কারেন রাসেল (সেন্ট লুসি’জ হোম ফোর গার্লস রেইজড বাই উল্ভস)

অনুবাদ – মধুশ্রী বসু

প্রথম স্তর : গুরুমা’র কৃপায় বালিকাদিগের চিত্তে আশ্রমের সমস্ত কিছুই নূতন, উৎসাহব্যঞ্জক ও মনোমুগ্ধকর বলিয়া প্রতিভাত হইবে। এই স্তরে, নূতন পরিবেশে উহারা স্বেচ্ছানুসারে ঘুরিয়া বেড়াইবে। ইহাই বিধেয়। – সাধ্বী ঠাকুরাণীর ‘চতুষ্পদ বালিকা পালন’ হ্যান্ডবুক থেকে।

.

প্রথম-প্রথম আমরা মহানন্দে মাটি কাঁপিয়ে গরগর ফুটছি, লোম উড়ছে। বাপ-মায়েদের যে কথা দিয়ে এসেছিলাম – ভদ্রসভ্য ব্যবহার করব, বড়দের কথা শুনব, ভালো বাড়ির মেয়েদের মতো মেপে মেপে কথা কইব – সেসব মাথায়ই নেই। আশ্রমের কেঠো ঘরগুলোকে তছনছ করে, গেরুয়া ছোপানো থানে নাক ঘষে, লাল ফেলে, উঁচু ক্লাসের মেয়েদের মাড় দেওয়া জাঙিয়া খামচে-ছিঁড়ে, আলোর বাল্বগুলোকে এক-এক থাবার ঘায়ে চুরচুর করে দিচ্ছি। অন্ধকারই ভালো, অন্ধকার আমাদের চেনা। আলো-আঁধারি শোবার ঘরটার কোনো গন্ধ নেই, তাতে কোনো জানলা নেই। আমরা তাই পা তুলে-তুলে দেয়ালে-মেঝেতে-বিছানায় হলুদ তরলের বন্যা বইয়ে দিচ্ছিলাম। প্রতিটা বাঙ্কে। এক বাঙ্ক থেকে আরেক বাঙ্কে লাফিয়ে যাওয়ার সময় মাঝ-আকাশে একে অন্যের নাকে নাক ঘষে দিচ্ছিলাম, শরীরে শরীরে ধাক্কা খেয়ে আমাদের হা-হা হাসি ছিটকে যাচ্ছিল ঘরময়। সাধ্বীরা ঘরের কোণ থেকে চুপচাপ আমাদের দেখে যাচ্ছিল। মুখে চাপা বিরক্তি।

“জয় মা”, প্রভাময়ী মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন – “আপদবালাই দূর করো মা…”, বলে গলার আঁচল টেনে দেয়ালে বড়মা’র ছবির দিকে তাকিয়ে জোড় হাত কপালে ঠেকালেন কয়েকবার। প্রভাময়ী মা ঠাকুরাণীর এই থানে এসেছেন টাউনের দিক থেকে বদলি হয়ে। সেখানে আমাদের মতো মেয়েরা নাকি সব মোটকা-সোটকা লক্ষ্মী, হাত থেকে কলা খায় – তা-ও খোসা ছাড়ানো, বিচিও ফেলে। এমনকি নীচের ক্লাসের মেয়েদের অব্দি লোম চকচকে জটহীন – এত ধবধবে, যে লোম বলে চোখেই পড়ে না প্রায়। আমাদের লোম মেটে-বাদামী, ময়লা, জট পড়া। চলাফেরার ছিরিছাঁদ নেই। কড়া ওঠা হাতপায়ে মাটির চাতাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছি, কথায় কথায় বেরিয়ে আসছে দাঁত। ছোট্ট-ছোট্ট, ছাতা পড়া, ধারালো দাঁতের সারি। জয়া-মা সাধ্বী ফোঁত করে নাক টানলেন। তারপর হলুদ-ছোপানো আঁচলে ফাঁস পাকাতে-পাকাতে মিষ্টি হেসে প্রভা-মা’কে বললেন, “এই থানে যেগুলোকে আনে না দিদি, সব আড়ার জঙ্গল থেকে তোলা। একটু বুনো তো, তাই একটু ধৈর্য রাখতে হয়।” আমি জয়া-মা’র পায়ের গোছ জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। দাঁত বসাতে গিয়ে মোটা ক্যানভাসের চটিতে চোয়াল আটকে গেল। জয়া-মা’র স্বাদ ঘাম আর ফুসকুড়ির মতো। গন্ধে মনে হয়, একে বেশ সহজেই খেয়ে ফেলা যাবে।

আমরা মোটে সেদিন সকালেই বন থেকে সোজা ঠাকুরাণীর থানে এসেছি। পনেরো জনের দল। সঙ্গে একজন শুঁটকে লোক – নাকি সমাজের ভালোর জন্য কাজ করে – অথচ গা থেকে পরিষ্কার ভয়ের গন্ধ বেরোচ্ছিল। এছাড়া ছিল আড়ার জঙ্গলের পশ্চিম দিকের নতুন মন্দিরের পুরোহিত – বামুন, ফ্যাকফ্যাকে ফর্সা, ভুরু-টুরু নেই। আর ছিল বাঘা বলে মস্ত একটা কুকুর আর চারজন তাগড়া চাষী। ওই পুরোহিতই তো আমাদের হাতে দুটো করে ছ্যাতলা পড়া কেক দিয়ে কি যেন অংবং মন্ত্র পড়ল, তারপর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমাদের নিয়ে চলল। পথে বড় গুহায় রসটম্বুর মৌচাকগুলো দেখতে পেলাম। তারপর শালকাঠের গুদাম পেরিয়ে যখন সাধ্বী ঠাকুরাণীর মন্দিরের সন্ধ্যারতির শব্দ আমাদের কানে, ধূপধুনোর গন্ধ আমাদের নাকে, তখন খালপাড়ে দাঁড়িয়ে পুরোহিতটা সেই বাঘা কুকুরের পাহারায় আমাদের ভাইদের লাইন করে আলাদা করে দিল। আর তাদের নিয়ে পাড়ে বাঁধা একটা নৌকোয় চড়ে দাঁড় বাইতে শুরু করে দিল। আমরা মেয়েরা রয়ে গেলাম খালের এপারে। দৌড়ে এদিক যাচ্ছি, ওদিক যাচ্ছি, কামড়াকামড়ি করছি – গায়ে মোটা কাপড়ের নতুন জামাগুলো কুটকুট করছে। গলুইয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাইয়েদের হকচকিয়ে যাওয়া মুখগুলো ছোট হতে-হতে একসময় মিলিয়ে গেল।

আমাদের বাপমায়েরা – নেকড়ে-মানুষ। বনের ধারে সারি-সারি গুহায় না-মানুষ, না-পশু হয়ে থাকা। একদিকে ঝড়জল-শীতগ্রীষ্ম, অন্যদিকে গ্রামের মানুষের বল্লম-কাটারি। স্থানীয় চাষিরা ওদের গ্রামে ঢুকতে দেয় না। ওরা নাকি ভাঁড়ারে থাবা মেরে পিঠেপুলি খেয়ে যায়, বাছুরগুলোকে ভয় দেখায়। অথচ ওরাই আবার স্থানীয় নেকড়েদের গ্রামের বার করে রাখে, মানে যারা পুরোপুরি পশু আর কি। তার কারণ হয়তো নেকড়ে-মানুষদের হাতে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বুড়ো আঙ্গুল, হৃদয়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কী এক অনুশোচনা, বা মানুষের বাচ্চার মতো চেহারা নিয়ে গজিয়ে ওঠা ওদের ছানাপোনা (না-মানুষী অবস্থাটা মাঝে-মাঝে এক প্রজন্ম ছেড়ে পরের প্রজন্মে দেখা দেয়)। আমাদের কচিদের দলটা ভাঙাচোরা পুরনো মন্দিরটার খাঁচার মতো ঘেরা চাতালে বড় হয়ে উঠেছিল। যাদের গায়ে শুদ্ধ নেকড়ের রক্ত, তাদের সাথে আমরা পেরে উঠতাম না ঠিকই, কিন্তু হামা দিয়ে চারপায়ে চলতে ছাড়িনি কখনো। গরগর গর্জন আর সমবেত হুল্লাট ডাকের সাথে আমাদের মোটা জিভে ভাঙা-ভাঙা স্থানীয় শব্দ মিলিয়ে আমাদের নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বাপ-মা’রা চাইত, যে আমাদের একটা হিল্লে হোক। আমরা আমাদের আঁকাবাঁকা দাঁতে ক্লিপ পরি, নরম তোয়ালে দিয়ে গা মুছি, নেকড়ের ভাষা আর মানুষের ভাষা আলাদা করে শিখে পুরোপুরি দ্বিভাষী হয়ে উঠি। ঠাকুরাণীর আশ্রম থেকে ওরা যখন এল, বাবা-মা’রা একটু লোভে পড়ে গেল। যে সাধ্বীরা এসেছিল, তারা বলল, আমাদের নাকি মানুষ-সমাজের স্বাভাবিক ও অনস্বীকার্য সদস্যপদ দেওয়া হবে। দেওয়া হবে সভ্য ও সুন্দর সংস্কৃতিবোধ। অথচ আমরা যে বাবা-মা’দের আর কোনোদিন চোখের দেখাও দেখতে পাব না – এটা না আমরা জানতাম, না বাবা-মা’রা নিজেরা বুঝতে পেরেছিল।

প্রথম সন্ধ্যেটা সাধ্বীরা আমাদের আশ্রমের গ্র্যানাইটের পাথরের পাঁচিলে ঘেরা মাঠটাতে চরতে দিয়েছিল। সবই তখন আমাদের কাছে নতুন কিনা? তাই কি উৎসাহ আমাদের। যা দেখছি – মুগ্ধ! পাঁচিলের ওপারে নীলচে জঙ্গল মাইলের পর মাইল জুড়ে গুনগুন করছে। মাঠের মাঝখানে একটা মার্বেল পাথরের বেদী দিয়ে ঘেরা ঝর্না, তাতে কতরকমের পাখি উড়ে এসে বসছে, লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সাধ্বী মায়ের একটা মূর্তিও রয়েছে। তাঁর শ্বেতপাথরের চামড়া আমার মা’র নাকের ডগার চাইতেও শীতল, মণিহীন চোখ আকাশের দিকে তাক করা, পাথরকঠিন পায়ের আঙ্গুলে বোকা কাঠবেড়ালিরা এসে কুরকুর করে দাঁত বসাচ্ছে। ভাইদের হারিয়ে আমাদের দলটা আধাখ্যাঁচড়া হয়ে গেছিল। মাঠে নেমেই আমরা একসাথে আকাশের দিকে মুখ করে ডেকে উঠলাম। নেকড়ে ভাইদের গলাগুলো তাতে যোগ দিয়ে উঠল না ঠিকই, তবু আমাদের সমবেত ডাকে তখনো একটা বীভৎস উল্লাস। এদিকে মাঠময় ছোট-ছোট গর্ত।

গর্তগুলোর কয়েকটাকে তখনই বুজিয়ে ফেলা গেল। কাঠি বা বাখারির চোঁচ, আমাদের নতুন জামার ছেঁড়াখোঁড়া টুকরো, ক’টা মাথামোটা কাঠবেড়ালি যারা আমাদের সাথে  ভাব জমাতে এসেছিল, তাদের হাড়গোড় – এইসব গুঁজে। এদিকে কেউ যেন অদৃশ্য থেকে আমাদের নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে চলেছিল। কি যে অসুবিধাজনক অবস্থা সেটা! সমস্তকিছুতে একটা মানুষ-মানুষ গন্ধ – রান্নার মশলা, হাতরুটি, পেট্রল, ধূপধুনো আর তেলের ভারি গন্ধের নীচে আবার সাধ্বী-মায়েদের মেয়েলি ঘামের গন্ধ। আমরা একে-অন্যের গন্ধও পাচ্ছিলাম – কিন্তু সে-ও কেমন নতুন বলে মনে হচ্ছিল। আসলে এই অদ্ভুত জায়গাটায় এসে আমাদের নিজেদের গন্ধগুলোই অদ্ভুত অচেনা লাগছিল।

সবে গরম-গরম খেয়ে, দুপুরবেলার ঝিম রোদে গা এলিয়ে চোখ লেগে আসতে শুরু করেছে, অমনি সাধ্বীরা এসে আমাদের ঘিরে ধরল। প্রথমে বহেড়া গাছটার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেখিয়ে-দেখিয়ে ফিসফাস করে কি কি সব বলল। তারপর এগিয়ে এল। আমাদের বড় বোন তখন ঘুমের ভিতর ভিরকুটি করছে, এপাশ-ওপাশ, দাঁত কিশকিশ। তার স্বপ্নে তখন ঠিক তিন হাত দূরে একটা মোটাসোটা বুনো খরগোশ থমকে আছে, ভয়ে নড়াচড়া করতে পারছে না (আমরা সেসময় দল-কে-দল একই স্বপ্ন দেখতাম, যেমন একই ঝর্নার জল খেতাম, একই পাথুরে মাটিতে শুতাম)। সাধ্বীদের এগিয়ে আসতে দেখে বড় বোন কিছু ভাবার আগেই ফ্যাঁশ করে রোঁয়া ফুলিয়ে উঠল। রোঁয়া ফুলোনোটা অবশ্য কথার কথা – কেননা তার পরনে তখন মানুষের বেশ। তবু সে তার থাবা দিয়ে নিজের বাদামী চুলের ঝোপটাকে খামচে খাড়া করে টেনে ধরল। প্রভা-মা’র মুখে কাঁপা-কাঁপা হাসি।

“তোর নাম?”

অমনি আকাশে নাক তুলে চিৎকার – হয়তো তাতে কিছু শব্দও ছিল, কিন্তু ভয়-যন্ত্রণার জটপাকানো গোঙানি থেকে তাদের আলাদা করা যাচ্ছিল না। আবার আধো-বিস্মৃত শিকারের রাত আর গ্রহণ লাগা চাঁদের গল্পও তাতে মিশে ছিল। প্রভা-মা বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে একটা হলদে স্ট্যাম্প মারা হলুদ কাগজের আইনি খাতায় ‘আমার নাম ………………’-এর ফাঁকা জায়গাটায় লিখে বিড়বিড় করে পড়ল – “মি-ন-তি… আমার নাম মিনতি।”

দলের বাকি সবাই আমরা একটা ঢিলেঢালা বৃত্ত বরাবর ঠিক কিছু বুঝতে না পেরেই একটা অজানা দুশ্চিন্তায় দৌড়ে বেড়াচ্ছিলাম – একদিকে বড় বোনকে সাহায্য করার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, অন্যদিকে কেমন একটা নতুন রকমের ভয় – সামনে একটা বিপদ আসছে। হলুদ খাতায়, অজানা ভাষায় লিপিবদ্ধ একটা বিপদ।

আমাদের সবচাইতে ছোট বোন – সে সবথেকে চটপটে। দুহাতে নিজের কানদুটোকে রগের দুপাশে চেতিয়ে দিয়ে, বাগানের একদম দূরের একটা কোণায় সেঁধিয়ে একটা আট বছরের ছোট্ট নেকড়ে-মেয়ে যতটা ভয়ঙ্কর মুখ করে চাপা গর্জন করে যেতে পারে, সে ঠিক তা-ই করছিল। ধরতে যেতেই ছুট। প্রায় দু’ঘণ্টা পরে তাকে পাওয়া গেল। মাটিতে পেড়ে ফেলে তার পরিচয়পত্র জামায় পিন দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হল : ‘আমার নাম বেলকুঁড়ি।‘

“প্রথম স্তর…” – প্রভা-মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্দুকে একটা ঘুমপাড়ানি তীর তাক করতে করতে বললেন – “…বড় তেজ বাড়িয়ে দেয়। সবই তাঁর লীলা, মা গো।”

.

দ্বিতীয় স্তর : গুরুমা’র কৃপায় বালিকাদিগের উপলব্ধি হইবে, নূতন সংস্কৃতির সহিত উহাদিগের মানানসই হইয়া উঠা আবশ্যিক। ইহা এক অস্বস্তিজনক প্রক্রিয়া, যাহার প্রভাবে ছাত্রীদের পরিচিত গৃহ, পরিবেশ, খাদ্য ইত্যাদির অভাবে কাতর হইয়া পড়িবার সম্ভাবনা রহিয়াছে। দিবসের বৃহদংশ উহারা দিবাস্বপ্ন দেখিয়া কাটাইতে পারে। একাকীত্ববোধ, বিরক্তিবোধ, বিস্ময়বোধ, অবসাদ ও সাধারণ ভাবে অস্বস্তিবোধের প্রকোপ অধিক হইবার প্রবল সম্ভাবনা।

.

সেসময় আমরা সারাদিন নদী আর কাঁচা মাংসের স্বপ্ন দেখতাম। পূর্ণিমার রাতগুলো ছিল সবচেয়ে ভয়ানক। স্যাঁতস্যাঁতে পায়খানা আর সেদ্ধ শাকের চাইতেও, আমাদের নকল নতুন নামগুলোকে উচ্চারণ করতে গিয়ে জিভে জট পড়ে যাবার চাইতেও বিশ্রী। কারণ ছাড়াই আমরা একে অন্যের উপর খিঁচিয়ে উঠছিলাম। নীচে তাকিয়ে চারটের জায়গায় দুটো পা – তা-ও চটি পরা – এই অদ্ভুত দৃশ্যটা আমাকে প্রতিবার চমকে দিত। “মুখ বন্ধ, মুখ বন্ধ, মুখ বন্ধ…” – আমি হাঁটার ক্লাসগুলোতে নিজেকে বলেই চলতাম – দুচোখ সোজা সামনের দিকে, উপরনীচ নয়, সামনে – “মুখ বন্ধ, চটিতে পা, মুখ বন্ধ, চটিতে পা… চটিতে মুখ নয়, না! না! দাঁত নয়! চটিতে দাঁত নয়! শুধু পা!“ আমি যেন স্বপ্নের মধ্যে হাঁটছিলাম। আমার মুখ ভর্তি চটির ময়লা। আমাদের গোটা দলটা তিতিবিরক্ত, অবসাদগ্রস্ত। স্বস্তি নেই, অস্বস্তি প্রকাশের ভাষা নেই, নতুন ভাষাশিক্ষার বইগুলোতে আঁকড়ে ধরবার মতো কোনো শব্দ নেই। এত তীব্রভাবে পালিয়ে যাবার ইচ্ছে আমাদের আর কখনো হয়নি। কিন্তু পালিয়ে যাব কোথায়? আমাদের মায়ের কালচিটে মুখে ভ্যাংচানো দাঁত আর বাবার দু’থাবায় ধরা বাদামী লোমে ভরা মস্ত মাথাটা। ফিরে যাব! তাতে ওদের বিশ্বাসভঙ্গ হবে না? ওরা যে মরা শজারুর চর্বিওয়ালা পেটের মাংসটা সবসময় আমাদের জন্য রেখে দিত। যখন আমাদের লোম ওঠেনি, আমাদের ন্যাড়া গোলাপি ঘেন্নাটে পুঁটলির মতো শরীরগুলোকে ওরা ভালবেসেছিল। সদ্য লাফাতে শিখে, ভোরের শিশির পড়া ঘাসের শীষ টপকে লাফাতে গিয়ে আমরা যখন গড়িয়ে পড়তাম, তখন আমাদের নাক দিয়ে ঠেলে ঠেলে খাড়া করে দিত ওরাই। শেষে সাধ্বী-মায়ের আশ্রমে ঠেলে দিল, শুদ্ধু যাতে আমাদের ভালো হয়, তাইজন্য।

এটা যদি খালি ওই মাঠের চারধারের নিচু পাঁচিলটা টপকে যাবার ব্যাপার হত, তাহলে আমরা কেউ এখানে এতক্ষণ পড়ে থাকতাম না। জয়া-মা কাঠের দরজাগুলোতে হুড়কো অব্দি দিতেন না। জানলার পাল্লা হাট করে খোলা, যাতে জ্যোৎস্না রাতে জঙ্গলের হাতছানি দেওয়া ডাক আমরা পরিষ্কার অনুভব করতে পারি। কিন্তু আমরা তো জানতাম, আমরা জঙ্গলে ফিরে যেতে পারব না – যতক্ষণ না আমরা সভ্য হই, যতক্ষণ আমাদের ফিরে আসতে দেখলে আমাদের মা’র মনে হতে পারে – সব পণ্ড হল। গোটা মানুষ জাতটা যেন ষড়যন্ত্র করে আমাদের এই অবস্থায় টেনে ফেলে মজা দেখছিল।

আশ্রমের স্যাঁতস্যাঁতে উদোম শোবার ঘরটাকে ‘নিজের ঘর’ বলে ভাবা অসম্ভব। আমরা তো প্রথমেই চান করার তোলা জল সমস্তটা গিলে খেয়ে ঘরময় আমাদের নিজস্ব এলাকা জাহির করে বেড়ালাম। পুরনো হলদে কাঠি বার করা মাদুরগুলোর উপর ছোট ছোট পুকুর তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু রাতে ওঘরে ফিরে দেখি, দল-দল গন্ধটা কারা ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়ে গেছে। সেই থেকে রোজ বিকেলে সেই একই গল্প। সকালে, আর রাতে ঘরে ফিরে আমরা মুতি আর মুতি, আর রোজই বিকেলে কে যেন অ্যামোনিয়া দূরীকরণ অভিযান চালিয়ে আমাদের মুতের গন্ধ, মানে আমাদেরকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়। শত চেষ্টাতেও আমরা আমাদের গন্ধ ওই ঘরে, ওই আশ্রমে টিকিয়ে রাখতে পারছিলাম না। যেন আমরা ওখানে থেকেও ছিলাম না। শেষমেশ আমাদের চেষ্টাটুকুও বন্ধ হয়ে গেল। তবু তখনো আমরা দলের সাথে তাল মিলিয়ে চলছিলাম। আমাদের মধ্যে যে মেয়েরা একটু চালাকচতুর, তারা তদ্দিনে তাদের হাঁটাচলা শুধরে নিতে শিখে গেছে – চলছে ধীরেসুস্থে হেলে-দুলে কিম্বা হালকা চালে। প্রায় সকলেই আমরা তখন দুপেয়ে হয়ে উঠেছি।

প্রায়।

বেলকুঁড়িকে নিয়ে আমরা সমস্যায় পড়ে যাচ্ছি।

ও ঠাকুরঘরের চালকলা খানিক খেয়ে, খানিক ছড়িয়ে, পুজোর বাসনে ইঁদুর-কাঠবেড়ালির হাড়গোড় ভর্তি করে রাখে। বাইরের মাঠে ওর অনুপস্থিত ল্যাজ দুলিয়ে নেচে বেড়ায় (আমাদের সবাইকেই এটা নিয়ে ভুগতে হয়েছিল – যখনতখন মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে খরগোশের গতিতে আমরা পাছা নাচাতে শুরু করে দিতাম। “ছি ছি! এ কি অসভ্যতা!” প্রভা-মা আড়চোখে তাকিয়ে বলতেন, গলার স্বরে একটু হিংসে লেগে থাকত)। আমরা দেখতে পেলে দৌড়ে গিয়ে ওকে চিমটি কেটে সাধ্বীদের মতো গলায় হিসহিস করে বলতাম, “বেলকুঁড়ি! এসব বন্ধ কর্‌! না! না বলছি!” বেলকুঁড়ি আমাদের দিকে আহত অবোধ চোখ তুলে তাকাত, কান খাড়া।

কিছু কিছু জিনিস একই রয়ে গেছিল। নেকড়ে-জীবনের সার কথা হল, ‘নিজের জায়গাটা জানো’। তা সে কাজটা আমাদের ভালমতই করতে হচ্ছিল। মানুষের ভিতর বসবাস করতে করতে আমাদের মধ্যে একটা পোষা কুত্তাসুলভ নেই-আঁকড়া ভাব চলে এসেছিল – মাটিতে লুটিয়ে গড়াগড়ি দিয়ে মনিবের মন জোগানোর একটা অদম্য ইচ্ছে। যেই আমরা টের পেলাম, যে খাদ্য শৃঙ্খলে আমাদের উপরে থাকা কোনো এক প্রজাতি আমাদের উপর নজরদারি রাখছে, অমনি আমরা বেমালুম পা-চাটা বনে গেলাম। …মুখ বন্ধ… সারাক্ষণ বিড়বিড় করছি, …চটিতে পা… অথচ বেলকুঁড়ির যদি পা-চাটার কোনো দূরতম ইচ্ছে থেকেও থাকে, সেটা তার মনের কোন অন্তরতম কোণে ঘাপটি মেরে আছে, এটা সাধ্বী মায়েরা অব্দি বুঝে উঠতে পারছিল না। এই সে চলল লাফাতে লাফাতে, একান থেকে ওকান অব্দি হাসি, এক পা তুলে বড় ঠাকুরাণীর শ্বেতপাথরের মূর্তির বুক তাক করে ছ্যারছ্যার ফোয়ারা, ওই আবার সাবান-পাউডার তুচ্ছ করে যে পোকাগুলো ওর চামড়ায় পাকাপাকি বাসা বেঁধেছিল তাদের থাবা মেরে ঘ্যাসঘ্যাস করে চুলকোচ্ছে। প্রভা মা প্রায় কেঁদেকেটে ওকে রোল কলের লাইনে দু’পায়ে খাড়া দাঁড় করায় বটে, আর ওর সরু, শক্ত পেশীবহুল বিদঘুটে পিছনের পা-দুটো অব্যবহারের ফলে থরথর করে কাঁপে, আর তারপরেই ঝুপ্‌! ফের সে চলল চারপায়ে লাফাতে লাফাতে (আমরা ততদিনে শিখে গেছি, যে ওই চলাটা অস্বাভাবিক, লজ্জাজনক… ভাবাই যায় না একদিন আমরা ওইভাবে চলাফেরা করতাম), ওর হাতের ছোট্ট মুঠিগুলো আঘাতে-আঘাতে নীলচে শাদা, যেন একটা গোপন কথাকে মাটির সাথে ঠেসে ধরে রেখেছে। প্রভাময়ী মা যতবার ওকে দেখেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন – “জয় মা! মা গো!” বেলকুঁড়ির পাশে বসে প্রভা-মা ওর মুঠিগুলোকে শক্ত আঙ্গুলে টানটান করে খুলে ধরে আলতো স্বরে বারবার বলেন – “দ্যাখো তো মা সোনা? তোমার মুঠিতে কি কিছু আছে নাকি? বোকা মেয়ে। কিচ্ছু নেই!”

তারপরেই ফের সেই আখর – “মিনতিকে দেখে শেখো। তোমারই তো বড় দিদি। তার মতো হও মা…”

মিনতিকে আমরা কেউ দেখতে পারি না। সে এই থানে আমাদের দলের মধ্যে সবচাইতে সফল – শিকড় ছিঁড়ে সবচাইতে দূরে হেঁটে আসতে সক্ষম হয়েছে। তার সত্যিকারের নাম ছিল গর্‌র্‌। কিন্তু সে নামে আর সাড়া দেয় না। রঙবেরঙের সুতলি পাকিয়ে বিনুনি বানিয়ে চটিতে লাগায়, যেমন মাথার চুলেও বেণী বাঁধে নানা রঙের রবারব্যান্ড দিয়ে। (গুনগুন করে গান গায়, “আমার যেমন বেণী তেমনি রবে…” ইত্যাদি) এমনকি ঘড়ঘড় করে বলতে অব্দি শিখেছে, “জ্‌জ্‌য় ম্মা! জ্‌জ্‌জ্রয় ম্মা!” আগে যা তার থাবা ছিল, সেদুটো জড়ো করে কপালের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে প্রায় নাক অব্দি পৌঁছে যেতে পারে সে।

“এই আমাদের ছোট্ট সাধ্বী নেকড়ে! মায়ের দয়া কোথায় কোথায় গিয়ে সব পড়ে, অ্যাঁ?” অন্য আশ্রমের সাধ্বীরা নামগানের আসরে বা অন্য কাজে এলে, এই থানের পুরনো সাধ্বী বীণা-মা তাঁদের রঙ্গ করে বলেন। আর সব্বাইকে অবাক করে দিয়ে মিনতিও তাঁদের সঙ্গে হেসে ওঠে – একটা অমানুষী, জান্তব ঘড়ঘড়ে হাসি। সে এখনো তার ক্ষুরের মতো ধারালো শ্রবণক্ষমতা হারায়নি। মিনতি আমাদের মধ্যে প্রথম ক্ষমা চাইতে শেখে, হাত পেতে চরণামৃত খেয়ে হাত মাথায় মুছতে শেখে, অফিসঘরের হিসেবের খাতা লেখে যে লোকটি, তার ধুতি ওঠা পায়ের ডিমের দিকে লোভের চোখে টেরিয়ে তাকানো বন্ধ করার ব্যাপারেও তার নাম সবার প্রথমে। যখন পাশের গ্রাম থেকে নাপিত এসে তার কেশরী ঘাড়টা চেঁছে সাফ করে দেয়, তখন তার মুখে ঠিক হাসি দেখা না গেলেও হাসির তুতো ভাইয়ের মতো কিছু একটা ফুটে ওঠে। তারপর খসে পড়া মরা কালো চুলগুলোকে সে পাপোষের তলায় ঝাঁট দিয়ে জড়ো করে রাখে। শোবার ঘরে ঢোকার সাথে সাথে আমাদের সব্বার নাক কেঁপে ওঠে, নাকের ফুটো বড়-বড় হয়ে যায় – কোণাঘুঁজিতে অচেনা সব গন্ধ – পেঁয়াজ আর ব্লিচিং পাউডার, পোড়া মোমবাতি, আধোয়া শরীরের স্যাঁতস্যাঁতে বাস। হাস্যমুখী মিনতির ওসবের বালাই নেই। ওর যেন নাকটি নেই, ও যেন গন্ধটি পায় না।

আমিও মোটের উপর ভালো মেয়েদের মধ্যেই গণ্য। ভীষণ ভালো নয়, আবার খারাপও নয় – বেশ দলের মাঝখানটিতে। আমার কিকরে জানি ভাষার উপর একটা দখল জন্মেছিল। চান করতে শেখারও আগে আমি পড়তে শিখে গেছিলাম। চাইলে বোধহয় মিনতির সাথে এক নম্বর জায়গাটা নিয়ে লড়ে যেতে পারতাম। কিন্তু নিজের স্বাভাবিক ক্ষমতাগুলোকে একদম মাথা থেকে বার করে দিলে তার ফল কি হয়, সেটা আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। এটা তো আর জঙ্গল নয়, যেখানে তোমাকে হতে হবে সবচাইতে দ্রুত, সাহসী আর বলশালী। ঘরে থাকতে গেলে, ভালোভাবে বেঁচে থাকার নিয়মগুলো অন্যরকম বলে বোঝা যাচ্ছিল।

গোটা দলের কেউ আমরা মিনতিকে দেখতে পারি না। কিন্তু বেলকুঁড়ির উপর আমাদের রাগ যেন আরও বেশি। আমরা ওকে দেখেও না দেখার ভাণ করতে শুরু করলাম। তবু সে হঠাৎ-হঠাৎ উদয় হয়ে আমাদের চমকে দিতে থাকে। কখনো অন্ধকার বিছানায় গা ঘেঁষে আসে, কখনো বাগানে বসে আনশান জায়গার হাড় চিবোয়। নিজের বোন যখন দূর থেকে দৌড়ে এসে পেটে গোঁত্তা মারতে যায়, সেটা একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে। তখন লোম খাড়া করে গরগর করে উঠতেই হয়, যেমন করতে হয় আয়নায় নিজের ছায়াটার দিকে তাকিয়েও, যেন ওটা অচেনা, সন্দেহজনক কেউ।

“এরপর…বেলকুঁড়ির কি হবে?” আমরা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করি, উত্তর ছাড়াই, কারণ উত্তর মানেই বিস্বাদ ভয়, আর ভয় মানেই আবার তাকে ঠেসে গিলবার চেষ্টা। যেসব চারপেয়ে মেয়েরা নতুন সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি, তাদের কি হয়, সেসব নিয়ে আমরা তখন নানান গুজব শুনে ফেলেছি। তাদের নাকি ছেড়ে দেওয়া হয় গভীর জঙ্গলে, যেখানে কোনোদিন মানুষ ঢুকতে পারে না। এসব লজ্জাকর আলোচনা আমরা করি রাত্তিরবেলা, ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগে, যেমন ভূতের গল্প শুনে কাঁটা হওয়ার মধ্যে ঘা চুলকোনোর আনন্দ পাওয়া যায়, তেমনি। লজ্জাকর। অথচ ইঁটের মতো শক্ত বিছানায় শুয়ে ভীষণ চুপিচুপি সেই বিষাক্ত লজ্জাকেই আবার আঁকড়ে ধরি। আসলে ছায়ার মতো একটা প্রশ্ন রোজ রাতে আমাদের প্রত্যেকের বিছানায় শুয়ে থাকে – “এরপর…আমার কি হবে?”

দিনের মধ্যে একটা বড় সময় আমরা এখন জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখে কাটাই। মিনতি অব্দি। আমি দেখেছি, সে কেমন অন্ধভাবে বনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেসময় তাকে ডাকলে সে খেঁকিয়ে ওঠে, বুনো জীবনে যেমন দাঁত বার করে খেঁকিয়ে উঠত বড় বোনেরা, ছোটরা তাদের বিরক্ত করলে, যেন সে মিনতি নয়, যেন সে মানুষ হয়ে ওঠেনি এখনো। আর তখনই সেই পুরনো ভালবাসার টানের গন্ধ তার গায়ে – সেই মুখ দিয়ে ফেনা ওঠা পুরনো মিনতি।

স্কুলে ওরা আমাদের বড়ঠাকুরের বাণী পড়ে শোনায় রোজ, রোজ, রোজ। তারপর সাধ্বীরা আমাদের দেয় চায়ের দোকানের আঠালো কেক। এসব পরীক্ষা কখনো আগে থাকতে জানান দিয়ে নেওয়া হয় না। আমি অনেক পরে গিয়ে বুঝতে পারি, যে আমরা আসলে গবেষণার ইঁদুরের মতো চব্বিশ ঘণ্টা নজরবন্দী। “যা তো মা, হাঁসগুলোকে খাইয়ে আয়,” ওরা বলে, “মায়ের দয়া সর্বজীবে সমভাবে বিতরিত।” ঠাকুর আমায় যেন বেলকুঁড়ির সাথে একসাথে না পাঠায়, দোহাই ঠাকুর, আর যে হোক, বেলকুঁড়ি নয়… “সুভাষিণী –”, জয়া-মা মিষ্টি করে হেসে বলেন – “ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে হাঁসেদের খাইয়ে আয় তো। যাও বেলকুঁড়ি, দিদির সাথে যাও…”

“যাহ্‌চ্ছিজ্জয়ামাজ্জয়মাজ্জয়থাগুর”, আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে (কথা বলতে আমার অনেকদিন লেগে গেছে, এখনো বলতে গেলে নেকড়ে ভাষা থেকে মনে-মনে বাংলা করে নিয়ে তবে আমার কথা বেরোয়)। আচ্ছা এ কেমন বিচার! ওরা খুব ভালো করেই জানে, বেলকুঁড়ি কেকের দলা পাকাতে শেখেনি। কেকের প্যাকেটটা খুলতে অব্দি পারে না। তার চেয়েও বড় কথা, হাঁস দেখলেই ও ঝাঁপ দেবে, কামড়ে ধরবে গলা, ধরবেই; শিকারের স্বাভাবিক ইচ্ছেটাকে কারচুপি করে লুকিয়ে রাখবার কথা ওর মাথাতেই আসে না। আর তখন? আমাদের শাদা জামায় রক্তের দাগের দায় কার ঘাড়ে এসে পড়বে? আমাদের নামে যে খাতা রয়েছে আশ্রমের অফিসে, তাতে কার নম্বর কম হবে? কার নামের পাশে লাল ঢ্যারা পড়বে? কার, শুনি?

বাগানের দরজা দিয়ে বেরিয়েই আমি কেকের প্যাকেটগুলো বেলকুঁড়ির হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে যাই হাঁসপুকুরের দিকে, একাই। বেলকুঁড়িও আমায় তাড়া করে আসে, গোড়ালিতে আলতো করে দাঁত বসাতে বসাতে। ভাবে, আমি তার সাথে খেলছি। “থাম্‌ বলছি,” আমি রাগে গরগর করে উঠি। আরও জোরে দৌড় লাগাই। কিন্তু তখনো আমি মোটে দ্বিতীয় শিক্ষাস্তরে – হাঁটতে গেলে পায়ে পা জড়িয়ে যায়। তাই একটু গিয়েই উল্টে পড়ি একটা খড়ের আঁটির উপর। সেখান থেকে আড়চোখে দেখি বেলকুঁড়ির তীরবেগে হামা দিয়ে আসা ঝাপসা শরীর। মুহূর্তের ভিতর সে আমার উপর চড়ে বসে। টানামানির খেলায় নেকড়ে ভাষায় আমরা যেমন করে ডাকাডাকি করতাম, সেইসব পুরনো শব্দ ওর মুখে। কেকের প্যাকেটগুলো আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে গেলে আমি পালটি খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত বার করে খেঁকিয়ে উঠি, কানদুটো রগের দু’পাশে চিপকে থাকে। আমি ওর কাঁধ কামড়ে ধরি – একবার, দু’বার – কারণ ও খালি ওই ভাষাটাই বোঝে। তারপর ওর বিরুদ্ধে আমার নতুন শেখা শারীরিক প্রতিক্রিয়া ব্যবহার করি। ওর দিকে ধুলো মুঠি করে ছুঁড়ে মারি, নুড়িপাথর ছুঁড়ি। “যাঃ যাঃ,” চিল্লিয়ে বলি। ও সিঁটিয়ে গিয়ে পুকুরপাড়ের বেগুনি পাতাবাহারের ঝাড়ের পিছনে লুকিয়ে পড়ার পরেও বলে যাই, “যাঃ যাঃ যাঃ…”

বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে ওরা বেলকুঁড়িকে খুঁজে বার করে – অনেক দূরে কোন এক নদীর চরায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর একটা ভোঁদড়ের গলায় সাধ্বীদের দেওয়া হাতের তুলসিমালাটা পেঁচিয়ে মারার চেষ্টা করছে। আমি তখনও হাঁসপুকুরের পারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় বসে, পিঠ বাঁকা, হলুদ চোখ ঝলসাচ্ছে। আমার মুখভর্তি কেক আর তার গুঁড়োর পরত জমে আছে আমার দু’ঠোঁটের কষে।

বেলকুঁড়িকে ওরা কি করেছে, আমি জানি না। আমাকে ওরা বাকি বোনেদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। আর একটা ভিডিও দেখিয়েছে। সেইসব নেকড়ে মেয়েদের ভিডিও, যারা চেষ্টা করেও মানুষ সমাজের রীতিনীতি শিখে উঠতে পারেনি। আকাটা চুল, বিষণ্ণ চোখের কিছু আধাবয়েসী মেয়ে, তাদের শাড়ি লুটোচ্ছে, ছেঁড়া চটি পরে লেংচে লেংচে বহু বছর আগে ছেড়ে আসা নেকড়ে দলের পিছু নেবার চেষ্টা করে চলেছে তারা। এক ব্যাঙ্ক কর্মচারী নেকড়ে-মহিলা, তার মুখের মেকআপ ঘামে গলে ছড়িয়ে গেছে, টাকা জমা দেবার স্লিপের উপর এক টুকরো কাঁচা মাংস রেখে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে চিবিয়ে চলেছে, আর অন্য কর্মচারীরা তার দিকে ঘেন্নার চোখে তাকিয়ে। শেষের দিকে আমাদের বাবা-মায়েদের ভিডিও-ও রয়েছে। আর একদম শেষ দৃশ্যে সাধ্বী ঠাকুরাণীর ছবি, তার নীচে ফুটে ওঠে একটা প্রশ্ন – “অতঃপর দুই প্রজাতির দ্বারাই বিতাড়িত?

এরপর থেকে আমি বেলকুঁড়ির সাথে আরও, আরও কম সময় কাটাতে শুরু করি। এক রাতে সে আমার কাছে এসে উপস্থিত হয়, তার মুঠি পাকানো হাত আমার দিকে বাড়ানো। গায়ে-মাথায় কাঁচের টুকরো, নাকের ফুটো দিয়ে একটা তীক্ষ্ণ কাঁদুনি বেরিয়ে আসছে। আমি কি বুঝতে পারিনি, যে ও কি চাইছিল? আমার পুরনো ভাষা থেকে তখনও তো আমি তেমন দূরে সরে যাইনি (যদিও তদ্দিনে আমার পড়ার মান বেশ উঁচু – পঞ্চম স্তরের কাছাকাছি)।

“নিজের ঘা নিজে চাট্‌ গিয়ে,” আমি তাকে বলি। একদম যে মায়াদহাহীন ভাবে বলি, তা-ও নয়। সাধ্বীরা আমাদের এগুলো বলতে শিখিয়েছে – সেই অভ্যেস থেকেই বলা। সভ্যসমাজে তো আর একে অন্যকে চেটে দেওয়া যায় না। আর এ অজপাড়াগাঁয়ে এমনিতেই যত অসভ্য লোকের কারবার। তবু, বেলকুঁড়ির, তার ছোট্ট শাদা গোটানো শজারুর মতো মুঠি, দুই ভুরুতে আহত জন্তুর মতো অবিশ্বাসের প্রশ্নচিহ্ন – আমার বুকটা টনটন করে ওঠে। মানুষ তার নিজের মতো করে কীভাবে বাঁচতে পারে? এটা কিন্তু রীতিমত তৃতীয় স্তরের একটা প্রশ্ন!

.

তৃতীয় স্তর : বালিকা ছাত্রীগণ নূতন ও ভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসিবার পর কিছুকাল অতিবাহিত হইলে নিম্নরূপ অবস্থার সৃষ্টি হইবে। আশ্রমে প্রদত্ত সংস্কৃতিকে বর্জন করিবার এক তাড়না উহাদের অন্তরে জন্ম লইবে এবং তদনুসারে উহারা আপনার অন্তর্জগতে আপনাকে গুটাইয়া রাখিবার প্রয়াসে রত হইবে। ইত্যবসরে উহাদের নিকট আশ্রমে প্রদত্ত শিক্ষা সাধারণ ভাবে এক বর্জনীয় বস্তু বলিয়া প্রতিভাত হইবে ও ছাত্রীরা ইহাই ভাবিয়া অস্থির হইবে যে কেহ কী রূপে এমত জীবনযাপন করিতে পারে। সদাই হৃদয়ে এরূপ অনুভূতি উৎপন্ন হইতে থাকিবে, যে উহাদের স্বগৃহে পালিত সাংস্কৃতিক আচার-ব্যবহার আশ্রমে প্রদত্ত রীতিনীতি অপেক্ষা বহুগুণে শ্রেষ্ঠ ও বরণীয়।

.

সাধ্বীরা বেলকুঁড়িকে নিয়ে মুখে না বললেও চিন্তিত হয়ে উঠছিল। দোষ শুধরোতে গেলে দোষের কাজটাকে আগে দোষ বলে মানতে তো হবে! এদিকে বেলকুঁড়ি সক্কলের সামনে, মূল জপঘরের ঠিক সামনেটিতে বসে নিজের জামা চিবিয়ে ফালাফালা করে ফেলছে। বাগানের খরগোশ ধরে হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে নিয়ে আসছে আশ্রমের খাবার ঘরে, যেখানে বসে আমরা বাকিরা সব ছোট্ট-ছোট্ট গ্রাসে ডালসিদ্ধ কিম্বা পালং শাক দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছি। হিসি করে দিচ্ছে চরণামৃতের বাটিতে।

“আর না, ঢের হয়েছে,” আমরা একদিন আড়ি পেতে প্রভা-মা’কে বলতে শুনলাম, “ও কি পারেটা কি? ঠিক ক’টা ঢ্যারা পড়ে গেছে বলুন তো ওর নামের পাশে? ও ঠাকুরের অষ্টনামের একটাও জানে কি? ‘হুর্‌র্‌র্‌র্‌হা!’ – শুনলেই লজ্জায় মাথা কাটা যায় – এছাড়া ওর মুখ থেকে আর একটাও শব্দ শুনেছে কেউ? খঞ্জনি দিয়ে ঠুকে ইঁদুর মেরে… আর কি বলব?”

গোটা ঘর চুপ।

“কিছু একটা করতে হবে।” ঠাণ্ডা স্বভাবের বীণা-মা একটু জোর দিয়েই বলে উঠলেন। অন্য সাধ্বীরাও সম্মতিতে মাথা নাড়ছিল। একটা শাদা ঢেউয়ের মতো ডায়ে-বাঁয়ে আগুপিছু সাধ্বীরা সারি করে বসেছে। গন্ধহীন, রক্তহীন চুলে জবজবে তেল দিয়ে বেণী পাকানো। “কিছু একটা” – ওরা একসুরে বলছিল। যেন এতই ভয়ানক সেই ‘কিছু একটা’, যে ওরাও কেউ মুখ ফুটে সেটা বলে উঠতে পারছিল না।

আমি ওকে আলাদা করে কাছে টেনে সাবধান করে দিতে পারতাম। বাড়িতে থাকার সময়, যদি বেলকুঁড়িকে গ্রামের নেড়িকুত্তাগুলো নিঃশব্দে ঘিরে ধরত, বা খরিশ সাপের গন্ধ উঠত নেকড়ে-ডহরে, আমি ওকে ঠিক সাবধান করে দিতাম। আসলে সত্যিটা ছিল এই, যে তৃতীয় স্তরের শেষাশেষি এসে আমার মনোগত ইচ্ছেটাও ছিল, যে ও এবার যাক। বেলকুঁড়ির না পারাটা আমাদের সবাইকে ক্লান্ত করে তুলছিল। ওর দাঁতগুলো ক্ষয়ে গেছিল, যেখানে-সেখানে চুল খসে পড়ছিল। দিনের পর দিন রবারের ছিবড়ের মতো সবজি, যা আমরা খাচ্ছিলাম, ওকে খেপিয়ে তুলছিল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, যে ও খেতে পারছে না, ওর ফ্রকের তলায় পাঁজরার হাড় বেরিয়ে যাচ্ছিল। অথচ ওকে এতটুকু মায়া দেখালেও ও এমন পেয়ে বসছিল, যে বলবার নয়। খাবার সময় পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে থাকবে উচ্ছিষ্ট চাটার জন্য। সেসময় আমি দিনের পর দিন ঘুমোতে পারতাম না, কারণ আমি ভুলতে পারতাম না, বেলকুঁড়ি আমার খাটের নীচে রাতভর গুঁড়ি মেরে বসে আছে, আমার চটিদুটোকে চিবিয়ে ফালাফালা করে দিচ্ছে…

তৃতীয় স্তরে পৌঁছে আমরা প্রথম শুদ্ধজাত নেকড়ে-বালিকাদের দেখলাম। এরা বেড়ে উঠেছে ঘেরাটোপে, ঠাকুরাণীর থান থেকে স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়ে। চকচকে ব্রণহীন মুখ, ফিনফিনে পরিষ্কার চুল – কারুর বিনুনি, কারুর ঝুঁটি, কারুর ঘাড় অব্দি পরিষ্কার করে কাটা চুল। চতুর্থ স্তরে থাকা এই মেয়েরা আমাদের সভ্যসমাজের খেলাধুলো শেখাতে এসেছে। তাদের নামের বাহারও বা কত – প্রজ্ঞা, শতরূপা, তন্ময়া। গিনিপিগের মতো ছোট্ট কান, খরগোশের মতো মিষ্টি নাক, আর একমুখ ভীতু-ভীতু হাসি। আমরাও ওদের দিকে চেয়ে হিংস্র ভাবে হাসলাম। আসলে কিন্তু নতুন মানুষ দেখতে হবে ভেবে আমরা সিঁটিয়ে ছিলাম। পদে-পদে এতরকমের ভুল করে ফেলার সম্ভাবনা! আর নতুন মানুষের নতুন স্বভাবের উপর নির্ভর করে আমাদেরও তো নতুন করে বদলাতে হবে নিজেদের – হাত মেলাব কি মেলাব না, গান গাইব কি গাইব না, দাবা খেলব কি খেলব না, হাঁপাব কি হাঁপাব না।

শুদ্ধজাত মেয়েগুলো আমাদের সাথে দাবা খেলতে বসল।

“এই মেয়ে-মেয়েগুলোর মাথায় কি গু পোরা আছে?” আমাদের আরেক বোন লতা ফিসফিস করে আমায় বলল, “এই নিয়ে আমি পরপর পাঁচবার জিতলাম!”

লতা ঠিকই বলছে। আসলে এই মেয়েগুলো আমাদের ইচ্ছে করে জিততে দিচ্ছে। “মন্ত্রীটা সরাও, সর্‌র্‌রাওওও…” আমি গরগর করে উঠলাম, আর প্রজ্ঞা-বোন ভীতু-ভীতু চোখে তাকিয়ে তার মন্ত্রীকে এক ঘর ঠেলে দিল। তন্ময়ার ভুলভাল চালে খেপে উঠে আমরা যখন দাবার বোর্ডটাকে নখ দিয়ে কুটিকুটি করে ফেললাম, সে একটি আঙ্গুল অব্দি তুলল না – মাটির দিকে চেয়ে রইল। ওদের জন্য আমার কষ্টই হচ্ছিল। ঘেরাটোপে মানুষ হওয়া কেমন কে জানে! হয়তো সে জীবন মানে কোনো এক অচেনা অরণ্যের জন্য ঘুমের ঘোরে কেঁপে-কেঁপে ওঠা। গাছেদের জন্য কাতর হওয়া, যে গাছ তারা কোনোদিন চোখ দিয়ে অব্দি ছুঁয়ে দেখেনি।

মিনতি বেশ খঞ্জনি বাজিয়ে কীর্তন করতে শিখেছে। শনি-মঙ্গলবার বড়ঠাকুরের আশ্রমসঙ্গীতের চটিবই দেখে-দেখে গায় – “সুশিক্ষা সাধন ধন / জয় জয় জয় মা।“ সাধ্বীরা আখর মেলায়, “জয় মা জয় মা জয় মা জয় মা।”

বুধবার করে, যেসব মেয়েরা সাইকেল চালাতে শিখেছে, তারা এক-একজন সাধ্বীকে পিছনে বসিয়ে টাউনে ঘুরতে যেতে পারে। শুদ্ধজাত মেয়েগুলো সাতশো গজ গিফ্ট-র‍্যাপিং কাগজ বিক্রি করে সেই টাকায় আমাদের জন্য সূর্যমুখী ফুলের মতো কটকটে হলদে সাইকেল কিনে দিয়ে গেল। প্রত্যেকটা সাইকেলে দু’জন করে বসে প্যাডেল করতে পারে। আমরা সেই সাইকেল খাড়া চড়াই বেয়ে চালিয়ে উঠতাম। এইটুকু হাঁপানো আমাদের আশ্রম থেকে বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রত্যেকের পিছনে একজন করে গোমড়ামুখো সাধ্বী হাঁই হাঁই করে প্যাডেল করে চলে। “বাঃ!” হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের কেউ হয়তো বলে ওঠে, “মানুষ হয়ে ওঠাও সাইকেল চালানোর মতো, বুঝলে? একবার শিখলে আর ভুলতে পারবে না।” বেলকুঁড়ি সাইকেলের পিছনে দৌড়োয়, ঘড়ঘড় করে আমাদের পুরনো নাম ধরে ডাকার চেষ্টা করে – “হাঃভ্রা! গর্‌র্‌! টর্‌র্‌র্‌র্‌র্‌…” আর আমাদের প্যাডেলের গতি বেড়ে যায়।

এদিকে আমাদের প্রায় ছ’সপ্তাহ ক্লাস হয়ে গেছে। মিনতি ছাড়া আর কারুর তখনও ঠাকুরাণীর পাঁচপাঁচালি মুখস্ত হয়নি। তবে সাধ্বীরা বলছে আমাদের নিয়ে এবার যুগল সংকীর্তনের আসর করবে। আগামী পূর্ণিমায় আমাদের ভাইদের নিয়ে আসা হবে বড়ঠাকুরের চতুষ্পদ বালক প্রতিপালন আশ্রম থেকে, নৌকোয় করে। টাউনের দৈনিক সংবাদপত্র থেকে একজন আসবে ফোটো তুলতে । কয়েক গ্রাম দূর থেকে আসবে ঢাকীর দল। পুদিনা, আমচুর আর বরফ দিয়ে ড্রাম ভরা লেবুর জল ছোট ছোট প্লাস্টিকের গ্লাসে করে দেওয়া হবে। ভাই… ওদের কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। মনে পড়তেই আমাদের অদৃশ্য ল্যাজ নেতিয়ে পড়ল, হাড়ে ঝিমঝিম ভাব। অথচ খবরটা শুনে আমার ভাল লাগারই তো কথা ছিল। লাগল না। উল্টে সাধ্বীদের উপর রাগে গা রি-রি করে উঠতে লাগল। ওরা খুব ভালো করেই জানে, ভাইদের সাথে যুগলে কীর্তন করা তো দূরের কথা, মুখোমুখি কথা বলার অবস্থাতেও আমরা নেই। অথচ জঙ্গলে থাকতে কেমন সহজে একে অন্যের সঙ্গে মিশে যেতাম। সে রাতে বোনেরা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যাওয়া অব্দি অপেক্ষা করে আমি সিঁড়ির তলায় ঘুপচিতে গিয়ে বসলাম। গুনগুন করে অভ্যেস করছি… চোখ বোজা… ঠাকুরাণীর হাসি-হাসি মুখের ছবিটা চোখের সামনে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা। ঠাকুরাণীর পাঁচালি, দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বাদশ অধ্যায়। জয় মা, জ্‌জয় মা জয় মা জয় মা…বালিকা হৃদয় মাগো পাপের জঙ্গল / নখদন্তী চতুষ্পদ কুচিন্তা সকল / অসভ্য মলিনবাস বিস্রস্ত কেশ / পশ্যে তাহা ঠাকুরাণী দিলেন আদেশ / সভ্যতা কাহারে বলে, শুন বালিকা / মুখ বন্ধ মেয়ে তোর, চটিতে পাআআআআআ… জয়মাজয়মাজয়মাজয়মাজয়জয়জয়জয়জয়…

এইরকমই চলছিল। তারপর এক রাতে সিঁড়ির তলা থেকে বেরিয়ে ঘরে আসার সময় আমি আরেকটু হলে মিনতির গায়ে উল্টে পড়ি আর কি। সে তখন জানলার তাকে চাঁদের আলোয় বসে। কোলে একটা লাইব্রেরির বই (আমাদের মধ্যে লাইব্রেরি কার্ড প্রথম মিনতিই করিয়েছিল) আর দু’গালে জলের দাগ।

“কাঁদছিস কেন?” জিজ্ঞেস করার সাথে-সাথে আমার জিভটা ওর গালে ঠেকিয়ে চোখের জলটুকু চেটে নেবার আসন্ন মুহূর্তটাকে আমায় খপ করে ধরে ফেলতে হল।

মিনতি জানলার পর্দাটা টেনে নাকটা মুছে নিল। (ওর ভুলগুলোতেও আমাদের বিরক্তি লাগত – সবসময় কেমন একটা ভালো করার চেষ্টা।) আরেকবার নাক টেনে ও বইটার একটা লাইন আমায় আঙ্গুল দিয়ে দেখাল – ‘দীঘির জলে জঙ্গল আর তার মাথার উপরকার ধবধবে চাঁদ মিলে একটা নতুন ছবি তৈরি হয়েছিল, নেকড়েরা ঢকঢক করে খাচ্ছিল আকাশের সেই শীতল ছায়া।’– আমি মনে মনে পড়ে ফেললাম। কিন্তু দলের বাকি কেউ তখনও পড়তে শেখেনি, তাদের ছেড়ে মিনতির সাথে এক গোয়ালে ঢোকার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না।

পরদিন মিনতি ছোট সাধ্বীদের সাথে মালা গাঁথতে বসল। বাগানে আর ঠাকুরঘরে বড়ঠাকুর আর ঠাকুরাণীর শ্বেতপাথরের মূর্তি, তাছাড়া ঘরে-ঘরে তাঁদের ছবি। ঠাকুরঘরের মূর্তিতে জুঁইফুলের গোড়ে মালা সবচাইতে মোটা। বুড়ো মালী শিবাপতি হাঁসপুকুর থেকে লাল পদ্মকুঁড়ি কেটে তুলে আনে। সেই কুঁড়ির তৈরি লকেট বিকেলবেলা মালার নীচে শাদা হয়ে ফুটে ওঠে। ছুঁচ-সুতোর ডিব্বা থাকে প্রভা-মা’র কাছে। মিনতিকে ঠাকুরঘরের মালায় হাত দিতে দেওয়া হয়নি বটে, কিন্তু বাগানে বড়ঠাকুরের গলায় দেখি তার গাঁথা মোটকা জুঁইমালা, তাতে লজ্জাবতী পুষ্পগুচ্ছের লকেট।

বৃহস্পতিবার পুজোর দিন। ওই দিনটায় ভাণ করাটা আমাদের কাছে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, যেন ওটাই আমাদের স্বভাব। আসলে ঠাকুরঘরটা এমনিতেও আমাদের পছন্দের জায়গা। পুরোহিত কি মন্ত্র-টন্ত্র পড়ছে, সেসব বুঝে উঠবার অনেক আগে থেকেই প্রভাতসঙ্গীতের সুরটা আমাদের মনটাকে কেমন যেন করে দেয়। হারমোনিয়ামে বসেন মোটাসোটা সুখী মাসি – হাতেগলায় সোনার বাজু-মফচেন, আনারসের ডিজাইন কাটা। সাধ্বীদের থেকে আমরা মোট যা শিখেছি, সুখী মাসির কাছে কুলমিলিয়ে তার চাইতে শেখা হয়েছে বেশি। আমাদের দল বেঁধে ডাক দিয়ে ওঠার পুরনো খিদেটাকে বুঝি গানের ভিতর দিয়ে মিটিয়ে নেওয়া যায়। এটা তাঁর কাছ থেকেই শেখা। ভাঙা জানলা দিয়ে গুলমোহর গাছের মাথায় মেঘ ভেসে যেতে দেখি। দেয়ালের গায়ে হঠাৎ কিসের ছায়া দেখে মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মা… আমি ভাবি, আর মনে-মনে একটা ছবি তৈরি করার চেষ্টা করি… একটা কালো ছায়া, সন্ধ্যেবেলা শালবনের আলোআঁধারি মাড়িয়ে ছুটে চলেছে।

প্রত্যেক সকালে ঠাকুরঘরে আমরা সমবেত সঙ্গীত গাই। আমরা বুঝে নিয়েছি, এই হল মানুষদের চাঁদ – যেখানে কারণ ছাড়াই গলা ছেড়ে ডেকে উঠতে হয়। সঙ্গী খুঁজতে নয়, শিকার খুঁজতে নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী বা আর কিছু খুঁজতেও নয় – খালি ওই শব্দটাই করা – ব্যাস। তাই আমরাও সুখী মাসির হারমোনিয়ামের সাথে, সাধ্বীদের সমবেত সঙ্গীতের সাথে গলা মিলিয়ে ডেকে উঠি। “কি সব গলা! মা গো!” সাধ্বীরা এ-ওকে ঠেলাঠেলি করে বলে। কিন্তু আসলে যে তারা আমাদের চেষ্টায় ভারি খুশি, সেটা আমাদের কাছে চাপা থাকে না।

.

চতুর্থ পর্ব : প্রতিপালক সংস্কৃতির সহিত ক্রমবর্ধমান পরিচিতির এই পর্বে উপনীত হইয়া ছাত্রীগণ নূতন পরিবেশে উত্তরোত্তর আরাম বোধ করিতে থাকিবে। প্রতিপালক বিদ্যালয় উহাদের স্বগৃহ বলিয়া বোধ হইবে, এবং উহাদের স্বনির্ভরতাও বৃদ্ধি পাইবে। সহসা নূতন পারিপার্শ্বিক উহাদের নিকট অর্থবহ হইয়া উঠিবে।   

.

“বোন সুভাষিণী,” মিনতি আমার কাছ ঘেঁষে ঘড়ঘড় করে বলে, “দেখেছিস, হঠাৎ কিরকম সবকিছুর মানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে?”

আমি জবাব দেবার আগেই বেলকুঁড়ি ঘরের একটা আলমারির পিছন থেকে ছিটকে বেরিয়ে মিনতির হাতের কাজের খাতার উপর খ্যাঁক করে দাঁত বসিয়ে দিল। পাতার পর পাতা জোড়া যত্ন করে আঁকা ছবি, খাতার সাথে টেপ দিয়ে সাঁটা রিবন, রঙিন কুচি কাগজ পাথরের মেঝেতে ছত্রাকার – যেমন গাছের নীচে ছড়িয়ে থাকে শুকনো মৃত পাতা।

“তোর কি মনে হয়? বেলকুঁড়ি?” মিনতি শান্ত হাতে গড়িয়ে যাওয়া রবারের টুকরো কুড়িয়ে নিতে-নিতে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করে। ও-ই আমাদের মধ্যে একমাত্র, যে বেলকুঁড়ির সাথে এখনো কথা বলে। সাধ্বীদের কাছে ওর যা নামডাক, তাতে এই দাঁত ছিরকুটে নেকড়ে-মেয়েটার সাথে এক-দু’টো কথা বললে ওর ক্ষেত্রে সেটা দোষ বলে গণ্য হয় না। “মানে খুঁজে পাচ্ছিস কিনা? কুঁড়ি?”

বেলকুঁড়ি ডেকে উঠল, যেন আর্তনাদ করে উঠল। তারপর আমাদের এমন খিমচোতে শুরু করল, আর থামেই না, হাঁটুর নীচের হাড্ডিসার জায়গাটায় এমন জোরে বসে গেল ওর নখ, যে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। তারপর ঠাণ্ডা পাথরের মেঝেতে পিছলে গড়িয়ে গিয়ে ও আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে লাগল খাতার পাতায় আঁকা রাশি রাশি আল্পনার ভিতর। আমাদের মাথার উপর সিলিং-এর জাফরি দিয়ে মুক্তোর মতো আলোর বিন্দু এসে ঘরের ভিতর পড়ছিল।

মিনতির ভুরু কুঁচকে গেল। “আরে তুই নাহয় একটু দেরিতে ফুটবি। খুব বেশি হলে বারো মাস, ওরা বলেছে। তার মধ্যে সব্বাই সমস্‌স্‌তোক্কিচ্ছুর মানে খুঁজে পেয়ে যায়।” আমার কানে খট করে লাগল মিনতি কেমন ‘সমস্তকিছুর’ বলতে গিয়ে তুতলে উঠল। হুর্‌র্‌র্‌র্‌হা! মিনতি তুই কোনোদিন আমাদের পুরনো উচ্চারণের জের কাটিয়ে উঠতে পারবি না। তুতলোতেই থাকবি। ভাবতে বেশ ভালো লাগছে – তোর প্রত্যেকটা ব্যবহৃত শব্দ তার নিজের ব্যবহারের জন্য নিজেই আজীবন ক্ষমা চাইতে থাকবে।

“সুভাষিণী, সুভাষিণী,…” মিনতি আমার সাহায্য চাইছে। বেলকুঁড়ি ওর শক্ত চোয়াল গেঁথে দিয়েছে মিনতির আঢাকা পায়ের ডিমে, তাঁকে খিঁচে নিয়ে যাচ্ছে আলমারিটার দিকে। “ও সব নোংরা করে দিয়েছে, একটু তুলে রাখ বোন…”

আমি ওর কথায় কান না দিয়ে খাবার ঘরের দিকে হেঁটে গেলাম। সংকীর্তন হতে মোটে ঘণ্টা চারেক বাকি। আমি নিজের বাইরে আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। এই পর্বে এসে আমার বোনেদের দলের কে কি ভাবছে তার কোনো হিসেব আর আমার পক্ষে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না।

ঠিক সন্ধ্যে ৭টায় বীণা-মা ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে আমাদের লাইন করে ঠাকুরঘরে ঢুকিয়ে দিল। সাধ্বীরা গোটা ঘরটাকে ভয়ানক সাজিয়েছিল। সমস্ত জানলায় বড়ঠাকুরের নামাবলীর পর্দা, তার উপর কমলা-হলুদ গ্যাঁদার মোটা মালা দুলছে, লাল জবাফুলের তোড়ার লকেট। সিলিং থেকেও নীচ অব্দি ঘন-ঘন নেমে এসেছে ফুলের মালা, কেঁচোর মতো টোন সুতলির গিঁট – তাতে আমাদের চুল জড়িয়ে যাচ্ছিল। জানলার বাইরে একটা কটকটে হলুদ চাঁদের মুখভেংচি। ঢাকীরা ঢাকে আলতো কাঠি মেরে মেরে হাত গরম করছে আর মাইকে বাজছে বড়ঠাকুরের লেখা ভজনসঙ্গীত। বড়-বড় ড্রামে সেই মশলাদার লেবুর শরবত। আর…আমাদের ভাইয়েরা।

ওদের অবশ্য আর ভাই বলে গন্ধে চেনা যাচ্ছে না। গায়ে পাউডার আর ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাঁতে ঘামের গন্ধ। ওদের কেমন ছোট ছেলের মতো দেখাচ্ছে। কে যেন ওদের চান করিয়ে কানের পিছন অব্দি পরিষ্কার করে দিয়ে, শাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিয়ে দিয়েছে। সুচরিত ছিল, যাকে বলে মদ্দা নেকড়ে, বিটভৌঔঔঔর্‌! তেড়েফুঁড়ে ফণা তোলা কেউটে সাপের মুণ্ডু এক চিবুনিতে থেঁতো করত, খরগোশেরা ওর সাথে দৌড়ে পারত না, ভাল্লুকের মুখ থেকে জ্যান্ত পাঙাশ মাছ ছিনিয়ে এনে খেয়েছিল। আর এখন শরবতের ড্রামের পাশে করুণ মুখ করে দাঁড়িয়েছিল, যেন না জেনে, না বুঝে কোথায় এসে পড়েছে।

“জয় মা জয় ঠাকুর!” আমি ঘোঁতঘোঁত করে বলি, “ঠাকুরের কৃপায় কি চমৎকার সন্ধ্যেটা আজ।”

“হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যা,” সুচরিত উল্টে ঘোঁতঘোঁত করে বলে, “শুক্লাপঞ্চমীর আর দেরি নেই কিনা।” গোটা ঘর জুড়ে নেকড়ে-বালকবালিকারা একই কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে সন্ধ্যেটা বিশ্রী গরম আর আজ সকালবেলাই কালচা সাপের কামড়ে প্রভা-মা’র পঞ্চত্বপ্রাপ্রি ঘটেছে। কিন্তু আমরা এখন পর্ব ৪ কথোপকথন ৭-এ আছি : আনুষ্ঠানিকতা। কথোপকথন ১২-তে পৌছলে তবে গিয়ে শিখব ‘কি প্রকারে দুর্ঘটনা বিষয়ে সুচারু বিনিময় সম্ভব?’ অতএব আমরা ফ্যাটফ্যাটে শাদা পাজামা-পাঞ্জাবি-কামিজে, সাজুগুজু করে, সোনামুখ করে পুদিনা-আমচুর দেওয়া লেবুর শরবত খাই, আমাদের বিদঘুটে সত্ত্বার সাথে প্রাণপণ মানিয়ে নিতে-নিতে।

সাধ্বীরা আমাদের চুল টেনে বেড়া বেণী করে দিয়েছে। ফলে আমাদের দেখলে মোটামুটি মানুষ বলেই মনে হচ্ছে, অন্তত চট করে মানুষখেকো বলে মনে হচ্ছে না। যেমন কাঠবেড়ালিদের ফাঁপানো ল্যাজ দেখে অনেকে ভুলে যায়, যে তারাও আসলে ধেড়ে ইঁদুর মাত্র। আমার শাদা কামিজের বুকের উপর শাদা ওড়না, মাথায় লাল রবারব্যান্ড। মিনতির বুকে বেগুনি ওড়না, মাথায় নীল রবারব্যান্ড, সুনীতির বুকে লাল ওড়না, মাথায় কমলা রবারব্যান্ড। বেলকুঁড়ি বসে আছে ঘরের একটা অন্ধকার কোণায়, মুখে একটা কুত্তার মুখে পরানোর খাঁচা। ওর পায়ের চটি পায়ের পাতার সাথে মোটা ডাক্ট-টেপ দিয়ে চেটানো। ওর মুখের খাঁচাটায় ছোট ছোট শাদা কাপড়ের ফুল বসিয়ে দিয়েছে সাধ্বীরা, যাতে বাকি ঘরের হাসিখুশি চেহারাটার সাথে বেমানান না দেখায়। তবে এতসব সত্ত্বেও ঢাকীরা ওর দিকে ভয়ে-ভয়ে চাইছে। আসলে খবর ঠিক হাওয়ায় ভেসে যায়।

“তোমার গন্ধোওওওটা কি সুন্দোওওওঔঔঔ!” সুচরিত বলছে, সুন্দর বলতে গিয়ে ভুল করে ডেকে ফেলেছে, আর লজ্জায় ওর মুখ লাল হয়ে গেছে। “মানে…”

“আমি জানি তুই কি বলছিস।” আমি ওর কথা কেটে গর্জে উঠি (এটা অবশ্য আমার তরফে একটু বাড়িয়ে বলা হল, আমার গলা থেকে শেষ গর্জন বেরিয়েছে – সে বেশ কয়েক মাস হতে চলল)। আমার গন্ধে এই মুহূর্তে সৌন্দর্যের রেশটুকুও নেই। আর কিছু না ভেবে পেয়ে আমি সারাগায়ে একটা পেঁপের মোরব্বা ঘষেছি আমার গায়ের স্বাভাবিক বুনো বোঁটকা গন্ধটাকে ঢাকতে। এখন আমার গন্ধ একজন শুদ্ধজাত মেয়ের গায়ের গন্ধের মতোই, যাকে এক থাবায় পটকে দেওয়া যায়। আমি সুচরিতের দিকে চোখ ছোট-ছোট করে তাকাই, কানের পাতা রগের সাথে চেটিয়ে, যা গত কয়েকমাসে একবারও করিনি। সুচরিত ঘাবড়ে যায়, সেই লাইনগুলো মনে করার চেষ্টা করে যা আমায় ভালোমানুষের মেয়ের মতো সুব্যবহারে ফিরিয়ে আনবে। আমার ভীষণ গরম লাগতে থাকে, রক্তাভ চোখের কোণায় মোটা-মোটা তেলের বিন্দুর মতো কান্না জমে ওঠে। চটিতেপাচটিতেপাচটিতে… আমি নিজের দিকে নিজেই দাঁত খিঁচোই। আবার করে শুরু করি, “ঠাকুরের কৃপায় কি চমৎকার সন্ধ্যেটা…”

ঢাকীরা একজোটে ঢাকে কাঠি মারে।

“সংকীর্তন শুরু হতে চলেছে,” জয়া-মা মাইকে বলে ওঠেন, “মেয়েরা, দুহাত জোড়, চোখ বোজ। ঠাকুরাণীর পাঁচালি তৃতীয় খণ্ড সপ্তদশ অধ্যায়… ভাইয়ের হাতদুটির মাঝে তোমার দুটি হাতের পাতা…” শিবাপতি কোথা থেকে একটা বড় করতাল ঢং ঢং করে বাজাতে শুরু করে। সবার চোখ আমাদের উপর।

পারব না, আমি পারব না। আমি ক্রমশ বেলকুঁড়ির কোণটার দিকে পা-ঘষটে পিছিয়ে যেতে থাকলাম, কিন্তু সুচরিত আমার দুহাত টেনে তার হাতের ভিতর চেপে ধরেছে। “না!” আমি দাঁতের ফাঁকে, নিঃশ্বাসের ফাঁকে বলার চেষ্টা করছি, “নাআআআআ।” হঠাৎ আমি হাঁপাচ্ছি, আমার শরীর হাঁপানো আর হাঁপানো ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারছে না। কে যেন সূর্যের মতো চোখ ধাঁধানো একটা শাদা আলো জ্বালিয়ে দিল ঘরের মাঝখানটায় আর সঙ্গে-সঙ্গে ঠাকুরাণীর থানে কাটানো আমার বিগত কয়েকটা মাস আমার মাথা থেকে একদম নেই হয়ে গেল। আমি আবার একটা কোণঠাসা জন্তু। আমার পা’গুলো যেন চটির থেকে বেরিয়ে নিজে-নিজেই লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। মুখ বন্ধ! আমি আমার খালি-পায়ের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠছি, মুখবন্ধমুখবন্ধমুখবন্ধ!

“সংকীর্তন শু-রু-হ-তে-চ-লে-ছে,” জয়া-মা গলা খাঁকারি দেন, “সংকীর্তনের সময় এটা,” একটু থেমে আবার, “সংকীর্তন?” যেন আমাদের মনে করাবার চেষ্টা করছেন, “তোমরা যেটা করছ মা, সেটা কি সংকীর্তনের ধারকাছ দিয়েও যাচ্ছে?”

আমার কপালে ঘামের বিন্দু জমে উঠেছে। আমার চোয়াল খুলে গিয়ে মুখের বাঁ পাশ দিয়ে জিভ ঝুলে পড়ছে। কি যেন লেখা ছিল সপ্তদশ অধ্যায়ে? ভাইবোন দোঁহে করে কীর্তনবিহার / বালিকা বালক সনে ষোড়শোপচার / জয় জয় ঠাকুরাণী…জয় জয় ঠাকুরাণী… কি ছিল কথাটা? আমার মাথা কাজ করছে না। মিনতিকে দেখতে পেয়ে আমার ধড়ে প্রাণ এল। মিনতি জানে, মিনতি বলে দেবে, পাঁচালির কথাগুলো আমায় মনে করিয়ে দেবে।

ও ঘরের একটা কোণে বসে আছে, চুকচুক করে লেবুর জল খাচ্ছে আর আমাকে হাঁপাতে দেখছে। চোখে চোখ পড়তে আমি চোখ দিয়েই আমার করুণ অবস্থাটা যতটা যা বোঝানো যায় তার চেষ্টা করছি। যেমন জঙ্গলে করতাম,বেজির হাড়ের ভাগ চেয়ে। “কথাগুলো বল্‌ আমাকে,” আমি অল্প মুখ নাড়িয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, “পাঁ-চা-লি-র-ক-থা-গু-লো।”

“পাঁচালির কথাগুলো বলে দেব?” মিনতির মুখে একটা এ-কান থেকে ও-কান হাসি ছড়িয়ে গেল, প্রকৃত নেকড়ের হাসি। এক মুহূর্তের জন্য তাকে ঠিক আমাদের মায়ের মতো দেখতে লাগছিল। “তোকে? নাঃ।” ও-ও আমার মতো মুখ নাড়িয়ে শব্দ না করে বলল।

আমি ঘাড় উঁচু করে মাথাটাকে পিছন দিকে ছুঁড়ে দিলাম। একটা ডাক আমার কণ্ঠনালীর গভীর থেকে নখ বসিয়ে-বসিয়ে উঠে আসছিল। আমার নামের পিছনে কতগুলো ঢ্যারা পড়তে চলেছে তার কোনো ঠিক নেই, আর নামকীর্তনের পরীক্ষায় আমি ডাহা ফেল। কিন্তু যখন মনে হচ্ছে হাঁপাতে-হাঁপাতে আমার বুকটা এবার ফেটে যাবে, ঠিক তখনই আমার পিছনে কে যেন জোরে গুঁতো মারল। ধপ করে আমি মাটিতে গড়াগড়ি, আমার কামিজ উল্টে পেট বেরিয়ে গেছে। বেলকুঁড়ি আমার চোখ দিয়ে সাহায্য চাইবার ভাষাটা পড়ে ফেলেছে। ওর মুখের খাঁচাটা চিবিয়ে খুলে, ছুটে এসে ও আমার পিছনে ধাক্কা মেরেছে, অদৃশ্য জংলি কুকুরদের হাত থেকে আমায় বাঁচাবার চেষ্টা করছে, ওর ছোট্ট শরীরটা দিয়ে আমায় ঢেকে রাখবার চেষ্টা করছে। “মা গো!” জয়া-মা কুঁইকুঁই করে উঠলেন, ওঁর হাত থেকে সূর্যের মতো ফ্ল্যাশলাইটটা পড়ে গেল। ঢাকীদের বাজনা থেমে গেছে। আর আমি… আমি এত ভালো জীবনে কাউকে বাসিনি, যতটা আমি সেই মুহূর্তে আমার ছোট্ট বোনটাকে বাসছিলাম। আমি চাইছিলাম পেটের উপর গড়িয়ে গিয়ে ওর কানদুটো চেটে দিই, এক ডজন ছিট-ছিট হরিণের ছানা শিকার করে এনে গোটাটা ওর সামনে সাজিয়ে দিই।

কিন্তু সবার চোখ তখন আমার দিকে। সবাই দেখছে, আমি কি করি। “তোর সাথে কথা বলছিলাম না আমি!” ওকে ঠেলে তাড়াতে-তাড়াতে বললাম, “আমি তোর সাহায্য চাইনি। তুই আমার কীর্তনের পরীক্ষা নষ্ট করে দিয়েছিস। তুই গোটা নামকীর্তনের সভাটাকেই ভ্রষ্ট করে দিয়েছিস।” আমার গলা চড়তে লাগল। আশা করি সাধ্বীরা শুনতে পাচ্ছে, আমার উচ্চারণ কেমন শুদ্ধ হয়ে উঠেছে।

“নষ্ট সভা! ভ্রষ্ট সভা!” আমার বাকি বোনেরাও হাঁপাচ্ছে, আমাদের চারদিকের গোলটা ছোট হয়ে আসছে। “বেলকুঁড়ি সভা নষ্ট করে দিয়েছে!” প্রত্যেকটা মেয়ের চোখ পাগল-পাগল, কামিজের নীচে পাঁচড়ার মতো চুলকুনি, ফেনা-ফেনা লেবুর জল ঠোঁটের কষে, চিবুকে। আমাদের গোটা দলটা এরকম একটা মুহূর্তের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করে ছিল। “বেলকুঁড়ি মানিয়ে নিতে পারছে না। জঙ্গলে ফিরে যাক, ও জঙ্গলে ফিরে যাক!”

ঢাকীরা ইতিমধ্যে তাদের মালপত্র গুটিয়ে পাশের ছোট দরজা দিয়ে মানে-মানে কেটে পড়েছে। ছেলেদের দল, মানে আমাদের ভাইয়েরা পালিয়েছে নদীর দিকে, হাতা গুটিয়ে, পাজামা তুলে। বেলকুঁড়ি তখনো আমাদের মেয়েদের বৃত্তের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় গর্জে চলেছে। বুঝবার চেষ্টা করছে ঠিক কোন শত্রুর হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে হবে। সাধ্বীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে…

সকালবেলা বেলকুঁড়িকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। আমরা সবকটা বিছানার তলায় খুঁজলাম। আমাকে অবাক হওয়ার ভাণ করতে হচ্ছিল। আসলে যে মুহূর্তে ও আমার পিছনে এসে গোঁত্তাটা মেরেছিল, আমি জানতাম, ওর চলে যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে। শিবাপতি কীর্তনের পরে অনেক রাতে এসে আমায় ফিসফিস করে বলেছিল, “একবার শেষ দেখা দেখে নেবে নাকি?” আমি বেলকুঁড়ির মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না, তাই যাইনি। তার জায়গায় খবরের কাগজে মুড়ে দুটো প্রসাদী পরোটা, গুড়, কচুভাজা, চকোলেট বিস্কুট আর মাথায় কাঠ মেরে অজ্ঞান করা একটা কাঠবেড়ালি ওকে দেবার জন্য জয়া-মা’কে দিয়ে এলাম। সাথে একটা ছোট্ট চিরকুট – “ঠাকুরাণীর আশীর্বাদ সঙ্গে থাকুক।” নিজেকে বললাম, ওর জন্য যা-যা করা সম্ভব ছিল, আমি করেছি।

“জয় মা!” আমাদের দলটা একজোটে হৈহৈ করে ওঠে, “কিছু একটা করা হয়েছে!”

আমরা ছুটে যাই খোলা বাগানে, ঝলমলে সূর্যালোকে। সবাই খুব ভালো করে জানি, আমাদের বোনকে আশ্রমের বাইরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কোনোদিনই ওকে আর দেখতে পাব না। আমাদের প্রত্যেকের গলার ভিতর একটা শব্দ গুরগুর করে ওঠে, আর হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে সেই সম্মিলিত শব্দটা আকাশে উঠে গাছগুলোর পিছনে হারিয়ে যায়। আমি কান খাড়া করে শুনি, যদি বেলকুঁড়িও এই ডাক শুনে ফিরে ডাক দেয়, কোথাও থেকে। আমার বুক কাঁপে, যদি সে আমাদের ডাক শুনে ফিরে আসে? কিন্তু পাঁচিলের ওপার থেকে কেউ আমাদের ডাকের উত্তর দেয় না।

এরপর আমরা যথাসময়ে ঠাকুরাণীর থান থেকে পাশ করে বেরোই। আমার যতদূর মনে পড়ে, ওদিনের সেই ডাকটাই আমাদের দলের শেষ সম্মিলিত ডাক।

.

পঞ্চম পর্ব : অবশেষে ছাত্রীগণ নূতন সাংস্কৃতিক পরিবেশে সম্পূর্ণরূপে কর্মক্ষম হইয়া উঠিবে ও দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির অন্তর্বর্তী পরিসরে স্বচ্ছন্দে গমনাগমন করিবে।

.

আমার তখন আশ্রমে থাকার শেষ দিক। এক রবিবার, সাধ্বীরা আমায় বাড়ি যাবার বিশেষ অনুমতিপত্র লিখে দেয়। আবার একজন তাগড়া চাষীর পাহারায় জঙ্গল অব্দি যাওয়া। কিন্তু এবারের যাওয়াটা শুধু পাহারার কারণেই নয় – আমার তখন আর বাড়ির রাস্তা মনে নেই। আমি আমার সবচাইতে ভালো জামাটা পরেছি, সাথে আশ্রমের চকচকে স্টিলের টিফিন ক্যারিয়ারে স্টেশনের দোকান থেকে কেনা মাটন মশলা আর আশ্রমে বানানো মুখরোচক শশার আচার। আমরা ঝরে পড়া অসংখ্য পাতার উপর দিয়ে চুপচাপ হাঁটছি, আর আমার বুকে একটা অবসাদ আরও ভারি হয়ে জাঁকিয়ে বসছে। “আমি এইখানটায় থাকব,” আমার সঙ্গী শালগাছের পড়ে থাকা একটা শুকনো গুঁড়ির উপর গা এলিয়ে বসে, একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে বলে।

গুহাটা আমার যা মনে ছিল তার চাইতে অনেক ছোট বলে মনে হচ্ছিল। মাথা নুইয়ে ঢুকতে হল। ওরা তখন খাচ্ছিল। আধখাওয়া বুনো শুয়োরটার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ওরা একসাথে আমার দিকে তাকাল – আমার মাসিপিসিমামারা, এলিয়ে বসা কুতকুতে চোখ তুতো ভাইবোনেরা, মা, বাবা। মেজমামার মুখ থেকে একটা দাবনার হাড় খসে পড়ে গেল। আমার সবচাইতে ছোট ভাই ভয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। ছোট্ট এক নেকড়ে-বালক সে – লক্ষ্মীট্যারা। পরে অবশ্য সফলভাবে তার মানুষীকরণ করা হয় এবং সে এখন খিটখিটে ধরনের এক শিশুগল্প রচয়িতা। আমার মা ছিটকে আমার কাছ থেকে সরে গেল, যেন আমি অচেনা কেউ। টর্‌র্‌র্‌র্‌র্‌? তারপর মা আমায় অনেকক্ষণ শুঁকল। শেষে আমার পায়ের গোছে দাঁত বসিয়ে দিল, মুখে চাপা গর্ব আর দুঃখ। ল্যাজ নাড়ানাড়ি, ডাকাডাকি-চাপা গর্জনের পাট চুকে গেলে মা-বাবারা আস্তে আস্তে তাদের পিছনের পায়ে ভর দিয়ে বসে আমার দিকে তাকাল। ধূসর গুহার ঠাণ্ডা মোড়কে ওদের হাঁপানোর মৃদু শব্দ। চোখে আশা, যে আমি এবার ওদের কিছু একটা কয়ে-করে দেখাব, যে আমি কি শিখেছি, কি জেনেছি।

“দ্যাখো?” এই প্রথম আমি ঠিক মানুষের মতো করে মিথ্যে বললাম “দ্যাখো আমি ঠিক বাড়ি ফিরে এসেছি।”

লেখক পরিচিতি : কারেন রাসেল

চল্লিশ অনূর্ধ্ব সমসাময়িক অ্যামেরিকান গল্প লেখকদের মধ্যে কারেন রাসেল বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য নাম। জন্ম ১৯৮১। ম্যাকআর্থা‌র ফাউন্ডেশন জিনিয়াস গ্রান্ট ইত্যাদি একাধিক সম্মান প্রাপ্ত রাসেলের গল্পে বারবার উঠে আসে প্রকৃতি ও পশুজগত – মানুষের সামাজিক সম্পর্কের রূপক হিসেবে, মানুষ ও প্রকৃতির ক্রমবর্ধমান দূরত্বের পরিচায়ক হিসেবেও। রাসেল ‘সেন্ট লুসি’জ হোম ফোর গার্লস রেইজড বাই উল্ভস’ লেখেন ২০০৭-এ।

অনুবাদক পরিচিতি : মধুশ্রী বসু

গল্প পড়তে আর লিখতে উৎসাহী। জীবিকা – নাচ, ছবি আঁকা ইত্যাদি।

2 thoughts on “সাধ্বী ঠাকুরাণীর আশ্রমে নেকড়ে-পালিতা মেয়েরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.