রাণা আলম

ওজন বিরাশি কেজি। প্রিয় খাদ্য পেঁয়াজি আর ডালপুরি। কপাল দোষে প্রেমিকার নাম সায়ন্তিকা। বাড়ি মুর্শিদাবাদ।পেশায় স্কুল শিক্ষক। নেশায় লিটল ম্যাগ কর্মী।
বিঃ দ্রঃ- চোখে পড়ার মতন ভুঁড়ি আছে।

‘তারপর একটা বোরখা পরা লোক পুলিশের ভ্যান থেকে নেমে আসে। গ্রামের সমস্ত জোয়ান মদ্দদের তার সামনে প্যারেড করানো হয়। বোরখা পরা লোকটা যার দিকে আঙ্গুল তোলে আর্মি তাকে তুলে নিয়ে যায়। কিসের অপরাধে তা জানা যায় না। কোনো উকিল দলিল থাকেনা। কোনো প্রমাণ থাকেনা। সে আর ফেরত আসেনা। জলজ্যান্ত একটা মানুষ ভ্যানিস হয়ে যায়। সে যে ছিল, বাস্তবে তারই কোনো প্রমাণ থাকেনা।’
একটা বারো-তেরো বছরের ছেলে গল্প শুনছে তার বাকি ভাই বোনেদের সাথে। সালটা ১৯৯৭। তারই এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন এক কাশ্মীরী শাল বিক্রেতাকে। বিয়ের পর তিনি কাশ্মীর চলে যান। বেশ কবছর পর স্বামী আর দুই সন্তান কে নিয়ে তাঁরা কাশ্মীর ছেড়ে চলে আসেন। তাদেরই গল্প।
বক্তা শেষ করেন, ‘কাশ্মীরে মুসলমান হওয়ার জন্যই এত অত্যচার হয়’।
বারো-তেরোর ছেলেটার শিরদাঁড়া দিয়ে তখন ভয়ের স্রোত নেমে যায়।
এর অনেক বছর পরে যখন বছর তিরিশের ছেলেটা বিশাল ভরদ্বাজের হায়দর দেখতে যায়। সেই নব্বইএর কাশ্মীর। পুলিশের ভ্যানে বোরখা পরা লোক।সামনে দিয়ে গ্রামের জোয়ান মদ্দরা প্যারেড করে যাচ্ছে। বোরখা পরা লোকটা যার দিকে তাকিয়ে হর্ন বাজালো, আর্মি তাকেই তুলে নিয়ে গেলো। কিসের অপরাধে তা জানা গেলো না। কোনো উকিল দলিল নেই। কোনো প্রমাণ থাকলো না। সে আর ফেরত আসেনা। জলজ্যান্ত একটা মানুষ ভ্যানিস হয়ে যায়।
পুরোনো ভয় লাগাটা আরেকবার ফেরত আসে। নুইয়ে পড়া শিঁরদাঁড়ায় আরেকবার ভয়ের স্রোত নেমে যায়।
আগেরমতই ‘মুসলমান’ ছেলেটার সামনে ধর্ম দিয়ে শত্রু আর বন্ধু খোঁজার পুরোনো খেলাটা উঁকি দেয়।

মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম আমার। ইলেক্ট্রিক দেখেছি সাত বছর বয়সে। মাটির বাড়ি ছিল। বাবা-মায়ের চাকুরীসূত্রে তারপরেই আমরা শহরে চলে যাই। পিতৃদত্ত নাম ছিল রাণাপ্রতাপ মন্ডল। আমাদের পারিবারিক উপাধি মন্ডল। তিন চার পুরুষ আগে নমঃশূদ্র হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিম আমরা। আবার অনেকে বলেন আমরা নাকি বাউল ছিলাম। হিন্দু ধর্মের কুৎসিত বর্ণভেদ প্রথাতে যারা নমঃশূদ্র ছিলেন, তারাই আমাদের পূর্বপুরুষ। আমাদের বাড়িতে গরুর মাংস খাওয়ার চল ছিল না। এখনও আমার বাড়ির বয়স্করা অনেকে গরুর মাংস খান না। রেশন কার্ড অব্দি রানাপ্রতাপ মন্ডল নামটা ছিল। তারপর ঠিক মুসলমান নাম নয় এই কারণে নামটা পাল্টায়। বিশুদ্ধ শাস্ত্রসম্মত মেহফুজ আলম নাম রাখা হয়। ইসলাম ধর্ম কাফের নাম থেকে রক্ষা পায়। যদিও সরকারী কাজ ছাড়া এই নামটা ব্যবহার করিনা। নিজের নাম সব জায়গাতেই লিখি রাণা আলম। এই নাম নিয়েও একটা ব্যাপার আছে। অনেক মুসলিম বাড়িতে আরবি শব্দ বিহীন নাম রাখা হয় এই জন্য, যাতে তারা হিন্দুদের আক্রোশ থেকে রক্ষা পায়। আমার সঙ্গেই পড়ত সুমন সরকার, দিলীপ মন্ডল যাদের নাম শুনে বোঝা যেত না তারা মুসলমান। আসলে এর পিছনে কিছু ঘটনা, যা আমরা বড়দের মুখ থেকে শুনতাম, সেগুলো কাজ করত। আমি ছোট থেকেই শুনেছি যে হিন্দুরা আমাদের ঘৃণা করে। মানুষ ভাবেনা। আমার এক গ্রামতুতো চাচাজি’র দাড়ি ধরে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার মা যখন চাকরির ইন্টারভিউতে যান, সেই স্কুলের দিদিমণিরা চান নি যে কোনো মুসলিম সেই স্কুলে আসুক। তারা স্কুলের সেক্রেটারির কাছে আবেদন অব্দি করেছিলেন। কাটরা মসজিদের দাঙ্গায় কিভাবে কোনো মুসলিমকে কুপিয়ে মেরেছিল হিন্দুরা তার বর্ণণা শুনতাম। সেসব কাহিনী শুনে হাড় ঠান্ডা হয়ে যেত। কাউকে চেনার আগেই তাকে তার নাম শুনে শত্রু কিংবা মিত্র নির্বাচিত করতাম। এই অভ্যেস অসচেতনভাবেই আমাদের তৈরী হয়ে যায়, সমাজ আমাদের দিয়ে তৈরী করায়।
আমাদের গ্রামে আমাদের কালীবেলতলা বাগানের পাশে ‘রামনবমী’ মেলা বসতো প্রতিবছর। রামের মন্দির ছিল। পূজারী ঠাকুররা ক’ঘর থাকতেন মুসলিম বাড়ি ঘেরা পাড়াতে। কোনোদিন সমস্যা হয়েছে বলে শুনিনি। তারপরে সব পালটে গেলো। মন্দির উঠে গেল। হিন্দুরা যারা পারলেন, বাড়ী বিক্রি করে চলে গেলেন অন্যত্র। মন্দিরের সামনের মেলাটা আমার ছোটবেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল। সব শেষ হয়ে যাবার পরের কয়েকবছর মন্দির আর মেলার জায়গায় গিয়ে বড্ড ফাঁকা লাগতো। এখন সব সয়ে গেছে।

*

সালটা বোধহয় দুহাজার ছয় কি সাত। বহরমপুরে স্কোয়ার ফিল্ডের পাশে তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের সামনের চাতালে’র কাছে বড় ছাতা টাঙিয়ে বিএসএনএল-এর ৯৪৩২ সিরিজের সিম বিক্রি হচ্ছিল দশ টাকায়। তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমি আর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অম্লান সিম তুলতে গেলাম। অম্লান আমার আগে। ভিড় অল্প। অম্লান ডকুমেন্টস জমা দিল। জিজ্ঞেস করল সই করতে হবে কিনা ফর্মে। কাউন্টারে বসা ছেলেটি মাছি ওড়ানোর ভঙ্গিতে জানাল যে লাগবে না। এরপর আমি। ডকুমেন্টস জমা দিলাম। ছেলেটি অলস ভঙ্গিতে ডকুমেন্টসের দিকে তাকালো, তারপর আচমকা সোজা হয়ে বসে বলল ‘আপনি ফর্মে সই করুন’। আমি অম্লান কে সই করতে হয় নি দেখে নিজেও ফিরে যাচ্ছিলাম। এবার ফিরে সব কটা সই করতে শুরু করলাম। আড়চোখে দেখলাম যে ছেলেটি, যে অম্লানের ডকুমেন্টস গুলো একবার দেখেই রেখে দিয়েছিল, আমার ডকুমেন্টস গুলি খুঁটিয়ে দেখছে।
ঠিক কবে থেকে আমি মুসলমান হয়েছি তা ঠিক মনে করতে পারছিনা। তবে মনে পড়ছে সেই ছোটোবেলায় আমাদের বাড়ির থেকে অনতিদূরের যে প্রাচীন আশ্রমটি আছে, সেখানকার এক সন্ন্যাসী আমাদের বাড়িতে ভিক্ষে নিতে এসে মা’কে দেখে তৎক্ষণাৎ অ্যাবাউট টার্ন করে ফিরে যাওয়াতে আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে মা হেসে বলেছিলেন ‘আমরা মুসলমান তো।ওরা হিন্দু সন্ন্যাসী’।
তখনও ঠিক বিষয়টা বোধগম্য হয়নি। হিন্দু সিন্ন্যাসী হলে মুসলমানের বাড়িতে কেন ভিক্ষে নেওয়া যাবেনা, সেটাও বুঝে উঠতে পারিনি। গরমের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। জ্যাঠতুতো ভাই বোনেদের সাথে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেখানে দুই পাড়ার ছেলে মেয়েদের মধ্যে টিফিনের সময় খেলা নিয়ে ঝগড়া। ঝগড়ায় যে গালাগালগুলো ব্যবহার হচ্ছিল তা আমি কখনও শুনিনি। সেখান থেকে জ্ঞানলাভ হল যে আমরা, মানে মুসলমানেরা হলাম ‘নুনুকাটা’র জাত। আর হিন্দুদের নুনু কাটা হয় না। নিজের আইডেনিটিটি নিয়ে আরো বুঝলাম যে আমরা আব্বা-আম্মা বলি, ওরা, মানে হিন্দুরা বলে বাবা-মা। আমরা পানি বলি, ওরা বলে জল। আমরা নামাজ পড়ি। ওরা পূজো করে। প্রাইমারি স্কুল পার করার আগেই এই শব্দগত বিভেদগুলো বুঝে গেছিলাম।
আরেকটু বড় হলাম। ক্লাস ফাইভে পড়ি। তখন শুনলাম পাকিস্তান আছে বলেই নাকি আমাদের ভারতে মুসলমানেরা বেঁচে আছে। পাকিস্তান নাকি হুমকি দিয়ে রেখেছে যে ভারতের একটা মুসলমানের ক্ষতি হলে ওরা ভারতকে উড়িয়ে দেবে। নইলে কোনকালে হিন্দুরা ভারতের মুসলমানেদের কচুকাটা করে দিত। ভারত পাকিস্তান খেলা হলে বেশ কিছু জায়গায় তখন পাকিস্তানের পতাকা উড়ত। অনুপস্থিত ঈশ্বরের মতই অদৃশ্য পাকিস্তানের ভরসায় হিন্দুদের হাত থেকে বেঁচে কেটে গেলো আরো কয়েকটা বছর। হাই স্কুলের গন্ডিতে পা দিয়ে নিজের মুসলমানত্ব নিয়ে আরো নিঃসংশয় হলাম। ঈদ আমাদের পরব। দুর্গাপূজো হিন্দুদের। হিন্দুরা গরুকে পূজো করে, অতএব গরু খেলেও হিন্দুদের সামনে বলা যাবেনা। ওরা কষ্ট পাবে। বন্ধুদের সাথে একসাথে স্কুলে যেতাম আর ফিরতাম। যাতায়াতের পথে হিন্দু বন্ধুরা মন্দির দেখলে দাঁড়িয়ে প্রণাম করত। তাদের সাথে আমিও করতাম। বন্ধুত্বের টানে না কিসের জন্য তা বলতে পারবো না। অত ভাবার বয়স তখন ছিল না। এরকমই একদিন ফেরার পথে জনৈক স্বধর্মীয় গুরুজনের সাথে মন্দির দেখে অভ্যেসবশতঃ প্রণাম করেছিলাম। তিরষ্কার ছাড়াও দু-একটা চড় চাপাটি যে জুটেছিল, তা মনে আছে। হিন্দুদের মন্দিরের সামনে মুসলমান হয়ে প্রণাম করাটা যে ঘোরতর পাপ তা আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আমি ঠিক নিজের আত্মকথা লিখতে বসিনি। সংখ্যালঘু মাত্রেই আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভোগে। সে যেখানকারই সংখ্যালঘু হোক না কেন। আমি মূলতঃ নামগত কারণে সংখ্যালঘু – নিজের এই সংখ্যালঘুত্বটা বিচার করতে বসেছি। হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকে বাঙালি সমাজে হিন্দু-মুসলিম পার্থক্যটা ভালোমতই মগজস্থ হয়েছিল। বিশেষতঃ কথা বলার সময় খেয়াল রাখতে হত যাতে কোনো মুসলমানী শব্দ বাইরে ব্যবহার না করি। আবার দু-চারজন সংখ্যালঘু যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতো তখন তারা নিজেদের স্বাভাবিক শব্দে ফিরে যেত বা এখনো যায়।
কিছুদিন আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় জহর সেন এর একটি লেকচার শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন যে যেকোনো সমাজে তার কালচার বা বহিরঙ্গএর যাবতীয় যা কিছু আসলে সখ্যাগুরু দ্বারা নির্ধারিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়। সংখ্যালঘুকে সেখানে অ্যাডপ্ট করতে হয়। সংখ্যালঘু মুসলমান হিসেবে এই অ্যাডাপ্টেশন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আমিও গেছি। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের হিন্দুদেরও নিশ্চয় একইভাবে অ্যাডপ্ট হতে হয়। আমাকে হিন্দুদের যাবতীয় প্রধান উৎসবের নাম জানতে হয়েছিল। কেউ শেখায় নি বা জোর করেনি। কিন্তু যে আবহে বড় হয়ে উঠেছি তাতে এমনিই জেনে যেতাম। এবং অবাক লাগতো যে আমি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। পুরাণ আর উপকথাগুলো জানি। কিন্তু আমার চারপাশের হিন্দুদের অধিকাংশই মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে কছু জানেন না। এর কারণ সংখ্যাগুরু হিন্দুদের উদাসীনতা নাকি মুসলিমদের রক্ষণশীলতা, অথবা দুটোই, তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। ঈদ যে বাঙ্গালির উৎসব এই ধারণাটা গড়ে ওঠেনি। বাঙ্গালি’র উৎসব বলতে দুর্গাপূজাই জেনে এসেছি। পত্র পত্রিকাগুলোর পূজো সংখ্যা বেরুতো। আমি – ভুল না করলে – যে বছর কলেজে দাখিল হই, ২০০২-০৩ হবে, সেই বছর সাংবাদিক বাহারউদ্দিন প্রথম কোনো পত্রিকার ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করেন।
বারো ক্লাস পরীক্ষার আগে আমার জনৈক সহপাঠিনী যিনি পরবর্তীকালে একটি বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদে আসীন হবেন, আমাকে একদিন বললেন ‘রাণা, তোকে কিন্তু আমাদের মতই লাগে। মুসলমান মনে হয় না।’ আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন রে? মুসলমানরা কি আলাদা কিছু হয়?’ তিনি আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, ‘না,মানে ওরা একটু কেমন কেমন হয় জানিস তো’। তখন মনে হয়েছিল তাহলে কি আমি আমার মুসলমানত্ব হারাচ্ছি? সংখ্যালঘুর যে আত্মিক বিপন্নতা থাকে, যেখান থেকে সে সংখ্যাগুরুর সাথে মিশে যেতে চায়, তারই কি প্রভাব পড়েছিল আমার উপর?
শুধু এই প্রশ্নটা নয়, উত্তর খোঁজা বাকি ছিল আরো অনেক কিছুর। আমার শহর বহরমপুরে যেভাবে চোখের সামনে পুরোনো বাড়িগুলো ভেঙ্গে হুড়মুড়িয়ে ফ্ল্যাট গজিয়ে উঠে আমার চোখের চেনা ছবিগুলো নিমেষে ঝাপসা করে দেয়, ঠিক তেমনি রাণা আর রাণা আলম, নামের তফাতে কিভাবে যেন দুনিয়ার দুই রূপ হাজির হত। স্কুল জীবনের শেষ দিকে এক নামী সংখ্যালঘু আবাসিক স্কুলে আমাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে সবাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রোজা রাখে। যথার্থ মুসলমানী আবহাওয়া। আমার অস্বস্তি হত। বাড়িতে কোনোদিনই আমাকে ধর্ম চর্চা করতে চাপ দেওয়া হয় নি। বছরে দুদিন ঈদ গাহে গিয়ে নামাজ পড়ি বা পড়বার ভান করি, তারা এতেই খুশী ছিলেন। এখানে এসে অন্যরকম পৃথিবী। দেখতাম আমি যে মুসলিম আইডেনটিটি নিয়ে শংকিত থাকি। বাইরে চেপে চলার চেষ্টা করি। এখানে এরা সেই আইডেনটিটি নিয়ে বেশ সহজ থাকে। ধর্মীয় আবহে আর কড়া শৃংখলায় মানাতে পারিনি, কিছুদিন থেকে চলে আসতে হয়েছিল। এতে সেই স্কুলটার দোষ নেই। সেখান থেকে এখনও প্রতি বছর প্রচুর কৃতী ছাত্র ছাত্রী বের হয়। আমাদের হোস্টেল ছিল পার্ক সার্কাসের জান নগরে। পার্ক সার্কাস স্টেশনে নেমে নাক চেপে হাঁটতে হত। চতুর্দিকে জঞ্জাল আর ঘিঞ্জি। এখানে কি পৌরসভার গাড়ি ঢোকেনা? নাকি পৌরসভা এদের দেখতে পায় না? এরা বাংলায় কথা বলেনা। ভাত খাওয়া পেটে কাবাব বিরিয়ানি সহ্য হত না। ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ। হোস্টেলের পাশের ক্লাবে দেখতে গেছি। পার্ক সার্কাস সম্বন্ধে আগেই শুনে এসেছি যে এটা আদতে অ্যান্টিসোস্যাল আর পাকিস্তান পন্থী মুসলিমদের বাস। আমি সৌরভের আর ভারতের সমর্থক। একটু সিঁটিয়ে ছিলাম। শচীন খুব ভালো ব্যাটিং করছিল। দেখলাম প্রত্যেকটা বাউন্ডারি’র সাথে সেখানকার ছেলে ছোকরার দল লাফিয়ে উঠছে আনন্দে। দু-একজন বয়স্ক লোক, তার মধ্যে পাশের ফার্মেসীর মালিক ছিলেন, তারা পাকিস্তানের সাপোর্টার ছিলেন। আমাদের দাপটে বেশী মুখ খুলতে পারেন নি। খেলা শেষে ভারতের জয়ে যখন আমরা সমবেত উল্লাস প্রকাশ করছিলাম চিৎকার আর কোলাকুলি করে, তখন আমার ভিতরের অদৃশ্য বাউন্ডারিটা মুছে যাচ্ছিল।
হোস্টেল থেকে ফেরার পথে শেয়ালদহ স্টেশনে আমার সাথে আলাপ হয়েছিল এক বৃদ্ধা ভিখারিনীর। তিনি ওপার বাংলা থেকে সব হারিয়ে এসেছিলেন। এপারে এসেও শান্তি জোটেনি। ভিক্ষে করে বেঁচে আছেন। কয়েকবার তাঁর সাথে পরপর দেখা হওয়াতে বেশ গল্প হত। লালগোলা ঢোকার অনেক আগেই আমি প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাতাম। তিনি আমাকে ওপারের গল্প শোনাতেন। তাঁদের বাড়ি ছিল বরিশাল। কিভাবে পালিয়ে এসেছেন। কিভাবে সেখানকার চেনামুখগুলো আচমকা পালটিয়ে গিয়েছিল। রাতের বেলায় কিভাবে সশস্ত্র মানুষেরা হিন্দু বাড়ি খুঁজে বেড়াতো। সেই বৃদ্ধার মুখে ঘটনাগুলো শুনে মনে হয়েছিল সীমান্তের কাঁটাতারগুলো কোনোদিনই কালো নয়, বরং লাল…রক্তাক্ত লাল। শুনতে গিয়ে কষ্ট হত। এরকমই একদিন আমি ওনার পাশে বসে গল্প করছি প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে। আমার এক সহপাঠী আমাকে দেখে আমার ভালো নাম ধরে, যেটি আরবি ভাষার, ডাকলেন। বৃদ্ধা আমাকে ডাক নামেই চিনতেন। ভালো নামটা শুনে চমকে উঠলেন। এক পলকে সাদা হয়ে গেল মুখটা। আমার সাথে ওনার আর কোনোদিন দেখা হয় নি।
সেদিন মাথা নিচু করে ট্রেনের জানালার ধারে বসে মনে হচ্ছিল অনেক মাইল দূরের কোনো এক দেশের কতগুলো নরপিশাচের অপকর্মের দায় কিভাবে নাম বা ধর্মগত সাদৃশ্যের কারণে অনায়াসে আমার উপর এসে পড়ল। হাতদুটো মেলে দেখেছিলাম যে কোথাও রক্ত লেগে আছে কিনা, হয়ত আছে, অথচ আমি দেখতে পাচ্ছিনা। আমি সেই বৃদ্ধার কোনো দোষ দেখিনি। তার জায়গায় আমি থাকলেও হয়ত একই রকম ঘৃণা পোষণ করতাম।
এই ঘৃণার শেষ কোথায় ? আমি মুর্শিদাবাদের লোক। দু-একটা লোকসভা আগে, কোনো এক পঞ্চায়েত ভোটে আরএসএস কিছু জায়গায় লিফলেট ছড়িয়েছিল যে মুসলমানেরা হল মীরজাফরের জাত, বিশ্বাসঘাতক। অতএব,মুসলিম ক্যান্ডিডেট দের ভোট দেবেন না। মুসলিমদের সম্পর্কে মীরজাফরের জাত কথাটা অনেককেই ব্যবহার করতে দেখেছি। কিন্তু সিরাজের শত্রু ইংরেজদের সাথে তো মীরজাফর একাই হাত মেলান নি। জগত শেঠ ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান হোতা ছিলেন, অথচ তার নাম কেউ বলেনা কেন? কেন জগত শেঠের জাত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ছাপ্পা পায় না? এই প্রশ্নগুলো তখনই মাথায় আসতো। টাকার কয়েনের মতই কখনই ঘৃণারও একদিক হয় না। আমাকে আমার এক স্বধর্মীয় ব্যক্তি একবার বলেছিলেন, ‘তুই তো দিনরাত হিন্দুদের সাথে মিশিস। ওদের সাথেই ঘুরিস। তুই তো নিজেই হাফ হিন্দু।’
মানুষ যে কখন হাফ হিন্দু আর হাফ মুসলমান হয়, তা সত্যিই বোঝা দায়। আমি খুব ছোট থেকেই শুনেছি যে হিন্দুরা আমাদের ঘেন্না করে। মানুষ বলে ভাবেনা। নিজে বোঝার মত বয়সে এসে এরকম অনেক অপ্রীতিকর মুহুর্তের মুখোমুখি হয়েছি। পেশাগত সূত্রে পরিচিত আমার এক ব্যক্তি অনায়াসে তার কোনো এক পরিচিত বিশ্বস্ত মুসলিমের কথা বলতে গিয়ে আমাকে বলেছেন যে মুসলিমরা কিন্তু সাধারণতঃ ওরকম হয় না, মানে বিশ্বস্ত হয় না।পঞ্চায়েত ভোটে কর্মী হিসেবে গিয়ে আমার এক পরিচিত আমায় বললেন ‘খুব ভালো জায়গা পেয়েছি। আশেপাশে কোনো মহামেডান নেই। অতএব ঝামেলা হবেনা।’ এরা কিন্তু আমায় ‘রাণা’ নামেই চেনেন। আমার নাম রাণা আলম জানলে কখনই এই লুকোনো ঘৃণা বেরিয়ে আসতো না। শিক্ষিতরা যেভাবে বাইরে মুখোশ পরে ভিতরে ঘৃণা লুকিয়ে রাখেন,তা সত্যিই খুব আশংকাজনক।

*

একটা বয়স অব্দি আমার ধারণা ছিল যে এই সাম্প্রদায়িকতা আসলে সংখ্যাগুরুর অধিকার। সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে ধারণা হয়েছে আরও পরে। আমাদের গ্রামে, যেখানে আমরা বছরে দুদিন যাই, একবার খবর পাওয়া গেল যে গ্রামের এক ব্যক্তি সে সপরিবারে মুসলমান থেকে ক্রীশ্চান হয়েছে। আমি লোকটিকে আগেও দেখেছি। খুব হতদরিদ্র অবস্থা। প্রায় খেতে পেতনা। গ্রামে ধর্মের মুরুব্বীদের মধ্যে মিটিং হল যে এভাবে ধর্ম ত্যাগ করা বেইমান কাফের কে গ্রাম থেকে তাড়াতে হবে বা তাড়ানো উচিত। আমি তখন স্কুলে উঁচু ক্লাসের ছাত্র। আমি অবাক হয়েছিলাম এটা ভেবে যে লোকটা অ্যাদ্দিন খেতে পেতনা মুসলিম হয়ে, তা নিয়ে কারুর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। ক্রীশ্চান হয়ে চার্চের দৌলতে সে একটা কাজ পেয়েছে, তার ছেলে মেয়েরা স্কুলে পড়তে পারছে। তাহলে এতে বাকিদের সমস্যাটা কোথায়? নাকি ধর্মও আদতে সেই সংখ্যাতত্ত্ব মেনে চলে? ওড়িশার অনেক ক্রীশ্চান আদিবাসীকে বজরং দল বা আরএসএস আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনে বলে পড়েছি। তাহলে ধর্মও সেই মেজরিটি গেম খেলে থাকে যাতে অন্যের উপর নিজের জোর ফলানো যায়।
কলেজে উঠে আরেকটা ঘটনা ঘটলো। আমার ছোট ফুপা, মানে ছোট পিসেমশাই চাকরি সূত্রে আমাদের গ্রামেই থাকতেন। তার মেজ মেয়ে, আমার পিসতুতো বোন ভালোবেসে এক হিন্দু ছেলে কে বিয়ে করলো। তাতে গ্রাম তোলপাড়। আমাদেরই অনেক আত্মীয় পরিজন ঘনঘন মিটিং করলেন যাতে পিসেমশাইকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা যায়। আমাদের নিজস্ব পারিবারিক পরিচিতি আছে, তার সুবাদে ব্যাপারটা বেশিদূর গড়ালো না, তবে পিসেমশাই এর অসহায় মুখটা আমার মনে আছে আজও। আমি স্কুলে পড়ার সময় আমার এক দাদা এক হিন্দু মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। তা নিয়ে আমি আমার বাড়িতে কান্নার রোল পড়তে দেখেছি। জাত ধর্ম যে আর কিছু রইলো না এবং এরফলে সমাজে মুখ দেখান যাবেনা, এটাও শুনেছি। আরেকটা কথা বলে রাখা দরকার, আমার বৌদিকে মুসলিম ধর্মে রূপান্তরিত করা হয়েছিল এবং একইভাবে আমার পিসতুতো বোনও বিয়ের পর হিন্দু ধর্মের আচার পালন করে থাকে।
মুসলিমদের মধ্যেও অনেকে হিন্দুদের চরম ঘৃণা করেন এটা নিজেই দেখেছি। যেহেতু তারা সংখ্যায় কম তাই আরএসএস বা বজরং দলের মত গলা ফাটিয়ে জাহির করতে পারেন না বটে, তাই বলে বিদ্বেষের চাষ বন্ধ থাকেনা। হিন্দুরা অনেকসময় মুসলিমদের বাড়ি ভাড়া দেন না বলে কথা শোনা যায়। অনেকাংশে সত্যি। আমি নিজেই কল্যাণীতে নিজের নামে ঘরভাড়া পাইনি। খোদ বহরমপুর শহরেই কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বন্ধু জিয়াউল রহমান কে তার এক বন্ধুর মেসের মালিক মুখের উপর বলেছিলেন যে তাঁর বাড়িতে মুসলমানেদের থাকা চলবেনা। কিন্তু কয়েনের উলটো পিঠটাও তো আছে। আমার শহরেই অনেক মুসলমান বাড়ীওলা আছেন যারা হিন্দু ভাড়াটেকে বাড়ি ভাড়া দেবেন না। হিন্দুরা ঘর ভাড়া দেয় না, এটা নিয়ে চেঁচামেচি শুনি, কিন্তু অনেক মুসলমানও যে একই কাজ করে থাকেন, তা নিয়ে কথা হয় না কেন? যারা সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা বলেন তারা অনেক ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে চুপ করে থাকেন। এতে বিরুদ্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি’র হাতই যে শক্ত হয় এটা কি তারা বোঝেননা, নাকি বুঝেও বুঝতে চান না. তা খোদায় মালুম।
যারা তসলিমা নাসরিন কে কলকাতায় থাকতে দেওয়ার বিরুদ্ধে মিছিল করেন বা শাহবাগে জামাতিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলে তা নিয়ে পার্ক সার্কাসে জমায়েত করে বিক্ষোভ দেখান, তারাও আরএসএস বা বজরং দলের থেকে কিছু কম সাম্প্রদায়িক নন, এই সারসত্যটা বোঝা উচিত।
প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি করে, মুসলিমরা ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার হয় – এ অভিযোগ শুনে থাকি। কিন্তু মুসলিমরা নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার হতে দেয় কেন, সেটাও বুঝিনা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নির্লজ্জ তোষণ নীতি’র উদাহরণ রেখে কিছুদিন আগে ‘ইমাম ভাতা’ চালু করলেন। যদি মুসলিমদের উপকারই করতে হত তাহলে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় আরো কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা কিংবা আরও কটা স্কুল খোলা, তা না করে উনি ইমামদের টাকা বিলিয়ে তাঁদের মাধ্যমে মুসলিমদের হাতে রাখতে চাইলেন। এটা নিয়ে শিক্ষিত মুসলিমরা খুব একটা সন্তুষ্ট তা নয়, কিন্তু তাঁরা এটা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুললেননা সেভাবে। আরএসএস যে পায়ের তলায় এই রাজ্যে জমি পাচ্ছে, তার অন্যতম কারণ এই ইমাম ভাতা। অথচ শিক্ষিত মুসলিমরা প্রতিবাদ করলেন না। ইমাম সম্প্রদায় যারা নিজেদের মুসলিমদের হর্তাকর্তা বিধাতা মনে করেন তারাও হাত পেতে টাকা নিতে দ্বিধাবোধ করেন নি।
মুসলিম সংগঠনগুলোর কাজকর্মও বোঝা দায়। তারা সুদূর ফিলিস্তিনে মানবতা আক্রান্ত বলে পোস্টার লাগান। সভা করেন। অথচ বাড়ির পাশের দেশে যখন হিন্দুরা সেখানকার কিছু বর্বর মুসলিমদের হাতে আক্রান্ত অত্যাচারিত হয় তখন তা নিয়ে মুখ খোলার প্রয়োজন বোধ করেন না। এদের মানবিকতাও ধর্ম ভিত্তিক। টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম সাংবাদিক ডেকে ফতোয়া দিতে পারেন যে কাকে ভোট দিতে হবে, অথচ আল কায়দা সমেত বিভিন্ন ইসলামিক উগ্রবাদী সংগঠনের পৈশাচিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে একবারও মুখ খোলেন না। শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে যারা ধর্ম মেনে থাকেন, তাদের অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি এটা নিয়ে। তাঁরা জানিয়েছেন যে জঙ্গীরা যা করছে তা ইসলাম নয়। কিন্তু যদি তা ইসলাম না হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ কেন করা যায় না, এটাও বুঝিনা। নিরাপদ দূরত্ব রাখা ভালো কিন্তু নিজের ঘরে আগুন লাগা অব্দি অপেক্ষা করাটা বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
রাষ্ট্রের মূল সমস্যা হল, সে যখন তার পেয়াদাদের ডেকে আনতে বলে তখন তারা বেঁধে আনে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে যে উগ্র মৌলবাদীদের দাপট বাড়ছে, কিছু মাদ্রাসায় আপত্তিকর কাজকর্ম হচ্ছে, এটা কিন্তু আজকের তথ্য নয়। এমনিতে সীমান্তরক্ষা বাহিনীর সৌজন্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা বা যাওয়াটা তেমন কোন ব্যাপার নয়। সেক্ষেত্রে এই এলাকাগুলো তো দীর্ঘদিন ধরেই অবাধ চোরাচালানকারী আর মৌলবাদীদের সেফ প্যাসেজ হয়ে আছে। প্রশাসন যদি বলে বসে যে অ্যাদ্দিন কেউ এসব জানতনা, তা মিথ্যে। এবার বেঁধে আনার একটা গপ্প বলি। সীমান্তের কাছে এক মুসলিম বাড়িতে – কোনো এক আত্মীয়ের বাড়ি – গিয়েছি। সে বাড়িতে একজন মারা গিয়েছেন কিছুদিন আগে। মুসলিমদের কেউ মারা গেলে চল্লিশ দিন পর একটি অনুষ্ঠান হয়। একে সাধারণতঃ চল্লিশা বলা হয়। সেই উপলক্ষেই যাওয়া। খেতে বসবো। মাটিতে সারি সারি পাত পড়েছে। রাস্তার ধারেই বাড়ি। আমাদের সাথেই খেতে বসেছিল স্থানীয় একটি অনুমোদনহীন মাদ্রাসার কিছু কিশোর ছাত্র। আচমকা একটি পুলিস ভ্যান রাস্তা দিয়ে গেলো। তক্ষুণি সেই কিশোরেরা পাত ছেড়ে দুদ্দাড় করে দৌড়ে পালিয়ে গেল। পরে জানতে পারলাম পুলিস উগ্রপন্থী খোঁজার জন্য এদের মাদ্রাসাতেও হানা দিয়েছে রাত বিরেতে এবং নিশ্চয়ই এই কিশোরদের সাথে খুব একটা শোভনীয় আচরণ করেনি, নইলে তারা পুলিস দেখেই এভাবে পালাতো না। এই ঘটনা পূর্বতন সরকারের আমলের। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। মাদ্রাসা মানেই জঙ্গী আখড়া নয়। কিছু মাদ্রাসা অবশ্যই জঙ্গীদের আড্ডা। প্রশাসন তাদের খুঁজে বার করুক। দোষীদের শাস্তি দিক। কিন্তু এবিষয়ে এজাতীয় সরলীকরণ আদতে বিচ্ছিন্নতাবাদকেই অক্সিজেন যুগিয়ে যায়।
বিশাল ভরদ্বাজের হায়দর দেখার আগের ঘটনা। আমাকে ছোট ভাই এর মত স্নেহ করেন, এরকম এক রাজনৈতিক নেতা আমায় ট্রেনে ফেরার পথে বললেন যে মুর্শিদাবাদের নবগ্রামে সেনা নিবাস করা হয়েছে, কারণ প্রশাসন আন্দাজ করছে যে ভব্যিষতে মুর্শিদাবাদ মালদা রেঞ্জে মুসলিমরা বড়সড় ভারত বিরোধী গোলমাল পাকাবে। তাই এটা আগাম সতর্কতা। আমি হাঁ করে রইলাম। কারণ আমার জানা ছিল যে, এই সেনা নিবাস আদতে কর্ম সংস্থানের সূযোগ তৈরী করবে। বললাম, এর থেকে এখানকার মানুষ যাতে উগ্রপন্থাকে বেছে না নেয় তার চেষ্টা করাটা ভালো নয়? উনি অপ্রস্তুত হলেন। স্বীকার করলেন যে বিষয়টা ভাবেন নি এভাবে। বাস্তবটা হল যে আমরা অধিকাংশই এভাবে ভাবিনা।
যারা মুর্শিদাবাদে এসেছেন বা খোঁজ রাখেন, তারা জানেন যে এখানে দারিদ্র্য খুব প্রকট। মুর্শিদাবাদের অনেক মানুষ রাজ্যের বাইরে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যান – অনেকের কাছে সেটাই রোজগারের সোর্স। এর আরেকটা অর্থ হল যে মুর্শিদাবাদে কাজ নেই। সীমান্তবর্তী এলাকায় চোরাচালান জীবিকা হিসেবেই ধরা হয়। পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নটা অনেকের কাছেই বিলাসিতা। উগ্রবাদীদের কাছে বিকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ কিন্তু এটা। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ কান্ডে যারা ধরা পড়ছেন তারা অধিকাংশই নিম্ন আর্থিক বর্গের মানুষ আর প্রথাগত শিক্ষা পান নি। এদের সামাজিক উন্নয়নের মূল স্রোতে আনতে পারলে হয়ত চরম উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে।
তখন ইস্কুলে পড়ি। এক আত্মীয় আপত্তি জানাচ্ছিলেন স্কুলের ইতিহাস বইতে আকবরের ছবি নিয়ে। ওনার মতে ছবিতে আকবরের দাড়ি নেই। অথচ আকবরের নাকি ফার্স্টক্লাস দাড়ি ছিল। বকলমে যেটা বলছিলেন তা হল হিন্দুরা চক্রান্ত করে আকবরের দাড়ি বাদ দিয়েছে। আকবরের দাড়ি থাকলো কি না থাকলো তাতে কি আসে যায় সেটা তখনও বুঝিনি। পরে বুঝলাম দাড়ি রাখা মুসলমানত্বের ট্রেডমার্ক।
বিদ্বেষ খুব সন্তর্পণে তৈরী হয়। আমার এক হিন্দু বন্ধুর মুখে শুনেছি যে তারা শুনেছেন যে মক্কায় হজ করতে গিয়ে মুসলমানেরা শিবের মূর্তির দিকে পাথর ছোঁড়ে। আমি শুনেছি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থে আল্লাকেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে অথচ কাফেররা তা বাইরে স্বীকার করেনা। এভাবেই প্রচুর অসত্য তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয় ইচ্ছাকৃতভাবে যাতে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ভিত মজবুত হয়।

*

মুসলিম হওয়ার অসুবিধে হল যে, তাকে কখনই ভুলতে দেওয়া হয় না সে মুসলিম। প্রাইমারি স্কুল থেকে কর্মক্ষেত্র ছাড়িয়ে জীবনযাপনের পদে পদে আমাকে কোনো না কোনোভাবে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আমি মুসলিম। বাম রাজনীতি করি। সেখানেও ইসলামিক উগ্রবাদের বিরোধিতা করার কথা বলতে গিয়ে এক সহকর্মী বললেন ‘এই যে রাণা আলম, ইনি কিন্তু সমানে ইসলামিক উগ্রবাদের বিরোধিতা করে থাকেন।’ মানে তার কাছেও আমি মুসলিম। এই কথাটা আমার বাবাও আমাকে বলেছিলেন যে পৃথিবীর যেখানেই যাও, তোমাকে কখনই ভুলতে দেওয়া হবেনা যে তুমি মুসলিম। সংখ্যাগুরুর দেশে সংখ্যালঘুকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলে ধরা হয়। অফিস-কাছারি সব জায়গায় এই বৈষম্যের ভুরি ভুরি নিদর্শন আছে। তাহলে কি গোঁড়া ইসলামিক আবহে মিশে যাওয়াটাই একমাত্র ভবিতব্য? বেশ শান্তিতে সেক্টরাইজড হয়ে বাঁচা যায়। অথচ তাতেও শান্তি কোথায়? কাশ্মীরী মুসলমানদের জন্য চোখের জল ফেলবো আর উচ্ছেদ হওয়া কাশ্মীরী পন্ডিতদের কথা ভুলে যাবো ? মানুষকে ধর্মের নিক্তিতে মেপে বিদ্বেষের গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে রক্তের গন্ধ শুঁকে ঠিক কতদূর যাওয়া যায়? ঠিক কতদূর?
মাঝেমধ্যে মনে হয় একটা গভীর শূন্যতার মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছি আর নিরন্তর চাপে ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
মুসলমানত্বটা ঠিক তাহলে কোথায় দাঁড়াচ্ছে? খানিক আইডেনটিটি ক্রাইসিস আর ধর্মীয় আবহের কড়চা নাকি পারিপার্শ্বিক সিস্টেমের মধ্যে নিজের জায়গা খুঁজে যাওয়ার ক্লিশে গল্প? অথবা কোনোটাই নয়।হয়ত অনেকগুলো কনফ্লিক্টিং আইকনের মধ্যে নিজেকে ডিফাইন করার অক্ষম প্রচেষ্টা কিংবা নিছকই একজন মাইনরিটির প্রাণপণে নিজেকে ‘সেকুলার’ প্রমাণ করার তাগিদ।
নিন ওস্তাদ, গুচ্ছের বাজে বকে ফেললাম।এবার এই মেলোড্রামাটিক মনোলগটাকে কোন ডাস্টবিনে ফেলবেন সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার।
চললুম। জয় হিন্দ।

27 thoughts on “মুসলমানের কিসসা

  1. Thank you very much for sharing your thought, I was in Berhampore for four years, and I had a very good and bad experience regarding HINDU MUSLIM, I was in a mess, and the owner and major students was muslim, and the Owner was very caring, one day From a tea shop one Man called me and told that dont walk in outside with Three quater pant, I asked why, He replied its Muslim locality I cant wear this type of pant, you may use LUNGI or Full pant, I had one very close Friend who was Muslim and we never felt He is muslim and I am Hindu, we had food in single plate, we shared same food…. We celebrated EID together and He celebrated Durgapuja even Mahalaya together…BUT yes its only politics and some blind god-owner who are doing all non sense….
    Again Thank you very Much for such article….

    1. Until culturally our beautiful world will not start to practice “Respect to all” in true sense, no matter you Hindu / Muslim / Sikh / Christian……you are under white terror from all corner ! The politicians / Moula / Priest / political parties / Madrasa / Missionaries / Tols would not be your savior……your inner eye is your navigator….need judge everything in term of Humanity….Problem is Over….We are on the same boat ! it’s that much eassy…..But shale o hizre political parties / Moula / Priest will not allow you to practice that for their own benefit……..As BJP others TMC / Left / Cong. all just using minorities as usual…..kik out them who are trashing hate every where ! Huanity first & Humanity Last !

  2. Really nice article. Your Idea and expression is realistic.
    This kind of articles are very much helpful to establish the peachful environment.

  3. শুনতে খারাপ লাগলেও এটা অস্বীকার করা যায় না যে আমরা এখনও এসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে একে অপরকে নিজেদের নেমেসিস ভেবে পরস্পরের জন্য বিদ্বেষ পালন করি। আপনার উদ্দেশ্য যদিও সফল হওয়ার নয়, As buddha has failed, so is Gandhi, then who is mere Rana Alam?
    কিন্তু আশায় বাঁচে চাষা। দেখা যাক মন বদলায় কিনা।
    আমি আশাবাদী। একদিন বদলাবে এ সমাজ।

  4. Rana, erpor tomar naam e RSS r Jamat – dujonei supari debe… jodi bhul kore tar sathe paan diye fele tahole amake dio….
    Osadharon likhecho… sabash…

  5. রাণা আলমকে অনেক শুভেচ্ছা এতগুলো কথা সাহস করে বলে ফেলার জন্যে। ভালো থাকুন, আরও লিখুন।

  6. অসাধারণ!
    রাণা আলম আপনার কথাগুল যখন পড়ছিলাম তখন একটু সময়ের জন্য নিজেকে কোনো অন্য দেশের নাগরিক মনে হয়েছে। যাহউক খুব ভালই লিখেছ, বভিশ্যতে আর লেখা পাওয়ার আশা রইল। ভাল থেকো।

  7. Satti kotha je eto akopote bole fela jay….. jantam na…. asole seta bolte nijeke chena khub joruri.. Rana …kudos man… darun likhechoooo.. just Spellbound… vabchi… vabchi….

  8. জাত-পাত’এর Identity মুছে দেওয়া-টা কি খুব জরুরি রানা বাবু? পাশের বাড়ি নিয়ে কুটকাচালি তো থাকবেই। বিচ্ছিন্নতাবাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা না হলে, কিছু নির্দোষ pnpc-তে অসুবিধে কোথায়?
    (পুনশ্চঃ নিম্নবর্ণ ইত্যাদি কারনে নয়; বেশিরভাগ হিন্দুই মুসলমান হয়েছে কর-এর অত্যাচার এড়াতে। )

  9. ভালো লাগলো রাণা। স্মৃতিলেখা, জিজিয়া করই যদি কারণ হবে, নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই হিস্টরিকালি কনভার্ট হল কেন?

  10. আপনার লেখা অত্যন্ত মনোগ্রাহী এবং সঠিক। কিন্তু যতদিন পৃথিবীতে “ধর্ম” নামে এই মিথ্যাচার বেঁচে থাকবে, যতদিন পৃথিবীতে প্রতিযোগিতাভিত্তিক সমাজ থাকবে, যতদিন না মানুষ পরষ্পরকে বড় বলে প্রমাণ করার প্রবণতা ত্যাগ করবে, সোজা কথায়, যতদিন না পৃথিবীতে সাম্যবাদ স্থাপিত হবে, ততদিন আপনার মতন ভালোমানুষেরা আক্ষেপ করেই যাবেন আর যারা বদমায়েশি করে মানুষে মানুষে বিভেদ জীইয়ে রেখে নিজেদের আখের গোছায়, তারা তা করেই চলবে। আমার অনুরোধ যদি শোনেন, কোনও ধর্মের দেবতাকেই প্রণাম করবেন না, কারণ দেবতা কেবল মনগড়াই নয়, তাকে গড়া হয়েছে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে।

  11. আগের লেখাটাতে একটা লাইন ভুল লিখেছি, কথাটা হবে, “যতদিন না মানুষ পরষ্পরকে ছোট করার প্রবণতাকে ত্যাগ করবে”

  12. RanaDa, Ami Mir’er birat boro fan.. Mir’er puro naam Mir Asraf Ali. Kintu songoto karone on Mir naam’tai byabohar kore. Kintu prokashye esob niye keo mukh khultei chai na. Hindu-Muslim discourse/kotha uthlei joto somosya.. kintu Hindu-Muslim danga-maramari korar ba seta niye nirlojjo rajneeti kora’ta kothao jeno swobhabsiddho bharatiya sangskriti. Tomar moto anek RanaDa’der dekhar ba shonar protikkhai. HOK KOLOROB..!!!

  13. Rana. Amaro apnar lekha bhalo legechhe. Khub powerful lekha. Apni katota mushalman bole nijeke identify koren janina, aar Islam-e atheism ba nirishwarbaader jayga nei eta jenei bolchhi Irshad Manji bole ekjon Iranian-Canadian bhadromohila achhen jini anek bhabe (bishesh kore lingobaishamyer dik theke) dekhte gele prothom Islam-ke bhetor theke reform karar cheshta korechhen (aboshyo Iran-e theke noy). Tini nijeke bolen Muslim refusenik. Jai hok, eta jaruri noy je apni completely Muslim hishebe nijeke bhabun ba ekta syncretic monobhab poshon korun dharmer proti, jeta jaruri ta holo dharma ebong mushalman dharma shamporke shatthik proshno tule dhara ebong ja thik bhaben shei anujayi jibonjapon kara, ebong shey jaygaye apni pathopradorshoker bhumika palon korechhen. Tai apnar lekha pore mugdho hoyechhe.

  14. এত সহজ করে কোন গভীর সমস্যাকে বর্ণনা করা যায় জানতাম না……অসাধারন..মানুষপন্থী হয়ে লিখতে থাকুন…। শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রইল…।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.