রূপা আইচ

“আমার কথা…আমাকে ঘিরে আরও অনেকের কথা…কথা…কাহিনী…ইতিহাস… আত্মকথনে জীবনের পাতা ওল্টানোর ব্যর্থ(?) প্রয়াস…” – রূপা

গ্রামের নাম দিগ্‌নগর। বধর্মানের আউসগ্রাম ব্লকের একটা গ্রাম। এটা গ্রামের উত্তরদিক। তাই জায়গাটাকে উত্তরদিগ্‌নগর বলে। আমাকে নামতে হয় কেঁওতলা বাসস্ট্যান্ডে। বছরখানেক হলো গ্রামের মেয়েদের নিয়ে নানা রাজনৈতিক কমর্কাণ্ড গড়ে তোলার আকাঙ্খায় আমি খুবই নিয়মিত এখানে আসি। তবে এবার মাসখানেক বাদে এলাম। কলকাতায় নানা কাজে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়া—এর কারণ বলা যেতে পারে। তবে এইরকম হলে দুঃখ হয়, বেশ ভয় হয়। কি জানি, কোথাও আমার শহুরে জীবনের অভ্যস্ততা আমার গ্রামে আসার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
সেদিন বাস থেকে নেমেই দেখি গাদা লোকের ভিড়—একটা থমথমে পরিবেশ। মনে হল কিছু একটা হয়েছে। গ্রামগুলিতে খুব ধীর, নিস্তরঙ্গ জীবন কাটে মানুষের। তাই সামান্য কারণেই শোরগোল পড়ে যায়।একটু এগোতেই দেখি একটা বেদির ওপর একটা মেয়ের মৃতদেহ রাখা। তাকে ঘিরে রয়েছে অনেক মানুষ। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে তারা। হঠাৎ দেখি প্রতিমার মা দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসা, মাসি কী হয়েছে? প্রতিমার মা যা বলল, মেয়েটির বয়স নাকি বেশি নয়। (যদিও মৃতদেহ দেখে বোঝার উপায় নেই, বেশ মাঝবয়সি লাগছিল।) উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছে। শান্তিনিকেতনে বিএ পড়া্র চেষ্টা করছিল। অনেকদিন ধরে ওর মাথা ব্যাথা। চোখের ডাক্তার দেখিয়ে চশমাও বানিয়ে ছিল। কিন্ত ব্যথা সারেনি। কাল প্রচণ্ড মাথা ব্যথার পর হঠাৎ-ই মেয়েটা মারা যায়। গ্রামের লোক সবাই ভাবছে, মাথার কোনো টিউমার ছিল, টিউমার ফেটে মারা গেছে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। সামনে একটা উঁচু মণ্ডপ, চারপাশটা হাফ-পাঁচিলের মতো করে ঘেরা। দেখি সেখানে কাঠের চিতা সাজানো। মেয়েটির মামার বাড়ির লোক তখনও এসে পৌঁছয়নি। তাই অপেক্ষা করছে সবাই। আমার অদ্ভুত লাগল। বাস-স্ট্যান্ড, বাজার, পঞ্চায়েত, অফিস, কাছেই পরপর কয়েকটা জনবসতি—এরই মাঝে বড় রাস্তার ওপর একটা শশ্মান! শশ্মানটা নাকি খুবই পুরনো—তাই এর সঙ্গে গ্রামের মানুষের গভীর ধর্মবিশ্বাস জড়িয়ে। আমি গ্রামের কয়েকটি অল্প বয়সি মুখচেনা ছেলেদের ডেকে বললাম, এরকম একটা জায়গায় শশ্মান তো খুবই অস্বাস্থ্যকর। এখানে আর কোনও শশ্মান নেই? ওরা জানাল প্রায় কয়েকগ্রাম অন্তর ফাঁকা জায়গায় আরও ২-৩টি শশ্মান আছে। আমি বললাম, শশ্মানটা না হয় সংরক্ষণ করে রাখো তোমরা। কিন্তু মরা এখানে না পুড়িয়ে ফাঁকা কোনও একটা জায়গায় শশ্মানে নিয়ে যাও। ওরা জোরের সঙ্গে বলল, না দিদি, তা হয়না। এটা আমাদের বিশ্বাস, কেঁওতলার শশ্মান খুব পবিত্র।
গত কয়েকবছর ধরে গ্রামে যাতায়াতের সুত্র ধরে বুঝেছি, কী পশ্চাৎপদতার মাঝে মানুষ বাস করে এখানে। জীবনযাপন থেকে চিন্তাভাবনা সর্বত্র। মন খারপ হয়ে গেল। হল অনেক কারণে, বাবা-মা মেয়েটির কোনও চিকিৎসাই করেনি। সবচেয়ে অদ্ভুত মেয়েটির বাবা উচ্চশিক্ষিত। মূলত টিউশন করে সংসার চালান। অথচ বাড়ির একটা মেয়ে, যে গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের থেকে অনেকটা আলাদা। পড়াশোনা করে, পড়া নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। পরপর দুটি বড় পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে। অথচ তার শিক্ষিত বাবা কোনও চিকিৎসাই করেনি। গ্রামে `মেয়েদের মাথাব্যথা’—আবার একটা রোগ হলো নাকি, সে জন্য তার ডাক্তার বদ্যি করতে হবে। `নিরুপমা’র মতো গ্রামের অনেক মেয়েদের মরে গিয়ে বাঁচার স্বস্তি ফিরে পেতে হয়। মরে গিয়ে তারা প্রমাণ করে , বারেবারে, সমাজের পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারের কারণে মেয়েদের প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকাটা আজও কত অসম্ভব।
গ্রামে ঢুকেই আজ এক মন খারাপ করা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হল। প্রতিমার বাড়ির দিকে এগোতে থাকলাম। সারা রাস্তা ধরেই মানুষের জটলা—ফিসফাস শব্দ। প্রতিমার বাড়ি পৌঁছলাম। প্রতিমা বাড়ির পেছনে ফাঁকা জায়গাটায় এক বালতি জল নিয়ে গায়ে ঢালতে গেল। চ্যাঁচাতে লাগল `দিদি বসুন বসুন। আজ চান করতে একটু দেরি হয়ে গেল। সেন্টার থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।’ প্রতিমা আইসিডিএস-এ কাজ করে, স্কুলে মিড ডে মিলের কাজ করে। আমি বললাম, `তুই ধীরে ধীরে কর। তাড়া তো নেই, সেই তিনটেতে মিটিং।’

স্নান সেরে প্রতিমা কুটনো কুটতে বসল দাওয়ায়। আমি গিয়ে ওর পাশে বসলাম। ভাবলাম, ওই মৃত মেয়েটির কিছু খোঁজখবর নেব। প্রতিমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাব, চোখ দু’টো ওর মুখের ওপর স্থির হল। আগে যা কখনো দেখিনি। মুখখানা যেন বর্ষার মেঘের মতো ভারী, অন্ধকার। বললাম `কী হয়েছে রে তোর? চোখমুখের এমন চেহারা কেন?’ প্রতিমার মুখ আরও ভারি হ’ল। দু’চোখ ভরে টলটল করছে জল। আমি ওর পিঠে হাত রাখলাম, `কী হয়েছে রে?’ নিজেকে সামলে নিয়ে প্রতিমা বলল, `দিদি আমার জীবনে কোনও সুখ নেই, কারও থেকে সুখ নেই।’ আমি বললাম `কী হয়েছে বল না? দেখ মনটা একটু হালকা লাগবে।’
`দিদি কাল রাতে ওর বাবা মদ খেয়ে এসে আমায় যা-তা বলেছে। আমার গায়ে হাত দিতেও এসেছিল। আমি একটু রুখে দাঁড়িয়েছি। তুমি তো জানো, আমার ছেলে কতো অসুস্থ, হার্টের অসুখ। আমাকে মারতে না পেরে ছেলেটাকে ধরে বেধড়ক মারল। হয়তো মরেই যেত। আমি পাড়ার সন্তু, শান্তকে ফোন করে সব বলেছি। ওরা ছুটে এসে ওকে বোঝালো। তখন তো চুপ করে গেল। যেই ওরা বেরিয়ে গেল আবার চিল চিৎকার শুরু হল। সারারাত আমাকে ভয় দেখিয়েছে—তুই আমার বদনাম করলি, আমি সুইসাইড করব। দিদি দেখেছো তো, গ্রামে এখন এই সব কত বেড়ে গেছে। ভয়ে আমি সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি।’
ইতিমধ্যে প্রতিমার মা ঘরে ঢুকলো। কানে এসব কথা যেতে তেড়ে এল—`এ সব তোর দোষ, বুঝলি, তোর জন্যই আজ এ অবস্থা। বিয়ের পর থেকে তোর ঘাড়ে চেপে আছে, তুই বসে বসে খাওয়াচ্ছিস। হবেই তো এখন।’ প্রতিমা ঝাঁঝিয়ে উঠল, `তুমি চুপ কর তো। আমার অশান্তি আর বাড়িও না। কেন তুমি আমাদের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছো? কী চাও, কী চাও তুমি—আমি ওকে ছেড়ে দিই?’ বাটিটা মাটিতে শুইয়ে রেখে ধেয়ে গেল মায়ের দিকে—`আর একটা কথা তুমি বলে দ্যাখো। সবাই বর-ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঘর করছে, তুমি চাও কি আমি করব না?’ প্রতিমার মা, প্রতিমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দাওয়ায় উঠল। বলল, `সত্যি কথা বলি তো তোর ভালো লাগে না, না? আমার কী? ভুগতে চাস ভোগ।’ `হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ভুগবো তো ভুগবো। তুমি কোনো সুরাহা করতে পারবে কি? পারবে না যদি চুপ থাকো। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না।’
প্রতিমা আবার কাজে ফিরে এল। উনুনের আঁচটায় খোঁচা দিতে দিতে বলল, `অন্যায় করবে অথচ আমি কাউকে বলতে পারব না। সন্তু, শান্তকে বলেছি বলে সারারাত কী অশান্তি!’ ওর গাল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়াতে লাগল।
প্রতিমার কথা শুনে মনটা ভারি হয়ে গেল। কী যে বলা উচিত, ভেবে পেলাম না। যদি এ ঘটনা আমার কাছে খুব আশ্চর্যজনক নয়। প্রথম প্রথম যখন এসেছি, প্রতিমার সঙ্গে আলাপ হল। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, আইসিডিএস-এ চাকরি করে। চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ,আত্মবিশ্বাসী চলন-বলন, বেশ ইমপ্রেসিভ, যদিও তথাকথিত সুন্দরী নয়। যে কোনও বিষয়ে ওকে বোঝাতে অন্য মেয়েদের চেয়ে অনেক কম সময় লাগে। নিজের উদ্যোগে নানা কাজ করতে পারে, অসম্ভব পরিশ্রমী। সত্যি কথা বলতে কী, অনেকদিন বাদে গ্রামে এমন একজন নারী সংগঠক পাওয়া গেল, যে নারী আন্দোলন গড়ে তোলাতে একটা ভূমিকা নিতে পারবে। এদিকে প্রথম প্রথম এলে মুকুল বা সাথীর বাড়িতে উঠতাম। কিন্তু তারপর মনে হলো, কাজের বোঝাপড়া গড়ে তুলতে প্রতিমার বাড়িতেই উঠলে ভাল।
প্রথম যেদিন প্রতিমার বাড়িতে গেলাম, দেখলাম ওর বর রান্না করছে। মেয়েকে স্নান করিয়ে আনল। খেতে বসেও দেখলাম, লোকটি মেয়ের খাওয়া নিয়ে বেশ যত্নশীল । ভাত মেখে দিচ্ছে, কোনটা খেতে ভালো লাগছে না লাগছে খোঁজ নিচ্ছে। হাতের কাজ ফেলে আমাদের সঙ্গে সংগঠনের কাজে বেরিয়ে পড়ল প্রতিমা। লোকটির হাসি মুখ তাতেও নিস্প্রভ হল না। বেশ ভাল লাগল। মনে মনে ভাবলাম, প্রতিমার এতো সম্ভবনা, আর বাড়ির সহযোগিতা পায় যদি এভাবে, অনেক কাজ করতে পারবে। তারপর থেকে যতদিন গেছি, লোকটিকে একই কাজ করে যেতে দেখেছি। দু’চার দিন যাবার পর হঠাৎ-ই মনে হল, আচ্ছা লোকটা তো সারাক্ষণ বাড়ি থাকে—কোনও রোজগারের কাজ করে না? সুযোগ বুঝে প্রতিমার কাছে একদিন কথাটা পাড়লাম। প্রতিমা হাসল। বলল, `তাহলে দিদি বুঝেছেন তো আমি কী নিয়ে থাকি! অনেক অনেক চেষ্টা করেছি, ওকে নানা কাজ করানোর। কিছুতেই পারিনি। দু’একদিন গিয়ে কাজ ছেড়ে দেয়। বাড়িতে বাচ্চাগুলোকে এমন আস্কারা দেয়। আমি পড়া নিয়ে , স্কুলে যাওয়া নিয়ে বকাঝকা করি। কিন্তু আমাকে মানবে কেন? সব বাপের দলে।’ একটু বোঝার জন্য আমি বললাম, `তুই শ্বশুরবাড়ি না থেকে মা-র  কাছে থাকিস কেন?’ ও বলল, `ওই তো! সর্বনাশটা তো ওখানেই করে ফেলেছি না, নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছি। শ্বশুরবাড়ি আমাদের মানেনি। তাই বাবার বাড়ি এসে থাকছি। মা তো সারাদিন কথা শোনায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।কিন্তু জমি কেনা, বাড়ি করা কম টাকার ব্যাপার বলুন তো? একার এই সংসার চালিয়ে এত টাকা কোথা থেকে পাব? কত বলি, কাজ করতে। কিছুতেই শোনে না।’
প্রতিমার খুব বলিষ্ঠ, সাধারণভাবে প্রতিবাদী লড়াকু মেয়ে। আমি ভাবতে থাকি প্রতিমা কেন এত মানিয়ে নিয়ে চলে? সেদিন প্রতিমাকে লড়াইয়ের কথা বোঝাতে পারিনি। তবে হতাশও হইনি। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আমার জীবন, আমার মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বন্ধুদের জীবন। সম্পর্কের প্রশ্নে কী ভয়ানক কম্প্রোমাইজ-এর মধ্যে থাকে।তবে `নারীমুক্তি’ সম্পর্কে হাজার হাজার গুণ বেশি সচেতনতা থাকলেও, তাদের কাছে প্রতিবাদের জায়গাটা বেশ ভয়ের, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের। নারীমুক্তি আন্দোলনের সমস্যা তো এখানেই। শোষক বাস্তবত দাঁড়ায় পুরুষ আর নারী শোষিত। কিন্তু সমাজের আর পাঁচটা দ্বন্দ্বের মতো এটা মুখোমুখি বৈরি সম্পর্ক তো নয়। নারী-পুরুষ সম্পর্কে ভালবাসা ঘৃণার যে জটিল দ্বান্দ্বিকতা দেখা যায়, তার মীমাংসা করা, ব্যালেন্স বেছে নেওয়াটা কি চাট্টিখানি কথা। মধ্যবিত্ত জীবনে টানাপোড়েন একরকম, দরিদ্র শ্রমজীবী পরিবারে আরেক রকম। কিন্তু এ বিষয়ে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি যে বিচিত্ররূপে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত জীবনে আছে, তেমনি শ্রমজীবী পরিবারেও। সমাজের উঁচুস্তর থেকে চুঁইয়ে তাদের মধ্যে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে সংস্কৃতির এই গ্লানি। শুধু লেখাপড়া শিখে অর্থোপার্জন করে এই পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে, কি প্রতিমা, কি আমার সমশ্রেণির বন্ধুরা—কেউই আমাকে আশার আলো দেখায় না। খুব কঠিন বাস্তব। অথচ এই বাস্তবকে, সকলের সঙ্গে মিলে অতিক্রম করার কাজ আমাদের জীবনে জরুরী হয়ে উঠেছে।
একদিন শুনলাম, প্রতিমার বর ওর পয়সায় খেয়ে ওকেই এসে মারে। আর প্রতিমা এর প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। কারণ স্বামী ছেড়ে চলে যাবে—এই তার ভয়। মিনমিনে গলায় বললাম, `একটু বেশি বাড়াবাড়ি না? এগুলো কিন্তু তোর ছেড়ে দেওয়া উচিত না। আমরা কী নারী আন্দোলন করব, আমরাই যদি নিজেদের জীবনে এতো মানিয়ে নিই, তাহলে আমরা অন্যদের কী বলব?’ প্রতিমা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, `সেই দিদি এসব না হলে তো ভালই হত। কিন্তু এসব বদলে ফেলা কি সম্ভব? সম্ভব নয় গো গ্রামের আর পাঁচজন বলবে, মেয়েটা বরের সঙ্গে ঘর করতে পারল না। সবাই আমাকেই দূষবে।’
এর মধ্যে একদিন, দিগনগরে আমাদেরই এক বন্ধু আমাকে জানালো, মালেদা পাড়ায় প্রতিমার বর এক সেলুন দিয়েছে। মনে মনে খুশি হলাম, যাক কাজে বেরোলে লোকটার যদি কোনও পরিবর্তন হয়। সেদিন, ওর মা যখন আমাকে বলল, বিয়ের পর থেকে প্রতিমা লোকটাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে, তখন মনে হল এই সংকট এবার কেটে যাবে। সেলুনে কাজ করে লোকটা কিছু টাকা নিশ্চয়ই সংসারে দেবে। প্রতিমাকে বললাম, `তোর বর এখন সেলুনে কাজ করছে, এবার ওর টাকা থেকে ধার দেনাগুলো আস্তে আস্তে মিটিয়ে দে।’ প্রতিমা থালা ধুতে ধুতে বলল, `ও বাবা! তাহলেই হয়েছে! ও আমাকে একটা পয়সা দেয় নাকি? আগেও অনেক ছোটখাটো কাজ করেছে, কিছু দেয়নি। বললে বলে, ওর বাড়িতে পাঠায়।’ আমি বললাম, `সত্যি দেয়? খোঁজ নিয়েছিস?’ প্রতিমা বলল, `বলছে যখন হয়তো দেয়। আর না দিলে এতোগুলো টাকা নিয়ে কী করবে?’ আমি বললাম, ‘তবু একটু খোঁজ খবর নিলে ভালো করতিস।’ প্রতিমা নিজের দমে পনের বছর সংসার কাটিয়ে দিয়েছে। এ টাকার পরোয়াও করে না। তবু এই যে বরের অবহেলা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা—বুঝি প্রতিমারা তার জ্বালায় দগ্ধে দগ্ধে মরে। সুখে না মেয়েদের থাকার ক্ষওয়া শরীর আর উস্কোখুস্কো চেহারা আমার চেনা।
বাড়িতে ফিরছি ট্রেন ধরে। আজ দীর্ঘ একমাসেরও বেশি পরে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি কর্তব্য পালন করতে। শ্বশুরবাড়ি যাওয়া মানে অধিকাংশ দিনই রাতে বরের সঙ্গে সহবাস। আজ রাতে বরের সঙ্গে হয়ত আবার এক যৌনমিলন হবে। হয়তো আমার কাছে যার উদ্দেশ্য হবে বরকে খুশি দেখা, ভালো রাখা। অধিকাংশ বরের মতো। এ কিন্তু সরাসরি আমার বরের দাবি নয়। আর পাঁচজনের মতো ও বিশ্বাস করে দাম্পত্য জীবনের সুখের প্রমাণ এই নিত্যকার দৈহিক আকুতি। আর তাই সুখী দাম্পত্যজীবনের প্রমাণ দিতে, আমার বিবাহিত সঙ্গীকে তার প্রত্যাশা মতো দাম্পত্য সুখ ও নিরাপত্তা দিতে, আমার মনের নানা স্তরে বাধ্যতামূলক যৌনসম্পর্কের এক জটিলতর বোঝাপড়া আমিই জাগিয়ে তুলি আমার নিজের মধ্যে। অনেক ভেবে মনে হয়েছে আসলে এই সম্পর্কের স্টেবিলিটি আমার জীবনে কোথাও ম্যাটার করে যায়। ভাবি, তার অভিব্যক্তিটা সমাজের গড়ে তোলা রীতিমাফিক না হলে, বাকি সবটাই প্রশ্ন চিহ্নের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে যাবে। তাই এই বোঝাপড়া নিজের সঙ্গে নিজের। এত পথ চলা সত্ত্বেও পুরুষতন্ত্রকে লালন করি আমি সযত্নে। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আমার সঙ্গীকে জানাতে কোথাও যেন এক নিরাপত্তার অভাব বোধহ য়।
প্রতিমা অনেক প্রতিবাদের কথা তোকে বলে এলাম। বলতে পারলাম না, তোর আমার জীবন এ প্রশ্নে কোথাও মিলেমিশে আছে রে। মনে পড়ে পরদিন উদ্বিগ্ন গলায় প্রতিমা ফোন করছিল, `দিদি আমার কথাগুলো কাউকে বলনি তো?’ আমি ওকে নিশ্চিন্ত করলাম, `না রে বলিনি। বলবনা, তুই চিন্তা করিস না।’ প্রতিমা তোর কথা না রেখে আমাদের কথাগুলো আজ সর্বসমক্ষে উচ্চারণ করলাম। বিশ্বাস কর, আর কিছু না পারি, নিজের অপারগতাটা বোঝা, স্বীকার করা—এটা আজ খুব দরকার বলে মনে হচ্ছে। তোর কী মনে হচ্ছে বল? এই স্বীকৃতিটাই আমাদের এ গ্লানি অতিক্রমের শক্তি দেবে। সত্যি বল তো, যথেষ্ট হয়েছে। আরও কত অপেক্ষা করব আমরা নিজের শক্তি জাগিয়ে তুলতে? চল প্রতিমা শুরু করি। হয়তো আত্মকথনে।

1 thought on “আমার কথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.