শ্রাবণী দাশগুপ্ত

“কলকাতার মেয়ে। জে.ইউ. থেকে মাস্টার্স সাতাশি সালে। তারপর বিয়ে, সংসার। লিখতে ভালো লিখি। তবে বেশ অনিয়মিত। খেয়াল খুশি মতন। দু-এক জায়গায় বের হয়েছে – বর্তমান, রবিবাসরীয় আনন্দবাজার। দেশেও একবার। আর কিছু লিটল ম্যাগাজিনে। বই টই বার করিনি। গল্প লিখতে ভালো লাগে, কবিতা আসেনা. রাঁচিনিবাসী বহুদিন। এখানে একটি স্কুলে পড়াই। ” – শ্রাবণী

ru-18oct14-ilus-0002
(১)
অবসাদের গাদে থেঁতলে যাচ্ছে তৃণা। অফিস ছুটি নিয়ে বসে আছে, নিঃশর্ত এবং অসীমিত। পরিণাম যাই হোক্‌, সে তৈরি। উত্তর-পশ্চিমের একরত্তি তিনকোণা ব্যালকনি ও লাগোয়া ঘর। সব বিরুদ্ধতাকে আন্তরিক স্বাগত জানিয়ে সে স্বেচ্ছাবন্দী। ব্যালকনিটা এই ফ্ল্যাটের সবচেয়ে ওঁচা জায়গা, পুরো বছর বন্ধ রাখতে হয়। এলোপাথাড়ি হাওয়া, গা-জ্বালানো রোদ্দুর, কনকনে ঠাণ্ডা – সমান দাপট। আবাসনের অদূরে কিসের একটা মাঝারি কারখানা। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে চোখ জ্বলে ধোঁয়াতে। ভিশাল ফ্ল্যাটটা দেখতে এসে বলেছিল,
“ছোড়্‌ তো। পিছেওয়ালি বালকনি খুলনে কা জরুরত থোড়ি হোগা।”
কার যে কখন কেন বা কী ভাবে কোনটা খোলার দরকার পড়ে যায়!
দেড়মাস ধরে বাড়ি, মিডিয়া, পুলিশ। তৃণা ক্লান্ত। তাদের এ্যাপার্টমেন্টের বাউণ্ডারির পাশে একটু খালি বাতিল জমি। যদি একবার ন’তলার ওপর থেকে নিচে হেঁটমুণ্ডে…। লাথি মেরে তৃণা সরিয়ে দিল বেতের হাল্কা চেয়ারটা। রেলিং ঘেঁষটে দাঁড়াল, রেলিংযের মাথা তলপেটের সামান্য নিচে। সাহস করে ঝুঁকলেই…। তৃণা সরু সাদা মোমবাতির মতো, পাঁচ ছয়, ভিশাল পাঁচ আট। ভাগ্য খারাপ হলে আবার হাসপাতাল, পুলিশ ইত্যাদি, প্রভৃতি।
“তি-ন-নি”
ভিশাল কি ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়? অফিস থেকে ফিরে এসেছে?
(২)
শর্টকাট রাস্তাটা ওরা ধরেছিল সেদিন। বারণ করেছিল তৃণা, ভিশাল শোনেনি। সরু গলির দু’পাশে সেঁটে থাকা একতলা-দেড়তলা ঘরবাড়ি, খোলা ড্রেন। পাঁচিলে মেলা শাড়ি, লুঙ্গি, বাচ্চাদের জামাপ্যান্ট। গুড়িগুড়ি মটরদানার মতো বাচ্চা কুকুর, মানুষের ছানাও। গলি পেরোলেই ঝক্কাস্‌ শপিং কমল্পেক্স। উল্লসিত শিস্‌ দিলেও, সতর্ক হয়েই চালাচ্ছিল। অসাবধানে লেগে গেলে ভয়ানক বিপদ। কোমর জাপটে বসে উচ্ছল তৃণা। আলাদা অফিস দুজনের, অনেকদিন পরে সেদিন একসাথে অফ্‌ পাওয়া।
প্রথম দিনটা অফিসে দু হাতে মাথা গুঁজে বসেছিল ভিশাল, ভয়ানক দপদপ করছিল।
“কি হলো ভিশ্‌? শরীর খারাপ?”
“নাথিং মাচ। জানিস সঞ্জীব, তৃণা এতো ডিপ্রেসড্‌ – মানতেই পারছে না।”
“জয়েন করেনি বলছিস। জয়েন করলে দেখিস নর্মাল হয়ে যাবে।”
“হোপ্‌ সো। বলছে, কোলকাতায় ফিরে যাবে। অথচ লাস্ট থ্রি-ইয়ার্সে একবারও যাবার কথা বলেনি।”
“টেম্পোরারি ট্রমা – ঠিক হয়ে যাবে। তিনদিন আগের ঘটনা মোটে। শী ইজ্‌ আ সফট এন স্যুইট গার্ল। তোদের এরকম ধামাকেদার শাদী, দু’বাড়ির এগেনস্টে গিয়ে। দ্যাখ্‌ তৃণা তখন কী স্টেডি ছিল, স্টেপব্যাক করেনি! একটু বোঝা ওকে, কাউন্সেলিং কর্‌।”
টিভিতে একশ’বার দেখিয়েছে, হাইলাইট্‌সে। ধাক্কাধাক্কি – তৃণা প্রচণ্ড মারপিট করছে। পায়ের স্টিলেটো খুলে মারছে ঠকাঠক। ওর লেদার ব্যাগ আর গোলাপিরঙের ক্যাজুয়েল শার্ট ধরে টানছে দুটো তাগড়া ছেলে। ভিশাল পেটাচ্ছে বাকি তিনজনকে। মাটিতে উলটে পড়ে, ঠেলে উঠছে। গলিটার দুপাশে ঠুঁটো ভিড়। বাইকের চাবিটা তবু বাঁচাতে পেরেছিল। রীয়ার উইণ্ডো ভেঙে গেছে। সামনের চাকার হাওয়া বেরিয়ে গেছে। কোনও রকমে রগড়াতে রগড়াতে নিয়েছিল এলাকার বাইরে। তারপর কাছাকাছি থানা, এফ-আই-আর। তৃণার দিকে তাকাতে পারছিলনা। ওর গোড়ালি বিশ্রী মচকেছে। টী-শার্টের গলার কাছটা ছিঁড়ে অন্তবার্সের উঁকি, চুলগুলো লণ্ডভণ্ড।
“বোলিয়ে জী কি খোয়া গেছে। কিমত ভী বোলিয়ে।”
“মোবাইল, জেন্টস্‌ ঘড়ি, এটিএম কার্ড, রে-ব্যানের সানগ্লাস…”
থেমে থেমে লিস্ট আর দাম বলছিল ভিশাল। বয়ান দিয়েছিল ঘটনার। কষে রক্ত, কপালে কাটা, কব্জিতে, কোমরে চোট। ভিশালের পরে তৃণা, পাশের চেয়ারে বসেছিল। ভিজে চোখ লাল। একবারও মুখ খোলেনি।
“নাম বতাইয়ে ম্যাডাম।”
“তৃণা মজুমদার।”
“হাজবেণ্ড – ”
“ভিশাল দ্বিবেদী।”
“রেপ অ্যাটেম্পট্‌ হয়েছিল? এ্যাবিউজ্‌ড? মলেস্টেড? ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন কেন?”
“মেইনলি রবারি – ইভন মাই মোস্ট ফেভারিট সানগ্লাস গন্‌। বাকিটা কম্পালসিভ আর ইন্সিডেন্টাল।”
“আই সী। যান এখন, পুলিশ কাজ করবে। কিন্তু কল্‌ করলে হাজিরা দেবেন। মাস্ট কাম ম্যাডাম।”
বলাৎকার দেখালে টিভি চ্যানেলের টিআরপি বাড়ে। শ্লীলতাহানিও ভাল কাটে। কিন্তু এই সব নেটিপেটি ছিনতাই, রাহাজানি নেহাত আলুনি। থানা থেকে বেরিয়ে একটা ক্লিনিকে ঢুকে ফার্স্ট এইড করিয়ে, অটো ধরেছিল। ফিরে এসে পেইন-কিলার, হাল্কা সেডেটিভ আর চূড়ান্ত ক্লান্তির গভীর ঘুম। ধুম জ্বর হঠাত নেমে গেলে যেমন হয়। জিনিসগুলো ফেরত পাবার দুরাশা ছিল না।

(৩)
অসংখ্য চেনা আর অযাচিত কল্‌ পরের সকালে। ভিশালের মোবাইলে বেশি। তৃণার পুরনো নম্বরটা গেছে নতুন ফোনটার সঙ্গে, ভিশালের উপহার ছিল। নম্বরটা ব্লক করতে হয়েছে। পুরনো ফোনে নতুন সিম। নম্বর বিশেষ কাউকে দেওয়া হয়নি। এমনিতেও তৃণার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ওর বাবা-মা আসতে চেয়েছিলেন, নিজেই বারণ করেছে। অফিস জয়েন করল বেশ কিছুদিন পরে। ভিশাল অবশ্য অনেকটা আগে। সহকর্মীদের প্রশংসার উচ্ছ্বাস ভাল লাগছিল, ক্ষতের মলমের মতো আরামের লেপ। পাল্লাটা তৃণার দিকে বেশি ভারী, মেয়ে বলেই।
তিন বছরের প্রেম ওদের, তিন বছর বিবাহিত। বারবি ডলের মতো তৃণা। নরম, আহ্লাদী, একমাত্র লাড্‌লি। ভিশাল আগলেই রেখেছিল। সেই মেয়েটা এক সন্ধ্যেতে ‘ঝাঁসী কী রাণী’। আশ্চর্‍য, তৃণা কি শুধু একা লড়ছিল? বুকের মধ্যে, গলায়, অস্বস্তিকর আলপিনের খোঁচাগুলো ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল। বাড়ি ফিরে দেখল, তৃণা সোফার ওপরে এলোমেলো হয়ে গুটিয়ে বসে। টিভি বন্ধ। চোখের তলায় পুরু কালো। কষ্ট হচ্ছিল ভিশালের। ঘেঁষে এল,
“এ্যায়সা কেয়া হুয়া হ্যায় তিন্নু? ভুল জা। চল্‌ মুভি দেখে আসি নাইটশো। ডিনার করে ফিরব।”
“নাঃ, ইচ্ছে করছে না। কাল থেকে অফিস যাব।”
প্রায় দশ দিন ধরে সদ্য ত্রিশ পেরনো দুটো তাজা শরীর অন্ধকারে পাশাপাশি ঘুমোল শুধু। ভিশালের কোমরের আঘাতটা ভোগাচ্ছে। ওষুধ চলছিল। একদিন আলতো হাত রেখেছিল তৃণার বুকে, নাইটির ভেতর দিয়ে। আসলে, উষ্ণতা ছুঁয়ে স্বাভাবিক হতে চাইছিল। ঠাণ্ডা, শীতল – যেমন থাকে পাথরের মূর্তির। ভিশাল চমকে উঠে বেড-লাইট জ্বেলেছিল। সুস্থ আছে তো মেয়েটা? টিভি নিউজে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে, তৃণার সাহসিকতা বড়ো বড়ো বিশেষণে। রিপোর্টার ইন্টারভিউ নিয়ে গেছে বাড়িতে এসে। বারেবারে একটা কথাই বলে গেছে তৃণা,
“নিজের ইজ্জত রক্ষা আর হাজব্যাণ্ডের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা, নাথিং এলস্‌ টু সে।”
“ইউ আর রিয়েল্লি আ লাকি গাই ভিশ্‌… য়্যাসী বিবি…!”
“ছোড়্‌ না ইয়ার। দ্য ম্যাটার ইজ্‌ ওভার। নো রিপিট, প্লিজ্‌।”
বন্ধু একটু দমে যায়। খুশি হবার কথাই তো! আজকাল শুনলেই কেন বিরক্ত লাগছে, বিব্রত লাগছে কেমন। কেন মনে হচ্ছে, তৃণা বাড়াবাড়ি করেছে? কি প্রমাণ করতে চেয়েছিল? এই মেয়েটা তিনবছর আগে যখন সব ছেড়েছুড়ে, তাকে বিয়ে করার সাহস দেখিয়েছিল, দেশোয়ালি বন্ধুরা বলেছিল,
“বেঙ্গালি গার্ল! খুব ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট। সামলাতে পারবি? প্লাস তৃণা – সো বিউটিফুল এ্যাণ্ড একমপ্লিশড্‌!” সেদিন অহঙ্কারে ফুলেছিল ভিশাল। খুঁজে পেয়েছে রত্নাগার, জয় করেছে।
অথচ কী একটা ঘটনা! তৃণা সেই সময়ে অনড় দাঁড়িয়ে থাকলে, দৌড়ে পালিয়ে গেলে, সে স্বস্তি পেত? রেপড্‌ হলে – নিজের মহত্ব দেখাত? যত রাজ্যের হিজিবিজি চরকি, মন খুলতে পারা যায়না।
(৪)
তৃণা সাদা স্বচ্ছ, কোনওদিন কথা লুকোতে পারেনা। ঝগড়ার শুরুতেই কেঁদে ফেলে। বিনা দোষে কতবার যে ‘সরি’ বলে ভিশালকে! যেভাবে ওকে চেয়েছে, তৃণা দিয়েছে সেভাবে। তৃনা তার বউ, বয়সে একটু ছোট। ওর মা খুব কড়া, বাবার অগাধ প্রশ্রয়। বাবা যখন নিমরাজি, তৃণা বুঝিয়েছিল,
“জান বাপি, ভিশ্‌ ইজ্‌ এ্যান এক্সেলেন্ট হিউম্যান। পরে দেখো। লভেবল্‌, সিনসীয়ার, হার্ড-ওয়ার্কিং-।”
ভিশাল নিজের মাকে ফোন করেছিল,
“তৃণাকে চিনলেই না। মেনে নিচ্ছনা… কিন্তু দেখলে বুঝতে, ও একদম আলাদা… যেরকম তোমরা চাও। সংস্কারী, ঘরেলু, বাধ্য, নমিত। শুধু চাকরিটা করে, ছোড়েগী নহীঁ।”
তৃণা নিজেও ভেবে অবাক হচ্ছে, কী মারপিটটাই সে সেদিন-। অথচ আগে, মা একটু বকলেই চোখের জল। ভিশাল ভারী গলায় কথা বললে অভিমান। তারপরে, যখন পরপর থানা-পুলিশ, আইডেন্টটিফিকেশন, ইন্টারভিউ, মিডিয়া – সে কী ভাবে সামলেছে। তুমুল সংযত, অনুত্তেজিত। অফিস জয়েন করতেই সম্বর্ধনার আরতি,
“প্রাউড অফ ইউ তৃণা। কি করে পারলে?”
“কামাল কর্‌ দিখাঈ রে তৃণা!”
বেশ অস্বস্তি লাগছিল। আবার নির্ভেজাল উষ্ণতার সেঁকও। বাঁ গোড়ালির ব্যথাটা সারেনি, লিগামেন্ট ছিঁড়েছে। ক্রেপ ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। ফেরার সময়ে রোজ লিফট দিচ্ছিল কেউ না কেউ।
ট্রমা কেটে গেছে প্রায়, আবার যথাযাপন। দুঃস্বপ্নের ছোট্ট দাগ আর কয়েকটা আঘাতের চিহ্ন। বয়স অনেকটা ভারী হয়ে উঠেছে অভিজ্ঞতার মাপে। তৃণা আরেক তৃণাকে চিনছে। গহীনের ঢাকনা খুলছে। এতদিন পাত্তা না দেওয়া এক চাহিদা তীব্র হয়ে জাগছে। কিন্তু সে জানে, ভিশাল এখন চাইবে না! তার অতি রক্ষণশীল বাবা-মা, গ্রাম্য পরিজন, সম্পত্তি, পুং-সন্তান, বংশরক্ষার সাতকাহন বিয়ের আগে শুনিয়েছিল তৃণাকে।
একটু তাড়াহুড়োয় পাল্টে যাচ্ছে সকাল বিকেলের রঙ। আবদার করতে ভালবাসত তৃণা বাবার কাছে, ভিশালের কাছেও। চোখের জলে রঙিন, ন্যাকা, আদুরে তৃণা। ভিশাল টানলে, তার বুকে লতানে গাছ। খুলে নিলে, সে লজ্জাবতীর পাতা। আদর করেছে ইচ্ছেমতো, তৃণা মুখ ঢেকে রেখেছে। হয়ত ভিশাল ক্লান্তিতে ঘুমিয়েছে। সে নিজের চাওয়াগুলো শাসন করে, রাতভর জেগে ছটফট করেছে। জানায়নি। ভিশাল পৃথিবীর সুখিতম স্বামী। ছিল!
(৫)
ভিশালের বারবি ডল ইদানিং ছোটখাট রাগারাগিতে বিরক্তির ভ্রূ তোলে। গোঁ ছাড়েনা। ভিশালের বলা জোকস্‌গুলোয় অকারণ হাসেনা। না কি বোকা বোকা, পাতি, রাস্টিক? ভিশাল কি ভুল দেখছে সবটাই? পর্দার ভাঁজে, আসবাবের খাঁজে বিরোধের গুঁড়ো। ঝোড়ো হাওয়ার অদেখা সঙ্কেত হতে পারে। তরল লাভা জমাট, ঘর্ষণেই উদ্গীরণের আশঙ্কা। তাই সাবধানে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে, ব্যবধান রেখে, অন্য অন্ধকারে, অন্য ছায়াপথে পা ফেলা। কার দোষ কার কী, এভাবে বোঝা যায় না। আসলে দোষ নয়, ভুল শুরু হওয়ার কয়েকটি নিজস্ব মুহূর্ত থাকে।
কোন্‌ ভোরে ফোন করেছিল ভিশালের মা, এ্যাদ্দিন পরে! আজকাল সে নিজের চা নিজেই করে নিচ্ছে। দ্বৈত ভোরালি চায়ের ছোট্ট আড্ডাটুকু অজান্তে শেষ হয়ে গেছে। তার কড়া লিকার, ঘন দুধ, চিনি। তৃণার ঘুম দেরিতে ভাঙছে। সেও তাড়াহুড়োয় শুধু নিজেরটা – লিকার চা, গ্রীন-টী। মায়ের একরাশ প্রশ্ন তীরের মতো, বেশির ভাগ ওই ঘটনা নিয়ে।
“বহু ঠীক হ্যায় না? টিভি পে মর্দানী জেইসি দিখী থী। লম্বী, বহুত পতলি ভী। খাতী-খিলাতী নহী ক্যা ঠীক সে?”
মা ‘তেরি বিবি’র বদলে ‘বহু’ বলেছে। ভিশালের ফুলে ওঠার কথা। তৃণাকে এখন খুঁচিয়ে, রাগিয়ে আদর করার কথা। তার যত্নআত্মি, পুজো-উপোস, নিরামিষ খাওয়া যথাযথ হয় কি না, সেগুলো নিয়ে মা’র অপার প্রশ্ন। এতদিনে বুঝি বউ দেখার ইচ্ছে হয়েছে? তৃণাকে ভিশালের কিছু জানানোর নেই! সে অর্ধেক খেয়ে ঠাণ্ডা চা’টা সিঙ্কে ঢেলে দিল।
সন্ধ্যেগুলোর নিভৃতি হারিয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিন কোনও অতিথি। খাওয়া দাওয়া, বিপুল হুল্লোড়। সেদিন সহকর্মী সুপ্রিয়া তৃণার অতিথি। সুপ্রিয়ার বর যশ টিপসি হয়েছে সামান্য। অবিরল ‘তৃণা ম্যাঁয় আপকী ফ্যান হুঁ! আপ ইতনী ব্রেভ হো, গ্রেট হো! ভিশ্‌ আপ সদা সলামত রহো। এ্যাইসী বিবি মিলী…’- অসহ্য বোধ হচ্ছিল ভিশালের। অপেক্ষা করছিল, কখন যাবে ওরা। খাবারে স্ন্যাক্স ছিল প্রচুর, সুপ্রিয়াও কিছু এনেছিল। তৃণা ককটেল বানিয়েছিল একটু কড়া করে। ভিশাল হার্ড-ড্রিঙ্কস নেয় না। এমনিতে হজমের গণ্ডগোল চলছে, খেতে পারল না বিশেষ কিছু। বাড়তি খাবার চটপট ফ্রিজে তুলেছে তৃণা। ডাইনিং টেবিলে বিশ্রীভাবে ছড়ানো খাবারের এঁটো টুকরো, খালি গ্লাস-প্লেট। পরদিন দুজনেরই অফ্‌ডে। কতদিন পরে আবার। এরকম রাতের জন্য আকুল থাকত দুজনে।
চাদর টেনে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছিল ভিশাল, মাথা যন্ত্রণায় ঝন্‌ঝন্‌। তৃণা ফুরফুরে, মদিরার প্রভাবে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মেক-আপ তুলে, নতুন করে সাজল। মনের মধ্যে কুলকুল ঢেউ। মহার্ঘ সুগন্ধির মৃদু সুরভি মাখল। ভিশ-এর বন্ধ চোখের পাতায় তিন বছরের উদ্দাম মায়াবী নিশি, নেগেটিভ ফিলম্‌স্ট্রিপের মতো। তৃণার শরীর এখন স্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী, স্বচ্ছ নাইটি আগ্রাসী। আজ তৃণার রাত, ভাষা বদলে চাওয়া। দিনগুলো বদলেছে, তৃণাও জানে, ভিশালও। তেমন কিছুই না, তবু অসহ্য লাগছিল ভিশালের। চোরাগোপ্তা কোন্‌ হীনমন্যতা।
(৬)
রাতবাতি নেভানোর বদলে, সবক’টা লাইট একসাথে জ্বালিয়েছিল তৃণা। ভিশাল একটু চোখ খুলেই বুজে নিয়েছিল। ধ্যানভাঙানো সংহার মূর্তিতে তৃণা। খামোকা রাগে ফেটেছিল ভিশাল,
“সুইচ্‌ অফ দ্য লাইট তৃণা – আমি বলছি।”
“নোপ্‌। আই নীড ইট্‌।”
“হেডেক মেরী – সরদর্দ হচ্ছে। বুঝতে পারছ না”? তেতো গলায় বলেছিল ভিশাল।
“মেরা দুসরা প্ল্যান হ্যায় আজ… আমরা নীট্‌ খাব, জল ছাড়া। ঠিক হয়ে যাবে তুমি। তারপর-” রঙ্গিনী হয়ে উঠেছে সহজ সরল মেয়েটা।
“বকওয়াস বন্ধ করে শুয়ে পড়ো। আয়্যাম নট ওয়েল।”
“সো হোয়াট্‌? সেরে যাবে। কতদিন আমারও শরীর ভাল থাকেনি ডার্লিং। তুমি তো ছাড়ো নি তখন? আই উইল মেক ইউ ফিল গুড্‌! শোনো না প্লিইজ্‌! লেটস্‌ ট্রাই ফর আ বেবি… এ্যাণ্ড আজ থেকেই।”
কি বলছেটা কি তৃণা? কান বুজে মরার মতো বিছানায় কাঠ হয়ে আছে ভিশাল। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিটা ভীষণ অচেনা বলেই ভয় করছে, গা ছমছম। নিজেকে আড়াল দিয়ে, নরম হয়ে সামলানোর চেষ্টা করল,
“তিন্নু, পাগল হয়ে গেছিস্‌। চল্‌, আভি সো জা জানু। সত্যিই যে মাথাটা… একটু বাম লাগিয়ে টিপে দে সোনা, আয় ঘুমোই।”
“ওঠো। উঠ যাও।” আশ্চর্য, তৃণা কি ভিশালের কাতরানো শুনতেই পেল না?
তৃণা হুমড়ি খেয়ে উঠে পড়েছে বিছানায়। হাঁটু গেড়ে বসে, শক্ত বাহুতে জাপটে ধরেছে ভিশালকে। ফোর-প্লের মূল ভূমিকায় সে। জোর করে নিজের ঠোঁট ঢুকিয়ে দিয়েছে ভিশালের ঠোঁটে। লালায় ভিজিয়ে দিচ্ছে। এতদিনে বুঝে নেওয়া সংবেদনশীলতায় উত্তেজিত করছে। ভিশাল স্বাভাবিক রিরংসায় দৃঢ় হয়ে উঠছে, অথচ মানতে পারছেনা। অসহায় লাগছে, তাই নিজেকেও অস্বীকার করছে। ঠেলে দিয়েছে তৃণাকে, প্রচণ্ড জোরে। যথেষ্ট বলশালী সে, তার কঠিন ধাক্কায় খাটের একপাশে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে তৃণা। ভিশাল উঠে বসে দাঁত পিষছে কশকশ,
“কেয়া তু আজ মুঝে রেপ করেগী শালী? রেণ্ডি কঁহি কা। ওই দিন শরীরে অন্য লোকের হাত ভাল লেগেছিল খুব, না?”
বাঁশের কঞ্চির মতো লম্বা হাতে ঠাসিয়ে এক চড় মেরেছে তৃণা। ফুঁসছে চোখের জলে, নাকের জলে।
“কী বললে ডরপোক্‌ হিজড়ে! আমাকে অপমান করছো – এত বড়ো সাহস! ওইদিন আমি না বাঁচালে কোথায় যেতিস? শর্ম আতী নহীঁ তুঝে? আমি সত্যিই চলে যাব, দেখে নিও।”
“বহুত ঘমণ্ড হয়েছে তোর! যা যা, কোথায় যাবার আছে। এখন তোর অনেক অনুগত… ফ্যান। লাভারস্‌। নিজেকে কি ভেবেছিস? বীরাঙ্গনা? বাইরের লোকের প্রশংসায় খুব গুদগুদি, না? ঢলে পড়িস!”
“ভিশ্‌ তুম্‌ – ইউ আর জেলাস্‌। তুমি হিংসে করে অপমান করছ আমাকে।”
ঠাণ্ডা নিবির্কার তৃণার স্বরে ঝাঁঝ, গলায় দুঃখ! ভিশাল কিচ্ছু দেখছে না, অকথ্য গালাগালির বিষ ছেটাচ্ছে। জমা রাগ, লুকনো নীচতার থকথকে দুর্গন্ধ ক্লেদ যেন পা দিয়ে ঠুকছে। চুপচাপ মাখছে, গিলছে তৃণা। নিঃশব্দে। বেশি কথা বলতে শেখে নি মেয়েটা। তার গলা নাক কান জ্বলছে। নাইটি কাঁধ খসে নেমে পড়েছে। আলুথালু করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সুন্দর সাজিয়ে তোলা নিজের শরীর, চাদর বালিশ বিছানা – পাশের অনাদৃত গেস্টরুম আর সংলগ্ন ব্যালকনিটায়!
জ্যোৎস্নার তিথি ছিল সেদিন, বাইরে আইটি শহরের ঘরবাড়ি আলো শুষে নিচ্ছে।
চিত্রণ – রু দাস

4 thoughts on “অন্য আকাশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.