অর্ণব দত্ত

“জন্মেছি ওই মুক্তির দশকে। বেঁচে আছি যে সময় – মুক্তিদাতাকে যেন কোনো একটা চেয়ারের মত দেখতে – এই টানাপোড়েনে নেশার মত গল্পের অন্য নাম জীবন। তাই সমুদ্রস্নানের আরাম আসে ওই অল্প অল্প গপ্পেই।” – অর্ণব

beggar
ভিক্ষের বাটিতে কিছু পয়সা ছড়ানো। একনজরে দেখে মনে হল, সবটা জড়ো করে গুনলে দশ টাকাও হবে না।
কোলে ছেলে। ন্যাতানো কাপড়ের উপর শোয়ানো। ভিখিরি মেয়েটা সিঁথিতে ঘষটে ঘষটে সিঁদুর লাগিয়েছে। বাচ্চা ছেলেটা, কতই বা বয়স — বড় জোর তিন চার। নেতিয়ে আছে। নাক দিয়ে সিকনি গড়াচ্ছে। বৈশাখের রোদের প্রখর তাপ ওর মুখে এসে পড়েছে। ঘুমে যেন তলিয়ে আছে ছেলেটা।
ওভারব্রিজের সিঁড়ি ভাঙছিল তন্ময়। কে যেন পা জড়িয়ে ধরেছে। ওই ভিখিরি মেয়েটা। পা ছাড়াতে গিয়ে এতসব দেখে ফেলল তন্ময়। বেজায় বিরক্ত হল।
অনেকটা সিঁড়ি ভাঙতে হবে এখন। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে তন্ময় নিজের উপরই বিরক্ত হচ্ছিল। কেন যে চোখের পর্দায় বারেবারেই ভেসে উঠছে মেয়েটার ভিক্ষে চাওয়ার কুচ্ছিত ধরণের ভঙ্গিটা। চিমনি দিয়ে গলগল কালো ধোঁয়া বেরিয়ে পরিষ্কার আকাশটাকে পর্যন্ত যেন কালো করে দেবে।
সে এক বিকট ব্যাপারই।
ভিখিরিদের মুখ ভীষণ অপচ্ছন্দ করে তন্ময়। ভিখিরি যখন ভিক্ষে চায়, তার মুখচোখে, গোটা শরীরে এমন অভিব্যক্তি ছড়িয়ে পড়ে যে — তা চোখ থেকে যদি মনে, মনটা যতটা মাথায় থাকে, তার চেয়েও বেশি থাকে তো বুকে — ভিখিরিদের কাতরানি দেখলে বুকটা ফাটে না — পরমাত্মীয় না হোক বন্ধুবান্ধব বিপদে পড়লে যদি হাত-পা গুটিয়ে নিরুপায় বসে থাকতে হয়, তবেই বুক ফাটে। আগে নয় পরে নয়, বধ্যমুহূর্তে শুধু জলের মতো।
ভিখিরির কাতরানি দেখে বুকটা ফাটে না, কেটে যায়। ক্রমাগত কাটে। ফাটার যন্ত্রণার চেয়েও কাটার জ্বালাটা নিক্তিতে মাপলে দেদার বেশি। তার উপর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ে তবে কাণ্ডটা যা হওয়ার, তা হল — খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার হেলে গরু কিনে।
মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে একা একা চিৎকার করলে কে কি ভাববে — পাগল-ছাগল, পশুপাখি, যে যা খুশি ভাবুক না। উইদাউট মাইক্রোফোনে কিছুদিন কলকাতা শহরের মোড়ের মাথাগুলোতে চিৎকার করার একটা বাসনা রয়েছে তন্ময়ের। বিস্তর চিন্তা ভাবনার পর ওর মনে হয়েছে, ভিখিরিদের করুণ মুখগুলিই ওই চেপে রাখা চিৎকারটায় দরকার পড়লে আকাশটাকে পর্যন্ত ধসিয়ে দিতে পারি এমন এক একরোখা প্রতিজ্ঞায় কাঁপিয়ে দেবে দুনিয়াটাকে।
কিন্তু কবে? সেদিনের বিদ্রোহ ও সুখের ছবি কল্পনা করতে গিয়ে কোথাও একটা আটকায়। দুশ্চর তপস্যা না করলে, হাত ঘোরালেও নাড়ু যে মিলবে না, সে হাড়েহাড়ে জেনেছে তন্ময়।
আপাতত তন্ময়ের জীবনেও চলছে ভিক্ষাপর্ব। মহাভারতের প্রকাণ্ড কাণ্ডের মতো জীবনের এই পর্যায়টি বনবাস পর্ব ভেবে আরাম পায় তন্ময়।
ওভারব্রিজের উপর ভরদুপুরেও একটা মেয়ে, ক্ষয়া চেহারা, তেমন তেমন লোক দেখলেই চোখ মটকাচ্ছে। সর্বক্ষণ পানের পিক ফেলছে। ওদের দেখেই তন্ময়ের শয়তান সম্পর্কে নিজস্ব একটা ধারণা হয়েছে। শয়তান যেন দুরারোগ্য ব্যাধি। মানুষের শরীর তার প্রিয় আস্তানা । শরীরে ঢুকে মন নষ্ট করাই শয়তানের প্রিয় কাজ। তখন মানুষ আর্তনাদ করে, মেয়েরা খানকি সাজে। চারপাশটাকে তখন শেষ দৃশ্যের মতো দেখায়। ফলে শয়তানের নির্দেশে আদতে কিছু শুরুই হয় না।
কারা যায় ওই মেয়েদের কাছে? কলকাতা শহরের অনেক জায়গায় বিশ-পঞ্চাশ টাকাতেও যৌনতা কেনা যায়। এদের দাম অবশ্য ততটা কম নয়। তবে দর তেমন উঁচুও নয়।
সত্যি কত কিছু দেখিয়েই যে ভিক্ষে করে মানুষ। সম্প্রতি জাইদুল আমেরিকা ঘুরে এসেছে। কী একটা স্কলারশিপ নিয়ে তিনমাসের জন্যে গিয়েছিল। ফিরে এসে প্রচুর বকছে। জাইদুলের স্বভাবের এই দিকটা গোঁয়ারের। ওর দেখাই নাকি প্রথম দেখা। অন্তত ও যেভাবে দেখেছে, সেই দেখাটা নতুনের সঙ্গে পুরনো মিশিয়ে এমন মজাদার যে হো হো হেসে জাইদুল কোনও তত্বফত্বের লাইন না মাড়িয়ে একথাটা বেশ উঁচুগ্রামে জাহির করবেই।
তন্ময়ের বেশ বিরক্ত লাগে। তাও শোনে। শোনে ঠিক না, কারণ জাইদুলের কথায় গন্ধমাদন থেকে বিশল্যকরণী খুঁজে নেওয়াও যথেষ্ট পরিশ্রমের কাজ। আসলে জাইদুলের সঙ্গে মেশবার একটাই কারণ, যাবতীয় বকুনির শেষে প্রথম সূর্যের মতো ওই হাসিটি আর কোনও বাচালের মুখে ও ছড়িয়ে পড়তে দেখেনি।

বাচালতা যদি দিনের শেষে হাসায়, তাহলে বাচালের রাস্তা আটকাবো না। নিজেদের সার্কেলে তন্ময়রা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ফলে জাইদুলের হাসি ও বাচালতা দুইই — বিভোর হয়ে গল্পের গরু গাছে উঠলে কেমন দেখায়, ল্যাজ মুচড়ে কোন গরু এপর্যন্ত কতজনকে বৈতরণী পার করিয়েছে, তাও বেজায় কৌতুকের এক আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। গল্পের আসর ভেঙে গেলেও জাইদুলের হাসাহাসির জেরে বন্ধুবান্ধবরা কেউ কাউকে না জানিয়ে যে যার গরু খুঁজতে থাকে। তারপর সেই গরু দিয়ে কেটে কে কিমা-কাবাব বানাচ্ছে, কে সকাল-বিকেল বাঁটের দুধ টানছে, চামড়া ছাড়িয়ে জুতোর পরিকল্পনাটাও আছে কয়েকজনের — আখেরে যা হয় — শত দায়িত্বপালন, ব্যস্ততার ভিতরই কিভাবে জানি হা হা হাসির মতো ছড়িয়ে পড়ে জাইদুলের বাচালতাটা। তাতে বিশ্ববিপ্লব না হলেও গায়ের ঘামটা শুকিয়ে যায়। ঘোর গরমের দিনে মাথার উপর ফ্যানটা ফুলস্পিডে ঘুরিয়ে যতক্ষণ খুশি বিছানায় শুয়ে থাকার মওকা পেলে তো কোনও কথাই হবে না।
এই যেমন এখন হঠাৎ উল্টোডাঙায় ঝোপ বুঝে ঢুকে পড়ল জাইদুল। আমেরিকা থেকে ফিরে, সে দেশের ভিখিরা স্কুলমাস্টার বা সরকারি কেরাণির চেয়েও নাকি ভাল জীবনযাপন করছে, এরকম একটা রিপোর্ট পেশ করেছে জাইদুল। সত্যি মিথ্যে জানেনা তন্ময়। কলকাতা শহরের বাইরে খুব দূরে কখনও যায়নি সে। একারণে সে কথা কম বলে। কলকাতা শহরটা কূপ কিনা, সে হিসেবে তন্ময় নিজেও একজন কূপমণ্ডুক কিনা, এ ব্যাপারটা নিজে বোঝা একটা অসম্ভব কাজ বলেই কথাও খুব কম বলে তন্ময়।
মাঝে কিছুদিন নানা বিষয়ে বক্তব্য রেখেছে। বাঙালির ছেলে কবিতা লিখতে পারে না, গানের গলাও নেই, কোনওভাবেই গুণীজনের পর্যায়ে পড়ে না সে — তাহলে কী তার কোনও মতামত থাকতে পারে না? এইটা ভেবেই স্বল্পভাষী তন্ময় চায়ের ঠেকে দুনিয়ার সমস্ত বিষয় নিয়ে পরচর্চা পরে আচমকা কিভাবে জানি ঝিলিক দেওয়া আলোয় জেনে গেছে, জাদা বোলনেকা নেহি হ্যায়। বিগ বসটি যে কে, যে তাকে না বলা কথার ভিতর থেকে কথা খুঁজে নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন, তা ভাবলে এবেলা ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে তো ও বেলা ফের ধুম জ্বর।
গরমের দিকে এই সময়টায় অনেকেই রোগে পড়ছে। তন্ময় নিজেও কয়েকদিন জ্বরে পড়েছিল। শরীরটা দূর্বল। কপালে হাত রেখে তন্ময়ের মনে হল জ্বরটা যেন ফের ঘুরে আসছে। এদিকে অফিস আর ছুটি দেবে না। ছুটি নিলে মাইনে কাটা। মাইনে কাটা যাওয়ার নিয়মটা বড্ড খারাপ নিয়ম। তবে সবকিছুতেই যখন জ্যাঠামশাই মার্কা কেউ একজন নিয়ম করে কোমরে দড়ি পরিয়ে তারপর টানছে, এই উপলব্ধির পরে তন্ময় মনে করছে, ফুর্তিফার্তার নিয়মটাই হল সবচেয়ে ভাল নিয়ম।
হতে পারে আবোল-তাবোল। তবু সবচেয়ে ভাল পাউরুটি আর ঝোলাগুড়। আবোল-তাবোল হলেও ব্যাপারটার ভিতর যেহেতু হা হা হি হি হো হো ঢুকে আছে, সে মাল তো আর ছাড়বেই না, একান্ত দরকার পড়লে হা হা হি হি হো হো হয়েই বেরোবে বলে একেবারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এই কৌতুকের ভেতর কিছু ভিখিরি তন্ময়ের শরীরে-মনে থেবড়ে বাটি বাগিয়ে পাঁচ-দশ পয়সার জন্যে কেঁদেকেটে রাস্তাঘাট ভাসিয়ে দিচ্ছে। নতুন জামায় কাদার ছিটে লাগলে যেমন সেই দিনটাই নষ্ট হয়ে যায়। প্রথমটায় তেমন ধরনের ঝামেলা পুইয়ে, এখন তন্ময় ব্যাপারটাকে সামলেছে এইভাবে, যস্মিন দেশে যদাচার।
সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ। বরাবরের মতো উচ্ছন্নে যাওয়ার দিক দিয়েও ভাল। আমাদের মাতৃভূমি পূণ্যবান বটে। আচমকা একটা অপারেশন থিয়েটার দেখল তন্ময়। এটা দৃশ্য হিসেবে বেজায় আশ্চর্যের। অ্যাপ্রন পরা ডাক্তার, নার্সের দল। গুরুতর অপারেশন চলছে। চারপাশে অজস্র যন্ত্রপাতি। গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। তন্ময় অনুভব করল, ওটা অপারেশন থিয়েটার নয়। বরং হিমশীতল কোনও ষড়যন্ত্র। জীবনের অধিকারগুলো ছেঁটে ফেলা হয় সেখানে। যুগ যুগ ধরে ওই যন্ত্রগুলো অমর। পালাবদল করে নিষ্ঠুর অস্ত্রোপচারকারীদের যাতায়াত। কেন, কিজন্যে এর ইতিহাস, ভূগোল খুঁজতে গিয়ে একবার দে মা ফাঁসির মতো বারেবারেই ঝুলে পড়ছে তন্ময়।
জাইদুলের দেখে আসা আমেরিকান ভিখিরিদের গাড়িবাড়ি সবই নাকি আছে। তবে সস্তার মাল সেসব। তা দুনিয়া জুড়ে ভিখিরির জীবনটা সস্তারই হওয়ার কথা। কবে কোন ভিখিরি দাবি করেছে সে একজন বিশিষ্ট মানুষ! খারাপ-ভাল, মতলববাজ, খুনি, শিষ্টশান্ত অথবা ছোটলোকি, ভদ্রলোকি সব ধরনের জীবনকে বাদ না দিলে কখনো মনেই হবে না, ভিক্ষে করাই বেশ।
জাইদুলের অনেক দেশ ঘোরা। ওর কাছে জেনে নিতে হবে, আমেরিকায় বড়রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের পিছন চুলকে নেওয়াটা সিভিক ল-সম্মতভাবে আনহাইজিনিক কিনা, ধরা পড়লে শাস্তিই বা কদ্দিনের?
তবে কলকাতার রাস্তার পুলিশ কিছু বলছে না। শিশুর দেয়ালার মতো ট্রাফিক পুলিশ হাত-পা নাড়ছে, মেয়েরা পুলিশের পোশাক পড়লে ওদের আরো সেক্সি দেখায়, এই বার্তাটি মিনিবাসের জানলা দিয়ে ওপারের তরুণী কস্টেবলটির চোখে চোখ রেখে, আশা করি তুমিও তা জানো জাতীয় হাসিটি হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়ার পরে নিশ্চিতভাবে সিটের গায়ে মাথাটি এলিয়ে গুনগুন করে গানবাজনা না করে উপায়ও তো নেই। সেই সঙ্গে এটাও ভাবতে হয়, এই টাওয়ার কে কোথায় বসিয়েছে, যার দৌলতে দিব্যি চলছে ম্যাসেজ দেওয়া-নেওয়া। দুনিয়াটা সত্যিই হা হা হো হো হি হি। এছাড়া, আরও যা কিছু জুটেছে সবই তো মাথাটাকে জট পাকিয়ে এমন বিতিকিচ্ছিরি চিজ বানাচ্ছে যে, চুল চেপেচুপে আস্ত এক বোতল নারকেল তেল মেখে স্নান না করলে হবেই না। জট ছাড়বে না আর কি!
এদিকে ভিখিরিরাও আছে যে! এত ভিখিরি কেন? খবরের কাগজে এবিষয়ে একটা চিঠি লিখবে ঠিক করেছে তন্ময়। কলকাতা শহরটা ভিখিরিতে থিকথিক করছে। হাত বাড়াচ্ছে, পা জড়িয়ে ধরছে — ঘা খেলে সময়ে সময়ে কুকুর যেমন মুখ তুলে করুণ চোখে তাকায় — কি যেন প্রার্থনা করে, হয়তো নিজের কুত্তারূপ জন্মই — সস্তার তিন অবস্থার এরচেয়ে অথেনটিক ছবি আর পেল না তন্ময়।
ভিক্ষা দেওয়া ও নেওয়া সংক্রান্ত কোনও আইন আছে নাকি? এখন প্রশ্নটা কাকে জিজ্ঞেস করা যায়, ভাবতে বসে মোবাইল নিয়ে বিস্তর টেপাটেপি করে তন্ময়।
পকেটে টাকা নেই। আজ মাসের পনের তারিখ। মাইনেটা হয় প্রতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। মাঝেমধ্যে ভদকা-হুইস্কি খাওয়ারও শখ আছে তন্ময়ের। এছাড়া, আবহাওয়া যাকে বলে আবগারি ওয়েদার, তেমনই।
ছোট্ট দুপেগ হুইস্কি হলে মন্দ হয় না। যমুনা সিনেমা হলের কাছে একটা শান্ত বার আছে। পরিবেশ ভাল। ওয়েটাররা বেশ আন্তরিক।
এই এলাকাতেও বাচ্চারা ভিক্ষে করে। বাচ্চারা তো কলকাতা শহরের সর্বত্র ভিক্ষে করছে। ইট বাজিয়ে হিন্দি ছবির চটুল গান গাইতে গাইতে ভিক্ষে করে বাচ্চারা। অপাপবিদ্ধ শিশুরা যানজটে আটকে পড়া প্রাইভেট গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়ায়।
কেউ হয়তো দু’চার পয়সা ছুঁড়ে দিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জানলার কাঁচ উঠে যায়। ভিখিরির আদৌ কোনও যন্ত্রণা আছে কিনা কে জানে! কিন্তু, লোককে ভিক্ষে করতে দেখলে প্রচন্ড যন্ত্রণা পায় তন্ময়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যেয়ের সেই ছোটগল্পটার মতো তন্ময়ের মনে হয়, কেড়ে খায় না কেন? ভিক্ষে করার চেয়ে কেড়ে খাওয়াই তো সাহসের।
তাছাড়া, দরিদ্র মানুষ, তাদের রক্ত ঘাম শুষেই পতাকা বেঁচে থাকে। নতুন কোনও পতাকা যদি আজ জন্মগ্রহণ করে — হয়তো বা তার জন্মমুহূর্তের শুভক্ষণ আবেগ, ভালবাসা, সততার মতো গুণাবলী নিয়েই জন্মগ্রহণ করবে — কিন্তু ওই আপাতত জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে ঝুলছে।
প্রশ্নটা তন্ময়ের মাথায় ঘোরাফেরা করে। অনেকটা ঘড়ির কাঁটার মতো ধীরে ধীরে ঘণ্টা-সেকেন্ড-মিনিটের হিসেব মানতে মানতে ঘোরে। একেবারে কাঁটায় কাঁটায়। ও কাঁটা যে মাপতে যাবে শক্তির কবিতার ওই লাইনটার দশা হবে তার। আগে নয় পরে নয়, বধ্যমুহূর্তে শুধু জল।
লার্জ পেগ হুইস্কির অর্ডার দিয়ে মোবাইল ঘোরাল তন্ময়। এদিকেই কোথায় একটা দিশার অফিস। ওকে ডেকে নেওয়া যেতে পারে। তন্ময়ের মনে হয়, ওদের বন্ধুদের মধ্যে দিশাই সবচেয়ে সমাজমনস্ক। সে নিজে একটা কিছুই না তবে অন্যান্যদের প্রকাশ্যেই রাগিয়ে তোলার জন্যে হাফ গেরস্থ বিশেষণটা যখন-তখন প্রয়োগ করে তন্ময়।
বউ, ছেলেপুলে নিয়ে পথে বসতে কে আর চায়। তন্ময়ের কথাটা গ্রাহ্যেই আনে না কেউ। ও একটা কথার কথা।  অথবা, কখনও সখনও ভাল খাবারের মতো চিবিয়ে খেয়ে ফাঁকা প্লেটটা তন্ময়ের হাতে ধরিয়ে দেয় বন্ধুর দল।
এদিকে ভিখিরি বেড়েই চলেছে। চিহ্ন জিনিসটা সর্বশক্তিমানের মতো। যে কোনও শুরুওয়াতের আগে চিহ্ন একটা বৈধতা দেয়। এটা মানুষের নিয়ম নয়, প্রকৃতির নিয়ম। চিহ্ন গোপনীয়তা ভাঙে। চিহ্ন এতই সত্যি যে তার রহস্যমোচনের পুরস্কার হতে পারে দুনিয়ার সেরা রূপসীর সঙ্গে সহবাস। কামকলার গভীরতম অর্থ স্পষ্ট করে দেওয়ার ক্ষমতা ধরে ওই চিহ্নই। মানুষের জীবনে যত রকমের উচ্চাকাঙ্খা আছে, তা ওই চিহ্নের এক-একটি রূপ। ভিক্ষাও তেমন চিহ্ন থেকে জাত। ম্যাথ অর্নাসের ড্রপ আউট হিসেবে আলফা-বিটা-ইনফিনিটির কোন অভেদ ভেদ করছে চিহ্নরা — কলেজ লাইফে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি তন্ময়। সেদিন ওর অন্য কোনও ব্যস্ততা ছিল। ওভারব্রিজের ভিখিরি দেখার পর তন্ময় স্পষ্ট দেখেছে, ঘরের ভেতরও ভিক্ষা করছে মানুষ। ওরা এখন অসহায় হাত বাড়িয়ে। সামান্য আশা। তবে ফুটপাত নয় — ঘরবাড়ি।
মদের অর্ডার দিয়ে তাই ভাবছিল তন্ময়।
দিশা চলে এল। দিশার জন্য আর এক পেগের অর্ডার দিয়ে তন্ময় সোজাসুজি ভাবে বলল, মানুষ কবে প্রথম ভিক্ষে করেছিল বলতো?
প্রশ্নটা শুনে চশমার কাঁচটা রুমাল দিয়ে মুছল দিশা। খুব সিরিয়াস টাইপের মানুষ সে। যা তা কিছু বলতে চায় না। একটু আগে দিশাকে মনে পড়তেই মাথায় ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। আপাতত তন্ময় চাইছে টিকটিক করে ওই কাঁটাটা শুধু ঘুরুক। চলন যেন না থামে।
সময় যদি বাইচান্স সেকেন্ডের ভগ্নাংশটুকু জন্যেও থেমে যায়, তাহলে কি হতে পারে? ব্রহ্মাণ্ডে সময় কোনও দাবিতে স্ট্রাইক ডাকলে যে বিপর্যয়টি ঘটবে! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, পৃথিবী এখনও ততটা জোচ্চোর হয়নি যে, সময়কে স্তব্ধ হয়ে যেতে হবে। কিন্তু মানুষের ইতিহাসে রোগভোগে বিরক্ত হয়ে সময় যদি কোনওদিন আর চলবে না বলে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে, তাহলে ভয়ঙ্করের চেহারা ঠিক কেমন হবে, ভেবে হাল্কা যে নেশাটা একটু জমেছিল সেটা কেটেকুটে একশা।
এই সময় দিশা বলল, ভিখিরির জন্ম মহাকাব্যে।
তন্ময় একটু ভড়কে যায় । রাস্তাঘাটে বিভিন্ন ধরণের ভিখিরি দেখা ইদানিং তার শখ হয়েছে। ভিক্ষে কখনও-সখনও দেয়ও। তবে তা মেপেজুপে। কিন্তু কাকে ভিক্ষা দেব, কে খেটে না খেয়ে ভিক্ষে করে হারেমে জীবন কাটাচ্ছে — মোদ্দা কথা ভিখিরি সম্পর্কে তন্ময় যা জানে, ওর স্থির বিশ্বাস তা লিখলে একটা থিসিস পেপার লেখা হয়ে যাবে।
সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে দিশাকে দেখে তন্ময় বলল, মানে…
হুইস্কির গ্লাসটা নামিয়ে দিশা বলল, পঞ্চপাণ্ডব তো ভিক্ষাবৃত্তিই করছেন, দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামীই তো অনেকগুলো বছর ভিক্ষেবৃত্তি করেছেন। মহাভারতটা পড়িসনি নাকি?
তা অল্পসল্প জানি। ডিটেলে জানি না। তন্ময় বলল।
দিশা বলল ওই অল্প জানলেই চলবে। তাছাড়া শিব তো ভিখিরিই। যাকে বলে রাজা ভিখিরি।
তন্ময় অবাক হল। ব্যাপারটা এভাবে কখনও ভাবেনি সে। এযুগেও অনেক মেয়ে শিবভক্ত। মাসতুতো বোন বিপাশা মেডিক্যাল কলেজ থেকে সবে ডাক্তারি পাস করেছে, সেও তো শিবের পরম ভক্ত। মেয়েদের কি ভিখিরি ভিখিরি ব্যাপারটা খুব পছন্দের? এদিকে শিবও যে ভিখিরি। তার উপর নেশাখোরও। অঙ্কাটা এখন বেজায় জটিল মনে হচ্ছে তন্ময়ের।
দিশার ব্যাখ্যা শুনে তন্ময়ের মাথাটা বেশ গরম হয়ে গেল। ও বলল, ভিক্ষার মহত্ব সম্পর্কে আর কী জানিস?
দিশা বলল, ভগবান বুদ্ধের অনুগামীদের তো অনেকই ভিক্ষু।
কথাটা খুব ঠিক। কিন্তু কলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়ায় যারা, তারা কেউ শিবও নয়, বুদ্ধের অনুগামীও নয়, পঞ্চপাণ্ডবও নয়। বরং তারা হল একটা সিস্টেমের শিকার। যে সিস্টেমের মূল বৈশিষ্ট্য এখন — তফাত বাড়াও। তফাত বাড়াতে দরকার হলে আর একটা পতাকার জন্ম দাও। ওই পতাকা অন্যভাবে যে কাজটা করতে পারে তা হল, স্রেফ মুনাফা বাড়াও।
দিশার কথার প্রতিবাদ না করে স্বগতোক্তির মতো তন্ময় বলে, আমি ঠিক জানি না। ওই মহান ভিখিরিরা সকলেই যোদ্ধা সুলভ প্রতিপত্তি নিয়ে ভিক্ষে করেছেন। সঞ্চয় ছিল না। তবে সিস্টেমকে রপ্ত করে নতুন করে সাজানো সিস্টেম তাতে দুর্বল তো হয়ইনি, বরং কোথাও একটা প্রেরণা রেখে গেছে। জীবন সংগ্রামে কাজে লাগবার মতো কিছু একটা …
বিড়বিড়ানি থামিয়ে গোটা ব্যাপারটা চেপে যেতে চাইল তন্ময়। ঠিক না ভুল এমন একটা সংশয়ে দ্বিধান্বিত ভঙ্গিমায় তন্ময় বলে, ওইসব মহান ভিক্ষের পিছনে একটা বিরাট উদ্দেশ্য ছিল। তার পরিণতিও ন্যায়ের রাজনীতি, শিল্প সংস্কৃতি…এইরকম আর কী! শীতের রাতে ফুটপাথে ভিখিরির মৃত্যুর মতো জঘন্য খবর তো সেটা হয়নি। তাই না? ভুল কিছু বললাম নাতো?
দিশা টেবিলে মুখটা ঝুঁকিয়ে চুপ করে আছে। ও অনেকটা টানতে পারে। সাত-আট পেগেও পা-ফা টলে না। সবে মাত্র তিন পেগ চলছে। দিশার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করছিল তন্ময়।
দিশার তেমন কিছুই হয়নি। আসলে জীবনকে মহাকাব্যের ধারাবাহিকতা মনে করে দিশা। জীবনের একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে দিশা মনে করে, প্রতিটি মহাকাব্য রোগভোগে ঠাসা। ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের রক্ত, ধর্ষণ, ধূর্তামি। দখলের বিরুদ্ধে পালটা দখলের কৌশলই মহাকাব্যিক ন্যায়। উপলব্ধির অভাব থেকেই যন্ত্রণা পাচ্ছে তন্ময়।
সেদিন সাত পেগ মদ্যপানের পর টলটলায়মান অবস্থায় হুশহাশ করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ট্যাক্সিগুলির একটাকেও যখন থামাতে পারছিল না তন্ময়, তখনকার কোনও এক মুহূর্তে খুব স্পষ্টভাবে দেখল, কলকাতা ময়দানে অসংখ্য ভিখিরি সমাবেশ।
মাইক্রোফোন তারস্বরে বাজছে। ওই ভিখিরির ভিড়ে একজনও শিব, বৌদ্ধ ভিক্ষু অথবা পঞ্চপাণ্ডবের ভাইদের টিকিখানাও খুঁজে পেল না তন্ময়।
প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণে বুকটা যেন কেঁপে উঠল।
ওহ, এখনও তাহলে থেমে যায় নি সময়।
আছড়ে ধ্বংস হওয়ার আগে পাগলের মতো হেসে উঠল তন্ময়।
হাতঘড়িটাই বাঁচিয়ে দিল তন্ময়কে। বহুবছর আগে এক জন্মদিনে এটা উপহার দিয়েছিল ছোড়দাদু। মানুষটা অধ্যাপনা করতেন। দামি ঘড়ির বাক্সটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, যত্ন করে পোরো। সময় বলে কথা!
বাক্সের লাল রিবন খোলার মুহূর্তে সেদিনও অকারণ আনন্দে হেসেছিল তন্ময়।
সময়ের চরিত্র নারী চরিত্রের চেয়েও দূরূহ। তন্ময় কেবল এইটুকু বুঝেছে, সময়ের কাছে হাত পাতলে ঋণ ক্রমশ বাড়ে। শোধ না করলে পাওনাদারের মতো তাগাদা। সময়ের দেনা না চোকালে শেষ পাতে সে পরিবেশন করবে গালিগালাজ।
এদিকে অংসখ্য ভিখিরি। সমাবেশের অসহ ছবি মুহূর্তে ক্রমশ সহনীয় হয়ে আসে। স-এর দোষ থাকলে যে কোনও সময়ই অতি খারাপ, দুষ্কৃতী পরিপূর্ণ। তাতে সংখ্যায় বাড়ে ভিখিরিই।
দেনা কিছু মেটাব এবার। কটা বাজে?
ঘড়িটা দিব্যি চলছে।
চিত্রণ – সপ্তক দাশগুপ্ত

1 thought on “হা হা সময়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.