দেবাশিস আইচ

সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী নাগরিক উদ্যোগ থেকে প্রকাশিত ‘পশ্চিমবঙ্গ – সাম্প্রতিক দাঙ্গাচিত্র ও নেপথ্য রাজনীতি’ বইটিতে প্রকাশিত প্রায় কুড়িটি লেখার মধ্যে দেবাশিস আইচের এই লেখাটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। আয়নানগর এই উদ্যোগের সহযোগী হিসেবে ইতিমধ্যেই এই সঙ্কলনের সম্পাদক ও লেখক বিশ্বজিৎ রায়ের বসিরহাট রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ধারাবাহিক ভাবে, ইংরিজিতে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে বাংলা ও বাকি ভারতে ক্ষমতা দখলের যে রাজনীতি বর্তমান সরকার চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াইয়েরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ এইজাতীয় লেখা ও প্রকাশনা। আশা রাখি এই লেখাগুলি অন্তত কিছু পাঠকের ভাবনার ফসল হবে।
সাংবাদিক দেবাশিস আইচ বেশ কিছু সময় ধরে দেশের বর্তমান সাম্প্রদায়িকতামূলক ঘটনা নিয়ে লিখে চলেছেন। তাঁর গো-হত্যা ও আইন নিয়ে লেখা ইতিপূর্বে আয়নানগরে প্রকাশিত হয়েছে।
সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী নাগরিক উদ্যোগ-এর সাথে যোগাযোগ করুন ফেসবুকে বা ৯৮৩০৪১১৫২৫ বা ৯৪৩৩০১২৭২৮ নম্বরে।

আসন দিব হৃদমাঝারে হে…

টানা বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিলই। ভোররাতেই ঝেঁপে নামল। সেদিন ছিল ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭। দুপুরের আগেই মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার কালুখালি গ্রামে   পৌঁছানোর কথা। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রওনা দেওয়া গেল। ভেবেছিলাম যত উত্তরে এগোব, বৃষ্টি তত দূরে যাবে। হা হতোস্মি, কালুখালি গ্রামে যাওয়ার জন্য সুবর্ণমৃগী স্টেশনে নামলাম ছাতা খুলেই। মনে পড়ল, পূর্বাভাস ছিল বৃষ্টি হবে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। তবে আর কালুখালি বঞ্চিত থাকবে কেন? আমরা তো বদ্বীপ পেরিয়েও যাইনি। মনে খচখচানি বাড়ে, এই বৃষ্টি যদি চলতে থাকে তবে ‘বাউল-ফকির সঙ্ঘের সম্মেলন’ ভেসে যাবে না তো? আর আমাদের যা জানতে চাওয়া, বুঝতে চাওয়া তাও কি এই আবহাওয়া ভেস্তে দেবে?

সম্মেলনের অন্যতম ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল, সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা, বাউল-ফকিরদের সমস্যা নিয়ে অতিথি ও সাধকদের আলাপচারিতা। আমাদেরও উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতার বসত কতদূর বিস্তৃত হয়েছে, তা যতটুকু পারা যায় জেনে বুঝে নেওয়া। আমরা জেনেই গিয়েছিলাম মুর্শিদাবাদের পিরপন্থী সাধকরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের দরবার বা খানকা শরিফ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এক-আধটা নয় অন্তত খান তিনেক। শরিয়তপন্থীদের হাতে ফকিরদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু, সুফি পিরদের উপর আক্রমণ নতুন। তবে কি বর্তমান পরিস্থিতিতে ফকিরদের উপর নির্যাতন নতুন মাত্রা নিল? অতীতের সঙ্গে তার ফারাক ঠিক কতদূর, কোন মাত্রায়? এ বুঝে নেওয়া এক জরুরি কর্তব্য। এই সময়ে  তাড়নাজাত বটে। সত্যি কথা বলতে কী, একে প্রতিকূল আবহাওয়া, সেই আবহাওয়ায় কর্তাব্যক্তিদের সম্মেলন জারি রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা, সীমিত সময় —- আক্রমণের কিছু ঘটনার হদিশ দিল মাত্র। তার চেয়েও সত্যি কথা, বিন্দুতে সিন্ধু-প্রমাণ জ্ঞান লাভের বিদ্যা এ কলমচির অধিগম্য নয়। নুড়িও কুড়োনো হল না। জানাই হল না, “আমার এই ঘরখানায় কে বিরাজ করে / জনম ভরিয়া একদিনও না একদিনও না দেখলাম তারে।” ‘ফকিরনামা’র লেখক জানাচ্ছেন, তিনি এই গান শুনেছিলেন মুর্শিদাবাদের এক দিনমজুর আবেদ ফকিরের মুখে। শরিয়তিরা তাঁর ঘর ভেঙেছে, মারধোর করে তাড়িয়েছে গ্রাম থেকেও। আবেদ তবু লালনের গান গেয়ে বেড়ান। তাঁর দুনিয়া মারফতি দুনিয়া। লালন আর তাঁর আমলের বাউল-ফকিররা কি শাস্ত্রাচারী হিন্দু আর শরিয়তপন্থী মুসলমানদের কম অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধার শিকার হয়েছেন? একতারার বিরুদ্ধে লাঠি ধরতে যেমন পিছপা হয়নি বাংলার আলেমসমাজ তেমনই ওহাবি, ফারায়াজি, আহলে হাদিসের মতো ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে অত্যাচার, নিগ্রহ বেড়ে উঠেছিল। কাজী আবদুল ওদুদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “এই মারফত-পন্থীদের বিরুদ্ধে আমাদের আলেম-সম্প্রদায় তাঁদের শক্তি প্রয়োগ করেছেন, আপনারা জানেন। এই শক্তি প্রয়োগ দূষণীয় নয় — সংঘর্ষ চিরদিনই জগতে আছে এবং চিরদিনই জগতে থাকবে। তাছাড়া এক যুগ যে সাধনাকে মূর্ত করে তুলল, অন্য যুগের ক্ষুধা তাতে নাও মিটতে পারে। কিন্তু আলেমদের এই শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলার সব চাইতে বড় প্রয়োজন এইখানে যে সাধনার দ্বারা সাধনাকে জয় করবার চেষ্টা তাঁরা করেননি, তার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে লাঠির জোরে তাঁরা দাবিয়ে দিতে চেয়েছেন। এ-দেশী মারফত-পন্থীদের সাধনার পরিবর্তে যদি একটা বৃহত্তর পূর্ণতার সাধনার সঙ্গে বাংলার যোগসাধনের চেষ্টা আমাদের আলেমদের ভিতরে সত্য হতো, তাহলে তাঁদের কাছ থেকে শুধু বাউলধ্বংস আর নাসারাদলন ফতোয়াই পেতাম না।”

‘বাউল-ফকির সঙ্ঘ’র এই পঁয়ত্রিশতম সম্মেলনের প্রচারলিপি জানাচ্ছে, “এ মাটিতে মাদারি ফকিরেরা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মিলে সাহেবদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। নক্সাবন্দী আর কালেন্দরেরা এখানে অবিরল ঘুরে ঘুরে গান গাইতেন, “দম দমাদম মস্তকালন্দর”। এ জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত সাধক আর তাদের হাজারো মাজার-সমাধি। তারা ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। মানবজমিন আবাদ করে তারা ফলাতেন সোনা। তারা বানিয়েছিলেন এক সমন্বয়ী সংস্কৃতি। তাই সুফি বৈষ্ণবে করে কোলাকুলি ভগবানগোলায় এসে।

“বানের জলে ভেসে গিয়েছিল সুবর্ণমৃগী আর কালুখালি। সে সব সামলিয়ে আমরা বেঁচে আছি। হেথা আমরা আছি ভালই। অপমানুষেরা হিংসা ছড়ায়, খুন করে দাঙ্গা বাঁধায়। আমরা সেগুলিকে ঝেটিয়ে পরিষ্কার করি। এ দেশ, এ মাটি আমাদের। ডাকি কাতরে, সর্বজনে, হিন্দু মুসল্লি খ্রিষ্টানে, আসুন বাউল ফকিরের সম্মেলনে। আসন দিব হৃদমাঝারে হে।” (বানান, ভাষা অপরিবর্তিত)।

১৪ বছর আগের এমনই এক প্রচারলিপিতে ছিল মিলনের আরও এক স্পষ্ট কথন-চিত্র। সেবার ছিল একুশতম বার্ষিক সম্মেলন, নদিয়ার করিমপুরে। “নাটনার মোড় থেকে শিকারপুরের পথের দুধারে বিশাল সব মেহগিনী গাছ দাঁড়িয়ে। মোড়ের অদূরে মাথায় জট নিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন এক বটগাছ। এ বটতলার পুবে এক ফকিরের সমাধি। মাঝখানে ভদ্রকালীর মন্দির। মন্দির সংলগ্ন ভূমিতে হয় নাম সংকীর্তন। আর পশ্চিমে ইদগাহ। রোজার পর ইসলামি জনগণ এখানে মিলিত হন নামাজে। শাক্ত-বৈষ্ণবে, মারফতে-শরিয়তে, হিন্দুতে-ইসলামে এখানে একাকার। মন্দির-মসজিদ নিয়ে যারা লড়াই করে, জাতের নামে বজ্জাতির দাঙ্গায় মানুষের রক্তে যারা কলঙ্কিত করে ভারতের পুণ্যভূমিকে, তাদের আমরা দেখাতে চাই আরেক ভারতবর্ষ, বড় বটতলার মতো অযুত ভূমিখণ্ড। আমরা মানুষ মাত্রকেই একজাতি বলে মান্য করি হে। নরবপুরের মধ্যে চিহ্নিত করি আল্লা-নবীর নুর, কৃষ্ণের স্বরূপ, পরম কুণ্ডলিনীকে। এক এবং অদ্বিতীয় স্রষ্টার বিশ্বের বহু রূপের কোনওটিকেই আমরা অগ্রাহ্য করি না। সারা জাহানের সর্বত্র যিনি থাকেন, দেয়াল বন্দী ঘরে তাকে বন্দী করার আমরা বিরুদ্ধে। কোরান পুরাণ দিয়ে মানুষকে ভাগ করার সমর্থক নই আমরা। আমরা বাউল ফকিরেরা শাস্ত্র গ্রন্থ, জাত পাত বর্ণ  লিঙ্গ শ্রেণী ভেদ করি না মানুষের। বলি, ‘মানুষ সত্য’। পরলোকে নয় ইহলোকেই, আমরা মানুষের জন্য সুখ শান্তির স্বর্গ নির্মাণ করতে শুরু করেছি। রণ-রক্তপাতের দেশ নয় আমাদের বাসভূমি, মিলনের ভারতভূমির আমরা নাগরিক।” (বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত)।

১৯৮৩ সাল থেকেই ৩৫ বছর যাবৎ বাউল-ফকির জাহান এই সম্প্রীতির বার্তা বয়ে বেড়াচ্ছে। ১৯৮৩ ছিল মোড় ঘোরার সাল।   ফকিরদের উপর শরিয়তপন্থীদের লাগাতার আক্রমণের মুখে সে বছরই গড়ে উঠল সংঘ। বাউল-ফকিরদের প্রাণের মানুষ শক্তিনাথ ঝা-এর নেতৃত্বে। সংঘবদ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না যে। শারীরিক অত্যাচার, একঘরে করা থেকে ঘরছাড়া করা, আর্থিক জরিমানা থেকে মসজিদে নিয়ে গিয়ে ফকিরি মত ত্যাগের ‘তওবা’ করানো; অত্যাচারের যেমন শেষ নেই, তেমনি পাশে দাঁড়ানোরও কেউ ছিল না। ভোট হারানোর ভয়ে বাম কিংবা ডান মুখ ফিরিয়ে থাকত। পুলিশ-প্রশাসন নম নম করে দায় এড়াত। আজও তো সেই এক কাহিনি। এই যে ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর রেজিনগর বিধানসভা এলাকায় আন্দুলবেড়িয়া দুই গ্রাম পঞ্চায়েতে ভাঙা হল তিনটি খানকা শরিফ। পাশে তো দাঁড়ায়নি কোনও দল। উলটে আবার দারোগা নাকি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে পিরপন্থীরা তো জনসংখ্যার পাঁচ ভাগ, তাদের জন্য তো আর পুলিশ-প্রশাসন ৯৫ ভাগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না।

সংঘের সম্পাদক আকবর আলির সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে কিংবা সভাপতি শক্তিনাথ ঝা-এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এটুকু জানা গেল, আক্রমণকারীদের নাম-ধামে চিহ্নিত করা যায় বটে কিন্তু সংগঠন দিয়ে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। কেন না এখানে কেউ মৌলবাদী শক্তিকে সরাসরি সমর্থন করছে না। অথচ, আন্তর্জাতিক সীমানাহীন এক শরিয়তি ধর্মীয় সংস্কৃতি ক্রমে গ্রাস করছে। শিক্ষিত মানুষের মধ্যে তাদের প্রভাব বাড়ছে। নানা কিসিমের উৎপীড়ন যেমন বাড়ছে তেমনই গান-বাজনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছে গ্রামের শিক্ষিত তরুণদের একাংশ। অথচ সংগঠনের নাম শোনা যাচ্ছে না। সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে না। রাতভর মিলাদ-মেহফিল বেড়েছে হরিসভার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সীমান্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠা হচ্ছে বড় বড় মন্দির। আবার লাফিয়ে বাড়ছে মসজিদের সংখ্যাও। রেজিনগরের যে গ্রামগুলোয় পিরপন্থীদের একটি দরগা ও তিনটি দরবার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, সেই তেঘরি, পশ্চিম তেঘরি, নাজিরপুর গ্রামে আশির দশকে ছিল একটি মসজিদ আজ আটটি। কিছুকাল আগেও পিরপন্থীদের সঙ্গে গ্রামে তেমন কোনও বিরোধ ছিল না। পিরপন্থীরা মসজিদে যেতেন। কেন না তারা আল্লা বিরোধী নয়, কোরান বিরোধীও নয়, তবে, শরিয়তের পাঁচ অবশ্য পালনীয় কর্তব্য নামাজ, রোজা, কলমা, হজ, জাকাত অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে, এমনটি তারা মানেন না। তাদের সাধনপথ ভিন্ন। তবু, এই বাজারে ২০১৭ সালের মে মাসে সংঘ ‘শরিয়তি মুক্তাঞ্চল’ করার বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক ও এসপি’র কাছে স্মারকলিপি জমা দেয়। আর আজও লালন সাঁই-এর গান সত্য হয়ে ওঠে —
তোমার পথ ঢ্যাকাচ্ছে মন্দিরে মসজিদে।
ও তোর ডাক শুনে সাঁই, চলতে না পাই—
আমায় রুখে দাঁড়ায় গুরুতে মুরশিদে।।

* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

কালুখালির শাহ সুলেমান চিস্তির খানকা শরিফ আর সাধু-ফকিরদের ভিড় বুঝিয়ে দেয় প্রকৃত ব্রাত্যজনের দরবারেই এসেছি। নিখাদ গরিব শ্রমজীবী মানুষ। দুই হাতে দু’হাত জড়িয়ে ধরে জয়গুরু ডাকে কাছে টেনে নেয়। দুপুর হয়েছে। ‘সেবা’ গ্রহণের আন্তরিক আবেদনে, পা মেলে চটের টানা আসনে বসি। গরম গরম মোটা চালের ভাত, ডাল আর সবজির ঘ্যাঁট পেটপুরে খেয়ে ধাতস্থ হই। আর তার পরই এক নতুন নতুন শব্দের পৃথিবী গ্রাস করে। দরবার, খানকা শরিফ, মারফতি, বেদাত, নেকি, চিল্লাখানা…। হরবখত মসজিদ, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, শরিয়ত শোনা কানে কিছুটা বিজাতীয় শোনায় বটে। একদিকে শিয়া-সুন্নি ইসলামি সম্প্রদায় / গোষ্ঠী অন্যদিকে চিস্তিয়া-কাদেরিয়া-নকশবন্দিয়া সুফি তরিকা। এ যেন ভিন্ন এক সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু শব্দাবলী,যে চোখেই দেখি না কেন, সে হিন্দু চোখ হোক কিংবা মুসলমান। মুসলমানের গল্পই যে জানা হল না তেমন করে। রস রতির ফকিরি গুহ্যসাধনা তো অন্য জীবনচর্যার কথা।

আওয়ালসিদ্ধির খ্যাপা ফকিরের আখড়া ভরে উঠেছে। বিকেল থেকে একে একে এসে হাজির হয়েছে ফকির-গোঁসাইরা। আসুন সুবিদ মোল্লার ‘দেহ ছেড়ে অন্তরে’ গল্পের কিছু অংশ পড়ে ফেলা যাক। “একটু পড়ে শুরু হবে কবর জিয়ারত। খ্যাপা ফকিরের বউ রহিমা বিবি, ধুনুচিতে ফুঁ দিতে দিতে কবরের পাশে এসে দাঁড়ায়। ধূপের গন্ধে বাতাস পবিত্র হয়ে উঠেছে। এমন সময় হাট থেকে ঘরে ফিরছিল গ্রামের মসজিদের ইমাম। কাদেরের বাড়ির কাছে এসে মৌলবি সাহেব থমকে যায়। খ্যাপাবাবাজি, তার বউ, ছেলে কাদের কবরে ধূপ, মোমবাতি জ্বালছে। মুসলমান গ্রাম হলেও খ্যাপা ফকিরদের অবস্থা করুণভাবে সংখ্যালঘু। গ্রামে কয়েকঘর মাত্র ফকিরের বাস। শরিয়তপন্থীরা কথায় কথায় তাদের ত্রুটি খোঁজে। এসব বেদাতি শেরেকি কাণ্ড চলছে গ্রামের মধ্যে। রাগে গরগর করতে করতে মৌলবি সাহেব পথ ধরে।”

গল্প এগোয়। আমি সদ্য কেনা ‘অপ্সরা প্লাটিনাম’ কাঠ পেন্সিল দিয়ে একটা একটা শব্দের নীচে দাগ মারি। ‘জিয়ারত’, ‘বেদাতি’, ‘শেরেকি’। সংসদের অভিধান খুলি। জিয়ারত বি. তীর্থ বা কবর প্রদক্ষিণ (‘আসিয়াছি মাগো জিয়ারত লাগি’ : নজরুল)। [ আ. জিয়ারৎ]। ব…ব…বে…দা… নাহ! বেদাতি মেলে না, শেরেকিও নয়। এবার ‘চলিত ইসলামি শব্দকোষ’ খুলে বসি। বাংলায় বেদায়াত হয়েছে বেদাতি। কোষ জানাচ্ছে, ইসলামের স্বীকৃত উৎস বা মহম্মদের নির্দেশ ও জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খায় না এবং নতুন ধর্মতাত্ত্বিক বা সামাজিক বিষয় বোঝাতেও বেদায়াত শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বেদায়াতের আবার ভালো মন্দ রয়েছে। মহরমে ঢোল বাজানো, শাঁখা-সিঁদুর পরা বা কবরে সিজদা বা ধূপ-ধুনো দিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে পুজো-পুজো আবহ তৈরি করাও বেদায়াতে সাইয়া বা খারাপ বেদায়াত। কারণ তা কোরান বা সুন্নার পরিপন্থী। কিন্তু মাইকে আজান দেওয়া কোরান-হাদিসে না থাকলেও তা মুসলমানের মেনে নিতে আপত্তি নেই। সে হল ভাল বেদায়াত বা বেদায়াত হাসানা। শেরেক শব্দের অর্থ হল, আল্লার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করা। পৌত্তলিকতা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আল্লা ছাড়া অন্য কাউকে উপাসনা যেহেতু মুসলমানের নিষেধ তাই শেরেকি কাজকে ইসলাম বিরোধী এবং অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে করা হয়।

ইতোমধ্যে পান্তাপাড়ার মুনসুর ফকির হারমোনিয়ামে সুর বাঁধতে লেগেছে। খ্যাপাবাবাজি তাল বাঁধছে তবলায়। আর কোন ফাঁকে  মওলানা সাহেবের ছেলে হাসমত চুপি চুপি এসে বসেছে সাধু-ফকিরদের পাশে। গানে-ভাবে জমে উঠুক আখরা আমরা সেই ফাঁকে আলোচ্য শব্দকোষটি সংকলনের পিছনের ইতিবৃত্তটি জেনে নিই। ২০০৬-০৭ সালে সংকলক মিলন দত্ত ‘পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ ও জীবনের গল্প’ নিয়ে আর একটি গ্রন্থ সংকলিত করেছিলেন। তো সেই গ্রন্থটির অনেক পাঠক বলেছিলেন, ‘বহু শব্দের মানে তাঁরা বুঝতে পারেননি।’ এমনকি, ‘মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের অনেক কিছুই জানা না-থাকায় অসুবিধায় পড়তে হয়েছে।’ তাঁদের পরামর্শ ছিল, কিছু শব্দের অর্থ কিংবা কিছু অনুষ্ঠানের বিবরণ ফুটনোট দেওয়ার। পরামর্শ সংগত মনে করলেও সংকলক জানিয়েছিলেন, “কিন্তু আমাদের মনে হয়েছিল, প্রায় হাজার বছর পাশাপাশি গায়ে গা লাগিয়ে বাস করার সূত্রে মুসলমান সমাজ নিয়ে লেখা গল্প পড়ার জন্য হিন্দু শিক্ষিত পাঠকদের অন্তত ফুটনোট প্রয়োজন হবে না। ভুল ভেবেছিলাম। প্রকৃত অবস্থাটা হল, মুসলমানের সামাজিক ধর্মীয় ব্যবস্থা এবং রীতিনীতি নিয়ে ভদ্রলোক হিন্দুদের অজ্ঞতা এ বাংলায় এক ধরনের সামাজিক সঙ্কটের পর্যায়ে রয়েছে।”

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। মুকুরে নিজের মুখ তো দেখতে পাই। যাই হোক, আখরায় গিয়ে বসি। গানে-ভাবে জমে উঠেছে যে।  মারফতি গান ধরেছেন ফকির মুনসুর। “ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে।” মৌলবি সাহেবের ছেলে, মাদ্রাসা পালিয়ে যে খ্যাপাবাবার কলেজ শিক্ষিত ছেলের কাছে আসে অন্য পাঠ নিতে, আখড়ায় যার মনের শান্তি সে বলে, ‘বুঝলাম না ঠিক। বাবাজি ভেদ ভাঙুন।’ কিন্তু, ফকিরি গানের তত্ব তো গুরুর মুরিদ না হলে ভাঙার নিয়ম নেই। তবু মুনসুর ব্যাখ্যা করেন,” ‘ঘর হল এই দেহ…’চোর হল ‘খোদা’। আর ‘হাওয়ার ঘরে’ এর অর্থ হল জেকের (আল্লার ধ্যান) করার সময় দমের কাজ করে। দমে দমে ওই চোরবেশী আল্লাকে ধরতে হয়। তবে হ্যাঁ বাবাজি ঘরখানা একটু ঝেড়ে মুছে সাফ করে রাখতে হয়, না হলে মেহমান (আল্লা) বসবে কী করে।” এই লোকায়ত সাধনা, আখরায় নানা জাতের ভিড়, শরিয়তিদের তাই বড় গোঁসা। দিনো ফকির বলে, “মিলাদ মহফিলে ওরা বলে বেড়াচ্ছে আমরা নাকি সব কুফরি (অবিশ্বাসী)  কাজ করছি।” মুনসুর হেসে উড়িয়ে দেয়। তারা চিস্তিয়া মতের ফকির। ভেদাভেদ নিষেধ। ভক্তেরও কোনও জাত হয় না। ফের গান ধরেন মুনসুর, “ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই/হিন্দু যবন বলে কোনও জাতের বিচার নাই।”

এখানেই বোধ হয় সত্য হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের মরমি উপলব্ধি। “আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্যদেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাদের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেচে। বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি, — এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি।… বাংলাদেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল-কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কি রকম কাজ করে এসেচে, হিন্দু- মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেচে, এই বাউলগানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।” এই উচ্চ সভ্যতার প্রেরণাই বোধহয় প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করতে শেখায় চাষি-মজুর-খ্যাপা-পাগল-ফকির-প্রেমিকদের। শাহ সুলেমান চিস্তির দরবারে ভেজা শীতরাতে ঠাসাঠাসি ভিড়। মূল মণ্ডপ ভেসে গিয়েছে। তবু দরবারের  বাঁশের বেড়া, টালির চাল আর মাটির মেঝের ছোট্ট এক হল ঘরে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক কাজ শেষ হয়। অত:পর  গানে গানে ভেসে যায় কালুখালি। দাওয়ায়, মূল দরবারের বারান্দায় কিংবা ভেজা মাটিতে পিঠের নীচে ত্রিপল, মাথার উপর আলগা ত্রিপল আর বাড়ি থেকে আনা কাঁথা-কম্বল সম্বল করে বড় নিশ্চিতে ঘুমোয় মানুষভজা ব্রাত্য মানুষ। হ্যাঁ, বৃষ্টি পড়ে। ভিজে হাওয়া ছুটে এসে খোলা চামড়ায় কামড় বসায়।

গো-রাখাল হাকিমুদ্দিন ও নাগরিক গো-এষণা

ছোট্ট হাকিমুদ্দিন প্যাট-ভাতের রাখালিতে যাবে স্থির করে ফেলে আবজেল। তাদের ডাঙালির গাঁ-ঘরে তেমন গেরস্থ নেই, তাই পাঠাবে দূর নাবালে। সেখানে বড় বড় জোতের গেরস্থ, তাদের ঘরে আট-দশটা করে বড় বড় গোলা। ভাত-তেলের অভাব নেই। যাওয়ার দিনও স্থির হয়ে যায়। হাকিমের ছেঁড়া-ফাটা প্যান্টে তালি মেরে ক্ষারে কেচে উনুনের আঁচে শুকিয়ে নিয়েছে মা জামিলা। যাওয়ার আগে বুড়ো বাপের কাছে ছেলেকে নিয়ে আসে আবজেল। ছেলের জন্য দোয়া চায়। নাতির গায়ে-মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে, “যা ভায়া আজ থেকে তুই রাখাল হলি। মন দিয়ে কাজ করবি। রাখালের কাছে গোরু হল গুরুজন। অনর্থক পাঁচনবাড়ি যাঁতাবিনে। অবলা পশু কথা বলতি পারে না। আল্লার মাখলুকাত।”

২০১৬-১৭ জুড়ে গো-রক্ষার নামে একের পর এক মুসলমান হত্যা, শারীরিক নির্যাতন সারা দেশ জুড়ে হিংস্র উন্মাদনা তৈরি করে। কেন্দ্রীয় সরকারের গো-বিধি বিল (বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের বলে অকার্যকর) আগুনে ঘি ছড়ায়। উলটোদিকে, প্রতিবাদ, আইনি লড়াই কিছু কম হয়নি। লেখা হয়েছে অজস্র অতি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক-আইনি প্রতিবেদন। প্রবন্ধ-নিবন্ধ, তদন্তমূলক রিপোর্ট। বেদ-পুরাণের ব্যাখ্যাও বাদ পড়েনি। স্মরণাতীত কালে গো-চর্চার এমন বিকাশ দেখা যায়নি। এই লেখকও সেই অবসরে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন নামিয়ে ফেলেছিল। সেখানে তথ্যের খুব একটা অভাব ছিল না। সংবিধানের দোহাই, আইনের ব্যাখ্যা ছিল। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ছবি ছিল। কিন্তু, যা ছিল না তা হল হাকিম-আবজেল-খানদার ফরাজিদের গো-যাপনের কথা।

নাবালের বড় গেরস্থ খানদার ফরাজির বাড়িতে ঠাঁই পায় হাকিম। তাকে শির-রাখাল ফকির আলির হাতে তুলে দেয় ফরাজি। ফকিরের এখন দায় হাকিমকে শিখিয়ে-পড়িয়ে রাখাল করে তোলার। ওইটুকু ছেলে, ফকিরের ভাষায় ছাগলছানার মতো। তাকে রাঙামাটি দিয়ে মাথা ঘষে স্নান করিয়ে তেল মাখাল ফকির। এবার রাখালিতে আনুষ্ঠানিক দীক্ষিত করার পালা।

লাল গামছা, নতুন ডোরা পরানো হল হাকিমুদ্দিনকে। বসানো হল গোয়ালমুখো করে। কোমরে ডোরার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল একগুচ্ছ গোরুর গোঁফালি। বাড়ির ছোট বউ টেনে দিল দু-চোখে কাজলের রেখা। কপালে কাজলের টিপ। হাকিম নিতান্তই খোকা তাই এখনই পাঁচনবাড়ি হাতে রাখালি করতে হবে না। সে বাড়িতেই থাকবে। বাড়ির কুকুর-মেকুর, ছাগল-মুরগি, বউ-ঝি থেকে বাচ্চা-কাচ্চা, গোরু-বাছুরদের চিনবে-জানবে। এই পরস্পরের চেনাজানাতেই সিদ্ধি আসবে। ফকির বলে, “গো-রাখাল হতে গেলে গোরুর সঙ্গে গোরু হতে হয়। তাহলে জানা যায় গোরুর ভাষা। গোরুর ভাষা জানলে জানতে পারবা গোরুর দু:খ-কষ্ট, আনন্দ-ফুর্তি, রোগ-ব্যাধি সব। ” গেরস্থ ফরাজিও বীজ মন্ত্র দেয়। বলে, “…তোমার কোমরে যে গোঁফালি বাঁধা হল তা গো-রাখাল হয়েছ বলে। এতে তোমার দায়িত্ব বেড়ে গেল। কখনও গোরুর সঙ্গে নিমকহারামি করবা না। নিমকহারামি করলে অবলা পশু অভিসম্পাত করবে। গোরুর গোবর থেকে ঘষি হয়, দোজখে সেই ঘষি সত্তরগুণ বেশি উত্তাপে জ্বলে উঠবে। খোদার ফিরিস্তারা বেইমান রাখাল-বাগালদের সেই আগুনে ছুঁড়ে ফেলবে। বুঝেছ?”

এখানেই শেষ হয় না নবীন রাখাল বরণ। গেরস্থ ফরাজি হাকিমের মাথায় বাঁ হাতের তালু রেখে, মুখের দিকে তাকিয়ে ছড়া কাটে —- রাখাল রাখাল গো-রাখাল রাখাল হল ডাঙালির / নতুন গামছা নতুন ডোরা আজ রাখালের মুখে ক্ষীর। ছড়া শেষ হয়, প্রথমে খানদার ফরাজি তার পর একে একে ছেলেরা, ছেলের বউরা তার মুখে পায়েস তুলে দেয়।

হাকিমুদ্দিনকে আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না তার ডাঙালি শালি গাঁয়ে। জলঙ্গী পুষ্ট নাবালে মিলবে না খানদার ফরাজিকেও। শ্যালো, লিফট ইরিগেশনে ডাঙাজমি এখন তিন ফসলি। চাষ নিবিড়। সাত-আট গাঁ হানা দিলে হয়তো এক-আধটা লাঙলের খোঁজ মিলবে। ট্র‍্যাক্টর চষে ফেলে মাঠের পর মাঠ। পেটান্তিপুরের মতো গো-চারণ ভূমি আসলে বিলাসিতা। হাকিমুদ্দিনরা গ্রামের পর গ্রাম ঝেঁটিয়ে আসমুদ্রহিমাচলে ছড়িয়ে পড়েছে। পেরিয়ে গিয়েছে আরব সাগর। গ্রাম বাংলার আর্থিক উন্নতির পিছনে এক অন্যতম প্রধান কারণ এই পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়িতে পাঠানো অর্থ। সে অন্য কাহিনি।  হাকিমুদ্দিন অবশ্য তার রাখাল জীবনে ট্র‍্যাক্টর দেখে ফেলেছে। রাখাল থেকে মোড়ল রাখাল হতে হতেই সে দেখেছে একের পর এক মাঠ, ঘাসজমি ফালাফালা করে চষে ফেলছে কলের লাঙল। গাঁয়ের পর গাঁ পেরিয়ে গেলেও আর তেপান্তরের মাঠের মতো চারণভূমি চোখে পড়ে না। অবশেষে একদিন ভাদ্র সংক্রান্তিতে গোটা পাল বিক্রি করে দেয় খানদার। প্রতিবারের মতো সেই সংক্রান্তিতেও ফরাজি বাড়ির বউরা গোসল করে নতুন শাড়ি পরে সদ্য প্রস্তুত করা পায়েস খাওয়ায় গোরুদের। দরবেশের মসজিদের আজান ধ্বনি থেমেছে বটে, তবে ওপারের শংকরপুর থেকে তখনও ঢাক-ঢোল, শঙ্খ ও উলুধ্বনি শোনা যায়। গোহাল খালি হয়। রাখালেরা অঝোরে কেঁদে চলে। শির-রাখাল ফকির আলির ষাঁড়ের গোঁফালি গোঁজা মাথার পাক মাটিতে লুটোপুটি খায়। সবুজ বিপ্লব আসে।

হিন্দু নাগরিক গো-এষণায় মুসলমান আর গরুর সম্পর্ক খাদ্য-খাদকের। বকরি ইদের। রাখাল বলতে বোঝে, ‘গোপের ব্রজ বালক’। আর তারই অনিবার্য সম্প্রসারণ ঘটে প্রকাশ্যে আকাদেমিক গোমাংস ভক্ষণে। গো-তাণ্ডব, গো-বিধির বিপরীত বয়ান নির্মাণে যত সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে আসে বেদ-পুরাণ, ততটা স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক উচ্চারণে উঠে আসে না শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ কিংবা সৈয়দ মুজতবা সিরাজের ‘গোঘ্ন’। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় -এর নাটক ‘দ্য পারসিকিউটেড’ প্রায় বিস্মৃত।

বদলে যাওয়া কৃষি অর্থনীতিতে গবাদি পশু আজ মূল চালিকাশক্তি। আজও দেশের কোটি কোটি ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, ভূমিহীন চাষি গো-অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। তারা কেবল মুসলমান নয়। হিন্দুত্ববাদী নির্মাণ অনুযায়ী গো-খোর যবন নয়। লেখক আনসারউদ্দিন অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় মনে করিয়ে দিলেন, পালক ও পালিতের মধ্যে এ এক স্বাভাবিক আত্মিক সম্পর্ক। এর মধ্যে হিন্দু-মুসলমান নেই। হাট থেকে নতুন গরু কিনে ঘরে ফিরে গেরস্থ গরম জলে তার পা ধুয়ে দেয়। আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককেও তিনি অস্বীকার করেন না। হাকিমের দাদু তাই নাতিকে স্মরণ করিয়ে দেন, গোরু ‘আল্লার মাখলুকাত’। আল্লার সৃষ্টি। বকরিদে গোরুর গলায় পোঁচ চালাতে কলমা পড়তে হয়। ধলি বলদ মরে গেলে ভোলা মিস্ত্রি খবর পাওয়া মাত্র ছুটে আসে। তার মায়াদয়াহীন কথা শুনতে ভালো লাগে না হাকিমের। মনে হয়, ‘একেবারে কাফেরের জান।’ দুটো দামড়া গোরু ধলিকে টেনে নিয়ে যায় ভাগাড়ে। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে পেছন পেছন হাঁটে হাকিম। ফকির, জাব্দার, খাস্তার ভাগাড়ের মাটিতে নামায় ধলির লাশ। ভোলা শিং-এ ঘষে ঘষে ছুরিতে শান দেয়। তার পর এক সময় জিজ্ঞাসা করে, ‘তাহলে বলদের কাছ থেকে খালাসটা নেবে কে? যা করবে চামড়ায় ছুরি বসানোর আগে।’ ফকিরের কথায় খালাস নিতে প্রস্তুত হয় হাকিম। সবাই জানে ওই তো ধলিকে সবচেয়ে ভালোবাসতো। এক হালি দুব্বোঘাস ছিঁড়ে নেয় হাকিম। সেই ঘাস পায়ে-পেটে ছুঁইয়ে মুখের উপর রাখে। ফকির আলির শেখানো মতো সে ভাঙা গলায় বলে, ‘ঘাস খেলে পানি খেলে, গো জন্মে খালাস দিলে।’ ভোলার হাতে ঝলসে ওঠে ছুরি।

কৃতজ্ঞতা:

ফকিরনামা, সুরজিৎ সেন, গাঙচিল,২০১৩।
Rejinagar Shariyati Violence, A fact-finding report, AMRA, 2017.
লালন সাঁই, আবুল আহসান চৌধুরী, গাঙচিল, ২০১৩।
মুসলমানের গল্প, মিলন দত্ত, পরম্পরা,  ২০১৬।
চলিত ইসলামি শব্দকোষ, মিলন দত্ত, গাঙচিল, ২০০৮।
গো-রাখালের কথকতা, আনসারউদ্দিন, অভিযান, ২০১৫।
গো-বিধি: একটি হিন্দু ফ্যাসিবাদী প্রকরণ, দেবাশিস আইচ, aainanagar.com, ২০১৭।

1 thought on “মুসলমানের কথা, মুসলমানির কথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.