সিদ্ধার্থ বসু
“এ লেখা তৈরি হয়ে যাবার পর জল আরো অনেক দূর গড়িয়েছে। সুমন ‘হাভাতের’ মত মমতার হাত থেকে ভূষণ-টুষন নিয়েছেন: ‘হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে’ই একরকম। বিজেপিকে রাজ্যে আটকাতে প্রবলভাবে টিএমসিকে ভোটে জেতানোর রোল তুলেছেন, ঠিক যেমন ২০০৭ থেকে সিপিএমকে হারাবার কথা বলতেন। অভিজিৎ রায় খুন হয়েছেন। বহু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ-দুঃখ-ঘৃণার প্রকাশের মাঝে লক্ষ্যণীয়ভাবে নীরব থেকেছেন সুমন। মুখ খুলেছেন শুধু নিজের সমালোচনা হলে তার নড়বড়ে উত্তর দিতে। নিজের কবিতা নিয়ে পরিকল্পিত ছ্যাবলামো করে চলেছেন, একটানা। তিতিবিরক্ত সকলেই। কিন্তু তবু…তবু…হ্যাঁ, সুমন বলেই কিছু বলতে পারার মত শেষ কথা এখনো জন্মায় নি: he is so consistently inconsistent, so badly so। জানি না এরপরেও আর কী কী ঘটতে চলেছে, বা ঘটতে পারে। তদ্দিন পর্যন্ত ফর্দ করা থাক আমার এই কূটকচাল, এক শহুরে দিগভ্রান্তের আবেগমথিত হাবিজাবি।“ – সিদ্ধার্থ
সুমন ভাট বকে বলেই তো শুনি। উত্পল বসু লিখেছিলেন: ‘দ্বিবিধ অর্থময় রায়গুণাকর ছিল অনেক বাচাল’। তার ঝোঁকে আমার বলতে সাধ যায়: বহুধা অর্থপূর্ণ কবীর সুমন, আমি তবুও নাচার। অনীতা দেওয়ানকে উত্সর্গ করা গানের মুখড়ায় ও শেষে যে চিত্কার করে উঠতে পারত: ‘অনীতা দেওয়ান ক্ষমা কোরো, বড় বেকুবের মত গান গাইছি আমি, আর কিছু পারি না বলে’, কিম্বা গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এক উত্তাল সময়ে যে লোকটা খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বামফ্রন্টকে খিস্তি-খেউড় করত আর মঞ্চে গেয়ে উঠত: ‘জানান দিচ্ছে এই মুহূর্ত, কীসের ডাইনে কীসের বাম/ মাটিই যাদের ইজ্জত সেই মানুষগুলো নন্দীগ্রাম’, সেই লোকটাই যখন বলে বসত— বা কথাগুলো ঝাঁঝিয়ে ওঠা সোডার বোতলের ছিপি খুলে ছিটকে উঠত বলা চলে, অনর্গল— ‘গণতন্ত্র ছিলনা এই রাজ্যে। কিন্তু গণতন্ত্র আসছে। ওই যে মহিলা গাছকোমর বেঁধে মুড়ো ঝাঁটা তুলে নিলেন হাতে, ওই যে ছোট্ট শিশুটি কান্নার প্রতাপে মারমুখী, ওই যে সামান্য সম্বল নিয়ে স্রেফ রাস্তা কেটে আর গাছ ফেলে একটা প্রশাসনকে আটকে দেবার মরীয়া চেষ্টা করছে একটা ছোট্ট গ্রাম, ওদের সবার মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্র আসছে’— তখন সেটাকে অতি নিকৃষ্ট ভাট বলে সনাক্ত করা সত্ত্বেও ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠতাম। কেননা তখন পড়ন্ত বেলার সুমন গিটার দাবড়ে গেয়ে উঠেছে: ‘জ্বলছে প্রাণে অনেক জ্বালার চকমকি আজ/ এবারে জ্বলবে আগুন’। আর সে গানের— হোক না সে নিকারাগুয়ার যুদ্ধের সময়ে লেখা (বা সেটাও আরেকটা ভাট)— প্রথম শোনার ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই বন্যার মত ভেসে যাচ্ছি বহুশ্রুত আরেক গানের আচম্বিত কিন্তু নিপুণ সময়জ্ঞানে: ‘ঝঞ্ঝার ঝংকার ঝংকারে, বাজলো ভেরি বাজলো ভেরি’: গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
সুমন শেষটায় মুসলিম হলো! সুমনের তা বলে এত নারীসঙ্গ! সুমন শেষমেষ তৃণমূলে যোগ দিল! শুধু ভাট বকে লোকটা। নিকারাগুয়ায় বিপ্লব দেখেছে। ভারতে মাওবাদ দেখেছে। কাপিতেল, ভগবদ্গীতা, কোরান-শরিফ, কবীর, সুকুমার রায়, আল-মাহমুদ, অরুণকুমার সরকার সবই নাকি উনি পড়ে বসে আছেন। লোকটার সাঙ্গীতিক জ্ঞানের কোনো হিস্ট্রিই নেই, স্রেফ ওপরসার চালিয়াতি। ডিলান-কোহেন ছেড়ে আরেকটু ক্লাসিকালে ঘেঁষলেই ওর দম ফুরুবে। আসলে লোকটা না হিন্দু, না মুসলমান, না বিপ্লবী, না সংগীতকার তেমন কেউকেটা (সুরের একঘেয়েমি তো কহতব্য নয়), না রাজনীতিক (না সি.পি.এম. না তৃণমূল না বি.জে.পি. না নকশাল), এমনকি না কবি, না সুরকার, না গদ্যকার, না প্রবন্ধকার, না তেমন কাজের কোনো চিন্তাবিদ্ বা কর্মী। শুধুই ভাট। লোকটা নিজেই একটা আস্ত ভাট।
এতসব ঠেলে আমি সুমনে যাই। আর দেখি সুমন— কচ্ছপ আর হিপোপটেমাসের একটা ক্লোন, বুড়ো সুমন— দুজন সঙ্গীকে নিয়ে গান ধরেছে, শুনি: ‘রাই জাগো রাই জাগো বলে দেশের পাখি/ শ্যাম-শামসুল ভায়ে ভায়ে দাঙ্গা হবে নাকি’; পুরনো গান, আবার শুনি, নতুন করে; কারণ এবারে সুমন তার ফাঁকে ভাট মেশাচ্ছে: মোদী সরকার শুনে রাখো, এ রাজ্যে নয়, অন্য যেখানেই হোক, এখানে নয়। মেশাচ্ছে: ‘এই মোদী সরকার গত কয়েকমাসে ক্যান্সারের আবশ্যিক ওষুধের দাম প্রায় ৬০ হাজার টাকা বাড়িয়েছে এবং সেই সঙ্গে আরো প্রায় ২৩ তা জীবনদায়ী ওষুধের দামও হু হু করে বেড়েছে, রাজ্যের প্রধান প্রচারিত সংবাদপত্রগুলো সে খবর ছাপে না’ (বি. দ্র. তথ্যে ভুল থাকতে পারে, আছেও)। বলছে দুধকুমারের কথা, বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে খ্যাতনামা দুধকুমারের সি. পি. এম.-এর হাতে রামঠ্যাঙানি খাওয়ার কথা বলছে; আর তার জন্যে সি. পি. এম.-কে একটা হাততালি পাইয়ে দিচ্ছে। আমি শুনছি: ‘ভেতরে আগুন বাইরে আগুন গুজরাট হয়ে জ্বলে/বুকের আগুন বাঁচিয়ে রাখাকে সন্ত্রাসবাদ বলে’; এ-ও বহুশ্রুত, কিন্তু খাঁটি নতুন ভাট সহযোগে পরিবেশিত।
সুমন আমার কাছে আপাদমস্তক আবেগতাড়িত একটা ভুলভাল মানুষ। ঠিক যেমন আমি নিজে। আজন্ম প্রবৃত্তির পিছু ধাওয়া করতে করতে কত কেলেংকারীই না ঘটে গেছে জীবনে। কিন্তু ফিজিক্সে পড়া সেই সংবেদী সুরশলাকার কথা মনে পড়ে যায়: একটা অতিসংবেদী সুরশলাকা যদি বানানো যেত, সামান্যতম পরিবর্তনেও যা কেঁপে উঠে জানান দেয়। সুমন ঠিক তাই। সর্বস্ব নিয়ে কেঁপে ওঠে সে প্রতিটা তরঙ্গভঙ্গে, যত তুচ্ছই সে হোক না। কিন্তু সেই সঙ্গে অনিশ্চয়তার কথাটাও মনে রাখতে হবে বৈকি। আলোড়ন যেখানে সহজেই ওঠে, সেখানে আলোড়নের ফল কোনদিকে যাবে তা নিয়ে শেষ কথা বলা অত সহজ হয় না তো। তাই সুমন সদর রাস্তায় দাঁড়িয়ে সি. পি. এম.-কে খিস্তি করে আর পরক্ষনেই তৃণমূলে যোগ দেয়; এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশস্তি গেয়ে গানও লেখে সে। কিন্তু মাথা ঘোরানোর অবকাশটুকু না দিয়ে সে গেয়ে ওঠে: ‘আর কিছু নয় বাঁধছে সময় ছত্রধরের গান’ কিম্বা ‘সাতচল্লিশ সাল থেকে, শুধু খিদেই দেখলে চেখে…/ শালবনীর দস্যি ছেলে, এত সাহস কোথায় পেলে?’ সাংসদ পদ আঁকড়ে থাকার তুলকালাম অভিযোগের মধ্যেও তার গলায় শুনতে পাই: ‘সিঙ্গুর থেকে নোনাডাঙ্গা একই দৃশ্য একই মার/উচ্ছেদে সব শাসক একই, দাঁড়াও বন্ধু আরেকবার’। আর যতই আবেগের সোডা ঝাঁকুনি খায়, ছিপি উড়িয়ে ভসভসিয়ে ওঠে ভাট। আমি শুনতে পাই ‘গান গাওয়া, এই যে আমি গান গাইছি, এটা তো নিজেই একটা রাজনীতি। তাই না? এই যে এক কলি গাইলাম, আমার ছিল যথেষ্ট শিক্ষা এবং তা পাওয়ার মত অঢেল অবসর; পয়সাকড়ি নিয়ে ভাবতে হয়নি আমায়। ওই যে গিটারটা, নাম ওভেশন, অনেক দাম ওর, যে সে কিনতে পারবে না। তাহলে আমি কি একটা জটিল রাজনীতির মধ্যেই পড়ছি না খুব সরল ভাবে?’ এমন একটা শ্রেণীসচেতন ভাট শুনে আমি আবারও সুমনে মজি। মনে পড়ে যায় ওরই গানের লাইন: ‘চুলোয় যাক না যা আছে চুলোয় যাবার/আমাদের আছে অঢেল খাবারদাবার’।
অজস্র ভুল দিয়ে, মিথ্যে দিয়ে গড়া একটা মানুষ সুমন। যে নিজেই ভাটায়: ‘আমি গুল দিই , কিন্তু সবসময় দিই না’। ‘দশরথ গেলেন মৃগয়ায়’— এর মত একটা গান সে শুধুই ভাট দিয়ে তৈরী করে বসে। “যখনি মনটা একটু আর. এস. এস. আর. এস. এস. করবে তখনি সলিল চৌধুরীর কথা ভাববেন, ভাববেন ‘আজ তবে এইটুকু থাক/বাকি কথা পরে হবে’; এ জিনিস কোনো গুজু গুজু মেড়োর বাচ্চাকে দিয়ে হবে না”, তখন প্রাদেশিকতার অসতর্ক ইঙ্গিত টের পেয়েও মনে হয় হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটা ঘৃণা জাগিয়ে তুলতে হয়ত একটু সহায়তাও করতে পারে এই অতিসরলীকরণ। ‘লাইটারের আলোয় খুঁজি, তোমার মুখ ক্লান্ত বুঝি, বয়স রাখে হাত/ ও হাত তুমি ধরেই ফেল, আজ যখন আলোই গেল, একটু পরে রাত’ নতুন করে নেশা জমাতে না জমাতেই ভাট: “বেশি বয়স্ক মানুষের প্রেম নিয়ে গান বাংলায় আর কেউ লেখেন নি, রবীন্দ্রনাথও না”। চটকা ভেঙ্গে নড়ে বসি; একটু বিরক্তই লাগে; আর আবার শুরু হয়: ‘তুমি ছিলে গালিবের দারিদ্র-দেনা, তুমি ছিলে গজলের পালিয়ে বেড়ানো’, মৌতাতে বুঁদ হয়ে থাকি।
নিজের জীবন আর সম্মান নিয়ে স্রেফ জাগলিং করার লোভ সামলাতে না পেরে সুমন ভাট বকে কি? ও কি ভাট না বকে একটা আস্ত অনুষ্ঠানও কোনদিন করেছে?
শুধু আমিত্বে বোঝাই একটা লোক। শুধুই নিজের কথা। এতকিছুর মধ্যে শুনি: ‘কেউ খিদে নিয়ে গান লেখে, কেউ খিদে নিয়ে মরে/ তার বমিমাখা মরা মুখে মাছি ভনভন করে/ যদি মাছি নিয়ে গান লেখ, আর জলসায় গাও/ লোকে হাততালি দেবে দেখো, পেটপুরে তালি খাও’; আর তারই ফাঁকে ভাট: “ভগবদ্গীতার কোনো এক সারানুবাদে পড়েছিলাম ‘পৃথিবীকে তুমি এমন কী দিয়েছ যা তুমি পৃথিবী থেকে নাও নি?’” আরেক স্বনামধন্য ভাটকে মনে পড়ে যায়: ‘দিকে দিকে জ্বলছে ধুনি/ভিড় করেছে জ্ঞানীগুণী’। এবার থামা দরকার।
১৫৬ শতাংশ একমত ।