শিরীষা নাইডু (অ্যাসোসিয়েট প্রোফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, রাইট স্টেট ইউনিভার্সিটি)
সঙ্গের কার্টুন – রেবেল পলিটিক (https://rebelpolitikblog.com/)
To read this article in English, click here.
এই লেখাটি আমাদের অর্থনীতি সিরিজের দ্বিতীয় লেখা। আপাতত আমাদের উদ্দেশ্য হল অর্থনীতির কিছু খুব সাধারণ ধারণা ও সংজ্ঞা, যা আমরা সর্বদাই খবরের কাগজে পড়ি, নিউজ চ্যানেলে – এমনকি রোজকার কথাবার্তাতেও শুনি, তাদের সহজ ভাবে বোঝানো। এই সাধারণ ধারণাগুলি যত কম মানুষ পরিষ্কার ভাবে জানেন, বা বুঝতে পারেন, যেকোনো সরকারি স্তরে বা কর্পোরেট সেক্টরগুলির পক্ষে তাঁদের বোকা বানানো ততই সহজ হয়ে ওঠে। সহজ হয়ে ওঠে উন্নয়ন সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার মিথ্যা কাহিনী নির্মাণ, আমাদের কিসে ভালো হবে, হচ্ছে, তাই নিয়ে যথেচ্ছ মিথ্যাচার।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বেকার যুবশক্তির জন্য বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। হালে পকোড়া বিক্রি একটি যথাযথ কাজ হিসেবে গণ্য কিনা, সে বিষয়ে তাঁর মন্তব্য বিতর্কের ঝড় তুলেছে। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তেলেভাজা শিল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এইজাতীয় মন্তব্য করেছিলেন এবং আরও হালের খবর – ত্রিপুরার নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী যুবকদের পানের দোকান দিতে পরামর্শ দেন – সরকারি চাকরির অপেক্ষায় না থেকে।
বর্তমান লেখাটি এইসব মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে প্রশ্ন তোলে, ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়নের যা পরিস্থিতি, তাতে স্ব-নিয়োজিত কাজই লক্ষ লক্ষ বেকারের একমাত্র সম্ভাব্য আয়ের পথ কিনা।
প্রিয় পাঠক, এই সিরিজটি বিষয়ে আপনার মতামত জানান। তাতে বিষয় নির্বাচন এবং লেখার ভঙ্গি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সুবিধা হবে।
এই সিরিজের আগের লেখা “অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফাঁদ” পড়তে এখানে ক্লিক করুন

২০১৮-র উনিশে জানুয়ারি, জি নিউজের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মন্তব্য করেন – “যদি কেউ আপনার অফিসের সামনে পকোড়ার দোকান খোলে, সেটা কি চাকরি বলে গণ্য করা হবে? ঐ পকোড়া বিক্রেতার দৈনিক রোজগারের  ২০০ টাকার হিসেব থাকছে না কোনো সরকারি খাতায়। অথচ সত্যিটা হচ্ছে এই যে, বহু মানুষ এইরকম নানা কাজ বেছে নিচ্ছেন।” এই মন্তব্যর উপর ভিত্তি করে অনেক কথার পরে কথা, মোদীর পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনা ও ব্যঙ্গমূলক অনেক লেখা, অনেক ‘মিম’ তৈরি হল। কিন্তু এই মন্তব্যের গভীরে লুকিয়ে আছে অনেক না বলা কথা। পকোড়া বা রাস্তার খাবারের দোকান কি চাকরির ক্ষেত্র? পকোড়া বিক্রি কি তাহলে জীবিকা হিসেবে মানুষের বিশেষ কাম্য নয়? কেন?
অর্থনৈতিক সূচক হিসেবে জিডিপি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য এবং মানুষের ভালো-খারাপ থাকার একটি পরিমাপ দেয় – যেমন আমরা আগের লেখাটিতে পড়েছি। একজন গড়পড়তা সাধারণ নারী – ধরা যাক তাঁর নাম মিরিয়ম, যিনি কলেজে পড়েছেন – চাকরির ব্যাপারে তাঁর ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলি উঠে আসবে – জিডিপি বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে তিনি কি চাকরি পাবেন? পকোড়া বিক্রিই কি তাঁর একমাত্র সম্ভাব্য কাজ? এই কাজ পাবার ফলে তাঁর ও তাঁর পরিবারের জীবনযাত্রার মান কি উন্নততর হবে? ঘুরিয়ে বললে, জিডিপি-জিডিপি করে এই যে অত্যুৎসাহ, তার নীচে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দুটি ধারণাকে আমরা প্রশ্নের আকারে প্রকাশ করতে পারি – এক, জিডিপি বাড়া মানেই কি চাকরির সুযোগ বাড়া? দুই, চাকরি মানেই কি জীবনযাত্রার মানের উন্নতি? প্রথম প্রশ্নের উত্তর আমরা এই লেখাটিতে খুঁজব। পরের প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা হবে এর পরের লেখাটিতে।

অর্থনৈতিক (জিডিপি) উন্নতি  = চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি? 
অর্থনৈতিক বিকাশ কাম্য, কারণ আমরা মনে করি, তা চাকরির সুযোগ বাড়ায়। কিন্তু সত্যি বাড়ায় কি?
মিরিয়মের জন্য এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বার করতে গেলে আমাদের জেনে নিতে হবে বেশ কিছু বছরের অর্থনৈতিক তথ্য। নীচের সারণী ১-এ ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩-৯৪, ১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০০৯-১০ এবং ২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬ – এই তিনটি সময়কালের তথ্য দেওয়া হল। ভারত ১৯৯১-এ উদারনৈতিক নীতি নিয়ে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করার ঘোষণা করে। এই সারণীতে সেই সংস্কারের আগের ও পরের তথ্য তুলনা করা হল।
সারণী ১:

সময়সীমা বাৎসরিক ভাবে চাকরির সংখ্যা বৃদ্ধি (মিলিয়ন/দশ লক্ষ) বাৎসরিক ভাবে কৃষি ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে চাকরির বৃদ্ধি  (মিলিয়ন/দশ লক্ষ) বাৎসরিক ভাবে কৃষি ক্ষেত্রে চাকরির বৃদ্ধি  (মিলিয়ন/দশ লক্ষ) জিডিপি বৃদ্ধির বাৎসরিক হার (%)
১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩-৯৪ ৬.৮ ৩.৮ ৩.৩ ৫.২
১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০০৯-১০ ৫.৩ ৫.৪ -০.১ ৬.৮
২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬ -১.৬৩ ১.৫৩ -৩.২ ৬.৮

তথ্যসূত্র – Thomas 2012; GoI (2016); National Accounts Statistics
সারণী অনুযায়ী, ১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০১৫-১৬-র অর্থনৈতিক সংস্কারের সময় বাৎসরিক জিডিপি বৃদ্ধির হার হয় ৬.৮%, যা কিনা সংস্কারের আগের ৫.২% হারের চাইতে বেশি। অথচ ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩-৯৪-এ বাৎসরিক ৬৮ লক্ষ চাকরি সৃষ্টি হয়, যেখানে কিনা ১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০০৯-১০-এর মধ্যে চাকরি সৃষ্টি হয় ৫৩ লক্ষ, ২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬-র মধ্যে চাকরির সংখ্যা বাড়বার বদলে ১৬.৩ লক্ষ কমে যায়।
অর্থাৎ, ১৯৯৩-এর পরবর্তী সময়ে যে সংস্কার ও অর্থনৈতিক বিকাশ, তাতে চাকরির সংখ্যা বাড়েনি। আরও সাম্প্রতিক কালে তো চাকরির সংখ্যা বাড়ার জায়গায় কমেই যাচ্ছে। কেউ কেউ এই ঘটনাকে ‘জবলেস গ্রোথ’ বা ‘চাকুরিহীন উন্নয়ন’ নাম দিয়েছেন। মানে, মিরিয়মের পক্ষে সংস্কারের পরের চাইতে আগেই চাকরি পাওয়া সহজ ছিল। আবার, ১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০০৯-১০-এর মধ্যে চাকরি পেলেও ২০০৯-১০ থেকে ২০১৫-১৬-র মধ্যে সেই চাকরি তাঁর হারাবার সম্ভাবনা ছিল অনেকটাই।
দেশের গোটা চাকরি ক্ষেত্রটাকে এবার আমরা কৃষি (চাষ ও অন্যান্য – যেমন, মৎস্যচাষ, বনপালন ইত্যাদি) ও অ-কৃষি – এই দুই ভাগে ভাগ করে নিই, এবং দেখি, যে মিরিয়মের পক্ষে কোথায় কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩-৯৪-এর প্রাক্‌-অর্থনৈতিক সংস্কার যুগে এই দুই ভাগে বাৎসরিক চাকরির সংখ্যা বৃদ্ধি কাছাকাছি ছিল। অতএব মিরিয়ম এই দুই ক্ষেত্রেই কাজ পেতে পারতেন। কিন্তু ১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০০৯-১০-এর মধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে বছরে ১ লক্ষ চাকরি কমে যেতে শুরু করে, এবং ২০০৯-১০ থেকে ২০১৫-১৬ – এই সময়ে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় বছরে ৩২ লক্ষে। অতএব ১৯৯৩-৯৪-থেকে ২০১৫-১৬-র মধ্যে চাকরি করতে গেলে আমাদের বন্ধু মিরিয়মের পক্ষে অ-কৃষি  ক্ষেত্রেই চাকরি নেওয়া ভালো বলে মনে হচ্ছে। এখানে আমরা অবশ্য চাকরিক্ষেত্রে লিঙ্গের বিচার ধর্তব্যের মধ্যে আনছি না; সে নিয়ে আমরা পরে একটি লেখায় আলোচনা করব।
এখন, এই যে কৃষি ক্ষেত্রে চাকরি হ্রাস – এবং সাধারণ ভাবে কৃষিব্যবস্থার দুরবস্থা – তার পিছনে নানান কারণ দেখানো হয়েছে – যেমন, মধ্যবিত্ত কৃষকদের ক্রমবর্ধমান ঋণ, আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ওঠাপড়া, সেচে সরকারি লগ্নির অভাব ও অন্যান্য কৃষি-সম্পর্কিত পরিকাঠামো। একুশ শতকে ভারতে কৃষির ব্যাপক সংকটের ফলে একটা বড় অংশের কৃষকরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন, অথবা অন্য ক্ষেত্রে চাকরি খুঁজতে গেছেন। অর্থাৎ, কৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত মিরিয়মের বাবা-মাকেও – যাঁরা গত ২০ বছর ধরে তাঁদের গ্রামে চাষের জমিতে কাজ করেছেন – ১৯৯৩-৯৪ নাগাদ সময় থেকে অ-কৃষি ক্ষেত্রে কাজ খুঁজতে যেতে হয়েছে।
প্রচলিত অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা অনুযায়ী কৃষি থেকে অ-কৃষিমূলক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সরণ ‘উন্নয়ন’-কেই সূচিত করে। চাকরি ব্যবস্থার পরিকাঠামোর ব্যাপারে এই পরিবর্তনকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বলেই ধরা হয়। ভারতীয় অর্থনীতিতে এখন এই পরিবর্তনের নানা  চিহ্ন দেখা যাচ্ছে – কৃষি ক্ষেত্রে চাকরি কমে যাচ্ছে দ্রুত। কিন্তু বাস্তবে সেই অনুপাতে অ-কৃষি ক্ষেত্রে সেই পরিমাণ নতুন চাকরি একেবারেই তৈরি হচ্ছে না। তাই মিরিয়মের বয়স্ক বাবা-মার মতো মানুষদের হাতে বিকল্প কাজের সম্ভাবনা থাকছে খুব কম; যুবসম্প্রদায়ের অবস্থাও তথৈবচ। মোটের উপর ২০১১-১২ এবং ২০১৫-১৬-র মধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ১২.৬ মিলিয়ন হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু অ-কৃষি ক্ষেত্রে মোটে ৬.১ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান ঘটেছে। এর ফলে, এই সময়কালে এ দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা কমে গেছে ৬.৫ মিলিয়ন।

চাকরির রকমগুলিকে বোঝার চেষ্টা 
মিরিয়ম এবং তাঁর বাবা-মার কাজের প্রয়োজন তো রয়েছেই। কিন্তু তার সাথে তাঁরা – শ্রমজীবীদের অবস্থা গভীর ভাবে যাঁরা বুঝতে চান, তাঁদেরই মতো – নিজেদের জন্য সম্ভাব্য চাকরির রকম এবং গুণাগুণও বুঝে নিতে চাইবেন বৈ কি। এ দেশের সরকারি স্ট্যাটিস্টিকাল ডেটা বা সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য থেকেই তাঁরা ক্রমশ বুঝে ফেলতে পারবেন, যে পকোড়া বিক্রিকে সম্ভাব্য কাজ হিসেবে ধরা যায় কিনা। এবং তার সাথে আমরাও বুঝে নেব, যে যেকোনো চাকরিই শ্রমজীবীর জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটায় কি না; যদিও এটা নিয়ে আরও দীর্ঘ আলোচনা আমরা করব এর পরের লেখাটিতে।
ভারতের নানা সরকারি ডেটা এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী শ্রমজীবী মানুষদের চার ভাগে ভাগ করা যায়:
ক) ফর্মাল ও ইনফর্মা‌ল সেক্টরে নিয়মিত মজুরি পান যে শ্রমিকরা। এখানে ফর্মাল সেক্টর মানে সরকারি ভাবে নানা নিয়ম (যেমন ন্যূনতম কর্মচারীর সংখ্যা) অনুযায়ী রেজিস্টার করা যে উদ্যোগ। ফর্মাল সেক্টরে এঁরা নানা প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগসুবিধা পান, যেমন পাকা বা প্রায় পাকা চাকরি, নিয়মিত কাজের দায়িত্ব, সামাজিক সুরক্ষা (সোশ্যাল সিকিউরিটি)।  ইনফর্মাল সেক্টরে নিয়মিত মজুরি পান যাঁরা, তাঁদের চাকরির তেমন নিরাপত্তা নেই, এবং ঐসব প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাও তাঁদের নাগালের বাইরে। মিরিয়ম যদি কোনো কোম্পানিতে নিয়মিত মাইনের স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে চাকরি পান, তিনি এই ধরনের চাকরির আওতায় পড়বেন। যদি তিনি গারমেন্ট-শ্রমিক বা বস্ত্রশিল্প-শ্রমিক হিসেবে কাজ পান, যেখানে মাইনে ও মাইনের সাথে জড়িত সুযোগসুবিধা ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগও কম, সেক্ষেত্রেও তাঁকে নিয়মিত মজুরির শ্রমিক বলেই গণ্য করা হবে।
খ) চুক্তি শ্রমিকদের ‘ভাড়া’ করা হয় বিশেষ সময়কাল ধরে, বিশেষ কাজের জন্য, কনট্র্যাক্টরদের মাধ্যমে। সারণী ২-এর তথ্য থেকে দেখা যাবে, ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩-৯৪ অব্দি নিয়মিত মজুরি পাওয়া শ্রমিকদের মধ্যেই চুক্তি শ্রমিকদের গণ্য করা হচ্ছে। ১৯৮৩ থেকে ২০১৫-১৬-র ভিতরে কিন্তু নিয়মিত মজুরি পাওয়া শ্রমিক এবং চুক্তি শ্রমিকের সংখ্যার অনুপাত বেড়ে গেছে ৪%-এরও বেশি – ১৬.৪% থেকে ২০.৭%।
গ) স্বনিয়োজিত কর্মজীবীর সংখ্যার অবশ্য বিশাল কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৮৩-তে যা ছিল ৫২%, ২০১৫-১৬-তে সেটা দাঁড়িয়েছে ৪৭%। আমরা পরের লেখায় এটা নিয়ে আলোচনা করব, যে এই ধরনের কাজ কিন্তু সবসময় উচ্চ আয়ের সুযোগ করে দেয় না। আপাতত এটুকুই বলার, যে স্বনিয়োজিত কর্মজীবীদের আবার এই কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:

  • যাঁরা স্ব-নিয়োজিত ভাবে কৃষি বা অ-কৃষি ক্ষেত্রে যুক্ত আছেন, কিন্তু অন্য কাউকে চাকরিতে নিয়োজিত করছেন না – সে পাকাপাকি ভাবেই হোক, বা চুক্তির মাধ্যমে। এর ভিতর আসে হকারি বা রাস্তায় দেওয়া অধিকাংশ দোকান; আবার একটা বড় অংশের খাদ্য উৎপাদনকারী চাষিরাও এর ভিতর পড়েন। মিরিয়ম যদি এখন রাস্তায় চা-পকোড়া বিক্রি করতে শুরু করেন, তো তিনিও এরও আওতায় পড়বেন। মোদীজির মন্তব্যের (যে পকোড়া বিক্রি ও তার হিসাবকে সরকারি কাগজপত্রে কাজ হিসেবে দেখা হয় না) উল্টোদিকে গিয়ে বলতেই হবে, ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অরগ্যানাইজেশন (এনএসএসও) – যা কিনা ভারতের সরকারি তথ্য এজেন্সি – এটাকে রীতিমত কাজ বলেই গণ্য করছে।
  • পারিবারিক বাণিজ্যক্ষেত্রে বেতনহীন শ্রম দিচ্ছেন যাঁরা। মিরিয়মের ছেলে যদি তাঁর দোকানে ক্রেতাদের খাবার পরে থালা ধোবার কাজ করে এবং তাকে তার জন্য মিরিয়ম মাইনে না দেন, তাহলে সেটা এই ধরনের কাজ হবে।
  • ইনফর্মা‌ল সেক্টরের এমন সংস্থার মালিক, যিনি অপরকে চাকরি দেবার জায়গায় আছেন। যেমন, নানান মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ বা অণু-উদ্যোগের মালিকরা, যাঁদের আয় ইনফর্মাল সেক্টরে অন্য নানা অংশগ্রহণকারীদের চাইতে বেশি। মিরিয়মের ভাই যদি একটা ছোট রেস্টুরেন্ট খুলে তাতে আরও তিন-চার জন মানুষকে চাকরি দেন, তো তিনি এই বিভাগে পড়বেন।
  • ‘ক্যাজুয়াল ওয়র্ক‌ার’, যাঁরা কোনো একজন মালিকের হয়েই কাজ করেন না, বরং দিন বা মাস বা কোনো বিশেষ সময়কাল, অর্থাৎ ‘সীজন’-হিসেবে শ্রম বেচেন। মিরিয়মের মা, যিনি এখন  নির্মাণ-শ্রমিক হিসেবে বালি বওয়ার কাজ করেন, বা কাকা, যিনি এখন কুলির কাজ করেন – তাঁরা এই বিভাগে পড়বেন। দৈনিক হিসাবে নিয়োগ করা ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা দেশের গোটা শ্রমিক-সংখ্যার ৩০%, এবং এই অনুপাতটি ১৯৮৩ থেকে মোটামুটি একই রকম রয়ে গেছে।

ফর্মাল সেক্টরে নিয়মিত মজুরির চাকরি ছাড়া উপরের এই সব ধরনের চাকরিতেই নিরাপত্তার অভাব রয়েছে, অর্থাৎ যেকোনো সময় যেকোনো কারণে চাকরি চলে যেতে পারে (‘চাকরিগত অনিরাপত্তা’), রয়েছে দুর্ঘটনা ও অসুস্থতা খাতে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার অভাব (‘কর্মগত অনিরাপত্তা’), এবং মাতৃত্ব ও স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত অন্যান্য খাতে সুযোগসুবিধার অভাব (‘সামাজিক অনিরাপত্তা’)। তার উপর রয়েছে কম মজুরি, যা আরও নানা নিরাপত্তার অভাবের জন্ম দেয়।
‘বন্ডেড লেবার’ এবং ‘ফোর্স‌ড লেবার’, অর্থাৎ যেখানে শ্রমিক মুচলেখা দিয়ে রয়েছেন এবং বাধ্যতামূলক ভাবে প্রায়শই দুঃসহ পরিস্থিতিতে এমনকি বেগার খাটতেও বাধ্য হচ্ছেন – সেসবও এর ভিতর পড়তে পারে।
সারণী ২: কাজের ধরন অনুযায়ী শ্রমিকদের বিভাজনের শতাংশ 

কাজের ধরন অনুযায়ী বিভাজন
১৯৮৩ ১৯৯৩-৯৪ ১৯৯৯-২০০০ ২০১১-১২ ২০১৫-১৬
নিয়মিত মজুরি পান যাঁরা (%) ১৬.৪* ১৬.২* ১৪.৫ ১৫.৮ ১৭
ঠিকা মাইনের শ্রমিক (%) ৩১.৩ ৩৩.৯ ৩৪.৯ ৩০.৩ ৩২.৮
স্ব-নিয়োজিত শ্রমিক (%) ৫২.৩ ৪৯.৯ ৪৮.২ ৪৮.২ ৪৬.৬
চুক্তি শ্রমিক (%) ২.৪ ৫.৭ ৩.৭

*-এ চুক্তি শ্রমিকদের তথ্যও ধরা হয়েছে। তথ্যসূত্র: Ghose (2015) এবং Gol (2016); শ্রমিকদের কাজের ধরন বেছে নেওয়া হচ্ছে ইউজুয়াল প্রিন্সিপাল স্ট্যাটাস (ইউপিএস) অনুযায়ী। 
সরকারি সূত্র থেকে নেওয়া সারণী ২-এর তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৪৭% শ্রমিক (যেটা সমস্ত শ্রমিকের অনুপাতে বেশ বড় একটি সংখ্যা) আমাদের বর্তমানে পকোড়া বিক্রয়কারী বন্ধু মিরিয়মের মতো স্ব-নিয়োজিত। চাকরিগত, কর্মগত ও সামাজিক নিরাপত্তাহীন ঠিকা শ্রমিকরা ১৯৮৩ থেকে ২০১৫-১৬-র মধ্যে সংখ্যায় সামান্য বেড়েছেন। নিয়মিত মজুরি পাওয়া শ্রমিকরা, উচ্চহারে অর্থনৈতিক সংস্কারের পরেও, দেশের সমস্ত শ্রমিকের মোটে ১৭% স্থান নিয়ে রয়েছেন। তার মানে এটাও দাঁড়ায়, যে সমস্ত শ্রমিকের মোটে ১৭%-র চাকরিগত, কর্মগত ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার আছে। একজন অর্থনীতিবিদ – তিনি যে পন্থীই হন না কেন, মানতে বাধ্য হবেন, যে ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে এই বিরাট সংখ্যক ক্যাজুয়াল ও স্ব-নিয়োজিত শ্রমিক এবং স্বল্পসংখ্যক নিয়মিত মজুরির শ্রমিক-এর সংখ্যাতত্ত্ব খুব একটা আশাপ্রদ ছবি তৈরি করছে না।
এর পরের লেখাটিতে আমরা দেখব চাকরিরর এই ক্ষেত্রগুলি কীভাবে নিম্ন ও উচ্চ আয় এবং দারিদ্র্যের সাথে সম্পর্কিত। আপাতত মোদীজির প্রশ্নে ফিরে যাওয়া যাক, যে “যদি  কেউ আপনার অফিসের সামনে পকোড়ার দোকান খোলে, সেটা কি কাজ হিসেবে গণ্য করা উচিত?” তিনি বলতে চাইছেন, যে পকোড়া বিক্রির মতো কাজকে চাকরির সংস্থানের সরকারি গণনায় ধরা হয় না। আমরা উপরে আগেই দেখিয়েছি, যে এটা তিনি ভুল বলছেন।
ভারতে কর্মসংস্থান তৈরির হার নিম্ন হবার কারণ এটা নয়, যে পকোড়া বিক্রেতাদের এই কর্মসংস্থান তৈরির তথ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বরং, উচ্চ অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সত্ত্বেও, এবং কর্মসংস্থানের সংখ্যার হিসাবে পকোড়া বিক্রেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা সত্ত্বেও,  কর্মসংস্থান তৈরির হার নিম্নই থেকে গেছে। অন্যভাবে বললে, উচ্চহারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সাথে সাথে উচ্চহারে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ঘটেনি। পরবর্তী লেখায় আমরা এটাও আলোচনা করব যে দেশে যে মাত্রায় কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, শ্রমিকদের জীবনযাপনের মান সেই মাত্রায় উন্নত হয়নি।
মোদী সরকারের হাতে পড়ে মিনিস্ট্রি‌ অফ লেবার অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট ২০১৬ থেকে চাকরি ও বেকারত্ব সম্বন্ধীয় বাৎসরিক তথ্য সংগ্রহ ও তার প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক নীতি কিসের ভিত্তিতে স্থির করা হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। মোদী যদি কর্মসংস্থান সংক্রান্ত তথ্যের খানিকটা পর্যালোচনা করতেন, তাহলে হয়তো তিনি এইজাতীয় বোকা-বোকা প্রশ্ন করতেন না।

1 thought on “শিরীষা নাইডুর ভারতীয় অর্থনীতি সিরিজ: ২. পকোড়া বিক্রি নয় কেন? (প্রথম কিস্তি – জিডিপি ও চাকরি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.