সর্বজয়া ভট্টাচার্য

ফেসবুকীয় আন্দোলন নিয়ে আমরা অনেকে অনেকসময় নাক কুঁচকে থাকি। তার পুরোটাই অন্যায্য নয়। কিন্তু এই ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে ভর করেই আবার আমাদের এই যুগে গড়ে উঠছে নানান নতুন আন্দোলন, যা সোশাল মিডিয়ায় বদ্ধ না থেকে সরাসরি রাস্তায় উঠে আসছে। তেমনই আরেকটি ভিন্ন ধারার বামপন্থী মোচ্ছবি পদযাত্রাই হল কলকাতার বুকে ‘জুলুস’। বাংলা নববর্ষে প্রথম পা ফেলে যে এর মধ্যেই মে দিবসে তার দ্বিতীয় পা মাটিতে ফেলে হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। প্রতিবাদের নন্দনতত্ত্ব বলতে বাঙালি ভদ্রলোক এতদিন যার সাথে পরিচিত ছিল, তার সাথে এই শোভাযাত্রার একটা পার্থক্য রয়েছে। যার প্রতিবাদ বিজেপি-তৃণমূলের হীরক রাজারাণীদের যথেচ্ছাচার থেকে শুরু করে, ধর্মীয় মৌলবাদের তোষণ-পোষণ থেকে শুরু করে, যশোর রোডে বেআইনি গাছ কাটা অব্দি; যাকে নিয়ে সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায় লিখেছেন “রায়বেঁশে নাচিয়েদের কায়দায় কোমরবন্ধে লালপাড় গামছা আর হেঁটো ধুতি এঁটে বাংলার ঢাক বাজাচ্ছে ঢাকিরা আর তাঁদের তালে তালে নাচছে তরুণ-তরুণীরা। তাঁদের চরণভাঙ্গা গানে গানে ধর্মের নামে ঘৃণা আর মৃত্যুর ব্যাপারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে দেশ জুড়ে হৃদয়ে হৃদয় মেলানোর কথা, খেটে- খাওয়া মানুষে মানুষে ভালবাসা, ভাইচারার কথা। হ্যাঁ, যারা গাইছে-নাচছে তাঁরা অধিকাংশ শিক্ষিত, শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্ত। এঁরা ফেসবুক প্রজম্মের অংশীদার। কিন্তু সেলফি-সর্বস্ব আত্মমগ্ন পণ্যরতির সময়ে ওরা ব্যতিক্রম“, সেই জুলুসের নববর্ষীয় প্রথম পদক্ষেপ নিয়ে ছোট্ট রিপোর্ট লিখলেন সর্বজয়া ভট্টাচার্য। সঙ্গে সহপদযাত্রী সৌরভ বসুর তোলা ছবি।

জুলুস আসলে কোনো বাংলা শব্দ নয়। যেমন ধরা যাক চেয়ার, কিংবা কাপ, কিংবা সাবধান, বা খবরদার – এগুলোও আদতে বাংলা শব্দ নয়। তবে এদের সঙ্গে জুলুস শব্দটার একটা পার্থক্য আছে। আছে পরিচিতির পার্থক্য। যে সমস্ত ‘বিদেশি’ বা ভারতেরই অন্য ভাষার শব্দ সহজেই জায়গা করে নেয় বাংলা ভাষায় – যাদের আমরা আর আলাদা করে চিনতেও পারি না, চেনার প্রয়োজনও বোধ করি না – খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এই শব্দগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই আমাদের প্রত্যেক দিনের জীবনের সাথে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত। বিশেষ করে এই ইংরেজি শব্দগুলো। জুলুস আসলে আমাদের প্রত্যেক দিনের জীবনের সাথে জড়িয়ে নেই। তাই জুলুস মানে যে মিছিল, এই কথাটা চট করে মাথায় আসবে না। মিছিলের প্রতিশব্দ হিসেবে আজকাল, ক্ষেত্রবিশেষে ‘জাঠা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় – দীর্ঘ মিছিল বোঝাতে গেলে। কিন্তু জুলুস শব্দটা এখনো মোটের ওপর অপরিচিত আমাদের কাছে।
তাই ফেসবুকে যখন দেখা গেল ‘বাংলা নববর্ষে জুলুস’ – তখন প্রথমে সবাই খানিক বিভ্রান্তই ছিল বলা যায়। কিছুটা সময় চলে গেল জুলুস জিনিসটা ঠিক কী, এটা স্থির করতে। আর স্থির যদি বা হল, বাঙালির নববর্ষের সাথে এর কী সম্পর্ক?


আমার জীবনের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ছুটি থাকত। কলকাতা শহরের আর কোনো ইস্কুলে থাকত বলে মনে হয় না। আমাদের ইস্কুলে বিশ্বকর্মা পুজো হত না। একটা বয়স অব্দি আমিও দেখেছি, ছুটির নোটিসে লেখা থাকত, ছাত্র-ছাত্রীরা ঘুড়ি ওড়াবে বলে কাল স্কুল বন্ধ থাকবে। স্কুলের ভেতরে ধর্মের প্রবেশাধিকার ছিল না, ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠানেরও না। ধর্মে বাইরে রেখে গেট পার করতাম আমরা। রাখা যায় না পুরোটা। নিশ্চয়ই আমাদের সেই অ-ধার্মিক ইস্কুল জীবনেও ধর্ম তার নাক গলাতো কখনো-সখনো; হয়তো ২০০২ সালে, আমরা এক ধাক্কায় খানিকটা বড় হয়ে গেলাম যে বার, আমরাও মাথা নীচু করে ক্লাসঘরে ঢুকে গেছি, ওয়াসিমের চোখে চোখ না রেখেই। কিংবা, অতটাও বড় কিছু নয়, আবার অতটাই বড় হয়তো – আমার মনে পড়ছে না আমাদের ছাত্রাবস্থায় স্কুলে কোনোদিন কোনো শিক্ষক বা শিক্ষিকা পড়িয়েছেন কী না যিনি হিন্দু অথবা ব্রাহ্ম নন। কিন্তু আমাদের সেই স্কুলের পক্ষ থেকেই আবার, সেই ২০০২ সালেই, একটা মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল। কিড স্ট্রিটে রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িতে বসে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ লিখেছিলেন, সেখান থেকে পার্ক সার্কাস অব্দি। উদ্দেশ্য? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ডাক। সেখানেও নাচ ছিল, খোলা গলায় গান ছিল। সেটাও কী জুলুস-ই ছিল একরকম?

তাই যদি হয়, তাহলে এই নতুন বছরের প্রথম দিনের মিছিল কলকাতায় দেখা আমার দ্বিতীয় জুলুস। কলেজ স্কোয়ার থেকে বিবেকানন্দ রোড, আমহার্স্ট স্ট্রিট ঘুরে আবার কলেজ স্কোয়ার। রাস্তা জুড়ে নাচ-গান-ঢাকের বাজনা। হাতে পোস্টার। বিলোবার জন্য লিফলেট। আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যে যতই বাংলা খবরের চ্যানেল আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে হোর্ডিং আর বিজ্ঞাপন চিৎকার করে বলার চেষ্টা করুক বাঙালির উৎসব হচ্ছে দুর্গাপুজো, আসলে বাঙালির উৎসব বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেটা হল এই নববর্ষ। বিভেদ-হীন। ধর্মসম্পর্ক-হীন।

দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু মানুষ জুলুসের ডাক দিয়েছিলেন। মনে রাখা প্রয়োজন, দলের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও, জুলুসের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক আছে যথেষ্ট। এটাও আসলে একটা রাজনৈতিক প্রচেষ্টা, এক ধরণের আদর্শকে প্রচার করার প্রচেষ্টা।
সবাই জানে, একদিন একটা জুলুস-এ কিছু পালটায় না। দু’দিন দুটো অথবা তিন দিনে তিনটে জুলুসেও পাল্টাবে না কিছু। মিছিল আরো দীর্ঘ আসলে, সেখানে জুলুস একটা পা-ফেলা মাত্র।

“Step by the step, the longest march, can be won, can be won.
Many stones can form an arch, singly none, singly none.”

***

ফটোগ্রাফি – সৌরভ বসু

2 thoughts on “জুলুস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.