সিজার মিশ্র
আর একটাও লাইন নেই…
আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে ২০১২ সালে জানুয়ারি মাসে আমি এবং আমার কিছু স্কুলের বন্ধুরা মিলে ঠিক করে ফেললাম “অন্যদিগন্ত” নাম দিয়ে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করব। এই লিটল ম্যাগাজিন ব্যাপারটা কয়েকজন ধরতে পারেনি। তাদের কাছে ম্যাগাজিন মানে ম্যাগাজিন; লিটল, বিগ বলে কোন ধারণাই তাদের নেই। ঠিক যেমনটা আমারও ছিল না ২০১০ এর আগে। পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা, দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর শহর বালুরঘাটে আমার বাল্যকাল এবং কৈশোর কাটে। বালুরঘাটেই আমার স্কুল জীবনের শুরু এবং শেষ। উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে ২০০৯ সালে কলকাতা চলে আসি কলেজে পড়ার জন্য। ২০১০ সালে প্রথম কলকাতা বই মেলা দেখতে যাওয়া এবং সেখানেই লিটল ম্যাগাজিন আর্কাইভের সাথে পরিচয় ঘটে। এর আগে পর্যন্ত লিটল ম্যাগাজিন এবং আরো অনেক কিছুর সাথেই পরিচিত ছিলাম না।
কলকাতা আগমন এবং কিছু ঘটনা
২০১০ সালে প্রথম এসএফআইতে যোগ দেই। আমি যেহেতু সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়তাম, আর সেখানে ইউনিয়ন বলতে এসএফআই-ই শুধু ছিল, তাই কলেজে একটু সুবিধে করার জন্য দলে নাম লেখাই। সুবিধে বলতে যাতে করে কলেজের ফি জমা দেওয়ার সময় যাতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে না হয়, পাসের ক্লাসগুলোতে উপস্থিতির হার কম থাকলেও যেন পার পাওয়া যায় এমন কিছু কারণে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের শোচনীয় পরাজয় এবং তৃণমূলের উঠে আসা, সব মিলিয়ে কলেজ রাজনীতিতেও এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল চোখের সামনে। এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে ১৩ই মে, ২০১১, সোমবারে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচনে জয়ী ঘোষণা করা হয় এবং ঠিক তার ২ দিন পরে অর্থাৎ ১৬ই মে, বৃহস্পতিবার কলেজে যাই। দুপুর ১টা কি ২টো হবে; কলেজে ঢুকতেই দেখি নিস্তব্ধতা। মনে হচ্ছে শ্মশানে চলে এসেছি যেন। ভেতরে ঢুকতে চোখে পড়ল, আগে যেখানে এসএফআই লেখা বিশাল এক ফেস্টুন ঝুলত, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধায়ের ছবি লাগানো তৃণমূলের ফেস্টুন ঝুলছে। শুনলাম যারা এসএফআই করত সবাই (৭/৮ জন ছাড়া) নাকি তৃণমূলে যোগ দিয়েছে। যারা থেকে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে ভেবেছিলাম “দেবা”-দাও নিশ্চয় থাকবে, পরে শুনলাম সবার আগে নাকি সেই কেটে পড়েছিল। কারণ তার নামে নাকি অনেক অভিযোগ ছিল পুলিসে, মস্তান ছিল নাকি সে।
এরপরও আমি প্রায় ২/৩ মাস এসএফআই-তেই থাকি, সেই সূত্রে কলেজস্ট্রীটের ফেবারিট কেবিনের দিকে সিপিএম-এর জোনাল পার্টি অফিস আছে সেখানেও যাতায়াত বেড়ে যায়। প্রায় প্রতিদিনই সেখানে যেতাম, বেশ কিছু বয়স্ক নেতা এসে ৭০-এর দশকের গল্প বলতেন। আর এক দাদা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজের দায়িত্বে, কি ভাবে আবার সুরেন্দ্রনাথে নিজেদের হারানো জায়গা পুনরুদ্ধার করা যায়। এমন নানা আলোচনা থেকে ধীরে ধীরে বুঝতে পারি আসলে ছাত্রীছাত্রদের জন্য সুবিধে নয়, এঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ক্ষমতা দখল করা। ঠিক এমন সময়, যখন আমি কি করব বলে ভাবছি, এসএফআই তে থাকব কি থাকব না, তখন আমার এক স্কুলের বন্ধু মৃন্ময়ের সাথে আবার দেখা হল কলেজ স্ট্রীটে। মাসটা আগস্ট, কফিহাউসে বসে নানা কথাবার্তা চলছে, পুরোন দিনের বেশ কিছু কথা উঠে আসছে, সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যতে কি হতে পারে এমন নানা আলোচনা চলতে থাকে। সবে সবে ছাত্র রাজনীতি করছি, বেশ উত্তেজিত আমি। তবে মনে শঙ্কা জাগে আমার এই বন্ধু হঠাৎ করে এত রাজনৈতিক বক্তব্য রাখছে কেন? কারণ স্কুল জীবনে ও কখনোই রাজনীতির ধারে কাছে ঘেঁষেনি। এমন করে ৬/৭ দিন যাওয়ার পরে জানতে পারলাম সেও নাকি ছাত্রীছাত্র রাজনীতি করছে। আমি জানতে চাইলাম কোন দল করিস তুই, এর উত্তরে ও যা বলেছিল তাতে আমি প্রথমটায় ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কারণ এসএফআই, সিপি, আরএসপি, তৃণমূল ছাত্র সাংসদ এদের বাইরেও যে কিছু থাকতে পারে জানা ছিল না। আর এও জানতে পারলাম যে এই ছাত্রীছাত্র সংগঠনের কোন মা-বাবা-ঠাকুরদা নেই, এরা স্বাধীনভাবেই ছাত্রীছাত্র সমাজের দাবিদাওয়া তুলে ধরে। এরপরে সেই সংগঠনে যোগ দেওয়া এবং নানা ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকা। এসএফআই থেকে বেরিয়ে আমি যে সংগঠনে যোগ দিয়েছিলাম, তার সূত্র ধরেই ২ মাসের মাথায়, নভেম্বর ২০১১-র শেষের দিকে প্রত্যক্ষ করলাম কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রীছাত্র নির্বাচনকে ঘিরে মেডিক্যাল কলেজের স্বাধীন ছাত্রীছাত্র সংগঠন বনাম মূল ধারার রাজনৈতিক দল (বর্তমান সরকারের) ও মিডিয়ার ভূমিকা। খবরের কাগজে দেখি কতটা মিথ্যা প্রচার চালান হচ্ছে। আবার কিছু কাগজ খুব নিপুণতার সাথে অর্ধেক খবর প্রকাশ করেছে, যাতে করে সরকারেরও মন জয় করা যায় এবং কেউ মিথ্যাও বলতে না পারে। অর্ধেক সত্য (খবর) যে কতটা ক্ষতিকর সেদিন বুঝেছিলাম।
হঠাৎ করে লিটল ম্যাগাজিন কেন?
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ঘটনার এক মাস আগেই দুর্গাপুজোতে নিজের দেশের বাড়ি যাই। সেখানে স্কুল জীবনের প্রায় সব বন্ধুদের সাথে এক সাথে দেখা করার এক মস্ত সুযোগ থাকে। এই সময় আমাদের মধ্যে এক জন প্রস্তাব দেয়, রি-ইউনিয়ন করলে কেমন হয়? প্রায় প্রত্যেকেই উৎসাহী হয়ে সম্মতি জানায়; সেই অনুসারে ঠিক হয় কালীপুজোতে একটা রি-ইউনিয়ন করা হবে। দুর্গাপুজো শেষ হলে আবার কলকাতা ফিরে আসি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে বন্ধুদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় থাকে, তার জন্য রি-ইউনিয়ন করা হবে। কিন্তু আমার মনে হল, রি-ইউনিয়ন তো বছরে একদিনের জন্য, এর দ্বারা তো মূল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। কালীপুজোতে আবার বাড়ি যাই এবং একদিন মোটামুটি যারা রি-ইউনিয়ন করবে বলেছিল তাদের ডাকি। বিকেল বেলা টাপ্পুর বাড়িতে কিছু বন্ধু মিলিত হই। অনেকেই আসেনি (হতে পারে আসতে পারেনি)। আমি আমার উদ্বেগের কথা সামনে রাখি এবং অন্য ধরনের এমন কিছু করা যায় কিনা, যাতে করে প্রায় সারা বছর আমরা প্রত্যেকের সান্নিধ্যে থাকি, সেটাও ভাবতে বলি। আলোচনার মাধ্যে দিয়ে নানা প্রস্তাব উঠে আসে, সব শেষে ঠিক হয় এমন কিছু করা হবে যাতে করে আমরা সেই কাজ বেশ কিছু দিন ধরে পড়াশোনার পাশাপাশি চালিয়ে যেতে পারি। সেই সময় প্রস্তাব আসে তাহলে পত্রিকা প্রকাশ করা হোক। আমার মাথায় লিটল ম্যাগাজিন ব্যাপারটা খেলে যায়। কারণ আমাদের মাঝে পত্রিকা বলতে সেই স্কুলে থাকাকালীন যে পত্রিকা বেরত তাই বোঝায়। লিটল ম্যাগাজিনের পক্ষে সবাই সম্মতি জানাল, কারণ ইন্টারনেটের যুগে লেখা পাঠানোতে কোন অসুবিধে হবে না, আর কাগজে প্রকাশিত না হলেও ই-ম্যাগাজিন আকারে তো প্রকাশ করাই যাবে। আর এই ম্যাগাজিনকে ঘিরে প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের যোগাযোগও থাকবে।
সমস্যা এবং উদ্দীপনা
২০১২ এর ২১শে মে “অন্যদিগন্ত” নামে আমাদের প্রথম ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। মনে পরে সন্ধে বেলা বৈঠকখানা রোড থেকে আমি একা ১৫০টি কপি নিজে তুলে আনি। সেদিন অদ্ভুতভাবে অন্য এক ভাল লাগা জন্মায়। নতুন কিছুর সূচনার আভাস ছিল সেদিন। এই প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করতে গিয়েই বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথম এবং প্রধান সমস্যা ছিল লেখার জোগাড় করা। যেহেতু আমরা কেউই তেমনভাবে কখনোই কোনো গঠনমূলক লেখার সাথে যুক্ত ছিলাম না, সে জন্য আমাদের মধ্যে লেখা তেমন ভাবে কেউই দিতে পারেনি। ১৩ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ৩ জন লেখা দিয়েছিল। এছাড়া ২-৩ জন চেনা মানুষের কাছ থেকে লেখা পেয়েছিলাম। তবে এই সংখ্যা প্রকাশের জন্য নূন্যতম যে লেখা প্রয়োজন ছিল, সেটার ৯০% লেখা পেয়েছিলাম বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছ থেকে। ২০১০ সালের শেষের দিকে ফেসবুকে এসে কি কি ভাবে যেন বাংলাদেশের অনেকের সাথে পরিচয় ঘটে। ইরফানুর, আবিদুলদা, ইস্ক্রা, সুদীপ, সুদীপ্ত, চন্দ্রশেখর – বাংলাদেশের এই বন্ধুরা না থাকলে ৭ মাসের মধ্যে “অন্যদিগন্ত” কাগজে ছেপে প্রকাশিত হতে পারত না। পরবর্তীকালে এদের অনেকেই আবারও লেখা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, কিভাবে এডিটিং করতে হয়, কি ভাবে লেখা সাজাতে হয়, সে ক্ষেত্রেও একটি সমস্যা ছিল। অরিজিৎদার সাহায্যে এই সমস্যার তৎকালীন সমাধান ঘটে। তৃতীয়ত, লোক বলের অভাব; খাতায় কলমে ১৩ জন সদস্য হলেও শুধুমাত্র আমাকেই প্রথম বার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হয়েছিল, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ; ঠিক একই সমস্যা হয়েছিল দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের সময়। দ্বিতীয় সংখ্যায় সুদীপ, যে এই ম্যাগাজিনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, তাকেই সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হয়। মানের দিক থেকে হয়ত খুব বেশি আহামরি হয়ত কিছু হয়নি, তবে আত্মপ্রকাশ হিসেবে আমার ব্যক্তিগত মতে খারাপও ছিল না।
হতাশা
প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পরেই আমি ব্যাঙ্গালোরে চলে আসি। এমন সময় আমি ছাড়া শুধুমাত্র সুদীপ, যে ম্যাগাজিনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল। যে কারণে ম্যাগাজিনের সূচনা, সেটা ধাক্কা খায়। অন্য কোন সদস্যই কোন ভাবেই ম্যাগাজিনের সাথে নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে উঠতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে যেমন নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে অনেকেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, সাথে সাথে কলকাতা থেকে দূরে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার জন্যও ম্যাগাজিনের প্রতি যে দায়বদ্ধতা সেটা কোথাও আলগা হয়ে যাচ্ছিল। এছাড়াও ধীরে ধীরে অনেকেই নিজেদের সরিয়ে নেয়, অনেকে শুধু মাত্র প্রতি মাসে টাকা দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। মৃন্ময় নিজে থেকে সরে যায়, কারণ ওর পক্ষে ম্যাগাজিনে সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, সেটা আমিও জানতাম, ও প্রচন্ড ভাবে সংগঠনের কাজে নেমে পড়েছিল। যাই হোক, প্রথম থেকেই শুনে এসেছি, “লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম হয় মৃত্যুর জন্য”। কিন্তু আমি এবং সুদীপ, আমাদের দুই জনের মধ্যে জেদ ছিল এই প্রবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করার। এমন সময় দাঁড়িয়ে আমার কলকাতা ছাড়া ছিল অন্যতম ঝুঁকি। তাই অনেকের কাছেই শুনতে হয়েছিল, “তুই ছেড়ে চলে যাচ্ছিস, দেখবি ম্যাগাজিনের এটাই প্রথম আর শেষ সংখ্যা হয়ে যাবে।” ইতিহাস তো এই কথাকে সমর্থনও করে, তবে কি সত্যি ম্যাগাজিনটা বন্ধ হয়ে যাবে। পথ চলার সুচনাতেই কি সমাপ্তির ঘণ্টা বেজে গেল তাহলে? এমন অনেক প্রশ্ন মনে জাগে, হতাশাও ঘিরে ধরে।
আশার আলো
ব্যাঙ্গালোরে চলে আসার পরে বেশ কিছু দিন কেটে যায়। আমি নিজেও নতুন পরিবেশে, নতুন সমাজে নিজেকে খাপ খাওয়াতে সময় নিই। কিছু দিনের জন্য হলেও ম্যাগাজিন নিয়ে ভাবার সময় হয়ে ওঠেনি। এরপর সুদীপ হঠাৎ করে বলে বসল, ৫/৬ মাস হয়ে গেল এবার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের জন্য কাজে নামা যাক। আচমকাই যেন একটা আশার সঞ্চার হয়ে গেল। আবার কোথাও গিয়ে মনে হল, এখনো তো আমরা আছি; ম্যাগাজিনও থাকবে তাহলে।
প্রত্যাশা
বর্তমানে এসে আমরা পঞ্চম সংখ্যা প্রকাশ করে ফেলেছি। তৃতীয় সংখ্যা থেকেই “অন্যদিগন্ত” বালুরঘাটের সদস্যদের বৃত্ত ছেড়ে অনেকটাই বেড়িয়ে পড়েছে। নতুন এক প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছে। এখন যে ম্যাগাজিনের প্রকাশের জন্য আমি অথবা সুদীপের উপর নির্ভর করতে হবে, তেমন পরিস্থিতি আর নেই। বেশ খানিকটা ব্যাক্তি নির্ভরতা কাটিয়ে আমাদের প্রচেষ্টা এখন সমষ্টি নির্ভর। আর এ নির্ভরতা এসেছে অঞ্জন, সৌম্য, সিম্পি এদের কারণে। শুধু মাত্র ম্যাগাজিন প্রকাশ করার দায়িত্বই নয়, সাথে করে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনার আমদানি করেছে এরা, ম্যাগাজিন বিক্রির ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে এই তিন জনের।
রাজনৈতিক বোঝাপড়া
অন্যদিগন্ত কি শুধু মাত্র বন্ধুদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য থাকবে? এই ভাবে কি আদৌ সেটা করা সম্ভব? এমন কিছু প্রশ্ন অন্যদিগন্তের প্রায় শুরু থেকেই আমায়, সুদীপকে ভাবিয়ে তুলেছিল। ম্যগাজিনে কি ধরনের লেখা প্রকাশিত হবে সেটা নিয়ে এক বিস্তর আলোচনাও করা হয়। আমি কলকাতায় আসার পরে ২০১১ সাল পর্যন্ত যে কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন পড়েছিলাম, হাতে পেয়ে একটু উল্টে পাল্টে দেখার সুযোগ হয়েছিল, তাতে করে মনে হয়েছিল মূলত দু’টি ধারা বর্তমান। এক ধরনের ম্যগাজিন সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেই বেশি পছন্দ করে, বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের কোন হেলদোল নেই, আবার কিছু ম্যাগাজিন বর্তমানে নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলে, তবে তাদের মধ্যেও যেন এক ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে। তারা আবার কোন ভাবেই সাহিত্যমূলক লেখা প্রকাশ করে না, ছোট গল্প, কবিতা এ গুলো যেন ব্রত। তাই যাতে করে আমরা কোন ভাবেই সীমাবদ্ধ না হয়ে পরি, সে ব্যাপারে প্রথম থেকেই আমারা সচেতন ছিলাম। তবে শুধু মাত্র যে এই সচেতনতা দিয়ে ম্যাগাজিনকে সঠিক পথে চালান যায় না; এর জন্য যে একটা রাজনৈতিক মতাদর্শ, বোঝাপড়ার জায়গা থাকা দরকার তা নিয়ে কোন দ্বিধা ছিল না। কিন্তু সমস্যা ছিল, আমি ছাড়া প্রায় কেউই সরাসরি রাজনীতি করত না। সুদীপ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, সেই সূত্রে বাম/ডান/তৃতীয় সব ধরনের রাজনীতির মতাদর্শের সাথে ওর একটা যোগাযোগ, বোঝাপড়া তৈরি হয়।
- সদস্যদের প্রতি
প্রথম এবং দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশ কাল পর্যন্ত যেহেতু ম্যগাজিনের বেশির ভাগ সদস্যই বালুরঘাটের ছিল এবং আমি ও সুদীপ যেহেতু ম্যাগাজিনের আগাগোড়া সব ঠিক করতাম, তাই রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে তেমন অসুবিধে হয়নি। ২০১৩ সাল থেকে আরো দু’জন ম্যাগাজিনে যোগ দেয়, তারা আমারই বন্ধু, তবে হাওড়ার। এই সময় থেকে ম্যগাজিনে কেমন ধরনের লেখা দেওয়া হবে, কোনটা বাদ যাবে এই নিয়ে মতপার্থক্যের একটা জায়গা তৈরি হতে থাকে। ম্যগাজিনে শুধু কেন ছাত্ররাজনীতি, নারীর সামাজিক অবস্থা, গণ আন্দোলন ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখা থাকবে, কেন উনিশ-কুড়ি ম্যাগাজিনের মত কোন প্রেমের গল্প থাকবে না, এমন নানা বিষয় নিয়ে বিতর্কের একটা জায়গা তৈরি হয়। এ সময় সব থেকে বেশি করে বুঝতে পারি ম্যাগাজিনের মাধ্যমে আসলে আমরা ঠিক কি করতে চাইছি, সেটা না জানা থাকলে সামনে অনেক অসুবিধের মধ্যে পড়তে হবে। কারণ আমাদের বয়সী অনেকের কাছে ম্যাগাজিন মানে উনিশ-কুড়ি; যেখানে দুষ্টু প্রেমের মিষ্টি গল্প থাকবে, থাকবে বাজে কিছু কবিতা, নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে কোন সেলিব্রিটির অবান্তর বক্তব্য, রাশিফল, বোগাস সব সিনেমা নিয়ে আলোচনা। এরকম ধারণা নিয়ে যদি কেউ ম্যাগাজিন করতে আসে, তাহলে যে সমস্যার উদ্ভব হবে, তা আমাদের জানা ছিল; আর এ জন্যই আমরা ঠিক করি ম্যগাজিনে কেউ সদস্য হতে চাইলে, প্রথমেই তাকে প্রাথমিক কিছু ব্যাপার বলে দেওয়া হবে। আর এ জন্যই অন্যদিগন্ত ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম তৈরি করা হয়। যেমন, ম্যাগাজিনে দুষ্টু প্রেমের মিষ্টি গল্প টাইপের কোন প্রেমের গল্প থাকবে না, কারণ এমন প্রেমের গল্প মানেই সেই চিরন্তন নারীর কনসেপ্টকে প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া কিছুই নয়; কোন মূল ধারার ছায়াছবি (কিছু বেছে নেওয়া ছবি ছাড়া) নিয়ে আলোচনা হবে না, কারণ মূল ধারার ছায়াছবিতে অবাস্তব সব স্বপ্ন বিক্রি করা হয়, যার সাথে প্রাত্যহিক জীবনের, বাস্তবের কোন সম্পর্ক থাকে না; ইচ্ছাকৃত কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের (মূল ধারা/তৃতীয় ধারা, যেই হোক না কেন) সপক্ষে অথবা বিপক্ষে লেখা যাবে না, কারণ আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে কোন রাজনৈতিক দলই ধোয়া তুলসী পাতা নয়, খাওয়াখায়ি সব দলের মধ্যেই আছে, কোথাও দৃশ্যমান, কোথাও অদৃশ্য; ব্যক্তিপুজো বর্জনীয়, অর্থাৎ যদি সময়ের দাবি মেনে কোন প্রিয় ব্যক্তি সম্পর্কে লিখতে/সমালোচনা করতে হয়, তাহলে যেন কোন ভাবেই তা পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে পড়ে। সুতরাং এই বিষয়গুলো জেনে যদি কেউ সদস্য হতে চায়, তাহলে ভবিষ্যতে কাজের ধরণ নিয়ে আলোচনা হতে পারে, মতাদর্শ নিয়ে বিরোধের জায়গা অন্তত আর কোন ভাবেই চরম জায়গায় পৌঁছবে না যেখান থেকে ম্যাগাজিনের ক্ষতি হতে পারে।
- সমষ্টি বনাম ব্যক্তি
ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে একটা অদ্ভুত সমস্যা দেখলাম, শুধু ম্যাগাজিন না, যে কোন যৌথ উদ্যোগেই হয়ত দেখা যায়। সমস্যাটা হল, অন্যদিগন্তের সদস্যদের প্রত্যকেরই নিজস্ব বক্তব্য, কোনো ঘটনা নিয়ে নিজস্ব দৃষ্টি ভঙ্গি থাকতেই পারে। কোথাও কথা বলা, অথবা লেখালেখির ক্ষেত্রে ভিন্ন মত প্রকাশ করা হতেই পারে। তবে এই ভিন্ন মত, ভিন্ন দৃষ্টি ভঙ্গি কতটা ভিন্ন হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা দরকার। কারণ সমষ্টি আর ব্যক্তির মধ্যে সব থেকে বড় দ্বন্দ্ব মত প্রকাশে, ভিন্ন দৃষ্টি ভঙ্গিতে। এমন নানা সময় এসেছে যখন কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে মতপার্থক্য এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে সেই নিয়ে প্রায় কোনো লেখাই কোনো সদস্য লেখেনি, অথবা ম্যাগাজিনের ফেসবুক পেজে দেওয়া হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, আমার ব্যক্তিগত ভাবে “নারী মুক্তি আন্দোলনের ধারা”, “গণ আন্দোলনের কিছু কিছু ব্যাপার”, “ছাত্রীছাত্রদের বেশ কিছু বিষয়ে আন্দোলন” নিয়ে মতবিরোধ থেকেই গেছে। তবে সেই বিরোধের অথবা মতপার্থক্যের দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই বিপরীত যে তা নিয়ে একটা বোঝাপড়ার জায়গায় আসা সম্ভব হয়নি। যেমন, কলকাতার নানা চত্বরে বিভিন্ন নারীবাদী পথ সভা থেকে কনভেনশন, সব জায়গাতেই দেখি প্রায় একই বক্তব্য দিনের পর দিন রেখে চলেছেন কিছু ব্যক্তি; আর তাঁদের হাত ধরে নতুনরাও সেই একই বুলি আওড়ে চলেছে। বক্তব্যগুলোতে সব দোষ পুরুষের, সব ষড়যন্ত্র পুঁজিবাদী সমাজের, সব ধরণের চরমপন্থা রাষ্ট্রের। উল্টে দেখেছি, নারীদের পরোক্ষ ভাবে ‘অবলা’, ‘রক্ষার দায়িত্ব’ পুরুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া এমন নানা প্রবণতা এই সমাজের মধ্যে প্রবল ভাবে বর্তমান। যা সরাসরি দেখতে পাওয়া যায় না, তবে জন-মানসে পরোক্ষ ভাবে প্রভাব সৃষ্টি করে। এমন ক্ষেত্রে কারো কারো মনে হয় আমার বিশ্লেষণ ভুল, আবার আমার মনে হয় তারাই ভুল। আবার আমি নিজের ফেসবুক পোস্টে কিছু লিখলে, যদি সেটা বিতর্কিত হয় সেটা নিয়ে অন্যদিগন্তকে অনেক সময় কথা শুনতে হয়। আসলে সমস্যাটা সামাজিক। ব্যক্তি এবং সমষ্টি যে আলাদা এবং যে কোনো ধরণের দলই যে ব্যক্তির আগে নয় (কারণ ব্যক্তির সমষ্টি দিয়ে একটি দল/সংঘ গঠিত হয়, ব্যক্তি-ব্যতিরেকে সংঘের বা দলের কোন অস্তিত্বই থাকে না), এমন কিছু জায়গায় অসম্ভব ধরনের ঘোলা জল জমা হয়ে আছে, যা পরিষ্কার করার কাজ খুব সচেতন ভাবে কেউ খুব বেশি করেনি।
- যৌথ উদ্দ্যোগের কিছু নোংরামো
- ঘটনা- ২০১৩ এর মাঝ বরাবর কফিহাউস, কলেজ স্ট্রীট চত্তরে কিছু নতুন মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে। এর মধ্যে কয়েকজন অন্যদিগন্তের কিছু সদস্যদের বন্ধুবান্ধব ছিল। তারা কেউ প্রসিডেন্সিতে এমএ করছে, কেউ স্কটিশে গ্র্যাজুয়েশান। এমন কিছু লোকজন মিলে নিজেদের ম্যাগাজিন প্রকাশ করার উদ্যোগ নেয় এবং আমাদের লেখা দিতে বলে। প্রথম দিকে আমি লেখা দিইও। ভালই চলছিল, নানা রকম আলোচনা, একসাথে চিত্র প্রদর্শনী করাও হয়। এরপর ২০১৩ সালের আগস্ট নাগাদ আমরা নিজেরাই পুজো সংখ্যা প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগ নেই, তখন ওদের দিক থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় এক সাথে যৌথ উদ্যোগে প্রকাশ করার। তাতে করে যেমন খরচা কম হবে, তেমনি বেশি লোকের কাছেও পৌঁছান যাবে নিজেদের বক্তব্য নিয়ে। আর রাজনৈতিক ভাবে যেহেতু লেখালেখির দিক দিয়ে মতাদর্শের মিল ছিল বেশ কিছুটা, সেহেতু এক কথায় আমরা হ্যাঁ করে দিই। নতুন একটি নামও ঠিক হয় পুজো সংখ্যার জন্য, যেহেতু যৌথ উদ্যোগে করা হচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায় কোনো ধরণের আলোচনা আর হচ্ছে না, কবে কি হবে কেউ কিছু বলছে না ওদের দিক থেকে। পুজো প্রায় চলে এসেছে, এমন সময় ওরা জানাল – না, এবার আর হচ্ছে না মনে হয়, কিছু অসুবিধের কথা অজুহাত হিসেবে খাড়া করে। আমরা বেশ কিছুটা আশাহত হই, কারণ আমাদের কাজকর্ম একক ভাবে প্রকাশ করা যাবে এমনও আর মনে হচ্ছিল না। আমরাও পিছিয়ে আসি। কিন্তু পরে পুজোর মধ্যে খবর পাই ওরা একক ভাবে নিজেদের ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছে। এরপর খুব সুন্দর করে পরিষ্কার হয়ে যায়, ওরা চেয়েছিল যাতে করে আমরা আমাদের ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে না পারি। আর পিছন থেকে কাজ করেছিল কিছু জ্যাঠা, কাকুদের মাথা, যারা ১৫/২৫ বছর আগে ছাত্র জীবন পার করে আসার পরেও একটা বড় ধরনের ছাত্রীছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করে। যারা প্রস্তুত হয়েই চলেছে আজন্ম ধরে, কিন্তু এখনও শেষ হয়নি তাদের প্রস্তুতি পর্ব। আর ছাত্রীছাত্র ধরার অন্যতম কৌশল হিসেবে তারা ম্যাগাজিন, নাটকের দল, ফটোগ্রাফির দল খুলে বসে থাকে; আর তাতে কাজ করে এমন কিছু কলেজে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মুখ যারা নিজেদের ইন্ডিভিজুয়াল শিল্পী বা অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচয় দেয়। আমাদের ম্যাগাজিনের সম্পর্কে ওদের ধারণা ছিল যে অন্য একটি বিশেষ ছাত্রীছাত্র দল প্রধানত এর পিছনে আছে (আসলে যে যেমন সে অন্য ব্যক্তিকেও নিজের মতই ভাবে; চোর সাধুকেও চোর ভাবে, এদের অবস্থাও ঠিক সে রকম)। আর তার জন্য প্রথমে ওরা নানা ভাবে আমাদের সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ডে টানার চেষ্টা করেছিল এবং পরবর্তীকালে সেটা না পারায় এই নোংরা রাজনীতি খেলে আমাদের ম্যাগাজিন প্রকাশটাকে পিছিয়ে দেওয়া এবং ম্যাগাজিনের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টির চেষ্টা; যদিও শেষ পর্যন্ত এর ফল হয়েছিল উল্টো। এই সময় থেকে রাজনৈতিক ভাবে আরো একটা ব্যাপার আমার মনে হয়; শুধু মাত্র প্রগতিশীল কথা বলে কেউ প্রগতিশীল হয় না। ব্যক্তি হিসেবে কথার থেকেও যে কাজটা বেশি জরুরি, আর তাতে ভর করেই যে দলের অন্যান্য সদস্যরাও কাজ করতে এগিয়ে আসবে, একটি প্রগতিশীল বাতাবরণ তৈরি হবে, তা বেশ ভাল ভাবেই টের পাই এবং সাথে সাথে যৌথ উদ্যোগ কেন বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, তা হাতেনাতে বুঝতে পারি।
- কেন এমন হয়?– এবার সব থেকে বড় প্রশ্নটা আমায় তাড়া করে বেড়াতে থাকে – এমন কেন হচ্ছে? আমি একটু আধটু যা ছাত্রীছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস পড়েছি, তাতেও দেখেছি বিভিন্ন সময় নানা স্বাধীন ছাত্রীছাত্র সংগঠন ভেঙ্গে গিয়ে আলাদা হয়ে গেছে এবং পরবর্তীকালে কখনোই তারা একসাথে পুনরায় যুক্ত হয়ে সংগঠিত ভাবে কাজ করেনি। ২০১৫ সালে দাঁড়িয়ে আমি নিজের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অনুভব থেকে কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি (অবশ্যই এই সিদ্ধান্তগুলো পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।)। প্রথমেই মনে হয়েছে যেহেতু একটা বাঁধা-ধরা সামাজিক নিয়মের মধ্যে আমাদের জীবনের প্রাথমিক পর্যায় আবর্তিত হয়, যেখানে বাইরের পৃথিবীর সাথে আমাদের মুক্তভাবে মেলামেশার সুযোগ থাকে কম, সেহেতু বাল্যকাল থেকেই আমাদের মধ্যে কিছু প্রাথমিক(মৌল) ভাবাদর্শ খুব দৃঢ় ভাবে গেঁথে যায়। সময়ের সাথে সাথে সে গুলো কখনো প্রকট হয়ে ওঠে, কখনো চাপা পড়ে যায় জীবন দর্শনের বাঁকের জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই আমরা সেই প্রাথমিক(মৌল) ভাবাদর্শ থেকে নিজেদের বার করে আনতে পারি না (ব্যতিক্রম সর্বত্র, সে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই)। ছোট বেলা থেকেই আমরা ব্যক্তি বুঝি, সমষ্টি না। স্কুলে যে শিক্ষা দেওয়া হয় সেখানেও একটা বড় সময় ধরে একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ মূলক ভাব পোষণ করা শেখানো হয়ে থাকে। যদিও সরাসরি শেখানো হয় না, কিন্তু এমনি ঘুরিয়েপেঁচিয়ে শেখানো হয় যে অবচেতন মন সেই বিদ্বেষমূলক ভাবকেই সহজাত একটা ব্যাপার বলে গ্রহণ করে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বোঝাপড়া কোন জায়গায় আছে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক ভাবে আমাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ থাকবে সেটাই বাঞ্ছনীয়। তবে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় কোন দিকটা নেব আর কোন দিকটা না। বিভিন্ন সময় দেখেছি, নানা মানুষকে যারা নিজেদের কমিউনিস্ট, মুক্তমনা বলে দাবী করেন তাদেরও কোথাও না কোথাও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। ভগবানে বিশ্বাস করে না, মূর্তি পূজার বিরোধী; কিন্তু মার্ক্স, লেনিন, চে কে ভগবানের থেকেও উঁচুতে যদি কিছু থাকত তাহলে সেখানে প্রতিষ্ঠা করতেও এঁদের দ্বিধা বোধ হত না। এঁদের কাছে এদের প্রিয় মানুষ যা বলেছে, সেটাই ঠিক, বাকিটা ভুল। তথ্য আর জ্ঞানের মধ্যে যে ফারাক, এঁদের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মধ্যেও ঠিক সেরকম। প্রতিটা বিষয়কে পৃথক পৃথক ভাবে বিশ্লেষণের ক্ষমতা এঁদের প্রায় নেই। প্রায় ঠুলি পরা ঘোড়ার মতোই এঁরা দৌড়ে চলেছেন যেন। তৃতীয়ত, মৌলিক চিন্তাচাবনায় যেহেতু বিদ্বেষ বর্তমান, সেহেতু কোনো কাজ করার সময় সেটা প্রকাশ্যে চলে আসে অজান্তেই। বিভিন্ন আঙ্গিকে এমনটা ঘটে বলেই আমার মনে হয়, এমনকি প্রগতিশীল মানুষদের মধ্যেও, অনেক সময়ই, ক্ষেত্রবিশেষে তা নজরে পড়ে; আর সেইজন্য যোগ করতে হয় ‘তথাকথিত’ শব্দটাকে। লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রেই যদি ধরি, লিটল ম্যাগাজিনের অন্যতম দাবি সমাজে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার বিরুদ্ধে গিয়ে, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গিয়ে সমান্তরাল ভাবে বিপরীত চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরা। কিন্তু এই ক্ষমতার বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করতে নেমেছেন, তাঁরাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেরাই ক্ষমতার অন্যতম শরিক হয়ে উঠেছেন কালক্রমে। ক্ষমতা এবং জ্ঞানের মধ্যে যে সম্পর্ক তাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে লিটল ম্যাগাজিনের পরিচালকগণের কর্মকাণ্ডে। আসলে জ্ঞান যেভাবে আমাদের মানব সভ্যতার উন্নতির হাতিয়ার, ঠিক সমভাবে অবনতিরও বটে। কারণ জ্ঞানী মানুষের কথা শুনে, তাকে দেখে উল্টো দিকের কম জ্ঞানী মানুষটির মনে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়, আর এখানেই ক্ষমতার প্রশ্নটা চলে আসে।
এই তিনটি দিক একে অন্যের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িত। ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যে বিপরীত ক্ষমতার জন্ম হয় তা বেশি রকমের ভয়ংকর। কারণ এ ধরনের ক্ষমতার স্বরূপ সহজে উন্মোচিত হয় না। উল্টোদিকে এই বিপরীত অপরিচিত ক্ষমতাধারীরা বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রয়োজনে ন্যায্যতার প্রশ্ন তুলে থাকে, যা মারাত্মক ভাবেই ক্ষতিকর যৌথ উদ্যোগের ক্ষেত্রে। আর মানবসভ্যতার শুরু থেকেই ক্ষমতাকে ভোগ করার বাসনা প্রবল। সুতরাং বিদ্বেষ, রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অভাব এবং সর্বোপরি ক্ষমতার লোভ থেকেই প্রায়শই যৌথ উদ্যোগ ভেস্তে যায় বলেই আমার বিশ্বাস।
- লেখা বিষয়ক রাজনীতি
ম্যাগাজিনের রাজনীতি ভাবনা চিন্তার থেকেও বেশি লুকিয়ে আছে লেখার ধরণের উপর, শব্দব্যবহারের উপর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমার মনে হয়েছে, সহজ-সরল শব্দের এবং বাক্যের মধ্যে দিয়ে যা বলা যেতে পারে, তা অত্যন্ত কঠিন কিছু শব্দ এবং বাক্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করাই আমাদের এই ম্যাগাজিন সম্প্রদায়ের স্বভাবে দাঁড়িয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্পাদকের জন্য এবং কিছু ক্ষেত্রে লেখকের জন্য এমনটা ঘটে থাকে। সম্পাদক নিজের ম্যাগাজিনকে অন্যদের থেকে বেশি ভাল প্রমাণ করার জন্য বেশ কিছু ভাল লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। আর এই ভাল লেখার মান ঠিক হয়, বিষয়কে ঠিক রেখে কিছু কঠিন কঠিন শব্দের এবং বাক্যের উপরে। এসব শব্দের ব্যবহার কত জন পাঠক বুঝে উঠতে পারবেন? কিন্তু আমরা লিখছি। আবার এ নিয়ে তেমন কোনো কথাও কেউ বলছেন না। ম্যাগাজিনের নামও হেবি হচ্ছে, লেখাগুলোকে বাহবা দেওয়া হচ্ছে। তাহলে কি আমার কোথাও ভুল হচ্ছে? মনে হয় হচ্ছে না, কারণ একটু সূক্ষ্মভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে ম্যাগাজিনের টার্গেট কাস্টমার যারা, তারা কিন্তু সমাজের উঁচু তলার মানুষ, অবশ্যই শিক্ষার দিক থেকে। আর এই লিটল ম্যাগাজিনের চল সব থেকে বেশি কলকাতাকে কেন্দ্র করে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এর সাথে যুক্ত এবং নিজেদের মধ্যেই এমন নানা লেখা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেই এরা খুশি। যদিও এদের ম্যাগাজিন প্রকাশ করার উদ্দেশ্য সমাজকে সচেতন করা, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজেদের মতামতকে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনার সাথে কাজের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। যার বাস্তব উদাহরণ আমি নিজে, যে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জানতই না যে লিটল ম্যাগাজিন বলে কিছু আছে। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা, হাওড়া, হুগলী ছাড়া দঃ ও উঃ ২৪ পরগণা, বর্ধমান, বাঁকুড়া তে কিছু মানুষ হয়তো জানেন, আর উত্তরবঙ্গে কে কে জানেন সেটা হয়ত হাতে গুণে বলে দেওয়া যাবে। অনেকে বলবে কমিউনিকেশান এবং পুঁজির অভাবের জন্য এমনটা ঘটেছে। কিন্তু আমি মানতে নারাজ।
এবার একটু কলকাতায় ফেরা যাক। কলকাতা লিটল ম্যাগাজিনের পীঠস্থান। দেশের সব থেকে বেশি লিটল ম্যাগাজিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। আর এই সব থেকে বেশি লিটল ম্যাগাজিনের শহরে সব থেকে বেশি ছাপাখানা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই সব ছাপাখানার কর্মীরা কি বুঝে উঠতে পারেন যে লেখক কি বলতে চাইছেন? সেই ম্যাগাজিন কি বলতে চাইছে? তারা কি বুঝে উঠতে পারেন যে তাঁদের জন্য ভাবিত কমরেডরা কি আহ্ববান রাখছেন তাদের প্রতি? আমার মনে হয় না; আর এই ‘না’ হয়তো মৃণাল সেনেরও মনে হয়েছিল। পদাতিক ছবিটা দেখছিলাম কিছু দিন আগে, সেখানে নিখিলদাকে যখন ছাপাখানার এক কর্মী, যে শব্দ সাজাচ্ছিল, জিজ্ঞাসা করে ‘নিখিলদা, এটা ঠিক বুঝতে পারছি না’, তখন নিখিলদা প্রথমে যে শব্দদুটো পড়ে সেটা সেই কর্মী বুঝে উঠতে পারেনি – “বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যাবস্থা”, সেই জন্য নিখিলদাকে “বুর্জোয়া” শব্দটা নীচে নামাতে হয়েছিল(এই দৃশ্যটা এখানেই শেষ নয়, সব থেকে বড় কথা যা এই দৃশ্যে লুকিয়ে আছে – “সব শেষ করবে, তারপরে তোমার ছুটি”)। তাহলে এমন নয় যে সে পড়তে পারে না, আসল ব্যপার হল, “বুর্জোয়া” শব্দটার মানে সে জানে না, তাই ঠিক লেখা আছে কিনা সেটা সে জানতে গিয়েছিল।
সুতরাং প্রথম থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম, যে ম্যাগাজিন আমি এবং বন্ধুরা মিলে প্রকাশ করতে চলেছি সেখানে ঐ জাতীয় সাহিত্যের কোন জায়গা নেই। সোজাসাপটা কথাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যাতে যাঁরা অন্তত পড়তে জানেন তাঁরা যেন বুঝতে পারেন, কোন ভাবেই যেন ভাষার উপর দখল নেই বলে বুঝতে পারা যাচ্ছে না এমনটা না ঘটে। প্রথম সংখ্যাতেই সম্পাদকীয়তে পরিষ্কার করে লিখেছিলাম, “কোন সাহিত্য রচনা করতে আসিনি”। ম্যাগাজিনের রাজনীতি এখানেই – আমরা যা বলি, তা লিখি না; কিন্তু যা লিখি তার প্রায় বেশির ভাগটাই বলি। সে জন্য কফিহাউসে, ফেবারিটে, যাদবপুরে আড্ডা দিতে গিয়ে কোন আলোচনা সভায় “বুর্জোয়া”, “প্রলেতারিয়েত”, “ভিত্তির উপর ভিত্তি স্থাপন” এমন বহু জটিল শব্দ কানে আসে। অল্প দু-এক ক্ষেত্রে এমনও শুনেছি – কেউ বিপ্লবী বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, “এই প্রলেতারিয়েতরা বুর্জোয়াদের শোষণ করে চলেছে। আমাদের উচিত বুর্জোয়াদের একত্রিত করে এই প্রলেতারিয়েতদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো”।
অন্য আরো একটি দিকে সমস্যা আমাদের মধ্যে লেখাকে কেন্দ্র করে থেকে গেছে, সেটা হল পুরোন কোন প্রকাশিত লেখা পুনরায় প্রকাশ করা। কোন লেখা পুনরায় প্রকাশ করতে প্রায় কোন ম্যাগাজিনই চায় না; এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে সমস্যাটা দুটো দিক থেকেই আছে। প্রকাশক এবং পাঠক এদের উভয়ের এক ধরনের বোঝাপড়ার উপর ভিত্তি করে এমনটা হয়ে থাকে। কোন ম্যাগাজিনে কোন লেখা ‘পুনরায় প্রকাশিত’ লেখা থাকলে পাঠক সমাজের মনে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়, ভাবে যে এমন বাজে ম্যাগাজিন সে কিনেছে যেখানে লেখার অভাবে পুরনো লেখা ছাপানো হয়। আবার প্রকাশক এমন ব্যাপার দেখে ভাবে ফার্স্ট হ্যান্ড হলে ছাপাবো, না হলে নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার এবং ম্যাগাজিনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে অদ্ভুত ভাবে মানসিকতার মিল আছে এখনো পর্যন্ত। আমাদের মনে হয় কিছু কিছু লেখা কখনো পুরোন হয় না, সময়ের সাথে সাথে হয়ত সেই লেখার প্রাসঙ্গিকতা বেড়েই চলে। আবার কিছু কিছু লেখা সময়ভিত্তিক, যা পরবর্তী সময়ের সাথে খাপ খায় না। আমার নজরে এমন বেশ কিছু লেখা আসে যেগুলো বহু আগে কোন ম্যাগাজিনে অথবা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু লেখার বিষয়ের দিক থেকে, বক্তব্যের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে লেখাটা সমান গুরুত্বপূর্ণ থেকে গেছে। আমি এমন কিছু লেখা ‘অন্যদিগন্ত’-এ প্রকাশ করি, পুনরায় প্রকাশিত বলে। কারণ আমার নিজের বিশ্বাস ছিল এবং এখনো আছে, সবাই সব লেখার সম্পর্কে চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত নয়। কল্যাণী মণ্ডলের ‘সরস্বতীমুক্ত শিক্ষাঙ্গন”, ডাঃ পুণ্যব্রত গুণের “ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান” কতগুলি ন্যায্য প্রশ্ন তুলে দিল” এমন ধরনের লেখা পুনরায় প্রকাশ করতে কোন দ্বিধা থাকা উচিত নয়। তাই ভবিষ্যতেও এমন ধরনের কোনো লেখা পেলে আমরা যে সেটা পুনরায় প্রকাশ করবই তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বাজার সংস্কৃতির বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে এমন ধরনের লেখাকে সমাজের যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় ততই ভাল।
উপসংহার
লিটল ম্যাগাজিনের উপসংহার বলে কিছু থাকতে পারে না। কারণ এখানে ভিন্ন ধরনের নানান আঙ্গিকের চিন্তা ভাবনার আদান প্রদান করাই এর উদ্দেশ্য। আর রাজনৈতিক মতাদর্শ এর জন্য প্রচন্ড ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। মতাদর্শের ক্ষেত্রে হামেশাই দেখা গেছে মার্ক্সবাদী, লেনিনবাদী, মাওবাদী(মাও সে তুং এর মতবাদে যারা বিশ্বাসী, তাকে জঙ্গলে থাকতে হবে এমন কোন ব্যাপার নেই), এমন নানা বাদের মধ্যে হারিয়ে গেছে মানুষ। নৈতিকতার প্রশ্নই যেন অনেক বড় হয়ে উঠেছে এদের কাছে, কোন বাদকে ন্যায্যতা প্রদান করা হবে সেটাই মূল কথা। আসলে কাজের মধ্যে দিয়ে যেখানে মানব সভ্যতার অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, যেখানে নীতি নিয়ে খুব বেশি মাথা না লাগালেও চলবে, সেখানেই আমরা নানান ‘বাদ’ নিয়ে উঠে পড়ে লাগি; আর ঠিক বিপরীত কাজ করি যখন নীতির প্রয়োজনটা সত্যি বড় হয়ে দাঁড়ায়। এমন অবস্থায় অন্যদিগন্ত কি ভাবে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাবে, মতবাদের থেকে কাজ যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এমন কোন বাস্তব দৃষ্টান্ত নিজে দিতে পারবে কিনা, তা সময় বলবে।
আজকের ছোটো ছোটো বোঝাপড়া আগামী দিনে শুভ সুন্দর এনে দেবে।
বহুজনের হিতার্থে ছোটো ছোটো স্বার্থ বিসর্জন কী দেওয়া যায় না ?