অমিতাভ নাগ
অমিতাভ নাগ Silhouette সিনেমা-পত্রিকার সম্পাদক এবং সিনেমা নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজিতে কবিতা ও ছোট গল্প লেখেন – বিষয়বস্তু সাবঅলটার্ন। অমিতাভ পেশায় সফটওয়ার কোম্পানির চাকুরে এবং একদিন নিজে সিনেমা তৈরি করার স্বপ্ন দেখেন।
১
আমি যেখানে শুয়ে আছি সেখান থেকে আমার বাবার ঘরটা আবছা দেখা যাচ্ছে। অসংখ্য নলের ভিড়ের মধ্যে বাবার মুখটা খুব একটা ভালোভাবে আর দেখা যায় না। আমিও অনেকদিন আর বাবার মুখের দিকে তাকাইনি। বাবার চোখ বন্ধ বছর দুই, কথা তার ও আগে থেকে – তাই বাবার মুখের দিকে আমার আর তাকানোর দরকার হয়নি। বাবা কখনো আমায় কিছু বলতে চেয়েছিল কিনা আমি জানি না, মা যতদিন ছিল আমাদের কাছে ততদিন বাবা আমার কাছে কিছু চায়নি। মা যেদিন চলে গেল, সেদিন আমার খুউব আনন্দ হয়েছিল। মা আমায় এত বকাবকি করত! কিছু হলেই মা বলত -‘আর যাই হও তোমার বাবার মত দয়া করে হয়ো না’। বাবার মত হওয়া খারাপ কেন সেটা বলার আগেই মা চলে গেল একদিন। দুপুরবেলায়।
শনি ও রবি আমার বাবা দুপুরবেলাগুলোয় নিজের স্টুডিওতে চলে যেত। তার পর আমরা হাসির আওয়াজ শুনতে পেতাম, গানেরও। সেই সব রাতগুলোয় বাবা আমাকে ছাদে নিয়ে যেত। ‘তারা দেখিয়েই বাবা হয়ে যাওয়া যায় না আমি জানি। তবে না দেখিয়েও যায় না , বুঝলি রে হতভাগা।’ বাবা আমাকে নানা নাম ডাকত – কখনো ‘হতভাগা’, কখনো ‘বান্দর’, কখনো ‘শুয়ার’ কিংবা ‘পাঁঠা’। আমার ভালই লাগত কারণ সে সব সময়ে বাবার গায়ে বন্ধুর গন্ধ লেগে থাকত। কিন্তু এই গল্পটা বাবার গল্প না।
২
কনক আমার সঙ্গে অনেক বছর হলো আছে। কনক আমার থেকে ফর্সা আর প্রায় আমার সমান লম্বা। কনককে আমার প্রথম ভালো লাগে যখন ও আমার মায়ে কাছে পড়তে আসতো। আমি আমার ঘরের মেঝেতে শুয়ে পর্দার নীচ দিয়ে কনকের ফর্সা পায়ের পাতা দেখতাম। তখন থেকেই আমি ভাবতাম নিশ্চই ওর গোড়ালি খুব নরম আর লাজুক। কনক আমার থেকে বছর কয়েকের বড় ছিল। মা যেদিন দুপুরে চলে গেল তার কয়েকদিন পর কনক প্রথম আমার সঙ্গে কথা বলল – ‘দীপামাসি অঙ্কটা খুব ভালো পড়াত রে ,কেন যে চলে গেল! এক্জাম চলে এল এখন তো আর দূরে গিয়ে পড়তে পারব না!’ কনক কিন্তু শেষমেষ ভাল রেজাল্ট করে বাবার কাছে রিপোর্ট কার্ড নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। আমি আবার মেঝেতে শুয়ে ওর পা দেখার উপক্রম করতেই কনক হঠাত ঘরে ঢুকে আমার কানটা ধরে – ‘কি দেখছিস উঁকি দিয়ে? বাবা জানে, মেয়েদেরকে উঁকি দিয়ে দেখিস? ‘আমি ঘেমে যেতে থাকি আর কিছু না ভেবেই চুমু খাই কনকের পাতলা রামধনু ঠোঁটে। কনক হঠাত কেমন ভেবলে যায়। কিছু বলে না। তার পর আরো বছর পাঁচেক পর থেকে কনক আমার কাছে থাকতে শুরু করে। এই বন্দোবস্ত কনকই ঠিক করে।
৩
ঘরে যারা আছে সবাই কোনো কারণে খুব ফিসফিস করে কথা বলছে। ভাবটা যেন জোরে কথা বললে আমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে। কনককে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। কে একটা বলল – ‘বাবাকে বলা হয়েছে?’ আরেকটা গলা ভেসে এল – ‘বাবা তো ভেজিটিবল, বলে লাভ কি!’
– ‘কালই দেখা হল জানেন , তখন ও বুঝতে পারিনি এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে।’
– ‘কখন হল ? কাল রাতে রাগারাগি কিছু হয়েছিল কি?’
– ‘কে জানে বাবা। এদের বাড়িতে সবাই তো চুপ মেরে থাকে – দাদু থেকে নাতি!’
– ‘বৌটাকেও দেখছি না তো। কান্নাকাটিও করছে না, কি অদ্ভুত!’
– ‘আরে বিয়েই হয়নি আবার বউ!’
– ‘ছেলে হল কি করে তবে? ‘
– ‘কেন ছেলে কিভাবে হয় তুমি জানো না?’ – একটা চাপা হাসির কলরোল উঠলো। উঠেই আচমকা থমকে গেল। যারা কথা বলছে তাদের কাউকেই আমার বা কনকের কোনদিন পোষায়নি। তবে আজ যেহেতু বারণ করার কেউ নেই তাই তারা একবারে শোয়ার ঘরে উঠে এসেছে।
আমার এদের কথা শুনতে ভালো লাগছিল না। আমি এই আধ-অন্ধকার ভিড়ে আমার ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে দেখি সে একটু দূরে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছেলেকে আগে একদিন ডেকে বলেছিলাম ‘বাবা-মা চিরদিন থাকে না আবার থাকেও’। ছেলে না বুঝে আমার মুখের দিকে প্রত্যূষের আলোর মত চেয়ে আছে দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও আমি থামিনি – ‘আকাশের তারা হয়ে বাবা মা তোমায় দেখবে’। ‘সবার বাবা মা তারা হয়ে গেলে আকাশে আর জায়গা থাকবে, বাবা?’ ছেলে আমায় জিজ্ঞেস করেছিল।
আমি তাকে ডাকি ‘বাবু শুনে যা’। কথাটা তার কান অব্দি আজ আর পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না।
কারো একটা মোবাইল বেজে উঠল সাময়িক স্তব্ধতাকে খান খান করে। এতে ঘরের গুমোট ভাবটা কিছুটা কেটে গেল – কেউ কেউ উঠে একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা কিম্বা সিঁড়ির দিকে বা পাশে বাবার ঘরে উঁকি দিতে শুরু করল। বাবাকে যে নার্সটি দেখে তার নাকের তিলটা আজ অসামান্য উজ্জ্বল হয়ে আছে – আমার ধারণা সে আমাকে পছন্দ করত কারণ এবাড়িতে একমাত্র আমিই তার সঙ্গে কথা বলতাম। আমি ছাড়া সেই বাবাকে ‘বাবা’ বলে ডাকত, হয়ত সে কারণেই সে আজ বেশি নিশ্চুপ, নত। নিচের দিকের ইতস্তত বিক্ষিপ্ততা সত্ত্বেও তার লম্বা চুল কোমরের নিচ অব্দি এখনও – সে উঠে আস্তে আস্তে বাবার ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল।
৪
আমার মোবাইলটা বার দুয়েক বেজে উঠে থেমে গেল। ‘সে’ কি ফোন করবে? তার নামটা আমি মোবাইলে সেভ করে রেখেছি ‘সে’ বলে। ওয়াটসাপেও আছে ‘সে’। আমাদের প্ল্যান-মাফিক ‘সে ‘ র-ও ফোন করার কথা একবার। জেনে নেওয়া খবরটা সত্যি কিনা।
-‘তোমার কি মনে হয় এভাবে চলতে পারে?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
-‘তুমি শুধু প্রশ্ন কর। সমাধান তুমি জানো না। চাও কি?’ ‘সে’ বলে।
আমাদের মধ্যেকার কথা গুলো এভাবেই সময়ের ভারে মিহি হয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে যেতে থাকে আজকাল।
-‘আমার ছেলে বা তোমার মেয়ে – তাদের কি হবে ভেবেছ একবার?’
-‘তাদের কথা ভাবার জন্য তো অন্য লোকও আছে, কিন্তু আমাদের কথা?’
-‘বুঝলাম। মা চলে যাওয়ার পর বাবা হারিয়ে গিয়েছে।’
– ‘তুমি নিজের কথা ভাবতে শেখনি , অন্যদের কথাও না।’
– ‘আ সোল নিডস টু বী লিবারেটেড।.’
-‘কার লিবারেশন?’ আমাদের কথারা ঝুলতে থাকে অনিশ্চয়। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াতে থাকে আলোকরশ্মি – ঘরের মধ্যে, আমার মাথার ভিতর আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তর মনে হয়। গলন্ত লাভা আমার কান, নাক, চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরোতে থাকে।
আমি এর পরেও ‘সে’ র জন্য অপেক্ষা করে থাকি।
-‘একটা পথ আছে। টু রীড সোল’স মাইন্ড…’
-‘আবার হেঁয়ালি? তুমি পারো বটে!’
-‘না সহজ । তুমি তোমার মেয়ে , স্বামীকে ছেড়ে যেতে চাও কেন?’
-‘তোমার কাছে যাব বলে, জানো না যেন , ন্যাকা!’
-‘লীভ হোয়াট ইউ হোল্ড অন টু ইয়োরসেল্ফ, রান এন্ড বী ফ্রি।’
-‘তুমি কি করবে?’
-‘আমি তোমার জন্য ওয়েট করব। রিয়েলাইজ দেয়ার ইজ লাইট ফ্রম ইয়োর ওন সোল…’
‘সে’ কখন ফোন করবে আমি জানি না। তখন কে ধরবে ফোনটা? ছেলে ধরলে এক রকমের কথা হবে। কনক ধরলে হয়ত কোন কথা হবে না। নিঃশ্বাসের শব্দ শুনবে কেবল দুজনে। তারপর একে একে দুজনেই বুঝে নেবে যেটা বুঝে নিতে হবে তাদেরকে।
৫
একটার পর একটা ঘর পেরিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। আমার পিঠের ওপর আলোর যাদুকাঠি। এক বিশুদ্ধ সচেতনতা, ট্রান্সেন্ডেস আমাকে ঢেকে রাখে। এখানে কোনো স্পেস-টাইম নেই, যা আছে তা শুধুই আত্ম-সমীক্ষা, মুক্তির উড়ান।
উড়তে উড়তে আমি ভগবানের সামনে পড়লাম – দেখলাম তিনি আমার চেয়েও দীর্ঘকায়, আরো নবীন।
-‘আমি তোমার পাশে পাশে অনেকদিন থেকে হেঁটেছি। ‘
-‘আমি টের পাইনি কেন?’
-‘তুমি ব্যস্ত ছিলে তোমার ভালবাসায় আর দুঃখবোধে।’
-‘আমার এত দুঃখ কেন?’
-‘কারণ আনন্দিত থাকার জ্ঞান তোমার কাছে নেই, তুমি কেবলই গ্লানির বোঝা বয়ে বেড়াতে চাও।’
-‘আমি খুব ক্লান্ত কারণ মৃত্যু বড্ড বোরিং।’
-‘কিন্তু তুমি তো তাই-ই চেয়েছিলে – অনন্ত মুক্তি।’
-‘আমি সেই মুক্তির স্বাদ তো পাচ্ছি না।’
– ‘তুমি তোমার চশমাটি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছ যে।’
-‘আমি তোমার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম।’
-‘তুমি ‘সে’কেও ছাড়তে চাও নি।’
-‘আমাকে ক্ষমা করে দাও।’
-‘কি চাও তুমি।’
-‘আমি আমার ছেলেকে দেখতে চাই।’
ভগবান তাঁর হাতটা আমার হাতে ছুঁয়ে দেওয়া মাত্র আমার চোখের সামনে থেকে সরে যেতে লাগলো চিত্রকল্প। তারপর আমার ঘরের জানলায় ফ্রিজ হয়ে গেল।
৬
আমার বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন বেজে যাচ্ছে। কয়েকবার বাজার পর কনককে দেখতে পেলাম ফোনটা ধরছে। কনককে আগের মতই লাগছে – বিষন্ন, উদাসীন, উষ্ণতা-বিহীন।
-‘তোমার কি দেরী হবে আজ অফিসে?’
-‘কনক আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না কিছুদিন।’
-‘তোমার লিবিডো মেটানোর জন্য মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না বুঝি?’ – কনকের গলায় হতাশা থাকে না, ক্ষোভ ও না, যেন দূরদর্শনের খবর পড়া চলছে – অনাসক্তি।
-‘ছেলে কি করছে ?’
-‘ছাদে উঠে তারা দেখছে।’
আমি ছেলের মোবাইলে ঢুকে পড়ি | বাজতে থাকে মোবাইলটা । ছেলে অন্যমনস্ক আকাশের দিক থেকে সম্বিত ফিরে পায় একটু পর । স্ক্রিনে ফুটে ওঠে – ‘বাবা’ ।
– ‘বাবা?’
আমি কোনো কথা বলি না – আমার ছেলে কানে চেপে ধরে মোবাইলটা । তার গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ আমায় ঘিরে ঘুরপাক খেতে থাকে|
-‘জানো বাবা সেদিন একজন ফোন করেছিলেন তোমার ফোনে – দেখলাম নাম সেভড আছে ‘সে ‘ বলে। মহিলা। বলল তোমার সঙ্গে নাকি দেখা হওয়ার কথা। জানত না। তারপর আরো বার দু-এক করেছে জানো, কিন্তু কোনো কথা বলেন না। আমিও বলিনা। তখনও ফোনটা ধরেই থাকেন। পাগল কিনা কে জানে। ও দাদুর পেসমেকারে একটা প্রবলেম হচ্ছে – ডাক্তার কাকু সেদিন এসে বলেছিল আবার আসবে টেস্ট করবে কিসব যেন…’
আমার ছেলে আরও কথা বলতে থাকে । আমি আসতে আসতে কেটে দিয় ফোনটা – নেমে আসি বিছানায় – বাবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হঠাত বাবাকে অসহ্য অসহায় লাগে – বেঁচে থাকাটাই কি অসম্ভব লোভ একটা সেটা ভাবি । বাবার পেসমেকার- এ কান রাখি – টিক টিক টিক।
আমি পেসমেকারের ভিতরে ঢুকে পড়তে থাকি। কনক ঘরে ঢোকে –
একলা।
*
চিত্রণ: সংহিতা স্যান্যাল
1 thought on “বাবা”