ল্যাংস্টন হিউজ (হোম) / অনুবাদ – সুস্মিতা সরকার

 

সঙ্গে অনেকগুলো ব্যাগ আর বেহালার বাক্স নিয়ে ছেলেটা ফিরল। সেসব ব্যাগ আর বাক্স জুড়ে নানারঙের কাগজ সাঁটানো। আর কাগজে অদ্ভুত সব ভাষায় কীসব যেন লেখা। ওগুলো আসলে দেশবিদেশের কাস্টমস অফিসের ছাপ। এছাড়াও ইউরোপের যেসব বড় বড় হোটেলে সে থেকেছে সেখানকার স্টিকার। আর আছে যে স্টিমারে করে এই লম্বা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে হকিন্সভিল ফিরেছে তার ছাপ। এমনিতে দেশে কারো সাধ্য নেই সেসবের মানে উদ্ধার করে। তবে এতসব ঝকমকে রঙিন কাগজের ঠেলায় চামড়ার রঙের ব্যাগ আর কালো রঙের বেহালার বাক্সের চেহারাই বদলে গিয়েছে। ওগুলো এখন বেশ ঝলমলে আর মজাদার সার্কাসের মতন দেখাচ্ছে। ব্যাগের চেহারা দেখে ট্রেনে যেসব সাদা চামড়ার লোকজন ছিল তারা সবাই হতবাক! ব্যাগ আর বাদামি চেহারার তরুণ ব্যাগের মালিক দুইই ওদের অবাক করে দিয়েছিল। আর শেষপর্যন্ত যখন সে সবকিছু নিয়ে মিসৌরির রেলস্টেশনে নামলো, স্টেশনে গুলতানি মারা বকাটে ছেলেগুলো সব ওর দিকে হাঁ করে দেখছিল। 

রয় উইলিয়ামস বিদেশ থেকে ঘরে ফিরছে। ওর নিজের আত্মীয়স্বজন, মা, বোন, ভাই সবাই এখনও সেই পুরনো শহরের বাড়িতেই থাকে। প্রায় সাত আট বছর ধরে পৃথিবীর নানান প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে ও। এখন যখন নিজের বাড়িতে ফিরছে, তখন পরনের জামাকাপড় ধোপদুরস্ত হলেও ভারি রোগা লাগছে ওকে। শরীরটা ভালো নেই ওর। 

সত্যি বলতে কী, এই শরীর খারাপের জন্যই ও বাড়ি ফিরেছে। কেন কে জানে, ওর বারবার মনে হচ্ছে ও আর বাঁচবে না। তাই মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য মনটা ছটফট করছিল ওর। এই মরে যাওয়ার চিন্তাটা গত প্রায় দুই তিন বছর ধরেই ওর মধ্যে ধীরে ধীরে গেড়ে বসেছে। ওর ধারণা, এর শুরু হয়েছে ভিয়েনাতে। মধ্য ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই শহরটা একই সঙ্গে প্রচণ্ড প্রাণোচ্ছল আবার মৃতপ্রায় এক শহর। ওখানে এত ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড়েও দামি খাবার আর মহার্ঘ পানীয় নিয়ে উৎসব করার লোকের অভাব নেই। বিশেষ করে সেই নাইটক্লাবে, যেখানে রয় ওর দলের সঙ্গে বেহালা বাজাত। 

রয়ের বিলাসবহুল জ্যাজ অর্কেস্ট্রার পর্দা সরালেই দেখা যেত মৃত্যুর সারি। রাস্তার উপর খিদের চোটে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে বহু মানুষ, আবার অন্যদিকে কিছু মানুষ দামি মদ আর খাবার খাচ্ছে পেট ঠেসে; এসব দেখে ওর কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগত। বেশি রাতে কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় কিছু সাদা চামড়ার অল্পবয়সী মেয়ে রাস্তায় ওর পিছু নিত। সামান্য মূল্যে শরীর বিক্রি করাই ছিল ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য। ওদের প্রত্যাখ্যান করতেই হত, কিন্তু ওদের সেই শরীর বেচার সামান্য পয়সাই যে কিছু খাবার জোগাড় করার একমাত্র উপায় সেটা বুঝতে পেরে রয়ের মনটা খারাপ হয়ে যেত। 

ভিয়েনাতে রয়ের একটা ঘর ছিল। সেখানে ও একাই থাকত। আসলে ও পড়াশোনা আর সুরের সাধনা দুটোই চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। সবথেকে ভালো বেহালা শিক্ষকদের একজনের কাছে ও শিখত। কিন্তু ক্ষুধার্ত অথচ সুন্দরী মেয়েদের ওই জায়গায় না এনে এড়িয়ে যাওয়া বেশ শক্ত ছিল। ওই মেয়েগুলো রয়ের মতন কোন পুরুষকেই ধরার চেষ্টা করে। কারণ ওর রোজগার আছে। সবশেষে কিছু টাকা দিতে পারবে সে। এমনকি কপাল ভালো হলে সেই রাতে ওর ঘরে শুয়ে ঘুমানোর জন্য একটু জায়গাও হয়তো পাবে। যে টাকা পাবে তাতে বাড়িতে না খেয়ে শুকিয়ে থাকা বাবামায়ের জন্য কিছু কিনতেও পারবে। 

রয়ের মনে হয়, ‘মাইরি, ইউরোপটা যেন নরকের থেকেও খারাপ। আমি তো আমার ওখানে নিগ্রোদের মধ্যেও এত অভাব, এত ক্ষিধের কষ্ট দেখি নি।’

অর্কেস্ট্রা নিয়ে বার্লিনে ফেরত আসার পর দেখা গেল সেখানে অবস্থা আরও খারাপ। মূল শহর কিংবা পর্যটকদের ঘোরার জায়গাটুকু বাদ দিলে বাকি অংশ জুড়ে খিদে আর কষ্ট যেন চিন্তারও বাইরে। কেউ প্রতিবাদ করলেই পুলিশের লাঠি। চুরি করলে বা ভিক্ষা করলেও পুলিশের পিটুনি খেতে হবে। অথচ রয় যেখানে বেহালা বাজায় সেখানে পয়সা ওড়ানোর লোকের অভাব নেই। তারা প্রতি রাতে নাচ আর আনন্দে মশগুল হয়ে কাটায়। দরজার বাইরে রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা শিশু, প্যাকিং বক্সে বেঁচে থাকা লোকজন কিংবা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে শরীর বেচা মেয়েদের কষ্টের কথা যেন জেনেও জানে না ওরা। 

বার্লিনেই সবথেকে বেশি মন খারাপ হত রয়ের। আর ওখানেই ওর কাশিটাও শুরু হয়। প্রাগে একদিন তো রক্তও বেরিয়ে এল। যখন প্যারিসে ছিল তখন ওর বান্ধবী ওর যথেষ্ট যত্ন করত। হয়তো সেই যত্নআত্তি পেয়েই শরীরটা একটু সেরেছিল। তবুও তখন থেকেই ওর মনে হচ্ছিল যে আর বেশিদিন হয়তো বাঁচবে না ও। কাশিটা যেন সারছিলই না। অবসাদটাও যাচ্ছিল না। তাই শেষমেষ মায়ের কাছে বাড়ি ফিরে এল। 

যেদিন রয় নিউইয়র্কে এসে নামল সেদিনই প্রাক্তন সেনাদের ওয়াশিংটনের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে কয়েকদিন কাটল। বন্ধুরা যারা বাদ্যশিল্পী বা অভিনয় করে তাদের বেশিরভাগেরই কোনও রুজি রোজগার নেই। রয়ের পরিপাটি কেতাদুরস্ত জামাকাপড় দেখে ওরা হাত পাততে শুরু করল। আর এখানেও রাতের অন্ধকারে রাস্তায় মেয়েরা ফিসফিসিয়ে প্রস্তাব দিতে শুরু করল। 

‘উফ, এ শালার পুরো দুনিয়াটাই মনে হয় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি বাড়ি যেতে চাই।’ রয়ের মনে হল। 

শেষরাতটা কিছুতেই ঘুমোতে পারল না ও। বারবার মায়ের কথাই মনে পড়ছিল। পরদিন সকালেই মায়ের কাছে টেলিগ্রাম পাঠাল যে ও ফিরছে।

নানা রঙের স্টিকার লাগানো ব্যাগপত্তর নিয়ে স্টেশনে নেমে দাঁড়াল রয়। ও পুলম্যান থেকে নেমেছে, যা কিনা সেই অঞ্চলের কালোদের জন্য বেশ অস্বাভাবিক ব্যাপার। ‘নাক উঁচু কালোটাকে দেখ।’, সেপ্টেম্বরের উজ্জ্বল রোদে রোগাটে অভিজাত চেহারার রয়কে দেখে স্টেশনের ফালতু বকাটে সাদা ছেলেগুলো বলে উঠলো। 

‘আরে শালা! এটা যদি রয় না হয়, আমার নামে কুত্তা পুষিস তোরা!’ একটা নাকি নাকি গলা আচমকা চেঁচিয়ে উঠল। 

দলের অন্যদিকে দাঁড়িয়ে থাকা লালচে ঘাড়ের সাদা লম্বা চার্লি মামফোর্ডকে চিনতে পারল রয়। ছোটবেলায় ওরা একসঙ্গে খেলত। চেনা মুখ দেখে হাত থেকে দস্তানা খুলে হাত বাড়াল রয়। সাদা ছেলেটা হাতটা ধরল বটে কিন্তু বেশিক্ষণ ঝাঁকাল না। হঠাৎ হুঁশ হল রয়ের যে ও এখন আর ইউরোপে নেই। ও তো ভুলেই গিয়েছিল যে কালো একটা লোকের হাতে দস্তানা মানে সে এক বিশাল ব্যাপার। তার উপর আবার সাদা মানুষের সঙ্গে হাত মেলানো! সে তো আরও সাঙ্ঘাতিক! 

‘তুই ছিলিস কোথায় বল তো?’ ছেলেটা জিজ্ঞেস করল। 

‘প্যারিস’। রয় উত্তর দিলো।

‘তা হঠাৎ ফিরলি যে বড়?’ ব্যাগের অন্য দিক থেকে আরেকটা ছেলে বলে উঠল। ওর কথার টানে কিছুটা আমেরিকার দক্ষিণী টান আছে।

‘আমার বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করল মায়ের কাছে’।

‘যাক, তোকে দেখে আমাদের যতটা না ভালো লেগেছে, আশা করি তোর মায়ের তার থেকেও অনেক বেশি ভালো লাগবে’। আরেকটা ছেলে বলে উঠল। কথার সুরে তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা স্পষ্ট। 

আশেপাশে কোনও কুলি দেখা গেল না, তাই রয় নিজেই ওর ব্যাগগুলো উঠিয়ে নিল। তারপর হাঁটা দিল একটা পুরোনো জং ধরা ফোর্ড গাড়ির দিকে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে ওটা হয়তো ট্যাক্সিই হবে। শরীরটা ভারী দুর্বল লাগছে ওর। মাথাটাও যেন একটু ঝিমঝিম করছে। সারা রাস্তার ধুলো, ধোঁয়ায় ভীষণ কাশি হচ্ছিল। স্টেশনের ছেলেগুলোর চাহনি মোটেই ভালো লাগল না ওর। ‘নিগার’ শব্দটা কানে যেতেই শরীরটা চিড়বিড়িয়ে উঠল। অনেকবছর পর নিজের গায়ের রংটা যেন আলাদা করে অনুভব করল। হ্যাঁ, নিজের জায়গাতেই ফিরেছে বটে।

‘বাবা এই যে তুই বাড়িতে এসেছিস, আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে! এবার বল কী খাবি? আমি তো ঠিকই বুঝতে পারছি আমার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য তুই কেমন ছটফট করছিস! তা তুইই বল, মা কী রান্না করবে তোর জন্য? ভুট্টার পাঁউরুটি, সবজি আর শুয়োরের মাংস করি? আরে তোর জামাকাপড়গুলো তো দারুণ। তোকে অবশ্য একটু রোগা লাগছে। বাবু, তুই কিছুদিন থাকবি তো? এখানকার কালো মেয়েগুলো সব পাগল হয়ে যাবে তোর জন্য। জানিস তো, এরমধ্যেই ওরা তোর জন্য মারামারি শুরু করে দিয়েছে। আর তুই যখন বেহালা বাজাস এতো ভালো লাগে আমার! এতো সুন্দর! তুই যে এতো ভালো বেহালা বাজাস সেটা ভগবানের তোকে দেওয়া এক বিশাল উপহার। সত্যিই কিন্তু এটা এক বিশাল প্রাপ্তি আমাদের। আমার তো এটা ভাবতেই এতো অদ্ভুত লাগছে যে এখানকার সাদা ছেলেগুলো নাকি তোর কথা আগে থেকেই জানতো। তোর বোন যেখানে কাজ করে সেখানে মেয়েটা বলেছে ওরা নাকি আগেই কোথাও তোর বাজনার দলের কথা পড়েছে। সেই যে একটা দলের সঙ্গে তুই প্যারিসে বেহালা বাজাতিস না, সেই দলের কথা। সে তো আবার তোর বোনকে বলেছে একদিন তোকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যেতে। ওকে একটু বাজিয়ে শোনাবি। আমি কিন্তু সাফ মানা করে দিয়েছি। বলেছি, না তুই মোটেই কারো বাড়িতে গিয়ে কাউকে বাজিয়ে টাজিয়ে শোনাতে পারবি না। বরং আমাদের চার্চে একটা বাজানোর আসর বসানোর জন্য ওই সাদা মহিলাকে ব্যবস্থা করার কথা বলতে বলেছি তোর বোনকে। বেশ সবাই আসতে পারবে। প্রভুকে পঁচিশ সেন্ট দান করে বাজনা শুনতে পাবে। তুইই বল ঠিক বলিনি আমি? তুই এখানে তোর নিজের শহরে প্রভুর জন্য বাজাবি। ইউরোপে রোজ রাতে শয়তানের জন্য অনেক বাজিয়েছিস… প্রভু যেন তোকে ক্ষমা করেন! আরে, ভুলেই তো মেরে দিয়েছি! যাই, জামাকাপড়গুলো কাচার ব্যবস্থা করি। দুপুরবেলায় তুই যখন বাজানো প্র্যাকটিস করবি, তখন তোর জন্য কুমড়োর পাই বানিয়ে দেব। বুঝতেই পারছি তোর মুখে জল চলে এসেছে নাম শুনেই! সোনা, তুই বাড়ি এসেছিস বলে মা যে কত খুশি হয়েছে তুই জানিস না। নে বাবা, এখন তুই তোর বেহালা বাজা’।

হপকিন্সভিলে এমন বাড়ি কি কোথাও আছে যেটা বিঠোভেন, ব্রাহামস, বাখ বা সিজার ফ্রাঙ্কের মতন বিখ্যাত সুরকারের সুর নিজের বাড়িতেই আটকে রাখতে পারে? ভগিনী সারা উইলিয়ামসের ছোট্ট বাড়ি তো নয়ই। শরীর খারাপ নিয়েও রয় যখন বাজায়, সুরের মূর্চ্ছনা জানলা দিয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। সাদা কালো নির্বিশেষে সবাই শুনতে পায় বিশ্ববিখ্যাত সুরকারদের সুর দক্ষিণ মিসৌরির এক সামান্য নিগ্রো বাড়ির থেকে ভেসে আসছে। প্রভুর দিব্বি, তুমি এত সুন্দর বেহালা বাজাও রয়! আজ তোমার কনসার্ট, তোমার বাজনার আসর।

সাদাদের জন্য কাজ করে এমন এক সংস্থা অনেক টিকিট বিক্রি করে ফেলল। রয়ের বাড়ি ফেরার পর প্রথম কনসার্টে অনেক টাকার টিকিট বিক্রি হলো। স্থানীয় চার্চে হবে কনসার্ট। প্রথম দিকের সারিগুলোর টিকিটের দাম পঞ্চাশ সেন্ট। যারা ওই টিকিট কিনলো তারা সবাই সাদা। পিছনের দিকের সারির টিকিটের দাম পঁচিশ সেন্ট। ওই সিটগুলো কালো মানুষে ভরে গেল। খ্রিস্টানদের মধ্যেও তো অনেক ভাগ। অনেক খেয়োখেয়ি নিজেদের মধ্যে। কিন্তু, সেসব ভুলে কনসার্টে সবাই হাজির হলো। অনেক কালো মেয়েও এলো। পাউডার টাউডার মেখে, লাল লিপস্টিক লাগিয়ে যতটা সম্ভব পরিপাটি হয়ে এলো তারা। ওদের সবার চোখ রয়ের দিকেই। গা ঘষাঘষি, মুখ চাপা খিলখিল হাসি, ফিসফিসানি আর সিটগুলোর পাস দিয়ে নতুন জুতোর মসমসানিতে ভরে গেল চার্চ। শুরু হতে দেরি হচ্ছে বলে কেউ কেউ হাততালি দিতে শুরু করলো। তাতে অবশ্য কারো কোনও হেলদোল নেই। কালোরা সাধারণত সবকিছুই দেরিতে শুরু করে। তাই কনসার্ট শুরু হতেই দেরি হলো। চার্চ একদম ভিড়ে ভিড়াক্কার। 

সবাইকে শুভ সন্ধ্যার শুভেচ্ছা। আজকের এই সন্ধ্যায় হপকিন্সভিলে আমাদের কালোদের চার্চে বেহালায় মিস্টার ব্রাহামসের গান শোনা যাবে। বাজাবে ভিয়েনাতে থেকে আসা এক অসুস্থ তরুণের শুকনো, বাদামি হাত। গরিব সাদা আর তাদের থেকেও গরিব কালোদের জন্য এই বাজনা। নিজের জায়গা ছেড়ে সারা পৃথিবীতে সুরের জাল বুনতে বুনতে ব্রাহামস সাহেব আজ আপনাদের মাঝে হাজির। আপনাদের তাঁর সুর শোনার যে স্বপ্ন ছিল তা পূর্ণ হবে আজ। জানেন তো, আমারও না একটা স্বপ্ন ছিল। আমি স্বপ্ন দেখতাম কার্নেগি হলের মতন এক বিশাল হলঘরে দারুণ এক স্টেজে বাজাচ্ছি। কিন্তু আজ আর তা পূরণ হওয়ার নয়। বরং আমি আজ এই অন্ধকারে বাজাব। এত ভালো বাজাব যে রোনাল্ড হায়েজ প্রভুর ক্রুস বিদ্ধ হওয়ার গান শোনালে যেমন সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে তেমনই হাজার হাজার মানুষ মুগ্ধ হয়ে আমার বাজনা শুনবে। শরীর খারাপ নিয়ে বাড়ি আসার আগে একবার ঠিক এরকমই একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। 

আজ আমি আমেরিকায় আমার প্রথম কনসার্ট বাজাব আমার মায়ের জন্য। এছাড়া আমার চার্চের জন্যও বাজাব। যে পঁচিশ সেন্ট বা পঞ্চাশ সেন্ট এরা আমার আর ব্রাহামস সাহেবের নামে তুলেছে, তা তো আসলে প্রভুর জন্যই। এটা আমার স্বপ্নের সেই বিশাল হলঘর বা দারুণ দামি দর্শকমণ্ডলী নয়। কিন্তু এই জায়গাটাই আমার আসল জায়গা। এই বাজনা আমার নিজের লোকজনের জন্যই বাজানো। এরা কেউ আমাকে হেলাফেলা করবে না। সামনের সারির সাদা লোকজন আর পিছনের সারির কালো লোকজন সবাই মিলে যেন এক জোড়া চোখের মতন একদৃষ্টে আমাকে দেখছে। 

এবার সবাইকে ‘ভদ্র মহোদয় ও ভদ্র মহোদয়াগণ’ বলে শুরু করা উচিত। ‘বন্ধুরা’ বলেও সম্বোধন করা যেত, কিন্তু সামনের সারির সাদা লোকজন তো আর আমার বন্ধু নয়! আমার যে স্বপ্ন সত্যি হতে পারত তা সত্যি হতে না পারার কষ্টে ভেঙে যাওয়া মন নিয়ে আমি এখন মাসেনের ‘মেডিটেশন’ বাজাব। এই বাজনা আমি বিশ্বের দরবারে বাজাব শুধু আপনাদের জন্য। জীবন আর ভালোবাসার এই বাজনা আমি কালো হাত আর বাদামি শরীর দিয়ে বাজাব… সোনালি আলোয় উজ্জ্বল মুখের সাদা সুন্দরী এর সঙ্গে গান গাইবে… একটু সামলে রয়! এই ভিড়ের চার্চে বড্ড গরম, তোমার শরীরও মোটে ভালো নেই… সুরের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে এমন স্বপ্ন দেখছো যেন ভিয়েনা থেকে নিজের শহরের দিকে পাগলের মতন হাঁটা লাগিয়েছ… শোন সুন্দরী, আমি চাই মিসৌরি পাহাড়ের উপর চাঁদের মতন সুন্দর হও তুমি… তুমি একদম চিন্তা কোরো না, আমি তোমাকে সাজিয়ে তুলব… মেডিটেশন দিয়ে… তোমার মনে আছে মা, (আজ আমার বাজনা শোনার জন্যও তুমি তোমার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করার নির্দিষ্ট জায়গায় বসেছো), তোমার কি মনে আছে, আমরা যখন ছোট ছিলাম আমাদের একটা চোঙাওলা রেকর্ড বাজানোর যন্ত্র আর ক্রাইসলারের একটা ফোনোগ্রাফের রেকর্ড ছিল? আমি ছাড়া আর কারো পছন্দ ছিল না ওটা। ওটা আমি কতবার যে শুনতাম। বারবার শুনতাম। তুমি কখনও আপত্তি করো নি। আচ্ছা মা, আমার বেহালাটা কোথা থেকে এনে দিয়েছিলে তুমি? আমার বুড়ো মাস্টারমশায়কে মাইনে দেওয়ার টাকা থাকত না অর্ধেক দিন। বেচারা, কত টাকা না পেয়েই শেষে উনি মারা গেলেন। ভগবান যেন ওনার আত্মাকে শান্তি দেন। কিন্তু যখন আমি গানের দলের সঙ্গে ভগবানের গান না করে আমাদের কালোদের নিজস্ব বাজনা বাজাতাম তখন তুমি কাঁদতে কেন মা? শিকাগোতে নাইট ক্লাবে বাজানোর চাকরি পেয়েছি লেখার পর কেন কাঁদলে তুমি? কেন তুমি সারারাত জেগে প্রার্থনা করলে যখন বললাম যে বার্লিনে ক্যাবারে ক্লাবে বাজানোর সুযোগ পেয়েছি? তোমাকে কত বোঝানর চেষ্টা করলাম যে বেহালা শেখার জন্য ভিয়েনাই সবথেকে ভালো জায়গা। সবথেকে ভালো শিক্ষক ওখানেই থাকেন। ক্রিসলারের রেকর্ডের মতোই আমি আবার ঘুরে ফিরে এখানেই আসব; বলিনি তোমাকে? তোমাকে তো টাকাও পাঠাতাম আমি। তাও তুমি এমন কাঁদতে, যেন তোমার চোখে বালি ঢুকেছে। …কিন্তু আজ এখানে সামনের সারিতে বসে থাকা সস্তা কোট আর লাল টুপি পরা সাদা মহিলা, এই যে আপনি আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন, আপনাকে তো মোটেই মাসেনেটের থাইয়ের মতন দেখতে লাগছে না। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, সুরের কাছে আপনি ঠিক কী চান? আপনি আমার কাছ থেকেই বা কী চান? এটা মিসৌরির একটা শহর। নিগ্রোদের ভিড়ে মিশে থাকা বাদামি মেয়েগুলোকে দেখুন। ওরা আমার জন্য, আমার বাজনা শোনার জন্য কেমন উদগ্রীব হয়ে আছে। ওদের বেশিরভাগ এর আগে এরকম সান্ধ্যকালীন পোশাকে সজ্জিত কোনও পুরুষকে দেখে নি। সাদা বা কালো কোনও পুরুষকেই না। এর আগে এই সুরটাও শোনে নি। নিজের জাতের কেউ বিদেশ থেকে ফিরে বেহালা বাজিয়ে শোনাচ্ছে, সেটাও ওদের জন্য একদম নতুন একটা ঘটনা। যতই ওরা সাদা লোকেদের পিছনে বসুক না কেন তবুও দেখুন ওরা আমার জন্য কত গর্বিত! ওদেরকে বেশ কষ্ট করে আপনার লাল টুপির উপর দিয়ে আমাকে দেখতে হচ্ছে, তবুও আমার বাজনা শোনার জন্য ওদের কত আগ্রহ দেখছেন? এটা বুঝতে পারছি যে সুর আর বাজনার মাহাত্ম্য আপনি জানেন, কিন্তু ম্যাডাম আপনি কে সেটা বলুন তো?

কনসার্ট শেষ হল যখন তখন অনেকেই রয়ের সঙ্গে দেখা করতে এল। এমনকি কিছু সাদা চামড়ার মানুষও এসে রয়ের সঙ্গে হাত মেলাল। এটাও জানাল বাজনাটা অপূর্ব হয়েছে। কালো লোকজন এসে বলল, ‘যাই বল ভাই, তুমি কিন্তু সত্যিই বাজাতে জানো!’ রয়ের তখন হালকা কাঁপুনি হচ্ছে, চোখ জ্বালা করছে আর ভীষণ কাশি পাচ্ছে। দুই কাঁধেও বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু তবুও ও হাসছে। ঠিক সেরকম হাসি, যে হাসিটা ইউরোপীয় বড়লোক মহিলারা খুব পছন্দ করত। জ্বর জ্বর অবস্থাতেই সবার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে ও। লাল টুপি পরা সাদা মহিলা ভিড়ের এক কোণায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। 

ভিড়টা যখন একটু হালকা হল, তিনি এগিয়ে এসে রয়ের সঙ্গে হাত মেলালেন। তিনি সেন্ট লুইস চার্চে সিম্ফোনি কনসার্টের কথা বললেন। তিনি যে পিয়ানো আর বেহালা বাজানো শেখান, তাও জানালেন। আর এটাও আফসোস করলেন যে রয়ের মতন কোনও ছাত্র তিনি কোনদিনই পাননি। সত্যি কথা বলতে কী এই গ্রামের কেউ কোনওদিন এত সুন্দর বাজায় নি। ভদ্রমহিলার ছিটছিটে দাগে ভরা রোগাসোগা মুখের দিকে তাকিয়ে রয়ের মনটা ভালো হয়ে গেল। উনি যে সংগীত বা সুর ভালোবাসেন, সেটা জেনে ওর খুব ভালো লাগল।

‘ওঁর নাম মিস রিস। উনি সাদাদের স্কুলের মিউজিক টিচার।’ উনি চলে যাওয়ার পর রয়ের মা এসে বলল। 

‘হ্যাঁ, উনি সুর আর বাজনা ভালবাসেন’, রয় উত্তর দিল।

পরের বছর পাতা ঝরার মরসুমে যখন স্কুল খুলল আবার মিস রিসের সঙ্গে দেখা হল রয়ের। একদিন সকালে একটা চিরকুট পেল ও। পরিষ্কার সাদা কাগজে খুব সুন্দর করে অনুরোধ করেছেন মিস রিস যে স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের জন্য একদিন বাজাতে পারবে কিনা রয়। এই ছোট্ট শহরে সুর আর সংগীতের মান বাড়ানোর জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন উনি। বাখ বা মোজার্ট নিয়ে উনি ছাত্রদের বলেছেন। এবার রয় যদি একদিন স্কুলে এসে ছাত্রদের এই দুই মহান সুরকারের সৃষ্টি শোনাতে পারে তাহলে খুব ভালো হয়। রয়ের সঙ্গে উনিও সঙ্গ দিতে পারেন। 

রয় নিমন্ত্রণ গ্রহণ করল। ওর মায়ের মতে সাদাদের স্কুল থেকে রয়ের মতন কালো চামড়ার কাউকে ডেকেছে সেটাই এক বিশাল সম্মানের ব্যাপার। ‘নাঃ, ওই মিস রিস তো সত্যিই একজন ভদ্রমহিলা! স্কুলে বেহালা বাজানোর জন্য নিগ্রো কাউকে ডেকে পাঠাচ্ছে, আমি তো অবাক! নোংরা পরিষ্কার করা ছাড়া আর কোনও কারণে সাদা কেউ নিগ্রো কাউকে ডেকে পাঠাচ্ছে, এতদিন এই গ্রামে থেকে সেটা কোনওদিন দেখিনি আমি। যা বাবু, তুই ওদের জন্য বেহালা বাজিয়ে ঈশ্বরের নাম উজ্জ্বল করে আয়’, নিজের মত প্রকাশ করলেন উনি। 

রয় স্কুলে গিয়ে বাজনা শোনালো। কিন্তু সেদিন ওর শরীরটা ঠিক জুতের ছিল না। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখ জ্বালা করছে। সকাল থেকেই একনাগাড়ে কাশছে ও। বাজানোর সময় সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল। শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করল। বাজনা ভালো হল না একদমই। কিন্তু তবুও মিস রিস খুবই ভদ্র ব্যবহার করলেন ওর সঙ্গে। তিনি রয়ের সঙ্গে পিয়ানো বাজালেন। বাজনা শেষ হওয়ার পর ক্লাসের সাদা ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘একেই বলে শিল্প। সত্যিকারের শিল্প, বুঝলি তোরা!’ 

‘আজ ভদ্র জামাকাপড় পরে একটা নিগ্রো স্কুলে এসেছিল। বেহালা নিয়ে। কীসব হাবিজাবি বাজিয়ে শোনাল। একটুও ভালো লাগে নি। একমাত্র মিস রিসের ভালো লেগেছে। তিনি তো খুশিতে ঝলমল করছিলেন বাজনা শুনতে শুনতে। নিজের মনেই বলছিলেন অপূর্ব! অসাধারণ! এমনকি নিগার লোকটা চলে যাওয়ার সময় মিস রিস অভিবাদনও করেছেন।’ সাদা ছাত্ররা সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে বাবা মাকে বলল।

রয় বাড়ি ফিরে সোজা বিছানায় গিয়ে শুল। ইদানীং ওর শরীরটা কখনও একটু ভালো থাকে তো কখনও বেশ খারাপ। কেবলই রোগা আর দুর্বল হয়ে পড়ছে। কখনও কখনও তো বেহালা বাজানো প্রাকটিসও করতে পারছে না। মা ওর জন্য খাবার বানালে বা বোন ওর কাজের জায়গা থেকে খাবার আনলে সেসব খেতে পারছে না প্রায়ই। মাঝেমাঝে এত গরম লাগে আর অস্থির লাগে যে মাঝরাতে বাইরের জামাকাপড় পরে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে ও। এমনকি জুতোর বেল্ট আর হাতে হলুদ দস্তানা পরতেও ভুল হয় না। হপকিন্সভিলে মাঝরাত মানে বেশ রাত। অত রাতে হয়তো মহল্লার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তবুও ও একাই রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। আসলে বছরের পর বছর রাত জেগে কাজ করার দরুন এখন সকাল হওয়ার আগে ঘুমানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে ওর জন্য।

একরাতে শেষবারের মতন ও বাড়ি থেকে বেরোল। চাঁদের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। জামাকাপড় পরার জন্য আলো না জ্বালালেও চলে এত আলো। চাঁদের আলো ওর ঘরে ঢুকে সব উজ্জ্বল করে তুলেছে। বিছানা, দেওয়ালের পাশে জমা করে রাখা জ্বলজ্বলে স্টিকার সহ ব্যাগ; সব! পাশের টেবিলে রাখা সার সার ওষুধের বোতলগুলোও আলোতে দেখা যাচ্ছে। রয় তবুও আলো জ্বালালো। ড্রেসিং টেবিলের লাগোয়া আয়নাতে নিজেকে ভালো করে দেখার জন্য। একসময়ের বাদামি মুখটা কেমন যেন ছাইয়ের মতন ধূসর হয়ে গিয়েছে। গালদুটো বসে গিয়েছে। মৃদু কাঁপতে কাঁপতে ও স্যুট, হলুদ দস্তানা, বেল্ট সহ জুতো আর নরম টুপি পরে নিল। ওভারকোট গলিয়ে নিল। তারপর লাঠিটা হাতে নিল। কিছুদিন থেকে লাঠিটা ব্যবহার করছে ও। স্টাইল করার থেকেও এই লাঠি নেওয়ার বড় কারণ ওর শারীরিক দুর্বলতা। তারপর হেমন্তের চাঁদনি রাতে বাইরে বেরিয়ে এল ও।

পা টিপেটিপে খাবার ঘর দিয়ে পেরোতে গিয়ে শুনতে পেল মায়ের নাক ডাকছে। যেহেতু মায়ের ঘরেই রয় ঘুমায় তাই মা খাওয়ার ঘরে বসার জায়গায় শুয়ে ঘুমায়। সামনের দরজা এখনও খোলা। রয়ের ভাইরা ফেরেনি। ওরা তাদের মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে জীবনটাকে উপভোগ করছে। শুধু ওর বোন বিছানায় শুয়ে। 

রাস্তা একদম শুনশান। হালকা কুয়াশায় মোড়া চাঁদের আলো, হেমন্তের পাতাসহ গাছগুলো যেন অর্ধনগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে। শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। তার নিচ দিয়ে চাঁদের আলো মাখা হাওয়ায় শ্বাস নিতে নিতে, লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শহরের ভিতরের দিকে চলল রয়। রাত আর রাস্তা দুটোই রয়ের খুব পছন্দের। প্যারিস আর লন্ডনের রাস্তার কথা মনে পড়ল ওর। মনে মনে ও যেন ইউরোপের আলো ঝলমলে আর সংগীতমুখর শহরগুলোতে ফিরে গেল। সেসব দিন যেন এখন স্বপ্নের মতন মনে হচ্ছে! মা চিরকালই বড্ড গরিব। ছেলেমেয়েরা কোনওরকমে স্কুলের নিচু ক্লাসের গন্ডি পেরিয়েছে। শহরে অবশ্য নিগ্রোদের জন্য কোনো স্কুলও ছিল না। রয়ের জন্য আরও শিক্ষার একমাত্র পথ ছিল বাজনা। এক জ্যাজ ব্যান্ডের সঙ্গে বার্লিন যাওয়ার সুযোগ এলো। এল সবথেকে সেরা শিক্ষিকার সঙ্গে বেহালা বাজানোর সুযোগ। সেই রোজগার থেকেই বিদেশে যাওয়ার পয়সা জোগাড় হল। রাতে জ্যাজ আর সকালে ধ্রুপদী। অনেক পরিশ্রম আর কঠিন অধ্যবসায় ওর বাজনাকে অসাধারণ করে তুলল। সুর, সত্যিকারের সুর! আর তারপরে বার্লিনে শুরু হল ওর কাশি। 

বড় রাস্তায় উজ্জ্বল আলোয় এখন অনেককেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রয় যেন কাউকেই দেখছে না। ও শুধু কিছু স্বপ্ন আর স্মৃতির সঙ্গে সুর মেশানো এক জগতে ডুবে আছে। কেউ কেউ ওর পোশাকের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। রুগ্ন কালো চেহারায় ইউরোপিয়ান ধাঁচের কোট! কায়দার জুতো, লাঠি নিয়ে এক তরুণ নিগ্রো মিসৌরির এই ছোট্ট শহরে! দেখার মতোই ব্যাপারটা। একদুজন সাদা ছেলে চেঁচিয়ে খিস্তি দিলেও বাকি সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। শুধু হাসাহাসি, নোংরা গালাগালি দিয়ে কিছু কটু মন্তব্য করা ছাড়া আর কিছুই হয়তো ঘটত না যদি না এক সাদা মহিলা ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে অভিবাদন করে শুভ সন্ধ্যা বলতেন। উনি সস্তার কোট আর লাল টুপি পরেছিলেন।

ওঁকে দেখে রয় এতই খুশি হল যে ও ইউরোপে নেই সেটা ভুলে হাতের দস্তানা আর টুপি খুলে ওনার সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়াল। ওনার অভিবাদনের উত্তরে পাল্টা অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘শুভসন্ধ্যা, মিস রিস’। শহরের আলোকোজ্জ্বল বড় রাস্তায় এক রুগ্ন তরুণ নিগ্রো আর এক সাদা বয়স্ক সংগীত শিক্ষিকা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল।

তিনি খোঁজ নিলেন, ‘তুমি কি এখনও সারাসাতের সুর নিয়েই কাজ করছ?’ ‘হ্যাঁ, অপূর্ব সুর ওঁর’, রয় উত্তর দিল। ‘আর তুমি কি হাইফেটজ এর অসাধারণ কাজগুলো শুনেছ?’ মিস রিসের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই রয় দেখল ওঁর মুখ হঠাৎ আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল। উনি কী দেখে এত ভয় পেলেন সেটা দেখার জন্য মাথা ঘোরানোর আগেই এক ভারী পাথরের মতন ঘুষি এসে পড়ল ওর চিবুকের কাছে। ঘুষি খেয়ে পড়ে গেল রয়। মাথাটা ঠুকে গেল ওষুধের দোকানের ধাতু মোড়া কাঁচের জানলার ধারে। মাথার ভিতর যেন বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। মিস রিস চিৎকার করে উঠলেন। রাস্তার সব সাদা লোফার ছেলেগুলো তাদের লাল ঘাড় নিয়ে হাত গুটিয়ে হাত মুঠো করে আরও ঘুষি মারার জন্য তৈরী। যাওয়া আসার পথে এভাবে এক নিগ্রো যুবক এক সাদা মহিলার সঙ্গে কথা বলছে! কী সাংঘাতিক অনাচার! সদ্য শেষ হওয়া সিনেমার দর্শকরা, যারা তখন ওখান দিয়ে যাচ্ছিল, তারাও প্রতিবাদ জানাল। নিগ্রো ছেলেটি ওই সাদা মহিলাকে অপমান করেছে! তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে! ধর্ষণ করেছে! ওরা দেখেছে রয় হাতের দস্তানা খুলে অভিবাদন জানিয়েছে। তারপ রয় ঘুষি খাওয়ার পর যেই না মিস রিস চিৎকার করে উঠলেন অমনি সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল যে ছেলেটা নির্ঘাত ওঁর উপর উৎপাত করছিল। ভিড়ের বাইরে কেউ কিছু জানার আগেই রয় যে বড় রাস্তার উপর এক উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত ওষুধের দোকানের সামনে ওঁকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে সে বিষয়ে সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল। হ্যাঁ, ও নিশ্চয়ই ধর্ষণ করেছে। 

এর শাস্তি হবে না? হতেই হবে। সুতরাং সবাই মিলে ধাক্কা মেরে রয়কে মাটিতে ফেলে দিল। একবার ফেলেই শান্তি নেই। যাতে আবার মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া যায় সেজন্য কেউ কেউ মাটিতে পড়ে যাওয়া টুপি, লাঠি আর দস্তানা মাড়িয়ে ওকে আবার তুলে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। কে ওকে মেরে মাটিতে শুইয়ে ফেলবে তা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।

রাস্তার ধারে মাটিতে পড়ে গিয়ে রয় ওর চারপাশে ভিড় করে থাকা সাদা চামড়ার লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল। রক্তে মুখ ভরে গিয়েছে আর চোখ জ্বালা করছে। জামাকাপড় নোংরা হয়ে গিয়েছে। ওর শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে যে মিস রিস কেন যে ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। ও এটাও বুঝতে পারল যে ওর মায়ের কাছে আর কোনোদিনই ফেরা হবে না।

কেউ একজন ওর পায়ে লাথি দিল। একজন ওর মুখে থুথু ছিটালো। মনে হচ্ছে সে ওর ছোটবেলার খেলার সঙ্গী। নিগ্রো হওয়ার জন্য একজন ওকে গালি দিল। আরেকজন পিছন থেকে কষিয়ে লাথি দিল। তারপর রাস্তার ছেলে বয়স্ক সবাই মিলে পাগলের মতন চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল। চেঁচামেচি শুনে মনে হবে যেন হিংস্র কুকুরের দল গর্জন করছে। ভিড়টা ছোটলোক নিগ্রোটার জুতোর বেল্ট ধরে ওকে টেনে রাস্তা থেকে বনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। আর হ্যাঁ, এসব ঘটনাই ঘটে গেল ওই আলো ঝলমলে রাস্তায়।

সেই ছোটলোক নিগ্রো যার নাম রয় উইলিয়ামস তার নিজের মুখে জমে যাওয়া নিজের রক্তেই দম আটকে যেতে শুরু করল। ওদের গলার গর্জন আর পায়ের হুটোপুটি চাঁদের আলোয় চারিদিকে ছিটকে পড়তে লাগল। ঠিক যেন বিঠোফেনের সুরের মূর্চ্ছনা। শেষ পর্যন্ত সাদা ভিড়টা ওর নগ্ন বাদামি শরীরটাকে শহরের প্রান্তে একটা গাছ থেকে ঝুলিয়ে দিল। দেখে মনে হচ্ছে ঠিক যেন একটা বেহালা ঝুলছে। সেই বেহালা এখন শুধু হাওয়াতেই বাজবে। সারারাত ধরে। 

ল্যাংস্টন হিউজ: কালো আমেরিকান সাহিত্যিক, নাট্যকার, কবি, বিশিষ্ট সমাজকর্মী ইত্যাদি নানান পরিচয়ের ল্যাংস্টন হিউজ আমেরিকান সাহিত্যের ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা নাম। ১৯২০-র সময়ের আমেরিকার জনজীবনে কালো বা নিগ্রোদের অবস্থান নিয়ে নিউ ইয়র্কের হারলেম শহরকে কেন্দ্র করে যে ‘নিউ নিগ্রো মুভমেন্ট’ গড়ে উঠেছিল তিনি তার এক নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিত্ব ছিলেন। শুধু আমেরিকান নয়, বিদেশের বিভিন্ন কালো লেখকদেরও অনুপ্রাণিত করেছিলেন তিনি। ‘নিউ নিগ্রো মুভমেন্ট’ যা ‘হারলেম রেনেসাঁ’ নামে বিখ্যাত তাতে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য ছিল আফ্রো আমেরিকান শিল্প সাহিত্যকে তুলে ধরা, বৌদ্ধিকতার জগতে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিষ্ঠা করা। আমেরিকায় নিগ্রোদের জীবনের নানান দিক, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা কালোদের জীবনযাপন, লড়াই ও বঞ্চনার বিভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে তাঁদের সৃষ্টিতে। কালোদের বিরুদ্ধে ঘটে চলা বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশের ফলে সরকারী রোষানলে পড়তে হয় ল্যাংস্টন হিউজকে। তাঁর বিরুদ্ধে কম্যুনিস্ট হওয়ার অভিযোগ ওঠে বহুবার। ১৯৫৩ সালে তাঁকে সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থক ও আমেরিকান বিরোধী হওয়ার অভিযোগে সেনেটর ম্যাককার্থির কমিশনের সামনে জবাবদিহি করতে ডাকা হয়। ল্যাংস্টন হিউজের লেখা হোম গল্পটা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে। গল্পটা যদিও প্রায় একশো বছর আগের লেখা, তবুও আজ আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তা যেন নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এক কালো তরুণ আমেরিকানের সুরের যাত্রা। শুরুতে পৃথিবী জুড়ে সম্পদের অসমবণ্টন, খিদে, আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য, দারিদ্র, এসব ছুঁয়ে যাওয়া গল্পটি শেষ হয় মব লিঞ্চিং-এ।

সুস্মিতা সরকার: গল্পের বই পড়া, গল্প লেখা আর আড্ডা প্রিয়।

 

সঙ্গের ছবি – ইন্টারনেট থেকে

1 thought on “ঘরে ফেরার গান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.