা বদলে যাবে শহরের। মফস্বল? দেখে চেনা যাবে না সিঙ্গাপুর না সোল না শিলিগুড়ি। নভেম্বর ১৩-র মৌ তার আনুষ্ঠানিক, পোষাকী ঘোষণা। আগে শোনা গিয়েছিলো হাই-টেক প্রকল্পটির মালিকানা রাজ্য সরকার, চ্যাটার্জি এবং এক ব্রিটিশ ফার্মের। মৌ বললো অন্য কথা:
(১) চাঁদমণি চা কোম্পানি আর বাগান চালাতে পারবে না, কেননা বাগানটি অর্থনৈতিকভাবে VIABLE’ বা আয়কারী নয়,
(২) চাঁদমণি চা কোম্পানি বাগানের জমিটি রাজ্য সরকারকে দিয়ে যেতে চাইছে, সেখানে একটা উপনগরী বানালে বেশ হয়, শিলিগুড়ির লোকের বড় কষ্ট, জনসংখ্যার চাপ, এ আর সহ্য হয় না,
(৩) শহরটা বড় ঘিঞ্জি, আর কাছাকাছি ডাবগ্রামে আর রানীনগরে (জলপাইগুড়ির কাছে) নতুন শিল্প এলাকা তৈরী হয়েছে, তাই এই উপনগরী, যেখানে থাকবে নিবিড় স্বাচ্ছন্দ্য আর পর্যাপ্ত ‘সামাজিক-প্রাকৃতিক পরিকাঠামো’,
(৪) চাঁদমণি বাগানের ৪০৪.৬৪ একর জমিতে উপনগরী তৈরী হবে। রাজ্য সরকার জমি নিয়ে নিন,
(৫) জমি নিয়ে রাজ্য সরকার নতুন কোম্পানিকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিন। বিনিময়ে নতুন কোম্পানি সরকারকে দেবে ১৩ কোটি, ৯২ লাখ, ৮৭ হাজার ৯৪৭ টাকা,
(৬) সব শ্রমিকদের পুনর্বাসন  দেওয়া হবে,
(৭) ১ লাখ গাছ লাগানো হবে,
(৮) ২০ একর জমিতে রাজ্য সরকার নানান কিসিমের দূষনহীন শিল্প গড়বেন,
(৯) হাই-টেক শহরে সবশুদ্ধু ১৫ হাজার লোক কাজ পাবে,
মৌ-এর ৭-৯ ধারায় যা সরাসরি নেই, তা হল চ্যাটার্জীরা এবং রাজ্য সরকারের পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য যা যা বলেছেন।
 চা-বাগানের লাভ-ক্ষতি বিষয়ে চ্যাটার্জীরা বলছেন বাগানের বিস্তর জায়গা বেদখল এবং বিভিন্ন সময়ে প্রচুর জমি বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া হয়েছে, সুতরাং এ বাগান আর চালানো যায় না।
কয়েকটি টীকা
চ্যাটার্জীরা বাগান নেবার পর সরকার কোনও জমি নেননি। বেদখল জায়গার ঠিকঠাক হিসাব পাওয়া যায় না। ওঁরা বলছেন টাউনশিপের পর চা বাগানে ২৫৭.৭৫৫ একর জায়গা থাকবে এবং চা-বাগান থাকবে ১২০ একরে। ভালো হাই-টেক কৃষিকাজে ওঁরা ১২০ একর জায়গাতেই ১ লাখ কেজির ওপর চা ফলাবেন। বাকি জমিটাতে শ্রমিকদের কোয়ার্টারস, রাস্তাঘাট ইত্যাদি ইতিমধ্যেই আছে। 
পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য মশাই বলছেন, যেহেতু শিলিগুড়ির উন্নয়ন অপরিকল্পিত এবং জঙ্গল কাটায় ও নদীর চরে বসতি ওঠায় পরিবেশের বড় ক্ষতি হচ্ছে,চাঁদমণি উপনগরীতে পরিকল্পিত উন্নয়ন করে শিলিগুড়িকে বাঁচাতে হবে। শহর বাড়ার আর পথ নেই, কি করা যাবে? তাছাড়া চাঁদমণি ওঠালে শিলিগুড়ি থেকে বাগডোগ্‌রা পর্যন্ত একটি নিরবচ্ছিন্ন শহরাঞ্চল তৈরী হবে।
(১) শিলিগুড়ি শহরের কাছাকাছি বৈকুন্ঠপুর বনাঞ্চলের অধিকাংশ ধ্বংস হয়, নদীর চরে কলোনি ওঠে মূলতঃ আশির দশকে। পুরমন্ত্রী  যে পার্টি করেন তার প্রত্যক্ষ মদতে।
(২) শিলিগুড়ি উন্নয়ণের জন্য প্রথম সংস্থা গঠিত হয় ষাটের দশকে। ১৯৬৬ সালে শিলিগুড়ি প্ল্যানিং অরগানাইজেশন নামে এই সংস্থাটি বৃহত্তর শিলিগুড়ি উন্নয়নের মাষ্টার প্ল্যান তৈরী করেন। সেই দলিলে পরিষ্কার বলা আছে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ (যথা কৃষিজমি, চা-বাগান, অরণ্য) শহর বৃদ্ধির কারণে বিপন্ন এবং এই নতুন পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে এই সম্পদকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করা হয়। (সূত্রঃ S.P.O. 1966 MASTER PLAN, Page: 101)
এছাড়া আরো বলা হয়, শহরের ভূমি ব্যবহার এমন ভাবে করা হবে, যাতে শহরের মধ্যে একটি বিশেষ কৃষি অঞ্চল থাকে, ৩০০ একরের উপর ফাঁকা জমি থাকে RECREATIONAL SPACE হিসাবে, এবং চা-বাগান চা-বাগানই থাকে (সূত্র ঐ পৃঃ ১২২-২৮)। এই দলিল রচয়িতা সংস্থাটি শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি নামের এক নতুন সংস্থার সঙ্গে মিশে যায় এবং এই দলিলটির ভিত্তিতে ১৯৮৬ সালে তৈরী হয় এক আউট্লাইন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান। এখনো পর্যন্ত এটিই নগরোন্নয়নের একমাত্র প্রামাণ্য দলিল। এই দলিলের ১৮/১৯ পাতায় ৭ এর “B” অংশে শিলিগুড়ির ভবিষ্যৎ বৃদ্ধির জন্য ৫টি এলাকাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন অঞ্চল, ফাঁসিদেওয়ার কাছাকাছি ডাবগ্রাম এলাকা, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন এলাকা এবং চম্পাসারি এলাকা মিলিয়ে মোট প্রায় ৪৫০০ একর জমির কথা বলা হয়েছে (যথাক্রমে ৮০০, ১১২০, ৬৪০, ১৬০০ এবং ২৪০ একর) যেখানে প্রায় সাড়ে তিন লাখ লোক বসবাস করতে পারবেন। আরো বলা হয়েছে চা-বাগান এলাকায় শহর করার প্রশ্নই ওঠে না। এই দলিলে জোর দেওয়া হয় শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি সংযোগকারী রাজ্য সড়ক ১২-র দু পাশে নগরায়নের ওপর।
(৩) শিলিগুড়ির ভেতরে এখন কোনো ফাঁকা জমি নেই। শিলিগুড়ি থেকে শুকনা, শালুগাড়া এবং বাগডোগরা পর্যন্ত জাতীয় সড়ক ৩১এ ও ৩১-র দু পাশে যাবতীয় জমি বিক্রী হয়ে গেছে, নির্মাণ কাজ শুরু হবে যে কোনো মুহূর্তে।
(৪) চাঁদমণি চা-বাগান ছাড়া শিলিগুড়ির আশেপাশে অন্যান্য চা-বাগানও রয়েছে। চাঁদমণির পাশেই দাগাপুর, যেখানে ৪৫৩.৪৫ একর, মাটিগাড়ায় ২৮৫.৭৭ একর, পাশেই নিশ্চিন্তপুরে ২৯৮.৯৩ একর। দাগাপুর এবং মাটিগাড়ার মালিকেরা উঁচিয়ে বসে আছেন। একবার চাঁদমণি প্রকল্প হলেই তাঁরা তাঁদের বাগান বেচে দিয়ে হোটেল, আবাসন ইত্যাদি বানাতে পারেন। কোনো আইনে তাদের আটকানো যাবে না।
(৫) জাতীয় সড়কের কাছে শিলিগুড়ির এস.জে.এল.আর.ও.(SJLRO) অফিস জমির দাম ধরছেন একলাখ সত্তর হাজার টাকা কাঠা থেকে ভেতরের দিকের অংশ ৫০ হাজার টাকা কাঠা। এই হিসাব ৯/০১/১৯৯৮ এর। মৌ অনু্যায়ী, চাঁদমণির মালিকরা জমি কিনছেন ১৫ হাজার টাকা কাঠায়। ৪০০ একরের মধ্যে ২০০ একর জমিও যদি ওঁরা বেচেন (বাকিটা ওঁরা বলছেন, পার্ক, রাস্তা, স্কুল ইত্যাদির জন্য থাকবে),লাভের পরিমাণ হিসেব করতে কষ্ট হয় না।
 বে-আইনের নানারকম 
চাঁদমণি প্রকল্পের এখনো কাগজপত্রও তৈরী হয়নি। পি.এফ.আর বা প্রজেক্ট ফিজিবিলিটি রিপোর্ট নেই, নেই ডি.পি.আর বা ডিটেইলড প্রজেক্ট রিপোর্টও। পরিবেশের ওপর প্রতিক্রিয়া জানার জন্য ই.আই.এ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট—পরিবেশ সমীক্ষা—এর পরে গৃহনির্মাণ,মানে হাউসিং শিল্পকে ই-আই-এ-র আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়) এখনো হয়নি। পুরমন্ত্রী বলেছেন হবে,হবে। অথচ ঠিক করা হয়ে গেছে প্রকল্পটি ভীষণ দরকারী। রাজ্য সরকার শিল্পায়নের কথা বলছেন এবং একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গের প্রধান শিল্পটির পেছনে ছুরি বসাচ্ছেন। চাঁদমণিকে রুগ্ন দেখিয়ে যে গল্পটির অবতারনা করছেন চ্যাটার্জীরা, সেটিকে মদত দিয়ে তাঁরা আরো প্রমান করছেন তাঁদের কাছে এই মুহূর্তে প্রোমোটারী আর জমির ফাটকাবাজির চাইতে গুরুত্বপুর্ণ শিল্প কিছু নেই।
বলা হচ্ছে চাঁদমণি শ্রমিকেরা কর্মচ্যুত হবেন না। চা-বাগানটির আয়তন অনুযায়ী সেখানে এখন থাকা দরকার (বাগিচা শ্রমিক আইন, বা প্ল্যান্টেশান লেবার আইন মোতাবেক) ৬৫০ জন শ্রমিকের। আছেন ২০০-র কিছু বেশী। ১৯৮৬-তে এই সংখ্যাটি ছিলো ৫৪৮। এখন যারা আছেন তাঁরা (একাংশ) কাজ পাবেন আর এক চা-বাগানে। সেখানে তাঁদের মাইনে ইত্যাদি কি দাঁড়াবে তা জানা নেই। এছাড়া বাবা-পিতামহ’র জমি থেকে তাঁরা বাস্তুচ্যুত হবেন। কার জন্য এই প্রকল্প? কাঁরা থাকবেন হাই-টেক্‌ টাউনশিপে? শিলিগুড়ির সাধারণ মানুষ? বাইরে থেকে যাঁরা কাজ খুঁজতে আসছেন, তাঁরা? যাঁরা নদীর চরে বসতি বসিয়েছেন, তাঁরা? যে প্রকল্প কিছু ফাটকাবাজ ফড়ে আর দালাল ছাড়া কাউকে সেভাবে উপকৃত করবে না, তার নাম উন্নয়নমুখী প্রকল্প? গণমুখী উন্নয়ন? হবেও বা।
প্রতিরোধের নকশা: চাঁদমণি
চাঁদমণি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে মূলতঃ দু’টি স্তরে। প্রথম স্তরে চাঁদমণি ট্রেড-ইউনিয়ন গুলি এক যৌথ সংগ্রাম কমিটি তৈরী করে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন, প্রচার চালাচ্ছেন, বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন। দ্বিতীয় স্তরে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে একটি যৌথ সংগ্রাম প্রস্তুতি কমিটি, যেখানে আছেন কিছু ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধি এবং ব্যক্তিগতভাবে, কিছু নাগরিক। এই কমিটির গঠন প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন উদ্যোগ/আন্দোলনের ফল। চাঁদমণি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন শিলিগুড়ির নেসপন। এক নাগরিক সভা থেকে ১৯৯৬-এর ডিসেম্বরে কন্সার্ন ফর শিলিগুড়ি নামে এক ফোরাম গঠিত হয়। এই ফোরামের পক্ষ থেকে পুরমন্ত্রীকে এক স্মারকলিপি দেওয়া হয়। একাধিক নাগরিক সভার পর বিভিন্ন কারণে ফোরামটি ভেঙে যায়। এরপর শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অরগানাইজেশন ও নেসপন-এর উদ্যোগে প্রতিবাদ-সভা করা হয় শহরের বিভিন্ন জায়গায়। এ ছাড়া, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক, চাঁদমণি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি চিঠি পাঠান।
মূলতঃ শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশান-এর উদ্যোগে ’৯৭-র ডিসেম্বরে শিলিগুড়ির ৫’টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনঃ  নেসপন, এ. পি. ডি. আর, ভক্তিনগর ওয়েলফেয়ার, শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার ও ন্যাফ যৌথভাবে নাগরিক কনভেনশন ডাকে ২০ ডিসেম্বর। এই কনভেনশনে বহু গণ-সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়াও চাঁদমণি শ্রমিকদের এক বড় অংশ যোগ দেন। ১৯৯৮-র ২রা জানুয়ারী শিলিগুড়ি থেকে চাঁদমণি পর্যন্ত প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৮ই জানুয়ারী পুরমন্ত্রীকে যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়, তাতে উপরোক্ত সংগঠনগুলি ছাড়া সই ছিলো, এ. আই. সি. সি. টি. ইউ, আই. এফ. টি. ইউ, ইউ. টি. ইউ. সি (লেনিন সরণী)-র প্রতিনিধিদের, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধিদের, সরকারী কর্মচারী ও প্রেস শ্রমিকদের সংগঠন যথাক্রমে ডব্লু. বি. জি. ই. ইউ ও এস. পি. এল. ইউ-র প্রতিনিধিদের। যৌথ-সংগ্রাম প্রস্তুতি কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লাগাতার আন্দোলনের, আইনী লড়াই চালাবার এবং শ্রমিকদের লড়াই-এর পাশে দাঁড়াবার। এই লড়াই-এর সাফল্য নির্ভর করছে এর বর্তমান চরিত্রের দীর্ঘস্থায়িত্বের ওপর, এবং সহযোগী সংগঠনগুলির সমর্থন-এর ওপর। শ্রমিক-কৃষক (আন্দোলনে আছেন বনবস্তির কৃষকরাও)-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণে চাঁদমণি আন্দোলন এ রাজ্যের সামাজিক আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
উচ্ছেদ-প্রতিরোধ-উচ্ছেদ : ১৯৯৯-২০০৩ 
কখনো টগবগে, কখনো খুঁড়িয়ে, চাঁদমণি আন্দোলন প্রায় বছর পাঁচেক চলে। শুরুর দিকে শ্রমিকদের এক বড় অংশের যে উৎসাহ ছিলো, বছর খানেকের মধ্যেই তা স্তিমিত হয়ে আসে—যে শ্রমিক নেতা আই এন টি ইউ সি-র হয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি মালিকের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন, উন্নয়নের মতো এই উচ্ছেদও অমোঘ, বাগান ডুববেই, এবং সে কারণে যা পাওয়া যায় তা মেনে নেওয়াই ভালো। ১৯৯৮-এই তাঁর অনুগামী শ্রমিকেরা বাগান ছেড়ে ওই মালিকের-ই আর এক বাগান—ফুলবাড়ি টি এস্টেট—অভিমুখে পাড়ি দেন। তাঁদের থাকার এবং কাজের ব্যবস্থা হয় চাঁদমণি চা বাগানের নতুন ‘সুবল ভিটা ডিভিশানে’। কার্যত ডিভিশানটির অস্তিত্ব ছিলো না। তড়িঘড়ি,বনবিভাগের অধীনে থাকা বনভূমিতে(সরকারী দলিলে এই এলাকাকে বনভূমি বলে দেখানো ছিলো) কিছু চা-চারা পুঁতে বলা হয়—এই দ্যাখো সুবল ভিটা বাগান। যেহেতু সরকারী দাক্ষিণ্যে এবং তদারকিতে এই কাজ হয়, এই জমি দখলে বনবিভাগ আপত্তি করেনি। অথচ, ১৯৮০-র বন সংরক্ষণ আইন আইন মোতাবেক এ কাজ করাই যায়না।
শ্রমিক আন্দোলন ম্রিয়মান, কিন্তু চাঁদমণি বাগান উচ্ছেদের বিরুদ্ধে যে যৌথ সংগ্রাম কমিটী গড়ে ওঠে, তার পক্ষ থেকে ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত, চাঁদমণি প্রকল্পে বে-আইনের প্রসঙ্গগুলিকে বার বার জনসমক্ষে আনা হয়। ১৯৯৯-এ কমিটি ও কলকাতার নাগরিক মঞ্চ যৌথভাবে কলকাতা হাইকোর্টে এক জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে বাগান হস্তান্তর এবং সেখানে শহর বসানোর সমগ্র প্রক্রিয়াকে বে-আইনী ঘোষণা করার আর্জি জানায়। এই জনস্বার্থ আবেদনের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো:
১/পশ্চিমবঙ্গ টাউন য়্যান্ড কান্ট্রিস প্ল্যানিং আইন, ১৯৭৯ অনুযায়ী শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষৎ যে উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরী করে,তাতে চাঁদমণি এলাকাকে চা-বাগান হিসেবে দেখানো আছে,চা-বাগানের জমি শুধুমাত্রই চা-চাষের জন্য ইজারা দেওয়া সরকারী জমি—এই জমি অন্য কাজে ব্যবহার করা যায় না।
২/শিলিগুড়ির মতো ঘনবসতি এলাকার ঠিক বাইরে চাঁদমণি বাগান,তা নষ্ট হলে শহরের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় এক সবুজ অঞ্চল নষ্ট হবে,ফলে পরিবেশ বিপন্ন হবে।
৩/ চা-বাগান নষ্ট করে শহর বসানোর কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই,এতে করে চা-শিল্পের ক্ষতি হবে
৪/শ্রমিকদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত—তাঁরা জীবিকাচ্যুত হবেন এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হবেন
দীর্ঘ শুনানির পর আদালত রায় দেন ২০০২ সালে((W.P no.3569 (w) of 1999, dtd 15/05/2002)। এই রায়ে বলা হয় রাজ্য সরকার হলফনামা নিয়ে জানিয়েছেন তাঁরা এই প্রকল্প রূপায়ণে কোনো আইনভঙ্গ করবেন না, সুতরাং বিশেষ কিছু শর্তসাপেক্ষে এই প্রকল্প রূপায়িত হতে পারে। আদালতের রায় নিয়ে কটু মন্তব্য বিপজ্জনক,কিন্তু এটুকু বলাই যায় যে যে ভাবে শুনানী এগুচ্ছিলো তাতে এই রায় প্রত্যাশিত ছিলো না। আদালত রায় দিতে গিয়ে বলেন,যে যে আশঙ্কা আবেদনে ব্যক্ত করা হয়েছে,সে সব ভবিষ্যতের বিষয়,আগে থেকে এত কিছু ভাবা ঠিক হবে না,বিশেষ,রাজ্য সরকার যখন হলফনামা দিয়ে বলছেন,তাঁরা আইন মানবেন। হাইকোর্টের দেওয়া শর্ত এইরকম ছিলো:
১/ ১৯৯৭ সালের ১৩ই নভেম্বর রাজ্য সরকার ও চাঁদমণি চা কোম্পানির মধ্যে সাক্ষরিত ‘মৌ’ বা সমঝোতাপত্র অনুযায়ী, বাগানের ৪৬৪ একর জমির উপর একটি উপনগরী গড়ে উঠবে, এবং সে কারণে রাজ্য সরকার এই বাগানের ওই পরিমাণ জমির চা-ইজারা(যে ইজারা বা লিজে আইনানুযায়ী চা-চাষ ছাড়া অন্য কোনো কারণে এই জমি ব্যবহার করা যায় না)বাতিল করে জমিটিকে ‘খাস’ করবেন, ও তা পুনরায় এক ‘নতুন কোম্পানি’কে নগরায়নের জন্য ৯৯ বছরের ইজারায় দেবেন।বাগানের বাকি জমি(সে সময় প্রায় ১৫০ একর—চাঁদমণির মোট এলাকা তখন ৬০০ একরের কিছু বেশী ছিলো) চাঁদমণি চা কোম্পানির চা-ইজারায় থাকবে,সেখানে চায়ের চাষ চলবে।
২/ কোনো বাগান-শ্রমিকের কাজ যাবে না এবং তাঁদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
৩/ কলকাতা উচ্চ আদালতের নির্দেশ মাফিক রাজ্য সরকার ১৯৯৯ সালের ১৯শে নভেম্বর এক হলফনামা দিয়ে জানান, তাঁরা এই ‘নতুন কোম্পানি’র অংশীদার হবেন। কোম্পানিটি একটি ‘জয়েন্ট সেক্টর’ বা যৌথ উদ্যোগ হিসাবে গড়ে উঠবে, রাজ্য সরকারের সেখানে ১৬ ভাগ অংশীদারিত্ব থাকবে।
৪/ ‘যদি ওই জমিতে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গড়ে তুলতে হয়…তা পরিবেশ এবং অন্যান্য সমস্ত আইনকানুন নেনেই করতে হবে’। অর্থাৎ প্রকল্পটিতে দুষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদের ছাড়পত্র থাকতে হবে, যে যে শর্তে রাজ্য সরকারের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব বিভাগ জমিটি নতুন ইজারায় দিচ্ছেন, তা পালন করতে হবে।রাজ্য সরকারের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব বিভাগ যে যে শর্তে জমিটি লক্ষ্মী টাউনশিপ কোম্পানি নামের এক কোম্পানিকে ইজারা দেন,তার মধ্যে ছিলো: বিশদ প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিটেইলড প্রজেক্ট রিপোর্ট(ডিপিআর) দিতে হবে, যেখানে নিকাশী ব্যবস্থার খুটিনাটি জানাতে হবে,পরিবেশ ছাড়পত্র নিতে হবে, জমি বা ওই জমিতে গড়ে তোলা ফ্ল্যাটবাড়ির দাম কি ধার্য হচ্ছে তা জানাতে হবে।
এই রায়ের পর রাজ্য সরকার পূর্ণোদ্যমে বাগান উচ্ছেদে তৎপর হয়। অনেকদিন মামলা চলায় যৌথ সংগ্রাম কমিটির আন্দোলন ততদিনে অবসাদগ্রস্ত। অবশ্য যে বাগানশ্রমিকেরা চাঁদমণি ছেড়ে যাননি তাঁরা এর মধ্যে যাবতীয় রাজনৈতিক দল ও দলীয় ট্রেড ইউনিয়ান সম্বন্ধে নেহাৎই বিরক্ত হয়ে নিজেদের মজদুর মোর্চা বানিয়ে বাগান বাঁচাতে মাঠে নেমে পড়েছেন। যতদূর মনে পড়ে, ২০০১-এর ২রা অক্টোবর এই মোর্চা তৈরী হয়। বাগানের বন্ধ কারখানার সামনের মাঠে যে প্রথম সভা মোর্চা করে, তাতে যৌথ সংগ্রাম কমিটির পক্ষে বর্তমান লেখকও উপস্থিত ছিলো। রাজ্য সরকারের পক্ষে পুরমন্ত্রী মশাই স্বয়ং, এবং তাঁর দলের লোকজন দফায় দফায় বৈঠক করে, লোভ ও ভয় দেখিয়ে মজদুর মোর্চা ভাঙতে পারেন নি। ফলত চাঁদমণি আন্দোলন তার শেষ পর্বে পৌঁছে এক যথার্থ গণ-আন্দোলন হয়ে ওঠে। বাগানে মোর্চা নিয়মিত রাত পাহারার ব্যবস্থা করে,লাইনে লাইনে সভা চলতে থাকে। শিলিগুড়ি শহরে যৌথ সংগ্রাম কমিটি মামলা হারার শোক ঝেড়ে ফেলে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে, নিয়মিত উচ্ছেদ-বিরোধী প্রচার চলতে থাকে, এবং ১৯৯৭-এ শুরু হবার পর এই প্রথমবার, গোলমেলে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ইত্যাদিরা মধ্যে না থাকায়, শ্রমিকদের সঙ্গে যৌথ কমিটীর এক সজীব, কেজো যোগাযোগ তৈরী হয়।
উচ্ছেদ-বিরোধী আন্দোলন দমদার হয়ে ওঠে, রাজ্য সরকারও গাছকোমর বেঁধে উচ্ছেদে লেগে পড়েন। সোজা আঙুলে যখন ঘি উঠলো না, অর্থাৎ শ্রমিকেরা যখন বাগান ছাড়তে বা উচ্ছেদে রাজি হলেন না, আঙুল বেঁকানো হলো। অর্থাৎ, সরকার ও পার্টির যৌথ উদ্যোগে, বিস্তর পুলিশ গুন্ডা নিয়ে বাগান ঘিরে ফেলে চা-গাছ উপড়োনো শুরু হলো। ২০০৩-এর ২৬শে জুন, পুলিশ বাগান শ্রমিকদের উপর যথেচ্ছ গুলি চালায়, মারা যান রামপ্রসাদ ভক্ত ও রঞ্জিত জয়সোয়াল নামের দুজন অস্থায়ী শ্রমিক, আহত আরো বহু ।নারী শিশুদেরও রেয়াৎ করা হয় না, ১৪ বছরের কিশোরী মিঝারেন লাকরা ও মহিলা শ্রমিক অম্বিকা উপাধ্যায়ের শরীরে গুলি লাগে,আরো বেশ কয়েকজন মহিলা পুলিশের লাঠির ঘায়ে জখম হন। চাঁদমণির পঞ্চায়েত সদস্য রবি খেরিয়া সহ ৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁদের নামে নানান ভুয়ো মোকদ্দমা দায়ের করা হয়। শ্রমিকদের প্রতিরোধ এত তীব্র ছিলো যে গুলি চালিয়েও বাগান খালি করা যায় না, উল্টে শ্রমিকেরা এবং তাঁদের সমর্থনে জড়ো হওয়া আশ পাশের মানুষদের সঙ্গে পুলিশের দীর্ঘ সময় ধরে সংঘর্ষ চলে। খবর পৌঁছে যায় শিলিগুড়িতে, যৌথ সংগ্রাম কমিটি প্রতিবাদ মিছিল বার করে, মহকুমা বন্ধের ডাক দেয়, বন্ধের দিন কমিটির সদস্যেরা গ্রেপ্তার হন।
চাঁদমণি গুলিকান্ড-পরবর্তী সময়ে,যৌথ সংগ্রাম কমিটি দিশাহারা হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র ও শাসক দলের মিলিত সংগঠিত সন্ত্রাসের উত্তর কমিটির কাছে ছিলো না। আন্দোলন নির্ভর করছিলো, সন্ত্রাসের মোকাবিলায় শ্রমিকদের আচরণ কি হবে তার উপর, শহরে নাগরিক প্রতিবাদ বা প্রচার সে মুহূর্তে আন্দোলনকে টিঁকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। এছাড়াও, সে সময় যৌথ কমিটিতে কম-বেশী সক্রিয় ছিলো খুব বেশী হলে গুটি চারেক সংগঠন—যাদের কারুরই এ জাতীয় যৌথ আন্দোলন, যার মূল ভূমিকায় আছেন শ্রমিকেরা, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিলো না। আন্দোলন বাঁচিয়ে রাখার জন্য, যৌথ সংগ্রাম কমিটি ও মজদুর মোর্চার অবশ্য করণীয় ছিলো আশপাশের চা-বাগানগুলোতে যাওয়া, সেখানকার শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন । ২০০২-এর মাঝামাঝি প্রধান ট্রেড ইউনিয়ানগুলি বাগান ছেড়ে পালাচ্ছে, একের পর এক বাগান বন্ধ হচ্ছে, অনাহারে শ্রমিকমৃত্যুর ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। অর্থাৎ চাঁদমণি ছেড়ে বেরিয়ে বৃহত্তর ও আরো প্রভাবশালী এক গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিলো। এই অতি-গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করা গেলো না কারণ যৌথ কমিটি ঐকমত্যে পৌঁছোতে পারলো না, বিশেষ, নানান ছোট ছোট রাজনৈতিক দল(বিভিন্ন নকসালপন্থী সংগঠন,এস ইউ সি আই) যারা এই কমিটিতে ছিলো তাদের ঘোরতর আপত্তি ছিলো। অন্যান্য চা-বাগানে যাওয়া মানে আন্দোলনের ভৌগোলিক পরিধির বিস্তার ও চরিত্রবদল,তাতে কোন দল/সংগঠন কি ফায়দা পাবে সে সব নিয়ে চুলচেরা বিচার আরম্ভ হলো—বর্তমান লেখক ও তার অদলীয় সংগঠন কমিটিতে নেহাৎই সংখ্যালঘু ছিলো, তার কথা কেউ গেরাহ্যি করলো না। ফলত আরো, যাকে বলা যেতে পারে, ট্যিপিকাল, সে জাতীয় কাজই  চলতে থাকলো—চিঠিচাপাটি স্মারকলিপি দেওয়া, সাংবাদিক সম্মেলন করা এই সব।
ইত্যবসরে,মজদুর মোর্চায় নিঃশব্দে ঘুণ লাগছিলো। ২০০২-এর অক্টোবর নাগাদ দার্জিলিং-এর জেলা শাসকের ডাকা এক বৈঠকে(শিলিগুড়ি সার্কিট হাউসে বৈঠক হয়), মোর্চার প্রতিনিধিরা এক সমঝোতাপত্রে সই করেন। এই সমঝোতায় স্থায়ী শ্রমিকদের প্রত্যেকের পাকা বাড়ি, মাথাপিছু দশ হাজার টাকা এককালীন, কারুর কাজ না যাওয়া ইত্যাদি সূত্র ছিলো। মানে দাঁড়ালো এই যে, বাগান উচ্ছেদের প্রশ্নটা এর ফলে কম-দরকারী হয়ে গেলো।
এরপর থেকে উচ্ছেদের ব্যাপারটায় বিশেষ সংশয় আর রইলো না। যৌথ সংগ্রাম কমিটির প্রতিবাদ, বাগানে মোর্চাকে পুনর্সংগঠিত করার চেষ্টা, আবার আদালতে যাওয়া ইত্যাদিতে লাভ হলো না। পুলিশ এবং আধা-সামরিক বাহিনী নামিয়ে চাঁদমণি ঘিরে ফেলে, শ্রমিক মহল্লায় সন্ত্রাস চালিয়ে, নাগরিকদের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের কন্ঠরোধ করে, ২০০৩-এর ১লা থেকে ৩রা ফেব্রুয়ারী, প্রায় একশো বছরের পুরোনো এই বাগানকে আক্ষরিক অর্থেই খুন করা হলো।
উচ্ছেদ-পরবর্তী কিস্যা: ২০০৩-২০১৩   
চাঁদমণি এখন ‘উত্তরায়ণ’, বিত্তবানদের আমোদপ্রমোদের, বাস করার জায়গা, মধ্যবিত্ত গরীব গুর্বোর বেড়াতে যাবার মল। আলো-ঝলমল সুসজ্জিত এই এলাকা দেখে আজ আদৌ বোঝার উপায় নেই এখানে কোনদিন চা-বাগান ছিলো, এক হাজারের-ও বেশী আদিবাসী শ্রমিক সেখানে কাজ করতেন, থাকতেন। এখনো যে ক’জন শ্রমিক কাজ হারিয়ে, এই বৈভব ও চাকচিক্যের সমারোহ থেকে দূরে, বাগানের একদা শ্রমিক-লাইনে টিঁকে আছেন, যে কোন দিন যাদের বাইরে চলে যেতে হবে, বাইরে থেকে তাঁদের দেখা যায় না।
অথচ উত্তরায়ণ নয়। চাঁদমণি চা-বাগান এখনও আইনত এই শ্রমিকদের বাসস্থান, আইনত চাঁদমণি চা-বাগান এখনও বর্তমান। উত্তরায়ণ কি তার সামনের যত্নে তৈরী সবুজ লনে শিল্পপতি হর্ষ নেউটিয়ার বেঙ্গল অম্বুজা কোম্পানির সরব উপস্থিতি এই প্রকল্প প্রসঙ্গে আইন ও নৈতিকতার অজস্র প্রশ্নকে ঢেকে দিতে পারে না। বিশেষ, যখন রাজ্যে বিপুল সংখ্যাধিক্যে নতুন সরকার, সরকারী জমি-চাষজমি নিয়ে, উচ্ছেদ-প্রচেষ্টা নিয়ে অনেক পুরোনো ঘটনার বিষয়ে সরকারী তদন্তের আদেশ জারী হয়েছে। চাঁদমণি চা-বাগান উচ্ছেদের পিছনে যে দীর্ঘ আইনভঙ্গের প্রক্রিয়া ছিলো এবং বাগান-উচ্ছেদের পরেও যে যে বে-আইন এখনও উত্তরায়ণ কর্তৃপক্ষ চালিয়ে যাচ্ছেন, সে বিষয়ে নিয্যশ নতুন করে নজর দেবার প্রয়োজন আছে ।
কলকাতা হাইকোর্টের দেওয়া শর্তের কথা বলা হয়েছে। বাগান উঠে মল হলো, বাড়ি হলো, অনেকে অনেক মুনাফা করলেন, উন্নয়ন হলো। শর্ত মানার কি হলো?
১/ ২০০৩-এ চাঁদমণি বাগান উচ্ছেদের সময় পর্যন্ত এবং তার পরে একটি শর্তও মানা হয়নি। ৪৬৪ একর ইজারা এলাকার বাইরে গিয়ে প্রায় পুরো বাগান এলাকাটাই ঢুকে গেছে উত্তরায়ণের পেটে। চা-গাছের চিহ্নমাত্র নেই।
২/বাগান শ্রমিকদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন প্রতারণা চালানো হয়েছে।পুর্নবাসনের নামে সুবলভিটা এলাকার সরকারী খাস জমিতে ও বনভূমিতে জবরদস্তি যে শ্রমিকদের বে-আইনী চালান করা হয়, তাঁদের প্রায় কেউই সেখানে থাকতে পারেন নি।সুবলভিটা এলাকায় ফুলবাড়ি চা-বাগানের যে তথাকথিত ডিভিশান রাতারাতি গড়ে শ্রমিকদের ‘পুর্নবাসিত’ করা হয়েছিলো,তা এখন অস্তিত্বহীন।চাঁদমণিতে থেকে গিয়েছিলেন যে শ্রমিকেরা,কাজ হারিয়েছেন তারাও।এলোমেলো ভাবে কেউ কেউ কিছু টাকা পেয়েছেন মাত্র।
৩/ লক্ষ্মী টাউনশিপ কোম্পানি,যাকে জমিটি ইজারা দেয়া হয়,তার কোন নামগন্ধ এখন উত্তরায়ণে এখন নেই,অন্তত দৃশ্যত।গোটা এলাকাটা চলে গেছে বেঙ্গল অম্বুজা কোম্পানির হাতে,যারা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় রিয়েল এষ্টেটের কারবার করেন। গোটা প্রকল্পে সরকারী ১৬ ভাগ অংশীদারীত্বের কি হলো,সে বিষয়েও কোন তথ্য নেই।
৪/ প্রকল্পটিকে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মঞ্জুর করেন।কিন্তু ইজারার শর্ত অনু্যায়ী যে প্রকল্প প্রস্তাব জমা পড়ার কথা ছিলো,তা আদৌ পড়েছিলো কি? পরিবেশ ছাড়পত্র কি এসেছিলো? বাগান যখন উপড়োনো হয় তখনও এ সব কিছুই হয়নি।
৫/ সবচাইতে বড় কথা,প্রকল্পটিতে বেঙ্গল অম্বুজা কোম্পানি কিভাবে এলেন? লক্ষ্মী টাউনশিপ কোম্পানিতে কি তাঁদের প্রতিনিধিত্ব ছিলো?
৬/ প্রায় জলের দরে(মাত্র ১৩ কোটি টাকায় প্রায় ৫০০ একর জমি,এখনকার অবস্থা ধরলে ৬০০ একরের-ও বেশী)  যাবতীয় আইন-কানুন লঙ্ঘন করে চাঁদমণি বাগানের সরকারী জমি বেচে দিয়েছিলেন তৎকালীন সরকার।শিলিগুড়ি শহরের সবুজ বলয়কে নির্মমভাবে ধ্বংস করে,আদিবাসী শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা ছিন্নভিন্ন করে যে হাই-টেক উপনগরী গড়ে তোলা হলো,তা থেকে কত মুনাফা এখন-ও পর্যন্ত তুলেছেন প্রকল্প নির্মাতারা? আরো কত মুনাফা হবে?
৭/ বলা হয়েছিলো,শিলিগুড়ি শহরের উপর চাপ কমানোর জন্য এই প্রকল্পটি ‘জনস্বার্থে’ প্রয়োজন।কি জনস্বার্থ এই প্রকল্প থেকে অদ্যাবধি রক্ষিত হয়েছে?
৮/ চাঁদমণি কেলেঙ্কারির সঙ্গে কারা যুক্ত ছিলেন? কারা এখনও আছেন?
২০১১-র আগস্টে যৌথ সংগ্রাম কমিটি সাংবাদিক সম্মেলন করে উপরের প্রশ্নগুলি তোলে,এবং চাঁদমণি প্রসঙ্গে নতুন করে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবী করে। ১৯৯৭ পর্যন্ত বাগানে বসবাসরত সমস্ত শ্রমিকদের উপযুক্ত পুর্নবাসনের, এবং ২০০২-এর গুলিতে আহত ও নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেবার দাবীও ওঠানো হয়। যৌথ সংগ্রাম কমিটিকে পুনরুজ্জীবিত করার এই শেষ পর্যায়ের চেষ্টা ফলপ্রসু হয়নি।
আমরা খুব সরল করে বলিনি, কিন্তু চাঁদমণির থাকা, রুগ্ন হওয়া, মরে যাওয়া, এই মূলত সরলরৈখিক গল্পটি একটানা পিছন ফিরে পড়লে একটি পাঠ তৈরী হয়। এই পাঠ প্রাকল্পিক, সাক্ষ্যপ্রমাণাদি দেওয়া যাবে না। কিন্তু নন্দীগ্রাম সিঙ্গুরাদির অনেক আগে, চাঁদমণিকে বড় কায়দায় নিকেশ করা যে হয়েছিলো,এতে সন্দেহ কম। এই এক কায়দায় কলকাতা ও আশেপাশের বহু কারখানা সুলভ প্রোমোটারখাদ্য হয়েছে,ফলে একটা ধারাবাহিকতা ছিলোই। কায়দাটি নিম্নরূপঃ
১/বাগানটিকে প্রথমে রুগ্ন বানানো হয়। ২/রুগ্ন বাগান কেনানো হয় এক চা-কর বা প্ল্যান্টারকে দিয়ে, যাতে লোকে সন্দ না করে। ৩/সরকার বাহাদুর মেনে নেন, বাগান বাঁচবে না। ৪/মৌ-সই হয়। ৫/সরকার জমি ফিরত নেনে, আবার ইজারা দেন, অন্য কোম্পানিকে। ৬/সেই কোম্পানিতে সরকারের অংশ থাকে, কিন্তু সে অংশ দেখা যায় না। ৭/বাগান, উন্নয়নের ঐতিহাসিক নিয়মে, পুলিশ দিয়ে উপড়োনো হয়, সেখানে মল হয়। ৮/ মল করেন অন্য আর এক কোম্পানি, যাদের নাম কোথাও ছিলো না। ৯/সিদ্ধান্ত—ওই কোম্পানিটি প্রথমাবধি ছিলো, জমিটি খুব সস্তায় তাদের ভোগে লাগার কথাই ছিলো, আগে যা হয়েছে তা সবই মায়ার খেলা বা আনোখা চমৎকার।
সুতরাং চাঁদমণি চা বাগান তার নিসর্গ, শ্রমিক, শ্রমিক মৃত্যু, উচ্ছেদ নিয়ে এখন নিতান্তই মরা ইতিহাস—যৌথ সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, মিছিলে হেঁটেছেন এমন অনেকে আকছার এখন উত্তরায়ণ সিটি সেন্টার মলে ঘুরতে বাজার করতে যান। এতে দোষ নেই, স্মৃতি সতত ভঙ্গুর। উল্টোদিকে বাজার সর্বশক্তিমান, এই  ধারণাটি অন্তত এ দেশে এখনো খুব চালু। উমবার্তো ইকো সাহেবের কায়দায়, স্মৃতির পরত খুঁড়ে, এক প্যালিম্পসেস্ট রূপে চাঁদমণি বাগানকে, যা কিনা এখন নেই, এখানে হাজির করা হলো। বাগানটি ফিরে আসবে না, কিন্তু মনে রাখা, মনে করা ভালো।
পাদপূরণ—উত্তরায়ণে জমিবাড়ি কিনেচেন এমন আপকান্ট্রি লোকজন আদালত যাচ্চেন।তাঁদের সম্পত্তির দলিল হচ্চে না,কেননা ইজারা/লিজ দেওয়া জমি বিক্কিরি হয় না।চাঁদমণি ওরফে উত্তরায়ণের মদ্দিখান দিয়ে প্রবাহিত একটি প্রাকৃতিক ঝোরা বুঁজিয়ে আরো বাড়ি উটচে।এতেও দোষ নেই।উন্নয়ন তো।
পরিশিষ্ট : চা বাগান, চা শিল্পের তথাকথিত রুগ্নতা ও শ্রমিক আন্দোলন প্রসঙ্গে কিছু ভাবনা
চা-শিল্পের সংকট
উত্তরবঙ্গের চা-শিল্পে আবার একটা তথাকথিত সংকট তৈরীহয়েছে। একের পর এক বাগান বন্ধ হচ্ছে, কখনো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই। ডানকান গোষ্ঠীর হাতে থাকা ১৬-১৭টা বাগান একসঙ্গে এই অবস্থায় আছে, বন্ধ কিন্তু বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নয়। এর আগে পরে অন্যান্য বাগান বন্ধ হয়েছে।
চা-শিল্পে যে সংকট তা যে আদৌ কোন সংকট নয়, সংকটটা যে তৈরী করা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশীয় বাজারে চায়ের চাহিদা বাড়ছে, রপ্তানিতেও এইমুহূর্তেই যে নতুন কোন ফেরবদল ঘটছে, তাও নয়। বড় চা-নির্মাতা শিল্পগোষ্ঠীদের অনেকেরই মুনাফা উর্ধগামী, যথা গুডরিক বা টাটাগোষ্ঠী। অন্যপ্রান্তে, ছোট চা-বাগানের সংখ্যা ও মোট এলাকা বাড়ছে।
চাহিদা থাকলে, চা উৎপাদন লাভজনক হলে সংকট কোথায়? বাগান বন্ধ হচ্ছে কেন? যে বাগান বন্ধ হচ্ছে, বন্ধ থাকছে, তা কি আবার চালু করা সম্ভব? সম্ভব হলে, বাগান চালাবেন কে বা কারা? যে মালিক/ মালিকদের আমলে বাগান ‘রুগ্ন’ হয়ে বন্ধ হয়ে গ্যালো, তাদের পক্ষে কি বাগান চালানো সম্ভব? তারা কি বাগান চালু রাখতে ইচ্ছুক? মালিক বদল করে কি বাগানের হাল ফেরানো যায়? সরকার/রাষ্ট্র যদি বাগান অধিগ্রহণ করেন, বাগান কি চালু রাখা যায়?
এই প্রশ্নগুচ্ছের উত্তর খোঁজাটা দরকার। না হলে বাগানবন্ধের ফলে সবচাইতে বিপন্ন যাঁরা, সেই শ্রমিকেরা হয় অনাহারে অর্ধাহারে মরতে থাকবেন, নয় অন্য কাজের সন্ধানে বাগান ছেড়ে চলে যাবেন। বাগানের চাগাছ অযত্নে শুকোবে, আগাছার জঙ্গলে ঢেকে যাবে। শেড ট্রি কেটে বেচে দেওয়া হবে। কারখানা, হাসপাতাল, স্কুল, বাবুদের কোয়ার্টার, শ্রমিকলাইন, সব পরিণত হবে ধ্বংসস্তুপে। দুতিন বছর বা তার বেশী সময় ধরে বন্ধ এমন বাগানে এ ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটছে। বাগান চালু না থাকলে, বাগান কেন্দ্র করে যে জনপদ গড়ে উঠেছে, তাও টিঁকে থাকবে না।
সংকট মোকাবিলায় যা চলছে ইদানীং
গত বারো-তেরো বছরের মধ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও অন্যান্যদের (যার ভিতরে সরকারও আছেন) তরফে চা-শিল্পের সংকট নিরসনে ও বিশেষত চা-শ্রমিকদের দুর্দশা দূরীকরণে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কাজ হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ান উদ্যোগে কিছু বন্ধ বাগান খুলেছে, বা খোলা/বন্ধ অবস্থায় আছে। রাজ্য সরকারের ফাউলেই প্রকল্পে বন্ধ বাগানশ্রমিকেরা ভাতা পাচ্ছেন। ট্রেড ইউনিয়ান ও সরকার ছাড়া, বৃহত্তর নাগরিক সমাজের পক্ষে নানা সময় বন্ধ বাগানে খাদ্য/ওষুধ ইত্যাদি ত্রাণবিলি হয়েছে, এখনো হচ্ছে। নাগরিক সংগঠন ও খাদ্যের অধিকার অভিযানের তরফে শ্রমিকদের খাদ্য সুরক্ষার দাবীতে যে মামলা করা হয় ও তার ফলে সুপ্রীমকোর্ট যে আদেশ দ্যান, তার পরবর্তী সময়ে বন্ধ বাগানে একাধিক সরকারী প্রকল্প চালু হয়েছে।
২০১২ থেকে ২০১৫-র গোড়া পর্যন্ত চা-বাগানে ন্যুনতম মজুরি চালু করার দাবীতে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। প্রায় সবকটি ট্রেড ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধভাবে যৌথ মঞ্চ গড়ে তোলে ২০১৪-য়। ২০১৫-য় রাজ্যসরকার’ নীতিগতভাবে’ বাগানশ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরির দাবী মেনে নেন, যদিও যৌথমঞ্চের সঙ্গে যে চুক্তি সরকারের হয়, তাতে মাত্র সর্বাধিক ১৭ টাকা মজুরি বৃদ্ধির কথা ছিলো।
আসল অবস্থাটা কি?
সংকটের মোকাবিলায় যা করা গ্যাছে, বা যা করার কথা ভাবা হয়েছে, এক কথায় তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য, অপ্রতুল। সমস্যার ভিতরে সেভাবে ঢোকা হয়ইনি। উৎপাদনশীল একটি শিল্প কেন সংকটগ্রস্ত’ হচ্ছে, সমস্যার উৎসে শিল্প ও শ্রমসম্পর্কের কি টানাপোড়েন রয়েছে, বোঝা হয়নি। ফলত আসলে যা শিল্প ও শ্রমসম্পর্কের বিষয়, তাকে মূলত এক সামাজিক পরিসরে সীমিত করে রাখা হয়েছে। চায়ের উৎপাদন-বিক্রী-মুনাফা-মজুরি-লগ্নি-উৎপাদন এই বুনিয়াদি সম্পর্কটি ঠিক কি ভাবে ও কেন বেশীর ভাগ বাগানে বিপর্যস্ত হয়ে গ্যাছে, তা তলিয়ে বোঝা যায়নি। ত্রাণ দিয়ে বা শ্রমিকদের এক জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে বাগানগুলিকে যে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়, বাগানকে বাঁচতে হলে যে উৎপাদনশীল শিল্প হিসেবেই বাঁচতে হবে, এই নির্মম সত্যকে মানুষের সামনে সেভাবে নিয়ে আসার চেষ্টাও হয়নি। সরকার/রাষ্ট্র এই কাজ করবে না। কিন্তু যে শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকস্বার্থে কাজ করছেন, যে নাগরিক সংগঠনেরা শ্রমিকদের পাশে সদর্থে দাঁড়াতে চাইছেন, তাঁদের এই মুহূর্তে এইটি অন্যতম মূল কাজ হওয়ার কথা।
উত্তরবঙ্গের, বিশেষত, ডুয়ার্স-তরাইয়ের চা-বাগিচার ক্ষেত্রে, উৎপাদন-বিক্রী-মুনাফা-মজুরি-লগ্নি-উৎপাদন এই বুনিয়াদি সম্পর্ক শেকলে দুটি ঐতিহাসিক বিশেষতা রয়েছে। এক, নামমাত্র খাজনায় বাগানের জমি বন্দোবস্ত পাওয়া, দুই, দাস-শ্রম। এই এলাকায় চা বাগিচা গড়ে ওঠার পিছনে জমি ও শ্রমের সহজলভ্যতা কাজ করে, যেভাবে ভারতের ও পৃথিবীর অন্যত্র আদি উপনিবেশগুলির অনেকগুলিতেই ঘটেছে। কমবেশী একশো পঞ্চাশ বছরের মধ্যে, খাজনা সে ভাবে না বাড়ুক, মূল্যহীন শ্রমের দাম বেড়েছে বহুগুণ। নগদ মজুরিতে না হোক, সামাজিক নিরাপত্তার দায় চোকাতে শ্রমিকপিছু বিনিয়োগ বেড়েছে। বাগিচাশিল্পের আদিকালে, শ্রমিকেরা নিজেদের খাদ্য উৎপাদন নিজেরা করতেন বাগানের জমিতে, নগদ মজুরি নামমাত্র। স্বাধীনতা-উত্তরকালে, ট্রেড ইউনিয়ান আন্দোলনের অভিঘাতে ও প্ল্যান্টেশান লেবর য়্যাক্টের ধাক্কায়, শ্রমিকদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা বাবদ বিনিয়োগ আইনত বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে, ফলত একদিকে যেমন নগদ মজুরি সেভাবে বাড়েনা, অন্যদিকে বাগানের যাবতীয় ফাঁকা জমিতে বাগিচা বিস্তৃত হয়, শ্রমিকদের চাষের জমিতেও থাবা পড়ে। অর্থাৎ মুনাফা একমাত্রায় রাখা ও বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন বাড়ানো ও শ্রমিকদের মজুরি যথাসাধ্য না বাড়ানো এই দুই প্রক্রিয়া যুগপৎ চালু থাকে। যেহেতু চায়ের বাজারে ভাঁটা সেভাবে আসেনি বললেই হয়, এই প্রক্রিয়া মুনাফা নিশ্চিত করার পক্ষে যথেষ্ট। উদাহরণ, টাটা বা গুডরিক গোষ্ঠীর লাগাতার মুনাফাবৃদ্ধি।
তাহলে বাগান বন্ধ হয় কেন?
উত্তরবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে এর দুটি প্রধান কারণ আছে। প্রথমটি স্থানীয়, কমবেশী অনেকেই জানেন। টাটা, গুডরিক বা এ জাতীয় বড় চা-কর গোষ্ঠীর হাতে যা বাগান আছে, তার চাইতে বেশী সংখ্যক বাগান আছে ব্যাপারী ও মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়েদের মালিকানায়। বাগান ঠিক ভাবে চালানোর প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা, পুঁজি বা ইচ্ছা কোনটাই এদের নেই। যতদিন বাগান হাতে থাকে, পুঁজির যোগান হয় তিন প্রকারে। এক, টি বোর্ডের দেওয়া অনুদান, ও সরকারী ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ। দুই, শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য প্রাপ্য বাকি রাখা, না দেওয়া। তিন, উৎপাদন স্থিতিশীল রাখা ও বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি বাগানে লগ্নি না করা। উৎপাদনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যতদিন জারি থাকে, অর্থাৎ যতদিন গাছে স্বাভাবিক নিয়মে (বা যতটুকু কাজ না করলে নয় করে) পাতা আসে, বাগান চালু থাকে ততদিন। শ্রমিকদের বকেয়া ও বাইরের ঋণ যখন মেটানোর সময় আসে, তখন পাতা থাকলেও চলে না, বাগান বন্ধ করতেই হয়।
দ্বিতীয় কারণটি পুঁজির বিশ্বজনীন চলনের সঙ্গে যুক্ত। সারা পৃথিবীতে আশির দশক থেকে পুঁজি ক্রমশ উৎপাদনশীল নির্মাণক্ষেত্র বা ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টার থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। নির্মাণক্ষেত্রে শ্রমের প্রয়োজনও কমছে, যে নির্মাণশিল্পে কায়িক শ্রম প্রয়োজন সেখানে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়তে বাড়তে এমন স্তরে পৌঁছেছে যে শ্রম উদ্বৃত্ত ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে।
পুঁজির মূল বিনিয়োগের জায়গা এখন অর্থ-বাজার বা ফিনান্স মার্কেট, ও তার পরেই দ্রুত বেড়ে চলা বিচিত্র পরিষেবাক্ষেত্র বা সার্ভিস সেক্টার। এই দুই ক্ষেত্রেই অনেক কম সময়ে বেশী মুনাফা করা সম্ভব। ফলে শ্রমনিবিড়, প্রাচীনধর্মী নির্মাণক্ষেত্রে পুঁজি আর আটকা থাকতে চাইছেনা। চা-বাগান বা বাগিচাশিল্প প্রাচীনধর্মী ও শ্রমনিবিড়, যন্ত্রায়নের সুযোগ এখানে সীমিত। এক্ষেত্রে পুঁজি চাইবে উৎপাদনের বিকেন্দ্রীভবন, বড় সংগঠিত বাগিচার জায়গায় ছোট অসংগঠিত বাগান, যেখানে উৎপাদনের খরচা কম, পুঁজি সেদিকেই যাবে। পৃথিবীর সর্বত্র নির্মাণক্ষেত্র ভাঙছে, বিকেন্দ্রিত হচ্ছে, যন্ত্রায়িত হচ্ছে।
চা-বাগানে অন্যরকম কিছু ঘটার কথা নয়। কিছু পুরোনো শিল্পগোষ্ঠী যাদের চায়ে লগ্নি প্রচুর এবং সে লগ্নিকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তারা ছাড়া বাগিচাকেন্দ্রিক উৎপাদনসম্পর্ক আঁকড়ে শেষ পর্যন্ত বিশেষ কেউ থাকবে, মনে হয়না।
অর্থাৎ, স্থানীয় অবস্থাটি এক্ষেত্রে বিশ্বজনীন অবস্থার অনুবর্তী, পরিপূরক। উভয়ত, পুরোনো বাগিচাগুলি নষ্ট হচ্ছে, ভাঙছে। উৎপাদন প্রক্রিয়া ও সমগ্র শিল্পসম্পর্ক উথালপাথাল বদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শ্রম ও শ্রমিক সেখানে বাতিল, ফালতু। মজুরি বাড়ানো হয় সম্ভব নয় (পুঁজি নেই), নয় অপ্রয়োজনীয় (পুঁজি অন্যত্র লগ্নি অনেক বেশী লাভজনক)। এই অবস্থায় মজুরিবৃদ্ধির পুরোনো আন্দোলন নিতান্ত বাহ্যিক হতে বাধ্য। সরকার/রাষ্ট্র এই অবস্থার মূলগত পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না, যে পুঁজি বাগিচা ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাকে ফিরিয়ে আনা তার সাধ্যাতীত। সরকারের কাছে সামাজিক নিরাপত্তার দাবী করা যায়, করাটা যৌক্তিক। কিন্তু যে সমস্যা মূলত পরিবর্তিত শিল্পসম্পর্কের, পুঁজির বদলে যাওয়া চলনের, সামাজিক নিরাপত্তা (খাদ্যসুরক্ষা, মনরেগায় কাজ) দিয়ে তার স্থায়ী মীমাংসা করা সম্ভব নয়।
কি করা যায়? আন্দোলন কোন পথে?
পুরোনো ধাঁচের ট্রেড ইউনিয়ান আন্দোলন মোটামুটি অচল। রাষ্ট্র শিল্পসম্পর্কের মৌলিক সমস্যা মেটাতে চায়না, সক্ষমও নয়। শ্রমিকেরা কি করবেন তাহলে? কি করবেন বৃহত্তর নাগরিক সমাজ যাঁরা চাইছেন বাগান খুলুক, চা-শ্রমিকেরা মর্যাদা নিয়ে বাঁচুন?
শ্রমিকদের সামনে, সহযোগী নাগরিকদের সামনে আজকের এই অবস্থা সমস্যার এবং সম্ভাবনার। সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করতে, না খেতে পেয়ে মরতে মরতে ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন আন্দোলনের ডাক দিতে একমাত্র তাঁরাই পারেন। চা বাগান তাঁদের কাছে পুঁজিলগ্নি ও মুনাফা করার জায়গা নয়, তা তাঁদের বাস্তুভিটে, সংষ্কৃতির আধারও। পুরুষানুক্রমে তাঁদের শ্রম অন্যের পুঁজি হয়ে বাজারে ঘুরেছে, এখনো ঘুরছে। পুঁজির নিজস্ব কায়দায় সেই পুঁজি এখন তাঁদের বাতিল পরিত্যক্ত ঘোষণা করছে। যে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাকেও পরিত্যাগ করছে পুঁজি। পুঁজির এই বেইমানীর যোগ্য জবাব, উৎপাদন প্রক্রিয়াকে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দখল করা। বাগিচার জমি, বাগিচার চাগাছ, শেডট্রি, কারখানা, কোয়ার্টার, বাংলো সবকিছু শ্রমিকদের অধিকারে যাক। যে জমিতে চা চাষ করা যায়, চাষ হোক, বাকিতে শ্রমিক পরিবারেরা যৌথচাষ করুন, খাদ্যশস্য বা অন্যশস্য ফলান।
চাষ করা চা কারখানায় তৈরী হোক, বিক্রী হোক যৌথভাবে, শ্রমিক আন্দোলনের, সমবায়ের মাধ্যমে। কোন শ্রমিক পরিবারকে না খেয়ে মরতে হবেনা, ত্রাণের জন্য বসে থাকতে হবে না। চা বিক্রীর টাকায় বাগানের জনপদ বাঁচবে।
সহযোগী নাগরিক বন্ধুরা এগিয়ে আসুন। সরকারকে সবাই মিলে বলা হোক বাগানের পুরোনো দেনার দায় নিতে, পুরোনো মালিকদের বাধ্য করতে শ্রমিকদের বকেয়া মেটাতে। বাগানে হাসপাতাল, স্কুল এসব চালু করতে, চালাতে সরকার এগিয়ে আসুক। যা পুঁজিমালিকের, পুঁজির ছিলো, তা সমাজের হোক। শ্রম শ্রমিকের হোক।
নতুন আন্দোলনের সময় এসেছে।

2 thoughts on “এসো মনে করি চাঁদমণি: এক পুনর্নির্মাণ প্রচেষ্টা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.