জেজে প্যাকার (ব্রাউনিজ)

অনুবাদ – সুস্মিতা সরকার

সেবার আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশ কয়টি দল মিলে ক্যাম্প করতে গিয়েছিলাম ক্রেসেন্দ বলে একটা জায়গায়। সেখানে পৌঁছনোর পরদিনই আমাদের দলের মেয়েরা মিলে ঠিক করে ফেলল যে, ৯০৯ নম্বর দলের মেয়েদের ভালোমতন শিক্ষা দিতে হবে। আসলে, ওই মেয়েগুলোকে দেখার পর থেকেই আমাদের দলের মেয়েরা বেশ বিরক্ত। ওরা সবাই সাদা। আর সেই চামড়ার এমন ধবধবে রঙ, যেন চামড়া তো নয়, স্ট্রবেরি আর ভ্যানিলা আইসক্রিম মেশানো অপূর্ব এক আস্তরণ! কচ্ছপের মতন গুড়গুড় করে ওরা সবাই জোড়ায় জোড়ায় বাস থেকে নামছে। সবার কাঁধে গুটিয়ে রাখা স্লিপিং ব্যাগ। ব্যাগের উপর নানান ডিজনি চরিত্র, স্লিপিং বিউটি, স্নো হোয়াইট অথবা মিকি মাউসের ছবি আঁকা। কিছুকিছু সস্তার স্লিপিং ব্যাগে আবার রঙচটা রামধনু, ইউনিকর্ন, অথবা বড় বড় চোখের পাপড়িওলা ব্যাঙের ছবি। বেশ বোঝা যাচ্ছে ওদের বাবামায়েরা গরিব। কেউ ইগলু কুলার জাপটে ধরে দাঁড়িয়ে, কেউ আবার তুলোয় ঠাসা পুতুল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে। দেখার ভঙ্গীতে মনে হচ্ছে যেন অভিভূত হবে বলে ঠিক করেই রেখেছে।

আমরা দল বেঁধে কিছুটা এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। বাসের চারপাশে, রেঞ্জারের ঘরের আশপাশ দিয়ে, তালা দেওয়া কাচের বাক্সের ভিতরে রাখা গুপ্তধনের ম্যাপের মতন দেখতে রঙ্গিন ট্রেল গাইডের সামনে ঘুরতে ঘুরতে আরনেটা ওই মেয়েগুলোকে মাপছিল। হঠাৎ বলে উঠল, ‘এই, তোরা ওদের গায়ের গন্ধ পাচ্ছিস? ঠিক যেন ভেজা চিহুয়াহুয়া কুকুরের গায়ের বিচ্ছিরি গন্ধ, তাই না?’ ওদের দলটা কিন্তু তখনও ঢোকার গেটের মুখে, আর আমরা ওদের থেকে বেশ অনেকটাই এগিয়ে এসেছি। তবুও আরনেটা নাক তুলে হাওয়া শুঁকতে শুঁকতে এমন ভাব করছে যেন দুর্গন্ধে সত্যিই ওর নাক কুঁচকে উঠছে। লাইনের একদম শুরুতে মিসেস মারগোলিন আর আরনেটা রয়েছে লাইনের একদম শেষের দিকে। মিসেস মারগোলিন সবসময়ই আমাদের সবাইকে নিজের পিছন পিছন নিয়ে ঘোরেন। দেখলে মনে হয় যেন মা রাজহাঁস তার একপাল বশংবদ ছানাপোনা নিয়ে ঘুরছে। এমনকি ওঁকে দেখতেও মা হাঁসের মতই লাগে। গোল বলের মতন মাথায় ছোট্ট ছোট্ট করে ছাঁটা চুল, ঘাড় বলে কিছু নেই আর তার সঙ্গে অসম্ভব বড় বুক। যেমন ভারোত্তোলকরা পরে, অনেকটা সেরকম বিশাল চওড়া বেল্ট থাকে কোমরে। তফাৎ একটাই যে ওঁর বেল্টগুলো সাধারণত সস্তা সোনালী ধাতুর বা খরগোশের লোম দিয়ে তৈরী অথবা নকল সূর্যমুখী ফুলে সাজানো।

উনি আবার হামেশাই এইসব বেল্ট আমাদের প্রকৃতি বিষয়ক শিক্ষা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেন। একবার নিজের বেল্টের দিকে দেখিয়ে আমাদের বললেন, ‘সবাই দেখ তোরা, এই বেল্টটা পুরোটাই কিন্তু বানানো হয়েছে বাচ্চা পায়রার পালক দিয়ে।’ একগাদা পালক লাগানো বেল্টটা এমনিতেই কেমন যেন ভুতুড়ে মার্কা দেখতে, তার উপর, আমি যে আসলে কোনওদিন বাচ্চা পায়রা দেখিই নি, সেটা আমার কাছে আরও অস্বস্তিকর। তারপর থেকে বহুদিন, যখনই আমি বাবার সঙ্গে শহরে যেতাম সবসময় পায়রার দলের পিছনে ছোটাছুটি করে বাচ্চা পায়রা খুঁজে বেড়াতাম। কোনওদিনই খুঁজে পাই নি অবশ্য।

তবে, প্রকৃতি বিষয়ক জ্ঞানদান করাটা মোটেই ওঁর মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং, দলনেত্রী হওয়ার সুবাদে নানান ধর্মীয় শিক্ষা দিতেই বেশি পছন্দ করেন উনি। চার্চে, যেখানে আমাদের দলের মিটিংগুলো হয়, সেখানে উনি রোজকার সাধারণ ঘটনার মধ্যে কী কী ধর্মীয় রহস্য লুকিয়ে আছে, কেমন করে শয়তান সবসময় মানুষকে পাপ করতে প্ররোচিত করে, এসব ব্যাখ্যা করতে বড্ড ভালোবাসেন। ওঁর মতে এই ধরাধাম ছাড়ার আগে সব মানুষেরই বাইবেলটা জানা উচিত। সময় পেলেই উনি বাইবেল থেকে নানান প্রশ্ন করেন, আর আশা করেন যে ওঁর শেখানো উত্তরগুলো আমরা তোতাপাখির মতন গড়গড়িয়ে বলব। কিন্তু, আমাদের মধ্যে একমাত্র আরনেটাই ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারে। বাকিরা বিড়বিড় করে ভুলভাল উত্তর দেয়। আসলে, আরনেটাই শুধু মন দিয়ে মিসেস মারগোলিনের ধর্মীয় আলোচনা শোনে। আর, উনি যখন যা প্রশ্ন করেন তার ঠিকঠাক জবাব দেয়। ফলে, আজ যখন ও সাদা মেয়েদের ব্যাপারে ভেজা কুকুরের গায়ের গন্ধ বলল, মিসেস মারগোলিন এমন ভাব করলেন যেন কিছুই শুনতে পান নি। একবার তো এমন হলো যে আরনেটা টমেটো সস মাখানো ফ্রেঞ্চফ্রাই খাইয়ে আমাদের দলের পোষা গোল্ডফিশটাকেই মেরে ফেলল। পরে মিসেস মারগোলিন জানতে চাইলেন যে ঠিক কী হয়েছিল। ও অবলীলায় বলে দিল যে, গোল্ডফিশটা নাকি অনেকক্ষণ থেকেই তাক করেছিল ওর ফ্রেঞ্চফ্রাইয়ের দিকে। আর শেষ পর্যন্ত লোভ সামলাতে না পেরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর হাত থেকে একটা গোটা ফ্রেঞ্চফ্রাই ছিনিয়ে নিয়ে খেয়ে মরে গিয়েছে।

‘হ্যাঁ, তাই তো, সত্যি সত্যিই চিহুয়াহুয়ার গন্ধ!’ অক্টাভিয়া বলে উঠলো। আরনেটা বা অক্টাভিয়া কেউই কিন্তু চিহুয়াহুয়া বানানটা পর্যন্ত জানে না। এমনকি, জীবনে কোনওদিন ওই কুকুর চোখেও দেখে নি। তবুও, আমাদের স্কুলের ক্লাস ফোরের মেয়েদের কাছে শক্ত শক্ত শব্দ উচ্চারণ করার মজাই আলাদা! আরনেটা আর অক্টাভিয়া দুজনে মিলে ডিকশনারির পাতা উলটে উলটে যত নোংরা নোংরা শুনতে শব্দ খুঁজে পাবে, সেগুলো সব যেমন করেই হোক নিজেদের কথার মাঝে গুঁজে দেবে।

‘সাদা চিহুয়াহুয়া’, আরনেটা বললো। ব্যাস! যেই না এইকথা বলা, আমাদের দলের সবাই হাসতে হাসতে একেবারে পাগলের মতন অবস্থা। ড্রেমা আর এলিস তো একে অপরকে জড়িয়ে এমন হাসতে শুরু করলো যে ওদের দেখে মনে হচ্ছে যেন দুটো প্যাঁচ লেগে যাওয়া ঘুড়ি। হাসতে হাসতে অক্টাভিয়া নিজের পেটেই চাপড় মারছে আর জ্যানিস লাফাচ্ছে। কিছুতেই কারোর হাসি থামতে চায় না। এতো হাসি এর আগে মাত্র আর একবারই হেসেছিলাম আমরা। সেবার মারতেজ নামের একটা ছেলে ইলেকট্রিক সকেটে পেন্সিল ঢুকিয়ে নিজেই ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল। তারপর সারাটাদিন চরম বোকা বোকা হাসি মুখে ঝুলিয়ে ঘুরছিল। আর তাই না দেখে আমাদের মেয়েদের দলের সে কী প্রচন্ড হাসি।

‘মেয়েরা, খুব হয়েছে এবার থাম তোরা। লক্ষ্মী হয়ে থাক।’ তর্জনী নাড়িয়ে শাসালেন মিসেস হেডি। কথাগুলো সবার কানে যাবে এমন জোরে বললেও উনি এতো হালকা চালে বললেন যে বোঝাই যাচ্ছিল কথাটা না শুনলেও চলবে। হেডি অক্টাভিয়ার মা। মায়েদের তরফ থেকে আমাদের দলের সাহায্যকারী। কথা বলার ভঙ্গী এমন যান্ত্রিক যেন বোতাম টিপলে আরেকবার একই কথা একইরকম ভাবে বলতে পারবেন।

স্বাভাবিকভাবেই, মেয়েদের হাসি তো থামলোই না উল্টে হাসির তোড় যেন আরও বেড়ে গেলো। আসলে, ‘সাদা’ শব্দটাই এত হাসির কারণ। এই ক্যাম্পিং ট্রিপের প্রায় মাস খানেক আগের কথা। একদিন স্কুলে একটা ছেলে গোড়ালির থেকে অনেকটা উঁচুতে তোলা জিনসের প্যান্ট পরে এসেছে। তাই দেখে আরনেটা তাকে আওয়াজ দিয়ে বলল, ‘তুই কী সাদা নাকি রে?’ ব্যাস, তারপর থেকে সবকিছুতেই ‘সাদা’ টিপ্পুনি। কেউ যদি তাড়াতাড়ি খায়, তাহলে সে সাদাদের মতন খায়। কেউ যদি ধীরেসুস্থে খায়, তাহলে সেও নাকি সাদাদের মতন খায়। আমাদের স্কুলের দোলনাটা যখন দুলতে দুলতে সবথেকে উঁচুতে ওঠে, তখন সেখান থেকে লাফিয়ে নেমে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে সেটা এক বিশাল গর্বের বিষয়। কিন্তু, যদি কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে, যেমন আমি অনেকবার পড়েছি, তাহলে আরনেটা আর অক্টাভিয়া দুজনেই সবসময় রেডি হয়ে বসে থাকে ফুট কাটার জন্য। ওরা পরস্পরের দিকে এমন করে তাকাবে, যেন ওরা রাস্তায় বেড়িয়ে একচুলের জন্য বিশাল দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে। তারপর মাথা নাড়িয়ে শিউরে উঠে বলবে, ‘একদম সাদাদের মতন!’

শেষে অবস্থা এমন হলো যে স্কুলের একমাত্র সাদা ছাত্র ডেনিস, সেও এই সাদা শব্দটা নিয়ে মজা করতে লাগল। মারতেজ যখন ইলেকট্রিক সকেটে পেন্সিল গুঁজে দিয়েছিল, ডেনিসই সেদিকে তাকিয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল, ‘আরে, এতো একদম সাদাদের মতন কাজ কারবার’।

আটলান্টা শহরের বাইরের দিকটায় থাকলে সাদাদের কথা ভুলে যাওয়া খুব সহজ। সেখানে সাদারা যেন সেই বাচ্চা পায়রাদের মতোই, বাস্তবে থাকলেও কখনই দেখা যায় না। কেউ ওদের কথা ভাবেও না।

সবাই রিচির জামাকাপড়ের দোকানে যায়। সেখানে সাদা মেয়েদের দেখে। দেখে পোশাক নিয়ে ওদের মায়েরা কেমন ন্যাকামি করে। সবাই শহরের লাইব্রেরীর ভিতর ব্যস্তসমস্ত ব্যবসায়ীদের দেখে। কিন্তু, সেসব সাদাদের চেহারা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। বেশিক্ষণ তাদের কথা মনেই থাকে না। কিন্তু, আমাদের পিছনে যে দশটা সাদা মেয়ে, আরনেটা পরে যাদের নাম দিলো বহিরাগত, তারা যেন বড্ড বাস্তব। চাইলেও ওদের ভুলে যাওয়া যাচ্ছে না। শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের মতন লম্বা, সোজা চুল নিয়ে ওরা আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত। ওই চুলই ওদের হিংসা আর ঘেন্না করার জন্য যথেষ্ট। আমাদের কালো মেয়েদের দলের মধ্যে একমাত্র অক্টাভিয়ার চুলটাই লম্বা। আর কারোর অমন লম্বা আর সোজা চুল নেই। ওর কোমর ছাপানো চুলের দিকে তাকিয়ে আমরা ভক্তিভরে ওর সব কথা শুনি। আমাদের হাবভাব এমন যেন তাহলে আমাদেরও চুল লম্বা আর সোজা হবে। এই যেমন, ক্যাম্পের প্রথম দিন অক্টাভিয়া ঘোষণা করল, ‘কেউ যেন আমাদের নিগার না বলে, বললে কিন্তু পার পাবে না কোনোমতেই!’ ওর কথা আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনলাম, কেউ কিচ্ছু বললাম না।

প্রথম দিনের শেষে, বেশ অনেকটা সময় বাথরুমে কাটিয়ে দলের অর্ধেক মেয়ে যখন কেবিনে ফিরলো, তখন আরনেটা বলল যে ও শুনেছে ৯০৯ নম্বর দলের একটা মেয়ে আমাদের দলের ড্যাফনিকে নিগার বলেছে। দলের বাকি মেয়েদের সঙ্গে মিলে আমি তখনও মিসেস মারগোলিনের হাতে-হাতে ক্যাম্প ফায়ারের ডিনারের বাসনকোসনগুলো পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সেসব পাট চুকিয়ে আমরা যখন বাথরুমে যাচ্ছিলাম দাঁত মেজে পরিষ্কার হওয়ার জন্য তখন মাঝরাস্তায় দেখা হল আরনেটার সঙ্গে।

‘আমি পরিষ্কার শুনেছি যে মেয়েটা ওকে নিগার বলেছে, তাই না ড্যাফনি?’

এমনিতেই ড্যাফনি খুব কম কথা বলে। কথা বললে ওর গলাটা নতুন ঝিকমিক করা কানের দুলের মতন রিনরিনে আর ভীষণ মিষ্টি শোনায়। ল্যাংস্টন হিউজের জন্মদিনে ও একবার একটা কবিতা লিখেছিল। গাছ, সমুদ্র, সূর্যাস্ত, চাঁদফাঁদ দিয়ে সে এক আবেগে জবজবে কবিতা। টিচারদের ভালো লাগারই কথা। তবে যেটা বড়দের সবথেকে বেশি ভালো লেগেছিল সেটা ওর কবিতার শেষের কয়েকটা পংক্তি –

‘হে সেনা, আমার পিতা
অন্ধকারে যখন তোমার অশ্রু গড়ায়
আমার হৃদয়ে তা বৃষ্টির মতন ঝরে পড়ে!’

এমনিতে আমাদের মধ্যে যখন জিন্স পরাই দস্তুর, ও তখনও রোজ রংজ্বলা অথচ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জামা পরে স্কুলে আসে। তবে সেদিন যখন সোনালী রঙের পাতাওলা খাতাটা পুরষ্কার হিসেবে নেওয়ার জন্য ডায়াসে উঠলো, তখন একদম নতুন একটা পোশাক পরেছিল। জামাটার উপরের দিকটা ছিল ভেলভেটের আর নিচের ঘেরের জায়গাটা ছাতার মত অনেকটা ছড়ানো। কবিতাটা না বুঝলেও ড্যাফনি যখন পুরস্কার নিচ্ছিল, সব বাচ্চারা হাততালি দিলো। লোকে যেমন কমিক্স পড়ে, আমি তেমন এনসাইক্লোপিডিয়া পড়ি। তা সত্ত্বেও কবিতাটার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারি নি আমি। কিন্তু, কবিতার শেষ পংক্তিগুলো এমন অদ্ভুতভাবে মাথার মধ্যে গেঁথে গেল যে আমি কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। বাবা আর আমি যখন সকালে খেতে বসতাম, আমি সমানে বিড়বিড় করে বলেই যেতাম, ‘হে সেনা, আমার পিতা, হে সেনা, আমার পিতা, হে সেনা, হে সেনা…’। শেষ পর্যন্ত বাবা, যে কিনা আদৌ সেনাবাহিনীতে ছিল না, থিয়েটারে অভিনয় করতো, ক্ষেপে গিয়ে একদিন আমাকে হিড়হিড় করে টেনে টিচারের কাছে নিয়ে গিয়ে জানতে চাইল, ‘এর সমস্যাটা কী বলুন তো?’

ভেবেছিলাম, ড্যাফনি আর আমি হয়তো বন্ধু হবো। কিন্তু, বোধহয় আমার বিড়বিড়ানির চোটেই ও একটু ভয় পেয়ে গেল। কবিতার শেষ পংক্তিগুলোর মানে জিজ্ঞেস করে করে ওর মাথা খেয়ে ফেলার কিছুদিন পর বুঝলাম দুজন কম কথা বলা মানুষ আলাদা আলাদা থাকাই মঙ্গল। দুজনের জন্যই।

‘ড্যাফনি, ওরা যে তোকে নিগার বলে ডাকলো, তুই শুনিস নি বল?’ আরনেটা ওকে ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করল। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। চারিপাশে গাছের ওপর দিকটা আগুনের মত লাল আর মাটির দিকে অন্ধকার। যেন একটা লেস বুনে রেখেছে কেউ। আরনেটার ধাক্কা খেয়ে ড্যাফনি প্রথমে একটু কাঁধ ঝাঁকাল, তারপর আরনেটার কটমট করে তাকানো দেখে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল।

মিনিট কুড়ি পরে আমরা বাথরুম থেকে ফিরলাম। আরনেটা তখনও ৯০৯ এর মেয়েদের নিয়ে বলেই যাচ্ছে। আমরা যখন বাথরুম থেকে ফিরছি, ৯০৯ এর কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হল। ওরা খুবই ভালো ব্যবহার করল। হাত নাড়লো, এমনকি আগে পৌঁছলেও ভদ্রতা করে আমাদের ছেড়ে দিল বাথরুমটা।

সাদাদের আমরা এর আগেও দেখেছি, তবে দূর থেকে। কোনওদিন এত কাছ থেকে দেখি নি যে বুঝতে পারবো ওদের মুখ সত্যিই যেরকম টিভিতে সব সাদা মেয়েদের দেখায় সেরকম নাকি। টিভিতে ওদের দেখলে মনে হয়, যেমন জীবনিশক্তিতে টগবগ করছে, তেমন প্রেম আর বিত্ত যেন উপচে পড়ছে। এখন যখন কাছ থেকে দেখলাম, তখন শুধু এটাই দেখলাম যে দিনের গরমভাব কমে গেলেও ওরা মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে। কেউ আবার খুব আস্তে আস্তে এমনভাবে মাথাটা দোলাচ্ছিল, যেন ঘাড়ের ব্যায়াম করছে বা খুব আনন্দ হয়েছে।

‘আমরা কিন্তু ওদের মোটেই ছেড়ে দেবো না’, ফিসফিসিয়ে একটু হাঁফ ধরা গলায় আরনেটা আবার বলে উঠল। ‘আমাদের নিগার বলে পার পেয়ে যাবে সেটা মোটেই হতে দেওয়া যায় না। আমার মতে, ওদের একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার।’

স্লিপিং ব্যাগের উপর বুদ্ধের মতন পদ্মাসনে বসে কথাগুলো বলতে বলতে ওর কুচকুচে কালো চোখদুটো যেন ঝিকিয়ে উঠল। ‘মিসেস মারগোলিনকে বলেও কোনও লাভ নেই। উনি নিজে ভালো কাজ করা আর অন্যের অকাজকে ক্ষমা করে দেওয়ার কথাই বলবেন শুধু।’ যেন উত্তর দেওয়ার অযোগ্য এক বিশাল অপমান সহ্য করছে এমন ভাব করে চোখ পিটপিট করতে করতে প্রায় আধবোঁজা করে ফেলল ও। এমন সময় আমরা শুনতে পেলাম মিসেস মারগোলিন শেষ কয়েকটা বাসনকোসন গুছিয়ে ফিরে আসছেন।

কিছুক্ষণ কেউ কিচ্ছু বলল না। এমনিতেও, আরনেটার কথা বলার ভঙ্গিতেই এমন একটা রাজকীয় নোংরামি আর আত্মবিশ্বাস মেশানো থাকে যে ও কিছু বললে আর কেউ টুঁ শব্দ করে না। চার্চের ঘন্টা বাজলে যেমন চুপ করে যাওয়াটাই নিয়ম, ঠিক তেমনই। কখনও কখনও অক্টাভিয়া আরনেটার কথার সমর্থনে কিছু বলে উঠলে তবেই বাকি মেয়েরা আবার কথা বলে। কিন্তু এখন অক্টাভিয়া নিজের লম্বা চুলের গুছি নিয়ে জিলিপির প্যাঁচ লাগাতে ব্যস্ত।

‘তাহলে?’ আরনেটা আবার বলল। ওকে দেখে মনে হচ্ছে পরিস্থিতির গুরুত্ব একমাত্র ওই বুঝতে পারছে, আর ও অপেক্ষা করছে কতক্ষণে আমরা, বাকি মেয়েরা, সেটা বুঝতে পারব। সবাই একবার আরনেটা আর একবার ড্যাফনির দিকে তাকাল। যতই হোক, কথাটা তো ড্যাফনিকেই বলেছে! ও কেবিনের খালি মেঝেতে বসে মেয়েদের স্কাউট গ্রূপের বইটা এমন অবাক চোখে দেখছে যেন ওটা কোনও সাধারণ বই না, কোনও ঝকঝকে চকচকে বিদেশি জামাকাপড়ের ক্যাটালগ। শেষ পর্যন্ত জ্যানিস নিস্তব্ধতা ভাঙল। হাততালি দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, ‘এক কাজ করা যায়। ওরা ঘুমাতে তো যাবেই। আমরা তখন চুপিচুপি ওদের কেবিনে ঢুকে ওদের স্লিপিং ব্যাগে কয়েকটা পোকা ছেড়ে দেবো। তারপর যেই না ওরা পোকার কামড় খেয়ে জেগে উঠবে অমনি পিটিয়ে ছাতু করে দেবো।’ বলতে বলতে হাতের তালুতে ঘুষি মেরে হিসহিসিয়ে উঠলো জ্যানিস। এমনিতে ওর গেঁয়ো চেহারা, কথার ভঙ্গী, আর লাফিয়ে লাফিয়ে চলা দেখলে হাসি চেপে রাখা দায়। ও মুখ খুললেই আরনেটা আর অক্টাভিয়া দুজনে মিলে হাসাহাসি জুড়ে দেয়। তবে জ্যানিস কোনওদিনই সেসবে বিশেষ পাত্তা টাত্তা দেয় না। তার বদলে সমানে ওদের দুজনকে তেল দিয়ে যখন যেমন ইচ্ছে, নিজের মতামত দিয়ে যায়। ওরা দুজন অবশ্য সেসবে মোটেই কান দেয় না। বরং ভাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে জ্যানিসকে। তবুও জ্যানিস অকারণেই ছিনে জোঁকের মতন ওদের আশেপাশে ঘুরঘুর করে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওরা হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর দাবিটা কী সাদা মেয়ে? কী চাই তোর?’

‘উফ, চুপ কর তো জ্যানিস!’ নিজের চুল পাকানো ছেড়ে অক্টাভিয়া খেঁকিয়ে উঠলো এখন। ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন জ্যানিসের কথায় ওর চুল নিয়ে খেলার মজাটাই মাটি হয়ে গেল।
জ্যানিস চুপ করে গেল। ওর মুখের শান্ত হাসি দেখে মনে হচ্ছে না যে ওর একটুও খারাপ লেগেছে।

এবার আরনেটা উঠে দাঁড়ালো, ‘ঠিক আছে, আমরা একটা গোপন মিটিং করে ঠিক করব যে এই ব্যাপারে আমরা কী করতে পারি’। তাই শুনে সব্বাই বেশ গম্ভীরভাবে মাথা দুলিয়ে সায় দিল। আসলে, এই ‘গোপন’ শব্দটারই একটা নিজস্ব ওজন আছে, আলাদা দম আছে। যদিও এই ‘গোপন’ ব্যাপারটা আর কিছুই না, প্রায় পরচর্চা পরনিন্দার মতোই। যেখানে তুমি ছাড়া অন্য কারোর পিন্ডি চটকানো হবে। তবুও, এই ‘গোপন মিটিং’ বা ‘গোপন ক্লাব’ ব্যাপারটা একদমই আলাদা।

ঠিক এরপরই আরনেটা আমাকে যেন কিছুটা আলাদা গুরুত্ব দিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘এই যে নাকের সিকনি, তুই আবার মিসেস মারগোলিনের কাছে চুগলি কাটতে যাবি নাকি?’

সেই ক্লাস ওয়ান থেকেই, যেদিন আমি হেঁচেছিলাম আর নাক থেকে সর্দি বেরিয়ে আমার পাশে বসা মেয়েটির গায়ে লেগে গিয়েছিল, সেদিন থেকেই আমি এই ‘নাকের সিকনি’ নামটা শুনে আসছি।

‘কিন্তু তুই হয়তো ঠিকমতন শুনতে পাস নি, মানে আমি বলতে চাইছি…’ আমি কথাটা শেষ করার আগেই আরনেটা জোর গলায় আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই আমাদের নামে চুগলি কাটবি কিনা সেটা বল!’ ওর কথা শুনে বাকি সবাই এমন করে আমার দিকে তাকাল যেন ওরা যা করার তা ঠিক করেই ফেলেছে, আর সেটা আটকে আছে শুধু আমার জন্যই।

ক্রেসেন্দ ক্যাম্পটা আগে হাইস্কুলের ব্যান্ড এবং হকি খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার হতো। একবার মাথায় হকির বল লেগে একটা মেয়ের ডানদিকটা প্যারালাইজড হয়ে গেল। তারপর থেকেই আর হকি খেলা হয় না। বলের আঘাতে মেয়েটা কোর্টের যেখানে পড়ে গিয়েছিল, সেই জায়গাতে কিছুদিন পর মেয়েটির দলের বাকিরা নেইলপলিশ দিয়ে রং করা একটা স্মৃতিসৌধ বানাল। সেখানে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠার শুভেচ্ছা, ফুল ইত্যাদির সঙ্গে হকির বলটাও অস্ট্রিচ পাখির ডিমের মতন রাখা ছিল।

ক্যাম্পের দ্বিতীয় দিনে ৯০৯ দলের মেয়েরা যখন ওই সৌধের চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাখির মতন কিচিরমিচির করতে করতে অদ্ভুতভাবে হাত পা নাড়িয়ে নাচ করছে, আমরা তখন হকির কোর্টের পাশে যে একটা ছোট নালার ধারে সবাই মিলে বসে মাংস আর কুলারের বরফে থসথসে হয়ে যাওয়া টমেটোর স্যান্ডউইচ ধ্বংস করছি। নালার ধারে বসে খেতে খেতে আরনেটা ৯০৯ নম্বর দলের মেয়েদের মাপছে। ঝামেলাটা কোথা থেকে শুরু করবে, বোঝার চেষ্টা করতে করতে একটা গালি দিয়ে বলে উঠলো, ‘ইশ, ওই মহিলা যদি না থাকতো আমরা এখনই ওদের একদম ঠুসে দিতে পারতাম’।

ওদের দলনেত্রী প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইজিপশিয়ানদের মতন চুলের স্টাইল করা একজন সাদা মহিলা। একটা পিকনিক করার কম্বল বিছিয়ে তাতে বসে মুখের সামনে বেশ মাইক ধরার মতন করে ধরে কলা খাচ্ছেন। পাশেই একটা মেয়ে বসে সমানে ডানা ভাঙা পাখির মতন হাত নেড়ে যাচ্ছে। উনি মাঝেমাঝে যেসব মেয়েরা ব্যাঙলাফ খেলছে কিংবা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠছে বা দল থেকে দূরে চলে যাচ্ছে তাদের ডেকে উঠছেন।

‘মিসেস মারগোলিনকে নিয়ে তো চিন্তার কিছু নেই। তিনি আপাতত তার প্রার্থনা নিয়ে ব্যস্ত। আর ওদিকে মা ব্যস্ত জুতোর কাদা পরিষ্কার করতে। উফ, মা যে এখানেও আমাদের সঙ্গে এসে হাজির হয় নি, আমি তাতেই খুশি।’ অক্টাভিয়া বলল। ‘আমি খুব কায়দা করে ব্যাপারটা ম্যানেজ করেছি, বুঝলি! ওদের দুজনকেই বলেছি যে আমরা পাতা কুড়াতে যাব।’ আরনেটা খুব অহংকারের সঙ্গে একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বলল।

‘পাতা কুড়াতে যাবো! হাহা, দারুণ বলেছিস তো! বিশেষ করে ওরা এই ক্যাম্পিং ব্যাপারটা নিয়ে এমন পাগল যে এটা শুনে খুশি হবেই!’ অক্টাভিয়া ঢক করে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে উঠল। তারপর একবার আকাশ থেকে মাটিতে আর একবার মাটি থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আমি না সত্যি বুঝতে পারি না, এটাকে ক্যাম্পিং কেন বলে। কাজের মধ্যে কাজ তো আমরা একটাই করি, সেটা হলো মাটি থেকে গাছের শুকনো ডাল তুলে বলি যে আরিব্বাস, এটা গাছ থেকে ভেঙ্গে পড়েছে!’ বলতে বলতে নোংরা আঙ্গুল দিয়ে ও নিজের স্যান্ডউইচের ভিতর থেকে একটা থসথসে টমেটোর টুকরো টেনে বের করল, তারপর সেটা শুকনো পাতা আর নোংরা ভরা নালার জলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। টমেটোর টুকরোটা জলে পড়তেই বাদামি রূপালী রঙের একঝাঁক মাছ এসে সেটাকে ঠুকরাতে শুরু করল। তাই দেখে ‘দেখ, দেখ, কতো মাছ!’ বলে চিৎকার করে উত্তেজিত হয়ে জলের উপর ঝুঁকে পড়ল জ্যানিস। হঠাৎ করেই একগাদা পোকা পাশের ঝোপ থেকে উড়তে শুরু করল। অক্টাভিয়া এমন করে জ্যানিসের পিছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল, যেন পারলে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেই দেয়! ড্যাফনির দিকে তাকাতেই বুঝলাম, একই ভয় ও-ও পাচ্ছে। আসলে আমরা জানি, অক্টাভিয়া হয়তো সত্যিই জ্যানিসকে ঠেলে নালায় ফেলে দিতে পারে। জ্যানিস চট করে ঘুরে তাকাল, কিন্তু ততক্ষণে অক্টাভিয়া নিরীহ মুখে জলের দিকে তাকিয়ে। তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের সবার মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করে জ্যানিস বলে উঠলো, ‘কী ব্যাপার বলতো?’ তাই শুনে এলিস গুনগুন করে গাইতে আরম্ভ করল, ওর সঙ্গে বাকিরাও। এবার জ্যানিসও গাইতে শুরু করল, কিন্তু, অন্য একটা গান। মাইকেল জ্যাকসনের গান। দুলাইন গেয়ে বলল, ‘মাইকেল জ্যাকসনকে আমার হেব্বি পছন্দ। আমি ওকে বিয়ে করব’। বলতে বলতে জিভ দিয়ে এমন করে ঠোঁট চাটল, যেন, মাইকেল জ্যাকসন কোনও লোভনীয় খাবার। ব্যাপারটা যে আসলে অসম্ভব, সেটা নিয়ে কেউ কিছু বলার আগেই আরনেটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। চোখের উপর হাত রেখে সূর্যটাকে আড়াল করে ৯০৯ নম্বর দলের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখল যে ওরা হকি খেলার মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তাই দেখে ওর গলা থেকে আফসোস ঝরে পড়ল, ‘ইশ, যদি একা পেতাম ওদের!’

একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করলাম আমি। একলা পেলেই ওদের পিটিয়ে ছাতু করবে, এই ভাবনায় সবাই এমন মশগুল যে একবারও ভাবছে না যে ওরাও ঘুরে মারামারি করতে পারে! ‘একমাত্র বাথরুম ছাড়া ওদের কখনোই একা পাওয়া যাবে না।’ আমার কথায় সবাই আমাকে ঘুরে দেখল। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম যে কেউ আমাকে সিকনি বলে প্যাঁক দেবে। সবসময় এই প্যাঁক দেয় বলেই সাধারণত বেশি কথা বলি না আমি। যথারীতি, একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অক্টাভিয়া ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘উফ, তুই চুপ করতো, সিকনি!’ কিন্তু, আরনেটা ধীরে ধীরে মাথা দোলাল, ‘ঠিক বলেছিস, বাথরুম!’ একবার না, বারবার মাথা নাড়িয়ে বলতেই থাকলো, ‘বাথরুম, বাথরুম!’

অক্টাভিয়ার হিসেব মত আমাদের কেবিন আর ৯০৯ নম্বর দলের কেবিনের মাঝামাঝি জায়গার বাথরুমে পৌঁছাতে আমাদের পাঁচ মিনিট মতন সময় লেগেছে। বাথরুমের ভিতরে বেসিনের উপর যে আয়নাগুলো লাগানো, সেগুলো সব ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। পাইনপাতা, নোংরা, জুতোর চাপে লেপ্টে যাওয়া চুইংগাম সব মিলিয়ে বাথরুমের মেঝেটা এক অদ্ভুত ডিজাইন হয়ে আছে। মেঝের একদম মাঝখানে ড্রেনের মুখে চুল জট পাকিয়ে আটকে আছে। সিংক আর তার উপর যেখানে আয়নাগুলো লাগানো, সেখানে ধাতুর ট্রেতে হাত মোছার জন্য একগাদা সাদা কাগজ ভাঁজ করে রাখা। সিংকের উপর ভেজা কাগজ দলা করে ফুলের গোছার মতন সাজিয়ে রাখা। দাঁত ফ্লস করার কিছুটা সুতো একদলা রক্তে গোলাপী হয়ে যাওয়া কাগজের সঙ্গে পেঁচিয়ে রেখেছে কেউ। দেখেই মনে হল, ওই সাদা মেয়েগুলোর কারোর দাঁত পড়েছে নির্ঘাত।

কিছুই বদলায় নি, তবুও আজ বাথরুমটা কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছিল। ছাদের থেকে নেমে আসা ভি আকৃতির কাঠের বিমগুলো আগে আমরা খেয়ালই করি নি। এখন তাকিয়ে মনে হচ্ছে যেন হাঙ্গরের মুখের ভিতর ঢুকে হাঙ্গরের পাঁজরের দিকে দেখছি।

‘ইশ, কী নোংরা!’ এলিস বলল।

‘সেটা হাজার বার বললেও কিছু পাল্টাবে না। তবে এখানে ওরা আবার আসবে’, দরজার হাতলে হেলান দিয়ে চারিপাশে তাকিয়ে আরনেটা বলে উঠল। সবমিলিয়ে ওকে বেশ খুশি খুশি লাগছে এবার। ‘আমরা প্রথমে ভিতরে এসে খুচরো আলাপ দিয়ে শুরু করবো। এই যেমন, কেমন আছে, কতক্ষণ লাগবে, এইসব। তারপর আমি আর অক্টাভিয়া ওদের বোঝাব আমাদের কাউকে কালো নিগার বললে তার ফল কী হয়!’

‘আমিও দুকথা শুনিয়ে দেবো’, জ্যানিস বলল।

‘ঠিক আছে। তোর যা প্রাণে চায় বলিস।’ উদারভাবে মেনে নিল আরনেটা।

অক্টাভিয়ার দিকে বন্দুকের মতো আঙ্গুল তাক করে জেনিস ওর আগে থেকেই ভেবে রাখা কথাটা বলল, ‘আমরা তোদের আচ্ছা করে শিক্ষা দেব’। তারপর টিভিতে দেখা ডাকাতের মত চোখে কুটিল হিংস্রতা মিশিয়ে আবার বলল, ‘এমন শিক্ষা দেব যে জীবনে ভুলবি না।’

‘থাম তো, তুই আমাকে কমোডে হাগতেও শেখাতে পারবি না।’ ওর আঙ্গুলটা অবহেলায় সরিয়ে দিয়ে অক্টাভিয়া বলে উঠল।

‘কিন্তু ওরা যদি বলে যে আমরা নিগার বলি নি, তাহলে?’ থাকতে না পেরে আমি বলেই ফেললাম।

‘সিকনি, তুই বরং কিছু ভাবিসই না বুঝলি! তুই শুধু মারামারি করবি। মানে সেই সামান্য কাজটাও যদি তোর দ্বারা হয় আরকি!’

কাউকে কিছু না বলে ড্যাফনি চুপচাপ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। একটা পরিষ্কার কাগজ নিয়ে এমন যত্ন করে সেটা খুলল যেন সেটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপ। তারপর সবার হাঁ করা চোখের সামনে সেই কাগজটা দিয়ে ও বাথরুমের সব নোংরা পরিষ্কার করতে শুরু করল।
‘চল, এখন কেটে পড়ি।’ বলে সবাইকে ডেকে আরনেটা দরজার দিকে এগোল। বাথরুম থেকে বেরিয়েই বাইরের ঝলমলে আলোতে এসে আমাদের সবার চোখে এমন ধাঁধা লেগে গেল যে আমরা হাত দিয়ে চোখ আড়াল করলাম।

‘ড্যাফনি, তুই আসবি না?’ আরনেটা ডাকল। আমরা সবাই ওকে দেখছি, ঝুঁকে আছে, পিছন থেকে দেখে মনে হচ্ছে ও যেন একটা স্টেজের উপর, আর সমস্ত আলোর সঙ্গে সবার নজরও ওরই উপর। ঝুরো চুলগুলো আলো পড়ে প্রায় স্বচ্ছ ফাইবারের মতন দেখাচ্ছে। আরনেটার প্রশ্ন শুনেও যেমন ঝুঁকে ছিল তেমনই থাকল। হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। বরং একটু থেমে মেঝেতে পড়ে থাকা পাতা, নোংরা কাগজ, ছেঁড়া তুলোর পুতুল থেকে বেরিয়ে আসা তুলো এসব তুলে পরিষ্কার করতে শুরু করল। এত অবলীলায় কিন্তু এতো যত্ন করে করছে কাজটা যে দেখে মনে হচ্ছে যেন এই কাজটা ও শিখেছে। হঠাৎ করেই ওর পুরোনো রং ওঠা, অথচ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জামাকাপড়ের কথা মনে পড়ল। আর তখনই বুঝতে পারলাম ও আসলে বড্ড গরিব। আমি যেন মানসচক্ষে দেখলাম যে ওর মা অন্য লোকের বাড়িতে কাজ করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরছে।

‘ধুস, ছাড় তো। ও আসবে না।’ বলে আমরা পাইন পাতাটাতা মাড়িয়ে ছায়া ছায়া রাস্তা ধরে আমাদের কেবিনের দিকে হাঁটা দিলাম।

‘আমাদের গোপন মিটিংয়ের কী হবে?’ একথা জিজ্ঞেসা করতেই জোরের সঙ্গে আরনেটা বলল ‘এইমাত্র সেই মিটিংটাই তো হলো!’ এরপর আর কারোর কোনও প্রশ্ন করার বা বিরোধিতা করার জায়গাই রইল না।

আমাদের ঘুমানোর সময় হয়ে এলেও তখনও সূর্য ডোবেনি।

‘ওই যে, তোর মা আসছে’, মিসেস হেডিকে নাক টানতে টানতে কেবিনের দিকে আসতে দেখে আরনেটা অক্টাভিয়াকে বলল। উনি যখন ধর্মকর্মের ঘ্যানঘ্যানে জ্ঞান দেন না, বুঝতে হবে তখন ওঁর মন খারাপ। কিছুদিনের মধ্যেই ওঁর যে ডিভোর্স হবে, সে কারণে মনখারাপ করে থাকেন। হয়ত কথাই শুরু করলেন, ‘আমি জানি না আমি আর অক্টাভিয়া না থাকলে রবার্টের কী হাল হবে! কে যে ওকে সিগারেট কিনে দেবে!’ এরকম হলেই অক্টাভিয়া এমন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে! ফিসফিস করে মাকে শাসায়, ‘মা!’, যার আসল মানে, ‘মা, দয়া করে চুপ কর। আমাদের নিজেদের সমস্যা, সবার সামনে না বললেই কি নয়!’ কিন্তু মিসেস হেডি যখন তার স্বামীর কথা ভেবে কথা বলতে শুরু করেন, আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়েও স্বামীর মুখ দেখতে পান তখন তাকে থামায় কার সাধ্য! উনি নিজের দুঃখে নিজেই এমন বুঁদ হয়ে থাকেন, যে কেউ সেই দুঃখের থেকে তাকে টেনে বের করতে পারবে না। একমাত্র ‘ব্রাউনি’ গানটাই তাকে একটু আনন্দ দিতে পারে। ওঁর মনখারাপ থাকলে যদি আমরা চুপচাপ থাকি, বলবেন, ‘তোরা তো জানিসই কোন গানগুলো আমার শুনতে ভালো লাগে, সেগুলোর একটা গান ধর না রে!’ তাই শুনে আমি আর ড্যাফনি ছাড়া আর সবাই খুব বিরক্ত হয়। আমি খুব একটা বিরক্ত হই না কারণ আমার নিজেরই ওই গানগুলো বেশ পছন্দ। তখন ‘ব্রাউনি গানটা মায়ের সবথেকে বেশি পছন্দ চল, সবাই মিলে শুরু করি’, বলে অক্টাভিয়া সবাইকে নিয়ে গাইতে শুরু করে।

বেশ আনন্দ উচ্ছ্বাসের হওয়া সত্ত্বেও গানটা সবার খুব অপছন্দের। তাই এক আমি ছাড়া আর সবাই এমন লেলিয়ে লেলিয়ে গায় যেন রেকর্ড খারাপ হয়ে গিয়েছে আর এর থেকে ধীরে হতেই পারে না।

‘বাঃ, খুব সুন্দর হয়েছে, তাই না লিন্ডা?’, বলতে বলতে কেবিনের দরজা বন্ধ করলেন মিসেস হেডি।

পরদিন হাতের কাজের জন্য পপসিকল স্টিক গুনে গেঁথে রাখতে ব্যস্ত মিসেস মারগোলিন মাথা না তুলেই সাড়া দিলেন, ‘ভগবানের নাম করো’।

খুব খুশি হয়ে মিসেস হেডি আমাদের আরেকটা গান গাইতে বললেন। এতো খুশি দেখে আমার এক মাতালের কথা মনে পড়ে গেল।

‘ওহ, ভগবান! মা এবার থামো!’ ফিসফিস করে আরনেটাকে বলে উঠল অক্টাভিয়া। মায়ের কান এড়িয়ে বলার চেষ্টা করলেও ওঁর কানে ঠিকই গেলো কথাটা। উনি কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।

দৌড়ে গিয়ে মিসেস হেডির হাত ধরে আরনেটা বলে উঠলো, ‘যেও না, আমরা আরও গান গাইব।‘ তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চল, আমরা একটা গান গাই ওঁর জন্য’। বলে এমন একটা গানের কথা বলল, যে গানটা আবার আমার একদম ভালো লাগে না।

গানটা কেউ শুরু করার আগেই মিসেস মারগোলিন রে রে করে তেড়ে উঠলেন, ‘না না, ওইসব হাবিজাবি গান না, এমন একটা গান কর, যেটা এখন ওঁকে মানসিক শান্তি দেবে। এই জাগতিক কূটকচালির ঊর্ধে উঠিয়ে ওঁর মন ভালো করে দেবে’।

বিরক্তিতে আরনেটা আর অক্টাভিয়া চোখ ঘোরালো। আমরা সবাই জানি উনি কোন গানটার কথা বলছেন। কেউ, মানে কেউই সেই গানটা গাওয়ার জন্য সিকি পরিমাণ আগ্রহী নয়। ‘দয়া করে যেন ওই ডোনাটের গানটা গাইতে বলবেন না!’ একজন করুণ সুরে আবেদন জানাল।

‘ওই জঘন্য গানটা গাইতে না হলে আমি একবার কেন, দুবার দাঁত মাজতে রাজি আছি’।

আমাদের আবেদনে পাত্তা না দিয়ে ‘শুরু কর তোরা’, বলে হুকুম করায় বাধ্য হয়েই আমরা গান জুড়লাম। ‘যীশু ছাড়া জীবনটা যেন একটা ডোনাট, যার মাঝে অসীম শূন্যতা…’ এমনিতে গানটা বেশ লম্বা, কিন্তু, আমরা প্রথম অংশটুকু গেয়ে ওঁর দিয়ে তাকালাম, বোঝার জন্য যে উনি আমাদের রেহাই দেবেন কিনা! দেখি ওঁর চোখ আধবোজা, প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছেন।

‘আহারে, বেচারার আজ বড্ড খাটনি গিয়েছে।’ মিসেস মারগোলিন যেন একটা মিষ্টি বাচ্চা, এমন করে বললেন মিসেস হেডি।

‘সত্যিই তাই। তোমরা যদি কেউ কিছু না মনে করো, আমি বিছানায় যেতে পারলে বেঁচে যাই। অপারেশনের পর থেকে আর আগের মতন খাটতে পারি না’।

আমি এই অপারেশনের ব্যাপারে কিছুই শুনি নি কোনওদিন। উনি তো সপ্তাহান্তের ব্রাউনি মিটিং কোনওদিন বাদ দেন নি, তাহলে এই অপারেশন কবে হলো! কে জানে! ড্যাফনির মুখ দেখে মনে হলো ও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বাকিদের মুখ দেখে মনে হলো ওরা ধরেই নিয়েছে যে এই অপারেশন নির্ঘাত অনেক দিন আগে কখনও হয়েছে। তারপরেও বেশ দুঃখী দুঃখী মুখ বানিয়ে রেখেছে ওরা। আমরা সবাই জানি বড়দের জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট থাকে। ট্যাক্স দেওয়া, বিল মেটানো, অক্লান্ত পরিশ্রম, সাদাদের সঙ্গে যোঝা, শরীর খারাপ আর মৃত্যু। তাই ওদের মতন আমিও চেষ্টাচরিত্তির করে মুখটা দুঃখী দুঃখী করে রাখলাম।

‘নিশ্চয়ই লিন্ডা, তুমি শুতে যাও, আমি মেয়েদের দেখে রাখব।’ মিসেস হেডি মুহূর্তের জন্য নিজের ডিভোর্সের কথা ভুলে বলে উঠলেন। মিসেস মারগোলিন সারি দিয়ে রাখা আমাদের স্লিপিং ব্যাগগুলো পেরিয়ে নিজের স্লিপিং ব্যাগের সামনে গিয়ে রাতের পোশাক গুছিয়ে নিলেন। ওঁকে দেখে মনে হচ্ছে যেন খুব কষ্ট হচ্ছে কাজটা করতে। তারপর ব্রাশ, মাজন, বালিশ বগলদাবা করে যাওয়ার সময় বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তাহলে যাচ্ছি। তোরা দেরি করিস না যেন, ন’টার ভিতর শুয়ে পড়িস।’ ওঁর বলার ভঙ্গিতেই এমন কিছু ছিল যে আমরা বুঝে গেলাম একটু আধটু দুষ্টমি করলে উনি কিছু বলবেন না। আর একটু দেরি করে শুতে গেলেও সেটা মেনে নেবেন।

উনি চলে যেতেই আরনেটা সবাইকে বললো ‘চল, আমরাও হাত, মুখ ধুয়ে আসি।’

সবার চোরা চোখ মিসেস হেডির উপর। যতই হোক রাত হয়ে গিয়েছে! উনি কি আমাদের সঙ্গে আসবেন? তাহলে তো ৯০৯ নম্বর দলের সঙ্গে আমাদের যে মারামারি করার প্ল্যান, সেটা তো আর সম্ভব নয়। ওরা এখন বাথরুমে গিয়েছে, মুখ হাত ধুচ্ছে। আমাদের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। এটাই সুবর্ণ সুযোগ।

একটু বাজিয়ে দেখার জন্যই আরনেটা বলল, ‘আমাদের তো বেশিক্ষণ লাগবে না। তাছাড়া আমরা যথেষ্ট বড় হয়েছি, আমরা নিজেরাই বাথরুমে যেতে পারি, তাই না?’

একটু দ্বিধান্বিত মিসেস হেডি ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবলেন, ‘তা অবশ্য ঠিক। তোরা অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছিস। তোরা এখন আর ব্রাউনি দল না, প্রায় স্কাউট দল হয়ে গিয়েছিস’।

‘ঠিক কথা। আর একটা ব্যাজ পেলে আর মাত্র এক লাখ বিস্কুট বিক্রি করতে পারলেই আমরা স্কাউট দল হয়ে যাবো।’ সবাই মিলে বলে উঠল। অক্টাভিয়া আমাদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ইঙ্গিত করল, ‘এই আমাদের সুযোগ’, যদিও ঠিক কিসের সুযোগ আমি বুঝলাম না।

শেষ পর্যন্ত মিসেস হেডি কেবিনের দরজা পর্যন্ত এলেন, যেখানে বিরক্ত মুখে অক্টাভিয়া দাঁড়িয়ে ছিল। এসে অক্টাভিয়ার থুতনি ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোরা সবাই লক্ষ্মী হয়ে থাকবি তো?’

‘নিশ্চয়ই মা।’

‘প্রার্থনা করতে ভুল হবে না তো? যদি ফিরে এসে দেখিস আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, তাহলে আমার আর তোর বাবার নামে প্রার্থনা করবি তো?’

‘অবশ্যই মা!’

বাকি সব মেয়েরা যতক্ষণ টুথব্রাশ, আর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। আমি ছবি আঁকতে শুরু করেছি। ড্যাফনি নিজের স্লিপিং ব্যাগে বসে বই পড়ছে।

‘তোরা যাবি না?’ অক্টাভিয়া জিজ্ঞেস করল।

ড্যাফনি মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। আমিও যেতে রাজি নই। ‘ড্যাফনি আর মিসেস হেডি যখন যাবে, আমি ওদের সঙ্গেই যাবো।’

আমার কথা শুনে আরনেটা মিসেস হেডির কান বাঁচিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ‘আজ্ঞে না সিকনি। আমরা যদি কোনও ঝামেলায় পড়ি, আপনিও সেই ঝামেলা এড়াতে পারবেন না।’

টর্চ জ্বালিয়ে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। কয়েক ঘন্টা আগে গাছের ডালপালা যেগুলো আমাদের ছায়া দিচ্ছিল, সেগুলোই এখন যেন হাত বাড়িয়ে খেতে আসছে। তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে কেউ যেন নুনের কৌটো উপুড় করে দিয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে তারাগুলো যেন এক পবিত্র উচ্চতায় স্থির হয়ে রয়েছে আর ওদের নিচে আমরা সামান্য কিছু মানুষ অস্থিরতায় কিলবিল করছি।

আমারা কয়েকজন চুপচাপ হাঁটছি, কারণ অন্ধকারে আমাদের ভয় করে। আবার কয়েকজন পাগলের মতন বকবক করছে। আসলে ওরাও অন্ধকারে ভয় পাচ্ছে।

‘আরিব্বাস, কত্তো তারা! এখানেই যেন যত তারা দেখা যায়। কই আমাদের ওখানে তো এতো তারা দেখা যায় না!’ আকাশের দিকে তাকিয়ে ড্রেমা বলল।

‘আরে, আমরা ক্যাম্প করতে এসেছি না! ক্যাম্প করতে এসে আকাশে তারা দেখা বাধ্যতামূলক!’ অক্টাভিয়া বলে উঠল।

‘আমার মা’র রুম-ফ্রেশনারের গন্ধ পাচ্ছি যেন!’ জ্যানিস একথা বলতেই এলিস বলল, ‘এগুলো সব পাইন গাছ। তোর মা হয়তো পাইন গন্ধওলা রুম ফ্রেশনার ব্যবহার করে।’ তাই শুনে জ্যানিস এমন জোরে ‘ওওও…’ বলল, যেন বিশ্বের সবথেকে বড় রহস্যের সমাধান হলো।

আমরা কেউই কিন্তু মারামারির ব্যাপারে টুঁ শব্দটি করছি না। এমনিতেই সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে আছি এই ভুতুড়ে গাছপালা ভরা অন্তহীন অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। আমি আবার মারামারি ব্যাপারটায় বেশ ভয় পাই। এদের এই মারামারি করার প্ল্যানটাও আমার পছন্দ হয় নি। তবুও এই মুহূর্তে নিজেকে এই দলের অংশ বলেই মনে হচ্ছে। যেন বিশাল কিছুর প্রতিবাদ করতে চলেছি! আরনেটা সামনে হাঁটছে। আমরা ওর পিছন পিছন ঢালু রাস্তা দিয়ে সাবধানে ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছি।

‘একটা কথা ভেবেছিস? ওদের লিডার ওদের সঙ্গেই থাকবে। নাহলে ওরা কেউই আসবে না। এখন তো অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। কাল দিনের আলো থাকতে থাকতেই সব সেরে নিয়েছিল। আমার মনে হয় আজকেও তাই হবে।’ কথাটা আমি বললাম। আরনেটা এমন ভান করল যেন শুনতেই পায় নি। ও যেদিকে তাকিয়ে ছিল, সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম আমরা প্রায় বাথরুমের সামনে পৌঁছে গিয়েছি। অন্ধকারে বাথরুমের চৌকো আলো দেখা যাচ্ছে।

মেয়েগুলো সব ওখানেই ছিল। দেখতে পাওয়ার আগেই ওদের গলা শুনতে পেলাম।

‘এক কাজ করা যাক। প্রথমে অক্টাভিয়া আর আমি মিলে যাই। ওরা ভাববে মাত্র দুজন আমরা। তোরা কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করবি। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা বলছি, ‘আমরা তোদের আচ্ছা করে শিক্ষা দেবো’ তোরা ভিতরে ঢুকবি না। তোরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকলে ওরা যা চমকে যাবে না!’ আরনেটা বলল।

‘কিন্তু, ওই কথাটা তো আমার বলার কথা!’ জ্যানিস বলল।

ওর কথায় সাড়া না দিয়ে আরনেটা ভিতরে ঢুকে গেল। পিছন পিছন অক্টাভিয়া আর জ্যানিসও। বাকিরা বাইরেই অপেক্ষা করছি।

ওরা ভিতরে যাওয়ার পর প্রায় মিনিটখানেক কেটে গিয়েছে। কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে মনে হচ্ছে। আরনেটা এখনও কোনও সংকেত পাঠায় নি। আমি বাইরে থেকেই শুনতে পেলাম ৯০৯ নম্বর দলের একটা মেয়ে জোর দিয়ে বলে উঠল, ‘না, এরকম কিছু মোটেই হয় নি!’ ওরা যে একেবারে অস্বীকার করবে তা তো জানা কথাই। যেটা আশা করি নি সেটা হলো ওই গলার আওয়াজ। মেয়েটার গলাটা এমন শোনালো যেন ওর জিভটা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। ‘ওই শব্দটা একটা খারাপ কথা, আর আমরা মোটেই খারাপ কথা বলি না।’ মেয়েটা আরও জোর দিয়ে বলে উঠল।

‘চল, আমরা ভিতরে যাই।’ এলিস বলল।

‘যদি ওরা আমাদের ধরে পেটায়! আমি যাবো না।’ ড্রেমা বলল।

‘সিকনি, তোর কী মনে হয়?’ ওর টর্চটা নিভিয়ে এলিস আমাকে জিজ্ঞেস করল।

এই প্রথম কেউ আমার মত জানতে চাইল। আমি অবশ্য বুঝতেই পারছি ওরা কেন আমার মতামত চাইল। আসলে ওরা ভয় পাচ্ছে।

‘আমার মনে হয় আমরা ভিতরে যাই। একবার দেখি তো, কী হচ্ছে ভিতরে!’

‘কিন্তু, আরনেটা তো কোনও সংকেত পাঠায় নি আমাদের। ওর তো বলার কথা যে, আমরা তোদের আচ্ছা করে শিক্ষা দেবো; আমি তো ওকে এটা বলতে শুনি নি!’ ড্রেমা একটু গাঁইগুঁই করছে।

‘আরে, চলই না। দেখিই না একবার ভিতরে গিয়ে।’

আমরা ভিতরে ঢুকলাম। সেখানে একটা বড় চেহারার মেয়ের পাশে পাঁচ-ছ জন মেয়ে জটলা করে দাঁড়িয়ে। ওই বড় চেহারার মেয়েটার গলাই যে আমরা বাইরে থেকে শুনেছি তা বুঝতে আমার একটুও সময় লাগল না। আমরা ভিতরে ঢোকা মাত্র আরনেটা আর অক্টাভিয়া আমাদের কাছে ঘেঁষে এল।

‘জ্যানিস কই?’ এলিস একথা জিজ্ঞাসা করা মাত্রই আমরা একটা কমোডের ফ্লাস করার আওয়াজ শুনে বুঝে গেলাম ও কোথায়।

‘আমার মনে হয় ওরা রিটার্ডেড। প্রতিবন্ধী।’ অক্টাভিয়া ফিসফিস করে বলল।

‘মোটেই না! আমরা মোটেই রিটার্ডেড নই’, বড় চেহারার মেয়েটা প্রতিবাদ করে উঠল। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছিলো যে ওরা সবাই মানসিক প্রতিবন্ধী।

‘বুঝেছি, ওরা নির্ঘাত ভান করছে!’ আরনেটা যেন নিজেকেই বলল।

অক্টাভিয়া ওর দিকে ফিরে বলল, ‘চল, আমরা বরং কেটে পড়ি’। এমন সময় জ্যানিস বাথরুমে ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। দেখেই মনে হচ্ছে খুব শান্তি পেয়েছে। আর হঠাৎ করেই ওর মনে পড়ে গেল যে ওর কিছু বলার কথা ছিল। ওই বড় চেহারার মেয়েটার দিকে আঙ্গুল তুলে বলে উঠল, ‘আমরা তোদের আচ্ছা করে শিক্ষা দেবো।’

‘ওহ, তুই চুপ করতো!’ কথাটা আরনেটা বলল বটে, কিন্তু জ্যানিস সত্যিই চুপ করবে সেটা যে ওর ইচ্ছে নয়, সেটা ওর বলার ভঙ্গিতেই বোঝা গেল। ওর মুখটা দেখে মনে হচ্ছে যেন ওর প্ল্যান ভেস্তে যাওয়ায় ও খুব দুঃখ পেয়েছে। অক্টাভিয়া এবার বড় চেহারার মেয়েটার দিকে ফিরল, ‘আমরা চলে যাচ্ছি। তোদের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। আর আমরা যে এখানে এসেছি সেটা কাউকে বলার দরকার নেই, ঠিক আছে?’

‘কেন বল তো? কাউকে বলব না কেন?’ যেন ইচ্ছে করে জ্বালানোর জন্যই বলল মেয়েটা। ও যখন কথা বলছে, ওর ঠোঁট দুটো মিলছে না, মুখটা বন্ধ হচ্ছে না। ওর জিভটা টাগড়ায় এমন করে আটকে আছে যেন একটা গোলাপী রঙের মাছ। ‘বুঝেছি, তোরা ঝামেলায় পড়বি, তাই তো! আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি।’

আরনেটা আবার ওর স্বাভাবিক ধূর্ততার সঙ্গে বলল, ‘যদি কিছু বলিস আমাদের নামে, তাহলে সবাই বলবে যে লাগানিভাঙানি করা স্বভাব!’

মেয়েটা এক মুহূর্তের জন্য দমে গেল, তারপর মুখটা জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল, ‘আমার খুব পছন্দ লাগানিভাঙানি করা!’

যেই না ৯০৯ নম্বর দলের লিডার ওদের সান্ত্বনা দিতে শুরু করলো, ‘এটা কোনও ব্যাপার না। সব ঠিক হয়ে যাবে’, দলের সবাই মিলে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওদের দেখলে মনে হবে যেন কেউ ওদের একসঙ্গে কাঁদার নির্দেশ দিয়েছে। দলের লিডার কয়েকটা মেয়েকে হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে, আর বাকি মেয়েরা ওনাকে ঘিরে জটলা করে আছে। একবার ঘুরতে গিয়ে একপাল শুয়োর দেখেছিলাম, বাচ্চা শুয়োরগুলো সব দুধ খাওয়ার জন্য মায়ের পেটের নিচে গুঁতোগুঁতি করছিল। এখন ৯০৯ দলের মেয়েদের জটলা দেখে ওই শুয়োরের পালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ওই বড় চেহারার মেয়েটা আমাদের কথা সবাইকে বলে দেবে এই হুমকি দেওয়ার একটু পরেই ওদের দলের লিডার বাথরুমে এসে হাজির হয়েছিলেন। তারপর ক্যাম্পের রেঞ্জার এসে সব শুনে রেডিও মারফৎ মিসেস মারগোলিনকে ডেকে পাঠালেন। ড্যাফনি আর উনি তাড়াহুড়ো করে এসে হাজির হলেন। এরপর রেঞ্জার চলে গেলেও আর সবাই মিলে মশা তাড়াতে তাড়াতে বাথরুমের বাইরেই জটলা করে দাঁড়িয়ে আছি।

মিসেস মারগোলিন খুব রাগী গলায় বললেন, ‘ওরা অবশ্যই ক্ষমা চাইবে। তারপর, একবার ওদের বাবা মায়ের কানে খবরটা পৌঁছাক, মজা কাকে বলে টের পাবে সবাই।’ কথাগুলো ৯০৯ নম্বর দলের লিডারকে বললেও আমি জানি উনি আসলে আমাদেরকেই শাসানি দিলেন।

‘এটা কোনও ব্যাপার নয়, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বলে মিসেস মারগোলিনকে সান্ত্বনা দিলেন ৯০৯ নম্বর দলের লিডার। একটু আগে ওঁর দলের মেয়েদের যেভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, এখন মিসেস মারগোলিনকে দেওয়া সান্ত্বনার সঙ্গে তার কোনও তফাৎ নেই। পুরো সময়টা উনি হাসি হাসি মুখ করে রেখেছেন। সেই যে টিভিতে কিছু মহিলাকে দেখায় না, যারা হাসি মুখে কথা বলতে বলতে পেঁয়াজ কাটে, ওঁকে তেমন দেখতে লাগছে।

‘দেখুন, এটা হতেই পারে যে এরকম কিছু ঘটেছে। আমি বলব না আপনার মেয়েরা বানিয়ে বানিয়ে বলেছে। আমার মেয়েরা এই অকাজটা করতেই পারে। কিন্তু, আমার মেয়েরা রিটার্ডেড নয়। ওরা হয়তো একটু দেরিতে সবকিছু শেখে কিন্তু তাই বলে ওরা মোটেই রিটার্ডেড নয়।’ প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে উনি বললেন। মাথা নাড়ানোর চোটে ওঁর থলথলে গালদুটো নড়ছিল। তারপর আমাদের জানালেন ওদের স্কুলের নাম। এটাও বললেন যে ওখানে অনেক ছাত্রছাত্রীর একটু আলাদা যত্ন দরকার। ওরা স্পেশাল। এই কথাগুলো উনি এতো মিষ্টি করে ধীরে ধীরে বললেন, যেন আমরাও সবকিছু শিখতে সময় নিই।

‘এরপর আমরা আর নিজেদের মতন বাথরুমে আসতে পারবো না’, বড় চেহারার মেয়েটা বলল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারবে। তবে আমার মনে হয় আগে আমরা স্কুলে ফিরি, তারপর’।

‘আমি মোটেই ততদিন অপেক্ষা করতে চাই না। আমি আমার স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার ব্যাজ চাই!’

আমাদের দলের মেয়েরা কেউ একটাও কথা বলছে না। আরনেটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখুনি কেউ ওকে ভয়ানক অত্যাচার করবে আর ও ভেঙে না পড়তে বদ্ধপরিকর। মিসেস মারগোলিন ঠোঁট চেপে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করলেন, ‘দয়া করো, হে ভগবান, ওদের করুণা করো’।

অন্যদিকে ওদের দলের লিডার সোৎসাহে কথা বলেই যাচ্ছেন। ওঁর হাসিটা ওঁকে ঘিরে যেসব মেয়েরা জটলা করে আছে, তাদের মতোই লাগছে কিছুটা। ‘এদের মধ্যে কয়েকজন আছে যারা ইকোল্যাহিক’। বলতে বলতে তিনি ওঁকে ঘিরে থাকা মেয়েদের মধ্যে একটা মেয়েকে এগিয়ে দিতেই মেয়েটি ভয়ে চোখ বড় বড় করে নিজেকে আড়াল করে ফেলল। মেয়েটার আচরণে মনে হচ্ছে যেন সবার স্বার্থে ওকে বলি দেওয়া হবে। উনি আরও বললেন, ‘যারা ইকোল্যাহিক, তারা যা শুনবে তাইই বলতে থাকবে বারেবারে। আসলে, সেজন্যই ওদের ইকোল্যাহিক বলা হয়। মানে আমার বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু কী বলুন তো, সবার বাবা মা-ই যে দারুণ প্রগতিশীল, তা তো নয়। হতেই পারে ওরা একটা খারাপ শব্দ শুনে সেটাই বারেবারে বলে। কিন্তু এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে ইচ্ছে করে খারাপ শব্দ বলবে না ওরা কেউই।’

‘ওই যে ও বলেছে, আমি ওর মুখেই শুনেছি’, বলে একটা ছোট মতন মেয়ের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে উঠল আরনেটা। তাই শুনে ওদের দলের লিডার মাথা নাড়িয়ে হেসে ফেললেন,

‘সেটা হতেই পারে না। ও একদম কথা বলে না। বলতে পারে না তা নয়, কিন্তু বলে না।’

‘তাহলে ও নয় মনে হয়।’

এই সময় ওই মেয়েটা এমন করে হাসল যেন ওকে কেউ কমপ্লিমেন্ট দিয়েছে। আমাদের দুই দলের মধ্যে একমাত্র ওই দলের ইউনিফর্ম পরেছে। ও আরনেটার দিকে এগিয়ে এসে খুব গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, ‘দেখলি তো, আমি একজন ব্রাউনি, এসব খারাপ কথা বলি না’। মেয়েটাকে দেখে এটা কল্পনা করাও কষ্টকর যে ও কাউকে নিগার বলবে। ওকে এতো খুশিখুশি দেখাচ্ছে যেন কেউ না আটকালে এখন কোনো বিশাল ভালুককে দেখলে তাকেও জড়িয়ে আদর করবে।

চতুর্থদিন সকালবেলায় আমরা বাড়ি যাওয়ার জন্য বাসে উঠলাম। আগের দিন আমরা পপসিকল দিয়ে ছোট ছোট চার্চ বানিয়েছি। কেবিন থেকে একদমই বের হই নি। মিসেস মারগোলিন আর মিসেস হেডি আমাদের এমন কড়া পাহারা দিয়ে রেখেছেন যে সারাদিন আমরা কেউ কথাই বলি নি। যেদিন বাড়ি ফিরছি সেদিনও পরিবেশ গম্ভীর আর সবাই চুপচাপ। বাস চলতে শুরু করল। আরনেটাকে মিসেস মারগোলিনের পাশে বসতে হয়েছে। আমি ড্যাফনির পাশে বসেছি। ওর প্রাইজ পাওয়া খাতাটা আমাকে বিনা বাক্যব্যয়ে ধরিয়ে দিল। ‘সেকি, তুই নিবি না?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করায় নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বলল।

এর মধ্যেই মিসেস হেডি ফুঁপিয়ে উঠলেন। ‘আমি মিসেস মারগোলিনের সঙ্গে গিয়ে বসছি, ঠিক আছে?’ বলে সামনে গিয়ে আরনেটাকে পিছনে পাঠিয়ে দিলেন। বড়রা সামনে বসেছে দেখে সবার একটু সাহস হল। একটা ভাষাহীন দৃষ্টি দিয়ে এলিস বলে উঠল, ‘এই!’ এবার আরনেটা ওই ইউনিফর্ম পরা মেয়েটার গর্বিত ভঙ্গিকে ব্যঙ্গ করে মুখ বাঁকালো। তাতে সবাই মজা পেয়ে গেল। কেউ কোনও কথা না বলে, জোরে না হেসে যে যার নিজের মতন করে ৯০৯ নম্বর দলের মেয়েদের নকল করে অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল। এটাই ওদের আনন্দ।

ড্যাফনি নিজের জুতোর দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে আছে আর আমি ওর দেওয়া খাতাটা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসলাম। অনেক ভেবেও মাথায় এলো না কী লিখবো। কী লিখলে ড্যাফনির লেখা কবিতার মতন ভালো কিছু লিখতে পারবো! শেষে ওই কবিতাটা ভাবতে ভাবতে আমার লেখার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গেল।

ইতিমধ্যে ওরা ৯০৯ নম্বর দলের মেয়েদের নিয়ে মজা করতে করতে হাঁফিয়ে গিয়েছে। এখন স্কুলে কে কাকে কী চিঠি লিখেছে সেই নিয়ে নিজেদের মধ্যে গুনগুনিয়ে গল্প করছে। হঠাৎ করেই যেন সব নিশ্চুপ হয়ে শুধু বাস চলার মৃদু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে আর মিসেস মারগোলিনের সঙ্গে মিসেস হেডি যে আলোচনা করছেন তার একটু একটু শোনা যাচ্ছে।

অক্টাভিয়া ফিসফিস করে বলল, ‘এই যে আমরা ক্যাম্প করতে এসে একদল রিটার্ডেড মেয়ের সঙ্গে ফেঁসে গেলাম, কেন বলতো?’

‘তুই বলতে পারবি?’ বেড়ালের মতন ধূর্ত সরু চোখে তাকিয়ে আরনেটা প্রশ্ন করল।

‘একবার আমার মা আর আমি একটা মলে গিয়েছিলাম। সেখানে একজন ভদ্রমহিলা আমাদের দিকে খালি ঘুরেঘুরে দেখছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমরা যেন অন্য কোনও দেশের। যেন আমরা চীন থেকে এসেছি’। ‘তো, উনি কী বললেন?’ এলিস জিজ্ঞাসা করল। ‘কিছুই না! সেই মহিলা কিছুই বলে নি!’ একথা শুনে কিছু মেয়ে যেন অনেক কিছু বুঝেছে, এমন ভঙ্গিতে খুব বিজ্ঞের মতন মাথা দোলালো।

‘একবার আমার বাবার সঙ্গে আমি একটা মলে গিয়েছিলাম আর…’ এতোটা বলতেই অক্টাভিয়া খেঁকিয়ে উঠল, ‘ওহ সিকনি, চুপ কর তো!’ অক্টাভিয়ার দিকে একটু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমি জানলার দিকে চোখ ঘোরালাম। পাশ দিয়ে দ্রুত সরে সরে যাওয়া গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছি, কতক্ষণে এসব কিছু শেষ হবে। এই বাসে করে যাওয়া, এই দল, এই স্কুল, এই সব, সব কিছু! কিন্তু, বাড়ি ফিরলেও পরদিন তো আবার সেই একই স্কুলে যেতে হবে। একই মেয়েদের চেহারা দেখতে হবে। বাসে করে আর কোথায় যাব! এসব থেকে রেহাই নেই।

‘লরেল, তুই বলতো কী হয়েছিল!’ ড্যাফনির কথা শুনে মনে হল এই গোটা ক্যাম্প ট্রিপে ও এই প্রথম কথা বলল, আর সেটা আমার নাম! এতো কান্না পাচ্ছে যে আমি ওর দিকে তাকিয়ে বোকাবোকা মুখে একটু হাসলাম। আমি ভাবলাম আমি ওর বন্ধু হতে চেয়েছিলাম, সেটা ভেবেই ও হয়তো আমাকে ওর পুরস্কারের খাতাটা দিয়ে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে। কিন্তু, এখন আমার হাসি দেখেও ও একটুও হাসল না। শুধু বলল, ‘তারপর কী হয়েছিল রে?’

এবার আমি অন্য মেয়েদের দিকে তাকালাম। ভাবলাম আমি কিছু বলার আগেই অক্টাভিয়া আবার আমাকে মুখ বন্ধ করতে বলবে হয়তো! কিন্তু, সবাই বোধহয় অবাক হয়ে গিয়েছে যে ড্যাফনি কথা বলেছে! নিশ্চুপ বাসে আমি বলতে শুরু করলাম, ‘আমার বাবার সঙ্গে আমি সেই মলে গিয়েছিলাম। কিন্তু, ওখানে আমাকে কেউ ড্যাবড্যাব করে দেখে নি বরং, আমিই হাঁ করে তাকিয়েছিলাম।’ আরেকবার বাসের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আবার শুরু করলাম। ‘ওখানে অনেক সাদা মানুষ ছিল, যারা সেই পুরোনো দিনের মানুষদের মতন পোশাক পরেছিল। ওরা কিন্তু পুরোনো দিনের মানুষ নয়। ওরা আসলে মেনোনাইট। ওদের কাছে কেউ কোনও সাহায্য চাইলে ওরা সেটা করতে বাধ্য। এই যেমন ধর, কেউ যদি বলে বাড়ির দেওয়াল রং করে দিতে, তাহলে ওরা সেটা করে দেবে। এটাই ওদের নিয়ম।’

‘এ বাবা! তাই নাকি! কী বিচ্ছিরি নিয়ম রে বাবা!’

‘ধ্যাৎ, তুই নির্ঘাত বাজে কথা বলছিস!’ আরনেটা বলল।

‘মোটেই না!’

‘তুই কী করে জানলি যে এটা আসলে একটা ঢপ না! মানে, এটা হয় নাকি যে কেউ কিছু বললেই সে সেটা করে দেবে!’ জ্যানিস কিছুটা চ্যালেঞ্জ করার সুরেই বলল।

‘আমি জানি এটা ঢপ নয়। কারণ, আমি যখন ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, আমার বাবা বলল, ওরা জানিস তো, যা করতে বলবি তাই-ই করবে। যা বলবি।’

কারোর বাবাকে তো কেউ মিথ্যেবাদী বলতে পারবে না, তাহলে মারামারি লেগে যাবে। তাই ড্রেমা খুব সাবধানে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু, তোর বাবা কী করে জানল যে এটা আসল, একটা ঢপ নয়?’

‘কারণ, বাবা ওই লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল যে ওরা আমাদের বাড়ির সামনের অংশটা রং করে দেবে কিনা, তখন সেই লোকটা বলল হ্যাঁ করে দেবে। এটাই ওদের ধর্মের নিয়ম।

‘কী ভাগ্যিস আমি ব্যাপ্টিস্ট! মেনোনাইটদের দুঃখে খুব দুঃখিত হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠল এলিস।

‘তারপর ওরা রং করে দিয়েছিল?’ জ্যানিস খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ, লোকটা ওরা পরিবারের সবাইকে নিয়ে এসেছিল। আমার বাবা গাড়ি নিয়ে গিয়ে ওদের নিয়ে এসেছিল। ওরা আমাদের বাড়ির সামনের অংশটা রং করে দিল। মেয়েরা লম্বা স্কার্ট পরেছিল, সঙ্গে গলা পর্যন্ত আটকানো টপ। লোকটা একটা অদ্ভুত টুপি আর বেল্ট দেওয়া প্যান্ট পরেছিল।’

‘কিন্তু, তুই একটা সহজ কথার জবাব দে। ওরা যদি যা বলা হবে তাই-ই করবে, তাহলে শুধু বাড়ির সামনের অংশ কেন, পুরো বাড়িটা রং করালি না কেন! কিংবা, ধর একশ’ টাকা চাইলি না কেন!’

আরনেটার প্রশ্ন শুনলেই বোঝা যায় যে ও আমার বলা একটা কথাও বিশ্বাস করেনি।

আমিও ভাবলাম, সত্যিই তো! এগুলো কেন করালো না বাবা! তারপর বাবার বলা একটা কথা মনে পড়ল। ওরা যখন বাড়ির সামনের অংশটা রং করছিল তখন বলেছিল বাবা কথাটা। যদিও আমি তারপর আর কোনোদিনই এটা নিয়ে ভাবি নি। এখন আরনেটার কথার জবাব দিতে গিয়ে নিজেই বুঝলাম বাবা ঠিক কী বলতে চেয়েছিল। ‘বাবা বলল এটাই একমাত্র সময় যখন কোন সাদা মানুষ হাঁটু গেঁড়ে বসে কোন কালো মানুষের জন্য কিছু করবে, বুঝলি?’

বাবার বলা কথাটা বলতে বলতেই আমি বুঝতে পারলাম বাবা কী বলেছিল আর এখন ঠিক ভালো না লাগলেও বুঝতে পারছি কেন বাবা ওই কাজটা করেছিল। আসলে দীর্ঘদিন ধরে কাউকে অপমান করলে, সবসময় ছোট করে রাখলে সেও সুযোগ পেলেই অন্যকে অপমান করার জন্য মুখিয়ে থাকে। আমার এখন পরিষ্কার মনে পড়ছে ঠিক যেমন ভাবে ড্যাফনি ঝুঁকে পড়ে বাথরুমটা পরিষ্কার করছিল, তেমন ভাবেই মেনোনাইটরা ঝুঁকে পড়ে কাজ করছিল। ওরা ঠিক মেঝে পরিষ্কার করার মতোই রং করছিল। এগুলো মনে পড়ে আর বুঝে আমার কেমন যেন কাঁপুনি আসছিল। ‘তোর বাবা ওদের ধন্যবাদ জানিয়েছিল?’ খুব আস্তে আস্তে জানতে চাইল ড্যাফনি।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি আমার চিন্তাভাবনা আর গাছগুলো যেন আর আলাদা করতে পারছি না।

‘না’, বলতে বলতেই হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, এই দুনিয়ায় এতরকম নোংরামী আছে, যা আমি চাইলেও আটকাতে পারবো না।

‘যদি ওদের পোশাক বদলে জিন্স-টিন্স‌ পরতে বলা হয়, ওরা পরবে?’ আরনেটা একটা বিচ্ছিরি হাসি দিয়ে বলল।

‘হয়তো সেটাও করবে। শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরেই!’ ড্যাফনি ধীর স্থির ভাবে শান্ত সুরে বলে উঠল।

নিগার শব্দটার আসল মানে কালো। আমেরিকায় আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষদের এই নামে অভিহিত করা হতো। স্প্যানিশ নেগ্রো শব্দের ইংরেজি হলেও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আমেরিকায় নিগার শব্দটা প্রায় গালাগালির মতোই হয়ে উঠেছিল। আফ্রো আমেরিকানরা নিজেদের মধ্যে এই শব্দ ব্যবহার করলেও সাদা চামড়ার কেউ এই শব্দটা বললে তা রেসিস্ট আর অপমানজনক বলেই গণ্য হয়। তারই ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে এই শব্দের ব্যবহার কমে এসেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।

লেখক পরিচিতি : জেজে প্যাকার

জেজে প্যাকার কালো অ্যামেরিকান লেখক। জন্ম ১৯৭৩। বর্তমানে সানফ্রান্সিস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত প্যাকার যখন ‘ব্রাউনিজ’ গল্পটি লেখেন, তাঁর বয়স মাত্র ২৬। গল্পটি তাঁর ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘ড্রিঙ্কিং কফি এলসহোয়ার’ গল্প সংগ্রহের অংশ। বিভিন্ন ‘অ্যামেরিকান ইয়াং অথর’ সম্মান ও পুরস্কার ও নানান লেখক ফেলোশিপ প্রাপ্ত প্যাকার এখন ‘সিভিল ওয়ার’ নিয়ে একটি উপন্যাস লিখছেন।

অনুবাদক পরিচিতি : সুস্মিতা সরকার

গল্পের বই পড়া, গল্প লেখা আর আড্ডা প্রিয়।

1 thought on “ব্রাউনির দল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.