নীতা মণ্ডল
(১)
‘কই গো ঘরের লোকগোলা সব কোথা গেলা গো?’
একটা বিশেষ সুরের ডাক। সঙ্গে ‘টক্-টক্-টক্-টক্’ তুড়ি বাজানোর শব্দ। এরকম জোরে তুড়ি বাজাতে ওরাই পারে। আগল ঠেলে ঢুকে পড়ল ফুলি। বছর পঁচিশের তরুণী। কালো কুচকুচে গায়ের রং। চোখে ধ্যাবড়া করে কাজল। চুলগুলো যত্ন করে তেল দিয়ে আঁচড়ানো। মাথার উপর চুড়ো করে বাঁধা খোঁপা। গলার দুপাশের উঁচু হয়ে থাকা হাড়ের মাঝখানে শোভা পাচ্ছে কয়েক ছড়া বুনো ফলের মালা। কপালে বড় করে আঁকা সিঁদুরের টিপ। ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মত গোল। দেখলেই বোঝা যায় অনেক যত্নে আঁকা। ঠোঁটে সস্তার রং। প্রায় কনুই পর্যন্ত রংবেরঙের কাঁচের চুড়ি। টকটকে লাল রঙের সস্তার সিন্থেটিক শাড়িখানা উঁচু করে পরা। শাড়ির নীচে নীল সায়ার ঝালর উঁকি মারছে। দুপায়ের পাতা আলতায় রাঙা। কাঁকে একটা বড় পেঁচে, বাঁশের তৈরি ঝুরিতে গোবর লেপা ধামা। বাঁ হাতের কুনুই দিয়ে রক্ষা করছে তার ভার। ওর পেছন পেছন একদল ছেলেমেয়েও ঢুকে পড়েছে।
ফুলি দুহাতে তুড়ি বাজিয়ে মুখে বিচিত্র শব্দে যন্ত্রসঙ্গীতের আবহ সৃষ্টি করল, ‘খেচাক দম- খেচাক দম- খেচাক দম…’
একটি ছয় সাত বছরের মেয়ে ওকে দেখেই লাফিয়ে নেমে এল উঠোনে। দাওয়ায় পড়ে থাকল বই, স্লেট আর পেনসিল। বড় বড় চোখদুটো মেলে, একমাথা ঝাঁকড়া রুক্ষ চুল দুলিয়ে কৌতূহলী সুরে বলল, ‘তোমরা আবার এসেছ? কোথায় তাঁবু ফেলেছ গো? ইশকুল ঘরে না কেলাবের ডাঙায়?’
ফুলির উত্তর দেওয়ার আগেই ওর পেছনে থেকে দলের পান্ডা কার্তিক উত্তর দিল, ‘কেলাবের ডাঙায়। তু বই গুটিয়ে চলে আয় ক্যানে। আজকে আমরা হাবু শুনব। আর কাল থেকে বহুরূপীর সঙ্গে যাব। খপর আছে, এবার রামায়ণের পালা দেখাবে।’

দু-একটা কচি গলা প্রতিবাদ করল, ‘না বাবা। রাক্ষস সাজবে, তারাসুন্দরী সাজবে… যে ভয় লাগে! তার চে হাবু ভাল।’
ফুলির পিঠে একটা বাচ্চা নোংরা গামছা দিয়ে বাঁধা। গামছার দুপাশে দুটো সরু, কালো ঠ্যাং বেরিয়ে আছে। মায়ের চেহারায় যত পারিপাটী, সন্তান ঠিক ততটাই অবহেলিত। দুচোখের কোণে পিঁচুটি। নাক থেকে ঘন সিকনি গড়িয়ে মুখে ঢুকছে। চুলে জট। হাত, পা আর আঙ্গুলগুলো কাঠির মত। গায়ের চামড়ায় খরি উঠেছে। ভালো করে দেখলে বোঝা যায় আরও একটি সন্তানের জন্মের সম্ভবনায় ফুলির পেটটা ঈষৎ উঁচু হয়ে আছে।
এ বাড়ির বাচ্চা মেয়েটিকে উঠোনে নামতে দেখেই চোখ চকচক করে উঠল ফুলির।
নিমেষে ভাবনার তরঙ্গ খেলছে, ‘আরও একজন। এরাই একে একে মিলে গড়ে তুলেছে দলখানটা। এখন পেছন পেছন ঘুরবে। কার মাচায় ডিঙ্গিলি, কার চালায় লাউ, কার আড়ায় শাগ সব খপর দেবে।’
মেটে উঠোনের এক কোণায় থেবড়ে বসল ফুলি। সন্ধানী চোখ চারিদিকে ঘুরতে লাগল। ধানের গোলার নীচে একটা এনামেলের কানা উঁচু থালা উপুড় করে রাখা। ভিখিরি, কানা, খোঁড়া মানুষ এসে ভাত চেয়ে দাঁড়ালে ওই থালা দেখিয়ে দেয় ঘরের গিন্নী।
‘কই গো মল্লানরা। সব কোতা গেলা? আজ দোপরে তোমাদের বাড়িতেই খাব গো। আমার বড় আর মেজো বিটিকেও লিয়ে আসব।’  দুপুরে খাবারের দাবী জানিয়েই শুরু করল গিন্নীর রান্নার সুনাম। বেজে উঠল তুড়ি,
‘বৌ আমাদের রাঁধে ভাল কুলেবেগুনে
ফুগ দিতে গিয়ে মুখ পুড়েছে তুষের আগুনে।
এক পো চালের মাছ কিনলাম ধুতে বাছতে সব গেল
মেয়েছেলের মরণ ভাল, গঞ্জনাতে পরাণ গেল…’
ভেতর থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মল্লানরা সব কোতা গো?’
জবাব দিল ঝাঁকড়া চুলের মেয়েটি, ‘ঠাকুমা ময়শাপুর গেয়েছে, বাপের বাড়ি। আর মা ঘাটে। আমি তো আছি। তুমি হাবু গাও। আমি তোমাকে চাল দোব।’
‘তুমি তো মেয়েটো ভাল। নামটো কী তোমার?’
‘আমার নাম টুকটুকি। ইশকুলে লিখি মিতালি মণ্ডল। এ বছরে ইশকুলে ভর্তি করে দিয়েছে তো। তা তোমার নামটো কী?’
‘ফুলি।’
‘ফুলি কী? আমার যেমন মিতালি মণ্ডল। তুমি তেমনি করে বল।’
‘ফুলকুমারী বাজিকর।’
‘বেশ বেশ, গাও।’
‘হাট গেলাম, বাজার গেলাম কিনে আনলাম মুড়ি
বাপবেটাতে লেগে গেল দাড়ি ছেঁড়াছিঁড়ি’ …
দৃশ্যটা ভেবেই হেসে ওঠে ছেলেমেয়েগুলো। হাসতে হাসতেই একজন বলল, ‘বেটার আবার দাড়ি থাকে নাকি? বেটা তো ছোট হয়।’
হাবু গানের ভেতরে যে কত গল্প! সব তো ফুলিদের জীবনের কথা। ওদের সুখদুঃখের কথা, আপদবিপদের কথা। সেসব গল্প কি আর এসব ছেলেপিলেরা বুঝতে পারে! তাই বারে বারে মানে শুধোয়।
ফুলি বলে, ‘বলব ক্যানে? খালি হাতটো কি ব্যাতে যায়? চাল দাও, পয়সা দাও।’
যতক্ষণ না গল্প উদ্ধার হয় ওরা ঘ্যান ঘ্যান করেই চলে। পয়সা দিতে না পারলেও সেরা জিনিসের  সুলুকসন্ধান দেয়। ফুলিও বুঝতে পারে এর পর কোন বাড়িতে গিয়ে, কী গান গেয়ে গিন্নীর মন গলাবে।
টুকটুকি নামের মেয়েটা আবার বকবক শুরু করেছে। ফুলিকে শুধোয়, ‘তোমাদের বাড়ি কোথা গো? ঠিকানা কী? আমাদের বড় মাস্টার শিখিয়েছে, কেমন করে ঠিকানা বলতে হয়। গ্রাম বলতে হয়, পোষ্ট বলতে হয়, জেলা বলতে হয়। তোমার ঠিকানা বল দেখি।’
‘আমরা কি আর তোমাদের মত নেকাপড়া শিকিচি গো? আমরা হলাম গে ছোটলোক, মুরুখ্যু মানুষ। আমাদের ঘর কুঁয়ে নদীর গাবায়, কোমল গাঁ। বর্ষার সময়ে সি কী বান! বিলের ধারে জমিগোলা সব জলে সাদা। ফসল পচে, ঘর ডুবে, গরু, ছাগল ভেসে গেয়ে আমরা সব্বোশান্ত।’
গলার স্বরে সামান্য ঔদাসীন্যের ছোঁয়া লাগলেও এরপরেই তুড়ি বেজে ওঠে,
‘আগেতে বান ঢুকল যার বাড়ি, তাকে করলে ভিকিরি
খেটে খাবার জায়গা নাই, উপায় কী করি।
কোন নদীতে যোগ দিয়েছিল,
অজয় নদী, ময়ূরাক্ষী ভেঙে পড়িল।
ভরা বান, বাঁচাও প্রাণ, রক্ষা কর মা তারা
হুড়পো বানে মানুষ মরে হয়ে গেল সারা।
দেশে দেখ কী বান এয়েচে
কত গেরস্তর কত ক্ষতি হয়েচে
গরু বাছুর ভেসে দেখ গেয়েচে
মাসে মাসে ভূমিকম্প হয়েচে
ঘূর্ণি ঝড়ি উঠেচে।
আরও কত হবে –
ওলোট পালোট করে কলি, এবার কলি – ই শ্যাষ হবে।’
শেষের দিকে তুড়ি ঘন ঘন বাজে। একটা লম্বা টান দিয়ে শেষ হয় গান।
টুকটুকি ভেতরে গিয়ে ধামা থেকে এক জামবাটি চাল এনে ঢেলে দেয় ফুলির আঁচলে।
অন্য বাড়িতে চাল জোটে বড়জোর এক আধ কাপ, নাহলে ছোট রেকাবির ডগায় যতটুকু ধরে। চালের পরিমাণ দেখেই ফুলির মনে খুশির জোয়ার এল।
কালো কালো ছোপ ধরা দাঁতগুলো বের করে বলল, ‘ডিঙ্গিলি দেবা না?’
‘দোব গো দোব।’ টুকটুকি বলল পাকা গিন্নীর মত। ‘আমাদের চালাতেই তো হয়েছে। ঠাকুমা বলেছে ভিকিরিতে চাইলে বলবি, ঘরের লয়, কেনা। কিন্তু মিছে কথা ক্যানে বলব? বইয়ে লেখা আছে, ‘সদা সত্য কথা বলিও।’ তোমার ছেলের জন্যে দুটো মুড়িও দোব।…’
‘আরও হাবু শোনাও। এদের এবারে এত্ত আলু হয়েছে… আলুও দেবে।’ দলের পাণ্ডা বলে ওঠে।
ঠিক তক্ষুনি ঘাট থেকে ফিরে আসে টুকটুকির মা। ফুলি যেন আবেগে গলে যায়। তুড়ি মেরে গেয়ে ওঠে,
‘আমি কোথা ফেলব শাগের পেঁচে, কোথা ফেলব পা
আমাকে ধরে লিয়ে যা…’
ফুলি আর তার চারিপাশ থেকে ঘিরে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে টুকটুকির মা থমথমে গলায় ধমকায়, ‘তোদের লেখাপড়া নাই? ইশকুল নাই? বাজকরদের পেছন পেছন ঘোরা! যা এখান থেকে। টুকি বইয়ের কাছে যা, এখন তু কোথাও যাবি না।’
একে একে সরে পড়ে ছেলেমেয়েগুলো। টুকটুকিও উঠে যায় দাওয়ার উপর।
ফুলি বলে, ‘তা তোমার বিটিটোর খুব উঁচু লজর গো। আশিব্বাদ করি, রাঙ্গা টুকটুকে জামাই হোগ তোমার। ঘর আলা করা লাতি হোগ।’
‘তোমাকে আর লাতি হবার আশিব্বাদ কত্তে হবে না। যা বাগানোর বাগিয়েছ। এবার বিদেয় হও দেখি।’
‘না না, আমার কোলেরটোর জন্যে মুড়ি আর তোমার বিটি বললে ঘরের ডিঙ্গিলি তাই খানিকটো না লিয়ে যাব না। দোপরে তো তোমাদের ঘরেই খাব গো।’ বায়না জোরে ফুলি।
তারপর নিজের পাওনা গন্ডা বুঝে নিয়ে উঠে পড়ে। পল্লীর মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে দেখে আবার জমে উঠেছে দল। এমনকি টুকটুকি নামের সেই মেয়েটাও রয়েছে দলে।
(২)
ফুলি বাজিকর বুড়ি হয়েছে। যত না বয়স, তার চেয়েও অনেক বেশি দেখায়। মুখ জুড়ে অসংখ্য বলিরেখা। শরীর শুকিয়ে দড়ির মত। গলায়, হাতে চামড়া ঝুলে গিয়েছে। খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম, শরীরের উপর নানান অত্যাচার, মদ আর বিড়ির নেশায় নষ্ট হয়েছে সব জৌলুস। মরদ একটা ছিল বটে, অনেকদিন সঙ্গেই ছিল। গন্ডা দেড়েক ছেলেপিলেও হয়েছিল। তবুও ঘর সংসারের প্রতি ওর কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব। গাঁ থেকে গাঁয়ে ঘুরে বেড়ানর মধ্যে যে নেশা, তাই নিয়েই বেঁচে ছিল ও। আজও ওর নিজের ঘরটুকুর কোনও ছিরিছাঁদ নাই। নাই জীবনধারনের জন্য সামান্য হাঁড়িকুঁড়িও। দুচালা ছিটেবেড়ার ঘরে প্রতিদিন ঝাঁটও পড়ে না। উনুন জ্বলে না। কোনদিন কেউ ডেকে খেতে দেয়। কোনদিন নিজেই হাত পেতে দাঁড়ায়।
পাঁচ মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তিনজন গিয়েছে বিহারে। দুজন গাঁয়েই। তবে তারা গাঁয়ে থাকে না। আসপাশের গঞ্জ আর শহরে গিয়ে বস্তিবাসী হয়েছে। লোকের বাড়িতে ঝাঁট দেয়, বাসন মাজে, ঘর মোছে। ছেলেও বহু বছর নিরুদ্দেশ। ফুলি একা। কষ্ট হয়, তবে সে কষ্ট একাকীত্বের চেয়েও বেশি।
পল্লীর শেষপ্রান্তে একটা ডোবা। ডোবার পাড়ে কবরখানা। চারিদিকে বাঁশের জঙ্গলে অন্ধকার হয়ে থাকে। কবরখানা পেরিয়ে রাস্তার ধার ঘেঁসে বাঁশের মাচা। প্রায়ই সেই মাচায় বসে থাকে ফুলি। আপন মনে ভাবে বসে বসে। যেন নিজের মনেই কিছু খুঁজে চলে। কী খোঁজে জানে না। বড় বড় শ্বাস ফেলে তাকায় পাড়ার দিকে।
গাঁয়ের এক কোণে টিমটিম করছে চারপাঁচ ঘর বাজিকর। আর সবাই বেশি টাকার লোভে বিদেশ বিভূঁইয়ে খাটতে চলে গিয়েছে। টাকা রোজগার করতে ওরাও তো যেত। কিন্তু পালা পার্বণে ফিরে আসত। তখন হাতে নগদ টাকা, বস্তা ভরা চাল। গাঁয়ে এসে কত আমোদ, কত ফুর্তি। মদ মাংসের মোচ্ছব। আর আজকালকার ছেলেমেয়েরা! মা-দিদিমাদের, বাপ-পিতেমোর কত পুরুষের জীবিকাকে পায়ে ঠেলে দিয়েছে। ওরা সভ্য হতে চায়। বলে, ‘এ কাজে পয়সা নাই।’
শিল্পী মানুষের কি পয়সাই সব! একথা কিভাবে বোঝাবে ফুলি! কাকেই বা বোঝাবে! নিজের মনেই গুমরে মরে। লঙ্কাবাঁটার মত জ্বলে বুকের ভেতর। বায়োস্কোপের মত কত মায়াবী ছবি দুলে দুলে ওঠে চোখের পাতায়।
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে হেঁটে চলেছে একদল বাজিকর। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, বেটাছেলে আর বিটিছেলে। সবার পিঠে বোঝা। তাতে কি নাই! বাঁশ, দড়ি, ত্রিপল ছাড়াও সংসারের খুঁটিনাটি, হাঁড়ি, কড়াই, হাতা, খুন্তি। বেটাছেলেদের আছে বহুরূপী সাজার জন্যে ঝলমলে, রংচঙে কাপড়চোপড়, রাংতার সাজ, রং আর মুখোশ। এছাড়া আছে পাখি মারার জন্যে লম্বা বাঁশের লগা। তার মাথায় লোহার ফলা। গাছের ডালে খুঁচিয়ে পাখি মারতে এদের জুড়ি নাই। চলতে চলতে পথে পড়ল একটা বড় গাঁ। তার এক টেরে তাঁবু ফেলা হল। বহুরূপীর পাঁচ দিনে পাঁচ রকম রূপ। শেষ দিনে রাক্ষস সেজে ভয় দেখাবে। ছোটছোট ছেলেমেয়েরা ঘুরবে পেছন পেছন। কেউ কেউ আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারবে। মাঝে মাঝে বহুরূপী পেছন ঘুরে খ্যাঁক করে তেড়ে যাবে। শুধু ছেলেপিলেই নয়, ঘরের বৌরা পর্যন্ত ভয়ে পিছিয়ে যাবে। একবারে শেষদিনে আদায়। পিঠে মুড়ির বস্তা, আর হাতে চালের। সেদিন বহুরূপীর দেহে মুনির সাজ। মুখে মিষ্টি মিষ্টি বুলি,
‘চাল দেবেন এক সের,
ভগবান ফিরে দেবে মা ঢের ঢের।
মুড়ি দেবেন এক টিন,
আমি আসব না মা দিন দিন।
টাকা দেবেন এক গণ্ডা,
আমি লাঘাটার বাসস্ট্যান্ডে খাব মণ্ডা,
আমি তবে হব ঠান্ডা।’
তারপর সন্ধ্যেবেলা ঢালাও আমোদ। ঝলসানো পাখির মাংস আর মদ। সে এক অপরূপ নেশা।
মেয়েরাই বা কম কীসে! চারিপাশে যা হয় তাই দেখে নিজেরা মুখে মুখে গান বাঁধে। সকাল সকাল সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ে। নিজেদের বাঁধা গান এক অভিনব সুরে, এক নিঃশ্বাসে শোনায়। দুহাতে বাজে তুড়ির বাজনা। গান শেষে আদায় করে। ভিকিরির মত এক মুঠো চাল দিয়ে বিদেয় করতে চাইলে ঝগড়া করে। আর সুযোগ পেলেই হাত সাফাই। তাতে ওদের সহজাত দক্ষতা। তবে এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না ওরা। আসেপাশে চারপাঁচখানা গাঁয়ে আদায় হয়ে গেলেই গুটিয়ে ফেলে তাঁবু। তারপর চলে যায় অন্য কোথাও, অন্য কোনও গাঁয়ে।
সকাল থেকে মাইকের শব্দে ফুলির কান ঝালাপালা করছে। হিন্দি গান বাজছে। গাঁয়ে পরব, দুজ্ঞাপুজো। ওরা যেমন ভদ্রলোকদের কাছে পতিত, ওদের পুজোতেও ভদ্রজন, ব্রাহ্মণ বাদ। দেবাংশিরা সেই কত পুরুষ ধরে পুজো করে আসছে। এবারে আবার নতুন ছোঁড়া। তার সাজপোশাকের বাহার বাবুদের মত।
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঝোকন পাড়ায় ঢুকল। এযুগের ছেলেদের মধ্যে ওই আলাদা। সারাবছর যেখানেই থাকুক এই সময়ে গাঁয়ে আসবেই। পাড়াতে ঢুকেই মাতিয়ে দিল। বিলিতি মদের সঙ্গে কালো রঙের ঠাণ্ডা জল মিশেল করে বিলি করল। সঙ্গে বাদামভাজা।
বিলিতি মদ ফুলির পেটে পড়ার পরেই, বুকের ভেতরে যেন ঝড় উঠল। ঘরে গিয়ে টেনে পুরনো বাক্সখানা নামিয়ে বের করে আনল একটা লালরঙের সায়া। নীচের দিকে চিকণের কাজ করা। একবার চৌহাট্টার একটা নতুন বৌয়ের কাছ থেকে বাগিয়েছিল। রং চটে গিয়েছে। ফেঁসে গিয়েছে জায়গায় জায়গায়। তবুও পরল সায়াটা। তার উপর চাপাল নীল রঙের শাড়িখানা। পায়ের সামনে একটুখানি সায়ার চিকণ লাল অংশ উঁকি দিয়ে থাকল। কুঁচকে যাওয়া চোখের পাতায় কাজল দিল মোটা করে। তেল দিয়ে পাতলা হয়ে আসা কাঁচাপাকা চুলগুলো আঁচড়ে খোঁপা বাঁধল। খোঁপার উপর আলতো করে ঘোমটা টেনে দিল। দুকানে দুলল নকল সোনার ঝুমকো। তারপর এলোমেলো পায়ে হাঁটতে লাগল গাঁয়ের রাস্তায়।
কখন কবরখানা পেরিয়ে চলে এসেছে টের পায় নি। দেখল ঠাকুরজামাই বসে আছে মাচার উপর। ঠাকুরজামাইয়ের সঙ্গে ফুলির ননদের বিয়ে হয়েছিল। সে ননদ কবেই মরদকে ছেড়ে দিয়ে অন্য লোককে সাঙা করে কেটে পড়েছে। তবুও ফুলির সঙ্গে ঠাকুরজামাইয়ের সম্পর্ক পিরিতের।
মাচার খানিকটা জায়গা গামছা দিয়ে ঝেড়ে দিয়ে ঠাকুরজামাই বলল, ‘বস গো ফুলবৌ, দুটো সুখদুখের কথা কই। গাঁয়ে পুজো আছে গো, ফুত্তি নাই। শিবু দেবাংশি ম’ল। তার বেটা গণশা হল নতুন দেবাংশি। আজকালকার ছোঁড়া। ডাঙ্গালের ইশকুলে নেকাপড়া শিখেচে। বলচে, বলি করা আইনে নাই। পুজোর দিনে মাংস নাই, ফুত্তি নাই, তা বাঁচা ক্যানে শুনি?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, ‘কলি বোধায় উলটিয়েই গেল গো ফুলবৌ…’
দুগালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ল ফুলি, ‘সেই বিতান্তই তো দিনরাত ভেবে মরি ঠাকুরজামাই। নতুন হাবু বাঁধি। কিন্তু শুনবে কে? তুমি শুনবা?’
ঠাকুরজামাই নীরব থাকলেও ফুলির দুহাত গাল থেকে নেমে আসে। দুর্বল আঙ্গুলে ক্ষীণ শব্দে তুড়ি বাজে।
‘হায় গো মরি তেলাক ঝাঁই
এই কলিতে মান্য নাই।
কী রোগ ঢুকেছে কলিতে, ভাবি মনেতে।
শাশুড়ির গলায় ল্যাইলে দড়ি, বৌয়ের গলায় চন্দহার
কলিতে যে উঠেছে কেমনতর বেবহার।
আরও কত হবে –
ওলোট পালোট করে কলি, এবার কলি – ই শ্যাষ হবে।’
ভটভট শব্দে একটা মোটর সাইকেল এসে থামে ওদের কাছে। ফুলির গান বন্ধ হয়ে যায়। দুজন জোয়ান ছেলে নেমে আসে মোটরসাইকেল থেকে। মাথা থেকে টুপি আর চোখ থেকে কালো চশমা খুলতেই ঠাহর হয় পেছনে যে বসেছিল সে বেটাছেলে নয়। বেটাছেলের মত জামাপ্যান্ট আর চশমা পরা।
মেয়েটি বলে উঠল, ‘এই তো পেয়েছি। মাসিকে দেখেই চিনেছি। সেই চুলের স্টাইল, চোখে কাজল … সব মিলে গিয়েছে। তোমরাই তো হাবু গাইতে যেতে, তাই না মাসি?’
ফুলি খুঁটিয়ে দেখে ওদের কাছে ফটোক তোলার যন্ত্র আছে কিনা! এমনি তো কেউ হাবু শুনতে চায় না আজকাল। সেই বছর খানেক আগেই একদল বাবু এয়েছিল। বলেছিল কলকাতায় রিসাচ না ফিসাচ কি করে। ফটোক তুলেছিল, মুখের কাছে যন্ত্র ধরে গলাটা পর্যন্ত তুলে নিয়েছিল। তবে ফুলি বিনা পয়সায় ছাড়ে নাই। গুণে গুণে পাঁচশটা টাকা আদায় করেছিল। আজ ফুলির চোখেমুখে সন্দেহ ঘনায়। কুটিল হিংস্রতা ফুটে ওঠে মুখের রেখায়। বলে, ‘এল আমার সাতকুলের বুনপো-বুনঝি। খোলসা করে বল দেখি, মতলবটো কী? হাবু আমরা এমনি গাই না। আমরা শিল্পী। শুধু হাতটো কি ব্যাতে যাবে? পয়সা চাই, পয়সা। একটো হাবুতে পাঁচশ টাকা লাগবে আর পুজোর চাঁদা আরও পাঁচশ।’
মেয়েটি মুক্তোর মত দাঁতগুলো বের করে হাসে। বলে, ‘আমরা হাবু শুনতে আসি নাই গো মাসি। তোমরা গাঁয়ে আছ কিনা, কেমন আছ দেখতে এসেছি।’
ঘাড় নাড়ে ঠাকুরজামাই, ‘মনটো তো মানতে চায় না…।’
‘তবে শোন। ইন্দেস গাঁ টো মনে আছে তোমাদের? আমরা যখন ছোট ছিলাম তোমরা যেতে সেখানে। আমরা সেই গাঁয়েরই ছেলে মেয়ে গো। আমাদের একটা ক্লাব আছে। আমরা, ক্লাবের ছেলেরা বছরে একদিন তোমাদের মত মানুষদের আদরযত্ন করে খাওয়াই। আর মেয়েটোকে দেখছ, এ খুব বড় চাকরি করে। অনেক টাকা দিয়ে সাহায্য করে। তোমাদিকে নেমতন্ন করতে এসেছি গো আমরা।’
বলে ছেলেটি পকেট থেকে একটা ছোট খাতা আর পেন বের করে। বলে, ‘নাম দুটো বল লিখে নিই। আরও কেউ থাকলে তাদের নামও বল। আমরা আসি আর না আসি প্রতি বছর তেরোদশির দিনে তোমরা চলে এসো আমাদের গাঁয়ে। ক্লাবের ডাঙায়। তোমাদের কোমলগাঁয়ে বাসে চাপবে সোজা গিয়ে ইন্দেসের বড়ি পুকুরের পাড়ে নামবে।’
মেয়েটি এগিয়ে এসেছিল ফুলির কাছে। বলল, ‘আমরা গাঁয়ে ঢুকেই তোমাদের খবর নিয়েছি। হাবু গান এখনকার বৌ-বিটিরা গায়?’
ফুলি ঘাড় নাড়ে, ‘না।’
‘তোমাদের কী করে চলে এখন? ঠিক মত খেতেটেতে পাও?’
মেয়েটির মায়ামাখা কথা ক’টা শুনে ফুলির চোখের পাতা কেঁপে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফুল্লরা মন্দিরের চাতাল। পেটে টান পড়লেই ফুলি হাজির হয় সেখানে। ভিখারিদের ভিড়ে মিশে হাত বাড়ায়, ‘দশ টাকা দাও গো বাবু।’ বাবুরা ওদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে উঠে যেতে চায় গাড়িতে। ফুলিও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। ছিনে জোঁকের মত লেগে থাকে বাবুদের পেছনে। টাকা আদায় হতেই আসেপাশে থেকে হামলে পড়ে অন্য ভিখারিরা। সাধুবাবারা পর্যন্ত গাঁজা খেতে খেতে উঠে এসে বলে, ‘ভাগ দে।’ তারপর শুরু হয় ঝগড়া, গালাগালি। ফুলি সেই ঝগড়ার ফাঁকেই অনেকটা সরিয়ে ফেলে কোঁচড়ের আড়ালে। অল্প খানিকটা ওদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘মর মর। মরে না ভিকিরির দল।’
সামনের মানুষদুটোর কথা বিশ্বাস হয় না। এ যুগে এমন ছেলেমেয়েও আছে!
মোটরসাইকেলের শব্দে ঘোর ভাঙে ফুলির। পেছন থেকে মেয়েটা বলে উঠে, ‘চললাম গো মাসি। যেও তেরোদশির দিন। আজ সপ্তমী। আর ঠিক ছদিন পর।’
(৩)
মাইকের শব্দে গমগম করছে চারিধার। পুকুরের ইশানকোণে বটগাছটা চোখে পড়ল ফুলির। গাছের ডালে একটা বড় চোঙ বাঁধা। আগে ওই গাছের ডালে ডালে শকুনি বসে থাকত। ওখানে ভাগাড় ছিল কিনা! ভাগাড়ের উপর দিয়েই পিচের রাস্তা চলে গিয়েছে। সেই ভাগাড়ও নাই, সেই শকুনিও নাই। দুপাশে দালান বাড়ি। মিষ্টির দোকান, কাপড়ের দোকান, জুতোর দোকান, বাসনের দোকান। গাঁ আর গাঁ নাই, যেন বাজার!
কয়েক পা এগিয়ে যেতেই রাস্তার উপর হলুদ গেঞ্জি, মাথায় সাদা টুপি, হাতে কঞ্চি একদল ছেলে বলল, ‘এস, এস। আমরা ভলেন্টিয়ার।’
কেলাবের ডাঙাও চেনার উপায় নাই। চারিদিকে ইটের পাঁচিল। একতলা পাকা কেলাব ঘর। সামনে রেলিং ঘেরা বারান্দা। বারান্দার সামনে শামিয়ানা টাঙানো। টেবিল চেয়ার পেতে বাবুরা বসে আছে। বাবুদের পরনেও ‘ভলেন্টারি’দের মত হলুদ গেঞ্জি আর সাদা টুপি। মাইকে কত কী বলছে! আদর করে ডাকছে ফুলিদের মত মানুষদের। আর বাবুরা চুপ করলেই গান বেজে উঠছে। ডাঙার আর একটা দিকে ধোঁয়া উঠছে। বাতাসে ভাসছে রান্নার গন্ধ।
ফুলিকে আর ঠাকুরজামাইকে দুজন ‘ভলেন্টারি’ নিয়ে গেল ভেতরে। ওদের কেউ কখনও এভাবে আদর করে ডাকে নি। ভেতরে ঢুকে চোখ জুড়িয়ে গেল ফুলির। শতরঞ্চির উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে কত গরিব, দুঃখী, বুড়ো থুত্থুড়ে, অক্ষম মানুষ। তাদের মুখে এমন সুখের হাসি, যেন গঙ্গাচান করতে এয়েচে।
ওকে আর ঠাকুরজামাইকে বসিয়ে দিয়ে ‘ভলেন্টারি’রা রঙিন শরবৎ দিল। ফুলি দেখল কেলাবঘরের বারান্দায় বসে সেই দিনের সেই ছেলেটা। যেন সাক্ষাৎ নারায়ণ। মুখের সামনে যন্ত্র ধরে কী যে বলে!
‘আমি ইন্দাস বিপ্লবী সংঘের সভাপতি কার্তিক মণ্ডল আপনাদের জানাতে চাই যে, আমাদের মাস্টারমশাই স্বর্গীয় গোপীনাথ মণ্ডলের ইচ্ছাপূরণ করার জন্যেই আজ এই আয়োজন। গোপীনাথবাবুর নেশা ছিল গ্রামে গ্রামে, মেলায় মেলায় ঘোরা। সেখানে ভিখারিদের দুর্দশা তাঁর হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করেছিল। এছাড়া বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে  ভিক্ষাজীবী মানুষদের দেখে উনি কষ্ট পেতেন। আমাদের কাছে প্রায়ই বলতেন, একদিন যদি এদের সম্মানের সঙ্গে দুমুঠো ভাত দিতে পারতাম!
কিন্তু মঙ্গলময় কাজ করতে গেলেও যে টাকা লাগে। সেকথা বলতেই মাস্টারমশাই বলেছিলেন ভয় কী? তোমাদের পড়াই নি, ‘আমার ভাণ্ডার আছে ভরে …’?
মাস্টারমশাই চলে গিয়েছেন। তার ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে আমরা কজন পথে নেমেছিলাম। এই গ্রামের মানুষের সাহায্যে সত্যিই ভরে উঠেছে আমাদের ভান্ডার। আর টুকটুকির সাহায্যে সেই ভাঁড়ার উপচে পড়ছে। টুকটুকি এই গ্রামেরই মেয়ে। বড় চাকরি করলেও, দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ালেও সে গ্রামকে ভুলে যায় নি। এবারের খাবারের পুরো খরচটা দিয়েছে ও। কাজের জন্যে তাকে ফিরে যেতে হয়েছে দিল্লী, নাহলে …”
কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল ফুলির। হঠাৎ টুকটুকি নামটা কেমন যেন মাথায় গেঁথে গেল। যেন খুব চেনা চেনা! সেদিন বেটাছেলে ভেবেছিল যাকে সেই মেয়েটো! ফুলির ভাবনা শেষ হল না, মাইকে বলল টিফিন দেবে। ‘ভলেন্টারি’রা এসে সরু করে শতরঞ্চি পেতে বসিয়ে দিল ওদের। সামনে পড়ল শালপাতা। প্লাস্টিকের গ্লাসে জল। তারপর এল মুড়ি, ডিঙ্গিলির তরকারি আর বোঁদে।
এসব গাঁ একদিন পায়ে হেঁটে চষে বেরিয়েছে ফুলি। রোজগার করেছে, তবে তাতে মান ছিল না। কেমন ‘দূর দূর ছ্যা ছ্যা’ করে তাড়িয়ে দিত বাবুদের বাড়ির লোকে। সেই কোন যুগের কথা! সেই যে বাবুদের বাড়ির ছেলেপিলেরা পেছন পেছন ঘুরত। তারাই লয় তো এই কেলাবের মেম্বর, পেসিডেন, সেই বিটিছেলেটো, টুকটুকি নাম!
কার্তিকের মুখের দিকে আকুল হয়ে তাকিয়ে সেদিনের ছেলেমেয়েদের খোঁজে ফুলি। বাবুদের বাড়ির বৌরা যখন চাল ডাল ঢেলে দিত, ফুলি ঢেলে দিত আশীর্বাদ। টেনে টেনে বলত, ‘ধনে বারুক মা…। ছেলের নেকাপড়া হোগ মা…। বিটির রাজার ঘর বিয়ে হোগ মা…, ঘর আলা করা লাতি হোগ মা…।’ সেসব ছিল সাজানো আশীর্বাদ। বলতে হয়, তাই বলা। আজ যেন সেই আশীর্বাদ বুকের ভেতর থেকে নিজে থেকেই ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
টিফিন খাওয়া শেষ হতেই কাগজের কাপে চা দিয়ে গেল। চায়েরও কী নেশা! ফুলির ভেতরটা চনমন করে উঠেছে। মনের মধ্যে বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া পুলক। চারিদিক কী সুন্দর! কী সুন্দর মানুষের মুখ! কী সুন্দর আকাশ, বাতাস, গাছপালা, পুকুরের জল! মনের মধ্যে দানা বাঁধছে নতুন ছড়া। ভাবছে, একবার যদি আগের মত গাইতে পারতাম। সামনে এত লোক, মাইকে গলা আর তুড়ি যদি গমগম করত! গোটা দুনিয়াটোকে জানাতে পারতাম আমি শিল্পী! জেবনটো ধন্য হয়ে যেত!
মনে মনে নতুন ছড়া বাঁধার চেষ্টায় ফুলির ভেতরটা ছটফট করে ওঠে।
কান আটকে যায় মাইকের ডাকে। নানুবাজারের চন্দনা দাস বৈরাগ্য আর লাভপুরের পার্বতী দাসকে ডাকছে ওরা, কীর্তন গাইবার জন্যে। ফুলি দেখল পাকা চুলের সাদা শাড়ি পরা দুজন মেয়েমানুষ উঠে গেল। কীর্তনের পালা ধরল।
গান শেষ হতে ‘আহা আহা’ রব উঠল লোকজনের মাঝখান থেকে।
ডাক পড়ল, কাঁদরার তারাপদ হাজরা আর খয়েরবুনির বলরাম দাসের। ওদের পরনে রংবেরঙের তালি দেওয়া আলখাল্লা, বগলে গাবু আর পায়ে ঘুঙুর। ঘুরে ঘুরে নাচতে নাচতে ওরা গান গেয়ে উঠল।
ওদের সঙ্গে সঙ্গে নেচে উঠল হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেগুলো।
‘ফুলকুমারী বাজিকর, গ্রাম কোমল গাঁ। আপনাকে স্টেজে আসতে অনুরোধ করা হচ্ছে।’
ফুলি কেমন অসাড় হয়ে গেল। এমন আনন্দ কোনদিন পাই নাই ও। ওরা যে ফুলির নাম ডাকছে। ফুলিরই তো নাম! ওরা বলছে ফুলি শিল্পী!
ওই তো সেই নারায়ণ ঠাকুর মাইকে বলছে, ‘হাপু বা হাবু বীরভূমের একটি হারিয়ে যেতে বসা লোকসঙ্গীত। আমরা খোঁজ করে দেখেছি আঙ্গুলে গোনা মাত্র কজন হাবুশিল্পী জীবিত আছেন। ওদের মেয়ে বৌরা কেউ এই গান শিখতে আগ্রহী নয়  …’
আরও কী সব বলছে মাইকে ফুলির কানে ঢুকছে না। ও উঠে দাঁড়াল। হাত পা কাঁপছে।
ফুলিকে শিল্পী বলেছে ওরা! এখানে আসার পর থেকেই এলোমেলো চিন্তায় ফুলি কেবল জর্জরিত হয়েছে। এতদিন যত গান বেঁধেছে, তা যুগের পরিবর্তন নিয়ে, খোঁচা দিয়ে। আজকালকার মেয়েদের সুযোগ সুবিধা দেখে হিংসে হয়েছে। কিন্তু এখন কেন ভেতরে এত কষ্ট, এত হা হুতাশ!
কখন উঠে এসেছে স্টেজে নিজেই টের পায় নি। সামনে মাইক ধরে ছেলেটি বলল, ‘গাও তো মাসি।’
সামনে এত লোক! এ যেন বিলের মাঠে বান। এত লোকে শুনবে ফুলির গান! হাত তালি দেবে! ফুলির চোখে হু হু করে জল আসছে। ও পারবে তো? ওকে যে পারতেই হবে।
টক্-টক্ করে তুড়ি বাজিয়ে শুনিয়ে দেবে একটা লম্বা হাবু। তবে আজ আর কোনও ঠাট্টা নয়, খোঁচা নয়।
ফুলি নিজের মনকে শক্ত করে। কিন্তু বুড়োআঙ্গুলটা বেইমানী করে। মাঝের আঙ্গুলে ঘষা খেয়ে বারে বারে ফসকে যায় যে! খসখস করে একটা শব্দ হয়। কী করবে ফুলি! শরীর যেন নিজের বসে নেই। গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না কেন! তবু প্রাণপণ লড়ে যায় ফুলি। ফ্যাসফেঁসে একটা আওয়াজ অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসে আর দু চোখ থেকে বেরোয় বাঁধ ভাঙা জল। গাল ভেসে যায়। জীবনে না পাওয়ার কষ্টগুলো গান হয়ে উঠে। ফুলি বিড়বিড় করে,
‘আই লো সই যাই লো সই, পড়ব আমরা রাত্তের ইশকুলে
দুই সইয়েতে পড়ব আমরা সাক্ষরতার ইশকুলে
বুড়ো বয়েসে পড়ে আর কী হবে তাই বল না
মেম্বরবাবু বলে যে গো, সই কর, তাই দেখি না…’
কথাগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য শব্দ তৈরি হয়। ফুলির পায়ের নিচের তক্তা দুলে উঠে। সামনের দিকটা বনবন করে ঘোরে। একজন স্বেচ্ছাসেবক দৌড়ে এসে ধরে পেছন থেকে ধরে ফেলে ওকে। বলে, ‘চল মাসি, একটু বিশ্রাম নেবে।’
সে কথা আর ফুলির কান পর্যন্ত পৌঁছয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.