দ্যুতি মুখোপাধ্যায়
দ্যুতি মুখোপাধ্যায় পেশায় সাংবাদিক। নাম গালভারি হলেও কাজটি কেরানির চেয়ে কিছু আলাদা নয়। ডেস্কে বসে কলম পেষাই সার। ‘ভার্নাকুলার’ কাগজে কাজ করার সুবাদে অনুবাদ নিত্যদিনের কাজ। ভালোলাগাও। তা বাদে সুতার্কিক। নানা বিষয়ে দূর থেকে মতামত দিতে পছন্দ করেন।
“‘লেটার টু আ ইয়ং লেডি ইন প্যারিস‘ গল্পটি হুলিও কর্তাজারের, ইংরিজি অনুবাদে পড়া। গল্পটি নাড়া দিয়ে গেছিল বলে নিজের মনেই একটা অনুবাদ মত করতে শুরু করেছিলাম। করতে করতে মনে হল গল্পটার প্রেক্ষাপটটা বেশ সর্বজনীন, মানে এ গল্পটা কলকাতায় হলেও লয়ক্ষয় হত না তেমন। হয়তো বা আলাদা একটা চরিত্রও পেত। সেই ভাবনা থেকেই বদলে গেল লেখা। এটাকে আর অনুবাদ বলা ঠিক হবে না। অনুকৃতি? তাই-ই সই।” – দ্যুতি
.
অনন্যা, তোমার গড়িয়ার বাড়িতে আস্তানা পাততে আমি চাইনি। না, খরগোশগুলোর জন্য বলছি না, আসলে যে কোনও গোছানো জায়গায় ঢুকতেই আমার অস্বস্তি হয়। এই যে একেবারে হাওয়ার চলনটুকু পর্যন্ত সযত্নে নির্মিত, তোমার ঘরের মৃগনাভি সুবাস থেকে ট্যালকমের কৌটোয় রাখা পালকের ঘনত্ব পর্যন্ত রবিশঙ্করের সেতার আর আল্লারাখার তবলার বোলের মত যুগলবন্দীর তারে বাঁধা। এমন সুচারু সুন্দর গৃহস্থালির মধ্যে মূর্তিমান কালাপাহাড় হয়ে এসে দাঁড়ানোটা রীতিমত যন্ত্রণাদায়ক। এ বাড়ির প্রতিটি ধুলোবালি, প্রতিটা জিনিস গৃহকর্ত্রীর চেতনার নিয়ম মেনে নিজের নিজের জায়গায় গিয়ে সেজে বসেছে যেন, এই যে এদিকে বইয়ের তাকগুলো (একটা আলমারিতে বাংলা, অন্যটায় ইংরেজি আর উর্দু), ওদিকটায় তাকিয়ার উপর ঠান্ডা সবুজ ইক্কতের চাদর বিছানো পরিপাটি, ক্রিস্টালের ছাইদানিটা রাখা কাচের টেবিলটপে, যেন স্বচ্ছ বুদবুদ ফুলে উঠতে উঠতে ঐখানে হঠাৎ স্থির হয়ে গেছে, আর সারাক্ষণ কী যেন সুবাস, সারাক্ষণ কোথা থেকে যেন ভেসে আসা মৃদু সুরেলা টুংটাং, কেটলি আর বোন চায়না আর সোনালি পাড় দেওয়া জাফরি কাজের ট্রে, সাদা দেওয়ালে কালো কাঠের ফ্রেমে সাজানো মৃত স্বজন… আহ, অনন্যা! কী কঠিন, এক স্বাধীন মেয়ের নিজের বাসার এই অপার্থিব সুন্দর সঙ্গতির জগৎটার সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে সে নিয়মের সামনে বাধ্যত নত হওয়া, কী কঠিন! কী অপরাধী লাগে যখন অভিধানটা টেবিলে রাখতে গিয়ে ফলের ঝুড়িটা সরাতে হয় (শুধুমাত্র আলসেমি করে চেয়ার থেকে উঠব না বলে, তাক থেকে বই নামিয়ে অন্য দিকে গিয়েও তো বসা যেত)। তোমার এই ঘরে ঝুড়িটুকু সরানো যেন মানে-র লিলির ল্যান্ডস্কেপের উপর বীভৎস লাল ছিটিয়ে দেওয়ার সামিল, যেন বা ভৈরবীর আলাপে হঠাৎ হামলা কড়ি মধ্যমের। তোমার অন্তরাত্মার ছকে মেপে মেপে সাজানো এ ঘর, প্রতিটা জিনিসের সঙ্গে প্রতিটা জিনিসের সম্পর্কে সে চেতনার দৃশ্যমান প্রকাশ, ঝুড়িটুকু সরালে তাই যেন বেসুরো বেজে ওঠে গোটা ঘরই। তাক থেকে বই নামাই কি তানপুরাটাকে একটু ছুঁয়ে দেখি কি নিদেনপক্ষে টেবিল ল্যাম্পটাকে একটু ঘুরিয়ে রাখি, যাই করি না কেন, তোমার অন্তরাত্মার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ ঘোষণার ভাব পেন্ডুলামের মত মাথার ভেতর দুলতে থাকে।
এই যে কাঠফাটা রোদের কবল থেকে অনেক দূরে সরানো তোমার এই শান্ত, স্নিগ্ধ বাড়িটা, এখানে আমি কেন এসে উঠেছি তা তো তোমার অজানা নয়। আসলে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার আগে পর্যন্ত সবকিছুই কেমন সরল স্বাভাবিক লাগে, না? তোমায় তিন মাসের জন্য বাড়ি ফেলে দিল্লি যেতে হবে আর আমারও একটা আস্তানা দরকার, দুজনের জন্যই সুবিধাজনক ছিল বন্দোবস্তটা। সেপ্টেম্বরে তোমার কলকাতা ফেরার আগে পর্যন্ত আমি এখানে থাকব আর তারপর হয়তো অন্য একটা বাড়ি যেখানে… কিন্তু সে কথা মনে করানোর জন্য আমি তোমায় চিঠি লিখছি না। লিখছি ঐ খরগোশগুলোর জন্য, ব্যাপারটা তোমার জানা উচিত বলে। আর আমার চিঠি লিখতে বেশ লাগে, তাছাড়া বৃষ্টিও পড়ছে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় এ বাড়িতে ঢুকেছি আমি, হা-ক্লান্ত, চোখে ধোঁয়া দেখছি প্রায়। আসলে জীবনে এতবার সুটকেসের ডালা খোলা বন্ধ করেছি, এত এত ঘণ্টা বাক্স গুছিয়ে কাটিয়েছি কিন্তু কোথাও যাওয়া হয়নি। সে বৃহস্পতিবারটাও ছিল এমন একটা দিন, ব্যাগের স্ট্র্যাপ আর আঁধারে ভরা। আঁধার, কারণ ব্যাগের স্ট্র্যাপ দেখলেই আমার মনে হয় চারপাশে অনেক ছায়া, আর ওগুলো যেন চাবুক আর সে চাবুক নিরন্তর আমার পিঠে পড়ে চলেছে, মানে সরাসরি না কিন্তু কেমন করে যেন একটা, খুব নিঃশব্দে, ভয়ানক গোপনে। কিন্তু, আমি ব্যাগ গোছানো শেষ করলাম, আর তোমার কাজের মেয়েটিকে ফোন করে জানিয়েও দিলাম আমি আসছি। তোমার ফ্ল্যাটের লিফটেই উঠছিলাম, আর ঠিক তখনই, দোতলা আর তিনতলার মাঝে বুঝতে পারলাম আমি একটা ছোট্ট খরগোশ বমি করতে চলেছি। এই ব্যাপারটা নিয়ে আগে তোমায় কখনও বলিনি। তুমি গল্পগাছা ভেবে উড়িয়ে দেবে বলে নয়, এমনিই, মানে আমি মাঝে মধ্যে খরগোশ বমি করে ফেলি এটা তো আর জনে জনে ঢাক পিটিয়ে বলার কথা নয়। যতবার এমনটা হয়েছে আমি কোনও একটা নির্জন জায়গা খুঁজে নিয়েছি। আমরা সবাই তো আমাদের শরীরের বহু ব্যাপারই লোকচক্ষুর আড়ালে রাখি, যতই সাধারণ স্বাভাবিক হোক না কেন, তাই না? এটার জন্য আমায় দোষ দিয়ো না অনন্যা, বকাবকি কোরো না। মাঝে মাঝে আমি এক একটা খরগোশ বমি করে ফেলি আরকি। সবার থেকে পালিয়ে একা একা গুমরে মরার এটা কোনও অজুহাত হতে পারে না, কারও বাড়ি যাওয়ার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করারও কোনও মানে নেই, সেটা তুমি নিশ্চয় স্বীকার করবে।
যখনই আমি বুঝতে পারি যে খরগোশটা আসতে চলেছে, সাঁড়াশির মত করে দুটো আঙ্গুল মুখে পুরে দিই, আর অপেক্ষা করি কখন জলে গোলা অ্যান্টাসিডের মত ভুসভুসিয়ে গলা দিয়ে উঠে আসবে ঈষদুষ্ণ তুলতুলে দলাটা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটে যায় ব্যাপারটা, ঝপাঝপ, কোনও ঝঞ্ঝাট নেই। দু আঙ্গুলের ফাঁকে উঁচানো কানদুটো ধরে বার করে আনি খুদেটাকে। বেশ হাসিখুশি সহজ স্বাভাবিক খরগোশ একটা, তবে একেবারে এইটুকুন; আয়তনে অনেকটা দোকানে বিক্রি হওয়া চকোলেট খরগোশগুলোর মত হবে, খালি এটা ধপধপে সাদা, আর একদম সত্যিকারের। হাতের তেলোতে নিয়ে সেটার এলোমেলো লোমগুলোতে আঙ্গুল বুলিয়ে সোজা করে দিই, দেখে মনে হয় জন্মাতে পেরে সে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছে। আমার হাতের উপর নরম নরম করে গুঁতোয় সেটা, খুরখুর করে হাঁটে আর চামড়ায় মুখ ঘসে। বুঝতে পারি ওর আসলে খিদে পেয়েছে। আর আমি তখন (রাজারহাটের বাড়িটায় যখন হয়েছিল তখনকার কথা বলছি) তাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে তুলসিগাছের টবটায় ছেড়ে দিই। ওদের কথা ভেবেই বাড়িতে তুলসি লাগিয়েছি। কানদুটো যদ্দুর ওঠে ততটা খাড়া করে গন্ধ নেয় খরগোশটা, তারপর টুকটুক করে ডালের চারপাশ ঘুরে গিয়ে একটা কচি পাতার কোনা চিবুতে আরম্ভ করে। আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে কাজে যাই, যারা বাজার থেকে খরগোশ কিনে এনে পোষে তাদের থেকে আর খুব একটা আলাদা থাকে না আমার জীবনযাত্রা।
আর এভাবেই অনন্যা, ঐ দোতলা আর তিনতলার মাঝে, যেন তোমার বাড়িতে আমার সময়টা কেমন কাটতে চলেছে তার একটা পূর্বাভাসের মতোই, বুঝতে পারলাম আমি একটা খরগোশ বমি করতে চলেছি। আমি বেশ ভয়ই পেলাম (নাকি হতভম্ব হবে শব্দটা? না, বোধহয় এই হতভম্ব অবস্থাটাকেই ভয় পেলাম)। কারণ, ঠিক দুদিন আগেই একটা খরগোশ বমি হয়েছে, ভেবেছিলাম আর এক মাস, কি পাঁচ সপ্তাহ, বা ভাগ্য ভালো থাকলে ছ’সপ্তাহও আর চিন্তা নেই। এবার দেখো, এই সমস্যাটার একটা বেশ সহজ সমাধান আমি বার করে ফেলেছি। আমার ঐ বাড়িতে তুলসি লাগিয়েছি, সময় হলে খরগোশটা বমি করি, দিয়ে সেটাকে তুলসির টবে ছেড়ে দিই। আর তারপর মাসের শেষে যখন আবার বুঝতে পারি যে কোনও মুহূর্তে… তখন সে খরগোশটা (এতদিনে বেশ বড়সড় হয়ে গেছে সেটা) নিয়ে গিয়ে ধরো এই অফিসের ঋতুপর্ণাদিকে উপহার দিয়ে দিলাম। উনি হয়তো ভাবলেন আমার মাথায় একটু ছিট আছে, কতরকমেরই তো শখ থাকে মানুষের। ব্যাস, আর তারপর আমি ঝাড়া হাত-পা, আমার ফুলের টবে তুলসিও বাড়ছে নিজের মত, আর আমি অপেক্ষা করছি আবার একদিন সকালে আমার গলা বেয়ে উঠে আসবে সুড়সুড়ি দেওয়া নরম গরম একটা দলা, আর একটা নতুন খরগোশ সেই মুহূর্তে জন্ম নিয়ে তার পূর্বসূরীর অভ্যস্ত জীবনচক্রে ঢুকে পড়বে। অভ্যাস, অনন্যা, অভ্যাস হল ছন্দ, সেই ছন্দ যা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। ব্যাপারটা একবার এই অভ্যাসের জাঁতাকলে ফেলে দিতে পারলে মাঝেসাঝে খরগোশ বমি করে ফেলাটা আর তেমন বেদনাদায়ক থাকে না। তুমি বলবে, এতো কাণ্ডই বা করা কেন, এই সব তুলসি কেনা, ঋতুপর্ণাদি, হ্যানোত্যানো। ওইটুকু জিনিস, সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেললেই তো… কিন্তু অনন্যা, যদি কখনও তোমারও এমন হত, একটা জলজ্যান্ত খরগোশ তোমার গলা বেয়ে উঠে আসত, আর তাকে দু’আঙ্গুলে ধরে হাতের তেলোয় রাখতে তুমি, শুধুমাত্র এই সামান্য ক্রিয়াটার মাধ্যমেই তোমার সঙ্গে তখনও জুড়ে সে, একদম তোমার অবিচ্ছেদ্য অংশের মত, এই সবেমাত্র বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তবে হয়তো বুঝতে। এক মাসে অনেকটাই বদলে যায় সবকিছু, লোমগুলো লম্বা হয়ে যাবে, চোখে আসবে হিংস্র ভাব, বড়সড় হয়ে যাবে, আর ঐ লাফঝাঁপ! ভোল বদলে যাবে পুরো। অনন্যা, এক মাস মানে আসলে একটা আস্ত, সত্যিকারের খরগোশ; কিন্তু ঐ প্রথম মুহূর্তটায়, ওই তুলতুলে নরম অকাট্য উপস্থিতিটা… যেন একটা কবিতার জন্মমুহূর্ত, কবির সত্ত্বার সঙ্গে তখনও একাকার… কিন্তু কালক্ষেপে যেন আর ততটা নয়, চিঠির কাগজের সাদা চ্যাপ্টা জগতে আবদ্ধ, দূরাগত, স্বতন্ত্র।
এই সব সাতপাঁচ ভেবে আমি খরগোশটা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই মেরে ফেলব ঠিক করলাম। তোমার বাড়িতে আমার মাস চারেক থাকার কথা, তাহলে চার, কি ভাগ্য ভাল হলে তিন চা চামচ যে কোনও ধরনের মদ (জানো তো, খুব দয়া হলে জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে এক চা চামচ মদ খাইয়ে একটা ছোট্ট খরগোশ মেরে ফেলা যায়। লোকে বলে মাংসটা নাকি কদিন বাসি হলে বেশ জমে, তবে আমি… ঐ তিন কি চার চামচ মদ, আর তারপর কালো প্লাস্টিকে মুড়ে বাথরুমের নর্দমা নয়তো ভাগাড়)।
চারতলা ছাড়াতে ছাড়াতে খরগোশটা আমার তেলোর উপর ঘোরাফেরা শুরু করে দিয়েছে। আমি জানি কমলাদি দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আমার সুটকেস নিয়ে যাওয়ার জন্য… খামখেয়াল বলে চালিয়ে দেওয়া যায় কি? খান্না মোড়ের হাটে নিয়ে এসেছিল বলে কিছু একটা গপ্পো দেব? খুদে জন্তুটাকে রুমালে মুড়ে জহরকোটের পকেটে পুরে ফেলি আমি, খুব একটা আঁটোসাঁটো করি না, যাতে দম বন্ধ না হয়ে যায়। ওর খুদে চেতনায় এতক্ষণে নানা জরুরি তথ্য জমা হতে শুরু করেছে; ওর মনে হচ্ছে জীবন ক্রমাগত উপরে উঠে চলা আর শেষে একটা খুট করে আওয়াজ, আর একটা খুব নিচু ছাদ, সাদা আর লবঙ্গের গন্ধ তাতে, উষ্ণ একটা গর্তের একদম নিচে নরম করে ঘিরে রাখে।
কমলাদি কিছু লক্ষ্য করেনি। আমার আলুথালু বাক্সপ্যাঁটরার পাহাড়টার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেই বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে, আর তারপর বাড়ির নিয়মকানুন বোঝাতে শুরু করলে(‘যেমন ধর’ শব্দবন্ধটা বড্ড ব্যবহার করে কমলাদি, বিরক্তিকর!) আমার চোর চোর হাবভাব দেখে আরোই ঘেঁটে গেল। বাথরুমের দরজাটা প্রায় মুখের উপর বন্ধ করে দিয়ে এবার ওটাকে মেরে ফেলতে চাইছিলাম আমি। রুমালটায় একটা থরথরে উষ্ণতা লেগে। ছোট্ট খরগোশটা বড্ড ধপধপে সাদা, বড্ড সুন্দর, মনে হয় আগেরগুলোর থেকেও বেশি।আমার দিকে মোটেই না তাকিয়ে মনের আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছিল, যেটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকার চেয়েও খারাপ। ফাঁকা দেরাজটায় ওটাকে ঢুকিয়ে সুটকেস খুলে শুরু করলাম। একটু বিচলিত ছিলাম ঠিকই কিন্তু অন্তত অখুশি নয়, অন্তত অপরাধবোধ নয়, অন্তত হাতের তেলোয় একটা প্রাণের শেষ বার কেঁপে ওঠার অনুভূতিটা নিংড়ে ফেলতে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হচ্ছে না।
বুঝতে পারলাম, ওটাকে আমি মারতে পারব না। কিন্তু সে রাতে আমি একটা কালো খরগোশ বমি করলাম। দুদিন পর আরেকটা সাদা। আর চতুর্থ দিন রাতে ছাইরঙা একটা।
বেডরুমের মস্ত সেগুন কাঠের আলমারিটা নিশ্চয় তোমার খুব প্রিয়, কেমন দরাজ হয়ে খুলে যায়, ভিতরে সার সার ফাঁকা তাক আমার জামাকাপড়ের জন্যই যেন অপেক্ষায় বসে আছে। ওদের ওখানে রেখেছি আমি।হ্যাঁ, ভিতরেই। শুনতে বেশ অবিশ্বাস্য লাগছে জানি, কমলাদি পর্যন্ত ভাবতে পারবে না। এই যে কমলাদি শেষ অব্দি কিছু বুঝতে পারেনি তার পুরোটাই আমার হাতযশ, সারা দিন রাত ধরে পতনোন্মুখ আপেলের মত একনিষ্ঠ ভাবে কী না কী সাবধানতা আমি অবলম্বন করে যাই, সারাক্ষণ ভিতরে ভিতরে কাঁটা হয়ে থাকি, ঠিক তোমার অ্যাকোয়ারিয়ামের সাদা কালো বুড়ো মাছটার মত; আর যতবার ওটাকে পেরিয়ে স্নানে ঢুকি আমি, দেখি অ্যাকোয়ারিয়ামের একদম তলায় লাল নিল নুড়ির মধ্যে বসে রোদ শুষে নিতে নিতে রোজ আরও একটু করে বুড়ো আর গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে সে।
সকালে ওরা ঘুমোয়। দশটা আছে মোট। গোটা দিনটা ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়। আলমারির বন্ধ দরজার পিছনে শুধুমাত্র তাদের জন্য একটা অনন্ত রাত আছে, সেই রাতটা ঝিমন্ত বাধ্যতায় ঘুমিয়ে কাটায় তারা। কাজে বেরোনোর সময় বেডরুমের চাবিগুলো নিয়ে বেরোই আমি। কমলাদি নিশ্চয় ভাবে আমি ওকে সন্দেহ করি। রোজ সকালে কেমন একটা জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকায়, মনে হয় যেন কিছু বলবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকে, আর আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। (নটা-দশটা নাগাদ যখন ও বেডরুম ঝাড়পোঁছ করে আমি বসার ঘরে ধুপধাপ নানা রকম আওয়াজ করতে থাকি, নয়তো কিশোর কুমারের সিডিটা চালিয়ে দিই, আর ডি বর্মনের জগঝম্পে গোটা ঘর ভরে যায়, আর কমলাদি যেহেতু পুরনো হিন্দি গানের খুব ভক্ত তাই আলমারি থেকে আওয়াজ আসছে কিনা অতোটা বোঝাও যায় না। আর আসেও না আওয়াজ, খরগোশদের তো এটা রাত, আর রাতে বিশ্রাম করাই দস্তুর।)
রাতের খাওয়ার এক ঘণ্টা পর ওদের দিন শুরু হয়। কমলাদি গোছগাছ সেরে শুতে যাওয়ার আগে ঝনাৎ করে পানের বাটা খুলে একটা আমার হাতে দিয়ে বলে ‘গুড নাইট’ – হ্যাঁ অনন্যা, গুড নাইট, কি আজব পরিহাস, না? তারপর কমলাদি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়, আর আমি অবশেষে একা হতে পারি, আমার যত দায়দায়িত্ব আর বিষণ্ণতার সঙ্গে।
ওদের বার করে দিই, ধুপধাপ লাফিয়ে ওরা ছুট্টে চলে যায় বসার ঘরে, প্রচণ্ড উৎসাহে আমার পকেট অব্দি লাফিয়ে গন্ধ নেয় তুলসীর, আর তারপর কার্পেটের উপর যখন সেগুলো ছড়িয়ে দিই মনে হয় নতুন কোনও নকশা বুঝি, কয়েক মুহূর্তেই উধাও। খুব ভালো করে খায় ওরা, ঝটাপট, একদম নিখুঁত। ততক্ষণ আমার কিছু করার নেই, সম্পূর্ণ অদরকারি একটা বই হাতে নিয়ে সোফায় বসে থাকি আর ওদের তুলসিপাতা খুঁটে খেতে দেখি; এই আমিই নাকি ঠিক করেছিলাম অমিয়ভূষণের সবকটা উপন্যাস শেষ করে ফেলব, আর ফুকোর হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটির তিনটে খণ্ড, তোমার সবচেয়ে নিচের তাকটায় আছে যেগুলো।
ওরা দশজন। মোটমাট সবাই সাদা। বসার ঘরে তোমার বাহারি তিনটে আলোর দিকে ছোট্ট উষ্ণ মাথাগুলো তুলে ওরা তাকিয়ে থাকে, ওদের পৃথিবীর তিনটে অনড় সূর্য। আলোটা ওদের খুব পছন্দ, ওদের রাতের আকাশে তো আর চাঁদ, তারা, স্ট্রিটল্যাম্প কিছুই নেই। তিন কোণে তিন সূর্য নিয়েই ওরা যারপরনাই খুশি। আর তারপর তারা লাফিয়ে বেড়ায়, চেয়ারে, কার্পেটে। দশটা সাদা ছোপ ঘরের এদিক থেকে ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওরা শান্ত হয়ে আমার পায়ের কাছে বসে আছে, এর চেয়ে বেশি কিচ্ছু চাই না আমি। আসলে অনন্যা, যে কোনও ঈশ্বরই বোধহয় এই স্বপ্নটা দেখেন, আর সে স্বপ্ন তাঁদের কোনোদিন পূরণ হয় না। আর তার বদলে? এই একটা রামকিঙ্করের ছবিটার পিছনে গুঁতোচ্ছে, তো আরেকটা দরজার পাশে কাঠের পুতুলটার পায়ে ঘুরঘুর, পলক না ফেলতে সেখান থেকে সোজা লেখার টেবিলের তলার অন্ধকারে ঘাপটি; আর সব সময় দশের থেকে কম, হয় ছটাকে দেখা যায় নয় আটটা, আর আমি মাথা খুঁড়ে মরি, বাকি দুটো কোথায় গেল, আর যদি কমলাদি উঠে পড়ে, আর হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটির তিনটে অধ্যায়ও শেষ হল না…।
অনন্যা, এই ভার যে কী ভাবে সামলাই তা আমি নিজেই জানি না। তোমার নিশ্চয় মনে আছে তোমায় বলেছিলাম কতটা ক্লান্ত আমি, সেই জন্যই তোমার এখানে কদিন থাকতে আসা। আমি যে মাঝে মাঝে এক একটা খরগোশ বমি করে ফেলি সেটা তো আমার দোষ নয়। আর এটা আমাকে ভিতর থেকে বদলেও দিয়েছে হয়তো, মানে, এটাকে ঠিক সংজ্ঞায় বাঁধা যায় না, না জাদুও নয় ঠিক, শুধু এটুকুই বলার যে – সবকিছু একসঙ্গে সুন্দর ভাবে সংহতি বজায় রেখে তো আর বদলায় না, মাঝে মাঝে এক একটা বদল আসে যখন এক ঝটকায় সমস্তটা নাড়িয়ে দিয়ে ধাক্কা পড়ে ভয়ঙ্কর, ঠিক যেন যখন তুমি ভাবছো চড়টা তোমার ডান গালে পড়বে তখনই… মানে অনেকটা এরকমই অনন্যা, ব্যাপারটা ঠিক এটা নয় হয়তো তবে অনেকটা এই রকমই।
এই যে লিখছি এখন রাত। ঘড়িতে দুপুর তিনটে কিন্তু ওদের কাছে এটা রাত। ওরা দিনের বেলা ঘুমোয়। উফ এই অফিসটা যে কি স্বস্তিদায়ক! চিৎকার, চেঁচামেচি, কম্পিউটারে খটাখট খটাখট, টিভিতে ব্রেকিং নিউজ! কি শান্তি, কি আরাম, কি ভয়াবহ অনন্যা! ফোনটা বাজছে আবার। আবার কেউ একটা রাত জাগার অপকারিতা নিয়ে জ্ঞান দেবে হয়তো, নয় অনিমেষ কফি হাউসে আড্ডা দিতে ডাকছে… নাহ, অমৃতা। নান্দীকার ফেস্টিভ্যালের দুটো টিকিট আছে, জোর করছে যাওয়ার জন্য। ওদের না বলার সাহস হয় না, লম্বা লম্বা দুর্বল সব গল্প খাড়া করি; আমার শরীরটা খারাপ, অনুবাদের কাজ বাকি আছে অনেকটা, যা মাথায় আসে তাই। আর তারপর বাড়ি ফিরি, লিফটটা দোতলা আর তিনতলার মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতি রাতে বোকার মত নিজেকে মিথ্যে আশ্বাস দিই, গিয়ে দেখব এ সব কিছুই আমার মনগড়া কল্পনা, কিচ্ছু সত্যি নয়।
ওরা যাতে তোমার জিনিসপত্র নষ্ট না করে সেদিকে কড়া নজর রাখার চেষ্টা করছি আমি। সবচেয়ে নিচের তাকের কয়েকটা বইয়ের কোনাগুলো খেয়ে ফেলেছিল, কমলাদি যাতে বুঝতে না পারে সে জন্য ওগুলোয় নতুন কাগজ সেঁটেছি, তুমি বুঝতেই পারবে। আর সেরামিকের আর্নটা, ওটা কি তোমার খুব প্রিয়? ভাঙ্গার দাগটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে, সারারাত ধরে ওটাকে সারাই করেছি, স্পেন্সার থেকে কেনা বিদেশি আঠা দিয়ে। ওটাই নাকি সবচেয়ে ভাল, ওরা বলল। আর এখন আমি ওটার ঠিক পাশেই বসে থাকি যাতে কোনোভাবে আর একটাও থাবা বাড়িয়ে ওটার নাগাল না পায় (ওরা যখন থাবা বাড়িয়ে পিছনের দুপায়ে দাঁড়ায় ভারি সুন্দর লাগে, যেন বহুদূরের মনুষ্য জীবনের জন্য আকাঙ্খা; হয়তো বা তাদের ঈশ্বরকেই নকল করার চেষ্টা, তাদের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে হেঁটে বেড়ায় যে ঈশ্বর। আর তাছাড়া হয়তো ছোটবেলায় তুমি দেখেও থাকবে, ছানা খরগোষ্কে যদি ঐ ভাবে দেওয়ালের ধারে দাঁড় করিয়ে দাও, তাহলে ওটা ঐ ভাবেই দেওয়ালে সামনের দুপা তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে)।
ভোর পাঁচটায় (সবুজ সোফাটায় খানিক ক্ষণের জন্য লম্বা হওয়ার চেষ্টা করি, আর প্রতিটা মখমলি সরসর ঠুকঠাক টুংটাঙে জেগে জেগে উঠি) ওদের আলমারিতে ঢুকিয়ে ঘর গুছিয়ে ফেলি। কমলাদি সকালে উঠে সবই জায়গামত দেখে, যদিও মাঝে মাঝে ওকে একটু অবাক হতেও দেখেছি আমি, কোনও একটা জিনিসের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল, বা কার্পেটটা যেন বা একটু অন্য রকম মনে হল, আর আবারও ওকে দেখে মনে হয় কিছু একটা বলবে; কিন্তু সেই মুহূর্তেই আমি এমন জোরে জোরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শুরু করি যে ওর আর কিছু জিজ্ঞেস করা হয় না। তোমায় কী করে বোঝাই অনন্যা, এই সব নিঃঝুম ভোরের ছোট ছোট দুর্ঘটনাগুলো কী অসহ্য, ঘুমে ঢুলে আসা চোখে টলতে টলতে মাটি আর কার্পেট থেকে খুঁটে খুঁটে তুলসির ডাল, পাতা, লোমের গোলা বার করা আর বারবার নানা আসবাবে ধাক্কা খাওয়া। শক্তির অনুবাদটায় এর মধ্যেই পিছিয়ে আছি, অভীকদা তাড়া দিচ্ছে, বিনয় মজুমদার ধরাই হয়নি, আর তারই মধ্যে এই এক সুন্দরীর চিঠিটাও আটকে আছে আর সে না জানি এতদিনে কী না কী… কেনই বা এটা করে যাচ্ছি আমি, কেনই বা এই চিঠিটা বারবার শেষ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি কপি লেখা আর হাজারটা ফোন কলের ফাঁকে ফাঁকে।
অনন্যা, প্রিয়তমা, আমার এখন একটাই সান্তনা, দশটার বেশি আর বাড়েনি ওরা। পনেরো দিন হল শেষ ছানাটাকে হাতের তেলোতে রেখেছিলাম। তারপর থেকে আর নয়, ওরা দশ জন আর আমি আর ঐ রাতদুপুরের খেলা। ওরা বেশ বড় হয়ে গেছে এর মধ্যেই, দেখতে কুৎসিৎ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, লোমগুলো লম্বা হচ্ছে আর তার সঙ্গে বাড়ছে দৌরাত্ম্য। সারাক্ষণ তাদের হরেক রকম বায়না আর খামখেয়ালিপনা, এই কাচের বাসনগুলোর উপর ঝাঁপায়, ঐ বসার ঘরে দৌড়ে বেড়ায়, আর আজকাল এমন ধুপধাপ আওয়াজ হয় যে ওদের তাড়িয়ে সরাতে বাধ্য হই, কারণ যদি কোনোভাবে কমলাদির কানে যায় আর ও ভয় পেয়ে চলে আসে রাতপোশাক পরেই; আমি জানি ঠিক এমনটাই হবে, কমলাদি আলথালু হয়ে ছুটে চলে আসবে আর তারপর…
শুধু দশটা, তার বেশি নয়। এত সব কিছুর মধ্যে এইটুকুই আমার সুখ। এটুকুর জোরেই বাড়ি ফেরার সময় দোতলা আর তিনতলার মাঝে নিজেকে শক্ত করতে পারি আমি।
একটা মিটিং-এ যেতে হল বলে বাধা পড়েছিল। এখন তোমার বাড়িতে আরও একটা নিঃঝুম ধূসর ভোরের আলোয় বসে চিঠিটা লিখছি। সত্যিই আরেকটা দিন, অনন্যা? এই দুটো দিনের ফারাক বোঝাতে পাতার উপর কিছুটা সাদা জায়গামাত্র দেখা যাবে, গতকালের চিঠি আর আজকের চিঠির মধ্যে পার্থক্য বলতে এটুকুই বোঝা যাবে। কিন্তু এই সময়টুকুর মধ্যে যে প্রলয় ঘটে গেছে তার কথা কী ভাবে বলব তোমায়? তুমি যেখানে ঐ সাদা জায়গাটুকু দেখছ, আমি দেখতে পাচ্ছি বাঁধ ভাঙার আগের মুহূর্তে উন্মত্ত জলরাশির গর্জন। পাতার এই দিকটায়, তোমায় লেখা এই চিঠিটার এই অংশটা আমি যে মানসিক অবস্থায় লিখছি, মিটিংয়ে যাওয়ার আগের আমির থেকে তা অনেক আলাদা। ওদের রাতের কুঠুরির অন্ধকার গায়ে জড়িয়ে এখন এগারোটা খরগোশের ছানা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। হয়তো এখনও, না না এখন নয়, ঐ লিফটে ওঠার সময়েই – নাকি বাড়িতে ঢোকার সময়; কোথায় সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ এটা তো এবার যখন তখন হচ্ছে, যদি এখন হতে পারে তাহলে যখন খুশি হতে পারে এটা আমার সঙ্গে।
যথেষ্ট হয়েছে। আমি লিখছি কারণ তোমার জানা দরকার যে তোমার বাড়িতে যে অনিবার্য এবং অপ্রতিরোধ্য ধ্বংসলীলাটা চলেছে তার জন্য আমি পুরোপুরি দায়ী নই। চিঠিটা আমি এখানেই রেখে যাব। দিল্লির কুয়াশামোড়া কোনও এক ভোরে তোমার ডাকবাক্সে এই চিঠি পৌঁছলে সেটা শোভন হবে না। গত রাতে নিচের ওপরের তাকটার সবকটা বই আমি পিছন দিকে ঘুরিয়ে রেখেছিলাম, ওরা এবার ঐ তাকের নাগালও পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পিছনের দুপায়ে দাঁড়িয়ে বা লাফিয়ে তা সত্ত্বেও ওরা সেগুলো সেই চিবিয়েই ছাড়ল দাঁতে শান দেওয়ার ঠেলায়। এমন নয় যে অদের খিদে পেয়েছিল, তুলসিপাতার ভান্ডার বানিয়ে রেখেছি আমি, টেবিলের দ্বিতীয় ড্রয়ারটায়। কিন্তু না। পর্দা, সোফার ঢাকনা, ক্যালেন্ডারের কোনা, সব, সব কিছু কামড়ে টেনে ছিঁড়ে একাকার; গোটা কার্পেট জুড়ে লোমের বন্যা, আর তারপর, ওরা কাঁদতে শুরু করল। বাহারি আলোটার ঠিক তলায় গোল হয়ে আমায় ঘিরে দাঁড়ালো ওরা, যেন মুগ্ধ হয়ে দেখছে, আর তারপর হঠাৎ ওঁয়াও ওঁয়াও ওঁয়াও! আর কোনও শব্দ নেই আমার কাছে… ওরা কাঁদতে শুরু করল, এমন কান্না কোনও জন্তুকে আমি কাঁদতে দেখিনি কখনও।
কার্পেট থেকে সব লোম খুঁটে খুঁটে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম আমি, চেষ্টা করলাম সবকটা ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় মসৃণ করে দিতে। সকাল হচ্ছে, কমলাদি হয়তো তাড়াতাড়ি উঠে পড়বে আজ। আশ্চর্য, আমি আর কমলাদির ব্যাপারে ততটা চিন্তিত নই। আশ্চর্য, ওদের নতুন খেলার জিনিস খুঁজে বেড়াতে দেখেও আমার আর ভয় করছে না। আমার দোষ ততটা নয় আসলে। তুমি বাড়ি ফিরলেই বুঝতে পারবে, আমি বহু বহু ভাঙ্গাচোরা জিনিস ঐ স্পেন্সার থেকে কেনা বিদেশি আঠাটা দিয়ে একদম নতুনের মত মেরামত করে দিয়েছি। আমার যথা সম্ভব চেষ্টা করেছি বিরক্তি উদ্রেক না করার… আসলে আমার কথা ধরলে, দশ থেকে এগারোয় যাওয়াটা একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে গেল। দেখ, দশটা অব্দি ঠিক ছিল। আলমারি, তুলসিপাতা আর আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাপারটা অনেকটাই আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া গেছিল। কিন্তু এগারোটা নয়, কারণ এগারো মানেই চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় এবার বারো, আর অনন্যা, বারোটা তেরো হওয়াটাও শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর তাই এবার আমার সামনে ভোর আর একটা শীতল একাকিত্ব যেখানে সব আনন্দ ধুয়েমুছে নিঃশেষ হয়ে গেছে। অনেক কিছু মনে পড়ছে, তোমার কথা, আরও অনেক অনেক কথা হয়তো। রাস্তার উপর এই ঝুলবারান্দাটা আলোয় ভরে যাচ্ছে, শহর জেগে ওঠার শব্দ ভেসে আসে। মনে হয় না ফুটপাথে ছড়িয়ে থাকা এগারোটা খরগোশ ছানা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন হবে, হয়তো ওগুলো চোখেই পড়বে না। লোকে অন্য দেহটা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকবে, বাচ্চারা স্কুলে যেতে শুরু করার আগে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওটাকে সরিয়ে ফেলাই শ্রেয়।
*
চিত্রণ: ঋতম সেন
1 thought on “অনন্যাকে লেখা চিঠি”