প্রথম প্রকাশ – আয়নানগর কলকাতা বইমেলা ২০১৭ 

“গত কয়েক বছরে কাজ করতে গিয়ে, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে কিভাবে একটি ভিন্নধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে আমাদের বহু ব্যক্তি ও সংগঠনের সাথে কথাবার্তা হয়েছে।  স্বভাব কলকাতার বন্ধুরা তার মধ্যে অন্যতম।  যদিও আয়নানগর টিমের অনেকের সাথেই স্বভাব কলকাতার অনেকের ব্যক্তিগতভাবে আগে থেকেই একধরনের পরিচয় ও বন্ধুত্ব ছিল।  যেমন বন্ধুত্ব থাকে আর কি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো জনগণের মধ্যে।

স্বভাব কলকাতা মূলত একটি থিয়েটার দল।  ওদের কাজকর্মের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যাবে নিচের এই সাক্ষাৎকারটির মধ্য দিয়ে।  কাজেই, একটি দীর্ঘ প্রাক-কথার মধ্য দিয়ে পরিচয়পর্বটা আর প্রলম্বিত করব না।  “সাক্ষাৎকার” ঠিক সেইভাবে নিচের আলাপচারিতাকে বলা যাবে কিনা জানি না।  বরং, প্রলম্বিত আড্ডা বলাই বোধহয় ভালো।  কথা হয়েছিল দুই পর্যায়ে –   ২০১৪ সালের  গ্রীষ্ম কালে ও ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। পাঠকের সুবিধার্থে কিছুটা সম্পাদনা করা হয়েছে, যাতে করে আমাদের আড্ডার অগোছালোপনা থেকেও একটা মোটামুটি সুসংহত বক্তব্য বেরিয়ে আসে। ” –  আয়নানগর (নন্দিনী, প্রমোদ)

প্রথম পর্ব

স্বভাব কলকাতা

আয়নানগর : তোমাদের যা স্কিল আছে তাতে ইচ্ছে করলে অনেক সহজে কলকাতার অন্য কোনো দলের সাথে নাটক করতে পারতে।  সেটা না করে কেন ‘স্বভাব’, কেন আরেকটি থিয়েটার দল? কেন অন্যভাবে থিয়েটার করার প্রচেষ্টা? এখন সেখানে তোমাদের তিনজনের ব্যক্তিগতভাবে বিকাশের যে পথ, সেখানে তোমাদের আগের কাজকর্ম, অভিজ্ঞতা এবং সেখান থেকে একসাথে হওয়া—কিছুটা ‘স্বভাব’-এর যে জেনেসিসের গল্প, সেটা একটু বলো।

অঙ্কুর (বর্তিকাকে) : ‘স্বভাব’টা তুমি যেভাবে শুরু করেছিলে, সেটা বল। আমার ওখানে এসে পড়া, পার্থ কিভাবে এসে পড়ল—সেগুলোয় তারপরে ঢুকব।

বর্তিকা : ‘স্বভাব’ শুরু করেছিলাম ২০০৮-এ। সেইসময় একটা ক্রিয়েটিভ লার্নিং সেন্টার হিসেবে জিনিসটাকে দেখা হয়েছিলো। আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমি যেভাবে বড় হয়েছি—খুব শেলটারড এনভায়রনমেন্ট, একটা কুকুন—যদিও বেড়ে উঠছি শহরের মধ্যেই। সেখানে আমি জাস্ট গাড়ি থেকে শহরটাকে চিনতাম। জাস্ট তোমার ওই পার্কস্ট্রীট, বালিগঞ্জ, আলিপুর—ওই কয়েকটা এলাকা। তো একটা সময় মনে হয়েছিলো, দরকার আছে শহরটাকে অন্যভাবে চেনা-জানা-দেখার। আসলে পড়াশুনো করার পর একটা সময় এলো যখন মনে হচ্ছিলো আমি কিছুই জানি না। অথচ আমি খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম, অলরাউন্ডারও বলতে পারো। কিন্তু যেটা বোঝা গেলো, যে আমি কোনো হাতের কাজ জানি না, শুধু মাথাটা ইউজ করতে জানি। কিন্তু বাড়িতে যেহেতু—রান্না হোক, জামাকাপড় ধোয়া হোক—সবকিছুর জন্য লোক ছিলো, তাই কখনো কিছু করতে হয়নি। তো আমি চাইছিলাম একটা স্পেস, যেখানে আমি আরও সেলফ-সাফিশিয়েন্ট হতে পারি। আর এটা আমার একার স্পেস হবে না, আরও বিভিন্ন লোকেরা এসে সেলফ-সাফিশিয়েন্ট, ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে পারবে। এই শহরে থেকেও কিভাবে অন্যভাবে বাঁচা যায়… মানে আমরা যেভাবে ওয়েস্ট জেনারেট করছি, প্রকৃতি থেকে যেভাবে আলাদা হয়েছি—এসবও আমাকে বদার করতো।

কাবাড় সে জুগাড়

তো আমার মনে হয়েছিল যে একটা স্পেস তৈরী করা প্রয়োজন, যেটার ভিতর দিয়ে এই শহরেই  অন্যভাবে বাঁচা যায়। আর আরও একটা জিনিস—আমি বড় হয়েছি এমন একটা এনভায়রনমেন্টে যেখানে বাড়িতে প্রচুর ‘চাকর’ ছিল। তো একই ছাদের তলায় কি করে এত ডিফারেন্ট লাইভস হতে পারে লোকজনের, সেটা আমি নিজে দেখেছি সারাজীবন। এটা আমাকে খুব ডিস্টার্ব করতো। আমার একটা পার্সোনাল নীডের জায়গা ছিলো, যে এমন একটা জায়গা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কোনোভাবে কোনো ডিস্ক্রিমিনেশন না হয়। যে যা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই আসুক, সবাই একই বাথরুমে যাচ্ছে, একই কাপে চা খাচ্ছে, একসঙ্গে বসে আছে…মানে যেখানে কোনো উঁচুনীচুর জায়গা নেই—আমার এইসব পার্সোনাল জায়গাগুলো থেকেই বেসিকালি ‘স্বভাব’ শুরু হয়েছে। কিন্তু এই গোটা জিনিসের মধ্যে আর একটা খুব ইম্পরট্যান্ট বিষয় ছিল আমার  কাছে, যে একটা ক্রিয়েটিভ এলিমেন্ট থাকবে। মানে এইসব নানা আলোচনা হবে, কিন্তু কিছু একটা করার মধ্য দিয়ে। এমনি আড্ডা হবে তা নয়,ক্রিয়েটিভ আর্টসের মাধ্যমে কিছু একটা হবে। সেটা গান হোক, নাটক হোক। ‘কাবাড় সে জুগাড়’ আমাদের একটা প্রজেক্ট যেখানে আমরা ওয়েস্ট নিয়ে কথা বলতে চাই। কিন্তু আমরা ওয়েস্ট নিয়ে খালি ‘কথা’ বলবো না। বিভিন্ন ওয়েস্ট নিয়ে, ওটার থেকে কিভাবে কিছু একটা বানাতে পারি… কিন্তু সেটা আবার ওই এলিট প্রোডাক্ট তৈরি করছি, তাও নয়। মানে আমরা একসঙ্গে ওয়েস্টের পলিটিক্সটা নিয়েও ভাবছি, কিছু জিনিসও বানাচ্ছি, আর তার সাথে সাথে নাটক, নাচ, গান এসবের চর্চাও করেছি। মোটামুটি এই জায়গা থেকে ‘স্বভাব’ শুরু হয়েছে। একটা জায়গা, যেখানে যে কেউ আসবে… মানে একটা সেন্স অফ সেলফ-ওয়র্থ, সেলফ-রেস্পেক্ট পাবে। আর কেউ এক্সপার্ট হবে না। মানে আমরা যদি কেউ ওখানে এসে নাচ করতে চাই, গান বা ছবি আঁকতে  চাই, তার মানে এই নয় যে  আমায় ওই জিনিসটার এক্সপার্ট হতে হবে। আমার একটা জিনিস নিয়ে একটা আগ্রহ আছে, আমি এখানে আরও কয়েকজনের সাথে মিলে এক্সপেরিমেন্ট করে একটা কিছু করার চেষ্টা করবো—এইখান থেকে শুরু।

তো তখন তো আমাদের কোনো অডিয়েন্সও ছিলো না। ‘স্বভাব’ যে বস্তির ছেলেমেয়েদের জন্য, বা আন্ডার-প্রিভিলেজডদের জন্য, বা ওদিকে মিডল ক্লাস বা আপার-মিডল ক্লাসের জন্য—সেরকমভাবে ঠিক ভাবিনি। আমি নিজে এসেছি একটা আপার ক্লাস ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। কিন্তু এটা সবার জন্যেই—যার একটা ক্রিয়েটিভ ভ্যাকুয়াম আছে, বা জেনারালি একটা ভ্যাকুয়াম আছে… ভ্যাকুয়াম থাকাটা তো খুব স্বাভাবিক… সেই জায়গা থেকে লোকেদের সাথে এনগেজ করা—সেই শুরু।

আর আমাদের লোকেশনটা এমন যে চারপাশে অনেক বস্তি। আমি প্রথম দিকে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে, বস্তিতে গিয়ে গিয়ে সবাইকে বলতাম, যদি কেউ একটা এই স্পেসটা কো-ক্রিয়েট করতে চায় তো আসতে পারে। তো প্রথমের দিকে অনেকটা কাজ হয়েওছিলো। বাই ডিফল্ট অনেক বস্তির ছেলেমেয়েদের নিয়ে হয়েছে। কারণ, তারা এভেইলেবল। খুব গোড়ার দিকেই অঙ্কুরও ‘স্বভাব’-এ চলে এলো, দু-তিন মাসের মধ্যেই। নাটক আর কিছু কিছু ক্রিয়েটিভ এক্সপ্রেশনের দিকটা ও আস্তে আস্তে টেক ওভার করে। আর তাছাড়াও আরও অনেক কিছু হতো। এর পরের গল্পটা কি তুমি একটু বলতে চাও (অঙ্কুরকে)?

অঙ্কুর : ঠিক আছে, কিন্তু তুমি প্যারেলাল কাজগুলো নিয়ে একটু বলো আগে।

বর্তিকা :  প্রথম দেড়-দু বছর প্রতি সপ্তাহে নাচ, গান, আঁকা, হাতের কাজ—মানে “কাবাড় সে জুগাড়,”  কিছুটা স্পোকেন ইংলিশ—সেটা কিন্তু একটু অন্যরকম ভাবে—রোজকার কনভার্সেশনাল ইংলিশ—এইসব হতো। তার মধ্যে অনেক কিছু হয়েছে,ভালো ইভেন্টস… কিন্তু একটা সময়ে  আমাদের মনে হলো, যে এটা কোথাও এটা একটা ফ্রি আর্টস কোচিং সেন্টারের মতো হয়ে যাচ্ছে। সেটা আমাদের অবজেক্টিভ ছিলো না। কিন্তু লোকেরা সেভাবে দেখতে লাগলো।

অঙ্কুর : আমি শুধু মাঝে অ্যাড করতে চাই, যে প্রায় একশ থেকে একশ কুড়ি জন ছেলেমেয়ে আসতো প্রতি সপ্তাহে। রেজিস্টার মেইনটেইন্ড হত।

বর্তিকা : মানে ওরা কি পাচ্ছে এই জায়গাটা থেকে, সেইটা দেখছিলো। কিন্তু গোটা প্রজেক্টটার  পিছনে যে একটা ভাবনাচিন্তা আছে সেটা কোথাও একটা মিস হয়ে যাচ্ছিলো। তো সে জায়গা থেকে আমরা কিছু চেঞ্জ করলাম। আরও অন্যান্য লোকজনের উপর ছেড়ে দিলাম। মানে আমরা যে জায়গাটা একভাবে গুছিয়ে রাখছিলাম, ডাইরেক্ট করছিলাম—সেই জায়গা থেকে আমরা আস্তে আস্তে সরে গেছি। দেখতে চাইছি যে লোকেরা নিজেরা ইনিশিয়েটিভ নিয়ে কতটা কি করে—কারণ সেটাই সত্যি,সেটাই থাকবে। আমরা কয়েকজন এসে কিছু একটা ডিজাইন করে ফেলছি আর ওরা সেটা উপভোগ করছে, এটা দিয়ে  অ্যাকচুয়ালি কোনো কাজের কাজ হবে না। তো আমরা আস্তে আস্তে সরে গেলাম। দেখা গেলো, হার্ডলি পাঁচ-দশ জন এটার সাথে যুক্ত হয়ে রইলো। এবার তুমি বলো একটু (অঙ্কুরকে)।

অঙ্কুর : একটু আগে থেকে ধরছি—আমার ‘স্বভাব’-এ গিয়ে পড়া এমন একটা সময়ে যেখানে আমার জীবনে একটা বড় শিফট চলছে—সব অর্থে শিফট। মানে ধর, আমি ইউনিভার্সিটির—আমার মতে যেটা একটা বড় বাবল ছিল—সেটার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি, আমার যে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার কেতাবি ধারণা, সেটার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি। আমি তখন প্রসেনিয়াম থিয়েটার করতাম… আমাদের একটা দলও ছিলো—সেটা প্রায় আড়াই বছর ফাংশনাল ছিলো—স্বভাবে আসার বছর খানেক আগে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। দলটার নাম ছিল ‘কলকাতা অর্যমা’। তাতে আমরা দুটো ইম্পরট্যান্ট কাজ করতে পেরেছিলাম।

এক, আমরা শুরুই করেছিলাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সিপাই’টাকে স্ক্রিপ্ট করা দিয়ে। সেটা একটা দীর্ঘ স্ক্রিপ্ট। আমরাও তখন বেশ ছোট ছিলাম—কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর বয়স সবার। কিন্তু একটু ওটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করছিলাম—রবীন্দ্র সদনে শো করবো ভেবেই এগোনো হচ্ছিলো। এটা বলছি, কারণ তাহলে স্পেকট্রামটা বুঝতে একটু সুবিধা হবে—আদার এন্ড অফ দা স্পেকট্রাম। যাই হোক, সেটাও খুব সৎভাবে করছিলাম। কিন্তু ষাট-সত্তর ভাগ স্ক্রিপ্ট করার পর বুঝতে পারছিলাম যে এটা এক্ষুনি এইভাবে করা যাবে না। তাই অন্যদিকে এগিয়েছিলাম।

দুনম্বর কাজ, সিঙ্গুরের সময়—২০০৬-এ যখন পুঁজির ডিরেক্ট দালাল বুদ্ধবাবুর নির্দেশে ম্যাজেস্ট্রিটের নোটিসটা পড়ছে, আমরা একটা নাটক লিখতে শুরু করি। বার্টোল্ড ব্রেখটের ‘সিটি অফ মেহগনি’ থেকে অনুপ্রাণিত ‘দক্ষিণ নগরের উত্থান’ বলে একটা নাটক। সাউথ সিটিটা আমাদের মাথায় ছিলো—তখন একজনের পর একজন শ্রমিক পড়ে মারা যাচ্ছে—খবরটা শুধু ‘আজকাল’-এ বেরতো—তোমার মনে আছে প্রমোদ? আর কোনো খবরের কাগজে খুব একটা বেরতো না। তো সেই ‘দক্ষিণ নগরের উত্থান’ প্রথম শুরু হয়েছিল একটি এগারো মিনিটের নাটিকা দিয়ে। রাজেশ বিশ্বকর্মা বলে একজন শ্রমিক ওপর থেকে ট্যাঙ্কে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। আলুওয়ালিয়া কনস্ট্রাকশনের কন্ট্র্যাক্ট লেবার। সেই আলুওয়ালিয়া বাইপাসের ধারে আজও উঁচু উঁচু বাড়ি বানিয়ে চলেছে। অতএব দ্য নেক্সাস কন্টিনিউস। যাক! তো সেইটা ধরে আমরা এগারো মিনিটের ওই নাটক করেছিলাম। একটাই শো হয়েছিলো। তারপরে ওইটাকে ধরেই আমরা এক ঘণ্টা সাঁইত্রিশ মিনিটের ‘দক্ষিণ নগরের উত্থান’ করি। ‘সিটি অফ মেহগনি’র সাথে—এমনকি তার প্লটের সাথেও ওর সামান্যই যোগ ছিল। থীমের একটা যোগ ছিলো, কারণ ওই নাটকটি থেকেই এটা আমাদের মাথায় আসে।

কিন্তু এটা নিয়ে একটা সম্পূর্ণ অন্যরকমের ভাবনাচিন্তা ছিলো আমাদের। প্লটওয়াইজ এবং স্পেসওয়াইজ, দুটো আলাদা আলাদা প্লেনে নাটকটা চলে। ভুলু নামে একটা দেড় বছরের বাচ্চার খেলাঘরে নানা কাণ্ড ঘটতে থাকে। একটা স্পেসে ভুলুর খেলাঘর, আরেকটা স্পেসে খেলাঘরের অন্দর, পুতুলগুলো যেখানে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। দুটো শো করেছিলাম বড় করে—মুক্তাঙ্গনে ব্যাক টু ব্যাক শো—মুক্তাঙ্গনের গোটা স্পেসটাকেই আমরা বদলে ফেলি। আমাদের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিই। কিন্তু সেটাতে আমাদের গোটা এনার্জিটা চলে গেছিলো। বিশেষ করে আমাদের মধ্যে কয়েকজন চাকরিও করছি তখন। আর আমি বুঝতে পারি যে ব্যাপারটাকে টেনে নিয়ে যেতে গেলে আমাকে একটা বড় রোল প্লে করতে হবে। তাই আমি আর খুব ওটাকে টেনে নিয়ে যেতে অতটা আগ্রহী ছিলাম না।

এরপরে বছর দেড়েক আমার থিয়েটারের সাথে কোনো যোগই ছিলো না। গত পনেরো-ষোলো বছরে আমার একটাই ওইরকম পিরিয়ড গেছে—আমার প্রায় একটা অ্যাভার্শনই হয়ে গেছিলো থিয়েটারের প্রতি। কোথাও একটা বুঝতে পারছিলাম, যে আমি যেসব শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বন্ধুবান্ধবদের সাথে ‘কলকাতা অর্যমা’ নিয়ে এগোচ্ছিলাম, তাদের চয়েস এবং কমিটমেন্ট ঠিক আমার—বা আরও দু-এক জন আমাদের মধ্যে—তাদের সাথে মিলছিল না। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, যে এরা স্কিলওয়াইজ, নাটকের অনেককিছুতেই আমার থেকে এগিয়ে। সেইখান থেকে খুঁজতে খুঁজতে আমি ‘স্বভাব’-এর খোঁজ পাই। বর্তিকাকে চিনতামই না। কিন্তু, ওর কাছে এসে বলি, যে আমি এরকম নাটকের কাজ করতে চাই—এই থেকে তখন থেকে সাপ্তাহিক নাটকের কাজ শুরু হয়।

কিন্তু সাপ্তাহিক ভাবে শুরু হতে হতে আমি আমার আগের নাটক করার অভিজ্ঞতা থেকে যেটা টের পাচ্ছিলাম যে, আমাদের যে সোম-বুধ-শুক্র-র সন্ধ্যেকালীন স্ট্রাকচার—সেটা দিয়ে হবে না, এবং ওটা ভেঙে বেরোতেই হবে। এইটা করতে করতে—২০০৮-এ আমরা ‘স্বভাব’ থেকে একটা ছোট্ট নাটক করি—রবীন্দ্রনাথের ‘বিদূষক’-এর হিন্দি—তার চার-পাঁচটা শো ‘স্বভাব’-এর ছাদেই হয়। তারপরে ২০০৯-এ—তখন ‘স্বভাব’-এর অ্যাক্টিভিটি বেশ তুঙ্গে—আমরা ভেবেচিন্তে একটা নোটিস ফেলি, যে এপ্রিল মাসে দশ দিন ধরে রোজ ছ’ ঘণ্টা করে ক্যাম্প হবে—দুটো থেকে আটটা। ক্যাম্প হবে—এবং টেনথ ডে-তে একটা নাটক হবে। কিন্তু মোটামুটি আমরা বড়রা তিন-চার জন বাদ দিলে ধর দশ জন তেরো থেকে কুড়ি বছরের ছেলেমেয়ে এসে হাজির হয়। এরা প্রত্যেকেই আশেপাশের বস্তিতে থাকে। এই কথাটা বলছি, কারণ আমাদের এই প্রস্তাবটা সবার কাছে ওপেন ছিলো। এই নাটকটার আমরা আটটা শো করি। তার মধ্যে পাঁচটা ‘স্বভাব’-এর ছাদে হয়েছিলো। তিনটে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায়। শেষ শো-টা হয়েছিলো আয়লা-র আগের দিন—সেটা একটা মজার ব্যাপার। তোর যদি মনে থাকে, আয়লা-র আগের দিন একটা তুমুল বৃষ্টি হয়েছিলো। ২৫শে মে, ২০০৯। তো সেই বৃষ্টির মধ্যে আমরা হরিদেবপুরের খোলা মাঠে নাটকটা করেছিলাম। নাটক শুরুর আগে আমরা সবাইকে জিজ্ঞেস করি—তোরা কি নাটকটা করতে চাস আজ? ওরা কিন্তু একবাক্যে ইউন্যানিমাসলি হ্যাঁ বলেছিলো। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে, কাদা মেখে, কিন্তু নাটকের ডিজাইন অক্ষত রেখে ওরা শো-টা শেষ করে। সেটাই ওই নাটকের শেষ শো। তারপরে জিনিসটা টানাহ্যাঁচড়া করে এগোতে থাকে—লোকেরা নাটক নিয়ে উৎসাহী ছিলো। কিন্তু ওদের যতটা নিজের থেকে ডেভেলপমেন্ট ঘটবে বলে আমরা এক্সপেক্ট করছিলাম, ততটা ঘটেনি। সেইহরিদেবপুরের স্পিরিটটা আমরা পরে ধরে রাখতে পারিনি। আসলে এটাতে হয়তো আমাদের লিডারশিপেরও গোলমাল ছিলো, আমরাও অতটা ম্যাচিওর্ড ছিলাম না… এবং লিডারশিপের দিক থেকে—আমাদের যতটা অংশগ্রহণ করা উচিত ছিলো,আমরা ততটা করছিলাম না, একটু দূরে সরে থাকছিলাম—এটা আমার এখন মনে হয়।

তো এই সময়টায় তোমায় মাথায় রাখতে হবে, যে ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের একদিকে ‘সিটি স্টাইল’ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। অন্যদিকে ‘সাউথ সিটি’ মলও ডালপালা ছড়াচ্ছে। শনিবার সন্ধ্যেবেলাগুলো—একটু যে লোয়ার মিডল ক্লাস বাড়ি থেকে আসা ছেলেমেয়েরা, যারা কিছুটা কলোনি আর বস্তি এরিয়া থেকে আসছিল—তাদের কাছে ওই জায়গাগুলোতে গিয়ে উইন্ডো শপিং করা আর আড্ডা দেওয়াটা কিন্তু একটা বড় টাইমপাস হয়ে ওঠে। সন্ধ্যেবেলার দিকে তুই আনোয়ার শা-র দিকে যা, দেখতে পাবি যে একটা বড় ক্রাউড ওইদিকে চলেছে—খানিকটা আমাদের সময় যেমন ছিলো নন্দন-রবীন্দ্র সদন। সেটা খারাপ না ভালো সে  দিকে আমি যাচ্ছি না, নন্দনেও যে এমন ভালো কিছু একটা হতো—তাও নয়—সেটা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো[হাসি], কিন্তু এই শিফটটা হয়েছে। তো সেই ২০০৯ থেকে আমরা ভাবতে শুরু করি, যে শহরে যাদের নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই, তাদের ভিতর থেকে একটা টীম উঠে আসুক। রেপার্টরির কথা যে তখনই ভেবেছিলাম, তেমন নয়। ওদিকে যারা আমাদের সাথে কাজ করছিলো, তারা খুব লেখাপড়া জানা হোক না হোক—যথেষ্ট স্কিলফুল আর এন্টারপ্রাইজিং ছিলো। ধরো আজকের কেএফসি বা ম্যাকডোনাল্ড বা প্যান্টালুন্সে কাজ পাওয়াটা তাদের কাছে বড় ব্যাপার না। অনায়াসে পেতে পারে,এবং তাতে তারা আরও খানিকটা আপ দা ল্যাডার যাবে। সেই এন্টারপ্রাইজিং ছেলেমেয়েরা আস্তে আস্তে সরতে থাকলো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন কেএফসিতে চাকরি করে। কেউ আছে অটো চালায়। তাদের কারুর কারুর সাথে আমাদের এখনো যোগাযোগ রয়েছে।

আরেকটা ট্রাই নিয়েছিলাম—সেটা হয়নি, কিন্তু অনেকদিন রিহার্সাল হয়েছিলো। সেটা উচ্ছেদ নিয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দ্বিতীয় নাটক। নাম ‘দ্য মামলেট কম্পানি’। সেটায় আমরা বেসিকালি একটা প্লে উইদিন প্লে করার চেষ্টা করছিলাম। তখন পরপর ওই স্টোন ক্রাশার, আয়লা—এইসব মিলিয়ে আরও বেশি মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। গল্পটা ছিলো, এরকম বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাস্তুচ্যুত মানুষ, তাদের মধ্যে কয়েকজন এক দালালের খপ্পরে পড়েছে। সে তাদের দিয়ে একটা যাত্রার দল খুলিয়ে বলছে এই শো করার বিনিময়ে তাদের শহরের পাসপোর্ট পাইয়ে দেবে। মাইন্ড ইট! শহরের পাসপোর্ট! সালটা ২০১০। এখনকার মতো ‘ঝি’-‘চাকর’-‘ড্রাইভার’দের আই কার্ড চালু হয়নি। কিন্তু এই নাটকটায় অভিনয় করেছিল সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়া একটা ছেলে, এবং সঙ্গে বস্তির ছেলেমেয়ে আর আমরা। একসাথে নিয়ে বেশ অনেকদূর অব্দি যেতে পেরেছিলাম। শো অব্দি টানতে পারিনি। তবে আমরা যে এরকম একটা ওপেন জায়গা তৈরি করবো সেটা খুব সচেতনভাবে ভেবে করিনি। ওই ‘তুই নাটক করবি?’ করতে করতে হয়ে গিয়েছিলো। মনে আছে, মে মাসে গরমের ছুটির সময় প্রায় সকাল ছ’টা-সাড়ে ছ’টা থেকে রিহার্সাল দিতাম, চলতো দশটা-সাড়ে দশটা অব্দি।

আমি পার্থকে চিনি ২০০৮ থেকে। একটা গ্রাসরুট লেভেল খবরের কাগজ করতে গিয়ে আলাপ। তারপর আমাদের দুজনেরই মনে হচ্ছিলো, যে আমরা হয়তো একটু আলাদা রকম কাজ করতে চাই। প্রথাগত কাজগুলির থেকে আমাদের পথটা একটু আলাদা হবে। তো সেই নিয়ে ২০১০ থেকে পার্থ আর আমি কথা বলা শুরু করি। পার্থ তখন ফলতার মহিরামপুর নামে একটা গ্রামের স্কুলে পড়াতো—এখনো পড়ায়।

পার্থ : আসলে অঙ্কুরের সাথে ওই পত্রিকার সূত্রে, মিটিঙের সূত্রে যতটুকু যা আলাপ ছিলো। একটা সময় আমার ইচ্ছে ছিলো, যে লেখালেখি করবো। তার আগে একটা রাজনৈতিক জীবন ছিলো, সংগঠন ছিলো। সেইভাবে ছাত্র সংগঠন করবো বলে আমি কখনো সংগঠন করিনি। আমার প্রথম আসা হলো—কানোরিয়া মুভমেন্ট যখন হচ্ছে, আমি তখন বইমেলায় কবি সমীর রায়ের থেকে কানোরিয়া নিয়ে পত্রিকা পাই—উনি বিক্রি করছিলেন। আমি তখন পাভেল করচাগিনের ‘ইস্পাত’ সদ্য সদ্য পড়েছি। বেহালার চোদ্দো নম্বরে থাকতাম আর এমনি সাধারণ স্কুলে পড়েছি। তাই আমার অনেক বন্ধুবান্ধবরাই তখন লোহা কাটার কারখানায় কাজ করে, ছোট গ্রিল কারখানায় কাজ করে। ভেবেছি তাদের পড়াবো, যে কানোরিয়ায় এরকম একটা কিছু হচ্ছে। সেই করতে করতে আশুতোষ কলেজে ঢোকা, ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ঢোকা। সেই সূত্র ধরে বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনের সাথে কিছুটা যুক্ত থাকা। এবার, ২০০১-২ থেকে সেসব থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে শুরু করি। তখন ইউনিভার্সিটিও শেষ হয়ে গেছে, আর কোথাও যেন কিছু আর ভালো লাগছে না—একটা একঘেয়েমি চলে আসছে। সেসময় সংগঠনের মধ্যে একটা বড় স্প্লিটও হয়েছিলো। তখন একবার নতুনভাবে একটা সংগঠন তৈরিরও চেষ্টা করেছিলাম। সেটাও দাঁড়ায়নি। মনে হচ্ছিলো ঠিক মিলছে না। এই গোটা জার্নিটার মধ্যে জয়াও [পার্থর স্ত্রী] ছিল। তো আমি, জয়া দুজনেই সংগঠন থেকে একদম বসে যাই। মাঝখানে স্কুলে চাকরি করতে যাওয়া, আর সেখানে আবার খুব কাছাকাছি ভাবে প্রথম গ্রামকে দেখা। কিছুদিন পড়ানোর পর বুঝতে পারছিলাম, যে—ধরো আমি ঘর থেকে ভরপেট ভাত খেয়ে আসছি, কিন্তু যে ছেলেমেয়েগুলো আমার কাছে পড়তে আসছে, তারা ভরপেট খেয়ে আসছে না। তখনও মিড ডে মিল চালু হয়নি। তো এইসব নানারকম হতে হতে—হয়তো কখনো কোনো ছাত্রকে বললাম, ‘চল, তোর বাড়ি যাবো।’ তারপরে পাশেই ফলতায় স্পেশাল ইকোনমিক জোন—সেখানে খানিকটা যাওয়া-আসা—সেখানে কি হয় দেখতে চাওয়া… তারপরে পত্রিকায় যুক্ত হওয়া, একটুআধটু লেখালেখি। তো এইটা থেকে আবার করে একটা অ্যাকাডেমিক অ্যাস্পিরেশন তৈরি হয়। কিছু একটা করবো, একটা কোনো ইনস্টিটিউটের সাথে যুক্ত হওয়া… যুক্ত হয়েওছিলাম।

অঙ্কুরের সাথে যখন আলাপ, তখন লালগড় মুভমেন্ট চলছে। আস্তে আস্তে আমারও মনে হচ্ছিলো, যা করছি, সেটা ঠিক মনঃপুত হচ্ছে না। আবার ধরো স্থানীয় কিছু একটা নিয়ে লিখলাম। ওই অঞ্চলে লিটারেসি এতো কম। পড়ার লোকও নেই, আর আমার এখন যেটা মনে হয়—সত্যিই সেখানকার মানুষ সেটা পড়ে করবেই বা কি? তার বিশেষ কিছু জানার তো নেই সেটা থেকে। তার চেয়ে তাদের সাথে যদি অন্য কোনোভাবে যুক্ত হওয়া যায়। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিভাবে। এই পরিস্থিতিতে অঙ্কুরের সাথে আলাপ হয়। কথা হতে হতে ঠিক হয় যে আমাদের স্কুলের লাগোয়া একটা ছাত্রদের সরকারি হোস্টেল আছে, সেখানকার আবাসিকদের এবং অঞ্চলের অন্যান্য ছেলেদের নিয়ে একটা তিন দিনের নাটকের ওয়র্কশপ হবে আর ফোর্থ ডে-তে একটা নাটক। স্থানীয় ভাবেই করা হবে সেটা। ভোর থেকে রিহার্সাল শুরু, দুপুরে খাওয়া থাকবে, তারপরে আবার রিহার্সাল, বিকেলে টিফিন, আবার রিহার্সাল। রাতে সবাই ঘরে বা হোস্টেলে ফিরে যাবে, পরেরদিন আবার রিহার্সাল। তো এই দ্বিতীয় দিন সবাই টার্ন আপ করলো না। তো আমাদের দুজনেরই খুব মন খারাপ। ওখানে যে ক’জন টার্ন আপ করেছিলো, তাদের খুব মন খারাপ—যে আর হলো না বোধহয় কিছু। তারপরে অঙ্কুর চলে গেলো চাকরি করতে দিল্লিতে, আট মাসের জন্য। এখান থেকে তুমি একটু বলো আবার (অঙ্কুরকে)।

অঙ্কুর : আমি আর বর্তিকা দুজনেই ২০১১-র মে-তে বেরিয়ে গেলাম, ২০১২-র ফেব্রুয়ারিতে ফিরলাম। ফিরে এবার আমার কাছে প্রথম প্রশ্ন ছিলো, এবার কি? কারণ দিল্লিতেও আমাদের যা পারপাস ছিলো সেইমতো কাজ কিছু হচ্ছিলো না, খুচরো এধার ওধার ওয়ার্কশপ, লোকজনের সাথে পরিচিতি ছাড়া। তো ওই যে নাটকটা—‘তেঁতুলদোনার রাজা’ বলে নাটকটা—সেটা ওই ফলতা অঞ্চলের ছোট ছোট গল্প, ছড়া, কবিতা—এইসব অ্যাসিমিলেট করে করার চেষ্টা হয়েছিলো। তো মাঝে ২০১১-তে ‘স্বভাব’-এ খুব গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করেছে শুভ্র—শুভ্রপ্রকাশ দাস। শুভ্র এখন আর ‘স্বভাব’-এ নেই, সুন্দরবনের সোনাখালি অঞ্চলে একটা স্কুলে পড়ায়। তো, একা হাতে আরও ছ’-সাত জনকে জুটিয়ে ২০১১-তে তখন ও-ই স্ক্রিপ্টটা লিখলো। আমি আর ও মিলে একটু সাজিয়েছিলাম। কিন্তু ও-ই গ্রামে যেটা হয়নি, সেটা শহরে রাসবিহারীতে যে দেশবন্ধু স্কুল—সেখানে করালো। তিনটে শো হলো—সন্ধ্যেবেলা। ওই দেশবন্ধু স্কুলের চাতালটাতে।

তেঁতুলদোনার রাজা

বর্তিকা : এমনি আমাদের ট্রায়্যাঙ্গুলার পার্কের কাছে একটা বাড়িতে—একটা ট্রাস্ট ওটা—রিহার্সাল হতো। কিন্তু ওই যে আট মাস অঙ্কুর আর আমি ছিলাম না, ওটা আমরা ফেরত দিয়ে দিই, বলি যে বাড়িটা আমাদের তখন আর লাগবে না। আসলে আমরা ভেবেছিলাম এখানে আর কিছু হবে না ওই সময়। কিন্তু শুভ্র আর ওই সাত-আট জন মিলে প্রতি সপ্তাহে দেশপ্রিয় পার্কের জাস্ট একটা কোণে বসে ওই একটু হাতের কাজ, একটু গান, একটু খেলা, ওখানকার ফুটপাতের বাচ্চাদের নিয়ে, ওখানে যারা হাঁটছে তাদের নিয়ে নিয়মিত আট মাস কাজ করেছে, আর সেইসময় ওই নাটকটাও একটা ছোট প্রোগ্রাম করে হয়েছে।

আরেকটা পয়েন্ট মনে হয় বলার দরকার। এটা ‘স্বভাব’-এর শুরু হওয়ার জায়গাটা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুরু হওয়ার পিছনে এটাও একটা কারণ ছিলো, যে আমার একটা ডিসইলিউশনমেন্ট তৈরি হয়েছিলো গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। এমনিতে স্কুলে তো বেশিরভাগ লোককে তো ফেলিওর—এইরকম ফীল করানো হয়, একজন দুজন হয়তো ভালো হয়, বাকি সব ফেলিওর। সেরকম কিন্তু আর্টস-এর ক্ষেত্রেও হয়ে যাচ্ছে আজ। নাচ, গান, নাটক, হাতের কাজ—যেগুলোর মধ্যে এতো পোটেনশিয়াল আছে—মানুষকে এতো সেল্ফ রেস্পেক্ট, সেল্ফ ওয়র্থ দেয়—সেটাও কোথাও একটা এমন হয়ে যাচ্ছে  যে হয় তুমি ভালো, নয় তুমি ভালো নও, হয় তুমি পারো, বা তুমি পারো না। তো এই জিনিসটাকে চ্যালেঞ্জ করাটা একটা বড় বিষয় ছিলো যখন স্বভাব শুরু করা হয়। মানে কেউ পারে না—এটা থাকবে না আমাদের মধ্যে। সবাই পারে। ‘শিল্প’ বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখাটা খুব ইম্পরট্যান্ট ছিলো ‘স্বভাব’-এর প্রথম থেকেই।

অঙ্কুর : ২০১২ থেকে ‘স্বভাব’ মূলত নাটক দল হিসেবে ফোরগ্রাউন্ডে আসতে শুরু করলো। কারণ বাকি জায়গাগুলোতে যাদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা, তাঁরাও আর অতটা সময় দিতে পারলেন না। কিছু কিছু কাজ একটা গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছিলো যদিও। মানে আমাদের ফেলে দেওয়ার জিনিস থেকে হাতের কাজটা যেমন দীর্ঘদিন আমরা করেছি। সাশাতে প্রচুর কাজ রয়েছে আমাদের। প্রচুর গ্রুপকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনো আছে। যেমন ‘স্বভাব’-এরই একটি মেয়ে পরে নিজের পাড়ায় গিয়ে শিখিয়েছিলো। শিপ্রা। আমরা নিজেরাও যাইনি। তো শিপ্রার পাড়ার ছোটরা কিন্তু প্রত্যেক পুজোতে ‘ত্রিধারা’তে স্টল দেয়। নরেন্দ্রপুরেও নিজের পাড়ায় গিয়ে শিখিয়েছে আলপনা বলে ‘স্বভাব’-এর একটি মেয়ে। ওখানেও করছে একটা দল। অতএব এইভাবে যদি বলিস জিনিসটা কিন্তু সেই অর্থে রয়েছে। তবে ‘স্বভাব’-এর মধ্যে আর সেইভাবে হয় না এগুলো। লোকজন নেই বলে।

এবারে নাটকের জায়গাটা আমি পরপর বলে গেলে তোর ট্রাজেক্টরিটা বুঝতে সুবিধা হবে। ২০১২-তে আমরা ‘তেঁতুলদোনার রাজা’ আবার রিভাইভ করলাম। বৈশাখী কালীপুজোতে ওই পার্থরই কিছু ছাত্রকে নিয়ে একটা চোদ্দো-পনেরো জনের টীম—আর আমরা ‘স্বভাব’ থেকে তিনজন গেলাম—আমি, অভিষেক আর বিশ্ব। তো সবাই মিলে তিন দিন ধরে কলাগাছিয়া বলে একটা গ্রামে থেকে, একদম ভোর ছ’টা থেকে রাত আটটা অব্দি রিহার্সাল করে ওটা তুললাম। রান্নাবান্না সব নিজেদের। কাঠ কুড়িয়ে এনে রান্না। তিন দিন পরে আমরা ওই বৈশাখী কালীপুজোর দিনে—ওটা ওখানকার সবচাইতে বড় উৎসব—দুটো মণ্ডপে দুটো শো করলাম। তারপর আর এগোনো গেলো না। আমরা যাদের ভেবেছিলাম ইভল্ভ করবে বলে, তারা ইভল্ভ করলো না। আমাদের অপেক্ষা করতে হলো ২০১২-র এপ্রিল থেকে অক্টোবর অব্দি। ওই বর্তিকা যে বাড়িটার কথা বলছিলো, সেখানে পার্থর ছাত্রদের নিয়ে একটা তিন দিনের ক্যাম্প করে চতুর্থ দিন সন্ধ্যেবেলা ‘ঈদের চাঁদ’ বলে একটা একুশ-বাইশ মিনিটের নাটক করলাম। ২০১২-র ডিসেম্বরে আমরা আবার টীমটাকে নিয়ে এলাম—সেটায় তখন খুচরো বদল ঘটেছে…

মধুবাবুর বাজার

আমাদের যে ট্র্যাভেলিং থিয়েটার, তার প্রথম বীজ ওই ‘ঈদের চাঁদ’-এ। তো আমরা একদম ছোটদের টীমটা নিয়ে সাতদিন ধরে নানা জায়গায় শো করে বেড়ালাম। অবশ্য বর্তিকা সেসময় উদয়পুরে ছিলো। আর পার্থও সবকটা রিহার্সালে বা শো-তে থাকতে পারতো না। তাই ‘স্বভাব’-এর যারা জুনিয়র মেম্বার তারাই দায়িত্ব নিয়ে এটা করালো। আর শো-গুলো কীরকম ভ্যারিড জায়গায় হয়েছিলো বললে তোদের মজা লাগবে। একটা হয়েছিলো ঢাকুরিয়ার বিনোদিনী স্কুলের অ্যাডাল্ট নাইট স্কুলে। আরেকটা করলাম বিবেকানন্দ কলেজে। একটা হলো আক্রার ষোলোর ঘেড়িয়া বস্তির ঠিক পাশে। ষোলোর ঘেড়িয়া তার ক’দিন আগেই পুড়ে যায়। চন্দননগরে বিজ্ঞান মেলায়, সুভাষগ্রামে একটা শিশুমেলায়— এরকম বিভিন্ন জায়গায়। করার পর আমাদেরও একটা অভিজ্ঞতা হলো, আর দলটাও—পার্থরই নেতৃত্বে—‘ঈদের চাঁদ’-এর প্রায় কুড়ি-বাইশটা শো করলো—আজ অব্দি।

২০১৩-তে ওই টীমেরই কিছু বড় ছেলেরা আর আমরা—যারা ‘স্বভাব’-এর শহুরে লোকজন—মিলে ‘মধুবাবুর বাজার’ বলে একটা নাটক করি। নামটা এলো জগুবাবুর বাজার থেকে। কলকাতায় পার্কসার্কাস বাজারের ওই জায়গাটা রিলায়েন্স নিয়ে নিচ্ছে,আর ওয়ালমার্ট তখন লুমিং লার্জ যাকে বলে—এই বিষয়টা নিয়ে আমরা ওই মূলত বাজার উচ্ছেদ—এই বিষয়টা মাথায় ছিলো। ভেবেছিলাম যদি দশ দিনের একটা রিহার্সাল করতে পারি, তাহলে কলকাতার বস্তি অঞ্চলগুলোতে আর বাজার এলাকায় নাটকটা করবো—একদম ওই ফোকাস করে। করতে পারিনি। আমরা ওই ‘স্বভাব’-এর ছাদেই চারটে শো করি। এইগুলো নিয়ে তোমরা স্পেসিফিক প্রশ্ন পরে করতে পারো, আমি খালি জার্নিটা বলছি।

মধুবাবুর বাজার

২০১৩-র মে মাসে আমাদের মাথায় একটা পোকা নড়লো। সারা দেশে ছড়িয়েছিটিয়ে আমাদের যে বন্ধুবান্ধবেরা রয়েছে তাদের সূত্র ধরে মোটামুটি এগারো জনের একটা নাটকের দল তৈরি করে ফেলতে পারলাম, যারা দেড় মাস একসঙ্গে ছিলো। জুলাইয়ের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি অব্দি—আমরা ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ বলে একটা উচ্ছেদবিরোধী নাটক করি। বিষয় জল-জঙ্গল-জমি রক্ষা। আশি মিনিটের একটা নাটক। আমরা ওইটাকে নিয়ে ট্রাভেল করলাম ছত্তিসগড় আর ঝাড়খণ্ড। আর কলকাতায় শো করলাম টিটাগড়ে—যেখানে সি পি আই এম-এল (রেডস্টার) কাজ করে—ওরা শো-টা করিয়েছিলো। আর ছত্তিসগড়ে কাজটা শুরুই হয়েছিলো দল্লিরাজহরার শহীদ হাসপাতাল থেকে। ঝাড়খণ্ডে শেষ শো-টা হলো নোয়ামন্ডিতে টাটা স্টীলের খুব কাছে আর কি। মধ্যে যেটা চেষ্টা করছিলাম এই ছেলেমেয়েদের দিয়েই। প্রশ্নটা যেটা উঠে আসছিলো—কলকাতার যারা কাজটা করছে, তারা ফলতার বা ওই জাতীয় কোনো জায়গার কাজের দায়িত্ব নেবে কিনা। এই প্রশ্নটা চলছিলোই। চলতে চলতে ২০১৪-র ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আমরা আরেকটা এরকম ট্রিপ করলাম, যেখানে ওই প্রথম দলটার প্রায় সত্তর-আশি ভাগ ছেলেমেয়ে ছিলো। এই কাজটা হলো মহারাষ্ট্র আর গোয়াকে ধরে। এটার আমরা চৌতিরিশটা শো করতে পেরেছিলাম। কোনোরকম সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই। ওই কোনো সংগঠন হয়তো জল-জঙ্গল-জমির আন্দোলন করছে, তারাই হয়তো বললো আমরা খানিকটা খরচ বেয়ার করতে পারবো—একটা কি দুটো শো করালো। ওরা হয়তো খানিকটা টাকা তুলতে পারলো, বাকিটার জন্য আমরা অন্য কারুর দ্বারস্থ হলাম—তারা দিয়ে দিলো।

মিস্টার ইন্ডি‌য়া

পার্থ : কোনো কোনো সংগঠনের সাথে আগে আলাপই ছিলো না। ওই কিছুটা ফেসবুকের সূত্র ধরে, কিছুটা চেনাজানা লোকজনকে ধরে… পুণ্যব্রত গুন যেমন ছত্তিসগড়ের প্রাথমিক যোগাযোগ করিয়ে দেন।

অঙ্কুর : সবটাই ওইভাবে। পার্থ নিজে ফিজিকালি থাকতে পারেনি, কিন্তু এই কাজগুলো করে দিয়েছিলো। অনেকগুলো সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলো। অতটা খরচ বহন তারা কিন্তু আমাদের ফেস ভ্যালুতে নিয়েই করেছে।

দ্বিতীয় ট্রিপে আমরা যেটা করতে পারলাম—বারো জনের একটা দলের থাকা খাওয়া ইত্যাদি ছাড়াও আমরা প্রত্যেককে তিন হাজার টাকা করে দিতে পারলাম। এই টাকাটা উঠলো। ইনক্লুডিং আমি, বর্তিকা, রোহিত বলে ‘স্বভাব’-এর একজন খুব ইম্পরট্যান্ট মেম্বার… আমাদের খরচটা খুব অল্প হলেও উঠলো।  কিন্তু ওই প্রশ্নটা বারবার এলো… যেমন ধর গোটা ভারতবর্ষে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’-র পঁচিশ থেকে তিরিশটা শো আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। কারণ আমরা বুঝতে পারছিলাম—যাদের কথা ভেবে এই প্রসেসটা করা, তাদের যদি ইভল্ভ করার থাকতো, তো তারা এতোদিনে ইভল্ভ করে যেতো।

এটা বলছি আরও এই কারণে, যে কোনোরকম সাহায্য ছাড়া গ্রামেগঞ্জে গিয়ে এইরকম একটা অল ইন্ডিয়া টীম তৈরি করা—এই রিস্ক এনএসডিও নেবে না। ধরো চিনিই না একজনকে, তাকে গিয়ে বলছি… কয়েক জায়গায় ইন ফ্যাক্ট গণ্ডগোলও হয়েছে—সেগুলো আমরা কাটাতে কাটাতে গেছি। আমরা বুঝতে পারছিলাম, এই ছেলেমেয়েগুলো আমাদের নেক্সট জেনারেশন অফ ট্রেনার হিসেবে, থিয়েটার ওয়র্কার হিসেবে ইভল্ভ করছে না। তারা অত্যন্ত স্কিলফুল এবং কাজটা করেছিলো খুব মন দিয়ে। কিন্তু আমরা যে হোল টাইম কমিটমেন্টের দিকে এগোতে চাইছিলাম ‘স্বভাব’ থেকে… একটা কাজ তো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, হয় এগোয়, নয় পিছোয়… তো সেইটার মতো মেটিরিয়াল আমরা পাচ্ছিলাম না। তাই আমরা ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’টা একটু পজ দিলাম। হয়ত তারা অন্য কোথাও ইভল্ভ করতে পারে এখনো। অন্য কোনো প্রসেসে, অন্য কোনো লিডারশিপে। কিন্তু, আমাদের চলতি প্রক্রিয়া দিয়ে আর হচ্ছিলো না।

মিস্টার ইন্ডি‌য়া

মাঝে একটা ফাঁকা সময় গেলো। আমরা ছোটদের জন্য একটা নাটক লিখলাম ‘আকবর চাচা’ বলে— সেটা অনেক পরে করা হয়েছিলো। তারপর বর্তিকা, আমি আর রোহিত চলে গেলাম ‘আঁধারশিলা’তে।  তোমার মনে আছে প্রমোদ, কলেজ স্ট্রিটে ওই হিরোশিমার প্রোগ্রামটার পরেই। ‘আঁধারশিলা’ মধ্যপ্রদেশের একটা আদিবাসী স্কুল। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল চালান এক দম্পতি। এটা মধ্যপ্রদেশের খুব ইন্টিরিয়রে সাকড় বলে একটা গ্রামে। ইন্দোর থেকে প্রায় তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগে। সেন্ধওয়া বলে একটা ছোট শহর আছে, তার কাছে। ওখানে আমরা ওই ‘তেঁতুলদোনার রাজা’টাই ওদের মাটিতে অ্যাডপ্ট করে পাঁচটা শো করলাম।

ফিরে এসে ২০১৪-তে ‘বিশ্বকর্মা’—যেটা তোমরা জানো আমাদের মাথাতেই ছিলো… আমরা চারজন—আমি, পার্থ, বর্তিকা আর বুলনদা—আমাদের সিনিয়র একজন বহুদিনের বসে যাওয়া নাট্যকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী—তাঁকে আমরা এক অর্থে বলা যায় রিভাইভ করলাম। ওই ‘বিশ্বকর্মা’ যেটা তোমরা দেখেছো, সেটা করলাম, একদমই অসংগঠিত শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে। আর আমরা নাটকটা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের স্পেসে করতে চেয়েছিলাম। সি পি আই এম এল (এনডি)-র মঞ্চে যেমন করেছি, হোককলরবের মঞ্চে করেছি, এমকেপিও আমাদের ডেকেছে, নৈহাটিতে লিবারেশনের সাংস্কৃতিক মঞ্চে করেছি—সবরককম, থার্ড স্ট্রীম লেফটের সবকটা ফ্যাকশনের সঙ্গে চেষ্টা করেছি। আবার ক্যানিং স্টেশন, বাগনান স্টেশনেও করেছি স্থানীয় বিজ্ঞান সংগঠনের ব্যবস্থাপনায়। আমার এটা মনে হয়েছিলো যে ‘বিশ্বকর্মা’ যাদের কথা মাথায় রেখে করা—সেই জায়গা থেকে শুধু ‘স্বভাব’-এর পক্ষে এটা লাগাতার করে যাওয়া মুশকিল আছে। তেরোটা শো-র পর আমাদের একটা পজ দিতে হয়। তারপর থেকে আমার যেটা প্ল্যান ছিল, যে অন্য কোনো সংগঠন যদি এটা তুলে নিতে চায়, সেটা নিয়ে কথা বলতে থাকি। আর এখন গুরগাঁও-বেসড একটা শ্রমিক সংগঠন, আর পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র-যুবক-শ্রমিকদের একটা দল, তাদের নাটকটা তুলিয়ে দিয়েছি। তারা ইন্ডিপেনডেন্টলি ‘বিশ্বকর্মা’টা করবে। এই নাটকটা নিয়ে একটা জিনিসই বলার—যে ডেফিনিটলি এটা একটা প্রোপাগ্যান্ডিস্ট প্লে, কিন্তু আমরা সচেতন ছিলাম যে এটা যেন একেবারে আকাঁড়া স্লোগানিয়ারিং না হয়। আমরা ক্রিয়েটিভলি অ্যাজিটপ্রপটাকে দেখার চেষ্টা করছি—যে আমরা প্রোপাগ্যান্ডা তো করবোই, কিন্তু পাশাপাশি ভাষাটা নিয়েও জরুরি কাজ করতে হবে। আমাদের মনে হচ্ছিল যে, আমাদের আরও ক্লোজ টু দা মাস কালচার, আরও ক্লোজ টু দা পপুলার যাওয়ার চেষ্টা করা প্রয়োজন।

বিশ্বকর্মা

‘স্বভাব’-এর নাটক দল এখন এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে… জানি না তোরা যে প্রশ্নটা করলি তার কতটা কাছাকাছি আমরা যেতে পারলাম। এখন, আমাদের ফেলিওরের জায়গা, মুখ থুবড়ে পড়ার জায়গাটা আরেকটু হাইলাইট করা দরকার। চিটফান্ড একটি বড় ধরণের রাজনৈতিক বিষয়। আর চিট ফান্ড এখন আবার করে রোল করতে শুরু করেছে। আজকেই একটা খবর আছে… নানান আকারে কিন্তু চিট ফান্ড ঢুকছে। এবং আমার ধারণা আমাদের যা ব্যাঙ্কিং সিস্টেম তাতে চিট ফান্ড থাকবেই—এটা একটা রিয়েলিটি। এটা নিয়ে অবশ্য আমার অনেক আগুনখেকো রাজনৈতিক কর্মীদের সাথেও তর্ক, যে চিটফান্ড এই মুহূর্তে একটা বার্নিং ইশ্যু কিনা। আমাদের মতে এটা বার্নিং ইশ্যু। এখন চিট ফান্ড আর তার সাথে চাষীদের খতম হয়ে যাওয়া—এসব মাথায় রেখে ‘জিন্দেগি এক জুয়া’ বলে একটা নাটক তৈরি করেছিলাম, যেটা গ্রামে গিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো। এদিকে অভিনেতার সংখ্যা চার থেকে তিনে নামাতে হয়েছে, কিন্তু নাটকটা আমাদের রাস্তায় করতেই হবে। আমি, বর্তিকা আর ওই ছেলেটি—যে ভেবেছিলো হোল টাইমার হবে, কিন্তু একটা সময়ের পর তার একটা দ্বন্দ্ব দেখতে পাই, অন্তত এই মুহূর্তে তাকে হোল টাইমার হিসেবে টানা যাবে না—ফলে আমরা ‘জিন্দেগি এক জুয়া’ও বন্ধ রাখলাম।

‘স্বভাব’-এর এই মুহূর্তে যেটা হয়ে আছে, যে আমরা কলকাতার এবং দিল্লি-হরিয়ানা—এই দুই জায়গাতেই কিছু কিছু কাজের ডাক পাচ্ছি। পরিষ্কার করে বললে এখন ‘স্বভাব’-এর মূল এজেন্ডা হচ্ছে—নিজেদের নাটক করা, রিসার্চ করা, নাটক তৈরি করা। আমরা এখনো পর্যন্ত কোনো ছাপানো নাটক করিনি, যা করেছি সবই আমাদের নিজেদের তৈরি করা। আর হলো দেশ জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় স্বতন্ত্র, স্বাধীন নাটকের দল তৈরি করা। যারা পলিটিকালি মোটিভেটেড, এবং একদম আক্ষরিক অর্থে পীপলস থিয়েটারটা করবে। সেটা শ্রমিক সংগঠন হতে পারে, ছাত্র-যুব সংগঠন হতে পারে। তাদের নিজস্ব একটা পলিটিকাল অ্যাফিলিয়েশন থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে, যাই হোক। কিন্তু আমরা যেটা বুঝতে পারছি, এই যে শ্রমিক সংগঠনের সাথে কথা চলছে—ওরা হয়তো আগামী ছ’মাসে আমাদের আরও কিছু নাটক তুলিয়ে দিতে ডাকবে, দল তৈরি করে দিতে সাহায্য করতে বলবে, সেইটাই এখন ‘স্বভাব’-এর মূল কাজ হবে। কারণ ফলতায় যে ছোটদের টীম—আমরা যে ‘আকবর চাচা’ বলে আরেকটা নাটক করি, তাদের দিয়ে তিনটে শো-র বেশি করানো যায়নি। যদিও আমরা ভেবেছিলাম ওরা আরেকটু ম্যাচিওর করে গেছে। ফলতায় এটা কেন করা যাচ্ছে না, সেটা পার্থ আরও ভালো বলতে পারবে। কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে যে অন্য জায়গায় নাটকের দল তৈরি করে দেওয়াটাই ‘স্বভাব’-এর কাজ হবে আপাতত মাস ছয়।

–ব্রেক–

আয়নানগর : আর্ট জিনিসটাকে বামপন্থী কর্মীমহলে সেইভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবা হয় না।  যদিও কথাটা যে কেউ মুখ ফুটে স্বীকার করবে, এমনটাও নয়।  ওই, যে ছবি আঁকতে পারে, সে কয়েকটা পোস্টার এঁকে দিলো, যে গান গাইতে পারে—লোকে যখন আর বক্তৃতা শুনতে পারছে না—তখন একটু গেয়ে দিলো, নাটকও ওইভাবেই…

অঙ্কুর : হ্যাঁ একটা ফিলার। পথনাটিকাও ওইভাবেই ব্যবহার হয়, যে লোক জমে গেলো, এবার সভা শুরু করা যাক।

আয়নানগর : হ্যাঁ, কোথাও একটা এর পেছনে একটা মনোভাব থাকে, “রাজনৌতিক কর্মকান্ড” বিষয়টিই মূল। হয়তো কেউ এক্ষুনি সেই সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যেতে পারছে না, তো তাকে একটু ওই ক্রিয়েটিভিটি, একটু কালচারাল কাজ দিয়ে ইনভল্ভ করে রাখলাম। দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে, এটাই মোটামুটি বামপন্থী দলগুলোর সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের প্রতি এটিচুড। তোমাদের কথার মধ্যে যে আমি যে একটা অন্য দিক দেখতে পাচ্ছি সেটা নিয়ে যদি আরেকটু বলো। যেমন পার্থ যে বললো,আগে নাটকের নাম শুনলে আর সে ঘরে ঢুকতো না [হাসি], সেখান থেকে তোমরা সবাই কি করে একসাথে নাটকটা করছো, সেই বিষয়টার মধ্যে যদি আরেকটু যাও।

বর্তিকা : প্রসেস নিয়ে একটা জিনিস যেটা খুব জরুরি—সেটা অঙ্কুর, তুমি পরে আরও বলতে পারো—যে আমরা কাদের জন্য নাটকটা করছি। আমাদের কাছে একটা নাটকের পারফর্মেন্স যতটা জরুরি, প্রসেসটাও ততটাই জরুরি। মানে ওই প্রক্রিয়াটা—আমরা যে পলিটিক্সের কথা বলছি—সেটা আমরা লিভ করার চেষ্টা করি এই প্রসেসের মধ্যে দিয়ে। আর এই পুরোটাই একটা কমিউনিটি নিয়ে। পলিটিক্সেও যে কমিউনিটির কথা আসে—এই কমিউনিটি-লাইফটার মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করি। যেমন যখন ‘স্বভাব’ নাটক দল নাটক করছে, তখন আমরা একসঙ্গে থেকে করার চেষ্টা করি নাটকটা। কারণ, শুধু রিহার্সাল দেওয়াটা জরুরি না, তার চেয়েও গুরুত্ব থাকে একসাথে রান্না করা, থাকা—এইসব জিনিসে। এই প্রসেসের মধ্যে দায়িত্ব নেওয়া, ডিসিপ্লিন,লোকের সঙ্গে একসাথে কাজ করা, টীমওয়র্ক, সেনসিটিভিটি, লোকজনকে বোঝা—মানে রাজনীতি করতে গেলে, সংগঠন করতে গেলে, বা কোনোরকমের একসাথে কাজ করতে গেলে যেসব জিনিস প্রিরেকুইজিট। এটা আমাদের প্রসেসের মধ্যে থাকে। ক্রিয়েটিভিটিও আছে, কিন্তু তার মধ্যে অনেকগুলো ভ্যালুজ মেনে আমাদের চলতে হয়। প্লাস, আগে যেটা বলছিলাম— যে সবসময় আর্টিস্ট হওয়ার দরকার নেই। আমি এটা পারি, বা আমি আর্টিস্ট—বরং প্রত্যেক মানুষের মধ্যে পোটেনশিয়ালটা কিভাবে আমরা বার করতে পারি, রীচ করতে পারি—সেটা আমাদের কাজ। বেসিকালি মানুষকে রেস্পেক্ট দেওয়া। আমার এতোটা পলিটিকাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, কিন্তু আমার মনে হয় মানুষকে রেস্পেক্ট দিতে না পারলে ছোট বড় কোনো কাজই করা সম্ভব না।

আয়নানগর : আমি তোমার কথার মধ্যে যেটা শুনতে পাচ্ছি, তা হলো, যে ‘আর্টিস্ট’ শব্দটির মধ্যে দিয়ে তো আমরা সোসাইটিতে একটা ক্যাটেগরি তৈরি করি। কেউ কেউ আর্টিস্ট হতে পারে, কেউ কেউ পারে না। তার মধ্যে তো হাজার একটা সামাজিক জটিলতা  অলরেডি আছে—শিক্ষার ব্যাপার আছে, একদম স্পেসিফিক একটা ট্রেনিং-এর ব্যাপার আছে। শ্রেণী, জাতপাত, লিঙ্গ—এইসব তো আছেই। কিন্তু সেইসব বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র কোথাও একটা কিছু তৈরি করার মধ্যে দিয়ে যে নিজেদের মনুষ্যত্ব—যদি খুব গোদাভাবে বলি—সেটার একটা খোঁজ মানুষ পাচ্ছে—যেটা সে আর কোথাও পায় না।

বর্তিকা : একদমই তাই। আমাদের নাটক করতে গেলে কোনো শিক্ষার দরকার নেই। শুধু দরকার হচ্ছে কমিটমেন্ট। তুমি কি এই প্রসেসের প্রতি, জিনিসটার প্রতি কমিটেড আছো কিনা, সময়টা দেবে কিনা। যদি দাও, তাহলে আর কিছুর দরকার নেই। তোমার মধ্যে থেকে আর্টিস্ট বার করার কাজটা আমাদের। একইসাথে আমরা নিজেদের ভিতরকার আর্টিস্টকেও খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি। ফলে এই প্রসেসটা খুবই  ইনক্লুসিভ। আমাদের সাথে যারা নাটক করেছে, তারা অনেকেই কিন্তু মেইনস্ট্রিম এডুকেশন সিস্টেমে ফিট করেনি। লোকজন—যাদের বলা হয়েছে—ওরা স্পেশাল চিলড্রেন, বা মোটর কোঅর্ডিনেশনে সমস্যা রয়েছে, বা কারুর…

অঙ্কুর : কেউ কেউ গুণতেও পারে না… পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েস।

বর্তিকা : হ্যাঁ, অর্থাৎ যারা বিভিন্ন ভাবে মার্জিনালাইজড। সোশিও-ইকোনমিক ভাবে মার্জিনালাইজড—সেরকম মানুষদের সাথে কাজ তো আমরা করছিই, কিন্তু আরও নানা ভাবে। ইভন মিডল ক্লাসে যারা অন্যভাবে পিছিয়ে আছে—ওদের সাথে আমরা খুব ভালো ভাবে কাজ করতে পারি, আর ওরা দারুণ পারফর্ম করতে পারে। আমাদের কাজটা ওদের মধ্যেকার আর্টিস্টকে বার করে আনে। আমাদের প্রসেস সবাইকে ওই রেস্পেক্টটা দেয়, সবাই মনে করে যে ‘হ্যাঁ, আমরা নাটকটা পারি’। অনেক প্রসেস হতে পারে যেটা ইনক্লুসিভ, কিন্তু কোয়ালিটি অফ পারফর্মেন্সটা আবার কম্প্রোমাইজড হয়ে যাবে। তো এই দুটোর মধ্যে কিভাবে… আমরা কোয়ালিটি পারফর্মেন্সও বার করতে পারি—কারণ এক্সেলেন্সও আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একই সময়ে আমরা লোকেদের পোটেনশিয়ালটা ধরি।

পার্থ : ধরো আমার সাথে যখন অঙ্কুরের প্রথম আলাপ, প্রথমে যখন ‘তেঁতুলদোনার রাজা’ তিন দিনের রিহার্সাল শুরু হলো, তার মধ্যে একদিন হয়ে যেটা ফেল করে গেলো, আমার মনে আছে—আমি ছাত্রদের জড়ো করলাম, ও রিহার্সাল শুরু করলো,আমি সাইডে খানিকক্ষণ বসে থেকে ঘুমোতে শুরু করলাম [হাসি]। আসলে তুমি মাঝে একটা কথা বললে না, যে রাজনৈতিক ট্রেনিং? আমার যা রাজনৈতিক ট্রেনিং, সেটা আমায় সবসময় বলে যে এগুলো ফিলার।

এবার এটা আমি বলছি ২০১০-১১-র কথা। তারপরে আমি যত অন্য বাচ্চাদের সাথে কাজগুলো দেখছি… আমি আগে নাটক দেখিনি তেমনটা নয়, কিন্তু এরকমও হয়েছে যে ওই নন্দন-অ্যাকাডেমি চত্বরে গিয়ে জয়া হয়তো নাটক দেখছে, আমি সাইডে বসে ঘুমিয়ে পড়ছি। মানে, এটা হামেশাই হয়। বা এখনো সিনেমায় যদি খুব অ্যাট্রাকটিভ কিছু না থাকে—ধাঁই-ঢিসুম-গান-ফান—আমি অবধারিত ভাবে ঘুমিয়ে পড়ি। আমায় জয়া বারণও করে—‘দ্যাখ, এমনি এমনি গিয়ে পয়সা নষ্ট করিস না বেকার’। ‘আয়না’র নাটক আমি দেখেছি—আমার ভালো লেগেছিলো। একটা নাটক ওরা করেছিলো সরশুনায় রিকশা স্ট্যান্ডে—ওই যেটুকু জায়গা আছে স্ট্যান্ডে—ওখানেই। নামটা আমার ঠিক মনে নেই। কিন্তু আমায় বেশ ছুঁয়ে গেছিলো। মনে হয়েছিলো নাটক হলে এরকমই হওয়া উচিত। সবার ইনভল্ভমেন্ট রয়েছে, একটা সুন্দর গল্প রয়েছে… পরবর্তীকালে যখন অঙ্কুর ‘তেঁতুলদোনার রাজা’ করছে—তখন দুটো-তিনটে শো হয়ে গেছে—তখন আমার এক বন্ধু আমায় জিজ্ঞেস করছে—‘গল্পটা কি?’ তো প্রথমবার আমি গল্পটাও ঠিক করে বলতে পারিনি। ওই বাচ্চাদের অরগ্যানাইজ করা হচ্ছে—এটাই যা একটা ব্যাপার ছিলো। বাচ্চাদের নিয়ে নানা জায়গায় যাওয়ার কথা— কখনো বিবেকানন্দ কলেজ, কখনো নাইট স্কুল—এইসব। তো তখন আমাকে যেটা সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিলো—এই বাচ্চাদের একটা টীম হয়ে ওঠার প্রসেস। আর বর্তিকা যেটা বলছিলো—রেস্পেক্টের প্রশ্ন। এই যে বাচ্চাগুলো একসাথে একটা টীম হয়ে উঠছে—এখানে একে অপরের প্রতি ফীলিংস—সেটা বাড়ছে কিনা,এটাই ছিল মূল বিষয়। মূল বিষয়টা এটা না যে তোমার কতো ভালো স্কিল আছে। মূল বিষয়, তুমি আর দশ জনের সাথে সহমর্মী হচ্ছো কিনা। কেউ একটা লাইন ভুলে গেলে তুমি দোষ না দিয়ে তাকে হেল্প করতে পারছো কিনা। মানে টীমটা ফাংশন করতে পারছে কিনা। অঙ্কুর যেটা বলে, যে গোটা ব্যাপারটা একটা ফুটবল খেলার টীমের মতোই। গোল করতে গেলে গোটা টীমটাকে একসাথে খেলতে হবে…

তো এই ব্যাপারটা আমায় আস্তে আস্তে আকৃষ্ট করতে শুরু করে। ২০১০-এর ওই সময়টা জুড়ে আমারও ফলতা অঞ্চল জুড়ে কিছু অ্যাকটিভিটি ছিলো। তার মধ্যে বড় একটা জায়গা জুড়ে—এখনো সেটার সাথে আমি কিছুটা যুক্ত আছি, কিন্তু আগের মতো নয়—সেটা হলো জৈব চাষ। কিন্তু জৈব চাষ করতে গিয়েও দেখতে পাচ্ছি, যে সেখানেও মূল ইন্টারেস্ট-এর ব্যাপারটা হচ্ছে কোথাও একটা টীম তৈরি করা গেলো কিনা। সেটা দেখছিলাম, হয়ে উঠছিলো না। লোকজন আসছে, কিন্তু সবাই তার মধ্যে একটা না একটা স্কীমের ধান্দা করছে। সেটা কখনো এটাও হয়ে ওঠে না, যে আমি একজনের পিছনে দাঁড়িয়ে বলছি যে ‘তোমায় আমি ভাই এতোটা সাপোর্ট দেবো…’ স্কীম ছাড়াই দেবো। এই সাপোর্টটা হয়তো সে স্কীমেও পাবে না। কিন্তু তাতেও লোকে বিশ্বাস করতে পারে না। এবং এটা দিয়েও আমি বোধের জায়গা থেকে, আগে রাজনৈতিক কাজ থেকে বসে যাওয়ায় যে জায়গাটা ছিলো—সেটার মধ্যে থেকেও যেটা বুঝতে পারছিলাম, যে প্রথম ওই টীম তৈরি হওয়ার প্রসেসটাও কোথাও গড়ে উঠছিলো না। যা যা আমরা বলছি, আর যা যা করছি—দুটোর মধ্যে একটা পার্থক্য থেকে যাচ্ছিলো। সেটা আমার নিজের জীবনেও সারাদিন ধরে যে খাওয়া-দাওয়া, ঘোরাফেরা—সেটার মধ্যেও একটা সমস্যা তৈরি করছিলো।

নাটকের এই ক্যাম্পগুলোর মধ্যে যখন আস্তে আস্তে ঢুকতে শুরু করলাম, একটু ইনভল্ভড হলাম… ধরো এ বছর ‘আকবর চাচা’র ক্যাম্পে আমি ফুল টাইম গিয়েছি। একদম স্কুল ছুটি নিয়ে, সমস্ত কিছু বন্ধ করে, ক্যাম্পের একজন সদস্য হিসেবে। কিছুটা ‘বিশ্বকর্মা’ বা ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’র সময়েও…

অঙ্কুর : ও চার দিন ছুটি নিয়ে চলে গেছিলো ঝাড়খণ্ড।

পার্থ : হ্যাঁ, এইগুলো আমায় আকৃষ্ট করতে শুরু করলো। এতোজন লোক, একসাথে খাওয়া, সবাই মিলে কাজকর্ম নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নেওয়া, এটাই আসল ছিলো আমার কাছে। শুধুই নাটক আমার কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। এখনো যদি শুধুই একটা নাটক হয়, আমি বিষয়টায় তত ইন্টারেস্টেড হবো না। আর তুমি যে পীপলস থিয়েটারের কথা বলছিলে… ওই যে বললাম সিনেমাতেও যদি একটা মৌজমস্তির ব্যাপার না থাকে… সেই ব্যাপারটাও ওইরকম আমায় আকৃষ্ট করেনি। কিন্তু এই নাটকের মধ্যে এই যে একটা ব্যাপার রয়েছ… যেমন একটা যাত্রার দলে থাকে। আমি কিন্তু যাত্রা দেখতে গিয়ে—সে যত খারাপই হোক—কখনো ঘুমোইনি।

অঙ্কুর : কিন্তু পথনাটিকা দেখতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছ! [হাসি]

পার্থ : হ্যাঁ, ভালো লাগেনি, সরে গেছি, অন্যমনস্ক হয়ে গেছি… কিন্তু ‘বিশ্বকর্মা’ থেকে শুরু করে মনে হচ্ছে, এখানে কাজ করা যায়। একসঙ্গে মিলেমিশে টীম তৈরির চেষ্টা করা যায়, পথ চলা যায়। অথচ ওই যে ভিতরে ভিতরেও রয়ে গেছে আমার এই ধারণাটা, যে এগুলো ফিলার—সেইসব নিয়ে খুব ঝগড়াঝাঁটিও হয়েছে, তিন দিন মুখ দেখাদেখি বন্ধ—কথা হচ্ছে না। তারপর হয়তো ওকে একটা এসএমএস পাঠালাম যে ‘না গুরু, ওটা ভুল হয়েছিল’… এইসব হ্যানত্যান। এরকম করে করে এগোনো।

এর সাথে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস—যে বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের ওঠাবসা, তারা মূলত গরীব ঘরের বাচ্চা। বাবুবাড়ির বাচ্চা নয়। এমনকি আমার মেয়েও যদি আসে, তারও একটা নির্দিষ্ট চাহিদা আছে, আমরাও তাকে একভাবে নার্চার করে থাকি। সেও হয়তো এই প্রসেসটার মধ্যে ঢুকবে না। যে বাচ্চারা আসে, তারা এমন পরিবার থেকে আসে—তারা তাদের নিজেদের যে নানান কিছু বেদনা, যন্ত্রণা, সেসব ভুলে, সেসবের উর্দ্ধে একটা চাওয়া-পাওয়ার জায়গা থেকেও আসে। এবং তার সঙ্গে আমিও যখন থাকছি, দেখতে পাচ্ছি, তাকে নাটকের এই বিষয়টা আনন্দ না দিলে সে দু’দিনে কেটে যাবে। ওইখান থেকেও আমার কাছে টেস্টেড হচ্ছে বিষয়টা, যে না, এইটা দিয়ে তো এই বাচ্চাগুলোকেও টীম হিসেবে দাঁড় করানো যাচ্ছে।

আয়নানগর : ইনক্লুসিভিটি, হেটেরোজেনাটি—এই শব্দগুলো একভাবে আজকের নিও-লিবারাল যে পাবলিক স্ফিয়ার, সেখানকারও ভাষা, শব্দ। সেইধারার সাংস্কৃতিক কাজকর্মের থেকে তোমরা কিভাবে নিজেদের আলাদা করছো?

অঙ্কুর : আমাদের এটা এনজিও থেকে কোথায় আলাদা… সাধারণভাবে আইপিটিএ অনওয়র্ড আমাদের যে লেফট থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটারের একটা বড় ধারা আবহমান—আমাদের মতে এখন দার্শনিক ভাবে, রাজনৈতিক ভাবে সেই ধারাটি আজ যথেষ্ট ক্ষয়িষ্ণু। আসলে প্রথমত, আমাদের এটাও একটা রাজনীতি। অবশ্য, শুধু বলে ফেললেই  যে আলাদা করা যাবে এমনটা নয়। বারবারই কাজের মধ্যে দিয়ে, বা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে আমরা এটা প্রমাণ করতে করতে যাবো—পাশে একটা লম্বা দাগ টানতে টানতে যাওয়া, দাগটাকে আরও কিভাবে লম্বা করা যায়। দুই হচ্ছে যে, লেফট থিয়েটার মুভমেন্ট, বা লেফট পলিটিক্স—এটার একদম মধ্যে দিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। এই লীগেসিটাকে আমি কোনোভাবে অস্বীকার করতে চাই না। তুই যে একটু আগে অফ দা রেকর্ড ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-র কথা বললি, আমি অন্তত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি না, যে আমি অ্যাকাডেমিতে দাঁড়িয়ে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’র মতো একটা নাটক করছি।

আয়নানগর : ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ না বলে ধর আমি বলছি ‘মারীচ সংবাদ’ …

অঙ্কুর : কিন্তু এই সব মাথায় রেখেও ব্যক্তিগতভাবে থিয়েটারের ছাত্র হিসেবে, রাজনীতির ছাত্র হিসেবে আমি যদি দেখতে বসি, তাহলে পলিটিকাল পেনিট্রেশনের জায়গা থেকে আমি বাদল সরকারকে সবচেয়ে আগে রাখবো। এবার পাশাপাশি অনেকগুলো প্রশ্ন আমাদের প্রায়ই ফেস করতে হয়। যেমন, আমরা তো তাহলে থার্ড থিয়েটার করছি। সরাসরি প্রশ্ন করলে আমি সরাসরি উত্তর দেবো, যে না, আমরা থার্ড থিয়েটার করছি না। কোনোরকম ভাবে আমি তো নই, পার্থ বা বর্তিকা তো নয়ই—আমরা কোনো থার্ড থিয়েটারের ব্যাগেজ নিয়ে আসিনি। এবং থার্ড থিয়েটারের পদ্ধতি ইত্যাদি কিচ্ছু ফলো করি না। কিছু কিছু তো কমন গ্রাউন্ড থাকবেই। এখন তুই যে প্রশ্নটায় বারবার আসতে চাইছিস—আক্ষরিক অর্থে পীপলস থিয়েটার করি কিনা—সেটার খানিকটা টেকনিকাল উত্তর দিতে পারি। কিন্তু পাশাপাশি আমি চাই না যে এমন কথার মধ্যে ঢুকতে এই পারটিকুলার আড্ডাটাতে—যাতে যারা এখনো থার্ড থিয়েটার নিয়ে কাজ করে চলেছেন, তাঁরা কোনোভাবে আহত হন। আমি মনে করি,তাঁরা ডেফিনিটলি আমাদের অ্যালাই।

আমাদের কথাটা আমি দুটো টিয়ারে এইভাবে বলতে পারি, একটা আরেকটার পরিপূরক। এক হচ্ছে, আমি যখন নাটক করছি, এক্সক্লুসিভলি আমি মেহনতী জনতার কথা ভাবছি—এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত বা দ্বিধা নেই। আমরা মনে করি, আমাদের নাটকে যদি সেই চর্চা, সততা, কমিটমেন্ট, রিসার্চ নিয়ে আসতে পারি, তাহলে পৃথিবীর গভীরতম দর্শনের কথা আমরা এর ভিতর দিয়ে বলতে পারবো। এবার, আমরা যখনই নাটক তৈরি করছি, গান তৈরি করছি, প্রসেস তৈরি করছি, বা একটা অ্যাকশন ভাবছি, আমার মাথায় কিন্তু সরাসরি ধরা যাক রয়েছে আমার মায়ের কাছে কাজ করে যে মেয়েটি—সুজাতা—সে কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে। বা আমি যে বন্ধ কারখানার শ্রমিককে চিনি—সে কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে। বা ধর আমি যে চায়ের দোকানে রোজ চা খাই, তিনি কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন। এখানে নন্দিনী, প্রমোদ—বা আমাদের যারা খুব ক্লোজ, কিন্তু সেই অর্থে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, হয়তো লেফট পলিটিকাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে, তাদের কি ভালো লাগবে, তাদের যে ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি,সেটা বিচার্য নয়। এমন একটা প্রসেস তৈরি করতে চাইছি, যেটায় শুধু মধ্যবিত্ত না, যে কেউ আসতে পারে। কিন্তু টার্গেট গ্রুপ যদি বলিস, তোদের কথা ভেবে করছি না, সেটা খুব পরিষ্কার।

আরেকটা যে দিক, সেটা হলো—আসলে ফর্ম-কন্টেন্ট বললে আমার আবার আজকাল একটু…

আয়নানগর : না আমি ফর্ম কন্টেন্ট বলছি না ঠিক, ধর ফর্মেরও তো একটা পলিটিক্স থাকে… যেটা নিয়ে তোমরা ভাবনাচিন্তা করেওছো। মানে তুই যে কন্টেন্টটার কথা বলছিস, সেটা তো একদম হিস্টোরিকাল লেফট কন্টেন্ট। পুঁজিবাদী আগ্রাসনের কন্টেন্ট, বা শ্রমিক সংগ্রামের কন্টেন্ট… বা আমি যদি শ্রমিক সংগ্রাম কথাটা বাদ দিয়েও বলি—পপুলার লড়াইয়ের কন্টেন্ট—সেটা নিয়ে আমি অতোটা বলছি না। কিন্তু সেটারও একটা লম্বা ইতিহাস আছে। একটা সময় নাট্যকাররা মনে করেছেন,এইরকম নাটক করতে গেলে শেষটা আমায় করতে হবে ইন্টারন্যাশনাল, লাল পতাকা দিয়ে। লাল আলোর সিল্যুয়েটে, প্রচুর রোগা রোগা পুরুষদের হাত, মুষ্টিবদ্ধ হাত, সামনে ভুঁড়িটা এগিয়ে আছে…

অঙ্কুর : একটু হালকা করে দিয়ে দিলি… [হাসি]

আয়নানগর : হ্যাঁ, তো ওই কন্টেন্টের জায়গাটা আমাদের আলোচনায় আসতেই পারে, কিন্তু এক্ষুনি জরুরি নয়। কিন্তু আমি বরং অনেক বেশি আগ্রহী ফর্মের রাজনীতিটা নিয়ে জানতে—যে আলোচনাটা আমরা পলিটিকাল আর্টের ক্ষেত্রে খুব একটা করি না।

অঙ্কুর : আমি একটু তোর সাথে ডিফার করবো এই জায়গাটা। ফর্ম-কন্টেন্ট-এর এই বাইনারিটাতে আজকাল আমি একটু কনফিউজড। এমনটা নয় যে আমি খুব বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু কনফিউজড সেটা স্বীকার করতেই হবে। এইজন্য কনফিউজড—ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই—‘মধুবাবুর বাজার’ নাটকটার কথা বললাম তোকে, যেটা বাজার ও বস্তি অঞ্চলে করবো বলে ভেবেছিলাম। ওই নাটকে একটা খুব স্ট্রং সাবটেক্সট ছিলো, সেটা হচ্ছে ‘দিওয়ানা’ বলে একটা বাংলা ছবি। একদম একটা বাংলা পটবয়লার, জিৎ-শ্রাবন্তী জুটির। তো ওতে একটা গান ছিলো, যেটার রেন্ডিশন আমরা একটা হ্যাপি সিচুয়েশনেও ব্যবহার করি, একটা স্যাড সিচুয়েশনেও ব্যবহার করি। একদম এন্ডে। এটা এইজন্য—তুই যদি বলিউড দেখিস আজকাল—একই টিউন একবার হ্যাপি, একবার স্যাড ফ্রেমে ফেলে গাওয়া হয় প্রায়ই। আমরা কিন্তু স্যাড সিচুয়েশনেও একিই ফাস্ট রেন্ডিশন ব্যবহার করি। স্যাড ফ্রেমে ফেলে স্লো রেন্ডিশন নয়। এবার এই জায়গাটা—তুই যদি বলিস ‘তুই কি ফর্ম ব্যবহার করলি?’—আমি বলবো ‘না’। এখানে কন্টেন্টটাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমি বহু এরকম নাটক দেখেছি, যারা হিন্দি সিনেমা বা পপুলার বাংলা সিনেমার একটা গান বা তার প্যারডি ব্যবহার করছে, বা কোনো সিচুয়েশন ব্যবহার করছে। তারা চাক বা না যাক, বাই ডিফল্ট সেটা স্পুফ হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজে হিন্দি বা বাংলা সিনেমার স্পুফ করার ঘোরতর বিরোধী। সেই জায়গা থেকে ফর্ম-কন্টেন্ট-এর বাইনারিটাতে আমি একটু থমকাতে চাইছি।

তাহলে আমরা কিভাবে দেখছি? মাস কালচার অ্যাজ এ হোল! একটা গল্প বললে আরও ভালো বুঝতে পারবি। ২০১৪-য় আইপিএল-এর ফাইনাল হচ্ছে। দেখছি স্প্রাইট-এর একটা নতুন অ্যাড হচ্ছে। শনিবার বোধহয় ফাইনাল হয়। হয়ে গেলো। তার এক দিন কি দেড় দিন বাদে আমি ফলতায় যাচ্ছি। সকাল সাতটায় নুঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছি, বাস ধরবো। নুঙ্গিতে একদম মোড়ের যে মিষ্টির দোকানটা—নুঙ্গিতে, মাইন্ড ইট কলকাতা নয়—আমি তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি, আগের দিন রাতেই, মানে আইপিএল ফাইনালের পরের দিন রাতেই ওই অ্যাডের, ওই জিংগলের ক্যাপশন দেওয়া গেটটা লাগানো হয়ে গেছে। এই স্পীডটা—আমার ব্যাটলটা এর সঙ্গে। প্রাথমিক ভাবে ভিশুয়াল লেভেলে ব্যাটল। এবার সেখানে যদি স্পেকট্যাকল বলিস, তো হ্যাঁ, যেকোনো রকম এক্সটেন্ট-এ গিয়ে আমি ওই স্পেকট্যাকল-টা তৈরি করতে চাই। এবার যদি পরের শব্দটা বলিস—সাবভার্শন। আমি কি মাস কালচারটাকে সাবভার্ট করছি? আমি জানি না। আমি এটুকু জানি, যে আমি যখন ওই মাস কালচারটার মধ্যে ঢুকছি,আমি একটা পলিটিকাল মাইন্ড নিয়ে ঢুকছি। কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু ঘটবে, কিছু না কিছু বদল আমি ঘটাবো। স্প্রাইট যে স্পীডে মুভ করছে, মার্কেট যে স্পীডে মুভ করছে, ওই স্পীডে নাটকটাকে মুভ করতে হবে। সেই ভিশুয়াল ব্যাটল। এবার সমস্যাটা হলো—এই যে কথাটা আমি তোকে বলছি, এটা আমি তোকে হলোফ করে বলতে পারি, আমাদের তৃতীয় ধারার রাজনৈতিক কর্মী বল, সাংস্কৃতিক কর্মী বল, বা যেকোনো সিম্প্যাথাইজার—তাদের একশো জনের মধ্যে নব্বই জনকে আমি কমিউনিকেট করতে পারবো না। করে দেখেছি। তারা জাস্ট বুঝতেই পারছে না আমি কি বলতে চাইছি। কারণ যে লীগেসি থেকে আমরা আসি, সেটা হাই কালচার-এর লীগেসি। আমিও ওখান থেকেই এসেছি। কিন্তু আমাকে সেটা ডি-স্কুল করে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। আমি রিয়েলাইজ করেছি অনেক পরে, মানে আমি যখন আর কি আঁতেল হবো বলে ঠিক করেছি, আমি অ্যাকচুয়ালি ওই হাই কালচারটাকে অ্যাডপ্ট করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার ছোটবেলাটা আক্ষরিক অর্থে কেটেছে আমার দিদি চিত্রহার বা চিত্রমালা দেখতে যাচ্ছে, আমি পিছনে ছুটছি, ওয়েসিস ডবল অ্যাকশন বাজছে… আশির দশকে যখন আমি বড় হচ্ছি, রেডিও কালচারটা তখন একটা খুব পোটেন্ট ব্যাপার।

আয়নানগর : শনিবারের বারবেলা…

অঙ্কুর : হ্যাঁ, হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্স [হাসি]। আমার লড়াইটা যেটা করার চেষ্টা করছি, আমি জিনিসটাকে মরালিটির বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ধর, আমরা ভাষা নিয়ে এতো কথা বলি। ভাঁটিখানায় লোকে কিভাবে কথা বলে—বারোদুয়ারি বা খালাসিটোলায় লোকে কিভাবে কথা বলে—কীভাবে এটা নাটকে আনতে পারি—নোবডি নোজ। পাশাপাশি এটাও আমি বলবো, যখনই কেউ রিসার্চের পারপাসে এই ভাষাটাকে অ্যাডপ্ট করছে, সেটা একটা এলিট স্পেস। আমি মনে করি নবারুণ এলিটদের জন্য লিখেছেন। উনি যে ফর্মটা নিচ্ছেন, সেটা এলিটদের জন্য। নয়তো বইয়ের দাম একশো কুড়ি টাকা হয় না। এরকম একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে, আমরা যা করছি, তার দশ গুণ বেশি রিসার্চ প্রয়োজন। অন্তত দশ গুণ বেশি লোকজন প্রয়োজন, যারা শুধু রিসার্চটা করবে। যারা হোর্ডিংটা দেখবে—বালিগঞ্জ থেকে ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত কিভাবে হোর্ডিংটা বদলাতে বদলাতে যাচ্ছে, তার ভাষাটা কিভাবে বদলাচ্ছে, এইটা স্টাডি করবে। এই মেটিরিয়াল, এই লোকবল, এই রিসোর্স আমাদের নেই। ওই হাঁচড়ে পাঁচড়ে, লোকের কথা শুনে, মোটামুটি একটা কিছু দাঁড় করাতে পারছি বলে আমরা মনে করছি।

এখন একটা এরকম কথা চলছে, যে আমরা কোনো একটা সংগঠনের সাথে কাজ করবো। তারা রাজস্থানের দিকে মুভ করতে চায়। রাজস্থানের একদম ইন্টিরিয়রে—মরুভূমির আশেপাশে—যেখানে এখন একটা আগ্রাসন শুরু হয়েছে। আমাকে যদি ওখানে যেতে হয়, আমাকে আমার যাবতীয় লীগেসি ছুঁড়ে ফেলে ওই এলাকায় গিয়ে পড়তে হবে। অন্তত তিন মাস ওইখানে দাঁড়িয়ে ওই ছেলেগুলোকে ধরে একটা নাটক নামাতে হবে। সেখানে—দুঃখজনক হলেও—আমার কোনোরকম আইপিটিএ বা লেফট থিয়েটারের লীগেসি—ফর্মের দিক থেকে গোদা অর্থে যদি ধরি—কিছুই কাজ করবে না। এবার তুই (নন্দিনীকে) আরেকটু বল।

আয়নানগর : এমনিতে আমি তোর সাথে একমত—নবারুণ সম্পর্কে, বা সাবভার্শন নিয়ে তোর যা রিডিং। এবং,  যেটা তোর কথায় খুব পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি, সেটা হলো এই যে, যে বাম ধারার ওই যে সাহিত্য, সংস্কৃতি— সেটাকে আরও ক্রিটিকালি দেখতে হবে। তো সেটার প্রক্রিয়া, তারপর ধর হোল টাইমার নিয়ে তুই বিভিন্ন সময়ে যেটা বলে থাকিস—এগুলো কিভাবে দেখছিস—এটা নিয়ে আরেকটু শুনতে চাইছি।

অঙ্কুর : তুই যদি হোলটাইমারের কথায় আসিস, যেটা কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে লেভি থেকে হয়… আমি যেভাবে চলছি সেটা আমি বলতে পারি, জানি না সেটাকে আদৌ একটা মডেল বলা যায় কিনা…কারণ মডেল আবার একটা অন্য রাজনীতি—সেটার মধ্যে ঢুকছি না। কিন্তু আমার এখনো অব্দি চলছে—একটা সময় যে চাকরি করেছিলাম, তার কিছুটা টাকা—পাশাপাশি আমার খরচ আমি অনেকটা কমিয়ে ফেলেছি। আজ যে এলাম, একবার বাসভাড়া পার্থ দিলো, একবার বর্তিকা দিলো। এইভাবে চলছে। কিন্তু এটা করতে করতেও আমি বুঝতে পারছি যে আমি আস্তে আস্তে একটা ব্যাঙ্করাপ্সির দিকে এগোচ্ছি [হাসি]। এটা করে হয়তো আমি আর ছ’মাস কি এক বছর টানতে পারবো। তার উপর—যেটা প্রমোদকে বলছিলাম—আমায় হয়তো একটা ঘর নিতে হবে এর মধ্যে। কিন্তু এটাও সত্যি যে মিনিস্ট্রি অফ কালচারের টাকা এখনও অব্দি বলছি—নেবো না। আমি সরাসরি কর্পোরেটের টাকা নেবো না। এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে… তুমি যদি বলিস ‘তাহলে তুই কি করবি?’—আমি আবারও সেই রাজনৈতিক দলগুলো—যাদের কাজ আমার মীনিংফুল মনে হয়—তাদের কাছে এই অ্যাপিলটা রেখে যাবো। যেমন দিল্লির এইটা—আমার অন্তত কিছুটা চলার মতো সাপোর্ট তারা করছে। ফাইনানশিয়াল সাপোর্ট ছাড়াও দুটো জিনিস তারা রিয়েলাইজ করছে। এক হলো, পার্টির বাইরেও একজন পলিটিকালি অ্যাওয়ার হোলটাইমারকে তারা রেস্পেক্ট করছে। দুই, তারা এই গোটা কাজটাকে মনে করছে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সহধর্মিতা। কালচার এখানে পলিটিক্সের পর্দানশীন সহধর্মিণী নয়,বরঞ্চ অ্যালাই। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবার মতো পোটেনশিয়াল দেখতে পাচ্ছে—এই দুটো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এখন সেদিন তোদের দুজনের (নন্দিনী, প্রমোদ) সাথেই সেদিন যে কথাটা হচ্ছিলো, যে একটা সোশাল ফেলোশিপ পেলে আমার খুবই সুবিধা হয়।

আয়নানগর : তুই কি বলছিস তোকে নাটক করতে গেলে হোল টাইমার হতেই হবে? মানে ধর, এই যে বাসভাড়াটা পার্থ বা বর্তিকা দিয়ে দিলো, তারাও যদি হোলটাইমার হয়? সবাই হোলটাইমার হয়ে নাটক করলে…

বর্তিকা : বাসভাড়াটা কে দেবে? [হাসি]

আয়নানগর : হ্যাঁ, কিছু লোককে তো দায়িত্ব নিতে হবে। মানে, হোল-টাইমার লাগবে। কিন্তু চারটে হোল টাইমার-এর পাশাপাশি তো পঞ্চাশটা লোককে থাকতে হবে, যারাও নাটকটা করে। কিন্তু তাদের চাকরি করতে হয়, সংসার চালাতে হয়, তাদের হয়তো তোর-আমার মতো বন্ধুও নেই, যে বা যারা ঠেকা দিয়ে হলেও চালিয়ে দেবে। বা তার হয়তো অনেকগুলো দায়িত্ব আছে। ফলত, সে কি থার্ড ফর্মে, বা তুই যে ফর্মের কথা বলছিস, সেইরকম নাটক করবে না?

অঙ্কুর : এটার দুটো উত্তর। এক হচ্ছে, আমাদের যা নাটক করার মতো এলেম, তাতে চারজনও যদি হোলটাইমার থাকে, আর তারা যদি ন্যূনতম মজুরিতে স্টিক করতে রাজি হয়, তার থাকা এবং খাওয়ার দায়িত্ব দল নেবে—আমরা যে নাটক করতে চাইছি, সেটা করে চারজন হোল টাইমারের পয়সা তুলে ফেলা যায়—শিওর। টেস্টেড। শুধু তো নাটক করে ডোনেশন নয়, আমাদের যারা বন্ধুবান্ধব, তারা লার্জলি পাতি বুর্জোয়া হলেও এখনো কিছু মানুষ এই সাপোর্টটা দিতে রাজি হবেন। এটা খানিকটা থিওরেটিকাল, খানিকটা টেস্টেড। ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা তো ময়দানে বলটা পুরোপুরি গড়াবারই সুযোগ পাচ্ছি না। বারবার ফেল করছি।

পাশাপাশি প্রমোদ তুমি যেটা বলছো—যে এই যে বড় সংখ্যক অংশ… ধরো ‘বিশ্বকর্মা’-য় আমি আর বর্তিকা—বর্তিকার এখনই সেইভাবে ফাইনানশিয়াল সাপোর্ট-এর প্রয়োজন নেই—কিন্তু সেই অর্থে আমরা দুজনই নাটকের হোলটাইমার। পার্থ আর বুলনদা—যিনি মন্টু করতেন—ওরা চাকরি করে ঢুকতো। এই যে চাকরি করে ওরা ঢুকছে, ওরা কিন্তু সেটটা, ঝাঁট দেওয়া ঘরটা, রান্নাটা রেডি পাচ্ছে। ওরা এলো—রিহার্সাল দিলাম। পরের দিন শো করে ওরা বেরিয়ে গেলো, আমরা আবার সব কাজ করে রাখলাম। এই যে স্পেসটা তৈরি করা—এই দুজন নন হোলটাইমারের জন্য কিন্তু দুজন হোলটাইমারের প্রয়োজন হচ্ছে। যখনই আমি এই লার্জার ক্রাউডের দিকে যাবো, আমার কোর বেস-টা কিন্তু হোলটাইমার বেস। পাশাপাশি আমরা একবারও বলছি না যে পার্টটাইম থিয়েটার করেন বলেই সেটা লুজ। এমন অনেক হোলটাইমার থাকতে পারে যারা পার্টটাইমারদের চেয়ে অনেক বেশি ঝুলিয়ে দেবে নাটক। এটা কমিটমেন্টের ব্যাপার। কেউ বলতেই পারে ‘আমি সপ্তাহে ছ’ঘণ্টা দেবো’, বা ‘উইকএন্ডে করবো’… অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু তারপরেও যে প্রশ্নটা উঠছে, যেখান থেকে আমরা আটকালাম… ধরো শনিবার বিকেল বা সন্ধ্যে বেলা পার্থ বা বুলনদা ঢুকছে। আমরা রিহার্সাল দিচ্ছি, রবিবার ওরা শো করে বেরিয়ে যাচ্ছে। সোম থেকে শনি দুপুর অব্দি আমার আর বর্তিকার কোনো কাজ নেই। আমরা ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাচ্ছি। এবার এর কিন্তু একটা উল্টো সাইডও তৈরি হচ্ছে। সেই জায়গা থেকে আমাদের ওই ‘বিশ্বকর্মা’-টা অফ করে দেওয়া। অন্তত একটা নাটক যেটা সোম থেকে শুক্র আমরা চারজনে মিলে করবো—তোমাকে বিভিন্ন টিয়ারে পারফর্ম করতে হবে। আমরা এই টিয়ারে গ্রুপটা তৈরি করতে পারিনি, ফেল করেছি। সেটা পরিষ্কার, যে এখনো আমরা ফেল করছি।

এই মুহূর্তে ‘স্বভাব’ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে দুটো খুব স্ট্রং মত রয়েছে। আমার মতে ছ’মাস ‘স্বভাব’ নিজের নাটক সেভাবে করবে না। হরিয়ানায় যেমন হচ্ছে, সেরকম আশেপাশে আরো দুএকটা টীম হবে, যাদের ‘স্বভাব’ শেখাবে। কিন্তু পাশাপাশি বর্তিকার যেটা মত, কিছুটা হয়তো পার্থরও, যে আমাদের যে নিজস্ব নাটক, সেটার তাহলে কি হবে? বর্তিকার যে পারফর্ম করার নিখাদ আর্জটা, সেটার কি হবে? এরকম একটা অমীমাংসিত অবস্থায় আপাতত আমরা পৌঁছেছি। এই তর্কটা উঠেছে আমরা দিল্লী থেকে ফিরে আসবার পর, কারণ ‘জিন্দেগি এক জুয়া’তে এতো খাটবার পরেও জিনিসটা ফেল করে গেলো। এতে কি তোমার প্রশ্নের উত্তর হলো খানিকটা?

আরেকটা যেটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমরা মনে করি, যে কেউ কর্পোরেটে কাজ করলো বলেই সে ব্রাত্য, কেউ থার্ড স্ট্রীমে কাজ করে বলেই সে ভীষণ বন্ধু, এই মূর্খামির মধ্যে আমরা নেই। ব্যক্তিগত এবং দলগত ভাবে আমরা মনে করি যে সমাজের নানা র‍্যাডিকাল এলিমেন্টকে আমাদের খুঁজে নিতে হবে। ধরো বর্তিকা বা রোহিত, ওদের তো কোনো লেফট বা অন্য কোনো পলিটিকাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছিলো বহু পলিটিকাল ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা মানুষের চেয়ে ওরা অনেক বেশি র‍্যাডিকালি ভাবতে, অপারেট করতে পারে।

বর্তিকা : বেসিকালি আমিও এগ্রি করি যে হোল টাইমারের একটা কোর গ্রুপ না থাকলে শুধু পার্ট টাইমার নিয়ে কাজ হবে না।

আয়নানগর : একটা কোর গ্রুপ লাগবে, যার কাছে এটাই হচ্ছে মূল।

বর্তিকা : তারা হয়তো ইন্ডিপেনডেন্টলি নাটক পারফর্মও করতে পারবে, যেখান থেকে খরচটা কিছুটা তুলতে পারবে।

আয়নানগর : দ্যাখ, এই প্রশ্নটা তো নানা আর্ট ফর্মের ক্ষেত্রে আসে, যার উত্তর আমার কাছেও নেই। কিন্তু ডিবেটটা আমি তুলি। ধর ডকুমেন্টারি, এটাও একটা ফর্ম। এই কাজটা করতে গেলে টাকাও লাগে প্রচুর। আমরা এটা ধরেই নিয়েছি, যে টাকায় খামতি পড়বে। বা খুব ভালো সিনেমা, তার খরচা…

আয়নানগর (নন্দিনী) : এমনকি ধর আয়নানগর। শুরুর ওই যে প্রথম এক-দেড় বছর টিকে থাকার স্টেজটা সেটা আমরা পার করে এসেছি। এখন এই সেকেন্ড স্টেজে, আমাদের প্রচুর ইম্যাজিনেশন আছে—যে কাদের দিয়ে লেখাতে পারি, কি ধরণের বই করতে পারি, কিন্তু সেটা সাসটেন করাতে গেলে, একটা র‍্যাডিকাল পাবলিকেশন চালাতে গেলে, সোসাইটিতে একটা কণ্ঠস্বর রাখতে গেলে যে লেভেলে যা যা  করতে হয়, তাতে হয় আমাকে অল্টারনেটিভ মিডিয়ার নাম করে এই প্লাটফর্মটাকে  একটা এনজিও বানিয়ে ফেলতে হয়, নয় যেভাবে এই ঘরানার কাজগুলো হয়—অর্থাৎ কখনো একটা প্যামফ্লেট বের হলো, কখনো একটা কবিতার বই বের হলো—খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিষয়টা চলবে আর কি।

আয়নানগর (প্রমোদ) : আমি এখান থেকে একটু বার করতে চাইছি আলোচনাটা। পাবলিকেশন বল, নাটক বল, বা যাই বল—ধর তুই যা বলছিলি—পপুলার বাংলা বা হিন্দি সিনেমা আমি… তার ল্যাঙ্গুয়েজ, তার ফর্ম নিয়েছি। সলমনের ছবি যে গরীব সে পঞ্চাশ টাকার থিয়েটারে গিয়ে দেখে। যে বড়লোক, সে পাঁচশো টাকার থিয়েটারে গিয়ে দেখে। কিন্তু আমাকে টিকিট কাটতে হবে। যে কোনো দর্শকই  টিকিট কাটে কেন, একটা ভ্যালু পায় বলেই কাটে। তাহলে প্রশ্নটা হচ্ছে, তুমি যদি একটা জিনিস তৈরি করতে পারো—ডকুমেন্টারি, নাটক, বই, যাই হোক—যেটা মানুষের ইন্টেলেকচুয়াল বা কালচারাল, যে চাহিদাই হোক, পূরণ করতে পারে। তবেই তো সে পয়সা দিয়ে কিনবে। আসলে তো মালটাই এমন বানানো হচ্ছে, যে তুমি হয়ত স্যাটিসফায়েড হচ্ছো, কিন্তু লোকের কাছে পৌঁছচ্ছে না। ওই কয়েকজন আঁতেল বসে দেখেছে। কিন্তু যদি অনেক মানুষ দশ টাকা দিয়ে টিকিট কিনেও দেখতো, তোমার টাকা উঠে যেতো। আসলে তো তুমি ওই লড়াইটার মধ্যেই যাচ্ছো না। চিরদিনই ক্লাসিকাল মিউজিক-এর ক্ষেত্রে যেমন রাজারা কবিদের পুষতো, সেই ধারাটাই চলছে এখনো… আজকের রাজারা হয়তো কর্পোরেট বা আনন্দবাজার… এই হাই আর্টটা সবসময়েই আসলে পুষবে কেউ। এটাকে কিভাবে চ্যালেঞ্জ করা যায়, ভাঙা যায়—এই জায়গা থেকে কি অ্যাপ্রোচ করা উচিত নয়?

অঙ্কুর : একদমই। আমরা দুজনে হয়তো একই কথা বলছি…

আয়নানগর (প্রমোদ) : ডিফারেন্সটা এইখানে যে শুরুতেই ধরে নেওয়া হচ্ছে এটা প্রফেশনাল নয়। ইচ্ছে হলো দেখলাম, কেউ চেনা থাকলে পাঁচ-দশ টাকা দিলাম। এটাকে কি করে ব্রেক করা যায়? এটাকে চ্যালেঞ্জ করা নিয়ে কি ভেবেছিস? যে আমি যেটা করছি, সেটাও এক অর্থে তো একটা প্রোডাক্ট…

অঙ্কুর : একদমই তাই। কিন্তু যে জায়গা থেকে তুমি কথাটা বলছো, সেখানে আমরা খেলাটাই শুরু করে উঠতে পারিনি। আমি যে একটা সত্যের নির্যাস বার করে একটা থিওরি তৈরি করবো, যে হ্যাঁ, এই সত্যে আমি উপনীত হলাম, এটা কাজ করার মতো কোনো কিছুই সাসটেন করছে না। যেটা তুমি হয়তো মানবে, যে একজনই  ভালো ডকুমেন্টারি বানিয়ে যাচ্ছে, বা একটাই  দল ভালো নাটক করে যাচ্ছে—এটা হতে পারে না। একটা সামগ্রিক কাউন্টার কালচার তুমি যদি তৈরি না করতে পারো তাহলে হবে না।

আয়নানগর : ইন্টারেস্টিংলি, গত সপ্তাহে আমাদের পরিচিত এক শ্রমিক সংগঠকের সাথে কথা হচ্ছিলো। তাতে উনি যেটা বলছিলেন যে, উনি যেসব ওয়র্কারদের মধ্যে কাজ করেন , তারা কম খেয়েও একটা অ্যানড্রয়েড ফোন রাখছে। কারণ ওটার মধ্যে দিয়ে সে যা ফর্ম অফ এন্টারটেইনমেন্ট পায়—তার কাছে কখনো কখনো খাওয়াটাও গৌণ হয়ে পড়ে…

অঙ্কুর : হ্যাঁ, এই অবস্থায় সংস্কৃতি-ফংস্কৃতি বস্তাপচা বললেও বোধহয় কম বলা হয়। মানে, এই যে অ্যানড্রয়েড—একে কাউন্টার করতে গেলে এখন আমাদের যা লীগেসি, তা দিয়ে হবে না। বিশেষ করে সিপিএম ক্ষমতায় আসার পরে পীপলস থিয়েটার আর পলিটিকাল থিয়েটারের নামে প্রভূত ঢ্যামনামি নানাভাবে চলেছে—সেটা আমরা সবাই জানি। সেটার বাইরে দাঁড়িয়ে, যখনি কিছু করার কথা ভাবব, তখনই আবারও ওই যদির কথায় এসে পড়ছে। যতক্ষণ না একটা চারজন বা ছ’জনের দলকে আমি ছ’মাস ফ্লোট করাতে পারছি, কিচ্ছু বলার মতো জায়গায় আমরা নেই। সেই অর্থে এই ইন্টার্ভিউটা হওয়ারই কথা না, আমরা কোথাও পৌঁছতেই পারিনি। আমরা কিছু পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছি—হ্যাঁ, এইরকম একটা দল যারা এই বিশেষ ধরণের নাটক করছে। এর বেশি কিছু বলার মতো কোনো জায়গায় নেই আমরা।

একটা পয়েন্ট শুধু—‘মিস্টার ইন্ডিয়া’টা আমরা ‘বেচবার’ মতো জায়গা পৌঁছে গেছিলাম। ‘দৈনিক ভাস্কর’-এর প্রতিটা এডিশন আমাদের কভার করতে করতে যাচ্ছিলো—মহারাষ্ট্রতে। মহারাষ্ট্রে তো প্রত্যেকটা শহরে—ওদের রিজিয়নভিত্তিক আলাদা আলাদা এডিশন বেরোয়—তার প্রত্যেকটায় পাতা জোড়া সাপ্লিমেন্ট বেরোচ্ছিলো। আগের ট্রিপে ছত্তিশগড়ের বিলাসপুরে আমাদের তিন-চারজন গিয়ে রেডিওতে টক শো করে এসেছিলো। আজকে নাটক, কালকে ইন্টার্ভিউ। এবার আরেকটা সমস্যা—আমরা এতে খানিকটা বিপদের গন্ধ পেয়েছিলাম কারণ কালচারাল রেজিস্ট্যান্সের একটা নিজস্ব গ্ল্যামার আছে। যেটায় আমি কাউকে ঢুকতে দেবো না। এতে যদি বলো আমি অথরিটেরিয়ান হলাম, তো হলাম। বহু জায়গায় আমরা কিন্তু কাউকে নড়তে দিইনি অডিয়েন্সে পুরো নাটকে। মানে পারফরম্যান্সের জোরে। উনিশটা গ্রামে আর পনেরোটা শহরে আমরা পারফর্ম করেছি। তখন বিপদের গন্ধ পাচ্ছিলাম… প্রচারের বিপদ।  গ্ল্যামারের বিপদ। এবং যেহেতু আমরা যারা নাটক করছিলাম তাদের নব্বই শতাংশ পাতি বুর্জোয়া ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসি, বিপদ কিন্তু ছিলো। গ্ল্যামার আমাদের আকৃষ্ট করে। ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’য় ওই খেলাটা আমি ঢুকতে দিইনি। কারণ, ওতে করে গল্পটা আমাদের হাত থেকে বেরিয়ে যায় আর তারপরে আমাদের কিছু করার থাকে না।

আয়নানগর : হ্যাঁ এই গল্পটা তো ভয়ঙ্কর হতে পারে… আচ্ছা ধর থিয়েটার—বা অন্য যেকোনো আর্ট ফর্ম—এতোদিন কাজ করে তোদের কি মনে হয়? এটা কতোটা রোল প্লে করতে পারে? একটা সামাজিক পরিবর্তনের আন্দোলনের  ক্ষেত্রে…

বর্তিকা : এটা মাপা যায় না। তুমি যদি সত্যি একটা প্রসেসের মধ্যে ঢুকে যেতে পারো—যেভাবে আমরা আর্টকে দেখি… সেখানে এটা বিভিন্ন লেভেলে একটা রোল প্লে করে। নাটকের বিষয়টা আমরা কতোটা বুঝতে পারছি, বিভিন্ন ইমোশন কিভাবে ফিল করতে পারছি, রিসার্চ করছি—প্লাস, আমরা একটা টীমওয়র্ক করছি—নিজেদের একটা গ্রোথ, ডেভেলপমেন্ট—সেটা একটা বিষয়। আরেকটা লেভেল হচ্ছে, যেমন ধরো একটা গ্রামে গেছি, যেখানে উচ্ছেদ হয়েছে, বা হতে পারে—ওদের গল্পগুলো শুনছি। তো একদিকে আমরা শিখছি, আরেকদিকে আমরা ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি—ওরা আরও খানিকটা সাহস পাচ্ছে। ‘বিশ্বকর্মা’ নিয়ে যখন মজদুরদের কাছে যাচ্ছি, বা ‘মিস্টারইন্ডিয়া’ নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি, তো সেই কমিউনিটিগুলোর কাজের সাথে আমরা রয়েছি। সেখান থেকে ওরা একটা এনার্জি পায় ওদের নিজেদের স্ট্রাগলটা করার ক্ষেত্রে। সেটা আরেকটা লেভেল। আর থার্ডলি হলো—মিডল ক্লাস হোক, স্টুডেন্ট হোক, ওদের কাছে আমরা যখন যাচ্ছি, নাটকটা একটা অল্টারনেটিভ মিডিয়া হিসেবে কাজ করছে। ওরা হয়তো একটা দিক দেখেছে, এখানে আরেকটা দিক দেখতে পাচ্ছে। এই তিনটে লেভেলে মূলত পরিষ্কার করে বলতে পারি যে আমাদের থিয়েটার বা আর্ট একটা চেঞ্জের দিক দেখাতে পারে। এখন কতোটা কি হবে সেটা দেখা যাক।

আয়নানগর : আরেকটা কথা হচ্ছে প্রসেনিয়াম থিয়েটার কেন করবো না? প্রসেনিয়াম মানেই কি অচ্ছুৎ? রাস্তাতেই কেন করতে হবে? অনেকে যারা প্রসেনিয়াম করে তারা না হয় রাস্তায় করবে না, কারণ তারা মনে করে ওটা উঁচু জাতের আর রাস্তায় করাটা নীচু জাতের। কিন্তু আমি যখন করছি, আমার কাছে তো এসব নেই। আমি কেন ওটা করবো না? ধর কেউ আমার সাথে দেখা করতে এলো, সে যদি একটা কোনো দামী হোটেলে উঠেছে, আমায় সেখানে দেখা করতে যেতে বললে আমি বলি—না, তুমি এসো কফি হাউসে বা বুড়োদার দোকানে। কফির পয়সা আমিই দেবো। তারপর হয়তো আমি একদিন তোমার ওখানেও যেতে পারি। কিন্তু তার আগে আমি বুঝে নেবো যে তুমি এখানে আসো কিনা। তো এখানে কি সেইরকম একটা চিন্তার জায়গা আছে? যে আমি রাস্তায় থিয়েটার করি, কিন্তু আমি দরকার হলে ওখানেও করতে পারি।

অঙ্কুর : আমাদের কিন্তু ওই অচ্ছুতের ব্যাপার নেই।

বর্তিকা : বিলাসপুরে আমরা যে শো করেছি…

অঙ্কুর : নাসিকেও…

বর্তিকা : সেখানে ওরকম ভাবেই করছি। আমাদের ওটা নেই।

অঙ্কুর : হ্যাঁ, তবে প্রসেনিয়াম নিয়ে আমার বা আমাদের যে ব্যক্তিগত এবং দলগত আপত্তির জায়গা—প্রসেনিয়াম মানেই একশ টাকা মিনিমাম টিকিট। এটা না আমার জিজ্ঞাস্য, জানো, আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এমনকি ‘নবান্ন’-ও তো প্রসেনিয়াম। শো সবমিলিয়ে কটা হয়েছিল? পনের-কুড়িটার বেশি কী? জানি না। আমাদের না আইপিটিএ ব্যাপারটা একটা মিথের পর্যায়ে চলে গেছে।

আয়নানগর : হ্যাঁ, এবং যত আমরা বলি হাজার হাজার মানুষ আসত—এগুলো খুব… মানে একটা লেভেল অফ মোবিলাইজেশন সোসাইটিতে ছিলো, প্রচুর মানুষ ইনভল্ভড হয়েওছিল। কিন্তু তুই যদি সত্যি দেখতে যাস এতে কতো মানুষ সত্যি পলিটিসাইজড হয়েছিলো, সেটা নিয়ে… তারপরে এর উল্টোদিকও তো আছে। ধর একটা লোক জমায়েত—সেখানে একটা নাটক করে দিলো। আরে ভাই নাটকের জন্য তো হয়নি লোক জমায়েত। সেখানে এরা বলে দিলো আইপিটিএ-র কি বিশাল মুভমেন্ট—এতো মানুষ নাটক দেখছে।

অঙ্কুর : একটাই পয়েন্ট তোমায় রেকর্ড করতে বলি—এটা পার্থ বলবে—এই যে আমাদের লীগেসি, বাংলা থিয়েটার বললেই আমরা আইপিটিএ বা ‘নবান্ন’-র কোলে ঢলে পড়ি, এর বিপরীতে আমরা দেখতে পাই না প্রচুর এরকম না বলা ঘটনা ছিলো। ‘নবান্ন’ তো আমাদের কাছে ক্লাসিক।

আয়নানগর : আর ‘নবান্ন’-র পলিটিক্সটাও তো খুবই রিফর্মিস্ট পলিটিক্স।

অঙ্কুর : এখন ‘নবান্ন’ ছাড়া… ‘নবান্ন’ আমার মতে আইপিটিএ-র সলমন খান আর কি… তো সেটা নিয়ে রিসার্চ তো অনেক হয়েছে। কিন্তু আমি নিজে জানতাম না—পার্থর কাছ থেকে শুনেছিলাম, বল নিত্যানন্দ চৌধুরীর কথাটা। তাহলে তোমরা বুঝতে পারবে, যে লীগেসিটা আমাদের কতোটা এক্সটেন্ড করতে হবে, কতোটা রিসার্চের প্রয়োজন।

পার্থ : হয়েছিলো কি, বজবজে জুটমিলে যখন ফার্স্ট মুভমেন্টটা গড়ে ওঠে…

অঙ্কুর : লেট টোয়েন্টিজ?

পার্থ : বা তারও আগে, কারণ উনিশশো কুড়িতে তো কংগ্রেস সেবাদল সেইসময় মীটিং করছে, বজবজ জুটমিলের শ্রমিকরা সেখানে এসে বিক্ষোভ দেখিয়েছে, আর নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের নেতৃত্বে সেবাদল তাদের পিটিয়েছে—এসব হয়েছে। আমি এই ঘটনাটা টুকটাক জানতাম। আমার বাড়িতে কোথাও একটা আছে ডকুমেন্টটা। তো সেই ডকুমেন্টে একটা নাম পাই, নিত্যানন্দ চৌধুরী। বাংলাদেশের ওই বরিশালের দিকে বোধহয় কোথাও একটা হেডমাস্টার ছিলেন। তারপরে অনুশীলন সমিতি, বেদান্ত সমিতি—এদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যে অস্ত্র কোত্থেকে আসবে, এইসবে ওখান থেকে বেশ কিছু লোক বেরিয়ে  চলে এসেছিলেন। একজন হচ্ছেন অনুরূপ চন্দ্র সেন আর আরেকজন হচ্ছেন এই নিত্যানন্দ চৌধুরী। অনুরূপ চন্দ্র সেনের নামে প্রচুর কিছু আছে, কিন্তু নিত্যানন্দ চৌধুরীর নামটা কোথাও ডকুমেন্টেড হয়নি। আমি পড়ছিলাম, নিত্যানন্দ চৌধুরী বজবজ জুটমিলের সামনে দাঁড়িয়ে—ওই উনিশশো কুড়ির আগে কোনো একটা সময় পায়ে ঘুঙুর বেঁধে জুটমিলের গেটে ঘুরে ঘুরে নাচছেন। এইটা কিন্তু কোথাও আইপিটিএ বা কোনো ডকুমেন্টে, আমি যা দেখেছি, কোথাও আসেনি। এটা আমার খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিলো। পরবর্তী কালে দেখি দক্ষিন চব্বিশ পরগনাতে উনি একজন নেতা হিসাবেই পরিচিত হন। যেমন শ্রী পলাশ প্রামাণিকের লেখা ‘তেভাগা আন্দোলন ও যতীশ রায়’ বইতে উল্লেখ আছে। আর সরোজ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা (২য় খন্ড)’-তে ১৯৪৩-র সেপ্টেম্বরে পিপিলস রিলিফ কমিটির অধীনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় রিলিফ কর্মীরা নিত্যানন্দ চৌধুরীর নেতৃত্বে কাজ করেছিলেন তার উল্লেখ আছে। নিত্যানন্দ চৌধুরী নামটির আরেকবার উল্লেখ আছে বর্তিকা (মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত) জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৩ সংখ্যায় আর জ্যোতি বসুর স্মৃতি কথায়। কিন্তু এসব জায়গাতে তার পরিচিতি নেতা ও সংগঠক রূপে। একমাত্র গনকবিয়াল গুরুদাস পালের স্মৃতিচারণে তাঁকে সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে পাই। আবার গুরুদাস পালের কথাই বা আমরা কজন জানি? তো এই যে, ধরো, এখন যখন আমাদের এইসব কথা হচ্ছে—এই যে ফিলারের রাজনীতি—নিত্যানন্দ চৌধুরীর কাজটা কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো ফিলারের কাজ ছিলো না।

অঙ্কুর : মানে একজন হেডমাস্টার পায়ে ঘুঙুর বেঁধে এটা করছেন—এটা আমার কাছে খুব ইম্পরট্যান্ট ঘটনা। লীগেসি খুঁজতে হলে আমায় ওইখানটায় যেতে হবে। শুধু ‘নবান্ন’তে হ্যাজানো চলবে না, হ্যাজানোটা অনেক হয়েছে। আমিও তো অনেক কিছু ডকুমেন্ট পড়েছি, কিন্তু এটা কোথাও দেখিনি। পার্থ কোন একটা লীফলেট না প্যাম্ফলেটের একটা অংশে এটা খুঁজে পায়।

পার্থ : এবং নিত্যানন্দ চৌধুরীর লীগেসিটা পরে গুরুদাস পাল মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে কিছুটা বহন করতেন। আমার ওনার সাথে আলাপ নেই, কিন্তু টুকরোটাকরা কাজ দেখে আমার তাই মনে হয়েছে। ব্যাপার হচ্ছে গুরুদাস পালকেও কেউ গ্রাহ্য করে না।

আয়নানগর : এটা আরেকটু খোঁজ খবর বার করে লেখ না। অল্প কিছুটা হলেও… লেফট পলিটিক্সটার যখন মেইনস্ট্রীমিং হয়, সেও তো তার মতো ইতিহাস বানায়। সে তখন তার ঘরানার লোকেদের কথাই বলেছে খালি।

অঙ্কুর : হ্যাঁ কিছু মানুষকে পিক করে নিয়েছে।

আয়নানগর : যে ইনকনভিনিয়েন্ট, তাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় এবং হয়েছে।

অঙ্কুর : এটা উনিশশো কুড়ি থেকেই শুরু হয়েছে।

প্রমোদ : আর একটা জিনিস আমি তোদের তিনজনকেই বলছি—আজকের জন্যে না, কিন্তু পরে কখনো—তোরা তো এতো শো করেছিস। কিছু তো একটা রেকর্ড থাকবে যে কিছু কিছু মানুষ কিভাবে এই থিয়েটার করার মধ্যে দিয়ে বদলালো। একটা-দুটো উদাহরণ—যেটা তোদেরও ইন্সপায়ার করে কাজটা করে যেতে—এইটার একটা ডকুমেন্টেশন শুরু করা প্রয়োজন।

বর্তিকা : আমরা বদলেছি কিনা সেটাও দেখতে হবে [হাসি]।

অঙ্কুর : ‘ভিভা লা মেক্সিকো’ ছবিটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অবশ্য হলিউডি ছবি, তাই রেফারেন্স কতটা গ্রাহ্য হবে জানি না। মার্লন ব্র্যান্ডো আন্দোলনের নেতা। কিন্তু তার অন্যতম কমরেড অ্যান্টনি কুইন যখন সহ-আন্দোলনকারীর স্ত্রীকে সেক্সচুয়ালি এক্সপ্লয়েট করে ব্র্যান্ডো তখন ধর্মসঙ্কটের মুখোমুখি।

তো, এই বদল খোঁজার একটা বিপদ আছে। সেটা হচ্ছে, একটি ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে বদল হচ্ছে কি হচ্ছে না… বদল তো হবেই, কোথাও তো কিছু  একটা যায় বটেই—এটা তো থিওরেটিকাল সত্যি। কিন্তু এটাকে কংক্রিটলি দেখার মধ্যে যে বিপদ সেটা আমি তোমায় সাম্প্রতিকতম একটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে বলছি। আমাদের ছোটদের টীমে যে ছেলেটাকে আমরা ভাবতাম স্কিল, কমিটমেন্টের দিক থেকে অনেকটা এগিয়ে, তার বিষয়টা একটা মেজর প্রশ্নের মুখে এসে পড়েছি আমরা।

এই বয়েসের ছেলেরা বিড়ি-সিগ্রেট খায়, গাঁজা অব্দি খায়—সেটা নিয়ে আমাদের খুব কিছু করার ছিলো না। কিন্তু যখন পার্থ এসে আমাকে এই ইনফরমেশনটা দেয়, যে ওই ছেলেটি ডেনড্রাইটও নিচ্ছিলো, এবার অনেস্টলি বলছি, তুমি যদি আমায় এখনো জিজ্ঞেস করো, এই ইনফরমেশনটা আমার কাছে জলের উপর তেল ভাসার মতো। আমি যখন বলছি এটা—আমার একটা নাম্বনেস চলে আসছে। এখনও অবধি আমি হজম করতে পারিনি। ওকে চিনি ২০১০ থেকে, কাজ করছি ২০১২ থেকে। অত্যন্ত পোটেন্ট একটি ছেলে—সব অর্থে। মেমারি সাঙ্ঘাতিক, অভিনয় খুব ভালো, দারুণ ওয়র্কার এবং অসম্ভব একটা গরীব পরিবার থেকে আসা। বাবা নেই, মা মানসিকভাবে অসুস্থ, ভাঙ্গড়ে একজনের বাড়িতে থাকেন। তো এই অবস্থায়, আমি এখনো এই ইনফরমেশনটাকে থিওরাইজ করতে পারিনি। আমি এটাকে দূরে রেখেছি। তো সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এখন বলাটা… ওকে যে সাপোর্টটা দেওয়ার দরকার ছিলো, সেটা একমাত্র হতে পারতো, যদি আমরা উল্টোদিকে একটা স্কুল বা হস্টেল তৈরি করি। এছাড়া কোনো উপায় নেই ওখান থেকে ওকে বার করার। এরকম আরও বহু ছেলেমেয়ে রয়েছে। মহিরামপুরের হস্টেলে  এরকম বহু ছেলেমেয়ে রয়েছে। হস্টেলটা ধান্দাবাজ লোকজন চালায়। এরকমও আছে, যাদের বাবা-মারা ‘পাড়া করতে’, অর্থাৎ ভিক্ষে করতে বেরোয়। এটা একটা রিয়েলিটি। এইখানে একটা থিয়েটার পেডাগোজি কি হবে, এটা একটা বড়ো সমস্যা। যেটার ওই স্কীম রয়েছে, ফান্ডিং কিছু আছে, সেটা একটা বেরিয়ে যাবে। ‘আর্ট ইজ এ থেরাপি’—এটা কেউ বললেই আমার মনে হয় আমি তাকে একটা কিছু ছুঁড়ে মারি। আর্ট ইস থেরাপিউটিক বাই ডিফল্ট। কিন্তু ‘আর্ট অ্যাজ এ থেরাপি’—এটা আমার কাছে একটা বড় ঢপ বলে মনে হয়, বিপজ্জনক মনে হয়।

পার্থ : যা বা যাদের নিয়ে আমরা কাজ করছি, তাই দিয়ে শেষ অব্দি একটা পিএইচডির থিসিস হচ্ছে, বা সেটা দিয়ে আমি কোথাও একটা যাচ্ছি, এটা না হওয়াই ভালো।

অঙ্কুর : এটা ভীষণ পোস্ট-মর্ডানিস্ট শোনাচ্ছে, কিন্তু আমি একেবারেই পোস্ট-মর্ডানিস্ট নই—হয়তো কাউন্টার সোশালিস্টও শোনাচ্ছে কথাটা… কিন্তু সত্যি এটাই বলার চেষ্টা করছি।

–প্রথম পর্ব সমাপ্ত–

দ্বিতীয় পর্ব

আয়নানগর : যেখানে আগের আড্ডাটা শেষ হলো, তারপর তো থিয়েটার নিয়ে অনেকগুলো এক্সপেরিমেন্ট চলেছে, অনেকগুলো কাজ হয়েছে, খুব ইম্পর্টেন্ট কাজ হয়েছে বলেই আমরা জানি। বিশেষ করে গুরগাঁওতে ওয়ার্কিং ক্লাস বেল্টে গিয়ে কাজ করার যে অভিজ্ঞতা, সেটা যদি একটু বলিস।

অঙ্কুর : তথ্যের আকারে বলা যায়, শ্রমিক এবং যুব সংগঠন মিলিয়ে কলকাতায় যে ‘ওলটপালট’ নামে একটা নাটকের দল ফ্লোট করা গিয়েছিল, তারা অগাস্ট ২০১৫ থেকে ডিসেম্বর ২০১৫ অবধি পশ্চিমবঙ্গের নানান জায়গায় ‘বিশ্বকর্মা’-র ২৬টা শো করে উঠতে পারে। দুই, হরিয়ানার গুরগাঁও-এর যে শ্রমিক সংগঠন তারা যখন ‘বিশ্বকর্মা’ করলো তারা জুলাই ২০১৫ থেকে মোটামুটি বলা যেতে পারে মার্চ ২০১৬ অবধি প্রায় ৩৬টা শো করে উঠেছে দিল্লির এনসিআর এলাকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টে। তাছাড়া দিল্লির কনাট প্লেসের পাশে শো হয়েছে। এছাড়া গাজিয়াবাদে শো হয়েছে, জয়পুরে ওরা কিছু শো করেছে। মোটামুটি বলা যেতে পারে হরিয়ানা, রাজস্থান, দিল্লি, দিল্লির লাগোয়া উত্তরপ্রদেশ যেমন নয়ডা, গাজিয়াবাদ সেখানে ওরা বেশ কিছু শো করেছে।

৩৬টা শো-এর পর গুরগাঁও-এর টিমটা একটু বদলাতে হয়েছিল। পুরনো যারা ছিল তাদের সবাই আর কন্টিনিউ করতে পারেনি। তাই একটা নতুন নাটক ভাবা হয়, ‘সুলতান’। সলমন খানের ‘সুলতান’ সিনেমাটা জুলাই-এর ছ’ তারিখ রিলিজ করেছিল,আর এই নাটকটার প্রথম শো হয় ৩০ জুলাই। তার মধ্যে আমরা ‘সুলতান’-টা দেখে, নাটক লিখ্‌ ওখানে গিয়ে রিহার্সাল করিয়ে সাড়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে ওদের-কে দিয়ে নাটকটি মঞ্চস্থ করাই। ঐ ‘সুলতান’-এর সাথে এই ‘সুলতান’-এর কি যোগ তা এই নাটকটা দেখলে বোঝা যাবে। তবে অবশ্যই একটা যোগ তো আছেই।

এই পপুলার আর্ট বিষয়টাকে কিভাবে আমরা দেখছি, তার একটা বিস্তারিত আলোচনা গতবার হয়েছিল, মনে আছে? তো, আমাদের কাছে এটা একটা বড় জায়গা যে, ওয়ার্কারদের মধ্যে আমাদের কাজটা যেন কখনো স্পুফ না হয়ে ওঠে। এবং, সেই প্রক্রিয়ার ফলেই কুড়ি মিনিটের নাটক “সুলতান”। তার মূল জায়গাটা কি? একজন ওয়ার্কার, যার নামও সুলতান, সে সলমনের ছবিটি দেখেছে। যে ছবিতে একজন কুস্তিগীর সোনার মেডেল এনেছে। তো, সেই মজদুর সুলতানকে দেখছে এবং তার পাশাপাশি নিজেকে দেখছে। ভাবছে কত ফালতু সে—একটা প্রমোশনও পেতে পারে না। এবং অবধারিতভাবে মাল খেতে শুরু করছে। এখন থেকে নাটকটা শুরু হচ্ছে। তো, আমি যখন “সুলতান” লিখছি, আমি ওখানকার একজন মজদুরের কথা ভেবে লিখছি। কোনো মধ্যবিত্ত  রাজনৈতিক কর্মীর কথা ভেবে লিখছি না।

এবং, এখানে কিন্তু আমি একভাবে হকারবৃত্তির দিকে হাঁটছি—নাটকের হকারবৃত্তি। আমি যেভাবে একজন শ্রমিকের কাছ থেকে আয়না বা চিরুনি বেচতে যাই, সেভাবেই নাটক ফেরি করতে যাচ্ছি। আমি তো নিজেকে আর্টিস্ট বলিই না। নৈব নৈব চ। অর্থাৎ, আমাকেও এখানে প্রচুর পরিমানে আন-লার্ন করতে হচ্ছে। আমি আর ওই ক্লাসিকাল বামপন্থী পলিটিকাল আর্টের মধ্যে থাকতে পারছি না। আমাকে ক্রমাগত নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে হচ্ছে। আমি এখন আর কালচারাল এক্টিভিস্ট এবং পলিটিকাল এক্টিভিস্ট এই বিভাজনের মধ্যে দিয়েও আর ব্যাপারটাকে দেখছি না।

তো, সেই ‘সুলতান’-এর শো ওরা ২৩টা করে উঠতে পেরেছে। শ্রমিকরা নাটক করছেন। গত ১৫ কি ১৬ মাসে, অর্থাৎ প্রায় দেড় বছরে, ওরা দুটো নাটক মিলিয়ে ৫৯টা শো করতে পেরেছে। এটা ঘটছে।

বর্তিকা : প্রথমে হরিয়ানার টিমে জয়পুরের কিছু ছেলে ছিল, পরে দেখা গেলো যে জয়পুর আর হরিয়ানা এই দুটো কোঅর্ডিনেট করতে গিয়ে শো-টা ঝাড় খাচ্ছিল, ওরা করতে পারছিল না। সে কারণে জয়পুরে একটা আলাদা দল হবে সেটা ঠিক করা হলো। ২০১৫-এর নভেম্বরে জয়পুরে পাঁচজনকে নিয়ে প্রথমে ‘হাঙ্গামা নাটক দল’ নামে আরেকটা নতুন দল তৈরি হলো। এখন এটাতে চারজন আছে। ওদের এখন একটা নতুন নাটক তোলানো হয়েছে ‘শহর মে আয়া তেন্ডুয়া’। জয়পুরে স্মার্ট সিটি নিয়ে গত বছর নভেম্বরে যখন নাটক হচ্ছিল, একই সময়ে তখন  রাজস্থানে লগ্নি টানার জন্য কনফারেন্স বড় করে হচ্ছে – ‘রিসার্জেন্ট রাজস্থান’। ওখানকার নাটকটা গোটা একটা কাউন্টার প্রচেষ্টার মত করে ভাবা হয়েছিল। স্মার্ট সিটি মানে কি, রিসার্জিং রাজস্থান মানে কি, কার জন্যে—এই সব নিয়ে একটা কুড়ি মিনিটের নাটক। এক বছরে ওরা এটার ৫০টা শো করে ফেলেছে। আর কোনও দল আমাদের কোনো নাটকের ৫০-টা শো করতে পারেনি। স্বভাব নিজেও পারেনি। হিন্দি-বাংলা ধরলে ‘বিশ্বকর্মা’ নাটকটা তিনটে দল মিলিয়ে মোট ৭৫-টা শো করেছে। কাজেই, একটি দলই একটি নির্দিষ্ট নাটকের ৫০টা শো করছে, সেটা এই প্রথম ‘হাঙ্গামা নাটক দল’ করে উঠতে পেরেছে। আর এটা ইন্টারেস্টিং যে ওদের একটা-দুটো শো ছাড়া কোনও শো-টাই অর্গানাইজড্ শো নয়। এমনটা নয় যে কেউ ডেকেছে শো করার জন্য বা কোথাও একটা প্রোগ্রামের অংশ নিয়েছে। এরকম দু-তিনটে হয়েছে।

শহর মে আয়া তেন্ডুয়া

আয়নানগর : ‘হাঙ্গামা নাটক দল’-এর কুশীলবরা কোন শ্রেণী থেকে এসেছে?

বর্তিকা : এরা বেসিকালি স্টুডেন্ট। বেশিরভাগই রাজস্থানের বিভিন্ন গ্রামের। জয়পুরে এসেছে সাধারণত পড়াশোনা করতেই। তারপর অন্য ধরনের কাজকর্মে ঢুকে গেছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝোঁক আছে। ওদের কেউ কেউ সাফাই মজদুরদের বস্তিতে গিয়ে বাচ্চাদের পড়ায়।

আর একটা যে নতুন জিনিস এর মধ্যে হয়েছে। উল্টোডাঙ্গার বাসন্তী কলোনি বস্তিটা পর পর তিন বার পুড়ে যায়। ঐ বস্তিতেই আমাদের বন্ধুরা ‘অন্য আকাশ’ নাম দিয়ে বাচ্চাদের একটা পড়াশুনো করার স্পেস তৈরি করে। গত দু-আড়াই বছর ধরে ওখানকার মহিলাদেরও পড়াশোনা শেখানোর ব্যবস্থা করেন। এর মধ্যে ওদের সাথে আমাদের আলাপ হয়। ঐ মহিলারা বেশিরভাগ লোকের বাড়ি কাজ করেন। বাসন্তী কলোনিতে ‘স্বভাব’-এর করানো দু-টো নাটকের শো প্রথম শো হয়। ‘বিশ্বকর্মা’ আর ‘চীনা ৪২০’। ‘দৃশ্যান্তর’ বলে একটা নাটকের দলকে আমরা ২০১৫-র জানুয়ারি মাসে ‘চীনা ৪২০’ তুলিয়ে দিই। এর মধ্যে এটাও আমাদের একটা কাজ। এক ঘণ্টার নাটক। গত এক বছরে ‘চীনা ৪২০’-র গোটা ১২ শো হয়েছে। যেটা বলছিলাম, আগে থেকেই নাটকের বিষয়ে একটা কাজ বাসন্তী কলোনিতে চলছিল, কিন্তু ‘চীনা ৪২০’ হওয়ার পর আরও দু-তিনজন মহিলা আগ্রহী হয়ে জানায় যে ওরাও নাটক করতে চান। তখন আমিও ঢুকি ওখানে। অনেক মহিলাদের সাথে আমার আলাপ হলো। ওদের এই মহিলাদের দলটাকে দাঁড় করানো যাবে কি না সেটা দেখার জন্য আমি সপ্তাহে একদিন করে দেড়-দু মাস ধরে ওখানে ওয়র্কশপ নিতে যেতাম। ন-জনের মত ছিল যাঁরা এই ব্যাপারটাতে থাকতে চান। এই ন-জন মহিলার মধ্যে দু-জন বাদ দিলে বাকিরা লোকেদের বাড়ি কাজ করে। অনেকের ছোট বাচ্চা আছে। দু-তিনজন তাদের মধ্যে একটু বয়স্ক। পঞ্চাশের ওপর বয়স। যাইহোক, ওরা আগ্রহী হলো, জিনিসটাও দাঁড়াল। ‘আমার কোন বন্ধু নেই’ বলে একটা ছোট নাটক করলো। গোটা-টা ওদের জীবনের গল্প নিয়েই তৈরি করা হয়েছে। ওয়র্কশপ চলাকালীন ওদের জীবনের গল্পগুলো বার করা হলো, তারপর সে সব জুড়েটুড়ে এটা করা হলো। ২০১৬-র মার্চে প্রথম শো-টা হয়। এখনও নাটক দলটা আছে। আটজনের দল। ৭টা শো বিভিন্ন জায়গায় এখনো অবধি করেছে। দেখা যাক এটা কোন জায়গায় যায়।

শহর মে আয়া তেন্ডুয়া

পার্থ : তারপরে বাচ্চাদের নিয়ে কাজ হয়েছে ‘মোদের কোন দেশ নাই’। ২০১৫-র ডিসেম্বরে এটার ক্যাম্প হয়। এটার ৯-টা শো হয়। আমাদের ধারণা ছিল, ফলতায় পুরনো যে ‘ঈদের চাঁদে’র টীমটা থেকেই ছেলেগুলো উঠে আসবে। তাদের মধ্যে একজন বাদে বাকিরা অদ্ভুতভাবে করতে রাজি হয় না। একজন ছাড়া কেউ সরাসরি এ ব্যাপারে আমাদের ফেস করেনি। নতুন ছেলেদের নিয়ে ‘মোদের কোন দেশ নাই’ করা হয়। ডিসেম্বরে ওয়ার্কশপ হয়, তারপর এখানে দুটো শো হলো, দুটো শোয়ের পর ওরা বাড়ি চলে যায়। এরপর গত বছর জানুয়ারি মাস থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে একটি ছাপা সিডিউল ওদের বাবা-মাদের দিয়ে দেওয়া হবে এবং  কথা বলে নেওয়া হবে যে শো করতে ছেলেপিলেদের এত দিনের জন্য ছাড়তে হবে। এতে করে কলকাতা ছাড়াও বীরভুম আর হাওড়া মিলিয়ে ৯-টা শো হয়।

‘মোদের কোন দেশ নাই’ নাটকের বিষয়টা হচ্ছে বিশ্বজোড়া রিফিউজি-সমস্যা। রিফিউজি-সমস্যা ছোটদের কিভাবে আঘাত করে, ওয়ার্কশপের সময়ে সেটা নিয়ে একটা নাটক তৈরি হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যে বাচ্চাদের নিয়ে আমরা কাজ করি সেখানে তাদের কাছে খবরের কাগজ-টাই একটা অপরিচিত বস্তু। এবার কি রিফিউজি-সমস্যা, কোথায় কোন দেশ, আমাদের দেশের গণ্ডী কি, দেশ বলতে কি বোঝায় এগুলো সম্বন্ধে কারোর কোন ধারণাই নেই। ফলে ওদেরকে নিয়ে নাটক শুরুর আগে এগুলো জানাতে প্রায় ৮-৯-টা ক্লাস হয়েছিল। সেই ক্লাসগুলোর মধ্য দিয়ে গোটা বিষয়টা পরিচিত করানো হয়। নানান ধরনের ছবি দেখিয়ে, নানান রকম গল্প করে, নানান রকমের কথার খেলার মধ্য দিয়ে, ছোট ফিল্ম দেখিয়ে ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পরিচিত করা হয়। যাইহোক, এরপর এটার ৯-টা শো হয়। আমাদের জায়গা থেকে একটা আশা ছিল এবং বাচ্চারাও উপভোগ করেছিল।

যদিও সেখানে একটা সমস্যা ছিল। সমস্যাটা হলো এরপর বাচ্চারা আর কত দিন টানতে পারবে। আগে যাদের সাথে কাজ করে ছিলাম তারা সবাই হচ্ছে হস্টেলের বাচ্চা, হস্টেলের বাচ্চা বলতে এদের ওপর পড়াশোনার চাপ ছিল না। আর এবারের টিমে ছ’জনের মধ্যে দু’জন বাদ দিয়ে বাকি চারজন বাড়ি থেকে আসছে। এই চারজনের মধ্যে একজন পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো। ফলে আমাদের নিজেদের মধ্যেও একটা চাপা টেনশনও ছিল, সেটা হলো বাড়ি থেকে সত্যি সত্যি ছাড়বে কি না। যাইহোক,এই ৯-টা শো-এর পর তারা জানায় যে না এর পর পড়াশোনা শুরু হয়ে যাবে, ওরা আর শো করবে না। এই বোঝাপড়ায় গোটাটা দাঁড়িয়ে যায়, যে ওরা শো করবে, কিন্তু সেটা পরে জানাবে।

আগে যে হস্টেলটা ঘিরে কাজটা হচ্ছিল, সেখানকার কিছু সমস্যা ছিল। সেই থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিই হস্টেল-কেন্দ্রিক ভাবে আর আমরা কাজটা করবো না। চেষ্টা করি গ্রামের দিকে সরে গিয়ে কাজটা করতে। আগের দুটো বছরে একটা গ্রামের মধ্যে কাজ হয়ে ছিল। সেখানে সরাসরি অঙ্কুর ঐ ব্যাপারটায় ছিল না, কিন্তু ওরই পরিচিত দুটি ছেলে কলকাতা থেকে গিয়ে দুটো আলাদা খেপে নাটক করায়। দু-বছর পর পর একটা শিশু মেলা হয়  ওখানে। সেখানেও দেখা গেলো গ্রামের লোকে ব্যাপারটায় মজা নিচ্ছে কিন্তু কোথাও তাদের ইনভল্ভমেন্ট নেই কোন বিষয়েই।

এতদিন গ্রামের যে অংশে কাজ করা হচ্ছিল সে অংশটা নিম্নবর্গের, কিন্তু তাদের প্রত্যেকের কিছু না হোক বাস্তু ভিটেটা আছে। বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকেই সেই বাস্তুভিটে আছে। কারো কারো জমিও আছে। ওই গ্রামেরই আরেকটা অংশে একটা সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যাটা হলো ওখানে মদ খাওয়াটা খুব বেড়ে গিয়েছিল। কেউ একজন গ্রামের আইসিবিএস স্কুলের পাশে হোম ডেলিভারি মদের সিস্টেম শুরু করে। আমি যেহেতু যাওয়াআসা করি, আমাকে ওরা ধরেছিল কি করা যায় সে ব্যাপারে। প্রথম বেশ কয়েকদিন আমি ওদের ঘুরিয়েও ছিলাম। আমি জানি না, যা পারো করো। তারপর আমি বলে দিই প্রসেসগুলো কী হবে। যে এই প্রসেসে এগোলে হয়তো কিছু হতে পারে। সেই ভাবে ওরা এগোয় এবং মদের ঠেকটা তুলে দেয়। এপ্রিলের গোড়ার দিকে ওদের ওখানে কালি পুজো হয়। এটা চৈত্রের কালি পুজো। ওরা বলে চৈত্রের কালি পুজোয় একটা নাটক করতে হবে। আমি দেখলাম গ্রামের আগের অংশের মানুষের কোনও ইনভল্ভমেন্ট নেই, আর এই অংশের মানুষ নিজে থেকে বলছে নাটকটা করতে হবে। ভাবলাম, তাহলে একটা চেষ্টা করে দেখা যাক।

এখানে বাচ্চারা দেখি খুব তাড়াতাড়ি কাজে যুক্ত হয়ে যায়। তখন আমার মাথায় ঢুকেছে যে হস্টেলের ওখানে কাজের ক্ষেত্রে এক রকমের সুবিধা ও অসুবিধা। এখানে কাজের ক্ষেত্রে আর এক রকমের সুবিধা ও অসুবিধা। আসলে গোটা ব্যাপারটা যদি ধরা যায় আলাদা আলাদা বিষয় হিসেবে, দেখা যাবে একটা লিঙ্ক রয়েছে। কাজটাকে সাসটেন করাতে হলে, যে কাজটা করছে তাকে আর্থিকভাবে সাসটেন করতে হবে। সেই কাজের মধ্য দিয়ে সে ভবিষ্যতে দেখতে পাবে যে কোথাও সে সাসটেন করতে পারছে।

আমি প্রথম দিকে একটু জোর করে ওদের ওখানে ‘ঈদের চাঁদ’ নাটকের রিহার্সাল শুরু করি। ওদের মধ্যে দুটো ছেলে যারা মদবিরোধী আন্দোলনে পুরোভাগে ছিল তারা বললো তারা প্রথমে থাকবে। ছিলও, কিন্তু আস্তে আস্তে তারাও অন্যান্য কাজে জড়িয়ে গেলো। যাইহোক, ওয়র্কশপ করে ওদের চৈত্রের কালি পূজোয় দুটো শো হয়। শো হওয়ার আগে বর্তিকা গিয়ে একদিন গোটাটাকে ঝালিয়ে দেয়। সেখানে এরকম অবস্থা হয়েছিল যে কে শো করবে আর কে শো করবে না আগের দিন পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। বর্তিকা যে দিন গেছে সেদিন আমি প্রচণ্ড রেগে গেছিলাম। বর্তিকাও অবাক হয়ে গেছিল। আমি বলি লোককে অত তেলিয়ে লাভ নেই, এখানে নাটক করতে হবে না, আমরা সবাই বাড়ি চলে যাই। শেষ পর্যন্ত শো হলো। এরপর কিছু ছেলে করবে-করবে না করছিলো। সে কারণে দলটাকে একবার ঝাড়াই-বাছাই করে আর একটা দল দাঁড় করানও হলো। নতুন দলটা চারটে শো করলো। এর মাঝখানে আবার একটা সমস্যা হলো…

কিন্তু এর মধ্যে থেকে আমাদেরও কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন আমরা যে অবস্থায় আছি, আমরা চাইলে ডিসেম্বরের শেষে গত বছরের মত একটা ক্যাম্প করে একটা নাটকের ওয়ার্কশপ করে তার হয়ত সাতটা বা আটটা শো করিয়ে দিতে পারি।

কিন্তু এরকম ভাবে কত দিন চলবে? বাচ্চাগুলোরই বা ভবিষ্যৎ কি? আমাদের বুদ্ধির চর্চা-টর্চা যা যা হচ্ছে বা হয় সেগুলো সব হয়ে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাচ্চাগুলো কোথায় যাবে, কি করবে? এটা নিয়ে আমাদের তিন জনের মধ্যে কথা হয়েছে।এখনও পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত নই যে এর পর আমরা কি করবো। আর ওরকমভাবে নাটকের ক্যাম্প হবে কি না, সেটাও জানা নেই। সম্ভাবনা এটাই যে ঐ ভাবে নাটকের ক্যাম্প আর হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত বাচ্চাদের চাওয়া-পাওয়ার জায়গাটা না বোঝা যাচ্ছে, ততক্ষণ হবে না। দু-জনের কাছ থেকে প্রস্তাব আছে যে তোমরা সারা বছর নাটক করবে তো নিয়ে নাও আমাদের বাচ্চাটাকে। সেটাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এখন যদি কেউ চারটে বাচ্চা দিয়েও দেয়, তাহলেও সারা বছর সেই দলটা নিয়ে নাটক করতে পারবো না। তাদের মনে হয় বাচ্চারা স্যারের সাথে থাকলে ভালো থাকবে। যে দু-জন বাচ্চাদের দিতে চায়, তারা ভয়ঙ্কর গরীব।

অঙ্কুর : ধরা যাক, আমরা একটা বাচ্চাদের দল তৈরী করলাম, যারা একটা নাটক করবে, থিয়েটারকে কেন্দ্র করে আমরা এমন একটা জায়গা তৈরি করবো, যেখানে বাচ্চাদের মাসে অন্তত সাত দিন পাওয়া যাবে, স্কুল যেমন করছে করবে, কিন্তু সাত দিন পাওয়া যাবে। তারা সাত দিনই এক জায়গায় জড়ো হবে পাঁচ-ছটা শো করে আবার ফিরে যাবে। এরকম বছরে যদি পঞ্চাশটা শো করি তাহলেও দুটো প্রশ্ন খুব জোরদার উঠে আসে। এক, তারা শো-টা করবে কোথায়? আমরা নিজেরা যে কোনও একটা নাটক নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়তে পারি। কিন্তু সেটা বাসন্তী কলোনিতে যে দলটা দাঁড়িয়ে আছে বা ফলতায় যে ছোটোদের দল, তাদের পক্ষে রাস্তায় উৎসাহ-হীন একটা শুকনো জায়গায় নাটক করা সম্ভব নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে, একটা উদ্যোগ যদি আমরা নিয়ে ফেলি তা ধারণ করার মত জায়গায় বাংলার প্রগতিশীল সমাজ আছে কি না? এটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আজকে। কোনও ফান্ডিং না নিয়ে অর্থাৎ কোনও এনজিও-র ধামা না ধরে, রাষ্ট্রের ধামা না ধরে, কর্পোরেটের ধামা না ধরে একটা দল যে বাঁচবে কি করে, আমার জানা নেই। বাংলা বাজারে কোনও অল্টারনেটিভ নাটকের দল কোনও রকম ফান্ডিং ছাড়া বাঁচবে এমন সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে আমি দেখছি না।

বর্তিকা : এর মধ্যে আর একটা কাজ যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে। যেটা অঙ্কুরের অনেক বছরের স্বপ্ন আর আমিও অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম, যে এটা একবার হলে ভালো হয়। সেটা হলো আমরা বড়রা যদি ছোটদের জন্য নাটক তৈরি করি,বিশেষ করে আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে স্কুলে নাটক করবো, শহর বা শহরের লাগোয়া অঞ্চলের কর্পোরেশন স্কুলে গিয়ে নাটক করবো। এটা এ বছর কিছুটা করতে পেরেছি, আমরা পাঁচজন ছিলাম। ‘হাত  ঘোরালেই গল্প’ বলে একটা ৩৫ মিনিটের নাটক তৈরি করেছি। দুটো লোককথা আর গান-টান মিলিয়ে একটা পারফর্মেন্স তৈরি করা হয়েছে, বিশেষ করে ছোটদের কথা মাথায় রেখে। ছোটোরা যেখানে টিভি, স্মার্টফোন, আইপড, কার্টুন ইত্যাদির মধ্যে থাকে, ওটাকে কাউন্টার করার জন্য একটা লাইভ পার্ফমেন্স দেওয়া। ঐ রকম এন্টারটেইনিং, ঐ রকম অ্যাকশন-প্যাকড, ঐ রকম আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান ওদের দেখা অভ্যাস। সুতরাং তারা ঐ সব ছেড়ে আমাদের নাটক কেন দেখবে?

হাত ঘোরালেই গল্প

কিন্তু দেখল। আমরা মোট চব্বিশটা শো করেছি। এটাও কিন্তু ইন্টারেস্টিং যে আমাদের প্রথম শো হয়েছে বাসন্তী কলোনিতে। তিনটে নাটকের প্রথম শো হয়েছে বাসন্তী কলোনিতে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা সহ সাতটা জেলায় আমরা শো করেছি, বস্তিতে করেছি, পাড়াতেও করেছি, গ্রামের সরকারি স্কুলে, শহরের সরকারি স্কুল, ক্যান্সার-আক্রান্ত বাচ্চাদের সামনে, কিছু এনজিও, যারা বস্তিতে কাজ করে, তাদের বাচ্চাদের জন্য হয়েছে। কিছু আন-অর্গানাইজ্‌ড্ শো যেমন পার্কসার্কাস ময়দানে বা হাজরা পার্কে গিয়ে শো করলাম। যদিও নাটকটা বাংলায় ছিল, কিন্তু দেখলাম হিন্দিভাষী-রাও ভালোভাবে নিয়েছেন।

এই নাটকে অনেকটা বডি ব্যবহার হয়েছে, অনেকটা ফিজিক্যাল থিয়েটার ছিল এটার মধ্যে, সব মিলিয়ে বলা যায় সব দিক থেকে বেশ ভালো হয়েছে। ‘হাত ঘোরালেই গল্প’-র ক্ষেত্রে এটা বলতে পারা যায় যে, এখানে যারা করছে তাদের পারফর্মেন্সের বেসিক একটা লেভেল আছে। আমরা পাঁচজন একসাথে থেকে এই নাটকটা করেছি, দেড়-দু মাস আমরা সব কিছু প্রায় ছেড়ে এটাই করছিলাম। পারফর্মেন্সের একটা স্ট্যান্ডার্ড-এ পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছি, অনেকটা সময়ও দিতে পেরেছি। বাচ্চাদের জিনিস, সেভাবে ওভার্টলি পলিটিক্যালও না, অনেক বেশি  ইউনিভার্সাল। তাও শো পেতে আমাদের খুবই কষ্ট হয়েছে। অনেকে বলে ছিলেন যে শো করার ব্যবস্থা করে দেবেন, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অঙ্কুর ছাড়াও এটার সাথে এমন তিনজন যুক্ত ছিল তারা কেউ অন্য কোনও কাজ করে না। সুতরাং তাদের তো কিছু দিতে হবে। সেই টাকা তুলতেও হিমসিম খেতে হয়েছিল। ভালো নাটক, তাই দর্শকদের কাছ থেকে ভালো সাড়াও পাওয়া গিয়েছিল। অথচ, তা সত্ত্বেও শো করায় সমস্যা হলো।

পার্থ : আমি নিজে স্কুলে কাজ করি। একজন শিক্ষক খুব সহজেই মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করতে পারে। অথচ এই ধরনের কোনও জায়গায় টাকা দিতে তাঁরা নারাজ। আমার একটা অভিজ্ঞতা বলি। একটা বাচ্চা ছেলে খেলতে গিয়ে পড়ে গেছে। পড়ে গিয়ে তার পেটের একটা ধমনী ছিঁড়ে গেছে। বাড়ির অবস্থা ভালো নয়, বাবা অটো চালায়। তা স্কুলে এসে সেই বাচ্চাটির বাড়ির লোক সাহায্য চাইলেন,  যেহেতু ছেলেটা এই স্কুলেই পড়ে। যদি শিক্ষকরা দুশো টাকা করে ডোনেট করে, তবে ওর চিকিৎসাটা হয়। মাস্টাররা এই বিষয়ে একটা মিটিং ডাকে কত কি দিতে হবে সে বিষয়ে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হচ্ছে যে চাইলে কেউ পঞ্চাশ দিতে পারে কেউ একশো দিতে পারে। অবশেষে তিরিশ জন স্কুলের স্টাফের কাছ থেকে টাকা উঠেছে ষোলশো পঞ্চাশ! কাজেই নাটকের কথা আর কি বলবো এরকম ক্ষেত্রে?

আয়নানগর : গতবার সাংস্কৃতিক কাজকর্মকে ফিলার হিসেবে দেখার যে বামপন্থী প্রবণতা, সেটা নিয়ে বেশ কিছুটা কথা হচ্ছিলো।  তো, এই গত এক বছরের কাজে তোরা যেভাবে এখন এই রাজনৈতিক কাজকর্ম ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মের মধ্যেকার সম্পর্ক এবং সংঘাত, বিষয়গুলোকে অনুভব করছিস, যদি বলিস।

বর্তিকা : দুটো গ্রুপের সাথে আমি কাজ করেছি লাস্ট ফেজে—রাজস্থান আর বাসন্তী কলোনি। জয়পুরের গ্রুপে সবাই ছাত্র। ওদের একটা পলিটিকাল এডুকেশন, একটা সামাজিক লিনিং আছে।  তো, সেখানে একটা পলিটিকাল এক্টিভিস্ট আর কালচারাল এক্টিভিস্ট, এই সংঘাতটা তো থেকেই। টু সি আর্ট এস আ টুল, এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে, টু সি দ্য প্রসেস অফ মেকিং আর্ট অ্যাস পলিটিকাল। এইটা অবশ্যই একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে ছিল।

কিন্তু, আমাদের প্রসেসটার মধ্যে কো-ক্রিয়েশন বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গতবার যখন আমরা ওখানে ‘শহর মে আয়া তেন্ডুয়া’ করি, সেখানে অনেকটাই নাটকটা একসাথে লেখা পর্যন্ত হয়। কারণ, নাটকটা জয়পুর-স্পেসিফিক।  ‘বিশ্বকর্মা’-র ক্ষেত্রে যেমন একটা স্ক্রিপ্ট আগেই ছিল। তো, এই যে নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো ওরা অনুবাদ করছে কবিতায়, গানে। দ্যাট ওয়াজ ভেরি এমপাওয়ারিং। তো, প্রথমে ওরা ওতো বুঝতো না, যে আমরা কেন এতো স্ট্রিক্ট। কিভাবে দাঁড়াতে হবে, কোনদিকে তাকাতে হবে, চোখটা কোনদিকে রাখবো, কেন এই বিষয়গুলোকে এতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, যখন নিজেদের শরীর কথা বলতে শুরু করলো, তখন বুঝছে যে, কিছু একটা হচ্ছে।  তো, এই যে আর্ট-ফর্মটার কাছে সৎ হতে হবে। এটা আমরাও ওখানে গিয়ে আবারও বুঝলাম।

এখানে যদি আমি বাসন্তী কলোনির কথা বলি, সেখানে বিকেলে নিয়মিত একসাথে হয়ে বস্তির মহিলারা একসাথে একটি কাজ সিরিয়াসলি করছেন, সেটা ইন ইটসেলফ একটা স্টেটমেন্ট। বিভিন্নরকমভাবে আমাদের বিরক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে আশেপাশের থেকে—জোরে জোরে গান বাজিয়ে বা এইসব কিছু করে। বস্তির মধ্যেও অনেকরকম ডিভিশন থাকে। সেসব কাটিয়ে যে মেয়েরা একসাথে একটা জায়গায় এসে একটা কাজ ডেলিবারেটলি করছে, তার মধ্যে দিয়ে একটা কালেক্টিভিটি তৈরী হচ্ছে।

প্রথমদিকে আমি সপ্তাহে একদিন গিয়ে কিছু বেসিক এক্সারসাইজ করেছিলাম। তো, যখন দেখলাম, একটা টীম ফর্ম করছে, আমি একটা সিচুয়েশন দিলাম। বললাম, তোমাদের ডিস্টার্ব করেছে এমন কিছু—হয়তো স্বামীর কোনো কথা, যে বাড়িতে কাজ করতে যাও সেখানেকার মালকিনের কথা, শাশুড়ি কিছু বলেছেন হয়তো—এইটা করে দেখাও। তো, ওরা সবাই এতো ফ্রিলি এসে করলো, যে আই ওয়াজ আমেজড। আসলে ওদের কাছে ‘আর্টিস্ট’ বিষয়টার কোনো ব্যাগেজ নেই। আমাকে যদি এখন কেউ বলে কিছু একটা করে দেখাও, আমি অনেকবার ভাবব। ভালো হচ্ছে কিনা বিচার করে দেখব। ওদের সেসব কিছু নেই। বলেছিলাম যে সকালসন্ধ্যে কলের জল ধরতে গিয়ে যে ঝগড়া দেখাও, অ্যান্ড আই ওয়জ ব্লোওন আওয়ে… প্রথম দিনেই অর্ধেকের বেশি নাটক আমি পেয়ে গেলাম। যেটা বুঝলাম যে যদি একটা স্পেস তৈরী করতে পারা যায়, যেখানে একজন মানুষ ফ্রিলি ক্রিয়েট করতে পারবে, তাহলে কত কিছু করতে পারে মানুষ! আসলে সেই স্পেসটাই তো তৈরি হয় না।

প্রায় দশ মাস হতে চলেছে। আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছি। একজনের একটা এক বছরের বাচ্চা আছে। তাকে খাওয়াতে হয় আটটার সময়ে। সাতটা থেকে নয়টা রিহার্সাল। খাওয়াতে পঁচিশ মিনিট লাগবে। আমি বলেছি, দু ঘন্টার কমে কিছুতেই রিহার্সাল করবো না। হ্যাঁ, ওদের জীবনটাকে বোঝার চেষ্টা করবো। কিন্তু এটাও সত্যি যে এর থেকে কমে কাজটা হয় না। তাহলে তুমি আর নিজের আর্ট ফর্মটার কাছে সৎ থাকছো না। আমি কতগুলো জায়গায় কম্প্রোমাইজ করবো না। এও বলেছি,করতে হবে না, ছেড়ে দাও। কিন্তু ওরা ছাড়তে পারছে না। এতো জায়গায় শো হয়েছে।একটা উৎসাহ পেয়েছে। নিজেদের ভিতরেও একটা ফ্রিডম পেয়েছে। একটা অন্য ক্ষমতা, যেটা ওরা ক্রিয়েটিভিটির মধ্যে দিয়ে এক্সপ্লোর করতে পারছে।

অঙ্কুর : দেখ, এই কাজটা খুব সীমিতভাবে হলেও ট্রেড ইউনিয়ন-এর মধ্যে থেকে করা যাচ্ছে। কারণ, আজকে বহু মানুষই আছেন, যারা খামতিটা বুঝতে পারছেন। তারা হয়তো নিদান দিতে পারবেন না, কিন্তু সমস্যাটা বুঝতে পারছেন। এখানে দুই দলের দিক থেকেই নিজেদের স্পেস দেওয়ার একটা ব্যাপার আছে। ওরাও আমাদের স্পেসে ঢুকছেন না, আমরাও ওদের স্পেসে ঢুকছি না। এখনও অবধি।

জিনিসটা ঘটানো গেছে, তার কারণ হচ্ছে যে, ব্যাপারটায় আমরা কখনোই রিডাকশনিস্ট ছিলাম না। ‘স্বভাব’-এর যখন নিজস্ব নাটক হবে, তখন বাড়তি মনোযোগ দিয়ে হবে, আর ওরা করলেই ‘বাড়ির ঝি তো, তাই যেটুকু করছে তাতেই হবে’ এই যে মধ্যবিত্ত মনোভাব, সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা কাজ করার কথা ভাবি না। এই বোধটাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। এবং, যতটুকু সম্ভব, আমরা করেছি। আমরা যখনই তথাকথিত ছোটলোকদের সাথে কাজ করি….

বর্তিকা : উইদাউট মিনিং টু, একটা কন্ডিসেনশন চলে আসে।

অঙ্কুর : এবার আমার কথা যদি তুই বলিস, আমার ওই কথাটাই মাথায় থাকে না। যখনই আমি ওই স্পেসটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি, যে মধ্যবিত্ত তাকেও আমি যেভাবে চাবকাবো, যে বাড়ির ঠিকে ঝি, তার কাছেও আমি একই পারফেকশন দাবি করি। তার বাইরে, তোমার জীবনে কি আছে, তা নিয়ে আমার একটা বেসিক সেনসিটিভিটি থাকবে, কিন্তু যখন তুমি এই স্পেসটাতে ঢুকছ, ওগুলো আর আমার কাছে প্রাসঙ্গিক নয়। অর্থাৎ, সবাইকেই আমরা একই সম্মান দেব। কেউ কেউ বলবে ‘আর্টিস্ট’ হিসেবে, কিন্তু আমরা বলবো ‘পারফর্মার’ হিসেবে।

স্বভাব কলকাতা

–দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত–

2 thoughts on “‘স্বভাব কলকাতা’র বন্ধুদের সাথে আড্ডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.