মিত্রাভ ব্যানার্জি‌

মিত্রাভ “‘হয়তো পায়নি কিছু, যা পেয়েছে তাও গেছে খসে/ অবহেলা করে করে, কিংবা তার নক্ষত্রের দোষে”…!

y1
অবনের ব্যবহারে আচারে একপ্রকার নেতৃত্ব প্রচ্ছন্ন থাকে। দিতির প্রথম দিনই মনে হয়েছিলো। অবন কথা বলবে শ্রোতার চোখের দিকে তাকিয়ে, খুঁটিয়ে লক্ষ্য করবে মণির রঙ, গঠন, তারার হ্রাস বৃদ্ধি। অবন হাতদুটো রাখবে মুখের সামনে, এমন ভাবে যাতে তার আর তার শ্রোতার দৃষ্টিসংযোগ অক্ষুণ্ণ থাকে। হাতের ভঙ্গী দেখে দিতির প্রথম দিন মনে হয়েছিল যেন অবন সে হাত দুটো রেখেছে কোনো শিশুর মাথায়, কপাল চুম্বন করবে এবার বুঝি। আজ মনে হল সে যেন অদৃশ্য কিছু ভাসিয়ে রেখেছে তার করতলের চৌম্বক ক্ষেত্রে। অবন সামনে ঝুঁকে কথা বলে অবনের কনুই উরু স্পর্শ করে আছে। রমলা একবার আড়চোখে দেখে নিলেন, চা’টা জুড়িয়ে গেল বোধহয়। সুমিত বড় চেয়ারটায় বসে ছিলেন পরাস্ত সম্রাটের মত। অবন তার ভাষায় ভঙ্গীতে নেতৃত্ব আরোপণ করে গেল।
‘যদি আপনি সিঙ্গুলারিটিতে বিশ্বাস করেন, তাহলে জানবেন বিগব্যাং-এর আগে সমস্ত, যাকে আপনারা ব্রহ্মাণ্ড বলেন, তা একটা বিন্দুতে অবস্থিত ছিলো’, বিন্দু উচ্চারণের সাথে সাথে অবন বাঁহাতে তুখোড় চিত্রকরের তুলিকা ধারণের ভঙ্গী করলো, ‘আয়তনহীন। এই বিন্দু হলো একক। যাকে আর ভাঙ্গা যায়না। বস্তুকে ভাঙ্গলে অণু, অণুকে ভাঙ্গলে পরমাণু, পরমাণুকে ভাঙ্গলে, ইলেকট্রন, প্রোটন, কিন্তু এই বিন্দু সব বিভাজনের উর্দ্ধে। এই বিন্দু এক। এই বিন্দু ব্রহ্ম।’ এই মুহূর্তে অবনের বাম তর্জনী নির্দেশ করবে ডিসেম্বরের শীতের ছুটি পাওয়া পোলার পাখাটিকে। খানিক নীরবতা। অবন বুঝে নেবে তার বক্তব্য শ্রোতাদের বোধগম্য হয়েছে, চোখের ভাবে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। ‘এরপরে কোনো এক সময়ে এই বিন্দু, অস্তিত্ব যাই বলুন আয়তনে প্রসারিত হতে শুরু করে। সে এক অনন্ত প্রসারণ, তার আয়তন বৃদ্ধি পায়, তার জাড্য, তার শক্তি বৃদ্ধি পায়। এবং এক সময়ে সেই অস্তিত্ত্ব বিষ্ফারিত হয়, সৃষ্টি হয়, পরমাণু অণু ,জল, ম্যাগমা, নক্ষত্র। সৃষ্টি হলো পৃথিবী। তাতে প্রাণের সৃষ্টি হলো। প্রথমে অ্যামিবা, তারপরে উদ্ভিদ, উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী, মানুষ, প্রেম, হিংসা, দেশাত্ববোধ’। ঠিক এইখানে দিতি অতিকষ্টে হাস্য সংবরণ করে। কারণ অবনের সেই বাম তর্জনী। সেই অঙ্গুলিহেলনে তার প্রতিটি বিশেষ্য উদ্ভিদ, উভচর, সরীসৃপ বিশেষণে পরিণত হয়। আর মনে হতে থাকে সেই বিশেষণরাজি সুমিতের উদ্দেশ্যে প্রক্ষিপ্ত হলো। দিতি, দ্রোণ ছোটবেলা থেকেই সুমিতকে সমীহ করেছে, ভয় পেয়েছে। আজ এই সুখী শৈত্যপ্রবাহে তাকে উদ্ভিদ বা উভচর ভাবতে ভাবতে হাসি ঠেকিয়ে রাখা শক্ত।

‘অর্থাৎ লক্ষ্য করুন আমাদের, এই…ব্রহ্মাণ্ডের যাত্রা সরল থেকে জটিলে, এক আয়তনহীন অস্তিত্ব থেকে নক্ষত্রপুঞ্জ, মানব সভ্যতায়। এটাই আমাদের বেঁচে থাকার অর্থ জানবেন। এই যাত্রাটিকে সমর্থন করাই আমাদের জীবনধারণের উদ্দেশ্য। এই অ্যামিবা থেকে অমনিপোটেন্ট, অমনিপোটেন্ট থেকে অবলিভিয়ন, এই চক্রের আমি আপনি দিতি সবাই অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ কিন্তু অনপনেয় অংশ মাত্র।’
আশা করি আমরা মঞ্চসজ্জা বর্ণনা করার সুযোগ খুব পেছনে ফেলে আসিনি। দক্ষিণ কোলকাতার সাবেকি বসার ঘর। ঠিক ধরেছেন, পুরনো ব্যবহারে কিরকম খসখসে হয়ে যাওয়া মোজাইক মেঝে। জানলায় বাহারি গ্রিল, যেমনটা ৯০ সালের শুরুর দিকে চল উঠেছিলো। বর্গক্ষেত্র ঘর। পুবদিকে চায়ের টেবিল, তাকে তিনদিক দিয়ে উপদ্বীপের মত ঘিরে রেখেছে লম্বা সোফা ছোট সোফারা। মুখোমুখি দুই ছোট সোফায় অবন আর সুমিত। লম্বা সোফায় জ্যামিতিগত ভাবে দুজনের ঠিক মাঝখানে রমলা। টেবিলে চায়ের কাপ। যা এতক্ষণে সরাবৃত শীতল, অপেয় তরলে পরিণত হয়েছে বলে রমলার বিশ্বাস। পশ্চিম দেওয়ালের নীচে টেলিভিশান। অকর্মণ্য সিডি প্লেয়ার।তার ওপরে কয়েকটি অগোছালো ডালহৌসি ফুটপাথ থেকে কেনা শস্তার চাকতি ঝলমল করছে। পাশ দিয়ে ভেতর বাড়ির দরজা, কাঠের পাল্লা। উত্তরে প্রবেশদ্বার। বাইরে নিশ্চই একটা বারান্দা আছে। অভ্যাগতরা যেখানে জুতো ছাড়বেন। দরজার পাশেই বাঙালি সভ্যতার শিখর সেই শোকেস। কাঁচের স্বচ্ছতা মরে এসেছে। অন্দরে শান্তিনিকেতনী গম্ভীর রবীন্দ্রনাথ, মেলার খোল ও সানাই বাদক, বেগুনি কুৎসিত বেড়াল আর পিসার মিনার বয়সভারে ন্যুব্জ। দক্ষিণ জানলায় দিতি দাঁড়িয়ে ছিলো। এই দাঁড়িয়ে থাকাটুকু লক্ষ্য করবেন। সুদূর রুশ দেশে এক বিশেষ মনোস্তাত্বিক বিশ্লেষণের চল আছে। যেখানে ঘর ভর্তি চেনা অচেনা মানুষকে মনোবিদ তাঁদের নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় দাঁড়াতে বা বসতে অনুরোধ করেন। কেউ কারো কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়, কেউ কারো থেকে শতহস্ত দূরে গিয়ে বসে। কেউ অস্বস্তিতে অচেনা কারো পানে চায়, কেউ অপেক্ষা করে। আলোকরশ্মিতে ধূলিকণার মত অপরিকল্পিত সেই চলাচল। এই মানুষ-মানুষের অবস্থান, বিশ্বাস, অকারণ বিতৃষ্ণা, প্রতিটি সতর্ক পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করেন মনোবিদ। বেরিয়ে আসে মানুষগুলির বিশেষত্ব। আজ কোলকাতার এই কক্ষে এই শীতের বিকেলে বিধাতা বুঝি চারজন মানুষকে কঠিন সেই পরীক্ষার মুখে ঠেলে দিলেন। তাদের অবস্থানে স্পষ্ট এই ঘরের শক্তির বিন্যাস সোফায় ঠিক মাঝখানে বসা রমলাকে অক্ষ করে। এক মেরুতে অবন, অন্য মেরুতে সুমিত। মাঝের চায়ের টেবিলটাকে আমরা পানিপথ বা পলাশী কল্পনা করতে পারি। বাকি রইল দিতি। বর্তমান অবস্থানে তাকে সোফার কোনো একট প্রান্ত পছন্দ করে নিতে হয়। সুমিতের প্রান্ত বা অবনের। বোঝা যাচ্ছে, নিশ্চই দিতিও জানে তার সেই প্রান্ত নির্বাচন ঘরের শক্তির বিন্যাস এলোমেলো করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যে প্রান্তে দিতি, তার অন্য প্রান্তে এক অক্ষৌহিণী সৈন্যও দুর্বল প্রতিপন্ন হবে বোধহয়। কিন্তু স্পষ্টতই দিতি কোনো পক্ষ অবলম্বন করেনি। অনিচ্ছা? নিস্পৃহা? জেদ? অপেক্ষা করুন, কাহিনীতে আরো কিছুদুর অগ্রসর হওয়া যাক।
‘অর্থাৎ আমাদের এই দৈনন্দিন জীবনযাপন নিরর্থক নয়। আপনি প্রতিদিন সকালে বিছানা ছাড়ছেন, পারিপার্শ্বিক থেকে জ্ঞান আহরণ করছেন, সেই জ্ঞান বন্টণ করে নিচ্ছেন, সন্তান উৎপাদন করছেন, সেই অমোঘ যাত্রাপথটিকে সমর্থন করার জন্যই’। বংশবৃদ্ধির উল্লেখে রমলা ঈষৎ ভ্রূকুঞ্চন করেন। ঠান্ডা চায়ের কাপ যা পলাশী বা পানিপথের একপ্রান্তে পড়েছিলো, অমর্যাদায় তাকে ঠেলে যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে অবস্থিত করালেন। যাতে তা অবনের গোচরে আসে। সন্তর্পণে। যেন দাবার ছকে কোন সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে গেল। অপচয় রমলা কোনদিনই সহ্য করেননি।
‘আমি আপনি সবাই এই ব্রহ্মাণ্ডে এই একটি কারণে অবস্থান করছি জানবেন’। অবনের বাম তর্জনী ফের পোলার পাখায় স্থির হলো। ‘তাহলে আমার আপনার, দিতির আর…আর এই চায়ের কাপের মধ্যে তফাৎ কোথায়?’ শতরঞ্জের সূক্ষ্ম চালটি সফল হয়েছে দেখে রমলার ভ্রূভঙ্গী স্বাভাবিক হলো। ‘তফাতটা হলো ‘আমি’ ভাবের। আমরা বিশ্বাস করছি যা দেখছি তা আমি দেখছি, যা শুনছি তা আমি শুনছি, আমি ভাবছি, আমি অনুভব করছি। এই-ই উপনিষদের অহং। আমি। আমরা মৃত্যুতে ভয় পাই সেই অহংবোধ নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে। ‘আমি’ এই অস্তিত্ত্ব লোপ পাবে ভেবে। গৌতম বললেন এই অহং-এর বিনাশ নেই। তার বাইরের অবয়ব পরিবর্তন হতে পারে। অ্যামিবায় জলপোকায়, অন্য মানুষে। কিন্তু আপনার এই অহংবোধ আপনার কাছেই সুরক্ষিত থাকবে। কতক্ষণ? যতক্ষণ না সেই নির্বাণ লাভ হচ্ছে।’ অবন চায়ে চুমুক দিলো। দ্রুত আড়চোখে চাইলো রমলার দিকে। রমলা ইস্পাতকঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। সেই দৃষ্টির সামনে আগেও বহু পুরুষ পরাস্ত হয়েছেন। অবনও দ্বিতীয় সংক্ষিপ্ত চুমুকটি দিতে বাধ্য হলো।
‘এখন প্রশ্ন হলো নির্বাণ কি? অনন্ত স্বর্গবাস? অপার ভোগসুখ? অগণিত সুন্দরী কুমারী? (রমলার ভ্রূকুঞ্চণ) না, বিশ্বাস করুন, না। নির্বাণ হলো এই সরল থেকে জটিলে যাত্রাপথের অন্তিম বিন্দু। যা একই সাথে জটিলতম আবার সরলতম। একক অস্তিত্ব অথচ আয়তনহীন ভরহীন। নির্বাণে আমাদের অহং বিনষ্ট হবে জানবেন। আপনার অহং, আমার অহং মিশে এক হয়ে যাবে। তখন আপনার দৃষ্টি আমার, আমার অনুভূতি আপনার। তখন আমি, আপনি আর…জড়বস্তুতে (তৃতীয় চুমুক) আর পার্থক্য থাকবেনা। সেইই ব্রহ্ম। অ্যাপেক্স অফ কমপ্লেক্স এক্সিস্টেন্স, সিম্পলার দ্যান দি সিমপ্লেস্ট। আমাদের মৃত্যু নেই।’
‘আর প্রিয়জন?’ সুমিতের প্রশ্নে দিতি ঈষৎ শিহরিত হয়। এতক্ষণ যে নিস্পৃহ দৃষ্টি জানলার বাইরে পিচপথে চেয়ে ছিলো তা হঠাৎ নিবদ্ধ হলো অবনের মুখে। ‘প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমরা বিচলিত হই কেন? নিজের মৃত্যু নয় বুঝলাম তোমার এই অহং নষ্ট হবার ভয়ে, কিন্তু অন্যের মৃত্যু? তার কথা ভেবে আমরা ভয় পাই কেন?’
অবন ভুরু ওপরে তোলে, চোখ বন্ধ করে হাসে, মাথা নাড়ে ওপরে নিচে। যেন অতীতের তুচ্ছ কোনো সমস্যার তুচ্ছতর সমাধান মাথায় এসেছে। ‘আপনি যাকে প্রিয়জন বলছেন, নেভিগেশানের ভাষায় তাকে বলে বিয়ারিং। অনন্ত আকাশ আর মহাসাগরের মাঝে এক জাগতিক বস্তু যেটা আপনার পয়েন্ট অফ রেফারেন্স। যাকে স্থির কল্পনা করে আপনি আপনার অবস্থান অনুমান করেন। আমাদের যদি জন্মাবধি সাদা ছয় দেওয়ালের ঘরে বন্ধ রাখা হতো তাহলে আমরা অস্তিত্বহীন হতাম। একটা বিশাল গ্রাফপেপেয়ারে কোনো একটা বিন্দুর মতো। কিন্তু আমাদের প্রিয়জন, জন্মস্থান, ছোটবেলার স্মৃতি এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান নিজেদের কাছে নিজে বর্ণনা করেছি। মানে সেই গ্রাফ পেপারে এক্স অক্ষ আর ওয়াই অক্ষ টেনে সেই বিন্দুর অবস্থান, কোঅর্ডিনেট হিসেব করেছি। তাই চেনা মানুষের মৃত্যু হলে, আইফেল টাওয়ারে বোমা পড়লে, কাশ্মীর হাতছাড়া হলে, বন্ধুর বাবা ট্রান্সফার নিয়ে ভিনরাজ্যে গেলে আমরা কষ্ট পাই, শঙ্কিত হই আমাদের চেনা পয়েন্ট অফ রেফারেন্সগুলো ওলটপালট হয়ে যায় বলে। আমাদের সেই অহং ধাক্কা খায় বলে। আমরা নিজেদের যেভাবে কল্পনা করেছিলাম, অমুকের সন্তান, তসুক পাড়ার ছেলে, চীনের পাঁচিলসজ্জিত এক গ্রহের বাসিন্দা, আনন্দবাজারের একনিষ্ঠ পাঠক ইত্যাদি সেই ভাবনা গোলমাল হয়ে যায় বলে।’
ঘরে খানিক্ষণ নীরবতা জারি থাকে। রমলা অনুমান করেন বক্তব্য শেষ। মৃদু শ্বাস ফেলে বলেন ‘বাবা, তুমি সারাক্ষণ এরকম উপন্যাসের ভাষায় কথা বলো নাকি?’ অবন উত্তর দেয়না। পেয়ালা তার হাতে ধরা থাকে। অবন দিতির দিকে তাকায়। ভুলে যাবেন না, দিতির দৃষ্টি এতক্ষণ তার মুখে স্থির ছিলো। সুমিতের প্রশ্নের কি উত্তর আসে তার অপেক্ষায়। আশা করা যায় দিতির সেই দৃষ্টি নিক্ষেপ অবনের অজানা ছিলোনা। এই তাত্ত্বিক বক্তৃতার পর অবন দিতির দিকে তাকাবে কেন? তারিফ কুড়োতে। তার চোখে গর্ব থাকবে, যুদ্ধ জয়ের শ্লাঘাও।
অবনের ঠাকুর্দা শ্রাবণ মাসে মারা যান। অবনের এই ব্রহ্মবাদ দিতি তার আগেই শুনেছে। বোঝবার চেষ্টা করেছে। দিতি আশা করেছিলো, চেয়েছিলো মৃতপ্রায় বৃদ্ধ যখন শূন্যদৃষ্টিতে দেওয়ালে তাঁর মায়ের শুকনো চন্দনলিপ্ত ছবির দিকে তাকিয়ে, তখন অবন হেঁটে যাবে সন্তের মতো। বৃদ্ধের শিরা উপশিরায় কাহিনীময় হাত নিজের হাতে নিয়ে সুকন্ঠে বলবে ‘ফিরে যাও। আলো পেও’ আজ আমি আর তুমি শরীরে সত্ত্বায় এক হয়ে গেলাম জেনো।’ অবন তখন কাঁদেনি। অশ্রুসংবরণ করেছিলো। পরে ওপরের ঘরে আর বাঁধ রাখতে পারেনি। গাল ভিজে গিয়েছিলো জলে। নাকের কুৎসিত তরল ওপরের ঠোঁটের শালীন সীমা লঙ্ঘন করেছিলো। শ্বাস নেওয়ার জন্য মুখ খুলতে মুখগহ্বরে প্রকট হয়েছিলো লালাতন্তু। সেই কদর্য কান্নায় অবন দিতিকে বলেছিলো ‘এই একটা মানুষ কোনোদিন আমার কাছ থেকে কিছু ফেরত চায়নি, টাকাপয়সা, ভালোবাসা, সময় কিচ্ছু না। খালি বলেছে ঠান্ডা লাগাসনি দাদুভাই। আমি ঠান্ডা লাগাইনি।’ সে সত্যভাষণ ছিলো। এই মৃত্যুতে অবনের পার্থিব অবস্থান, বা অহং বিপন্ন হয়নি। বাকি জীবিত মানুষেরা আজীবন তার কাছে দাবী রাখবে, তার কাছে প্রার্থনা করবে, যাচনা করবে জেনে অবন শোকাচ্ছন্ন হয়েছিলো। তবু সে সত্যভাষণ ছিলো।
পরদিন সুমিত অফিসে, রমলা স্কুল থেকে ফেরেননি। অবন দিতিকে অফিস থেকে ডেকে নেয়। অবন দিতির কাছে দিতির দেহে আশ্রয় চেয়েছিলো। অবন আদর করেছিলো, জোর করেছিলো, অন্যায় করেছিলো। সেই অত্যাচার দিতি সহ্য করেছিলো, মেনে নিয়েছিলো, প্রতিশোধ কামনা করেনি কেবল অবনের চোখে চেয়ে। কি ভয় কি আকুতি ছিলো সেই চোখে। দিতি জানে সেইই মৃত্যুভয়। সেইই ডুবন্ত মানুষের সন্তরণের আকুতি। আজ এই মূহুর্তে দিতির রমলাকে বলতে ইচ্ছে করছে ‘না অবন মিথ্যেবাদী। অবন উপন্যাসের ভাষায় নয়, কোলকাতার যুক্ত উচ্চারণ কলঙ্কিত, বিদেশী শব্দ আর ইতর অঙ্গভঙ্গীনির্ভর ভাষায় কথা বলে। অবনের ভাষাই প্রমাণ করছে, তার যুক্তি সাজানো। তার বক্তব্যের মহড়ার পর মহড়া হয়েছে এর আগে।’ সেদিন দিতির নিজেকে অত্যাচারিত মনে হয়নি। বরং আশ্রয়দাত্রী রূপে নিজেকে দেবী, মহীয়সী বলে মনে হয়েছে। আজ এই মুহূর্তে তার নিজেকে পদস্পিষ্ট ধর্ষিত মনে হতে থাকে। দিতি অবনের চোখে চেয়েছিলো। সে চোখে গর্ব নেই। উন্নাসিক শ্লাঘা নেই। বরং দিতি সেইদিনের সেই আকুতি, সেই ভিক্ষাপ্রার্থনা আবিষ্কার করবে অবনের চোখে। দিতি মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগে মৃদু হাসবে। সেই হাসিতে করুণা ছিলো, সমবেদনা ছিলো, প্রশ্রয় ছিলো, কিন্তু দিতি আর অবনের প্রেম, যে প্রেম নিয়ে আপনি, আমরা যুগজয়ী মহাকাব্য লেখা হবে বলে অনুমান করেছিলাম সেই প্রেমের তিলমাত্র অবশিষ্ট ছিলো না। দিতি মুখ ফিরিয়ে নেয়। দিতি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাইরে মন্বন্তরে, মতবাদে, দাঙ্গায়, মশায় ধ্বস্ত শহরের সূর্যাস্ত আসে ধীরে।
***
উপরের ছবি: সৌম্যদীপ সেন
***

2 thoughts on “দিতির পুরুষেরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.