দেবাশিস আইচ

দেবাশিস সাংবাদিক ও সমাজকর্মী। ছবি তুলেছেন পাঞ্চালি, শ্রাবন্তী, শ্যামলকুমার ও লেখক।

বৃষ্টি আসে, বৃষ্টি আসে বলে ব্রেক কষে ট্রাকের চালক। কেবিন থেকে তেরপল নিয়ে লাফ দিয়ে নামেন সুজিৎ সরকার, আমাদের পথ প্রদর্শক। জল ঝরাতে ঝরাতে ধেয়ে আসছে কালো মেঘ। ছোট ট্রাকটির পেট ভরা চিঁড়ে-গুড়-গুঁড়ো দুধ-বিস্কুট-ওআরএস-জলের পাউচ। আর একদল তরুণ তুর্কি। পাঞ্চালী, শ্রাবন্তী, জয়রাজ, অগ্নীশ্বর, সিদ্ধার্থ, সবুজ, প্রমোদরা। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা হবে দৌড়ে চলেছে ওরা।। এই তো কাঠপোড়া রোদ আর গরম হলকার হাত থেকে বাঁচতে মাথায় গামছা-দোপাট্টা যে যা পেয়েছে জড়িয়েছে।  ভাদ্রের পচা গরমে তাল-পাকা হয়ে যাওয়ার ভয়ে বোতল বোতল জল গলায় ঢেলেছে। মাথা-মুখ বাদ পড়েনি। খালি বোতলগুলো এখন গড়াগড়ি খাচ্ছে। বৃষ্টি এল।

দড়িদড়া দিয়ে আচ্ছাদন বেঁধেছেদে ছুটে আসা বৃষ্টির দিকে ধেয়ে গেল মাজদা। বৃষ্টির চক্রব্যুহে। জাতীয় সড়ক বেয়ে উদ্দাম ঔদ্ধত্যে। দু’ধারে বিস্তীর্ণ জলাভূমি থেকে ছুটে আসা পাগলা হাওয়া, অশ্বশক্তির গতি-তাণ্ডবের সঙ্গে মিলে ঝড় হয়ে আছড়ে পড়ে। কালো তেরপলটা উন্মত্তের মতো দাপাচ্ছে। কখনও ফুলে উঠছে, না কি ফুঁসে উঠছে! আবার কখনও আছড়ে পড়ছে। ঠিক যেমনটি আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদে অকালে সন্তান হারা মা কিংবা স্বামী হারা বউটি। এখন প্রাণপণ আচ্ছাদন আঁকড়ে পড়ে থাকা। সম্বল সামান্য হতে পারে, কিন্তু অনেক মানুষের পরিশ্রম, অর্থ, আকাঙখা, আবেগ জড়িয়ে আছে যে। তাকে তো বুক দিয়েই আগলে রাখতে হয়।  বাঁধ ভাঙা, পাড় উপচানো, খাল-বিল-পুকুর ভাসা, জমি ডোবা মানুষের অনেকেই আজও হাইওয়ে, পাকা রাস্তা, বাঁধের উপর তেরপলের তাঁবুতে ঠাঁই নিয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই। কোমর বাঁকিয়ে, মাথা নত করে কুঁকড়ে থাকা। ঘরও ডুবেছে যে। কী দুর্যোগ তাঁরা মাথায় নিয়ে কাল কাটাচ্ছে তারই কি একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নমুনা রেখে গেল প্রকৃতি?

বৃষ্টি ধরেছে। ভর দুপুরে এখন মেঘলা কালো আকাশ, কালো রাস্তা, সার সার কালো তাঁবু আর কালো কালো মুখের সারি। এখানেই বেহুলার সেতুর উপর স্থলযাত্রার আপাত বিরতি। যেদিকে তাকানো যাক না কেন, কেবলই দিগন্ত বিস্তৃত প্লাবনভূমি। পশ্চিমে দুর্গাপুর, পুবে ময়না, দেবীদহ। দল ভাগ হল। ভাগাভাগি হল খাবার-দাবার, জল। ২৫ ফুট নিচে নরেশ মণ্ডলের নৌকা বাঁধা। এ ঘাট নয়, আঘাটা। বেহুলার খাত থেকে অন্তত ২০০ মিটার।  পুলকের হাঁকডাকে জুটে গেল কয়েকজন। সেতুর রেলিং টপকে গ্র‍্যানিটের বোল্ডার বাঁধানো ঢালু গা-বেয়ে পেটি,বস্তা কাঁধে নেমে গেল তাঁরা। ভাগে পড়েছে দুর্গাপুর গ্রাম। অঞ্চল আলাল, ব্লক গাজোল। বৃষ্টির জলের ছোঁয়ায় মসৃণ আগ্নেয়শিলা। রবারের চটি হড়কে যাবে ভেবে হাত-বন্দি। খালি পা দুই পাথরের খাঁজে রেখে রেখে নামা যাবে, ভাবনা ছিল এমনই। ঠিক যতটা মসৃণ পাথরের গা, ঠিক ততটাই ধারালো তার ধারগুলো। পায়ে কেটে বসছে যেন। মাথায় বোঝা নিয়ে সরসরিয়ে নামতে নামতে টেকনিক জানিয়ে গেলেন একজন। মাল নামিয়ে উঠতে উঠতে আরেকজন বললেন, চটি পরেই তো সুবিধা হত। দু’পা ছড়িয়ে, হাঁটু-কোমর ভেঙে, সামনের দিকে ঝুঁকে টেকনিক মানতে মানতে নামা গেল। অক্ষত। প্রমোদ, অগ্নির মতো তরুণেরা অবশ্য সাবলীল।

নৌকা ছাড়ল। পিছনে বৈঠা হাতে দায়িত্ব নিলেন নরেশ, সামনের বৈঠায় ছেলে নীহার। কোষা নৌকায় হাল থাকে না।  ১৯৯৫-এর বন্যার সময় এই নৌকা গড়েছিলেন নরেশের বাবা ভুবন মণ্ডল। সেবারও মালদা, দিনাজপুরে বন্যা হয়েছিল প্রবল। ২৮ সেপ্টেম্বর একদিনে মালদায় নজিরবিহীন ভাবে বৃষ্টি হয়েছিল ৫৬৭ মিমি। এ গাঁয়ে এই একটাই এমন নৌকা। প্রথম গন্তব্য উপরপাড়া বা টান পাড়ার কালী মন্দির। উত্তরে সেতুর গা থেকে নেমে গেছে যে লাল মোরামের রাস্তা সেদিকটি অপেক্ষাকৃত উঁচু, উপরের দিক। ক্রমে গাঁয়ের ভিতরে নেমে গিয়েছে রাস্তা। গেছে দুপ পাড়া বা নিচু পাড়া, বালা পাড়ায়। রাস্তা যেটুকু আছে, তা ওই উঁচুপাড়াতেই। সেখানে রাস্তা যে দেখা যাচ্ছে, কারণ জল নেমেছে খানিকটা। ঘরের ভিতরেই তো ছিল কোমর জল। জল মূলত স্থির। হঠাৎই স্রোতের টান দেখা দিল। বেহুলার খাত। এ অঞ্চলে পূব থেকে পশ্চিমে বইছে। মহানন্দায় মিশেছে ব্লকের পাহাড়িভিটায়। সেতুর নিচে লম্বা-টানা জাল পাতা। সাধারণ ভাবে সম্বৎসর জল থাকলেও কৃশকায় বেহুলা নদী। গাঁ-গেরামের অধিকাংশ বউ-ঝিদের মতো অপুষ্টিতে ভোগা। বর্ষায় যা একটু গত্তি লাগে। এই সতেরোর বন্যায় তার করাল রূপ। ২২ বছর পর। বেহুলার খাত পেরিয়ে মোরামের রাস্তার ধারে নৌকা ঠেকবে। এই রে দড়ি লাগে যে। লাগবে গুড়ের চাঙর কাটার জন্য দা-খুন্তি কিছু একটা। খুঁটি সমেত গরু বাঁধার দড়ি এল, এল হাত দা। সজনে গাছের গোড়ায় বাঁধা পড়ল নৌকা। কেউ এল খালি হাতে। গামছা কিংবা শাড়ির আঁচল মেলে ধরল। কেউ এল গামলা বা ডেকচি নিয়ে। মুখে কথা নেই, হইচই নেই। চোখের চাহনিতে অবাক হওয়া নেই। নির্লিপ্ত গ্রহণ। পাড়ার ছেলে নীহার নৌকা বেয়ে এনেছে। ওর বাপও। জিজ্ঞাসা নাই বাকিরা কে গো। কুন জায়গার থ্যা আইছে। প্রশ্ন নাই কোনও। দড়ি খুলে লগির ঠেলায় পাড় ছাড়ল নৌকা। মোরামের রাস্তা বরাবর চলল।

নৌকা চলে, ডাক-খোঁজের আওতায় আসতেই নীহার হাঁক পাড়ে, ‘সবাই রেডি হয়ে যা। গামলা নিয়্যা আয়। খাবার নিয়া আইছি। খাইবের দিবেন লিগ্যা কলকাতা থ্যা মানুষ আইছে।’ নীহার হাঁকে। ভাঙা রাস্তার গায়ে নৌকা ঠেকে। কেউ একটা দড়ি টেনে খুঁটি পুঁতে দেয় নরম মাটিতে। কচি-কাঁচা, ল্যাদা শিশু কোলে বউ, থুরথুরে বুড়ি, কোমর ভাঙা বুড়ো ভিড় করে। জোয়ান-মদ্দরাও আসে। দুধের বাচ্চার জন্য আরেকটা গুঁড়ো দুধের প্যাকেট চায় কেউ। আরেকটু গুড়ের জন্য আবদার আসে। বাচ্চাদের আরও এক প্যাকেট বিস্কুট হলে ভাল হয়। আদুল গায়ে রং-চটা এক শাড়ি পরা বিধবা বুড়ি আঁচল পেতে ধরে। ‘তোমারে না দিলাম একবার। আবার এসেছ?’ বুড়ি ফোকলা মুখে বড় সুন্দর হাসে। না:, দাবি নেই কোনও। ভিড় টপকে কথার শব্দ ছড়িয়ে পড়তে পারে না। পরে না।

মাছ ধরে ফেরার পথে ভিন গাঁয়ের সুকুমার গড়াই ও প্রফুল্ল মণ্ডল তাঁদের ডিঙি ভেড়ান ত্রাণের নৌকার গা ঘেঁষে। ‘কী মাছ পাইলাও’, নরেশ প্রশ্ন ছোঁড়েন। প্রফুল্ল উত্তর দেন, ‘কাতল পাইছি দুই-তিনটা, রুই, ব্রিকেট, সিলভার। ১০-১৫ কিলো।’ সুকুমার হাসেন। আপন মনে বলেন, ‘হ:, ১০-১৫ কিলো! গপ্প মারে।’ নরেশ হালের খোঁচা মারেন কাঠের পাটাতনে। খোলের মধ্যে রাখা মাছ দেখতে চান। প্রফুল্ল খোলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা পাঁচ-ছ’শো গ্রামের রুই তুলে আনেন। বিল-পুকুর-দহ ভাসা মাছ। কপাল পুড়েছে মাছচাষিদের। পুবদিকে দেবীদহ, একক্রোশ দক্ষিণে আহোরার মতো বিশালকায় বিল ভেসে গিয়েছে। এখন জল নামতে থাকলে অগভীরে রোদের তাপ বিলের বড় মাছেদের সয় না। দল বেঁধে গভীর জলের দিকে ছোটে। সুযোগ বুঝে খ্যাপলা মারতে পারলেই হল। খ্যাপলা কেন, স্রোতের মুখে টানা জাল পেতে রেখেছে কেউ, কেউ আবার ভেচালেই কাটাচ্ছে সকাল-দুপুর। এই তো কিছুক্ষন আগে, ভেচালের পাশ দিয়ে নৌকা বাইতে বাইতে নরেশ হাঁক পারলেন, ‘তোর সুতাগুলা মোটা হয়ে গ্যাছে, বড় করা পারলি না? পাতল হলে বেশি হত।’ জালে তখন পোনা মাছের দাপাদাপি।

নৌকা ঘাট ছেড়েছে গায়ে ঠেকানো ডিঙি নিয়ে। সুকুমাররা মুখ ফুটে কিছু চান না। একটি বালক বাপ-কাকার মাঝে বসে বসে নৌকা ভরা চিঁড়ে-গুড়-বিস্কুট দেখে। বায়না ধরে না। হাত পেতে তো খেতে হয়নি। খেটে খেয়েছে। ফসল ফলিয়ে খেয়েছে। এই আকালেও তো রুই-কাতল খাবে। হোক না বিল-পুকুর ভাসা। নীহারের কাকা মরণ বললেন, ‘নাও গো একটু চিঁড়া-গুড় নিয়া যাও।’ সলজ্জ সুকুমার গামছা পেতে ধরেন। অনুরোধেও কুণ্ঠাভরে গামছা পাতেন প্রফুল্ল। বালকটি বিস্কুটের প্যাকেটটা আঁকড়ে ধরে। খুশির একরতি  রেখাও সাদা চোখে ধরা পড়ে না। আতস কাঁচের নিচে ফেললেও বুঝি মিলবে না।

ক্রমে মোরামের রাস্তা মুছে যায়। জল গভীর হতে থাকে। গ্রামীণ বিদ্যুতের তার বিপজ্জনক ভাবে মাথার উপর ঝোলে। লাইন কেটে দিয়েছে। তবু সাবধানের মার নেই। নৌকা পার হয়। যাত্রীরা হামাগুড়ি দিয়ে নিজেদের বাঁচায়। কোথাও কোথাও তারে ঝুলে থাকে লতা-পাতা-পানা। জল তার ছুঁয়েছিল মনে করিয়ে দেয়। বাড়ির টিনের দেওয়ালে, এক কোমর উঁচুতে নেমে যাওয়া জলের সাদা দাগ। নৌকা ভাসে।  নৌকা এবার গৃহস্থের উঠোনে, ঘরের দাওয়ায়। দু’সারি বাড়ির মাঝে যে পায়ে চলার রাস্তা সে পথে নৌকা ভাসে। গাছের গোড়ায় পাকা তাল ভাসে। আরও কিছু গাছে ঝোলে। শহুরে রোম্যান্স ভেঙে দিয়ে কে একটা সতর্ক করে, মাথায় পড়লে রক্ষা নাই। কখনও বৈঠা মেরে, কখনও লগি ঠেলে মরা ঝোপঝাড়, বাগানের ভেঙে পড়া বেড়া, নুয়ে পড়া গাছের ডাল, পানা সরাতে সরাতে নীহার হাঁক পাড়ে। এ গাঁয়ের একটি ঘরও সে ছাড়বে না। পণ করেছে। আধ ধসা মাটির দেওয়াল কিংবা টিনের দেওয়াল ভেদ করে কোনও প্রত্যুত্তর আসে না। একটা পাখিও ডাকে না। শোনা যায় না সন্ত্রস্ত পাখনার ঝাপটানি। বহিরাগতদের গন্ধে চিৎকার দিয়ে ওঠে না পোষা কুত্তা। হঠাৎই, জেগে ওঠা পিছল কাদামাটিতে পা গেঁথে গেঁথে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসেন কোনও বউ। বাড়িয়ে দেওয়া ধাতু পাত্রে শুকনো চিঁড়ে ঢালার শব্দ কর্কশ সুরে বেজে ওঠে। পাত্র ভরা হলে আবারও নৈ:শব্দ গ্রাস করে। হাইওয়ে থেকে এখনও ঘরে ফেরেননি অনেকেই। বাড়িগুলি দ্বীপের মতো জেগে থাকে। গোয়াল ঘর শূন্য। উঠোনের কলমের আমগাছটা মাথায় জল উঠে মরেছে। কাঁঠাল গাছটা পাতা নেতিয়ে নুইয়ে পড়েছে। দমবন্ধ হয়ে মরেছে সেটাও। বাঁধানো মঞ্চ জেগে উঠেছে বটে, তবে তুলসীর কঙ্কাল মাথায় নিয়ে। এরই মধ্যে  কোমর জল পেরিয়ে কেউ আসে, জল ঠেলার শব্দ হয়। ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা কোনও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন বুঝি। খালি গা, পরনে গামছা, হাতে কানা উঁচু থালা। ‘একটু বেশি করে জল দিয়েন। জলের বড় কষ্ট।’ আর কোনও চাহিদা নেই। খান ছয়েক পাউচ দেওয়া গেল। বললেন, ‘দু’দিন চলে যাবে।’ মালদা শহর থেকে বামনগোলা মোড় আসতেই একলিটার জল গলা দিয়ে নেমেছে। আধ লিটার মাথায়। মনে পড়ে যায়।

আরও নিচুপাড়ার দিকে ভাসে নৌকা। যতদূর চোখ যায় ততদূর বানভাসি, ততদূর ফসলের জমি। পাট উঠে গিয়েছিল। বসানো হয়ে গিয়েছিল ধানের চারা। সবজির খেত। জাঁক দেওয়া পাট কত যে ভেসে গেছে বেহুলার খাত থেকে, ডোবা থেকে তার হিসাব নেই। কিছু ইতিউতি ভেসে বেড়ায়। তাই টেনে নিয়ে উঠোনে ওঠায় কেউ কেউ। জলে ধুয়ে ধুয়ে আঁশ ছাড়ায়। পাটকাঠি বেঁধে রাখে। কার জাঁক কে জানে! স্রোতের টান বাড়ে। ইউক্যালিপটাসের সারির মাঝ দিয়ে জল কেটে চলে বাপ-ছেলে। কয়েক বিঘা জমিতে ব্যক্তিগত বাগিচা। অচেনা গাছের একটা বাগান দেখিয়ে নীহার শোনায়  পাহাড়ি সেগুন বলে কী এক গাছ গছিয়ে দেওয়ার ঠগবাজির গপ্প। আশি টাকা দিয়ে চারা কিনেছিল গ্রামের অনেকেই। ছ’মাসেই তরতর করে বড় হয়ে যাবে। তিন বছর কেটেছে, ফাঁপা প্রতিশ্রুতির মতোই ফাঁপা গাছের কাণ্ড। কোনও কাজে লাগে না। গাছ বিক্রির কোম্পানি কলকাতারই। বাইতে বাইতে হাজারো শহুরে কৌতূহল মেটাতে মেটাতে, বৈঠার টান শিথিল হয়। এত কথায় বিরক্ত বাপ তাড়া দেয়। ‘টান টান টান দে। বৃষ্টি আসে।’ পুবের আকাশে জমাট বাঁধছে মেঘ। মেঘলা ভাবটি গাঢ়তর হয়। রঙ বদলায় জল। দূরে বানের জলে দাপিয়ে সাঁতার কাটে কে? সঙ্গে এক কিশোরও রয়েছে। তাদের কাছাকাছি এক ডুবে থাকা গাছের গুঁড়িতে নৌকা বাঁধা। নৌকায় দুটি শিশু আর এক বৃদ্ধা বসে রয়েছেন। যাত্রী বোঝাই নৌকা দেখে বুঝি দ্রুত সাঁতরে নিজের নৌকায় উঠতে যায়। তাড়াহুড়োয় টাল খায় নৌকা। সামলে নেয়। সামলায় আঁচল। তার পর দ্রুত হাতে নৌকা বেয়ে মিলিয়ে যায় আর এক দ্বীপ বাড়ির আড়াল দিয়ে, অন্য এক দ্বীপ বাড়িতে। এদিকে হাওয়ার বেগ বাড়ে। নরেশ আপন মনে বলে ওঠেন, ‘মেঘ উড়ে যাবে, বৃষ্টি হবে না।’ যাত্রীরা আশ্বস্ত হয়। হাওয়ায় হাওয়ায় মেঘেরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে উড়ে যায়। জলে হালকা ঢেউ খেলে। গ্রামের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া গেল। এই নিয়ে বার আঠারো ভিড়েছে নৌকা। কিলোমিটার চারেক তো পাড়ি দিয়েইছে।

এটা বালা পাড়া, আবার হাঁকডাক। নৌকা যেখানে লগি পুঁতে ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে হাত বিশেক দূরে একটা ছোট্ট ডিঙিতে কলসি খান পাঁচেক। প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, এ বাড়ির টিউবওয়েলটি সচল। তাই পাঁচ বাড়ি থেকে জল নিতে আসে সন্তোষ সরকারের উঁচু ভিটের বাড়িতে। বলতে বলতে ছোটখাটো এক যুবতী কোমর জলে নেমে এলেন। পিছন ফিরে দু’হাতের চাপে শরীরের অর্ধেক তুলে দিলেন ডিঙিতে। ডিঙিটা একটু টাল খেল বটে, কলসিগুলো স্থির রইল। জলে পা ধুয়ে গুছিয়ে বসে অভ্যস্ত হাতে টান দিলেন বৈঠায়। বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে যেভাবে অনায়াসে বেরিয়ে এলেন, দেখে মনে হয়, এই বুঝি তাঁর পেশা। যেন বৈঠা নয়, হাতে পাওয়ার স্টিয়ারিং। মন হাততালি দিল কষে। হাত জোড়া চাইলেও দিল না। শোভনীয় নয়। মুগ্ধতার জবাবে, নরেশ গর্ব করে জানালেন, ডোবা এলাকায় মেয়েমানুষরাও নৌকা বাইতে জানে। আরও জানা গেল মাঝির নাম কাজলি।

এই দুর্গাপুর আসলে একটা নিচু অঞ্চল। ডোবা এলাকা স্থানীয় ভাষায়। অর্থাৎ, খুবই নিচু। মণ্ডল, সরকার, রায়, বারুই, বৈরাগী, বালাদের বাস। চাষবাসই মূল পেশা। বাড়িগুলো আগে সবই ছিল মাটির। এখন অধিকাংশই টিনের। ইটের বাড়ি আছে বটে, তবে হয় সে সম্পন্ন চাষি, না হয় সে বাড়িতে সরকারি-বেসরকারি চাকুরে রয়েছে। বাঁধের মত  রাস্তা থেকে অন্তত পাঁচ ফুট উঁচুতে প্রত্যেক বাড়ির ভিত। জমি ধরলে সাত থেকে দশ ফুট। পনেরো দিন পরেও প্রায় সাত-আট ফুট আর নদী খাতের কাছে ১৫-২০ ফুট জলের নিচে পুরো আলাল অঞ্চল। অঞ্চলে ১৩টি বুথ, প্রায় ১৫ হাজারের বেশি মানুষের বাস। আর এই দুর্গাপুর ডোবা এলাকার বাসিন্দা হাজার চারেক। তাদের চাষের জমি রয়েছে প্রায় ১০০ হেক্টর। আষাঢ়ে আমন বুনেছিল সবাই। ভাদ্রে সব শেষ। এখন তো হাত দুয়েকের ধানগাছের দিগন্ত জুড়ে সবুজের বন্যা বইয়ে দেওয়ার কথা। কোথায় কী! কার্তিকে ধান কাটা-বেচা, আর সে পয়সায় সরষে, মুসুরি, গমের রবি চাষ। যাঁর পাট ভেসেছে জলে, ধান ডুবেছে, তাঁর হাতে এক কপর্দকও থাকবে না রবি চাষের জন্য। আক্ষেপ নরেশের। জানিয়ে দিলেন, ১০ শতাংশের ঘরে আর খাওয়ার মতো চাল মজুত নেই। গরু-বাছুর বেচেও লাভ নেই। দাম তলানিতে ঠেকেছে। এই তো চা খেতে খেতে কানে এল, নীহারের দিদি ভাইকে বলছে, ‘জানিস, বাছুরের দাম দিচ্ছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।’ বোঝা গেল, গো-ফরমান আর গো-রক্ষকদের তাণ্ডবের ফল ফলতে শুরু করেছে। এ যেন গোদের উপর বিষ ফোঁড়া।

জল কবে পুরোপুরি নামবে তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। উত্তরবঙ্গ, নেপাল, বিহারের জল পুবে দিনাজপুর হয়ে  নেমেছে। ভাসিয়ে দিয়েছে গাজোল। আবার টইটুম্বুর মহানন্দার জলও উলটো স্রোতে বেহুলায় ঢুকে পড়েছে। তার সঙ্গে স্থানীয় অতিবৃষ্টি তো রয়েইছে। সারা দিনের শেষে মণ্ডল বাড়িতে গরম গরম হাত রুটি, পাঁচমিশালি সবজির তরকারি গোগ্রাসে গিলি। বানের জলে ধরা ভাজা মাছও আসে। সন্ধ্যা নামে। ফিরতে হবে মালদার হোটেলে। নৌকায় উঠি। নীহার ওর মামা পুলকের সঙ্গে আলাপ জোড়ে। নৌকা ভাসিয়ে পিকনিকের পরিকল্পনা ভাঁজে। মাছ না মাংস এ নিয়ে হালকা বিতর্ক বাঁধে। বাপ-ছেলে মাংসের পক্ষে ভোট দেয়। ভাবি, কী অদম্য এই নিম্নবর্গ জীবন।

মোট বানভাসি জেলা – ১১টি।
মোট বন্যার্ত – দেড় কোটি।
মোট মৃত – ১৫২ জন।
জলমগ্ন কৃষিজমি – ১০ লক্ষ একর।
কৃষির ক্ষতি – ৭০০০ কোটি টাকা।
সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি – তিন লক্ষাধিক।
আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি – লক্ষাধিক।
মোট ক্ষতি – ১৪ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র : রাজ্য সরকার। ৩১.০৮.১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.