সিদ্ধার্থ বসু

“সত্যি কথা বলতে পারা–একটা আস্ত জীবন জুড়ে–কী যে দুরূহ ব্যাপার একটা। আমি নিজেকে উপস্থাপিত করতে চাই মানুষের কাছে,আগাগোড়াই এমন একটা মানুষ হিসেবে যার গ্রহণযোগ্যতা বেশ উঁচু মাত্রার। আর সেইখানেই বেঁধে যায় যত গন্ডগোল : কে গ্রহণ করবে আমায়? কারা? কেনই বা করবে আদৌ? ফলে উপস্থাপিত হওয়ার অপার উচ্চাশায় আমি হয়ে উঠি দ্বিচারী; আর দুর্ভাগ্যক্রমে এই তফাত দিনে দিনে বাড়তে থাকে। অতঃপর….” – সিদ্ধার্থ

পাড় ভাঙ্গার গদ্য

আগেও অনেক জায়গায় লিখেছি যে, ‘মিথ্যে’ মানুষ-চরিত্রের সবচেয়ে নিশ্চিতকারক বৈশিষ্ট্য। বহুবার বহুভাবে বহু অনুষঙ্গে অতিব্যবহার করতে করতে বুঝেছি যে এইটুকুই আমার জীবনের চর্যা ও চর্চার একমাত্র অর্জন— এই বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তমত — প্রায় যেন অভিজ্ঞানেরই প্রত্যয়ে।

মানুষ মিথ্যে ছাড়া একদিনও বাঁচে না| সত্যি কথা বলতে কি, একটা পূর্ণ মুহূর্তও তার কাটে না মিথ্যে ভাবনার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে, প্রতিনিয়ত একটা মিথ্যে অস্তিত্ব বুনে চলা ছাড়া তার গতি নেই কোনো। আমি সারাদিন বাস্তবত যা যা করে উঠি, আমার ইচ্ছে হয় বলেই করি তো সেসব—অন্ততপক্ষে খুব বেশি কিছু অনিচ্ছার কাজ নয় এমনটা তো বলাই চলে। এই ক্রমসম্পন্ন কাজগুলোর মধ্যে প্রকাশ পায় আমার স্বার্থচিন্তা— কখনো সরাসরি বা কখনো একটু ঘুরপথে, পরোক্ষভাবে। এখন আমার স্বার্থসিদ্ধিপ্রয়াসী কাজকর্মের পরম্পরা কখনই সমান পুষ্টিকর হতে পারে না আর সকলের পক্ষে, বা কখনো আর কয়েকজন, কি একজনের পক্ষে। মজাটা হলো, আমি নিজে কিন্তু আমার এই কর্ম ও তার ফলশ্রুতি সংক্রান্ত সমাজব্যাপারে যারপরনাই সচেতন। অথচ আমায় টিকে থাকতে হচ্ছে এই সমাজেই। ফলত নিজের ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করার দায় আমার অস্তিত্বের সংকটের সাথেই সংস্পৃষ্ট। প্রথমত আমাকে গড়ে তুলতে হয় আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তিপরম্পরা : মিথ্যে ভাবা। তারপর সেই যুক্তিসিদ্ধভাবে নিজেকে হাজির করতে হয় আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনের মাঝখানে (কিছু অনাত্মীয় শত্রুভাবাপন্ন মুখও সেখানে থাকা বিচিত্র নয়): মিথ্যে বলা। এবং সবশেষে সবচয়ে উল্লেখযোগ্য যে কাজ, সেটা হলো নিজের ন্যায্যতাকে নিজেই গ্রহণ করা, বিশ্বাসে পরিণত করা এই বিবৃতিকে যে— আমি স্বার্থতাড়িত নই, স্বার্থান্ধ তো কোনমতেই নই: অর্থাৎ ফের মিথ্যে ভাবা। এইভাবে একেকটা চক্কর সম্পূর্ণ হয় আর আমার নিজের কাছেই রচিত হয়ে ওঠে এক নতুন আমি, আগের আমিগুলোর কোনটার চেয়েই যে একচুল কম প্রামাণ্য নয়।

অনেক সময় এমনটা মনে হতে পারে যে, খুব কূটচিন্তা, ফন্দি-ফিকিরে ফেঁসে থাকা অনাবেগী বা দুর্জন মানুষের পক্ষেই শুধু এমনতর সুবিধেবাদ সম্ভব। কিন্তু বাস্তবিক বিষয়টা তেমন নয় আদপেই। আমি যখন অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত এক দ্বিচারিতা নিয়ে কাটাচ্ছি তোমার সঙ্গে, প্রতি মুহূর্তে ছক কষছি কোন বিষটা অকপটে গিলে নেব আর কোন তামাশায় জ্বলে উঠব মিহি করে, সেরকমই অন্য এক মুহূর্তে তুমি কান্নায় ভেঙ্গে দিচ্ছ নিজেকে আমার কাছে: স্বতঃস্ফূর্ত? তাই সত্যির পবিত্র রসে স্নাত, স্নিগ্ধ? না। তা বোধহয় নয়। তুমি নিজের নিয়ন্ত্রণের রাশটাকে তখনি আলগা দিয়েছ যখন তোমার অন্যপথে আর সুবিধে নেই বলে মনে হয়েছে। বা অন্যকথায়, এই আপাত-নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থাটাকেই তুমি এই মুহুর্তে বেশি সুবিধাজনক বলে মনে করছ। তুমি অত যুক্তি-পরিকল্পনায় বাঁধতে চাও না মানবসম্পর্ককে? বিলক্ষণ! তুমি আসলে হিসেবপত্তরে আরো অনেক বেশি চোস্ত, আবেগ আর বিচক্ষণতা তোমার মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহাবস্থান চালায়, মানসাংকের জটিলতায়ও তোমার ক্যালকুলেটার লাগে না। আমরা দুজনেই কোনো কোনো বিরল মুহূর্তে ধরে ফেলি যে যার মিথ্যে চেহারাগুলো, আর ঈষৎ কেঁপে উঠে তৎক্ষণাত শুরু করে দিই ‘রঙে-রসে জাল’ বোনা।

আসলে আমি লোকটা তো প্রবৃত্তিতাড়িত। তুমিও। ফলে কাজে যা করি তার ভবিষ্যৎ হিতাহিত বিবেচনা আমাদের ধাতে নেই। চিন্তা থাকে যেটুকু, সে-ও আসলে আরেক প্রবৃত্তির তল্লাটে: আত্মরক্ষা: নিজের পরিণতি কী হবে, জনমানসে আমার কোন প্রতিকৃতি ফুটবে, আমার স্বচ্ছন্দ বেঁচে থাকার পথই বা কতটা কাঁটা-বিছানো হয়ে উঠবে আমার এই কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়ায়— সে সবকিছু নিয়েই আমি অত্যন্ত গভীরভাবে ভাবিত। আর তারই ফলশ্রুতি এই ‘রচি মম ফাল্গুনী’। অন্য কেউ কতটা আহত বা তাপিত হলো আমার ক্রিয়াকর্মে, বড় কোনো ক্ষতিই হয়ে গেল কিনা কারো— সেসব আমার বিবেচনায় তখনই আসে যখন সেসবের কোনো একটাও আমার জীবনযাপনকে একতিল অসুবিধাজনক করে তোলে, আমার সামাজিক বাঁচাটা একটু সংকটে পড়ে যায়, অন্যথা নয়।

ভণ্ডামি ছাড়া মানবসভ্যতার কোনো অস্তিত্ব সম্ভব নয়। এ একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার। হালের নয়, বহু প্রাচীন উদ্ভাবন। মানুষের মানবিকতার প্রমাণ সেইখানেই আরো প্রখর যে এই ‘সত্যি’, এই একমাত্র দোর্দণ্ড ‘সত্যি’ কে মানুষ তার সভ্যতার যুগ থেকে যুগান্তরে স্থানে-কালে-পাত্রে এক ‘উন্মুক্ত গোপন’ হিসেবেই রেখে দিতে পেরেছে। প্রত্যেকে নিজের মিথ্যে মুহুর্তগুলো সম্বন্ধে খুব সচেতন, কিন্তু এইরকম হাজার মিথ্যের বেসাতি করা ‘আমি’টির সৎ ও নিষ্পাপ অস্তিত্ব বিষয়ে তার মনে লেশমাত্র সংশয়ও কখনো জাগে না।

আত্মজীবনীর আরেক টুকরো

নিজের বিষয়ে কিছু লিখতে বসলেই শুধু অস্থিরতা আর মিথ্যাচার, এ দুটো অমোঘ অভিব্যক্তির কাছে ফিরে ফিরে যেতে হয় আমায়। মনে পড়ে সেই আশ্চর্য অন্তর্দৃষ্টির কথা ‘ALL AUTOBIOGRAPHIES  ARE LIES’; একবার লিখেছিলাম:

আমি নিজের কথা চেপে রেখেছি বলে/হারিয়ে গেছি অবাধ ঘোলা জলে

নেহাত রদ্দি হলেও এ যে একেবারে আমার কথা। নিজের, এক্কেবারে নিজের কথাগুলো আর পাঁচজনের কাছ থেকে চাপতে চাপতে আজ আর ভালো করে মনেও পড়ে না সেইসব। চিনতেই পারি না কোনটা সত্যিকারের আমি, আর কোনটা বা লুকোছাপা করে বানিয়ে তোলা নিজের প্রতিমা।

আরেকটা এর চেয়েও অপাঠ্য কবিতায় লিখেছি:

একটা জবর ধাক্কা দিতে হবে
রমঝম এই স্যায়না সময়টাকে
রপ্ত পায়ে বারান্দা-ঘর চষি
ফাঁক ফোকরে দু-পাঁচ মিনিট বসি
মাথায় আমার অজস্র ভয় থাকে

আমারই কথা, এইসব। সাপের মন্ত্রের মত নানান আইডিয়া ও আইডিয়াল বিড়বিড় করতে করতে কোন এক অতিলৌকিক জগতে, এই আপাদমাথা লৌকিকে নিমজ্জিত আমার— বসবাস।

জ্ঞান বলতে কোনকালে কিছু গড়ে ওঠেনি স্বভাবতই। আমিই উঠতে দিই নি—বলা ভালো। বেশিরভাগ ভালোলাগা বই শেষ করে উঠতে পারিনি। কারণ, যতটুকু পড়া হয়েছে, বড্ড ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছি সেটুকু পাঠেরই মুগ্ধতায়।

শুধু শোনা-কথা, দেখা-দৃশ্য পৃথিবীর, ছুঁয়ে-আসা বন্ধু ও প্রেমিকার শরীর— আমার মধ্যে খুব সাধারণ সব গল্প তৈরী করেছে। যে গল্পের কোনো মৌলিকত্ব নেই, এমনি সে সাধারণ। কিন্তু আমি মনে করেছি যে ‘তবে তো এ গল্প আর পাঁচজনের গল্পের সাথেও মেলার কথা’, যদি এমনি সে সাধারণ, এতই যখন সে অমৌলিক। আর তাই, সেইসব গল্পের যে কাহিনীসূত্র, যারা যারা নিজের নিজের নামভূমিকায় জীবন কাটাচ্ছেন, সেসব কিছু নিয়েই আমাকে চলতে হয়। গল্পগুলো নীতিগল্পের ধারার। ফলে ‘মরাইলে খাড়ায়’ একটা কিছু। আর সেই ‘মরাল’-এর নড়চড় কাউকে করতে দেখলেই ইচ্ছে হয়, চেঁচিয়ে ফাটিয়ে ফেলি গলার শিরা। ফলত আমি ভয়চকিত হৃদয়ে তর্কে অবতীর্ণ হই, বারবার, আবার আবার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হার হয়। কিন্তু এ তো আমার হার। আমার জ্ঞান-বুদ্ধির হার। আর সেসব তো আমার বাস্তবিকই কম। কিন্তু ‘মরাল’ যে গল্পে ছিল, সেটা তৈরী হয়েছিল সত্যিকারের ঘাত-প্রতিঘাতের প্রতিক্রিয়ায়, যে সমস্ত তথ্য আজ আর আমার স্মৃতিতেও নেই। কিন্তু গল্পটা আছে। সেটা সত্যি গল্প| ফলে নীতিটি আমি পরিত্যাগ করি না।

যেমন, আজ আমি খুব একা-একা এই ঘরে বসে মনে করছি, খুব নিঃসংশয় চিত্তেই মনে করছি যে মিথ্যাচরণ মানুষের সহজাত। কুকুরেরা মিথ্যে কাকে বলে জানে না। বেড়ালরাও নয়। ইঁদুর-আরশোলারাও নয় বলেই আমার বিশ্বাস।

আর মানুষ যা করে তা বলে না, যা বলে তা লেখে না, আর যা করে ও যা লেখে তার মধ্যে তো এক দুনিয়া পার্থক্য। সচেতন, সভ্য ও সুসংস্কৃত হয়ে ওঠা, অর্থাত পাশবিক বা জান্তব জগত থেকে নিজেকে আলাদা করার পদ্ধতিই আসলে একভাবে ক্রমশ আরো আরো মিথ্যাচারী হয়ে ওঠার অনুশীলন। নিজে ঠিক ঠিক যেমনটা, তেমনভাবেই নিজেকে উপস্থাপিত করতে সভ্য মানুষ অপারগ। আমি তোমায় পাব কেমন করে, যদি সত্যিকারের আমি-টাকে তোমায় দেখতে দিই? তুমিই বা অগণন তুখোড় ব্যাপারীর ঝাঁঝ টপকে সত্যিকারের আমার কাছে এসে পৌছবে কোন জাদুতে, যদি না বাতাসে ভাসিয়ে দিতে পারি মোহিনী আঘ্রাণ? চতুর্দিক ঝলমল করছে শুধু: অনেক সাজ, অনেক রং, অঢেল সুবাস, দেদার ভেলকি, অনেক মুখোশ। আমার পাড়াতুতো মাতব্বরদের কাছে আমি এক অবতার, সাংস্কৃতিক বড়দাদাদের কাছে আরেক। ‘সদরে-বাজারে-আড়ালে’ আমি নিত্য আমারও সমান নই। আপিস-আদালত-দপ্তরিখানায় আঁটসাঁট বেনের পুঁটুলি। চৌপর দিন আমায় শিরদাঁড়া ভাঁজ করে রেখে চলতে হয়। এরপরও তুমি আশা কর ছুঁতে পারবে সত্যি আমায়? আর তোমার দুচোখ? সুদূর আঁখিদুটি তোমার? তারাও তো দিশে হারিয়েছে জৌলুসে, ঝলসানিতে, রংবাহারে। এখন তুমি আর আসল তুমি হয়ে তাকাবে কোন নিশানায়? আস্পর্ধাই বা পাবে কোথায় এত? আমি নিজেকে বারেবারেই আবিষ্কার করি নিজেরই খুব মায়ার, ভালবাসার জনের কাছে মিথ্যাচরণে নিয়োজিত। আর তোমাকেও, বারংবারই, লুকিয়ে দ্বিচারী হতে সেই আমার কাছেই ।

এমনি সব ক্ষয়ে যাওয়া, বহুব্যবহারে জীর্ণ-মলিন নীতিগল্প আর তার থেকে উঠে আসা প্রত্যয়ে ঠেসান দিয়ে নিরালা বয়ে চলে আমার ভিড়-ভন্ডুল জীবন।

স্ট্রাটেজিস্ট

আমরা রাগ, ক্রোধ, বিক্ষোভ ইত্যাদি আচম্বিতে-প্রকাশের যে পদ্ধতি ব্যবহার করি, তা বেশিরভাগ সময়ে নিশ্ছিদ্র পূর্বপরিকল্পনার ভিত্তিতে গাঁথা হয়ে থাকে। হঠাৎ-আবেগের আতিশয্যে স্বতোদ্‌গীরণধর্মী অভিব্যক্তি মিথ্যে নয়, কিন্তু বিরল|। যে কতিপয় স্ফূরণ ক্বচিত চোখে পড়ে, সেসবও দ্রুত সামলে যায়, নিকট বা বড়জোর কিয়দ্দূর ফলশ্রুতির বিবেচনার ভয়-তরাসে। ক্ষোভ-বিরক্তি-তিক্ততা-যাচ্ছেতাই অপমান-অবুঝ অভিমান-দুরারোগ্য ক্লিষ্টতা এসবের কোনোটা কোনোটা—বা কখনো সবগুলোই—অসহনীয়  হয়ে ওঠে যে তাতে ভুল নেই, কিন্তু দাঁতে দাঁত ঘষে শিষ্ট থাকাটাই অনেক বেশি নিরাপদ— বোধোদয় হতেও দেরী লাগে না খুব। ‘অবিবেচক’, ‘অদূরদর্শী’ এমনকি ‘ইরেসপন্সিবল’-এর মত মর্মান্তিক বিশেষণ যথেচ্ছ হজম করা মনুষ্যকুলের আদত দূরদৃষ্টির অভাব বস্তুত তেমন  নেই। আগ্নেয় পর্বতের কন্দর থেকে তপ্ত লাভা, ম্যাগমা, বিদ্ধংসী প্রলয়ের চেহারা নিতে অনেক কালক্ষেপ করে বটে, কিন্তু যখন তা সত্যিই নেয়— কোনো আত্ম-পর লাভ-ক্ষতির খতিয়ান সে আদপেই করে না: সুযোগও পায় না, দায়িত্বও নেয় না। কিন্তু তা বলে মানুষ কিছু আগ্নেয়গিরি নয় যে তার ক্ষতমুখ থেকে অবিমিশ্র উদ্গীরণে নিঃসংশয় আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, যা উৎক্ষিপ্ত হবে স্রেফ শূন্যে, আর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সমস্ত পরিপার্শ্ব, এমনকি নিজের অস্তিত্বটুকুকেও। মানুষ অত কাঁচা খেলুড়ে নয়। যে অভিব্যক্তি দুর্নিবার পরাক্রমে আমার বেঁচে থাকাকে, টিকে থাকাকে টাল খাইয়ে দিয়ে বিস্ফোরিত হলো বলে তোমার মনে হচ্ছে, আসলে তার টিউনিং বা ফ্রিকোয়েন্সি ও সময়জ্ঞান অনেক ভেবে-চিন্তে, বিচার-বিবেচনা করে, গুনে-গেঁথে তবে ধার্য করেছি আমি—যাতে সে অভিব্যক্তির অদূর ভবিষ্যত প্রতিক্রিয়া আমার অনুকূলেই যায়, টলমল করিনি আসলে আমি শুধু টাল-মাটাল দেখিয়েছি, যাতে করে তুমি বাধ্যতই আমার প্রকাশনার কাঙ্খিত ফলাফলটুকুই শুধু দেখাও। কয়েকটা হাতে-গোনা ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু সেই দুয়েকটা ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বেফস্কা আবেগের সশব্দ ফেটে পড়াকে সামাল দিতে গিয়ে, যে পরিমাণ দুশ্চিন্তা-কূটভাবনার অবতারণায় বাকি আয়ুষ্কালের অধিকাংশ ব্যয় করেন দেখা যায়, তাতে আবেগের স্বতোৎসারণ স্রেফ ক্ষণিকের ভুলেরই মান্যতা পায়, অর্থাৎ উজ্জ্বল ব্যতিক্রমরূপে নিয়মের মূলগত ভিত্তিকে আরো মজবুতই করে মাত্র। বড়সড় দ্রোহকাল বা আলোড়ন-সময়ের কথা তো বাদ-ই দিচ্ছি: সেসবে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের সাথে অনেক অনেক গুণ বেশি করে মিশে থাকে ফিল্ড-এসেসমেন্ট, সেটাই মুখ্য ভূমিকা নেয় আন্দোলনের— সে বিষয়ে কোনো সংশয়-ই নেই। কিন্তু, এমনকি তোমার-আমার নিতান্ত প্রাত্যহিক ও ব্যক্তিগত গোলে-মালেও আসলে মূল আবেগের প্রচণ্ডতার চাইতে এতটাই এগিয়ে থাকে বিচক্ষণতা ও প্রাক্‌-পরিকল্পনা যে ভাবতে গেলে একটু অপ্রস্তুতেই পড়তে হয়। হাজার হোক আবেগময় মানুষ-ই যে বেশি মানবিক: ‘আবেগহীনরা তো আর দুনিয়াকে বদলায় না’। সত্যি নয়। সত্যি নয়।

আত্মজীবনীর আরেক টুকরো প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ঘাট’ লিটল ম্যাগাজিনে (২০১৫)।

1 thought on “মিথ্যের গদ্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.