স্মৃতি ভট্টাচার্য মিত্র
যুক্তাক্ষরটা তখনও অবনীর সড়গড় হয়নি। তাই কেউ যখন জিজ্ঞাসা করতো ‘তোমার ইশকুলের নাম কি?’ অবনী নিজের ছন্দে এবং দ্রুত লয়ে বুকে হাত দিয়ে বলে যেতো ‘ছাত্তমঙ্গল / অবনী মোহন / সিতি / পাক পাথমিক / বিদ্যালয়।’ বাকি বুঝে নেবার দায় প্রশ্নকর্তার। ও শুধু অবনী মোহন বলার সময় ‘আমার’ বোঝাতে বুকে হাত রাখতো।
ইশকুলের আবার মালিক হয়, তার আবার ‘আমার তোমার’ হয় এসব তো অবনীর জানার কথা না। শুধু জানে ‘এটা আমার ইশকুল’। তাই তো ওর নাম অবনী। তাই তো ইচ্ছে হলেই জগবন্ধুদার (যার বয়স তখন আনুমানিক ষাট) ঘরে চলে যেত ও।
সকালের ঘন্টা বাজানোর পর জগাদাদার তেমন কোন কাজ নেই। মাঝে একটু যেত বড় দিদিমণির নীল খাতা নিয়ে এঘরে-ওঘরে অন্য দিদিমণিদের কাছে। তারা কিসব সই-ফই করে দিত। এরপর জগাদাদা টিফিনের চারটে ঘন্টা বাজাতে উঠোনে যেত ইয়াবড় ফাদের পায়জামা পরে, গায়ে হাওয়াই শার্ট। তেমনি তার চেহারা। এই দুবার ঘন্টা বাজাবার মধ্যে অবনীর ক্লাশ থাকতো বৈকি! তবু অবনীও দুটো কেলাসের ফাঁকে ছুট্টে জগাদাদা র ঘরে চলে যেত, যারা রেডিওর ভেতর বসে গান গায়, তাদেরকে জগাদাদা কোথায় রাখে, তাই দেখতে। কারণ এই সময় ও দেখেছে জগাদাদা রেডিও খোলে, আর কিসব কাজকম্ম করে। তাই এটাই ছিল আসল সময়। কিন্তু সে আশ ওর কোনোদিন মিটতো না। তার আগেই শান্তি দিদিমণি হাঁক পাড়তো, ‘অবনীইইইই!’। অবনী পড়ি-তো-মরি করে এসেই বেঞ্চে বসে পড়তো। জগাদাদার ঘর মানে অনেক দূর তো নয়। এই অবনীর কেলাস আর ওই কুয়ো পাড়েই, পেয়ারা গাছে ঢাকা জগাদাদার ঘর।
অবনীর ইশকুল এখনকার স্কুল তো নয়। সে এক মজার যায়গা ছিল বটে। তনিমা দিদিমণি অবনীর কপালে একটা ঢি দিয়ে হনহন করে হাঁটতো। অবনীও পেছন পেছন ছুট – ‘ও দিদিমনি গো, আমি আমার পায়ে পড়ি। আর একটা ঢি দাও গো, না’লে আমার শিং গজাবে।’ আর এই অদ্ভুত বাক্যবিন্যাসের রস নেওয়ার জন্যই প্রতিদিন তনিমা দিদিমণি ঢি’টা দেবেই। তারপর কোলে তুলে নিয়ে আর একটা ঢি দিলে তবেই অবনীর শান্তি।
অবনীর ছোটকা সাইকেল থেকে নামিয়ে কাঁধে ব্যাগটা দিয়ে, স্কুলের গোড়ায় ছেড়ে দিত। ব্যাস। বাকিটা অবনীর আয়ত্তে। ছোটকা ছিল অবনীর প্রাণ। তাই পরীক্ষা দেবার সময় ছোটকা যেন টেবিল টেনিসের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে অবনী লিখবে। এবং এটা বলবৎ ছিল গোড়ার দিকে। কিন্তু বাকি দিনগুলোতে অত দরকার হতো না ছোটকাকে। তখন তো খেলা, খেলা আর খেলা, মাঝে একটু পড়া। পড়ার মধ্যে অবনীর সবচেয়ে ভাল লাগতো নামতা কেলাস।সারা ঘরটায় যত বন্ধু আছে অবনীর, সবাই একসাথে ‘তিন এক্কে তিন, তিন দুকুনে ছয়, তিন তিরিক্ষে নয়…’ – চিৎকার করে বলে যেত। তাদের তিরিক্ষে মেজাজেই বোধহয় কাকেরা উঠোনে এসেই আবার ‘কা কা’ করে ছুট মারতো। এই নামতা বলাটা যেমন বাধ্যতামূলক ছিল, তেমনি বলার সাথে সাথে হাফ প্যান্টে মশা কামড়াতো খুব, তাই পা চুলকোনো বা শান্তনুর পেন্সিল বক্স থেকে রবার নেওয়া, সেই নিয়ে ছোটখাটো মারপিট সব চলতো ‘তিন দশেক্কে তিই-রিশ’ পর্যন্ত।মারপিট বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গেলে দিদিমণি মুখে নামতা বলতে বলতেই দুজনের কান মুলে দিতো। ফলে নামতার এই স্রোত আবহমান বয়ে চলতো, কানে মাথায়। না দুলে নামতা যেমন বলা যায় না, তেমনি হাত পা না ছুঁড়ে ‘হও ধরো মেতে ধীর, হও কলমেতে বীর’ গাওয়া যেত না। ‘মানে’ ছাই অবনী জানে? শুধু বারবার কলমেতে বীর বলায়, ওর ধারণা হয়েছিল, ওর মাসতুতো বীর দাদার কলম নিয়েই কিছু বলা আছে এখানে। বীর দাদা তো ছোটখাটো লোক না। অনেক বড় কেলাসে পড়ে। তাই তার কথা আসতেই পারে গানে।
এহেন ইশকুলে প্রাত্যহিক দিনগুলো যেত হুড়োহুড়ি করেই। তারা যেমন বিশাল আড়ম্বরে ঢাকা ছিল না, তেমনি একঘেয়েও ছিল না।ইনফ্যান্ট থেকে ওয়ানে উঠে দোতলায় ক্লাশ করতে বসার ফলে পুরো একবছর অবনীর ধারণা ছিল, প্রতি বছর ওপরের তলায় উঠে বসবে ক্লাশ করতে। কিন্তু টু-এ উঠেই দেখে তাকে নীচের ঘরে বসতে হচ্ছে। এই নিত্যনতুনের স্বাদ তাকে বারংবার অচেনার আনন্দ দিতে থেকেছে।
এর মধ্যে একবার বন্যায় জল ঢুকে গেছিল ঘরে। ইশকুল বন্ধ ছিল অনেকদিন। অবনীর কেন জানি না মন্টু মাস্টারের কথাই মনে আসতো খুব। সারা মুখে যার কিসব ভর্তি। চোখ ছাড়া আর কিছু ভাল দেখা যেত না যার। কিন্তু মন্টু মাস্টার গল্প শোনাতো প্রতিদিন। আর তারপর পোশ্ন করতো, ‘রাম বনে কি পাড়ে?’, ‘জবা ফুলের কি রঙ?’ কোনদিন বকতো না। সেই মন্টু মাস্টারকে একদিন স্বপ্ন দেখলো অবনী। কানে গালে নাকে সেই ওঠা-ওঠা জিনিসগুলো সব মিলিয়ে গেছে। মন্টু মাস্টারকে কি সুন্দর দেখতে লাগছে! এরপরেই ঘুম ভেঙে গেছিল। আর সেদিন থেকে অবনীর কেবলই মনে হচ্চিল, কবে ইশকুল খুলবে আর দেখতে পাবে,মন্টু মাস্টার একেবা…রে ভাল হয়ে গেছে।
অনেকদিন পর ইশকুল যখন খুললো, তাকে ভুলে যেতে হয়েছিল স্বপ্নের কথা, কারণ আরও বড় অবাক করা ঘটনা অবনীর জন্য অপেক্ষায় ছিল। সারা ইশকুলে বাথরুম ধোয়ার গন্ধের মত গন্ধ।ঢেঁকি, দোলনা সবের কাছে সাদা সাদা পাউডার পড়ে আছে। তারমধ্যেই প্রার্থনার জন্য লম্বা লাইন হলো মাঠে। প্রতিদিন শান্তি দিদিমণি হারমোনিয়াম বাজায় আর ওরা সবাই গান গায়। আজ শান্তি দিদিমণিকে একদম অন্য রকম লাগছে। সেই যে চাঁদের মতো লাল টিপ পরে দিদিমণি, আর কি সুন্দর শাড়ি পরে আসে। মা যখন বলে ‘চাঁদের কপালে চাঁদ টি দিয়ে যা…’, অবনী তো এই টিপটাকেই দেখতে পেত। কে বলতে পারবে, কি হয়েছে শান্তি দিদিমণির। ভাবতে ভাবতে মাথায় আসে বড়াই মাসি ভাল। শান্তি দিদিমণির যা কিছু আনতে দেয়,বড়াই মাসি নিয়ে এসে দেয়। অবনী টিফিনে বিস্কুট আর জিবে গজা খেয়ে, ছুট্টে জলের বোতলে জল ভরতে গিয়ে দেখে বড়াই মাসি কলের পাড়ে। ব্যাস, অবনী প্যান্টটা একটু ঠিক করে নিয়ে, নিজেকে গুছিয়ে নেয়। তারপর বলে ‘ও বড়াই মাসী, শান্তি দিদিমণি টিপ পরেনি কেন? শাড়িটা অমন কেন? কেউ কি বকেছে?’ হঠাৎ দেখে বড়াই মাসীর চোখেও জল। সেই দেখে অবনী তো থ। তাহলে কি বকুনি দুজনেই খেয়েছে! বড়াই মাসি চোখের জল মুছে কুঁজোয় জল ভরে চলে যাচ্ছিল। অবনী বললো, ‘ও বড়াই মাসি তোমাদের দুজনকেই কে বকলো গো?’ বড়াই মাসি গাল টিপে, আদর করে বললো, ‘ঠাকুর।’ কোন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না অবধি চিন্তা হয়। উত্তর পেলেই তো মুক্তি। তাই এই উত্তরে অবনী এই সিদ্ধান্তে এলো, ‘আচ্ছা আমাদের তোমরা বকো, তোমাদের বকে ঠাকুর।’ তাই একদিনের বকুনিকে তেমন আমল না দিয়ে ছুট্টে চলে গেলো অবনী। পরেরদিন ভোরে যখন ‘সারা জীবন দিলো আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ’-টা সবাই গাইছে, অবনী দেখে আজও শান্তি দিদিমণি টিপ পরেনি। বাজে একটা শাড়ি পরে গাইছে। অবনী লাইনের ফাঁক দিয়ে দিয়ে মাথা গলিয়ে গলিয়ে শান্তি দিদিমণির পিছনে পৌঁছে গেলো। আর আঁচলটা টেনে বললো, ‘ঠাকুর বকলে সব দিন রাগ করতে নেই। একদিন করতে হয়।’ বলেই ছুটে নিজের লাইনে এসে হাতজোড় করে গাইতে লাগলো ‘তোমার আশিব্বাদ হে পোভু তোমার আশিব্বাদ…’
…
লেখক পরিচিতি : স্মৃতি ভট্টাচার্য মিত্র
“গত পঁচিশ বছর বাংলার বাইরে থাকলেও শিকড় আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রয়েছে।তাই গল্প পড়া এবং টুকটাক লেখা, কবিতা পড়া, নাটক করা এবং দেখা।কবিতা আবৃত্তি করা যেন প্রতিদিনের ভাত ডালের সঙ্গী।আর রাজনৈতিক সচেতনতা আমার কাছে মনে হয় বাঁচার মানদন্ড।”
Pingback: ‘স্কুল নিয়ে’ : আয়নানগর গল্পসংখ্যা | aainanagar