দেবাশিস আইচ

বর্তমানে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে কলকাতার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রধানত জেলা ও গ্রামীণ সংবাদ প্রচার ও সম্প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছেন। মানবাধিকার, পরিবেশ, বন্যপ্রাণ, প্রান্তিক মানুষের কথা লেখালেখির প্রিয় বিষয়।  দ্য স্টেটসম্যান অ্যাওয়ার্ড ফর রুরাল রিপোর্টিং, ২০১২ পুরস্কার পেয়েছেন।  সাম্প্রতিক প্রকাশিত বই ‘মায়াবন্দরের রূপকথা’। প্রথম বই, ভাগলপুর দাঙ্গার প্রেক্ষিতে গল্পগ্রন্থ ‘দহননামা।’ কবিতার বই, ‘আমাকে জাগিয়ে রাখো’ ও ‘রাত্রিকাল রাত্রিকথা।’ ১৯৮৯-১৯৯৭ মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ (পিইউসিএল)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

.

গাছ চিনছিলাম সন্তের কাছে। শাল, জারুল, চিলৌনি, চাপ, চিপরাশি, সেগুন…। এ জঙ্গল প্রকৃতির খেয়ালে তৈরি নয়। মানুষের অঙ্কে তৈরি। কোথাও জারুল-শালের সারি সারি বন, কোথাও বা চিলৌনি, গামার। সারি সারি সৈন্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছের বনটা বন দফতরের প্ল্যান্টেশন অর্থাৎ বানানো ‘বাগিচা জঙ্গল’। তার নীচের জমিতে ঝরা পাতা বা ইতস্তত ঝোপঝাড়। এ জঙ্গল কাটা হবে একদিন। দফতরের ভাষায় ক্লিয়ার ফেলিং ক্যুপ। পরিষ্কার করে কাটা আর কী। সরকারি ব্যবসা। ষাট-সত্তর-আশি বছরের প্রাচীন শালের প্ল্যান্টেশন কিন্তু প্রাকৃতিক বনের অনেক শর্তই মানে। যেমন, তার ক্যানোপির আধার, মানে চন্দ্রাতপ। লতার বহর। মাটিতে নানা গুল্ম-ঝোপঝাড়। সে বন কাটা মানে ভয়ানক ক্ষতি। তবুও, অর্থের লালসা। সেগুনের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবে না। এ গাছের নীচে ঘাসও জন্মায় না বলা যায়। তার জলের চাহিদা মাটিকে রুক্ষ করে দেয়।

কোথাও ইতিউতি বড় প্রাচীন গাছ। আর চারপাশে ছোটখাটো কিছু গাছ। যার অধিকাংশ লতা-পাতায় ঢাকা। নীচের জমিও ঝোপঝাড়, লতাগুল্মে ভর্তি। ছোটগাছগুলো লতাগুল্মের চাপে দমবন্ধ হয়ে মরতে বসেছে। ভাবলাম এক টুকরো প্রাকৃতিক বনের দেখা পাওয়া গেল। উঁহু, জানা গেল এককালে এখানে গাছ-কাটাই বা ‘ফেলিং’ হয়েছে। তার পর ফের বসানো হয়েছে চারা গাছ। সে যদিও নানা জাতীয়। বলির পাঁঠার মতো তারা বাড়ছিল। কিন্তু, বন দফতর গাছ কাটতে যত তৎপর, চারাগাছের যত্ন নিতে ততটা নয়। লতাগুল্মের স্বাভাবিক জীবনের গতি তাদের চারপাশ থেকে ঢেকে ফেলেছে। মনে হবে তা বেশ। ভাম, শেয়াল, খরগোশ, বনরুইদের একটা আবাস হল। ধুর! এ বন তো সাফা হওয়ার জন্য। তা হলে, লতার চাপে চারাগাছদের চিঁড়েচ্যাপটা হতে দেওয়া কেন? প্রশ্ন উঠলে বলা হবে কাজের লোক বাড়ন্ত। যত্ন নিতেই বাড়ন্ত, কাটতে হলে তো মেলা বসে যায়। এই যে কেটে ফেলা গাছের শিকড় উপড়ে নাও, মাটির যত্ন নাও, তার পর চারা পোঁতা। যতদিন না লায়েক হচ্ছে ততদিন তাদের চারপাশে লতাগুল্ম সাফ রাখা। সেটাই করা হয় না যে। এমনটাই বলছিলেন, কুরমাই গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য। কীভাবে গাছ কেটে ফেলা হয়। চারা লাগায় যত্ন নেয় না। দেখলে কান্না পেয়ে যায়…। জঙ্গল যাদের কাছে মা-বাপ তাদের কান্না তো পাবেই।


গ্রাম থেকে বনে ঢোকার কাঁচা রাস্তা কিছুদূর গিয়ে চারমাথা হয়েছে। চিলাপাতার সেই জঙ্গলে, গ্রামকে পিছনে রেখে, ডানহাতের রাস্তা সোজা চলে যাবে নলরাজার গড়ের দিকে। সোজা পথটায় যেতে মানা। শাল গাছের খুঁটি দিয়ে গেট করা আছে। তবুও, বনগেটের ক্রসিং না-বলে পেরোলাম। তার কারণ, সঙ্গে রয়েছে কুরমাই বনবস্তির সদস্যরা। ওঁরা ঠিক করেছেন, ও পথে ঢুকেই বাঁ-হাতে যে প্রাকৃতিক জলাশয়টি রয়েছে, পঞ্চায়েতকে দিয়ে ১০০দিনের কাজের মাধ্যমে তার সংস্কার করা হবে। তার আগে ইনস্পেকশন আরকি। প্রাকৃতিক সব শর্ত মেনে সে এক গহন বন। সূর্য যদি মাথার উপর না ওঠে তবে মাটিতে তার আলোর রেখাটিও পড়বে না। এমনই ক্যানোপি। পদে পদে পা জড়ানো গুল্মের ঝোপ, বিচিত্র লতা বেয়ে বেয়ে চলেছে বিচিত্র দিকে। কুস্তিগীরের হাতকে লজ্জা দেবে এমন তাঁদের গড়ন। গা ছমছমে পুকুর পাড়ের নরম মাটিতে হাতির হড়কে নামা পায়ের ছাপ। হাতি জল খায়-স্নান করে, চিতল, বার্কিং ডিয়ার, চিতা, গাউর জল খাবে। সারা বছর যাতে জল থাকে তার জন্য সংস্কার করা তো জরুরি। সে কাজটাই করতে চান বনবাসী মানুষেরা। ২০০৬-এর বন অধিকার আইন (যা চালু হয় ২০০৮-২র ১লা জানুয়ারি) তাঁদের সাহস যুগিয়েছে। বনের উপর ওদের অধিকারটাও যে প্রাকৃতিক সে কথা আইনই এখন বলছে। গ্রামসভা তৈরি করেছেন তারা। সঙ্গে নিয়েছেন পঞ্চায়েতকেও। ফরেস্টের কর্তাদের জানিয়ে দিয়েছেন, বনের দেখভাল, বন্যপ্রাণের দেখভাল আমরাও আমাদের মতো করব। এই তো মাস কয়েক আগে গ্রামসভার টহলদারী বাহিনী ধরে ফেলল চোরা গণ্ডার শিকারি আর তাদের স্থানীয় মদতকারীকে। তুলে দিল পুলিশের হাতে। গত আটমাসেই জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে সরকারি ভাবে পাঁচটি, বেসরকারি মতে আটটি গণ্ডার মেরেছে চোরা শিকারিরা। তার প্রতিবাদে বনদপ্তরের রেঞ্জ অফিসও ঘেরাও করেছেন বনবাসীরা।

চিলাপাতায় ফিরি। বাঁ-হাতের রাস্তাটা প্রথমে সোজা তার পর ডানে মোড় নিয়ে সোজা উঠবে শিলতোরসার বাঁধের উপরে। এ অঞ্চলে জঙ্গলও মোটের ওপর প্রাকৃতিক। বনদপ্তরের হিসাবমতে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের ‘কোর এরিয়া’, মানে বনের মধ্যমণি। বাঁ-হাতে নীচে জঙ্গল, ডান হাতে অগাধ তোরসা। ওপাড়ে আবার জলদাপাড়া।  প্রতি পদে ভয়। হাতি যদি বাঁধের উল্টো দিক ধরে আসে! গাছের ঠাসবুনোট চাঁদোয়া ভেদ করে এখানকারও অনেক জায়গায় আলো-তাপ পৌঁছয় না। সে সব জায়গা প্রখর গরমেও ভিজে ভিজে। মহীরুহযুথের কান্ডে শাখায় প্রাচীন শ্যাওলা,অর্কিডের সাজ। এ জঙ্গল শ্বাপদের হরিণের। গাউর-সরীসৃপ-অযুত কীটপতঙ্গের খাস দরবার। গাছের ডালে ডালে লাফ-ঝাঁপ, ডালভাঙা, পাতা ছেঁড়ার বাঁদরামি।  বনদপ্তরের কুনকি হাতি কিংবা জিপ ছাড়া সাধারণের এ পথে চলা মানা। তবুও যে সাফারি করে এ পথে এলাম, তার কারণ সঙ্গের রাভা সাথীরা। কাজের পাশাপাশি একটা বনশিক্ষাও হল সুন্দর-সন্তেদের কাছে। আর এ পথেই দেখা পেলাম বাইশ গাছের। গ্রামের প্রাক্তন মোড়ল তাঁর আমলের বনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছিলেন, বাইশ হয় জলায় আর শাল হয় ডাঙায়। পথে জলার মধ্যে নাতিদীর্ঘ কয়েকটি গাছ দেখা গেল। তাদের গোড়ালির উপর পর্যন্ত জলে ডোবা। এমনই থাকে সারা বছর। বর্ষায় সে জল নিশ্চয়ই গাছের হাঁটু ছুঁয়ে থাকে।

ডানহাতের পথেও গিয়েছিলাম একদিন। সুন্দরের বাইকে চেপে। সে রাস্তা গিয়েছে নলরাজার গড়ের দিকে। সেখানে নাকি প্রাচীন কিছু গাছ রয়েছে। আর রয়েছে একটা আরণ্যক পরিবেশ। সন্তের ইচ্ছে সে আমাকে এমন একটা গাছ দেখাবে যার গায়ে খোঁচা মারলে রক্ত ঝরে। উপাখ্যান শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে নলরাজা এই গাছেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। নলরাজের আমলের ভাঙা খিলান, পাঁচিলের উল্টোদিকে পাওয়া গেল তাকে। গুঁড়ি দেখেই সন্দেহ হল তথা কথিত ‘প্রকৃতি পর্যটকদের’দের পাল্লায় পড়ে গাছটি নিয়মিত ক্ষতবিক্ষত হয়। এভাবেই ওর মরণদশা ঘনিয়ে আসবে একদিন। সুন্দর অতি উৎসাহী হয়ে বাইকের চাবি দিয়ে খোঁচাতে শুরু করল। বুঝেছি বুঝছি বলে সে যাত্রা ওকে নিরস্ত করলাম। তবে, এ কথা সত্যি, ধারালো কিছু দিয়ে গাছের গা আঁচড়ালে লাল আঠালো রস বেরিয়ে আসে। চিলাপাতা অরণ্যে নাকি এমন খান কুড়ি গাছ রয়েছে।

প্রাচীন গাছগুলো দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি হল। একবার মনে হল প্রকৃতির লীলাখেলার অঙ্গ এই মহীরুহকুল। আবার পরক্ষণেই মনে হল সন্তে-সুন্দরদের বাপ-পিতামোদের হাতেই হয়তো বা পোঁতা হয়েছিল চারা, রোপিত হয়েছিল বীজ। সে সম্ভাবনা তো রয়েইছে। পিছনের দিকে হেঁটে যাই। এ জঙ্গল বেঙ্গল টাইগারের ঘাঁটি। আদিবাসীদের বাসভূমি। কোচবিহারের রাজাদের মৃগয়া ক্ষেত্র। ইংরেজ এল, দশ হাতে লুঠল বন, বনজ সম্পদ। রাজারা ইংরেজ বাবু-বিবিদের সঙ্গে মিলে গণহারে খুন করতে শুরু করল বাঘ-হরিণ-চিতা। সে শিকার উৎসবের কাল। প্রকৃতই চরম কাপুরষতা। হঠকারী লুণ্ঠন। একদিন তাদের সংবিৎ ফিরল। বুঝে নিল এভাবে নয়। ইংরেজ তখন রাজা। লুঠটা সিস্টেমেটিক্যালি করতে হবে। আইনের মোড়ক পরিয়ে। বাণিজ্যিকীকরণ করতে হবে। বনরক্ষা আইন হল। বন-বনজ-সম্পদ করায়ত্ত হল শ্বেত প্রভুদের। বনের মানুষেরা, আদিবাসীরা, বনের উপর নির্ভরশীল মানুষরা সমস্ত স্বাভাবিক অধিকার হারালেন। স্বাধীন আদিবাসীরা স্বাধীনতা হারিয়ে পরিণত হলেন দপ্তরের বেগার খাটা বনশ্রমিকে। যেমন রাভারা।

বলছিলাম সন্তে-সুন্দরদের পিতা-পিতামহদের কথা। তাঁদের যত্নে বড় হয়ে ওঠা আজকের অনেক মহীরুহ–এর পিছনে রূঢ় বাস্তব রয়েছে। বনে থাকা স্বাধীন মানুষেরা কখনও এ বন, কখনও ও বনে থাকতেন। বন বলতে তখন মূলত বড় ছোট ঘাসের তৃণভূমি,আর নীচু জলা,যেখানে ফি বছর ঢুকে আসত তোর্ষা ও অন্য বন্য নদীর জল। সেই ঘাস পুড়িয়ে ঝুম চাষের জন্য দু’চার বছর অন্তর জমি বদলাতে হত। শিকার চলত। নদী-ঝোরায় প্রচুর মাছ । কোথাও কোথাও গরু-শুয়োর পালন। ইংরেজরা প্রথমেই এঁদের বনে বনে অবাধ, স্বাধীন বিচরণ বন্ধ করে দিল। বশ্যতা মানতে বাধ্য করল। এক একটা গোষ্ঠীকে এক এক জায়গায় বসানো হলো। এগুলোর নাম হল ‘ফরেস্ট ভিলেজ’ বা বনবস্তি। সেখানে তাদের ঘর বাঁধার বন্দোবস্ত হল।। বিনি মজুরীতে বন-কাটাই করো, জঙ্গল পোড়াও, নতুন চারা লাগাও, চারার দেখভাল করো, ঝুর্ণী করো, মানে  আগাছা মারো। আবার বন কাটতে হলেও তাদের কাজে লাগাত। পুরোটাই বেগার খাটনি। ওরা বলেন, বেগা খাটা। ভাবটা এরকম, জমি দিয়েছি চাষ করে খাও। সারি সারি গাছের মাঝে শাক-সবজি ফলাও। ঝরা-মরা কাঠ নিয়ে যাও। জ্বালানি কর। খুঁটি কাঠ, পাটা নিতে পার ঘর বানাতে। ব্যস। পয়সা দিয়ে কী হবে?

সাহেবরা, বনের বাবুরা গাছ চিনত না। চাপ–চিলৌনি-চিকরাসি-অর্জুন-গামার-বাইশ-শিমূল কত শত গাছের চারা আদিবাসীরা গভীর জঙ্গল থেকে এনে পুঁততেন। জঙ্গলের ভাষায় বিছনবাড়ি। ওঁরা জানতেন কখন-কোথায়-কোন গাছের বীজ পাওয়া যাবে। তার জন্য গহন জঙ্গলে যেতে হত। সন্তের প্রয়াত পিতা মিলো রাভাও একজন বেগা শ্রমিক ছিলেন। তাঁর বাবাও। চিলাপাতা বনাঞ্চলের কুরমাই গ্রামে ওদের বাড়ি। জেলা জলপাইগুড়ি, আপাতত ফরেস্ট ডিভিশন কোচবিহার। মিলোর আমলের কথা একট বলা যাক। চার ছেলে, চার মেয়ে মিলোর। বাপের আমলের জমি বিঘা পনেরো। সংসারে মুখ বেড়েছে কিন্তু জমি বাড়েনি। একফসলি সে জমিতে সে আমলে দেশি হিমতি ধানের চাষ হত। এখনও হয় অনেক জমিতে। বিঘা প্রতি বড় জোর ধান হত তিন মণ। ধান বিক্রির গল্প ছিল না। পুরোটাই পেটে যেত। তবুও সারা বছরের খোরাক হত না। বেগা খাটা ছাড়া মিলো কাঠের লাঙল তৈরি করতে জানতেন। তিনটে লাঙল এক সপ্তাহে তৈরি হলে সাপ্তাহিক হাটে বিক্রি হত ৩০টাকায়। এছাড়া জ্বালানি কাঠ বিক্রি করে মিলত আরও কিছু। সপ্তাহের বাকি দিন ভোর থেকে বিছন লাগানো, বীজ-চারা খোঁজা, আগাছা সাফ করার নানান কাজ। দিনের খাবার সংগ্রহ করতে হত সেখান থেকেই। প্রধান খাবার কন্দ। তার অনেক রকমফের রয়েছে। এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাটি কুঁড়ে আলু পাওয়া যেত। কাঠ-কুটো জ্বালিয়ে আলু পুড়িয়ে পেট ভরানো। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে মিলত এক জাতীয় গোল আলু। স্থানীয় ভাষায় জিতু আলু। ভয়ংকর তিতকুটে। বাকল ছুলে প্রথমে গরম জলে সিদ্ধ করা হত। এর পর বাঁশের খাঁচায় করে ডুবিয়ে রেখে আসা হত ছোট ছোট ঝোরার জলে। সারারাত মিষ্টি জলের স্রোতে ভিজলে তবে তা খাবার উপযোগী হত। রাতের অন্ধকারে তাও চুরি হওয়ার ভয়ও থাকত। দারিদ্র ছিল এমনই।

ছাতু বা মাশরুম পাওয়া যেত বর্ষার সময়। খুব গভীর জঙ্গলে অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে জমিতেও পাওয়া যেত আরও বেশি দিন। এক এক মরা পচা গাছের ডাল, কাণ্ডে এক এক জাতের ছাতু। মরা শাল গাছের ছাতু একরকম, ঘাস জমিতে আরেক জাতের। ঘন ক্যানোপিতে ঢাকা জঙ্গলে জ্যান্ত গাছের গুঁড়ির নীচে জন্মানো ছাতুর আবার ভিন্ন জাত। কত না তাদের নাম। বেতের কচি ডগা, বাঁশের ডগা কত না খাবার মিলত জঙ্গলে। আজ কোথায় বেত? জঙ্গলের মধ্যে ১২-১৪ কিলোমিটার চষে ফেললাম। বেতের জঙ্গল কই চোখে তো পড়ল না! কত রকমের ঘাস হত। কোথায় সেই ঘাস জঙ্গল চিলাপাতায়? তোরসার চরে যে শুধু কাশিয়াই চোখে পড়ে। ঢাড্ডা নেই, মালটা নেই, পুন্ডী নেই।  হাতির খাবার কোথায়? ঘাস, বাঁশ (বাঁশও একজাতীয় ঘাস বটে), বেত।  হাতি তবে তো লোকালয়ে আসবেই। ধান খাবে, কলাগাছ খাবে, ভুট্টা খেত সাবাড় করবে। গ্রামে আসে বটে কিন্তু বাড়ি-ঘর নষ্ট করে না।

মিলোর ছোট ছেলে সন্তে। সন্তে রাভা। ওর কথা আলাদা করেই বলব। সে এক আশ্চর্য উত্তরণের কাহিনি। সন্তের ছোটবেলা কেটেছে গরু চরিয়ে। স্কুলের চৌকাঠ দেখেনি। আজ অবশ্য সন্তের পাড়ার এমন শিশু নেই যে স্কুলে যায় না। সন্তে ১৬ বছর বয়স অবধি গরু চরিয়ে কাটিয়ে দিল। একদিন মনে হল রোজগার করতে হবে। সামান্য তো চাষবাস। রোজগার হবে কোথা থেকে। তখন আশির দশকের প্রথম দিক। কিশোর সন্তে তখনই জেনে গিয়েছে জঙ্গল কাটলে রোজগার হয়। ওদের গ্রামের আশপাশের জঙ্গল ফাঁকা হচ্ছে। বড় বড় শিরিষ গাছ রাতারাতি হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। বনদফতরের কর্মীদেরও রকমসকম বদলে গিয়েছে। মেয়েরা জঙ্গলে লাঠি-খড়ি আনতে গেলেও বাধা পাচ্ছে। বাড়িতে পাতা দই, বাড়ির ধানের চিড়া ভেট দিতে হত। ক্রমে শুরু হল হাত পেতে পয়সা চাওয়া। তার পর একেবারে রাস্তার মোড়ে গামছা পেতে তোলা তোলা শুরু হল। দুই-তিন-পাঁচ যার কাছ থেকে যা পাওয়া যায়। বনবাসী ও বনকর্মীদের দ্বন্দ্ব তার আগেই তীব্র রূপ নিয়েছে। এবার গাছ সাফাইয়ের দলে নাম লেখাল সন্তে রাভা। আর কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ে উঠল জঙ্গলের ত্রাস। গাছ কেটে আইন বাঁচাতে একহাত পরিমাণ খড়ি কাঠ বান্ডিল বেঁধে নিয়ে আসত। তার পর পাঁচ-সাত ফুটের লগ সাইকেলে বেঁধে নিয়ে আসা শুরু। বন কাটো আর বেচো – এই হল পেশা। ২২-২৩ বছরে এই পেশার জোরেই বিয়ে। আর এই পেশা থেকে সন্তে রাভাকে সরাতে ‘শ্যুট অ্যাট সাইট’ অর্ডার দিল বনদফতর। গ্রামে এসে রেঞ্জার হমকি দিয়ে গেল, ‘বনে দেখতে পেলে বউ বিধবা হবে।’ সন্তে দমবার পাত্র নয়। সেও পালটা চ্যালেঞ্জ ছোড়ে। চার চারবার বন দফতরের ছড়রা গুলি তার শরীরে বিঁধেছে। সন্তে দমেনি।

২০০১ সাল সন্তের জীবনে পরিবর্তন নিয়ে এল। ছড়রা যা পারেনি তা পারল এলাকার বনবাসীদের আন্দোলন। আর লায়লা রাভা। সন্তের স্ত্রী। এই গুলিগোলা, গাছকাটা, পালিয়ে বেড়ানো তার পছন্দ ছিল না। সে বার বার বলত, ব্যবসা কর, অন্যকিছু কর এ কাজ ছেড়ে দাও। পেটের খিদের জ্বালায় জঙ্গল কাটছ বটে, একদিন তোমার ছেলেমেয়েরা খিদে-তেষ্টায় মরে গেলেও কাঁদার কেউ থাকবে না। জঙ্গল শেষ হয়ে গেলে মরুভূমি হয়ে যাবে চিলাপাতা। কী বুঝতো সন্তে সেই জানে। তবে আন্দোলনটাকে,আন্দোলনের লোকগুলোকে ভাল লেগে গেল। তাদের সঙ্গে জল-জঙ্গলের দাবিতে মিছিলে যায়। বড় মিটিঙে শিলিগুড়ি যায়। আজ সন্তে ওর মতো করে বলতে পারে, ‘জঙ্গল কাটলে নেক্সট জেনারেশনের কী হবে? গাছও তো একটা প্রাণী। আমাদের মতো শ্বাস নেয়। গাছের সঙ্গে আমাদের অক্সিজেন কানেকশন। গাছ না থাকলে তো জলও থাকবে না।’

এভাবে সন্তে রাভা একদিন সংগঠনের স্থানীয় সভাপতিও হয়ে গেল। আর আজ ওদের বন গ্রামসভা আন্দু বনাঞ্চলে ১১ হেক্টর পতিত বনের জমিতে চিলৌনি, জারুল, হরতকি, কাঞ্জাল, কাল্লা সহ নানা গাছের জঙ্গল তৈরি করছে। ওর আক্ষেপ, হেক্টরের পর হেক্টর টিক লাগিয়ে স্বাভাবিক বনভূমি ধ্বংস করে দিয়েছে সরকার, ‘সেখানে লতাপাতা উঠতে পারে না। সব জল শুষে নেয়। বনের পশুগুলো খেতে পায় না। কত ধরনের ঘাস ছিল। বেল-আমলকি ছিল। খাওয়ার কোনও অভাব ছিল না।’ শুধু আমরা বাঁচলে হবে। হাতি-গণ্ডার না বাঁচলে বন বাঁচবে? প্রশ্নও তোলে আমূল বদলে যাওয়া সন্তে। ওর দাবি, তোরসার পাড়ে কিছু প্রাকৃতিক জঙ্গল রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ মেন্দাবাড়িতে রয়েছে কিছুটা। সব মিলিয়ে ওর হিসাব মতো ২০০-২৫০ হেক্টর। এই বন ওরা আর কাটতে দেবে না। বন যেখানে যেমন রয়েছে সেখানে তেমনই থাকবে। এমনই ঠিক করেছে আন্দু, বানিয়া, কুরমাইয়ের বন গ্রামসভা। আন্দোলনটা ছড়াচ্ছে বনে বনে। তাঁর আঁচ পাওয়া যায়। কলকাতা এ খবর তেমন করে রাখে না। শহর বনে মোচ্ছবে যায়। আদিবাসী জমি বেআইনি উপায়ে কিনে মস্তির রিসর্ট হয়েছে অগুন্তি। নদীর প্লাবনভূমিতে রিসর্ট তুলেছে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কলকাতার বাবুরা। নিকাশির জল, বর্জ্য নদী ভরাচ্ছে, বনের গায়ের উপর একের পর এক অট্টালিকাসম রিসর্ট তৈরি হয়েছে লাটাগুড়িতে। যা আসলে বুনোদের যাতায়তের পথ। যেখান দিয়ে সাধারণের হাঁটার হুকুম নেই তা হচ্ছে রিসর্টে যাওয়ার প্রধান রাস্তা। বন বাঁচবে কীভাবে, বুনোরাই বা কীভাবে বাঁচবে? সে পথই কী দেখাচ্ছে সুন্দর-সন্তেরা? এই তো সেদিন জলদাপাড়া বনবিভাগের উত্তর খয়েরবাড়িতে তো আর একদল বনবাসী রাভা সম্প্রদায়ের মানুষ একজোট হয়ে রুখে দিল বিশাল এক শালবনের ক্লিয়ার ক্যুপ ফেলিং। বনদফতর-পুলিশের শত চোখ রাঙানিতেও অবিচল ছিল তারা। এ যাত্রায় চিলাপাতা, মেন্দাবাড়ি, খয়েরবাড়ি ঘুরে ঘুরে কোথাও মনটা যেন আবার আশাবাদী হয়ে উঠল।

Photography: Pramod Gupta

3 thoughts on “সন্তে-সুন্দরের সঙ্গে চিলাপাতায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.