দেবতোষ দাশ
দেবতোষ দাশঃ এই বা.লে.’র লেখালেখি মূলত লিটল ম্যাগাজিনেই। ইদানিং পপুলার ফিকশন লিখে পপুলার হওয়ার এক অলীক বাই উঠেছে। বারমুডা পরেন না। মদে অনেকটা জল মিশিয়ে খান। জাতির জনক হওয়ার বাসনা নেই, তাই কনডোম ব্যবহার করেন। আর ভীষণ সন্দেহপ্রবণ, এমনকি বাবু রায় মানিকবাবুর ছেলে কিনা এই নিয়েও তুমুল সন্দেহ।
বং সাহিত্য
কবি ও নকশাল। বিখ্যাত বাপ-মায়ের এক লওটা সন্তান। বং সাংস্কৃতিক মহলে পরিচয় বলতে এটুকুই। নবারুণ ভট্টাচার্য। এ অবশ্য সেই সময়ের কথা যখন র্যাম্বো একাই বেধড়ক ক্যালাচ্ছে, সোভিয়েত কোনোমতে টিকে, সিপিয়েমের অধঃপতন শুরু হলেও তাকে হার্মাদ বলতে সাহস করেনি কেউ। সবে শাদা-ধুতি বাঙালি লেখকেরা কালীপুজো-টুজোর উদবোধন করতে শুরু করেছেন, মার্জিনাল কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের সম্মান অটুট, সুখেন দাস-অঞ্জন চৌধুরীরা সাংস্কৃতিক কেষ্টবিষ্টু হওয়ার দুঃসাহস করেননি। এ সেই সময়ের কথা, ঢোঁড়াইয়ের পরম্পরায় বাংলা সাহিত্যে সাবধানে পা ফেলছে বাঘারু। উন্মাদের পাঠক্রমকেও আত্তিকরণ করতে চাইছে স্টেট। নবারুণ তখন ঘোষণা করছেন – এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না।
সোনারির ঠুকঠাক চলছিল, ৯২-তে লোহারের এক ঘা। লিখে ফেললেন প্রথম উপন্যাস হারবার্ট। বিষ্ফোরণে উড়ে গেল শ্মশানের চুল্লি, শ্যাওলা চৌবাচ্চা আর চেনা বর্ণপরিচয়। শুরুতেই আরডিএক্স। তারপর একে একে হাট করে খুলে দিলেন গোটা অস্ত্রাগার। বং কেরানি-কুলটুর ঘাবড়ে ঘ। পুরষ্কার-টুরস্কার দিয়ে সামলানোর চেষ্টা। নবারুণ মৃদু হেসে লেলিয়ে দিলেন পুরন্দর ভাট নামক এক স্বভাবকবিকে। পুরন্দর এসেই হাতের কাছে যা পেল টানাটানি করতে শুরু করল। পরে বোঝা গেল আসল টার্গেট তার বেরাহ্ম শাদা ধুতি-শাড়ি। এবং সত্যিসত্যি বং কালচার-ভালচারদের ধুতি-শাড়ি সে খুলে নিল। বেরাহ্ম কুলপতিরা কেন এখন অন্তর্বাস পরিহিত, এর রহস্য এখানেই। কাপড়-চোপড় তাদের পুরন্দরের কাছে। অবশ্য তাতে কী, ওই অবস্থাতেই নির্লজ্জ দাপাদাপি চলছে! কী নির্জীব, কী নির্জীব / নির্ঘাৎ ওটি বুদ্ধি জীব!
১৯৯২ থেকে ২০০৬ – অনতিদীর্ঘ এই সময়কালে মোট আট পিস উপন্যাস নামালেন নবারুণ আর সত্যি সত্যি বাংলা লেখালেখি নামক চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগর পাড়ি দিল। কলকাতার মধ্যে যে আরেকটা কলকাতা আছে নবারুণ সেই মহানগরের গল্প বলতে শুরু করলেন। শহরের নিচের মহল হাজির হল তার লেখায় ঘুগনিমাখা শালপাতা, পোড়া বিড়ি আর খিস্তির আরাম নিয়ে। নাশকতার এজেন্টদের ছড়িয়ে দিলেন কোণায় কোণায়। বিরাট নামিদামী পত্রিকায় না লিখেও নবারুণ, ঔপন্যাসিক নবারুণ, গল্পকার নবারুণ ‘পপুলার’ হলেন। সাবভার্সিভ লেখালেখিও যে পপুলার হতে পারে তিনি দেখালেন।
কাহিনিই লিখলেন কিন্তু তা নিটোল নয়, একটু টোল ফেলে দিলেন, তেরছা করে দিলেন ন্যারেটিভ, ডিসটর্ট করলেন বয়ান। এর আগেও এ চেষ্টা হয়নি তা নয়, কিন্তু তিনি ভাষা ও ন্যারেটিভে অতিবিপ্লবীয়ানা বা সবজান্তা ভাব বর্জন করলেন সতর্কতার সঙ্গে। সুবিমল মিশ্র বা মলয় রায়চৌধুরিরা অ্যাদ্দিনেও যা পারেননি, নবারুণ পারলেন।
সেই নবারুণ আজ কর্কটক্রান্তির ছায়ায়। হয়তো অচিরেই থেমে যাবে কলম। কিন্তু হায়, কলেজ স্ট্রিটের কলমকুমারদের থামানো যাবে না! বাঙালি লেখকের লেখালেখি, সন্দীপন যাদের বলতেন বা.লে(বাঙালি লেখক), সেই বা.লে’র লেখালেখি চলবে! ভাষাভাবনাহীন, ‘যা দেখি তাই লিখি’সুলভ বর্ণনাত্মক লেখালেখি চলবে। অসংখ্য বেবাক শব্দের হাত থেকে আমাদের মুক্তি নেই। শোনা যায়, কেউ কেউ নাকি আর চোখে দেখেন না, তাও রাইটার লাগিয়ে লিখছেন! কেউ কেউ জীবৎকালেই নাকি শতবর্ষ মানাবেন এমন হুমকি দিচ্ছেন! সে মানান, তাঁরা দু’শো বছর বাঁচুন, কিন্তু তাই বলে যদ্দিন বাঁচবেন তদ্দিন লিখবেন! বৃদ্ধ কলমকুমারদের কেবল দোষ দিয়ে লাভ নেই, কড়কছাপ নওজোয়ান কলমকুমারও যে কে সেই, হাতে কেবল কলমের বদলে কি-বোর্ড, কিন্তু ভাষাহারা উদ্বাস্তু। যে ভাষাহারা সে তো ঘটিহারা! তোতলা-কলম থেকে বাংলা লেখালেখির কি মুক্তি নেই? ভাটের নিদানঃ তাই ওষুধ একটাই / ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাঁই সাঁই!
বং সিনেমা
সুখেন-অঞ্জন-স্বপন সাহারা যে সাহস করেননি, আজ তাঁদের সফিস্টিকেটেড ভার্সানরা অবলীলায় তাই করছেন! তফাৎ কেবল এরা ইংরিজি মিডিয়াম। তাই সাত-সাত উনপঞ্চাশ খুন মাফ! চতুর্থ শ্রেণীর ছবি বানিয়ে ভাব মারছেন আমি সত্যজিৎ আমি গোদার! বং সিনেমার জগৎটা এখন এই নন্টে-ফন্টে হাঁদা-ভোদার। অতি মিডিয়োকার ঋতুপর্ণকে নিয়ে তাই মাতামাতি। বেচারা মরে বাঁচল। বালখিল্য রসিকতা ও ওয়ান লাইনার মেরে একটি ছবি হিট করাতেই অনীকবাবু নাকি বিরাট পরিচালক! পরের ছবি গোত্তা খেতেই পুনর্মুষিক ভব। পোয়েনজিৎ প্রেস্টিজ পেতে, ঋতুপর্ণকে ধরে শিক্ষিত বং ড্রইং রুমে গুঁতিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করলেন। এখনও করছেন। কিন্তু হা হতোস্মি! বাংলা ফিলিম এই সাত ফেরের বাইরে বেরোতে পারল না।
গত এক দশকে বাংলা ছবি যা বানিয়েছে তাকে বড়জোর টেলিফিল্ম বলা যেতে পারে, কদাচ ফিল্ম নয়। আর বাংলা ফিল্মকে টেলিফিল্মের স্তরে টেনে নামানোর মূল ভগীরথ ঋতুপর্ণ ঘোষ। আরবান-সেমিআরবান ড্রইং রুমের কিসসা নিয়ে নিটোল ন্যারেটিভ, শহুরে মধ্যবিত্তকে আবার হলমুখো করেছিল, এ কিঞ্চিৎ সত্য। কিন্তু ঋতু, সত্যজিৎ বা নিদেন পক্ষে তপন সিংহ নন, যে সেই নিটোল ন্যারেটিভেও লেগে থাকবে সময়ের ফিঙ্গারপ্রিন্টস্! ফলত সেইসব ‘বাচাল’ছবি টেলিফিল্মের ওপরে উঠতে পারে না।
গত পাঁচবছরে মৈনাক বিশ্বাসের ‘স্থানীয় সংবাদ’ বা সোমনাথ গুপ্ত’র ‘আমি আদু’, বহুদিন পর, ফিল্মের স্বাদ দিয়েছিল। কিন্তু মৈনাকদের সিনেমা বানাতে টাকা দেবে কে?
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এক হাতে বানাচ্ছেন মেঘে ঢাকা তারা, অন্য হাতে চাঁদের পাহাড়। চাঁদের পাহাড় দেখে অনেকেই ১৯৩৮-এ লেখা বইটি নিয়ে টানাটানি করছেন, যেন ২০১৪-য় এসে পরিচালকের যথেষ্ট দায় আছে অনুপুঙ্খ অনুসরণের! শৈশবের নস্টালজিয়া থেকে, নাকি আসলে শৈশব থেকেই আমাদের আর বের হওয়া হল না? কুসংস্কারের মতো অবসেশন আটকে মাথায়, ও বই না পড়লে শৈশব বৃথা! যদিও এখন যাদের শৈশব, তারা আর ওই বই পড়েও না। ছবিটি দেখে তারা যদি বইটি হাতে তুলে নেয় মন্দ কী!
আফ্রিকা না গিয়ে, দু’চারটে বিদেশী ভ্রমণ-ডায়েরি আর জার্নাল ঘেঁটে বিভূতিবাবু সেই সময় যা নামিয়েছিলেন, তা অসামান্য, কিন্তু আজ সিনেমার ভাষায় তাকে নামাতে গেলে লিবার্টি-লাজুক হলে চলবে কেন। মেক ইট লার্জ। এই নিয়ে বিতর্ক চলুক, কিন্তু কমলেশ্বর বড় করে ভাবছেন, তাই কুর্নিশ। বং ছবির চৌবাচ্চার তেলাপিয়াকে তিনি সাগরে পাঠাতে চান, উচ্চাকাঙ্ক্ষায় যেন সেই স্বাক্ষর।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুভিমেকার নামে আজিকাল এক গোল শোনা যায়। কিন্তু বাংলায় এখনও সে তাগদ চোখে পরেনি। কিউ নামক একজন যা দেখাচ্ছেন-টেকাচ্ছেন, বাঙালি ওসবে চমকায় না। এক-আধ নয়, বছর পঞ্চাশেক আগেই ও জিনিস বং সাহিত্য দর্শন করে ফেলেছে।
বং থিয়েটার
ওথেলো ডেসডিমোনাকে খুন করে মঞ্চে নগ্ন। দর্শকরা নিরাবরণ নিতম্ব দেখছেন। ঠিক আছে। ঘোষণা হল পরের শো-তে তিনি সামনে ঘুরবেন। হইহই রইরই। কেউ বাহবা দিল, কেউ বলল পাবলিসিটি স্টান্ট, বিজ্ঞাপন। কিন্তু, এই নগ্ন নিতম্ব থেকে সাহসী শিশ্ন – এই ১৮০ ডিগ্রি ঘোরাটাই, পুরুষ অভিনেতার, এখন আমাদের থিয়েটারের আধুনিকতা !
খাজা স্ক্রিপ্ট আর ততোধিক খাজা অভিনয় নিয়ে বং রঙ্গমঞ্চ চৌবাচ্চা থেকে বেরোবার কোনো লক্ষণ এখনও দেখায়নি। অভিনয় শিক্ষার একটা ভালো প্রতিষ্ঠান কেন বাংলায় নেই, এ নিয়ে হেল নেই দোল নেই। কেন ভালো বাংলা নাটক লেখা হচ্ছে না, ভাবার দরকার নেই! কেন থিয়েটারের যথার্থ মঞ্চ বাংলায় নেই, ভেবে কী হবে! আমার ছবি আমার বাতেলা কাগজে বেরোচ্ছে – আমি হনু। আমি আসলে বাঁশবনে শিয়াল রাজা, আমি চৌবাচ্চার তেলাপিয়া, তাতে কী!
ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামা এই কারণেই দিল্লিতে হয়, কলকাতায় হয় না!
এর মধ্যেই চমকে-দেওয়া ভালো খবর, স্বয়ং শাঁওলি মিত্র আগামী বছর মঞ্চে আনতে চলেছেন ‘চাঁদ বণিকের পালা’। যে নাটক আগে-পরের বাংলা অগুন্তি নাটকের মাঝে মস্ত মনুমেন্ট! এ যাবৎ যা কেউ সাহস করেননি মঞ্চে নামাতে, শাঁওলি তাঁর পিতার সেই সৃষ্টিকে মঞ্চায়িত করতে চলেছেন, এর থেকে আশার খবর আর কী হতে পারে! আগামী ২০১৫ হয়তো বং থিয়েটারের চৌবাচ্চা থেকে বেরোবার মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে।
দেবেশ চট্টোপাধায় আবার ‘দেবী সর্পমস্তা’ শুরু করলেন, ভালো খবর। সুমন মুখোপাধ্যায় আবার নতুন করে ‘মেফিস্টো’ নামালেন, সাধু সংবাদ। ব্রাত্য বসু কোম্পানী থিয়েটার বিষয়ে ইস্তেহার লিখে নতুন চিন্তার ইন্ধন দিচ্ছেন, উত্তম উদ্যোগ।
কিন্তু এরই মাঝে নিদারুণ দুঃসংবাদটি দিলেন কিংবদন্তী বিভাস চক্রবর্তী। এই মার্চেই এক সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করলেন, আর পরিচালনা করবেন না। থিয়েটারে তিনি আর আনন্দ পাচ্ছেন না। তিনি একজস্টেড। তিনি ক্লান্ত। তাই তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন। স্বেচ্ছায়।
দুঃসংবাদ হলেও, ‘চাক ভাঙা মধু’, ‘রাজরক্ত’, ‘শোয়াইক গেল যুদ্ধে’ বা ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’র বিভাস ব্যাট তুলে দর্শকের অভিবাদন নিতে নিতে ঘরে ফিরছেন। আমি আর থিয়েটারে আনন্দ পাচ্ছি না, আমি নিঃশেষিত – অর্ধশতাব্দী থিয়েটারের সঙ্গে ঘর-করা একজনের পক্ষে এটা বলা অত সহজ নয়, যেখানে তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠান! বুকের পাটা দরকার। সেলাম বিভাস!
হায়, বাঙালি লেখকদের যদি এই বোধোদয় হত!
(পুনশ্চঃ বর্তমান নিবন্ধে সবই গঙ্গাপারের বর্তমান রংচং। পদ্মাপারের ঢংচং নিবন্ধকারের অজানা। আলোকপাত প্রার্থনীয়।)
বাহা বাহা… বড় ভালো ঢং-এ লিকেচে। মন খুশ্ হইয়ে গেল।